0
undefined undefined undefined

সম্পাদকীয়

Posted in

সম্পাদকীয়



'শব্দকে লুকিয়ে রেখে শব্দেরই তাজ্জব এই খেলা
গোধূলিবেলায়
যে লোকটা দেখিয়ে স্মিত হেসে 
পর্দার আড়ালে চলে যায়, 
তাকে গুরু মানি। 

কিন্তু একইসঙ্গে এও জানি,
এ-খেলা জীবনে কেউ তিনবার দেখে না। 
একবার সে দেখে তার শৈশবদিবসে
আরবার গোধূলিবেলায়
যখন সে আকাশে তার ক্লান্ত চোখ রাখে। 

সম্ভবত মহাকাশ তারই জন্য আঁকে
অনন্ত ইঙ্গিত ভরা নিশীথির স্থির চিত্রখানি।' [নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী] 


শব্দের আড়ালে শব্দের অনন্ত বিস্তারকে ছুঁতে চায় ঋতবাক। বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্নভাবে। শব্দের নানান খাঁজ থেকে নিঃসৃত নানা রঙের বোধের আলকধারায় আশিরনখ ভিজিয়ে পবিত্র হতে চায়। ঋতবাক জানে, সাহিত্যের প্রথম পাঠ আমরা নিই শৈশবে। সোনার ঘটের মুখ সরিয়ে শব্দ দিয়ে ঢাকা সত্য অল্প হাসেন আমাদের পানে চেয়ে। তারপর, যা দেখেছি, তাকে আখর বাঁধনে বাঁধার চেষ্টা আমরা করে চলি জীবনভোর। ছোটদের জন্য লেখা সাহিত্য বাণীদেউলের সিঁড়ির প্রথম ধাপ। কিন্তু, এই লেখা ছাপান বড়রা, লেখেন বড়রা, কিনে দেন বড়রা। আর গোলটা বাধে এখানেই। বড়রা ধরে নেন ছোটদের তাই ভালো লাগে যা বাজারি আর মচমচে। একবার আশপাশে চেয়ে দেখুন। বাঁধা গতে ফেলা, চটজলদি ভালোলাগার উপকরণে তৈরি, একই জাতীয় লেখা হয়ে চলেছে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে। অবিকল জাঙ্ক ফুডের মতো। অথচ, ভাত, কয়েক টুকরো মাংস, ভাজা পেঁয়াজ মিশিয়ে, নাড়াচাড়া করে, ক্যাওড়া জল ছড়িয়ে, খেতে দিলেই, আজও সোনামুখ করে খেয়ে নেয় ছেলেমেয়েরা। মানে, শুধু ইচ্ছে আর সৃষ্টিশীলতা চাই। পৌনপৌনিকতা নয়। এই কারণেই ঋতবাক, চতুর্থ বর্ষ, প্রথম সংখ্যায় আরম্ভ হয়েছিল শিশু-কিশোর বিভাগ। আর, দ্বিতীয় সংখ্যা, যা আমাদের পুজো সংখ্যাও, সম্পূর্ণভাবে শিশু-কিশোর সংখ্যা হিসেবে গড়ে তোলা হলো। ঋতবাকের প্রথম শিশু-কিশোর সংখ্যা। এ দায়টা নিতেই হলো। ভৌতিক কাহিনী, রূপকথা, কল্পবিজ্ঞান, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, কুইজ, মুক্তগদ্য, বইপত্তরের খবর সবই রইল। আর তার সঙ্গে রইল সিনসিয়ারিটি। ছোটদের জন্য না লিখলে কলম শুদ্ধ হয় না : এই বিশ্বাস।

এই সংখ্যায় ধারাবাহিকগুলো বেরোবে না। আবার পরের সংখ্যা থেকে বেরোবে। এছাড়া, এই সংখ্যা সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন, অতিথি সম্পাদক সুস্মিতা কুণ্ডু। ভাবছি, এখন থেকে মাঝে মাঝেই বিশেষ সংখ্যা বার করে, নবীন প্রতিভাদের হাতে তার ভার ছেড়ে দেব। বাক্ এর কাছে, ঋতের কাছে দায়বদ্ধতা থেকেই এই কাজ করতে হবে। 

শুভকামনা নিরন্তর।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

অতিথি সম্পাদকের কলমে - সুস্মিতা কুণ্ডু

Posted in





প্রচ্ছদ - সুকান্ত


অতিথি সম্পাদকের কলমে 


সুস্মিতা কুণ্ডু


শুনতে পাচ্ছেন শিউলি ঝরার টুপটাপ শব্দ? আলতো হাওয়ায় কোমর দোলানো কাশের প্রাণের আনন্দ কি ছুঁয়ে যাচ্ছে আপনার মনটাকেও? পেঁজা তুলোর দিকশূন্যপুরের পথে যাত্রা কি উতলা করছে আপনাকেও? 
কী বললেন? হ্যাঁ?
ব্যস! নিশ্চিন্তি! তার মানে পুজো এসে গেছে। 
মেতে উঠুন উৎসবে, সকলের সাথে, সকলকে পাশে নিয়ে। 
আপনার খুশির ছোঁয়া ছড়িয়ে দিন সেই শিশুটির ঠোঁটেও যার পুজোয় নতুন জামা হয়না। আপনার আনন্দ রাঙিয়ে তুলুক সেই মানুষটার মনটিকেও যে আপনার দেবীর আরাধনা করেননি কোনওদিন। 


দুর্গাপুজো, নিছক জামাকাপড়, ফুচকা এগরোলের উৎসব না হয়ে বরং হয়ে উঠুক বিনিময়ের উৎসব। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সংস্কৃতি, আদানপ্রদানের উৎসব। 


ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।


0 comments:

3
undefined undefined undefined

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সুস্মিতা কুণ্ডু

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


পড়াশোনা করে যে...
সুস্মিতা কুণ্ডু



"...গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। তাই তো? জানি জানি। 
কিন্তু কেন? যদি না পড়ি? যদি সারাদিন খেলে বেড়াই? যদি ঘুড়ি ওড়াই? যদি টি. ভি. তে ছোটা ভীম, টম অ্যান্ড জেরি দেখি? আচ্ছা যদি গল্পের বই পড়ি? সেটাও তো পড়া, তাই না?"

আচ্ছা, যদি একটা ছোট্ট অবোধ শিশু এই প্রশ্নগুলো করে, কী উত্তর দেব আমরা, কখনও ভেবে দেখেছেন? 

হয়ত আমরা বলব যে,
-"ভালো করে পড়াশোনা করলে তবেই তো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, প্রফেসর, এ'সব হ'তে পারবে বড় হয়ে। বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে, নাম, যশ, অর্থ, সব পাবে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হ'বে।"

অবশ্যই, একদম খাঁটি কথা। এভাবেই তো পথ দেখাব কচিকাঁচাগুলোকে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনে দেব ওদের মনে। 
কিন্তু তার আগে একটু সাবধান, একটু সতর্ক হওয়ারও প্রয়োজন আছে। 
-----

কেন বলছি এ'কথা? 

কারণ, সময়টা বড় কঠিন। এ এমন এক সময় যখন শৈশব বন্দী ঘরের চার দেওয়ালের ভেতরে। শিশু ছড়া শেখে, দাদু দিদার মুখে নয় ইউটিউব থেকে। গেম খেলে এক্স-বক্সে, খোলা নীল আকাশের নিচে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে নয়। ঠাকুমার ঝুলি পড়ার বদলে তারা ব্যস্ত কম্পিউটার সার্ফ করতে। এই কম্পিউটার গেমিং-এর নেশা এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধছে, আকর্ষণ করছে কিশোর মনগুলোকে, যে কখনো কখনো তা প্রাণঘাতীও হয়ে উঠছে। 

তাই বলছি, সন্তানের মা-বাবাদের এবার নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। আসুন, আমরা গোড়া থেকেই একটু আলোচনা করে দেখি।
------

আধো আধো বুলি ফোটার পর থেকেই একটি শিশুকে ঘন্টার পর ঘন্টা মা বাবার সঙ্গ-ছাড়া হয়ে, যেতে হচ্ছে স্কুলে। ব্যাপারটা মোটেও সহজ নয় একটা শিশুর কাছে । কিন্তু বর্তমান যুগে এটা অবশ্যম্ভাবী। যেখানে নামী স্কুলে ভর্তি করতে গেলে ছ'মাস আগে থেকে ফর্ম তুলতে হয়, মোটা অঙ্কের টাকা জমা করতে হয়, লটারির মাধ্যমে ভাগ্য নির্ধারণ করতে হয়, মা-বাবা-সন্তান, গোটা পরিবারকে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে পরীক্ষায় বসতে হয়, সেখানে কোনও মা-বাবাকে এই পরামর্শ দিতে পারি না, যে সন্তানকে আরও একটু দেরিতে স্কুলে ভর্তি করুন। এটা হয়ত আজকের দিনে 'নেসেসারি ইভিল।'

কিন্তু নামী-দামী স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য যেভাবে শিশুটির ওপর মানসিক টর্চার শুরু করে দিই আমরা, ততটা 'ইভিল' হওয়া কি 'নেসেসারি'? অনর্থক তাকে জটিল-কঠিন সব প্রশ্নোত্তর মকশো করাই। সান ইজ 'গোল্ডেন ইয়েলো'-র বদলে যদি শুধু 'ইয়েলো' বলে ফেলে তাহলে দু/তিন বছরের শিশুটির সাথে জেলের কয়েদীর মত ব্যবহার করি। এতটা কঠোর হওয়ার কি প্রয়োজন আছে? একটু কম নামী স্কুলেই না হয় ভর্তি হ'ল। মনে করে দেখুন তো, আমাদের সবার ছোটোবেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কি হার্ভার্ডের মিনি সংস্করন ছিল? আপনারা "রামধনু" সিনেমাটি দেখেছেন? না দেখে থাকলে অনুরোধ করব দেখতে। না সিনেমার মতো বাস্তবে সব কিছু ঘটে না বা সেরকমটা অনুসরণ করাও সম্ভব নয়। তবু কিছুটা হ'লেও চোখের সামনে নিজেদের প্রতিচ্ছবিটা ভেসে ওঠে। 
--------

বড় জায়গায় ভর্তি হলেই, পাঁচনের মতো সব বিদ্যে তাকে তো কেউ গুলে খাইয়ে দেবে না, তাইনা? বরং কিছুটা দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। গৃহশিক্ষক বা স্কুলের ভরসায় সব ছেড়ে না দিয়ে নিজেও একটা খুঁট ধরে রাখুন। অনেকে হয়ত বলবেন, অনেক মা বাবার নিজেদের পড়ানোর যোগ্যতা বা সময় নেই বলেই তো সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব অন্যের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হ'ন। সেই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ল বলি। আমার দিদিমার মাত্র বারো বছর বয়সে ক্লাস ফাইভ/সিক্সে পড়াকালীন আমার দাদুর সাথে বিয়ে হয়। তারপর আর পড়াশোনার সুযোগ হয়নি। মা, মাসিদের মুখে শুনি, সেই দিদিমাই কিন্তু অনেক উঁচু ক্লাস অব্দি মায়েদের নিজেই পড়াত, কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না মায়েদের। দিদা নিজে পড়ে পড়ে শিখে শিখে মায়েদের পড়াত। ঠাকুমা আদ্যান্ত গ্রামের মানুষ, তাঁর স্টোরিটাও একরকমই। সে আমলের মানুষেরা যদি পারেন, আমরা পারিনা একটু চেষ্টা করতে?

এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অধিকাংশ মানুষেরই এখন সময়ের বড্ড অভাব। আচ্ছা, একটু চেষ্টা করলে, সারাদিনের শেষে বা সপ্তাহান্তে কিছুটা সময় বার করা যায় না নিজের সন্তানের জন্য? কড়ায় সব মশলা আনাজ তেল জল চাপিয়ে আগুনে বসিয়ে দিলেই কি সুস্বাদু ব্যঞ্জন তৈরী হয়ে যায়, বলুন তো? তাকেও সময়ে সময়ে নাড়তে চাড়তে হয়। তেমনি বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেই বা একগণ্ডা গৃহশিক্ষক নিয়োগ করে দিলেই আমাদের সব দায়িত্ব তো শেষ হয়ে যায় না। 
ধরুন সারাদিনের কাজের শেষে বাড়ি ফিরেছেন, একটু টি. ভি. তে খবর শুনবেন, একটু সিরিয়াল দেখবেন, গান শুনবেন, রান্না বসাবেন। পাশের ঘরে তাকে পড়তে পাঠিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবেন না, বা তাকে হাতের স্মার্টফোনটা ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাজে মেতে যাবেন না। এই সবের ফাঁকেই যদি বাচ্চাকেও দলে টেনে নেওয়া যায়, কেমন হয়? বিজ্ঞাপনের বিরতিতে ওকে দু'টো করে অঙ্ক কষতে দিন, একটু পড়া ধরুন, খুব ছোট্ট বাচ্চা হ'লে আম, কাঁঠাল, মাছ, ফুল, পাখি, স্কেচ করে দিয়ে তাতে ক্রেয়ন ঘষতে বলুন। ল্যাপটপে বসে অফিসের কাজ করার সময়, ওকেও পাশে বসিয়ে হিজিবিজি যা মন চায় লিখতে উৎসাহ দিলে, বাচ্চাটির মধ্যেও একটা সু-অভ্যাস গড়ে উঠবে।

রাত্রে ঘুমোনোর আগে একটা ছোট্ট রিচ্যুয়াল তৈরী করা যায়। আপনার সারাদিনের খবর সহজ ভাষায় ওকে দিন আর ওর স্কুলের গল্পগুলোও মন দিয়ে জেনে নিন এই সুযোগে। ওর কোন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ, কী ধরনের এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে ও সবচেয় বেশি আনন্দ পায়, খোঁজ নিন। নাচ, গান, আঁকা যেটা ভালোবাসে সেটা ওকে শেখানোর চেষ্টা করুন। 
ব্যক্তিগতভাবে বলব, শুরুতেই বড় বড় প্রতিষ্ঠানে বাচ্চাকে ভর্তি করে দিয়ে যদি প্রত্যাশা করতে থাকি যে সে খুব বড় আর্টিষ্ট হয়ে উঠবে, বা টি. ভি.-তে রিয়েলিটি শো-তে চান্স পেয়ে সবার সামনে আমাদের গর্বিত করবে, সেটা ভারী অবিচার করা হবে শিশুগুলোর ওপর। বাবা মা নিজেরা যেগুলো পারেন, সেগুলো অল্প অল্প করে নিজেরাই বাড়িতে তালিম দেওয়া বরং অনেক বেশি ভালো। 
নাহলে কখন যে ধীরে ধীরে ওর ভালো-লাগার, শখের জিনিসটা ওর কাছে বোঝা হয়ে উঠবে, সেটা আমরা টেরও পা'বনা। 
--------

এ তো গেল একদম ছোট্টবেলার কথা। এরপর ধীরে ধীরে যত বড় হবে তত সমস্ত কিছু কঠিন হ'তে থাকবে, শিশু এবং অভিভাবক দু'পক্ষের জন্যই। স্কুলব্যাগের ওজন ক্রমবর্ধমান হবে, বইগুলো দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বাড়তে থাকবে, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়বে, সেই সাথে পাশ-ফেল-ফার্স্ট-সেকেণ্ড এসবের হিসেব শুরু হবে। সমস্যার তালিকাটাও তাল মিলিয়ে লম্বা হতে থাকবে। 

একদিনের ঘটনা বলি, বাসে করে ফিরছি, পাশের সিটে একজন মা তাঁর বছর বারো তেরোর ছেলেকে নিয়ে ফিরছেন। বোঝাই যাচ্ছে স্কুলের পরীক্ষা চলছে, হাতে প্রশ্নপত্র ধরা মায়ের। কামান দাগার মত প্রশ্ন করে চলেছেন ছেলেকে, উত্তর মেলাচ্ছেন, ভুল বেরোলেই বাসভর্তি লোকের সামনে যাচ্ছেতাই করে বকে চলেছেন। বকুনির সারমর্ম এটাই যে, 
"এত খরচ করে ভালো স্কুলে ভর্তি করানো হ'ল, এত প্রাইভেট টিউশন দেওয়া হ'ল। নিজেদের টি. ভি দেখা, সিনেমা দেখা সব জলাঞ্জলি দিয়ে ওর পেছনে সময় দেওয়া হ'ল, আর তার প্রতিদান, এই !!"

বাজি রেখে বলতে পারি, এই দৃশ্যর সাথে একাধিকবার আমাদের সকলেরই কমবেশি পরিচয় হয়েছে। কখনও সামনে ঘটতে দেখেছি, কখনও বা নিজেরা ভিকটিম হয়েছি, কখনও বা আমরাই ওই মা-এর চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছি। আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ ঘটনা দেখতে লাগলেও, এই পুরো ব্যাপারটাই অত্যন্ত আপত্তিজনক, বিভিন্ন কারণে। 
প্রথমতঃ, একটি শিশু, যার মনে ধীরে ধীরে আত্ম-সচেতনতা গড়ে উঠছে, মান-সম্মান বোধ জাগছে, তাকে এভাবে চেনা-অচেনা লোকের সামনে অপমান করলে, তার মনোবল তলানিতে ঠেকবে। হয় সে প্রচণ্ড গুটিয়ে নেবে নিজেকে নতুবা অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠবে। দুটোই ওর ভবিষ্যতের উন্নতির পথে বড় অন্তরায়।

দ্বিতীয়তঃ, এভাবে পরীক্ষার মাঝপথে, যে বিষয়টা হয়ে গেল, তার ভুলভ্রান্তিটা নিয়ে আলোচনা করতে বসলে, পরের দিনের পরীক্ষাটায় তার প্রভাব মোটেই সন্তোষজনক হবে না। বলছি না যে সন্তানের পরীক্ষা কেমন হ'ল তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়াটা কোনও অপরাধ। কিন্তু ক'টা দিন অপেক্ষা করে, একদম পরীক্ষার শেষে প্রশ্নপত্র নিয়ে আলোচনায় বসাটাই মনে হয় শ্রেয়। 

তৃতীয় এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি, সেটি হ'ল, পুরো ঘটনাটায় অভিভাবকের মানসিকতার প্রতিফলনটি। সন্তানকে পৃথিবীতে তো আমরাই আনি। সে বেচারা ছোট্ট মানুষটি তো আর নিজে থেকে আসেনি। কাজেই তার জন্য যতটা আমরা, মা বাবারা করছি বা করব, সেটার পেছনে কেন জটিল অঙ্কের, দেনা পাওনার হিসেব কষব বলুন তো! গয়না বেচে তাকে পড়ালাম বা চাকরি ছেড়ে তার পেছনে সময় দিলাম, সেটার প্রতিদান আশা করার নামে তার ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়াটা অপরাধ।
-------

এইরকম এক বিভীষিকার মধ্যে দিয়ে পরীক্ষা তো উতরোয়, তারপর আসে ফল প্রকাশের দিনটি। নাহ্! সন্তুষ্ট আজকাল আমরা মনে হয ১০০ তে ১০০ পেলেও হ'ইনা। আরেকটা ছোটো ঘটনা বলি। প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, কোনো পরীক্ষাতেই প্রথম আর হ'ইনা। বাবা-মা দুঃখ করে প্রকাশ করে তাতে খানিকটা। তাঁদের খুব সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, "আমি ফার্স্ট হলে, অমুক কী হবে? তমুক কী হবে? ওরা কষ্ট পাবেনা বলো?"

সত্যিই তো, প্রথম তো একজনই হয়। বাকি সবাই কি তাহলে প্রথম না হতে পারার জন্য তিরস্কৃত হবে? অনেক সময়ই প্রথম না হতে পারা শিশুটিকে, আমরা অভিভাবকরা অন্য কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সাথে তুলনা করতে থাকি। আত্মীয় স্বজনের মেধাবী পুত্র কন্যার উদাহরণ দিয়ে দিয়ে তার সেল্ফ-এস্টিমের দেওয়ালে বোমা-বর্ষণ করি। কত অবিশ্বাসের ছিদ্র যে সেই কনফিডেন্স-এর পাঁচিলে হয়, কত ভরসার ইঁট যে খসে পড়ে, আমরা বুঝিনা। ভয়ংকর ক্ষতি হয়ে যায় আমাদের সকলের অগোচরে। প্রসঙ্গত আরেকটি সিনেমার কথা বলব, "ইচ্ছে"। 
যদি না দেখা থাকে, একবার দেখতে পারেন। 

-----

এই সব পরীক্ষার গণ্ডি টপকে অবশেষে আসে 'বড় পরীক্ষা'। দশম শ্রেণীর, বোর্ড-এর পরীক্ষা। জীবনের প্রথম স্কুলের বাইরের বড় পরীক্ষা। এই পরীক্ষার ফলাফলই নাকি স্থির করে দেবে একজন কিশোর বা কিশোরীর জীবন কোন খাতে বইবে এবার। অসম্ভব একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ছেলেমেয়েগুলোর ওপর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পরীক্ষার সার্টিফিকেট-টি বয়সের প্রমাণপত্র হয়ে থেকে যায়। কারণ, বহু ভাল ফল করা ছাত্র-ছাত্রী, আবার দু'বছর পরের বোর্ড পরীক্ষাতেই আশানুরূপ ফল করতে পারে না। আবার অনেকেই এই পরীক্ষায় ভাল ফল না করলেও পরের পরীক্ষায় চমকপ্রদ রেজাল্ট করে। তবে কি জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষার কোনও গুরুত্ব নেই? অবশ্যই আছে, তথাকথিত সাফল্য এবং ব্যর্থতা দুটোরই নিরিখে। 'সাফল্য' আগামী পথটা কিছুটা সুগম করে দেয়। আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, পছন্দের বিষয় নির্বাচন, পছন্দের স্কুল কলেজে ভর্তি, এগুলো সহজসাধ্য হয়। তেমনই আবার 'ব্যর্থতা' কোথাও যেন একটা ঈঙ্গিত দেয় যে, ভবিষ্যতের পথটা মসৃণ নয়। অতএব এখন থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে, কোমর বেঁধে লাগতে হবে। 

কোন বিষয় নিয়ে সন্তান পড়াশোনা করবে সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা অভিভাবকরা নির্ধারণ করার চেষ্টা করি। তার প্রাপ্ত নম্বরের ওপর ভিত্তি করে, ভবিষ্যতে চাকরির সহজলভ্যতা, নিরাপত্তা, সুযোগ-সুবিধে, নাম-যশ, ইত্যাদি গুণাগুণ বিচার করে আমরা তাকে ঠেলে দিই আমাদের পছন্দের অভিমুখে। কিন্তু আমাদের কাছে যেটা উত্তরণের সিঁড়ি সেটা তার কাছে খাদের কিনারাও হতে পারে। এভাবে পাপেটের মত সন্তানকে পরিচালনা না করে তাকে একটু ফ্রিডম দেওয়াটা বেশি জরুরী। পছন্দের বিষয় ও নিজেই বাছুক না। কোনো বিষয়ে বেশি নম্বরটাই মাপকাঠি নয়। ভালোলাগার বিষয় নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগোলে অনেক ভালো ফল করবে নিশ্চয়ই। 

তবে হ্যাঁ, যেহেতু ওদের বাইরের জগত সম্পর্কে ধারনাটা স্বচ্ছ নয়, চিন্তাভাবনাও খুব বেশি পরিণত নয়, তাই সবসময় ওদের পাশে পাশে থাকতে হবে। ওদের গাইড করতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে প্রফেশনাল কেরিয়ার কাউন্সেলিং সেন্টারগুলোর সাহায্য নিতে হবে। নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী সন্তানকে এগোতে দেওয়াটা বাস্তবসম্মত। তাছাড়া আজকাল 'এডুকেশনাল লোন' বস্তুটি আর ভিন-গ্রহের ব্যাপার নয়, পদ্ধতিটাও রকেট সায়েন্সের মত কঠিন নয়। 

-----

এর পর আসি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে। শুরুতেই বলছিলাম, সত্যিই কি পড়াশোনা করলে তবেই একমাত্র গাড়ি চাপা যায়, অর্থাৎ কিনা 'সফল' হওয়া যায় জীবনে? এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে মান্ধাতার আমলের এই ধ্যান-ধারনা আর প্রযোজ্য নয় মোটেই। আমাদের চারপাশে তাকালেই ক'ত কৃতী মানুষের উদাহরণ রয়েছে, যাঁরা লেখাপড়া ছাড়াও অন্য প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে অনেক উঁচুতে উঠেছেন, সাফল্যমণ্ডিত হয়েছেন। 

তাই, স্কুলের গণ্ডী টপকানোর পর প্রথাগত শিক্ষার পথে না গিয়ে কেউ যদি অন্যপথে যায় তাতে, 'গেল গেল রব' তোলার কিছু নেই। কারোর অনুকরণ করে বা অনুসরণ করে খুব বেশি দূর যাওয়া যায়না। নিজের পথ নিজে গড়ে নিতে পারে যে জন, তাকে আটকায় কার সাধ্য। মন প্রাণ ঢেলে যে জিনিসের সাধনা করা হয়, তাতে দেরিতে হলেও সাফল্য আসবেই। এইটুকুন ভরসা তো আমরা আমাদের সন্তানদের ওপর রাখতে পারি, তাই না? 

শুধু কেরিয়ার এর দিক দিয়েই নয়, মানুষ হিসেবেও ওরা যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, সেই শিক্ষাটা দেওয়া সবচেয়ে বেশি জরুরী।
------

সন্তান জন্মানোর সাথে সাথে মা-বাবারও জন্ম হয়। ওরা যেমন হাঁটতে কথা বলতে শেখে, আমরাও শিখি ওদের সঠিক পথটা দেখিয়ে দিতে, ভালো মন্দের তফাৎ বোঝাতে। আসলে কী বলুন তো, এটা একটা দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার ব্যালেন্সের খেলার মতো। অতিরিক্ত শাসন, বাড়াবাড়ি রকমের কন্ট্রোল, এগুলো যেমন করাটা উচিত নয়, তেমনি অবাধ স্বাধীনতা, ফুল ডিসিশন মেকিং পাওয়ার, এটাও ওদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। কোনও একদিকের ভার বেশি হলেই দড়ি থেকে পতন অনিবার্য। 

পরিশেষে আরেকটা কথা বলি। সন্তান মানুষ হোক, স্বাবলম্বী হোক, তার সাথে সাথে আমাদেরও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠাটা জরুরী। ওদের মানুষ করেছি বলেই বাকি জীবনটা মা-বাবা ওদের লায়াবিলিটি যেন না হয়। সন্তানের কাছে থাকা আর বৃদ্ধাশ্রমে থাকা, এই দুই এর মাঝে আরেকটা অবস্থান আছে। নিজের কাছে, নিজের মতো করে, ভালো থাকা। ওরা একটু একটু করে লক্ষ্যের দিকে এগোনোর সাথে সাথে, আমাদের, মা-বাবাদেরকেও একটু একটু করে খাঁচার দরজাটা খুলে দিতে হবে। ডানা মেলুক না ওরা মুক্ত আকাশে। আর আসুন না আমরাও শক্ত মাটিতে পা রেখে ওদের সেই উড়ান দেখি। আনন্দাশ্রুটা মুছে দু'চোখ ভরে দেখি, পরিযায়ী পাখীর আসা-যাওয়া।

3 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - সৌভিক চক্রবর্তী

Posted in


প্রবন্ধ


ফ্যান্টাসি, নারনিয়া ও বাইবেল
সৌভিক চক্রবর্তী



“ফ্যান্টাসি আর স্বপ্ন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে, সেই প্রথম দিন থেকেই। ঘুমোতে না চাওয়া ছোট্ট বাচ্চাকে তাই স্বাভাবিক অভ্যেসেই তার মা সুরেলা গলায় গল্প শোনান – আকাশের, চাঁদের, দূরদেশের পক্ষীরাজের। দুচোখের পাতা এক করামাত্র সে পৌঁছে যায় স্বপ্নের দুনিয়ায়, অবচেতন জগতটার সঙ্গে অনায়াসে মেতে ওঠে হাসি-খেলায়।”

হ্যাঁ, এখানেই ফ্যান্টাসির সার্থকতা, তার অপরিসীম জনপ্রিয়তা। একের পর এক উদাহরণে দেখানো যায়, কীভাবে ফ্যান্টাসি ভেঙেছে দুর্ভেদ্য দেয়াল, রুক্ষ, কঠোর বাস্তবের হাত থেকে ক্ষণিকের স্বস্তি উপহার দিয়েছে পাঠককে, জুড়েছে হৃদয়, দিয়েছে আশ্রয়। আর এই কারণেই বোধহয় ইউরোপ এবং আমেরিকায় বিশেষ সমাদর পেয়েছে হাই ফ্যান্টাসি, সোর্ড অ্যান্ড সর্সারী, কনটেম্পোরারি ফ্যান্টাসি, মিথিক্যাল ফ্যান্টাসি, ডার্ক ফ্যান্টাসি এবং ম্যাজিক রিয়েলিজমের মতো উপধারা। একটু পেছনে ফিরলে দেখব, সুমেরীয় ‘এপিক অফ গিলগামেশ’ দিয়ে ফ্যান্টাসি সাহিত্যের যাত্রা শুরু। তারপর চলার পথে মাইলফলকের মতো এসেছে গ্রীক মহাকবি হোমারের ‘ওডিসি’, ভার্জিলের রোমান মহাকাব্য ‘এনিড’, মধ্য-প্রাচ্যের ‘আ থাউজ্যান্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস’, ওল্ড ইংলিশে লেখা ‘বেউলফ’।উনিশ শতকের শেষ আর বিশ শতকের শুরুর দিকে যখন উইলিয়াম মরিস, অস্কার ওয়াইল্ড, জে. এম. ব্যারী, রুডইয়ার্ড কিপ্লিং, লর্ড ডানসানিরা ইংরেজি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ততদিনে ফ্যান্টাসির খোলনলচেই পালটে গেছে। বিংশ শতাব্দী নিঃসন্দেহে স্পেকুলেটিভ ফিকশনের নবজাগরণের যুগ; টলকিন, লুইস, রোলিংদের বেস্টসেলারগুলো ছাড়াও এই শতকে আমরা পেয়েছি টেরি ব্রুকসের ‘দ্য সোর্ড অফ শানারা’, রবার্ট সিলভারবার্গের ‘মাজিপুর ক্রনিকলস’, ফিলিপ পুলম্যানের ‘হিজ ডার্ক মেটিরিয়ালস’, টেরি প্র্যাচেটের ‘ডিস্কওয়ার্ল্ড’, স্টিফেন কিংয়ের ‘ডার্ক টাওয়ার’, রবার্ট জর্ডনের ‘দ্য হুইল অফ টাইম’এর মতো দুর্ধর্ষ সব ফ্যান্টাসি সিরিজ। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ যুগে লেখা অ্যাঞ্জি সেজের ‘সেপটিমাস হিপ’, রিক রায়ার্ডনের ‘পার্সি জ্যাকসন’, ক্যাসানড্রা ক্লেয়ারের ‘সিটি অফ বোনস’ সিরিজগুলোর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা আমাদের অবাক করে। 

ডঃ সিউস বলছেন, “Fantasy is a necessary ingredient in living, It's a way of looking at life through the wrong end of a telescope. Which is what I do, and that enables you to laugh at life's realities.”ফ্যান্টাসির এরচেয়ে উপযুক্ত বিশ্লেষণ মনে হয়না আর কিছু হতে পারে বলে। ম্যাজিক, কাল্পনিক জগৎ, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব, অলৌকিক জীবজন্তু জাতীয় নানা মোটিফ আমাদের পাঠকসত্তার কাছে ‘সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ’ দাবী করে, বাস্তবের সীমারেখার বাইরের বিষয়গুলোকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শেখায়। কখনও লেখক তাঁর চারপাশের জটিল সামাজিক সমস্যাগুলোকে ফ্যান্টাসির রূপকে মুড়ে তুলে ধরেন পাঠকের সামনে, আবার কখনও বা মানুষের মূল্যবোধ ও জীবনদর্শনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তারতম্যগুলো তাঁর সুদক্ষ লেখনীতে খুঁজে পায় ভাষা।টলকিন সাহেবের ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’এ সমস্ত রকম বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে খুদে হবিট ফ্রোডো ব্যাগিন্সের অসীমসাহসী অভিযান, হ্যারি পটারে বর্ণিত অত্যাচারী, ক্ষমতালোভী শক্তির বিরুদ্ধে এক অনাথ কিশোরের মরণপণ সংগ্রাম – এ সবই মন কেড়ে নেয় আমাদের। আর মন কাড়ে সি এস লিউইসের ‘ক্রনিকলস অফ নার্নিয়া’। এক অপূর্ব জগৎ, একের পর এক মায়াবী অভিযান, পরতে পরতে মিশে থাকা বিব্লিক্যাল অনুষঙ্গ আর অনেকখানি ভালোবাসার উপাদান।

বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ে আমরা জানতে পারি ক্রিয়েশনের কথা, দিন আর রাতের কথা, আলো আর অন্ধকারের কথা, প্রথম মানব মানবীর কথা। আরো জানি, ঈশ্বরের জগতে অশুভর প্রথম আগমনের রহস্য। নার্নিয়ার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় না। পেভেন্সি পরিবার ওয়ারড্রোবের ওপারের দুনিয়ায় প্রথমবার পা রাখার অনেক অনেক আগের নার্নিয়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটান লিউইস, তাঁর ‘দ্য ম্যাজিশিয়ানস নেফিউ’ উপন্যাসের মাধ্যমে।ডিগরি আর তার বন্ধু যাদু আংটির প্রভাবে পৌঁছে যায় এক অন্য মায়াজগৎ ‘উড বিটউইন দ্য ওয়ার্ল্ডস’, এবং তারপর মৃত্যুপথযাত্রী মহানগর চার্ণে। চার্ণেই আমরা পাই অশুভের মূর্ত প্রতীক, হোয়াইট উইচ জেডিসকে। ঘুম থেকে জেগে উঠে বিশ্বকে নিজের পদতলে করার আকাঙ্ক্ষা জাগে জেডিসের অন্তরে। এ যেন সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সেই ‘ভেনগ্লোরি’ যা স্বর্গ থেকে লুসিফারের পতন ডেকে এনেছিল। এরপর এগোতে থাকে গল্প, অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর মুগ্ধ বিস্ময়ে আঁধারঘেরা মহাশূন্য থেকে আসলান নামক এক অসীম ক্ষমতাশালী চরিত্রের হাতে নারনিয়া সৃষ্টির সাক্ষী হই আমরা। 

আসলানকে যীশু খ্রিষ্টের রূপক হিসেবে কল্পনা করে নেওয়া পাঠকের পক্ষে খুব একটা পরিশ্রমসাধ্যহবেনা হয়তো।কিন্তুমনে রাখতে হবে, বিষয়টা অতটাও সরল নয়।নার্নিয়াসেইঅর্থেকোনও ‘নেভার-নেভারল্যান্ড’ নয়, বরং আমাদের জগতেরই বিকল্প রূপ। আরসেই পটভূমিতে মসীহা আসলানের অবতরণ ততটাই বাস্তব যতটা ভার্জিন মেরীর কোলে ‘সন অফ ম্যান’এর অলৌকিক আবির্ভাব। আসলান সম্বন্ধে লিউইসের নিজের বক্তব্যকেই এক্ষেত্রে আমরা প্রামাণ্য ধরতে পারি–“He is an invention giving an imaginary answer to the question, ‘What might Christbe come like if there really were a world like Narnia, and He chose to be incarnate and die and rise again in that world as He actually has done in ours?’This is not allegory at all.” নিউ টেস্টামেন্টের রিভিলেশন ৫:৫’এ‘লায়ন অফ জুডাহ’ রূপে বর্ণিত যীশু যে আক্ষরিক অর্থেই পশুরাজ সিংহ হয়ে নার্নিয়ার জগতে অবতীর্ণ হয়েছেন সে বিষয়ে যেমন কোনও সন্দেহ নেই, তেমনই সন্দেহের অবকাশ নেই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ উচ্চতা ছোঁয়া আসলানের ঈশ্বরত্ব সম্বন্ধেও। সিরিজের প্রথম উপন্যাস‘দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ারড্রোব’ উপন্যাসে এডমান্ডকে বাঁচাতে আসলানের আত্মবলিদান এবং তৎপরবর্তী পুনরুত্থান আমাদের মনে খ্রিষ্টের ক্রুশিফিক্সন এবং রেজারেকশনেরই প্রতিধ্বনি জাগায়। সাময়িক পথভ্রান্ত এডমান্ডের উত্তরণথেকে শুরু করে হোয়াইট উইচের অভিশাপ থেকে নার্নিয়াকে মুক্ত করা – সবকিছুর মধ্যেই ঈশ্বরের পুত্রের অমর, অক্ষয় হস্তাক্ষর স্পষ্ট।

ক্যাথলিক খ্রিষ্টান থিয়োলজিতে ব্যাপ্টিজমের গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষত জন দ্য ব্যাপটিস্ট প্রণীত ওয়াটার ব্যাপ্টিজম। এই পরিপ্রেক্ষিতেই লিউইসের তৃতীয় উপন্যাস,‘ভয়েজ অফ দ্য ডন ট্রেডার’, আমাদের উপহার দেয় নার্নিয়া সিরিজের অন্যতম শক্তিশালী রূপকধর্মী দৃশ্যকল্প, যেখানে স্বার্থপর, লোভী, সংকীর্ণ চিন্তাভাবনার অধিকারী ইউস্টেস স্ক্রাব রূপান্তরিত হয় এক কদাকার ড্রাগনে। এই ড্রাগন অবশ্যই কুখ্যাত ফলে নএঞ্জেল লুসিফারের ইঙ্গিতবাহী, বাইবেলে একাধিকবার ‘সারপেন্ট’ এবং ‘ড্রাগন’রূপে বর্ণিত অ্যাডভার্সারি শয়তানের প্রতিমূর্তি হিসেবে পাঠকের সামনে আসে। আমরা দেখি, বারবার চেষ্টা করেও ড্রাগনের খোলস ছেড়ে নিজের আসল রূপে ফিরতে সফল হয়না ইউস্টেস। শেষ পর্যন্ত আসলান তাঁর ধারালো নখের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করতে থাকে ড্রাগনটাকে, এবং বেরিয়ে আসে রক্তাক্ত, যন্ত্রণাকাতর ইউসটেস। ওই অবস্থায় ইউস্টেসকে জলে ডুবিয়ে দেয় আসলান। ডুব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুছে যায় তার মনের ক্লেদ-কলুষ, জল থেকে উঠে শুদ্ধ, পবিত্র এক নতুন জীবন লাভ করে সে।

এরকম আরও অনেক অনেক আলোচনা করা যায় বিশ্ব ফ্যান্টাসি, নারনিয়া এবং বাইবেল নিয়ে। কিন্তু সময়ের অভাবে আজ থামতে হচ্ছে এখানেই। আশা রাখি, অন্য কোনও দিন সম্পূর্ণতা পাবে এই আলোচনা। পাঠক, সত্যি বলছি, আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও অধীর অপেক্ষায়।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - অনির্বাণ ঘোষ

Posted in

প্রবন্ধ 


যেখানে মৃতেরা ভীড় করে আছে 
অনির্বাণ ঘোষ


কঙ্কাল দেখলেই বেশ একটা ভয় ভয় লাগে না? স্কুলের বায়োলজি ল্যাবে ঝোলানো কঙ্কালটা দেখেই কতবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। ভুতের গল্পের বই মানেই তার মলাটে একটা হাড়গিলে কঙ্কাল বা খুলির ছবি থাকবেই। কিন্তু এক ঘর ভর্তি চল্লিশ হাজার মানুষের কঙ্কাল! তাও যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা, সে আবার হয় নাকি! হয় তো বটেই, না হলে বলছি কেন? তবে এই রহস্যের কিনারা করতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় সাড়ে আটশ বছর। 

সালটা ১২৭৮, এখন যে দেশের নাম চেক রিপাবলিক, তখন সেই দেশকে বলা হতো বোহেমিয়া। সেই দেশের রাজা ওটাকারের খ্রীষ্ট ধর্মে খুব বিশ্বাস। সেই রাজার একদিন শখ হলো যীশুর জন্মস্থানের ছোঁয়া পাওয়ার। কিন্তু সে তো সেই জেরুজালেমে, অনেএএক দূরের পথ। রাজা থোড়াই যাবেন এতটা রাস্তা মাড়িয়ে। তাই সেলডেক নামের একটা গ্রামের পাদরীকে পাঠানো হলো জেরুজালেমে। নাম তার হেনরি। 

তা এই জেরুজালেমের ঠিক বাইরেটাতেই একটা ঢিপি মতো আছে, দেখতে অনেকটা মাথার খুলির ওপরের অংশের মতো। এর নাম গলগথা। এই গলগথার নাম শুনলেই কিন্তু যে কোন খ্রিশ্চানের মাথা শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসে। কেন? এখানেই যে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়! পাদরী হেনরি জেরুজালেম ঘুরে ফেরার পথে গলগথাও ঘুরে গেলেন, আর নিজের সাথে একটা ছোট থলিতে করে নিয়ে এলেন গলগথার একটু মাটি। 

কিছুটা মাটি বোহেমিয়ার রাজাকে দিলেন, তিনি তো খুব খুশি, ঘরে বসে বসেই পরমপিতার সন্তানের ছোঁয়া পেয়ে গেলেন যে! বাকিটা হেনরি সঙ্গে করে নিয়ে এলেন সেলডেক গ্রামের নিজের ছোট্ট গীর্জাতে। তা কি করা যায় এই পবিত্র জিনিসটা নিয়ে? চার্চের গায়েই ছিল একটা কবরখানা। হেনরি মশাই সেই ঝুরো ঝুরো মাটি ছড়িয়ে দিলেন কবরখানার চারিদিকে। যারা শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে তারা ঈশ্বরের আরেকটু কাছে এল। 

খবরটা কিন্তু দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে! 

বেঁচে থাকার সময় যতই পাপ করুক না কেন, মৃত্যুর পরে প্রভু যীশুর কাছে থাকা যাবে, এই ভেবে গোটা মধ্য ইউরোপ ঝাঁপিয়ে পড়ল ওই এক রত্তি কবরখানাটার ওপরে, সবাই চায় যে তাকে যেন সমাধি দেওয়া হয় ওখানেই। তারপরে আরও দুশো বছরে হাজারে হাজারে মানুষ মারা গেল হুসাইটের যুদ্ধে আর প্লেগে, তাদেরও ঠাঁই হল সেলডেকের কবরখানাতে।

একটু একটু করে জায়গা বাড়ালেও একসময় এমন অবস্থা হলো যে আর কাউকে ওখানে সমাধি দেওয়াই সম্ভব নয়! সেটা ১৫১১ সাল, সমাজের ওপরতলা থেকে তখনও চাপ এসে যাচ্ছে, সব সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই চাইছেন তাদের শেষ ঘুমের জায়গাটি ওখানেই হোক। তা কি করা যায় এই অবস্থাতে? মাটি খুঁড়ে তুলে ফেলা হলো সব দেহাবশেষ, যাতে কেউ রাগ না করে তাই তাদের জায়গা হলো সেলডেক চার্চেরই গর্ভগৃহে। কিন্তু প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষের কঙ্কাল জমা রাখার দায়িত্ব যাকে দেওয়া হলো সে কিনা আবার এক কানা পাদরী। তাই অনাদরে মাটির নিচের ঘরটাতে ডাঁই করে রাখা হল হাড়গোড় গুলোকে, সেই ঘর কেউ আর খোলে না। ফিরেও তাকায় না ওই দিকে কেউ। 

এর পর কেটে গেছে আরো ৩০০ বছর, সেলডেকের মাথায় এখন সোয়ার্জেনবার্গ বংশ। এরাই এখন রাজ্য শাসন করছে। প্রবল প্রতাপ তাদের। রুপোর খনির খোঁজ পাওয়া গেছে সেখানে, সোয়ার্জেনবার্গদেরও প্রতিপত্তি তাই ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাদেরই এক উত্তরাধিকারের মাথায় একদিন অদ্ভুত একটা চিন্তা এল। আচ্ছা ওই চার্চের নিচে নাকি এক গাদা কঙ্কাল জমে আছে, ওগুলো দিয়ে কিছু একটা বানালে হয় না?! যেমনি ভাবা অমনি কাজ, ওই সব হাড় দিয়েই বানিয়ে ফেলতে হবে একটা আস্ত গীর্জা! কিন্তু এই দুঃসাহসিক কাজটা করবে কে! রাজ্যের সব কারিগর তখন ভয়ে মুখ লোকাচ্ছে। 

শেষে এগিয়ে এলেন ফ্রতিসেক রিন্ত নামের একজন অনামী ছুতোর, দু’কুলে কেউ নেই তার। টুকটাক কাঠের কাজ করেই দিন গুজরান হয়। সেই মানুষটা হয়ত বুঝেছলেন ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকার এই সুযোগ। তাই তার হাত একটুও কাঁপেনি। ধীরে ওই হাজার হাজার অস্থির স্তূপ থেকে তৈরী হলো সেলডেকের মাটির নিচের চার্চ। 

এই গীর্জার প্রায় সব রকম অলংকরণ হাড় দিয়ে তৈরি। ঘরটার মাঝেই সিলিং থেকে ঝুলছে একটা বিশাল ঝাড়বাতি, যাতে মানব শরীরের প্রত্যেকটি হাড় অন্তত একবার করে ব্যবহার করা হয়েছে। দেওয়ালে গায়ের নকশা তৈরি হয়েছে শিঁড়দাঁড়ার হাড় দিয়ে, মাটির ওপরে এক মানুষ সমান উঁচু পিলসুজ তৈরি হয়েছে মাথার খুলি আর হাতের হিউমেরাস দিয়ে। সোয়ার্জেনবার্গ বংশের কোর্ট অফ আর্ম বা লোগোটাও বানানো হাড় দিয়ে, এমনকি চার্চের দেওয়ালে রিন্ত বাবু নিজের নামটাও বানিয়েছিলেন মানুষের হাড় জুড়ে জুড়ে! 

এই গীর্জা কিন্তু আজও ঘুরে দেখা যায়। চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ থেকে বাসে বা ট্রেনে মাত্র দেড়ঘন্টার রাস্তা, চার্চের ঘরটাতে পা রাখলে মনে হয় টু’শব্দও বুঝি ভয়ে ছেড়ে পালিয়ে গেল। একটা অদ্ভুত গন্ধ ঘরটাতে। আর হাজার হাজার খুলির চোখ তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। ঘরের ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ের রক্তও যেন জল হয়ে আসে! 

চারিদিক এমনিতেই খুব ফাঁকাফাঁকা। সূর্য ডুবে গেলে শুধু বিশাল বড় কবরখানাটাকে জড়িয়ে নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে সেলডেকের চার্চ। রাত কাটানো জন্য জায়গাটা মন্দ নয়, কি বলো? 











0 comments:

0
undefined undefined undefined

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in


বইঘর


বইয়ের খবর
গ্রন্থকীট


বইয়ের নাম : কাকও গান গায়
রচনা : দেবপ্রসাদ মিত্র
নির্মাণ : চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড 
বিনিময় মূল্য : ৪০টাকা। 

ছোট্ট বই। ছোট ছোট গল্প। ছোট বেলার মধ্যে দিয়ে চলা। আবার পুরো ছোট বেলাও নয়। কয়েকটা গল্প আছে যেগুলো একটু বড় না হলে পুরোপুরি বুঝবে না তুমি। 'কাকও গান গায়' গল্পের ইংরিজি বলা কাকটাকেই ধরো। শালিখের সঙ্গে ঝগড়ার সময় নোটেশন, মিনিম, ক্রোচেট, কোয়েভারের কথা বলে। শালিখের কমপ্লেক্স জন্মায় কাকটা ইংলিশ মিডিয়ামের বলে। আবার, বেড়ালের হাত থেকে শালিখকে বাঁচিয়ে, তাকে বাংলা গান শেখানোর প্রমিস করে কাকটা। বল তো? দেখনি এমন বন্ধু? তোমার চেনা দুনিয়াটাই একটু বদলে দেখায় বইটা। পড়ে নিও। পলাশের হারিয়ে যাওয়া 'বাড়ি'র গল্প পড়ে আমার বুক ভারী হয়ে উঠেছিল। তোমারও যদি ওঠে, একসঙ্গে খুঁজতে বেরোব।


বইয়ের নাম : রঘুবংশের কথা
রচয়িতা : শুকদেব সিংহ
নির্মাণ : চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড
বিনিময় মূল্য : ৪০টাকা। 

তোমাদের জন্য উপেন্দ্রকিশোর লিখেছেন রামায়ণ আর মহাভারতের কথা। কুলদারঞ্জন লিখেছেন বেতাল পঞ্চবিংশতি আর কথাসরিৎসাগর। অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন কালিদাসের শকুন্তলার গল্প। এবার পেলাম 'রঘুবংশের কথা'। কথামুখ বলছে : 
'মহাকবি কালিদাসের নাম তোমরা বোধহয় শুনিয়াছ? ভারতীয় কবিদের ভিতর তিনি একজন সেরা কবি। ...কালিদাসের মহাকাব্যের নাম রঘুবংশ। শ্রীরামচন্দ্রের ঠাকুরদাদার বাবা রঘুরাজের বংশধরদিগকে লইয়া এই কাব্য রচিত হয়। 
এখন তোমাদের সেই রঘুবংশের কথাই বলিতেছি।'

অতি সুললিত ভাষায় তুমি পড়ে নেবে দিলীপ, রঘু, অজ, দশরথ, রাম, কুশ, ...প্রমুখের কথা। তারপর বড় হয়ে আসল বইটা পড়বে। পড়বে তো?


বইয়ের নাম : ঘুম তাড়ানি ছড়া
রচয়িতা : তপন চক্রববর্তী 
নির্মাণ : চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড 
বিনিময় মূল্য : ৪০টাকা। 

'ভূত নেই ভূত নেই, নেই জুজুবুড়ি,
ভূতের কাহিনী শুধু আছে ঝুড়ি ঝুড়ি
আঁধারে মনের ভুলে শুধু পাও ভয়, 
ভূত নেই জেনে রেখো, ভূত কিছু নয়।' 

বইয়ের নাম 'ঘুম তাড়ানি ছড়া'। তোমার মনের ঘুম ভাঙাতে চায় এ বই। বলতে পারো ছড়ার আড়ালে তোমায় কিছু কাজের কথা বলতে চায়। যাতে তুমি সজাগ থাকো। তবে একটা মুশকিল আছে। শেষ ছড়াটা দেখ : 

'রোজ সকালে মুগুর ভাঁজে পালোয়ান সে বড়,
ডন বৈঠক কুস্তি ঘুঁষি সব কিছুতেই দড়। 
ঘাটতি কিছু নেই শরীরে ঘাটতি শুধু মাথায়
শৈশবে সে মন দেয়নি পড়ার বইয়ের পাতায়।
সেই নিয়ে তার দুঃখ বড়, বললে - খোঁকাবাবু,
পড়াশুনোর লড়াই হলে তোমার কাছেই কাবু।'

কী বুঝছ? তুমি বাঙালি ভদ্রসন্তান। তোমার কাজ মস্তিষ্ক চালনা। শরীরচর্চা অবাঙালি ছোটলোকের ব্যাপার। লেখাপড়া করে তুমি গাড়ি ঘোড়া চড়বে। বাবু বলে সেলাম পাবে। ভুলেও এই কাজটা কোরো না। সবল দেহ আর জোরালো মন দুইই তোমার চাই। আর কক্ষণও ভদ্রলোক-ছোটলোক এই কথার প্যাঁচে পড়বে না। দেখবে, সত্যিকারের বড় হয়ে উঠবে।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

বইঘর - চয়ন

Posted in


বইঘর


মানিক জ্বলে মনে
চয়ন


মানিকবাবুর ছোটদের জন্য লেখা তুমি পড়েছ? 'মশাল'? 'পাশ ফেল'? 'চোর সাধুচরণ'? কী বলছ? এগুলো মানিকবাবুর লেখাই নয়? ওহো! তুমি মানিক রায় ভাবছ বুঝি? আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলছিলাম। 

হ্যাঁ, তিনিও ছোটদের জন্য লিখেছেন। তবে, তিনি ছোটদের জন্য লেখা বলতে একটা বিশেষ ধরণের লেখাকে বুঝতেন। 

ছোটদের জন্য লেখা কাকে বলে? অনেকে বলেন, এই সাহিত্য হবে সহজ, সরল, উপভোগ্য। জটিল জীবনের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেওয়ার দায় এ সাহিত্যের নয়। কিন্তু এই সংজ্ঞাটা একেবারে সঠিক বলা যায় না। ভেবে দেখ, 'মহেশ' বা 'ছুটি' কি ছোটদের কথা ভেবে লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথ? অথচ এই দু'টো গল্পই ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা পড়ে থাকে। 'ভোম্বল সর্দার' স্বীকৃত কিশোর সাহিত্য। ক্লাসিক বলে এর খ্যাতি। সেখানেও দেখি এই ভাগাভাগি খুব একটা মানা হয়নি। ভোম্বলের অস্থিরতা, বড়দের ওপর তার রাগ, জীবনকে দেখার তার দৃষ্টিকোণ আর সবার ওপর এ বই এর ভাষার চলন --কোনওটাই ঠিক সরল নয়! এ বই আসলে দুই ধরণের পাঠকের সাথে কথা বলে। এক, যারা শুধু গল্পটা পড়বে, মানে ছোটরা; আর দুই, যারা এর রচনা কৌশলও নজর করবে সঙ্গে সঙ্গে, অর্থাৎ বড়রা। এই দুই স্তরে কথোপকথন বহু সার্থক ছোটদের জন্য লেখা সাহিত্যের মূল শক্তি। এটা বারবার দেখা যায় যে সত্যিকারের শিশু কিশোর সাহিত্য রচয়িতারা কখনও তোমাদের বোধশক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন না। অবনীন্দ্রনাথ করেননি, লীলা মজুমদার করেননি আর করেন নি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ সাহিত্যের এই শাখায় তাঁর অবদানের কথা অনেকে জানেনই না। 

মানিক একবার লিখেছিলেন, 'বড়দের জন্য লেখা এমন গল্প যদি বেছে নেওয়া যায় যাতে কিশোর মনকে বিগড়ে দেবার মতো কিছুই নেই। বরং গল্প পড়ে বড়দের জীবন সংঘাতের কমবেশি পরিচয় পেয়ে কিশোর মন নাড়া খাবে, বিস্ময় ও অনুসন্ধিৎসা জাগবে,সেরকম গল্প কিশোরদের পড়তে দিলে দোষ কি?' বুঝতেই পারছ, তিনি খোকাপনা বাদ দেওয়া, মানুষের গন্ধ মাখা, জীবনের তাপে উত্তপ্ত লেখার কথা বলছেন - যা ছোট-বড় সবার। এই বোধ সম্বল করেই তিনি তোমাদের জন্য উপন্যাস লিখতে গিয়েছিলেন। 

একটা উপন্যাসের নাম শুরুতেই করেছি। 'মশাল।' 'রংমশাল' পত্রিকায়, ১৩৫১ -এর শ্রাবণ সংখ্যায় আরম্ভ হয়ে কিছুদিন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায় সেটি। ১৩৫২ এর ভাদ্র সংখ্যায় ছাপানো এক বিজ্ঞপ্তিতে লেখক জানান,

'অসুখ, হাঙ্গামা, দাঁতের শত্রুতা এইসব অনেককিছু আমায় সাময়িকভাবে কাবু করেছে। ... সুস্থ হলেই মশাল লেখার চেষ্টা করব।' 

সে চেষ্টাটা আর করতে পারেননি মানিক। কেন, কেউ জানে না। 

একই পরিণতি হয়েছিল 'মাটির কাছে কিশোর কবি' উপন্যাসটিরও। 'আগামী' পত্রিকার আশ্বিন -কার্তিক ১৩৫৯ সংখ্যায় এর প্রকাশসূচনা। পরের বছর মাঘ সংখ্যা পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে সাতটি পর্ব প্রকাশ পায়। তারপর, ফাল্গুন-চৈত্র ১৩৬০ সংখ্যায় সম্পাদক প্রতিশ্রুতি দেন, 'অনিবার্যকারণে এবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস মাটির কাছে কিশোর কবি প্রকাশ করা গেল না। সামনের মাস থেকে আবার সঠিকভাবে প্রকাশিত হবে।' সে সামনের মাস আর আসেনি। 

কেন যে তিনি মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলেন এই উপন্যাস কারোর তা জানা নেই। যেমন জানা নেই 'রাজীবের লম্বা ছুটি' খাতার পাতায় অসমাপ্ত পড়ে রইল কেন। 'কিশোর কবির' পরিণতি মানিক ভেবে রেখেছিলেন। উপন্যাসটা যতদূর ছাপা হয়েছিল তার মধ্য থেকেই বোঝা যায় কবিতার শক্তিতে খিদে, অভাব, রোগ, অবিচারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কাহিনী এটা। মূল সুরের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, মানিক থেমে যাওয়ার পাঁচ বছর পর, ১৩৬৫-এর 'আগামী'-এর শারদ সংখ্যায় উপন্যাসটি শেষ করেন খগেন্দ্রনাথ মিত্র।

আসলে, তোমাদের জন্য লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটাই সম্পূর্ণ উপন্যাস আছে। 'মাঝির ছেলে'। ধারাবাহিক ভাবে এ লেখা বেরোয় 'মৌচাক' -এ। শ্রাবণ ১৩৪৯ থেকে অগ্রহায়ণ ১৩৫০ পর্যন্ত। পড়লেই দেখা যায় অন্যান্য ছোটদের লেখা থেকে এ উপন্যাস কতটা আলাদা। ভাল মন্দ, সাদা কালোর সোজা-সাপটা ফারাককে বেমালুম অস্বীকার করে এ বই। বার বার জানাতে চায় জীবন ঠিক অতটা সরল নয়। 

যাদববাবু অভিজাত বংশে জন্মেছেন, কিন্তু মাঝির ছেলেকে নাগার প্রতি তাঁর কোনও তাচ্ছিল্য নেই। তাঁর মায়া আছে, মমতা আছে। আবার, তিনিই চোরাচালানকারী! নাগা এঁর কাছ থেকেই বিবেক আর ন্যায় এর ওপর আস্থা রাখতে শেখে। অন্যদিকে যাদববাবুর ভাই মাধববাবু কোনও বেআইনি পেশায় যুক্ত না থাকলেও, অর্থলোভে কত নীচে যে নামতে পারেন তার সীমা নেই। তাহলে এ গল্পের দুষ্টুলোক কে? নাগা যাদববাবুর সঙ্গী হয়; কিন্তু, তার মনে সদাই সংশয় আর দ্বিধা। সে বারবার দেখে, ভালো মন্দ সব ছাড়িয়ে মানুষ শুধু মানুষ। ডাকাত উদার হৃদয়, পুলিশের খোচর বন্ধুবৎসল। অথচ, সমাজ অস্বীকৃত পেশাও তো অস্বস্তি জাগায়। তাই নাগা বিশালের স্বপ্ন দেখে। সে সাগরে যেতে চায়। তারপর একদিন তুফানে উত্তাল নদীর বুকে জলপুলিশের তাড়ায় বিপথে ছোটা লঞ্চের বুক থেকে 'বড় একটা ঢেউ এসে.. নাগাকে.. তুলে নিয়ে চলে যায়।' আর নাগার মনে হয় এতক্ষণে তার সমুদ্রযাত্রা আরম্ভ হলো যার শেষ হবে 'একেবারে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে'।

কাহিনীর এই রূপরেখায় মাঝির ছেলের পরিচয় কিছুই পাবে না তুমি। বুঝবে না কেমন করে এ উপন্যাসের প্রতি ছত্রে জেগে থাকে দপদপে প্রাণ। কি বলিষ্ঠ জীবনবোধ প্রকাশ করে লেখকের অননুকরণীয় রচনাশৈলী। তাই এ লেখা তোমাকে পড়তে হবে। 

পত্রভারতীর তৈরী করা বইটা পড়ে নাও। তারপর প্রশ্ন করো। প্রশ্ন করো, কেন এ লেখার তেমন পরিচিতিই নেই? মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ কেন তেমনভাবে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন না এর সম্বন্ধে? প্রশ্ন করো, কেন 'মাঝির ছেলে' ক্লাসিক বলে নাম করেনি? 'মৌচাক'-এ ধারাবাহিক শেষ হওয়ার পর আরও তের বছর বেঁচে ছিলেন মানিক। এর মধ্যে কেউ 'মাঝির ছেলে' বই করে ছাপায়নি কেন? কিসের বাধা ছিল, বা আছে? প্রশ্ন করো। উত্তর পেলে আমাকে জানিও।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


ভাগীরথী ও কপিল মুনি
অনিন্দিতা মণ্ডল


হাজার হাজার বছর আগে বললেই হয়ত মানাত, তবু পণ্ডিতেরা যখন পুরাণের কিছু নির্দিষ্ট তারিখ নির্দেশ করেছেন, সেসব অনুসরণ করলে এবং ভুতত্বের ইতিহাস অনুসরণ করলে এ ঘটনার সূত্রপাত মোটামুটি ভাবে চার থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের বলে ধরে নেওয়া যায়। সেসময়ে বাংলায় এক অতি সমৃদ্ধ জাতির বসবাস ছিল। বানিজ্যে কৃষিতে সংস্কৃতিতে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় এরা বাকি ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। এর ফলে আর্যাবর্তর যুদ্ধপরায়ণ রাজারা হিংসেয় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। তখন অযোধ্যার রাজা ছিলেন সগর। মহাভারতের সেই আদিযুগের কথা। সগর রাজার নাকি ষাট হাজার পুত্র ছিল। না, ঠিক তা নয়। সগর রাজার ছয়টি পুত্র ছিল বলে মনে করা যায়। স্নেহে ওরকম বহুবচন চলত তখন । সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়াতে সগর রাজা করলেন কি, এক অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। এভাবেই তিনি রাজ্যজয় করতে পারবেন, এই আশা করে ঐ ছয়পুত্রকে দিয়ে তিনি যজ্ঞের অশ্বটিকে সাজিয়ে গুজিয়ে রওনা করে দিলেন। পথে তেমন গোলমাল হলনা ঠিক। ক্রমে সেই ছয়পুত্র অশ্বের সাথে এসে পৌঁছল সাগর সংলগ্ন সমতট ভূমিতে। বাংলার উত্তর অংশে তখনও সে অশ্ব বাধা পায়নি। কিন্তু সমতটের সাগর সংলগ্ন অঞ্চলে তখন আশ্রম ছিল এক মহাপুরুষের। তিনি মহামুনি কপিল। যাঁর সাংখ্য দর্শনের খ্যাতি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম, চতুর্দিকে। এই কপিল মুনির আশ্রম ছিল এক মহা প্লাবনময়ী নদী আর সাগরের মোহনায়। সে কোনও নির্দিষ্ট স্থান নয়। কারণ মোহনা অঞ্চল সদাই প্লাবনের ধারায় ধুয়ে মুছে যেত। ফলে মহামুনি তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ সহ সরে যেতেন অন্যখানে। সগর রাজার রাজ্যেও এই নদী বয়ে এসেছে। কিন্তু সমস্যা হল, সে কোনও বাঁধা ধরা খাতে বইতেই চায়না ! এখন সগর রাজার পুত্ররা যখন সেই মহা নদীর মোহনা অঞ্চলে পৌঁছল তখন তাদের অশ্বটি মহামুনি কপিলের আশ্রমে এসে পা ঠুকল। হ্রেষাধ্বনি শুনে মুনির ধ্যানভঙ্গ হয়ে গেলো। কপিল এক বিশেষজ্ঞ নদীবিজ্ঞানী ছিলেন। এই প্লাবন উপত্যকায় মানুষের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে সৌভাগ্যও যে কতটা জড়িয়ে ছিল তাই নিয়ে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আদতে যে নতুন পলির প্রলেপে প্রকৃতি শস্যশ্যামলা হয়ে উঠছেন, এবং মানুষের খাদ্য ও আশ্রয়ের পুনর্নির্মাণ ঘটছে, এই কথাটি তিনি ভালোই উপলব্ধি করেছিলেন। কপিলের মতে প্রকৃতিই সবলা। তাঁর ইচ্ছাতেই মানুষ এগিয়ে চলে। তাই প্রকৃতিকে ক্ষুব্ধ করা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ। সেসময় গঙ্গা কোনও একটি স্রোত ছিলনা। সমস্ত বদ্বীপ জুড়ে তার অসংখ্য স্রোত ছিল। কোনটি যে শাখা আর কোনটি যে উপনদী, কোনটি যে প্রধানা আর কোনটি যে মাত্রই সখীসম, সে আলাদা করে চিহ্নিত করা হতনা। ফলে সে এক বিশাল উপস্থিতি।

এমত সময়ে কপিল ব্যাস্ত ছিলেন জলবিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণায়। বিদ্যুৎকে কাজে লাগিয়ে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা তিনি ভাবেননি। এ তাঁর চিন্তার বাইরে ছিল। তিনি শুধু আরও এক প্রচণ্ড প্রাকৃতিক শক্তির কথা চিন্তা করেছেন। এ শক্তি আগুনের জন্ম দিতে পারে। শুধু চকমকি ঠুকে কাঠে কাঠে ঘর্ষণে জাত অগ্নি নয়। এ এক সর্বগ্রাসী আগুন। ঠিক যেমন চরাচর ভাসিয়ে দেওয়া জল। সে জলকে প্রতিরোধ করার শক্তি মানুষের থাকেনা। শুধু সেই স্রোতের সঙ্গে চলা ছাড়া। সেইরকম আগুন। দেখা যাক প্রকৃতি ঠাকুরানী এই শক্তির উন্মেষে কিভাবে সাড়া দেন। এই রকম এক মগ্ন মুহূর্তে সগরেরষাট পুত্র তাদের অশ্বটিকে ছেড়ে দিয়ে দেখছেন মোহনার মনোমোহন শোভা। সামনে মাঝে মাঝে বালুর চর। তার চারিপাশ দিয়ে ধীর গতি জলের ধারা। কিছু দূরে সেইসব ধারা গিয়ে মিলেছে অকূল জলধিতে। আকৃষ্ট করার মতই শোভা। এমনটি তাদের দর্শনে মেলেনা। ওদিকে মহামুনি এই অসময়ে ধ্যানভঙ্গ হওয়ায় যারপরনাই বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি কিনা সভ্য নাগরিক মানুষ! তাই তিনি নিজেকে সংযত করে সগর রাজার পুত্রদের আহ্বান জানালেন আশ্রমে। পুত্ররা তো ততক্ষণে মহামুনির শরণ চেয়েই ফেলেছেন। এ স্থান ত্যাগ করার প্রশ্নই ওঠেনা। তবে এমন শক্তিশালী যাদুকরের মতো বিজ্ঞানীর সঙ্গে যুদ্ধে পারা তো অসম্ভব! অতএব সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত। মহামুনি চরণে স্থান দিন বরং। 

কিছুকাল বাসের পর সগর রাজার সৈন্যরা অশ্বসহ ফিরে গেলেন অযোধ্যায়। রাজা খবর পেলেন সাগরের মোহনায় মহামুনি কী এক অসীম প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা করছেন যার প্রকাশে দিগন্তব্যাপী আগুন জ্বলে উঠবে। রাতারাতি চারিদিকে গুজব রটে গেলো মহামুনি কপিল সগরপুত্রদের বন্দী করেছেন পাতালে। মানে মোহনাসংলগ্ন কপিলাশ্রমে। আর সেই অগ্নিসম প্রাকৃতিক শক্তি তাদের ভস্মীভূত করেছে। অর্থাৎ তারা সেই শক্তির মহিমায় আকৃষ্ট হয়েছেন। 

গবেষণার নানা স্তর পেরিয়ে এসে যখন আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তিও খানিক হাতে এলো, তখন বহুকাল পেরিয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধ মহামুনির অস্থিও সাগরে বিসর্জন করা শেষ। সগরপুত্রদের বংশধারা এখন এই প্রাচ্যভূমিতে স্থিতিলাভ করেছে। এই সময়ে আবির্ভাব ঘটল আর এক নদীবিজ্ঞানীর। তিনি সগর রাজার বংশেই জাত। তিনি ভগীরথ। ঠাকুরদাদের বংশধারা খুঁজতে বেরিয়ে তিনি এসে হাজির হলেন মোহনায়। তখন এক অন্য কপিল সেখানে অধিষ্ঠান করছেন। মহামুনির শিষ্য পরম্পরায় তিনিই এখন কপিল। ভগীরথ এসে তাঁকে জানালেন নিজের কথা। কি করে এই অজস্র স্রোতকে একটি প্রধান ধারায় বহমান করা যায়। যদি যায় তবে এই বিধ্বংসী প্লাবনের থেকে সমস্ত প্রাণীই রক্ষা পায়। প্লাবনভূমির ওপরে বসবাস বা কর্ষণক্ষেত্র গড়ে তোলা আর অপরাধ হবেনা তবে। 

সগর রাজার সেই ষাট পুত্রর বংশধরেরা প্রথমে অনুমতি দেননি। কিন্তু পরে ভেবেচিন্তে দেখা হল ভগীরথ ভুল বলেননি। কারণ মানুষসহ সমস্ত জীবই প্রকৃতির অংশ বৈ তো নয়! সুতরাং এদেরও রক্ষা করা কর্তব্য।

এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হল ভগীরথের নেতৃত্বে। প্রধান ধারাটিকে অক্ষুণ্ণ রেখে আশে পাশে আরও নয়টি ধারার খাত কাটার কাজ শুরু হলো। কত সময় যে লেগেছিল সে কে বলতে পারে? তবে নিশ্চয় সে অনেক অনেক বছর লেগেছিল। আর অনেক বছর পরে গঙ্গাকে ভাগীরথী নাম দিয়ে ভগীরথ তার সেই আগ্রাসী প্লাবনকে রুখে দিয়েছিলেন। খনা কি আর সাধে বলেছিলেন – ভগার খাত!

0 comments:

2
undefined undefined undefined

রম্যরচনা - স্বাতী ব্যানার্জ্জী

Posted in


রম্যরচনা


সাগ্নিকবাবু
স্বাতী ব্যানার্জ্জী 


সাগ্নিকবাবু বিজ্ঞানী হতে পারতেন, বিজ্ঞানচর্চা করার সমস্ত গুণই তার মধ্যে ছিল। কেবলমাত্র মায়ের অনিচ্ছা এবং ক্রমাগত বাধাপ্রদানে দেশ এক প্রতিভাশালী বিজ্ঞানীকে হারালো। ঘটনা তাহলে খুলেই বলা যাক। সাগ্নিকবাবুর বিজ্ঞানীলগ্নে জন্ম। ছোটবেলায় দুধের বোতল তিনি হাত দিয়ে না ধরে দুই পা দিয়ে ধরে মুখে পুরতেন, ফলে দুটি স্বাধীন হাত অন্য গবেষণামূলক কাজে ব্যস্ত থাকতো যেমন নিজের কাঁথা টেনে ফেলে দেওয়া, ছোট্ট মশারি উল্টে ফেলে দেওয়া বা নিজের হিসুর শাওয়ারে নিজে স্নান করা ইত্যাদি। এরপর তিনি হামাগুড়ি দিতে শেখেন এবং নতুন স্হান আবিষ্কারের নেশায় বা সেরেল্যাক খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে খাটের তলায় ঢুকে সেখানেই নিদ্রা দিতেন। কেউ খাটে পা ঝুলিয়ে বসলে ফোকলা মুখে তাদের পা কামড়ে নতুন স্বাদ গ্রহণের তীব্র কৌতূহল ছিল তার। এইবয়সেই তিনি আত্মরক্ষার উপায় শেখেন এবং সারা গায়ে ডলে ডলে তেল মাখানোর প্রতিবাদ হিসেবে তিনি ঠাকুমার চশমা বা মায়ের কানের দুল টেনে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। সামান্য হাঁটতে শিখে সাগ্নিকবাবুর কৌতূহল (বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান) বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং তিনি টলটলে পায়ে আলনা, খাট, আলমারি, শোকেস ধরে ধরে বিশ্বভ্রমণে বের হন। প্রায়ই তাকে আলনার পিছনে বা সিঁড়ির মুখে পাওয়া যেত। এই ভ্রমণ বৈচিত্র্যময় করতে তিনি প্রতিটি পাপোষে হিসু করতেন।একদিন মা এবং ঠাকুমাকে শোকেস গুছাতে দেখে তিনি ভীষণ অনুপ্রাণিত হন এবং গোছানোর জন্য কোন শো পিস না পেয়ে অগত্যা নিজের শক্ত পটি শো কেসে সাজিয়ে রাখেন। তার এই আশ্চর্য প্রতিভায় ঈর্ষান্বিত হয়ে মা মাঝেমধ্যে খুব চেঁচামেচি করতেন বটে, কিন্তু ঠাকুমার ভয়ে বেশি কিছু বলতে পারতেন না।

এরপর তিনি রসায়ণবিদ্যায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একটি হাতলভাঙা কড়াইতে নিজের ঝুমঝুমি, চটি, জনসন্স ক্রিম, চুষিকাঠি নিজের বোতলের জলে গুলে রান্না করতেন। একথা সকলেই জানেন রান্নাবান্না মানেই কেমিস্ট্রি অর্থাৎ বিজ্ঞানচর্চা। এছাড়া তার পুতুলখেলার কাপে মিছিমিছি গ্যালন গ্যালন চা সকলকেই খেতে হত। কেউ না খেলেই সাগ্নিকবাবু নিমেষে বুথ সাহেবের বাচ্চার মতো চিল চিৎকার জুড়ে দিতেন।এরপর সবার মতোই তিনিও সোফা থেকে জানলায় উঠে গ্রীল ধরে দাঁড়াতে শেখেন এবং আধো আধো বুলিতে রাস্তা দিয়ে যাওয়া সকল ফেরিওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে মাম (মাছ) মামসো (মাংস) দিতে হুকুম করতেন। অনেকেই হেসে চলে যেতেন আবার কেউ কেউ বিক্রির আশায় দাঁড়িয়ে পড়তেন। অগত্যা বাধ্য হয়েই দাদুকে তাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু কিনতে হতো।

এরপর সাগ্নিকবাবু বড় হয়ে যান এবং দুইপায়ে উল্টো পচ্চল (হ্যাঁ বানান ঠিকই আছে, উনি এই উচ্চারণই করতেন) সারাবাড়ি টহল দিতে শুরু করেন। মাঝেমধ্যে বাবার জুতোয় পা গলিয়ে বিকট ঠকাস ঠকাস শব্দ করে তিনি বাবা কিংবা ঠাকুরদার অফিসে যেতেন। এইসময় তিনি একাধিক গবেষণামূলক কাজে জড়িয়ে পরেন যেমন ফুটন্ত ডালে পিংক ক্রেয়ন ফেলে ডালের রঙ পরিবর্তনের গবেষণা বা চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে খড়ম তৈরির চেষ্টা। আরেকটু বড় হয়ে তিনি কাঁচি ও ধূপকাঠির বিভিন্ন উপযোগীতা আবিষ্কার করেন; যেমন ঘুমন্ত ঠাকুমার বিনুনি কেটে ফেলে কাঁচির ধার পরীক্ষা করা বা মায়ের ছাদে মেলা শাড়িতে ধূপকাঠি দিয়ে ফুটো করা। সব প্রচেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি, কিন্তু মনে রাখতে হবে ব্যর্থতাই উন্নতির প্রথম ধাপ। সুতরাং দুপুরবেলা গল্প বলতে বলতে দাদু ঘুমিয়ে পড়লে তিনি দাদুর নাকের ফুটোয় পেনসিল ঢুকিয়ে নিশ্চিত হতে চাইতেন যে দাদু সত্যিই ঘুমিয়েছেন কিনা !

আরেকটু বড় হয়ে তিনি সিগারেট খান। না, নিজে কেনেননি, বাবার প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট নিয়ে কাঁচাই চিবিয়ে খান, কারণ আশেপাশে দেশলাই খুঁজে পান নি। শেষ অবধি গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে মা বমি করান এবং তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন কিল চড় কি জিনিস। যাইহোক বিজ্ঞানসাধনার ক্ষেত্রে এমন বাধা একটু আধটু এসেই থাকে। অন্যদিকে এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে তাকে সাবধানী করে তোলে। তাই যেদিন আলুপটলের তরকারিতে অল্পস কালো ফিনাইল দিয়ে সাদা হয় কিনা পরীক্ষা করছিলেন সেদিন মা'কে তেড়ে আসতে দেখেই তিনি ঠাকুরদার পিছনে লুকিয়ে পড়েন।

এরপরে বিজ্ঞানচর্চার গতি বেড়ে গেল। একমাত্র মা তার কাজে বিঘ্ন ঘটাতেন। একদিন ঠাকুমা পুজো দিয়ে আসার পর তিনি সিল্কিকে (স্পিৎজ কুকুর) নিয়ে ঠাকুরঘরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সিল্কি নিমেষের মধ্যে সমস্ত বাতাসা খেয়ে ফেলে। বিকালে ঠাকুমা বারবার করে বাড়ির সবাইকে, বিশেষ করে মা বাবাকে বললেন যে ঈশ্বর যে আছেন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। কেবলমাত্র তাকে এবং সিল্কিকে ঘেঁটি ধরে ঠাকুরঘরের থেকে বার করে আনা মা যে কেন সারা সন্ধ্যা ফিক ফিক করে হাসছিলেন, তা কেউ বুঝতে পারেনি। মা অবশ্য নানারকম অদ্ভুতকাজ করে থাকেন। সেদিন সাগ্নিকবাবু খুন্তির বদলে জেল পেন দিয়ে ডাল নেড়ছিলেন কড়াইতে। মা রেগে মেগে নোংরা বলে সব ডাল ফেলে দিলেন। অথচ আরেকদিন যখন সারাদিন কাদা ঘেঁটে তিনি দুটো গাছ লাগালেন তখন নোংরা ঘাঁটা সত্ত্বেও মা তাকে কোলে নিয়ে চুমা দিলেন। অদ্ভুত মহিলা। বাবা লোকটা আরও আশ্চর্যের। কখন আসে, কখন যায় কিছুই বোঝা যায় না। বাবা বাড়িতে থাকলে তাকে ঘুম পাড়িয়ে মা বাবা গল্প করেন।তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন ভেবে বাবা মা কে জিজ্ঞেস করেন, "ব্যাটা কি আমার মত দেখতে হবে?" মা হাসি চেপে বলেন, "না, শাহরুখ খানের মতো দেখতে হবে।" তারপর দুজনেই হেসে ফেলেন আর ঘুমন্ত সাগ্নিকবাবুর কপালে চুমো দেন। পরদিন কি কি গবেষণা করবেন ভাবতে ভাবতে মায়ের গায়ে পা তুলে সাগ্নিকবাবু ঘুমিয়ে পড়েন।

2 comments:

7
undefined undefined undefined

অণুগল্প - সরিতা আহমেদ

Posted in


অণুগল্প


মিমির বড় হওয়া
সরিতা আহমেদ


বেলা ৯টায় ঘুম ভাঙতেই মিমি টের পেল বাড়িটা থমথমে। মা-বাবান-দিদুন কেউ নেই, মিতুলটার সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। টয়লেট থেকে বেরিয়ে সোনাদাকে জিজ্ঞেস করতেই তার মনে পড়ল আজ শনিবার। ইস, যদি আর একঘণ্টা আগে উঠত তবে হয়তো সবার যাওয়াটা সে যে করেই হোক আটকাতে পারত।
মিতুলকে নতুন স্টিকার বক্সটাও না হয় দিয়েই দিত, পোকেমন না দেখে বাবানের দেওয়া সবগুলো অঙ্কও না হয় করেই ফেলত, যত বিচ্ছিরিই লাগুক নাকমুখ টিপে সকালে দুধ আর লাঞ্চে মাছভাত খেয়েও নিত, তাতেও না হলে মিথ্যে মিথ্যে পেট ব্যাথার বাহানা তো ছিলই – তবু ওদের আটকানো তো যেত। ইস, কেন যে এত ঘুমাল সে! আসলে কাল স্কুলের ঘটনাটা নিয়ে মা এত বকাবকি করল যে তার কান্না পেল ভীষণ, আর কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুম এসে গেল বুঝতেই পারল না। হয়েছিল কি, ওদের ক্লাসের কিছু মেয়ে একটা লিফলেট নিয়ে বেজায় হল্লা করছিল। মিমি সেটা হাতে নিয়ে দেখল তাতে বিচিত্র একটা আবেদন – “শ্রী শনি মহারাজ আবির্ভূত হয়েছেন কোকলামারির মাঠে। প্রাচীন বটবৃক্ষের নিচে এক সিদ্ধপুরুষের আশ্রমে নিয়েছেন ঠাঁই। ভক্তদের সব সমস্যার সমাধান এসে গেছে । তন্ত্রসাধক গাছবাবার কাছে মিলছে ফল। আগামী শনিবার এক বিরাট ধর্মচক্রে সামিল হতে দলে দলে যোগ দিন। হাতেনাতে ফল ১০০% গ্যারান্টি। যত পারেন এই প্রচারে সামিল হন। অবিশ্বাস করলেই শনির প্রকোপ নিশ্চিত, সাক্ষাৎ মৃত্যু...” পড়ার পর মিমি খুব হাসল, তারপর রিদ্ধিমার হাঁ হওয়া মুখের দিকে চেয়ে বলল ‘তোরা এসব ঢপে বিশ্বাস করিস? এই আমি লিফলেট ছিঁড়লাম, দেখি তো কি হয়!’ সবাই হাঁ-হাঁ করে তেড়ে আসার আগেই সে সবক’টা লিফলেট ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেলে দিল। রিদ্ধিমার সেকি ভয় ! ঘটনাটা এতটাই চমকপ্রদ যে বাড়ি ফিরে কাকে বলবে ঠিক করতে পারছিল না। মিতুল তো ছোট, বুঝবেই না। এদিকে চেপে রাখাও যাচ্ছে না। অগত্যা মা-কে সবটা বলতেই সেকি বকুনি! বেচারি মিমি কি জানত ওই আশ্রমে যাওয়ার প্ল্যান মা আগেই করে রেখেছে!
জলখাবার খেয়ে হোমওয়ার্ক নিয়ে বসতে যাবে এমন সময় জিদানের ফোন। জিদানের সাথে মিমির খুব ভাব। আগে একই পাড়ায় থাকত জিদানেরা, এখন দিল্লীতে। ছুটির দিনে সারা সপ্তাহের জমানো কথা দুইবন্ধু শেয়ার করে ।মন খারাপের কথা জিদানকে জানাতেই সে কনফারেন্স ক’লে টুবাইকে ডেকে নিয়ে একটা অভিনব প্ল্যান বানাল।
তখন বেলা ১১টা। প্ল্যান মতো টুবাইকে সাথে নিয়ে মিমি সোনাদার চোখ এড়িয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। একটা অটো ধরে সোজা কোকলামারির মাঠ। যথারীতি প্রচুর ভিড় হয়েছে। আশ্রমটা ছোটখাট, তবে ঘুপচি ঘর বেশক’টা। সিদ্ধিপুরুষ ‘গাছবাবা’ ইয়াবড় জটা এবং গেরুয়া বসন পরে ভক্তদের সমস্যা শুনছেন আর একটা কাগজে কিছু লিখে পাশের কামরায় যেতে বলছেন। ব্যাপারটা খানিকক্ষণ লক্ষ্য করে চুপিচুপি সেই ঘরের পেছনের জানলার কাছে মিমিরা পৌঁছে গেল। চারদিকের উচ্চকিত শব্দ ও মন্ত্রধ্বনির চোটে কেউই তাদের খেয়াল করল না। তারপর টুবাইয়ের কাঁধে চেপে জানলার ফাঁক দিয়ে ভেতরের সব দৃশ্য দ্রুত মোবাইল ক্যামেরায় বন্দী করল মিমি ।
দুপুর ২টোয় লাঞ্চে সবাই যখন খেতে বসেছে, তখন মিমি গম্ভীর মুখে বাবানের হাতে মোবাইলটা দিল। বাবান অবাক হয়ে একটার পর একটা ছবি দেখতে লাগলেন – কোনওটায় বাচ্চাদের দিয়ে রাসায়নিক কিছু মেশাবার আদেশ দিচ্ছে এক সাধু, কোনোটায় এক সাধু দাড়ি-পরচুলা লাগিয়ে সাজছে, কোনোটায় এপ্রোন পরে মুখে মাস্ক লাগিয়ে একজন কেউ বিভিন্ন ওষুধের গুঁড়ো মেশাচ্ছে বাবাজীর ‘জলপড়া’য়, কোনোটায় দুটো বাচ্চা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। দেখতে দেখতে বাবানের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, একে একে সেই গম্ভীরভাব ছড়িয়ে পড়ল সবার মুখে। মায়ের মুখে কথা সরল না। অনেকক্ষণ বাদে মিমি বলল, “মোবাইলটা কিনে দেওয়ার একটা শর্ত ছিল, আমি যেন বাজে কাজে না ব্যবহার করি। কিন্তু আজ তোমরা যে একটা বাজে জায়গায় ভরসা করে গেলে, তার বেলা!”
কথা শেষ হতেই ছোট্ট মিতুল কিছু না বুঝেই ফিক করে হেসে ফেলল, আর সেটা ছড়িয়ে পড়ল বাকিদের মুখেও। তারপর মিমিকে কোলে বসিয়ে বাবান বললেন “প্রাউড অফ ইউ, বেটা।” আর দিদুন তার গাল টিপে বললেন “সত্যি তো, এ আমাদের অন্যায়ই হয়েছে। বুঝতেই পারিনি আমার দিদিভাইটা কত্ত বড় হয়ে গেছে!”

7 comments:

1
undefined undefined undefined

অণুগল্প - দেবলীনা দাস

Posted in


অণুগল্প


ম্যাজিকওয়ালা
দেবলীনা দাস




“একটা ম্যাজিক করে দাও তো দেখি।”

লোকটা কেলে হাঁড়ির মধ্যে একটা বাখারির টুকরো দিয়ে ভাত নাড়ছিল। মিনির গলার আওয়াজে মুখ তুলে চেয়ে সাদা দাঁতে হাসে, বলে, “কি ম্যাজিক দিদি?” টিয়া মিনির আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসে। এ গাঁয়ে নতুন সে, আজ প্রথম ম্যাজিকওয়ালার নাম শুনেছে। তার কাজেই আজ আসা এখানে। মিনি জোর করে এনেছে - ম্যাজিকওয়ালা নাকি তার বন্ধু।

পাশে উবু হয়ে বসা মিনি তখন বলে চলেছে, “আমার এই বন্ধুটা গো। অংককে কি ভয় পায়। গত বার টেনেটুনে পাশ করে গেছিল। এবার তো এক্কেবারে ফেল!”

লোকটি গোলগোল চোখ করে টিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রতিধ্বনি তোলে - “এক্কেবারে ফেল?” লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে টিয়ার। কিন্তু লোকটা বলে, “আমি ইতিহাসে ফেল করতাম। বাবরের বাবার নাম বিদ্যাসাগর লিখে একবার এইসা মার খেয়েছিলুম!” মিনি মুখে চুকচুক আওয়াজ করে বলে, “এ:, খুব বোকা ছিলে তো তুমি! বিদ্যাসাগর কারোর বাবা হতে যাবেন কেন? আর বাবরের বাবার নাম তো, বাবরের বাবার নাম - যাকগে, সে ছাড়ান দাও। একটা অংকে পাশ করার ম্যাজিক করে দাও তো।

ভাত টিপে দেখতে দেখতে মাথা নাড়ে লোকটা। বলে, “ও ম্যাজিক খুব কঠিন দিদি। সব চেয়ে কঠিন।”

বন্ধুর সামনে অপদস্থ হওয়ার আশংকায় রেগে যায় মিনি। বলে, “সব চেয়ে কঠিন কি করে হয়? তুমি তো সেদিন বললে, মরা জিনিস বাঁচিয়ে তোলার ম্যাজিকটা সব চেয়ে কঠিন। সেই যে যেদিন পায়রাটা নিয়ে এলাম তোমার কাছে?”

ভাতের হাঁড়ি ধরে নামাতে নামাতে লোকটা ফিরে চায়। কেমন দু:খ দু:খ মুখে হেসে বলে, “মরা মানুষ বাঁচানোর ম্যাজিক জানলে কি আমি এখানে এরকম চালচুলোহীন পড়ে থাকতাম দিদি? আমার আমিনা, ছোট্ট ইমরানকে ফিরিয়ে আনতাম না, ঘর করতাম না সুখে?”

মিনি আর টিয়া ভেবলে যায়। মরে যাওয়ার ব্যাপারটা ধোঁয়াশা তাদের কাছে - কেন মরে যায়, কোথায় চলে যায় মানুষ, তারা জানে না। জানে না আমিনা কে, ইমরান কে, জানে না ম্যাজিকওয়ালার ঘর কোথায়। পুকুরের পাশের এই দরমার কুঁড়েতে নাওয়াখাওয়া আর ঘুমের সময়টুকু ছাড়া তাকে পাওয়া যায় না। মিনি জ্ঞান হয়ে ইস্তক এরকমই দেখেছে। বড়দের মধ্যে কেউ কেউ রহিমমাস্টার ডাকতেন ম্যাজিকওয়ালাকে, কিন্তু সে নাম হারিয়ে গেছে কবে কোথায়। তারা ছোটরা ডাকে ম্যাজিকওয়ালা। জাদু টুপি, রঙিন রুমাল, জীর্ণ তাসের পাতার ম্যাজিকওয়ালা।

লোকটার চোখ এড়ায় না মেয়ে দুটোর ভেবলে যাওয়া। ভাতের মাড় গালতে গালতে সে বলে, “আমি একটা ম্যাজিক করতে পারি দিদি।

চুপসে যাওয়া মিনি একটু উৎসাহ ফিরে পায়। বলে, “বলো কি ম্যাজিক?”

ভাতের হাঁড়ি পাশে নামিয়ে রেখে গামছায় হাত মুছতে মুছতে লোকটা বলে, “আমি অংক শিখিয়ে পারি দিদি তোমায়। শিখবে?”




টিয়া অংক শিখেছিল ম্যাজিকওয়ালার কাছে। গঞ্জের অফিস থেকে ফিরে বাবা সন্ধেবেলায় তার পড়া নিয়ে বসতেন। তিনি পর্যন্ত অবাক হয়ে যেতেন টিয়ার উন্নতি দেখে। কিন্তু গোল বাঁধত ক্লাসে। অংকের দিদিমণির মেজাজ আর বকাকে যমের মত ভয় করত টিয়া, আর ভয়েই ভুল করত। ভুল করলে বকা খেত, সেই ভয়ে আরো ভুল। একটা ভুলভুলাইয়ায় আটকে পড়ত সে বারবার। চোখ মুছতে মুছতে একদিন তাই বলে ফেলেছিল ম্যাজিকওয়ালাকে - “আমি স্কুলে গেলেই সব অংক ভুল করে ফেলি ম্যাজিকওয়ালা। তোমার কাছে, বাড়িতে সব অংক পারি, কিন্তু সীমা দিদিমণিকে দেখলেই আমার সব ভুল হয়ে যায়। খুব ভয় করে গো।” 

ঝলমলে হেসে ম্যাজিকওয়ালা এক আঙুল তুলে বলেছিল, “আরে এইটা তো সহজ! ভয় কাটানোর ম্যাজিকটা সব চেয়ে সহজ। দাঁড়াও।”

টিয়ার হাতে একটা ছোট্ট কাগজের পুরিয়া দিয়েছিল ম্যাজিকওয়ালা। বলেছিল, “এ পুরিয়া কক্ষনো খুলবে না দিদি। তোমার বাড়িতে এ জিনিস থাকলে যেখানে যতই ভয় পাও, তোমার অংক - অংক কেন, ইতিহাসও - কক্ষনো ভুল হবে না।” ইতিহাসের নাম শুনে মিনিও নিয়েছিল একটা। বাবর আকবর কে কার বাবা সব তার গুলিয়ে যেত কিনা। সত্যি আর অত ভুল হত না তারপর থেকে। এক সময়ে অংককে ভালবাসতেও শিখে গিয়েছিল টিয়া। সেই পুরিয়ার ভরসায় অংকে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল কলেজে।

আজ বুজাইয়ের পরীক্ষার সকালে সেই পুরিয়া ছেলেকে ছুঁইয়ে দেয় টিয়া। বলে, “কিচ্ছু ভুল হবে না দেখিস। যতই ভয় পাস।” বুজাই ঢোঁক গিলে বলে, “হবে না মা?” টিয়া দৃঢ় মাথা নাড়ায়, “না হবে না। আমার হয়নি কখনো। এটা ম্যাজিক।”

লাফাতে লাফাতে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে যায় বুজাই। টিয়ার হাতের মুঠোয় ধরা থাকে ম্যাজিকওয়ালার পুরিয়া। খুললে দেখা যাবে, তার মধ্যে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একটা নাম - “টিয়া।” তার নিচে নতুন সংযোজন, টিয়ার হস্তাক্ষরে - “বুজাই।” নিজের ওপর বিশ্বাসটাই আসলে সব চেয়ে বড় ম্যাজিক।

1 comments:

1
undefined undefined undefined

রূপকথা - ধূপছায়া মজুমদার

Posted in


রূপকথা


শান্তিনগরের উপাখ্যান 
ধূপছায়া মজুমদার



বন্ধুরা, আজ এক মায়াময় রাজ্যের গল্প শুনবে? সে রাজ্যের চেহারাখানা ভারি মিষ্টি। তার মাথায় বরফঘেরা পাহাড়চুড়োর মুকুট, পায়ের কাছে খিলখিল হেসে লুটোপুটি খায় সাগরের নীল জলরাশি। সেখানে পথে দু'কদম হাঁটলেই দুপাশে দেখা মেলে ঘন সবুজ বনরাজির, আর বনে যে কত রকমের গাছপালার বাস, সে বলে শেষ করা যাবে না। যেমন প্রাণজুড়ানো সেসব গাছের ছায়া, তেমন মিষ্টি তাদের ফুলের সুবাস, আর ফলের স্বাদ? আহা মরি মরি, সে ফলের সোয়াদের টানে দূরদূরান্ত থেকে কত যে পাখি সারা বছর ধরে উড়ে আসে, তার কোনও হিসেব নেই। তাই তো পাখিদের কলতানে সে রাজ্যের আকাশ বাতাস ভরে থাকে সারাক্ষণ। এমন মায়াময় রাজ্যের নামটিও ভারি আরামের, শান্তিনগর।

শান্তিনগরের রাজা সোমদেব, রাণী চন্দ্রাবতী, আর তাঁদের একটিমাত্র কন্যারত্ন সোমাভা। রাজকন্যা সোমাভা বুঝি সার্থকনামা, তার প্রতিভা আর হৃদয়ের আভা যেন চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণের মতোই চারপাশ আলো করে রাখে। তীক্ষ্ম বুদ্ধি আর নরম মন দিয়ে সে জয় করেছে রাজ্যশুদ্ধু মানুষ আর অবোলা প্রাণীদের হৃদয়। ঘোড়াশালের রুগ্ন ঘোড়াটি বলো, বা দূর গাঁয়ের শয্যাশায়ী বৃদ্ধ সৈনিক, রাজকন্যার হাতের স্নিগ্ধ ছোঁয়া যে একবার পেয়েছে, তার মন ভাল হবেই হবে। 

প্রতি বছর বর্ষার শুরুতে রাজ্যে মহা সমারোহে অনুষ্ঠিত হয় বৃক্ষোৎসব। এটিই রাজ্যের প্রধান উৎসব। সেদিন সকাল থেকে সারা রাজ্যে বেজায় হৈ-চৈ। ভিন্‌রাজ্যের প্রজা, রাজা, শান্তিনগরে সেদিন সব্বার নিমন্ত্রণ। গান-বাজনা, নাচ, খাওয়া-দাওয়া, বনে বনে, পথের ধারে নতুন গাছের চারা লাগানো, এসবের বন্দোবস্ত তো থাকেই, সেইসঙ্গে থাকে বনজ সম্পদের বাৎসরিক হিসেবনিকেশ আর বনজ সম্পদের প্রদর্শনী। প্রকৃতিকে প্রাণ ঢেলে ভালবাসলে প্রকৃতি-মা দু'হাত ভরে তাঁর সন্তানদের কি কি উপহার দেন, তারই নমুনা সকলের সামনে এনে রাখা হয় সেদিন। 

সেবার, এই বৃক্ষোৎসবের দিনে, ভারি গোল বাধল। প্রদর্শনীর কিছুক্ষণ আগে, সবে তখন সম্বৎসরের বনজ সম্পদের হিসেব মেলানো শেষ হয়েছে, রাজামশাইয়ের কাছে এসে হাজির হলো দূর পশ্চিমের সাগরতীরের শক্তিধর রাজ্য বলীদেশের এক দূত। তার হাতে বলীরাজ বজ্রবাহুর একখানি চিঠি। চিঠি পড়ে জানা গেল বলীদেশের এখন ঘোর বিপদ। অবশ্য সে বিপদ ঘনিয়ে আসার কারণ সে রাজ্যের মানুষের হঠকারিতা। তারা যন্ত্র তৈরির নেশায় মেতেছিল বহু বছর ধরে। সকাল থেকে রাত অবধি মানুষের যা যা কাজ, সেসবের উপযোগী যন্ত্র বানাবে তারা, যাতে মানুষকে কেবল মাথা ছাড়া আর কোনো অঙ্গ চালনা করতে না হয়, এমনটাই ছিল তাদের স্বপ্ন। 

এতদিনে সে স্বপ্ন প্রায় সত্যিই হয়ে এসেছে, কিন্তু সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে থেকে সেদেশের লোকেরা খেয়াল করেনি, অত জটিল সব যন্ত্রের জ্বালানি পুড়ে যে ছাই তৈরি হচ্ছে, সেসব জঞ্জাল যাচ্ছে কোথায়? এত বছর ধরে সেইসব জঞ্জাল গিয়ে জমা হয়েছে সাগরের কোলে। সেখানে আবার রাজা অর্ণবতেজের সাম্রাজ্য। বলীদেশের জঞ্জালের দূষণে সাগররাজ্যের বাসিন্দারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সেখানে মহামারী দেখা দিয়েছে। ব্যস, রাজা অর্ণবতেজ মহা চটেছেন এই অনাচারে। একেই তিনি একটু রাগী মানুষ, প্রজাদের এতটুকু কষ্ট সইতে পারেন না, তাঁর সৈন্যদলও বিশাল, সৈন্যসামন্ত নিয়ে বলীদেশ আক্রমণ করে তিনি সেদেশের মানুষকে ভিটেছাড়া করেছেন। এহেন সঙ্কটমুহূর্তে বলীরাজের মনে পড়েছে শান্তিনগরে বেশ বড় বড় জঙ্গল রয়েছে। তারই মধ্যে কয়েকটা জঙ্গল পরিষ্কার করে রাজা সোমদেব যদি তাঁদের একটু থাকতে দেন, বড় উপকার হয় তবে। যন্ত্রপাতি সঙ্গেই আছে, রাজামশাই অনুমতি দিলেই বলীদেশের লোকেরা গাছপালা উপড়োতে লেগে পড়বে। 

বজ্রবাহুর চিঠি প'ড়ে তো রাজা সোমদেবের মাথায় হাত। যে গাছপালাকে তিনি প্রজাদের মতোই স্নেহ করেন, বজ্রবাহু কিনা তাদেরই হত্যার অনুমতি চেয়ে বসেছেন? এ অনুমতি দেওয়া যে অসম্ভব। সভাসদদের মুখেও অসন্তোষের ছায়া দেখতে পান রাজামশাই। রাজকন্যা সোমাভা এখন মাঝেমাঝে সভায় এসে রাজকার্য শেখে, সে চিঠির বয়ান শুনে কেঁদেই আকুল,

"বাবা, তুমি ওদের এক্কেবারে বারণ করে দাও। গাছপালা কেটে আমাদের এখানে কেউ বসত গড়ে না যে!"

"সে নাহয় বারণ করব মা, তুই আগে চোখের জল মোছ্‌। এত আবেগী হলে রাজ্য চালাবি কেমন করে?" সস্নেহে মেয়েকে ধমক দেন রাজামশাই।

"আমি রাজা। কেউ আমার কাছে সাহায্য চাইলে তাকে কি আমি খালি হাতে ফেরাতে পারি? বলীরাজকে বরং সাগরতীরের নবগ্রামে থাকার বন্দোবস্ত করে দিই, কি বলিস মা? মহারাণী, মন্ত্রীমশাই, তোমাদেরই বা কি মত?"

"হ্যাঁ মহারাজ, সেটাই ন্যায্য বিচার হবে।"মহারাণী, যিনি রাজ্যের অর্থমন্ত্রীও বটে, সম্মতি জানালেন।

"নবগ্রাম তো বহু বছর ধরে ফাঁকা পড়ে রয়েছে। ওখানে বসতি হলে জায়গাটাও জমজমাট হবে, আর বলীদেশের লোকের সাগরতীরে থেকেই অভ্যেস, চেনা পরিবেশ পেলে মানুষগুলো দেশছাড়া হওয়ার দুঃখ ভুলবে।" প্রধানমন্ত্রীও সায় দেন রাজার প্রস্তাবে। 

রাজার প্রস্তাব লেখা চিঠি তুলে দেওয়া হল বলীরাজের দূতের হাতে। সে ফিরে যাওয়ার পর বৃক্ষোৎসবের বাকি অনুষ্ঠান সমাধা হলো। 

দু'দিন পর, সকালে প্রহরী এসে জানাল, বলীদেশ থেকে দূত এসেছে আবার। এবার দূতের বয়ে আনা চিঠি পড়ে জানা গেল বজ্রবাহু ভয়ানক চটেছেন। চিঠির ছত্রে ছত্রে তাঁর হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। তাঁর বক্তব্য হল, সাগরতীরে বাস করা মহা ঝামেলার ব্যাপার, তাছাড়া অর্ণবতেজের সৈন্যরা অপেক্ষায় আছে, সাগরতীরে বলীদেশের বাসিন্দাদের দেখতে পেলেই আবার আক্রমণ করবে। তার চেয়ে বরং সোমদেব তাঁর রাজ্যের সবসেরা শান্তিবন বলীরাজকে উপহার দিন, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি যুবরাজ বীরবাহুর সঙ্গে শান্তিনগরের রাজকন্যা সোমাভার বিবাহ দেবেন। শান্তিবনের গাছপালা কেটে সেখানে প্রতিষ্ঠা হবে বজ্রনগরী, রাজকন্যা সোমাভাকেও বিবাহের পরে দূরদেশে যেতে হবে না। কিন্তু সোমদেব এই প্রস্তাবে রাজি না হলে বলীরাজের সৈন্যরা জোর করে শান্তিবন দখল করবে।

প্রস্তাব শুনেই গর্জে উঠলো সোমাভা, "এত বড় সাহস! আমার বিবাহের বিনিময়ে শান্তিবনের দখল নিতে চায়? আমাদের সাধের শান্তিবন ধ্বংস করবে, এত স্পর্ধা! বাবা, অনুমতি দাও, আমার বাহিনী নিয়ে এক্ষুণি যাব শান্তিবন রক্ষা করতে।"

মল্লাচার্য প্রভাসের নেতৃত্বে সোমাভা আর তার সখীরা মিলে রাজ্যের যত কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে গড়ে তুলেছে সবুজ-বাহিনী। মল্লযুদ্ধ, লাঠি, ছোরা থেকে শুরু করে দড়ির ফাঁস, আত্মরক্ষার সবরকম কৌশল তারা নিয়মিত অনুশীলন করে। যেকোনো বিপদে এগিয়ে যেতে এরা প্রস্তুত। 

বজ্রবাহুর প্রস্তাবে রাজামশাইও যারপরনাই রেগে গিয়েছেন। তিনি এমনিতে নির্বিরোধী মানুষ, তবে রেগে গেলে মূর্তিমান বিভীষিকা। অনুমতি দিতে গিয়েও তিনি থেমে গেলেন, মনে পড়ল বলীরাজের বাহিনীর মূলধন হল যন্ত্রশক্তি। বন দখলের লড়াইয়ে তারা যেসব যন্ত্র নিয়ে আসবে, তাতে যদি সবুজ-বাহিনীর কারও প্রাণসংশয় হয়? 

তাঁকে আশ্বস্ত করলেন মল্লাচার্য প্রভাস, "আপনি অনুমতি দিন মহারাজ। আমাদের বাহিনী লড়বে বুদ্ধি আর হৃদয় দিয়ে। এই দুই শক্তির খোঁজ যন্ত্রের জানা নেই।"

তবুও ঠিক হলো রাজার সৈন্যদল তৈরি থাকবে, সবুজ-বাহিনীর বিন্দুমাত্র বিপদ বুঝলেই তারা ঝঁপিয়ে পড়বে শত্রুদের ওপর। 

এরপর শান্তিবনের শান্তি খানখান করে সেখানে বেজে উঠলো রণদামামা। সবুজ-বাহিনী তাদের সম্বল নিয়ে ঢুকে পড়েছে গহন বনে, এদিকে গাছ-কাটা যন্ত্র, আগুন-ঝরানো যন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে এগিয়ে আসছে বলীদেশের সৈন্যরা, তাদের সঙ্গে আসছে তাদের দেশের সেরা আবিষ্কার যন্ত্রমানব, যার চেহারা দেখে তাকে যন্ত্রদানব বললেও ভুল হবে না। দশাসই চেহারার সেই যন্ত্রে জ্বালানি ভ'রে তাকে একবার চালু করে দিলে সে সামনে থাকা গাছপালা, পাথরের চাঁই, মানুষ, সবকিছুকে নিমেষে গুঁড়িয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে চলে। তার গতিকে সামলানোর জন্য তার পেটের ভেতরে দুটো মানুষকে ঢুকে কলকব্জা নাড়তে হয়। শান্তিবনের গাছপালা ভেদ করে সূর্যের আলোও ভাল ক'রে ঢুকতে পারে না, সেখানে এই অতিকায় যন্ত্র কেমন করে ঢুকবে? তাই তাকে রেখে আসতে হল রাজপথে। সেখানে পাহারায় রইলএকদল সৈন্য। বাকিরা গাছপালা সরিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে লাগল। কিছুদূর যেতেই অজানা কোণ থেকে উড়ে এল পাথরের টুকরো। কিছু সৈন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এমনি করে তারা একটু এগোয়, অমনি কারা যেন তাদের লক্ষ্য ক'রে পাথর, নয়ত গাছের ভাঙ্গা ডাল ছুঁড়ে মারে। সৈন্যদের হাতে আগুন-ঝরানো যন্ত্র আছে ঠিকই, তাতে ঠিক জায়গায় চাপ দিলেই আগুন ছিটকে বেরিয়ে চারপাশ জ্বালিয়ে ছারখার করে দেবে, তবে জঙ্গলে নিশানা ঠিক না ক'রে আগুন ছুঁড়লে নিজেদেরই বিপদ। গাছপালায় আগুন জ্বলবে মুহূর্তের মধ্যে। তাই সৈন্যরা ঠিক করল আপাতত গাছ-কাটা যন্ত্র দিয়ে বড় বড় গাছগুলোকে কাটতে কাটতে এগোনো হবে। 

এই কথামতো যেই গাছ কাটতে যাওয়া, অমনি, এ কি কাণ্ড? প্রতিটি গাছকে জড়িয়ে ধ'রে দাঁড়িয়ে আছে একেকজন অরণ্যকন্যা! বনের সাজে সেজেছে তারা, গায়ে তাদের পাতার অলঙ্কার। তাই এতক্ষণ তাদের ঠাহর করা যায়নি। থমকে গিয়েছিলো সৈন্যরা, তাদের হুঁশ ফেরালেন সেনাপতি ত্রিবিক্রম। তাঁর নির্দেশে অরণ্যকন্যাদের ঠেলে সরিয়ে গাছগুলোর গায়ে গাছ-কাটা যন্ত্র চেপে ধরল তারা। মুহূর্তে জ্বলে উঠল অরণ্যকন্যাদের চোখ। বনসাজে সজ্জিতা রাজকন্যা সোমাভা আর তার সখীর দল অরণ্যকন্যার রূপ ছেড়ে এবার ধরল মল্লযোদ্ধার রূপ। নিপুণ কৌশলে তারা সৈন্যদের ধরাশায়ী করতে লাগল। বাকি সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে থাকা কিশোরের দল। এতক্ষণ তারাই আড়াল থেকে সৈন্যদের দিকে পাথর ছুঁড়ছিল। এখন তাদের হাতে রয়েছে এক ওষধি লতা, যার পাতার রস একবার গায়ে লাগলে গাত্রদাহ হবে তিনদিন ধ'রে। সেই পাতার রসের জ্বালায় আর অরণ্যকন্যাদের কৌশলী আঘাতে কাবু হয়ে পড়ল সৈন্যদল।

ওদিকে শোনা গেছে যন্ত্রদানবের হুঙ্কার। তাকে নিয়ে বাকি সৈন্যরা জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে, গাছপালা তছনছ করে সে এগোচ্ছে। তার হুঙ্কার রাজবাড়ি থেকেও শোনা গেছে, সেই হুঙ্কার শুনে শান্তিনগরের সৈন্যরা ছুটে আসছে শান্তিবনের দিকে। 

দানবের হুঙ্কার শুনে সোমাভার বুকে কাঁপন ধরে। তাদের লড়াই বুঝি এবার থেমে যায়! যন্ত্রের কাছে মানুষ যে বড় অসহায়। সঙ্কটমুহূর্তে তার মনে পড়ে গুরু প্রভাসের উপদেশ। হ্যাঁ, বুদ্ধি আর হৃদয় দিয়ে জিততে হবে এই অসম লড়াই। এদিকে আকাশ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে, মুহূর্মুহূ মেঘের গর্জন শুরু হয়েছে। যেকোনো সময়ে বরষা নামবে। ঈশ্বর আর প্রকৃতি-মা-কে স্মরণ ক'রে সে চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বেলে ফেলে, ছুঁড়ে দেয় সামনে পড়ে থাকা গাছেদের ধ্বংসস্তূপের ওপর।

"সই, এ কি করলি? সবাই মিলে ঝলসে মরব যে!" হতবাক সখী ইন্দ্রাণীকে আশ্বস্ত করল সোমাভা,

"মা আমাদের রক্ষা করবেন। আয়, হাতে হাত রেখে আমরা শেকল গড়ে দাঁড়াই। ওদের যন্ত্র আগুনের বলয় পেরিয়ে এলেও আমাদের শেকল ভাঙতে দেরী হবে, ততক্ষণে নিশ্চয়ই আমাদের সৈন্যরা এসে পড়বে।"

সবুজবাহিনী মানবশৃঙ্খল গড়ে দাঁড়াল আগুনের দেওয়ালের এপারে। এগিয়ে আসা যন্ত্রদানব আর সবুজবাহিনীর মাঝে নেচে নেচে বাড়ছে আগুনের লেলিহান শিখা। বুঝি সমস্ত জঙ্গলটাকেই সে গিলে খাবে এক্ষুণি। বলীরাজের সৈন্যরা আর এগোতে পারছে না ঠিকই, কিন্তু আগুন যে বেড়েই চলেছে! সোমাভা একমনে ডেকে চলে প্রকৃতিমা -কে।

শেষে বুঝি মা তার ডাক শুনলেন। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল। পাশের মানুষকে দেখতে পাওয়া যায় না, এমন তার তেজ। সেই প্রলয়ঙ্কর বৃষ্টিতে নিভে গেলসর্বগ্রাসী আগুনের শিখা, পেটের ভেতর জল ঢুকে অকেজো হয়ে গেল যন্ত্রদানব। বলীদেশের সৈন্যরা পালাতে গিয়ে বন্দী হলো শান্তিনগরের সৈন্যদের হাতে। আর রাজকন্যার সবুজবাহিনী? তারা তখন নিজেদের বাহাদুরিতে নিজেরাই অবাক!

সব ভাল গল্পেরই শেষভাগে যেমন রাশি রাশি খুশি এসে জড়ো হয়, এই গল্পের শেষেও তেমনটাই হল। বজ্রবাহু তাঁর দলবল নিয়ে রাজা সোমদেবের দরবারে গিয়ে পৌঁছলেন। তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। রাজ্যের জঞ্জাল জড়ো করে সাগররাজ্যে ফেলে আসা, শান্তিবন ধ্বংস করতে চাওয়া , এসব যে কী ভয়ানক অন্যায়, বলীরাজ তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি রাজার কাছে ক্ষমা চেয়ে সাগরতীরের কিছুটা জমি ভিক্ষা চাইলেন। বলীদেশের মায়েরা তাদের কোলের বাছাদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে, তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই যে!

রাজা সোমদেব ভারি খুশি হয়ে জমির বিলি বন্দোবস্ত করে দিলেন। ঠিক হল যতদিন না বজ্রনগরীর বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে, ততদিন শান্তিনগরের মানুষজন তাদের বাড়িতে বলীদেশের একেকটি পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করে দেবে।

বলীরাজ সেই যে গল্পের শুরুর দিকে তাঁর পুত্র বীরবাহুর সঙ্গে রাজকন্যা সোমাভার বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন , সেটি নিয়েও আলোচনা শুরু হলো। তবে তাঁরা তো কিছুটা অন্যায় করেছেন, তাই ঠিক হলো তাঁদের অল্প শাস্তি পেতে হবে। শাস্তির মেয়াদ শেষ হলে তবে বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে ভাবা যাবে। কি সেই শাস্তি? 

রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে বেশ খানিকটা অঞ্চল ছিল ঊষর, পাথুরে, ভারি রুক্ষ এলাকা। সেখানে না ছিল সবুজ গাছপালা, না ছিল নদীর জলের ধারা। বজ্রবাহু আর তাঁর পুত্র বীরবাহু সেখানে গিয়ে সবুজের চাষ করবেন, ঊষর ভূমিকে উর্বর করে তুলবেন, এই হল তাঁদের শাস্তি। তা, আগামীকাল শাস্তির মেয়াদ ফুরোচ্ছে, রাজা সোমদেব মন্ত্রীদের নিয়ে সেখানে কাল যাচ্ছেন নিজের চোখে সবকিছু দেখবেন বলে। তোমরাও যাবে নাকি? যাবে তো বলো, রাজামশাইয়ের কাছে গিয়ে আমাদেরও সঙ্গে নেওয়ার আর্জিখানা জানিয়ে রাখি।।

1 comments: