ধারাবাহিক
সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে - তিন
অমিতাভ প্রামাণিক
- একী রে, গোপাল, তোর এই হাল কী করে হল, বাবা? গালময় না কামানো দাড়ি, চুল উস্কোখুস্কো, পরণের জামা মনে হচ্ছে কতদিনের না কাচা। বলি, ব্যাপারটা কী?
- আর বলো না পিসি, আমি আর বেশি দিন নেই।
- ও আবার কী কথা বাবা! মরুক তোর শত্তুর।
- শত্তুর না গো পিসি, আমারই দিন ঘনিয়ে এসেছে। এক গণক হাত দেখে বলল।
- কোন গণক?
- সে তুমি চিনবে না। খোদ কাশী থেকে পাশ দিয়ে এসেছে। আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র নখদর্পণে।
- বলিস কী? সত্যি সত্যি সে তোকে এই কথা বলল?
- তবে আর বলছি কী, পিসি! বলেছে আর মেরেকেটে কটা মাত্র দিন।
- আহা রে বাছা, তোর বউটার কী গতি হবে রে? ঐটুকু একরত্তি ছেলে তোর, কাজকম্মোও তো কিছু করে না। তা এর কোনো বিধান দেয় নি সেই গণক?
- মৃত্যুর কি বিধান হয় গো, পিসি? নিয়তির মার কেউ খণ্ডাতে পারে, কখনো দেখেছ?
- তাই তো। সেও তো ঠিক। ভগবানের মার, দুনিয়ার বার। তো তুই এখন অবেলায় এই পাড়ায়? কারো বাড়ি যাচ্ছিলি বুঝি?
- কার বাড়ি আর যাব পিসি? তোমার এখানেই আসছিলাম।
- আমার এখানে! হঠাৎ -
- আর কদিনই তো মাত্র আছি, পিসি। ভাবলাম তোমার এখানে চাড্ডি প্রসাদ যদি পেয়ে যাই।
- এই বেলা তিনটেয়? একটু আগে আসতে পারলি নে? আমার তো খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে, বাবা। ঠিক আছে, তুই এক কাজ কর, কাল আয়। গণক এই সব বলেছে, পিসির হাতে দুটো ভাত খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে, তো কালকের দুপুরের খাওয়াটা এখানেই খাস। তবে বাবা, আমি বিধবা মানুষ, আমার তো নিরামিষ খাবার, ভাত-ডাল-তরকারি। তোর রুচবে তো মুখে?
- কেন রুচবে না, পিসি? তোমার রান্নার হাত যে এত ভাল, তা কি আমি জানিনে? আর এই যে বাড়িতে এত যত্ন করে শাকসব্জি লাগাও, এর যে কী স্বাদ –
- কাল আসিস তবে। বেশি দেরি করিস নে আবার।
- না গো, পিসি। আমি বেলায় বেলায় চলে আসব।
পিসিটি গোপালের নয়, রাজার। রাজা গোপালের সঙ্গে বাজি ফেলেছেন, হাড়কিপটে পিসির হাত গলিয়ে যদি দশটা টাকা সে কোনভাবে আনতে পারে, তবে তিনি একশো টাকা উপহার দেবেন। গোপাল তার বয়স্য, রাজা তাকে বিশেষ স্নেহ করেন। গোপালের উপস্থিত বুদ্ধি তুখোড়, তার অনেক প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। অগাধ সম্পত্তির মালিক এই বিধবা পিসিটি অবশ্য কৃপণ-শিরোমণি, একটা ফুটো পয়সা তার হাত দিয়ে গলে না। তার কাছ থেকে দশ টাকা কেন, দশ পয়সাও আদায় করা অসম্ভব। মহারাজ নিশ্চিত গোপাল এবার ধরাশায়ী হবে।
পরদিন গোপাল হাজির সকাল সকাল। পিসি শাক-ভাত-লাউঘন্ট বেড়ে দিতেই গোপাল হাঁ হাঁ করে উঠল, না গো পিসি, আমি তো তোমার প্রসাদ পেতে এসেছি। তুমি আগে খেয়ে নাও। পাতে যা থাকবে, আমি তাই খাব। তুমি বরং তেল-গামছা দাও, আমি ততক্ষণে পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে আসি।
স্নান করে এসে পিসির এঁটো থালায় খেতে বসল গোপাল।
- কেমন হয়েছে রান্না?
- খাসা হয়েছে, পিসি।
- আর কিছু নিবি?
- এ কটা আগে খেয়ে নিই। তারপর পেটে জায়গা থাকলে নেব।
- ঠিক আছে। ভাল করে খা।
পাঁচ মিনিট পরে আবার পিসি জিজ্ঞেস করলেন, কী নিবি বল।
- লাউ-চিংড়িটা দারুণ হয়েছে, পিসি।
- চিংড়ি? চিংড়ি কোথায় পাব গোপাল? লাউয়ের নিরামিষ ঘন্ট রেঁধেছি বাবা। বিধবা মানুষ, আমি কি চিংড়ি-টিংড়ি খেতে পারি? লোকে শুনলে বলবে কী?
- না গো পিসি, লাউ চিংড়িই। দারুণ হয়েছে। কী অদ্ভুত রান্না তোমার, পিসি!
গোপালের উচ্ছ্বাস যেন থামতেই যায় না।
- চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলছিস কেন? বলছি না লাউয়ের ঘন্ট। চিংড়ি টিংড়ি নেই। খেতে কি লাউ চিংড়ির মত লাগছে নাকি?
- আরে লাউ চিংড়ি কি শুধু লাউয়ের ঘন্টর মত লাগবে? দেখবে এস।
পিসি এসে দেখল গোপালের পাতে পরিষ্কার কয়েকখানা কুচো চিংড়ি!
- চিংড়ি কী করে এল রে, গোপাল? আমি তো এসব খাইনা। পুকুরের জলে রান্না, জলের সঙ্গে কি দু-একটা –
- দু-একটা কী গো পিসি, আমার পাতেই তো দশ বারোটা। তুমিও বেশ অনেকগুলোই খেয়েছ তার মানে।
- থাম থাম, এত জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলিস নে। বলছি না, আমি বিধবা মানুষ, আমিষ ছোঁয়াও আমার পাপ। পাড়া প্রতিবেশী শুনলে কী বলবে?
- সে আমি কী জানি? দেখছই তো লাউয়ের মধ্যে এতগুলো কুচো চিংড়ি এই থালায়।
- তুই বাপু আর কথা বাড়াস নে। এই নে চারটি পয়সা। মুখ বন্ধ কর, বাবা।
- মুখ কী করে বন্ধ রাখবো, পিসি? কাল তো মহারাজ আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, পিসির বাড়ি কী খেলে? আমি কী বলব?
- তোর আগ বাড়িয়ে বলতে যাওয়ার কী দরকার?
- আমি মিথ্যে বলতে পারব না, পিসি। মিথ্যে কথা বলা মহাপাপ। মহারাজ শূলে চড়াবেন।
- এদিকে আমার নামে যে ঢি ঢি পড়ে যাবে! সে বেলা! তোকে খেতে বলে কী পাপ করলাম, গোপাল! এই নে, পুরো চারানাই নে।
- চারানা দিয়ে পাপস্খালন হয়, পিসি? ভগবান শুনলে কী বলবে? বলবে, গোপাল, তুই মাত্তর চারানার জন্যে এত বড় মিথ্যে কথা বললি? নে, এবার পুন্নাম নরকে যা। অন্তত পঁচিশটা টাকা না পেলে –
দশ টাকার কমে রফা হল না। গামছায় লুকিয়ে আনা কুচো চিংড়িগুলো কাজে লেগে গেল বেশ। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় গোপালের কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে একশো টাকা বের করে দিলেন।
কৃষ্ণচন্দ্রের বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ, শৌখিন মানুষ। মাত্র আঠার বছর বয়সে তিনি নদীয়ার রাজা হয়েছেন। বাবা রঘুরাম রায় ছিলেন জমিদার। আদিশূরের কনৌজ থেকে আনা পাঁচ ব্রাহ্মণের একজন ভট্টনারায়ণের পুত্র নীপ থেকে অধস্তন একাদশ পুরুষ ছিলেন কামদেব। তার পুত্র জমিদার বিশ্বনাথ চতুর্দশ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লী গিয়ে সম্রাটের কাছ থেকে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন। তার অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ কাশীনাথ ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিক্রমপুরের কাছে এক বিরাট ভূখণ্ডের প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। দিল্লীর মসনদে তখন সম্রাট আকবর। বাংলার নবাব দেশীয় জমিদারদের শায়েস্তা করতে দিল্লীতে দরবার করলে আকবরের সেনা বাংলা আক্রমণ করে। তাতে কাশীরাম সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে গৃহত্যাগ করে। যুদ্ধে কাশীনাথ নিহত হলে তার স্ত্রী হরেকৃষ্ণ সমাদ্দার নামে একজনের বাড়ি আশ্রয় পান, সেখানে তার পুত্র রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করে। নিঃসন্তান হরেকৃষ্ণ রামচন্দ্রকে তার ক্ষুদ্র জমিদারি দিয়ে যান। রামচন্দ্রের চার পুত্রের বড়টির নাম দুর্গাদাস, তিনি লেখাপড়া শিখে ও যুদ্ধে নৈপুণ্য দেখিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে মজুমদার উপাধি পান ও ভবানন্দ মজুমদার নামে পিতামহ কাশীনাথের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চোদ্দটা পরগণার অধীশ্বর হন। ভবানন্দের তিন ছেলে, তারা সবাই দিল্লীর বাদশাহের আনুকূল্য পেয়ে জমিদারির এলাকা আরো বাড়িয়ে তোলেন। মধ্যমপুত্র গোপালের কর্মদক্ষ কনিষ্ঠ পুত্র রাঘব পিতামহের প্রাসাদ ত্যাগ করে রেউই নামে এক জায়গায় রাজধানী স্থাপন করে। তার পুত্র রুদ্র ১৬৭৬ সালে বাদশা আওরঙ্গজেবের ফরমানবলে আরো পরগণা লাভ করেন। কৃষ্ণের উপাসক রুদ্র রাজধানী রেউই-এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন কৃষ্ণনগর। রুদ্রের পুত্র রামজীবন, তার পুত্র রঘুরাম হচ্ছে কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা। ১৭১০ সালে কৃষ্ণচন্দ্রের জন্ম, পিতার অকালমৃত্যুতে তিনি রাজা হয়ে বসেছেন।
কৃষ্ণচন্দ্র সদাশয় উদার-হৃদয় পুরুষ। তার নদীয়ার রাজত্ব উত্তরে মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমে ভাগীরথী, দক্ষিণে গঙ্গাসাগর, পূর্বে ধূলিয়াপুরের বড়গঙ্গা। প্রায় সাড়ে পনের হাজার বর্গমাইল জুড়ে এই রাজ্য সুইজারল্যান্ড দেশের চেয়ে কিছুটা বড়ো। এর মধ্যে আছে ৪৯টি পরগণা ও ৩৫টি কিসমৎ। বড় বড় জায়গাগুলো পরগণা, যেমন নবদ্বীপ, উখড়া, সুলতানপুর, গয়েশপুর, মহিষপুর, শান্তিপুর, চারঘাট। অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট জায়গাগুলো কিসমৎ, যেমন হালিশহর, কলকাতা, পলাশি, বাগমারি, বালিয়া। গদিতে বসার সময় এর মোট সংখ্যা ছিল পঁচাত্তরটা, কৃষ্ণচন্দ্র নিজের যোগ্যতায় তার সাথে আরো ন’টা বাড়িয়েছেন।
কৃষ্ণচন্দ্রের যখন জন্ম হয়, বাংলার অবস্থা বেশ চিত্তাকর্ষক। বাংলার দেওয়ান তখন মুর্শিদকুলি খাঁ, তার ওপরেই দায়িত্ব এখানকার রাজস্ব আদায়ের। বাণিজ্যের কারণে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়মে জাঁকিয়ে বসেছে ইংরেজরা, চন্দননগরের ফোর্ট ডরলিয়ান্সে ফরাসীরা, চুঁচুড়ার ফোর্ট গুস্তাভাসে ওলন্দাজেরা।
মুর্শিদকুলি আদতে ছিলেন ব্রাহ্মণসন্তান, মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে শতাব্দীর শুরুতেই, ১৭০১ সালে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত হয়েছেন। বছর তিনেক পরেই ঢাকা থেকে তার কর্মক্ষেত্র সরিয়ে এনেছেন মুকসাদাবাদে, আর এসেই সেই জায়গার নাম বদলে নিজের নামে রেখেছেন মুর্শিদাবাদ। শুধু দেওয়ানই নয়, বছর দশেকের মধ্যে তিনি হয়েছেন বাংলার নবাবও। তার প্রতিপত্তি প্রবল, কাশিমবাজারে ইংরেজদের কুঠি বানানোর পরিবর্তে তাদের কাছ থেকে আদায় করেছেন পঁচিশ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে মুর্শিদাবাদে খোলা হয়েছে টাঁকশাল। ইংরেজরা তাকে সমীহ করে চলে, নিজেদের বাণিজ্য বজায় রাখতে তারা দিল্লী থেকে ফরমান আনিয়ে নিয়েছে, তার ফলে প্রতিপক্ষ ফরাসী আর ওলন্দাজদের থেকে তারা বেশ এগিয়ে, যদিও মুর্শিদকুলি সেই ফরমানকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নিজের প্রতিপত্তি বজায় রেখেছেন তাদের ওপর। তার কথার নড়চড় হবার উপায় নেই।
রাজস্ব বাড়াতে মুর্শিদকুলি বাংলায় অনেক নতুন নিয়ম জারি করেছেন, আর তার ফলে বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় হিন্দু জমিদাররা। মুর্শিদাবাদের যাবতীয় হিন্দু মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদের ইঁট পাথর দিয়ে নিজের জন্যে কাটরায় নিজের স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়েছেন। হিন্দুরা সঙ্গত কারণেই তার ওপর ক্ষুব্ধ।
অবশ্য সবাই নন। মানিকচাঁদ নামে এক জৈন ব্যবসায়ী বাংলার নামজাদা ধনী। মুর্শিদকুলি যখন বাংলার নবাব হলেন, মানিকচাঁদ তার ব্যবসা দেখাশুনা করতে দিলেন নিজের ভাইপো ফতেচাঁদকে। মুর্শিদকুলি এই ফতেচাঁদকে নিয়োগ করলেন দেওয়ানী মহাজন বা ব্যাঙ্কার হিসাবে, তাকে শিরোপা দেওয়া হলো জগৎশেঠ অর্থাৎ বিশ্ববণিক। সমগ্র বাংলায় যা রাজস্ব সংগৃহীত হতো, তার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জমা পড়ত জগৎশেঠের কাছেই।
মানিকচাঁদ ১৭৩২ সালে আর ফতেচাঁদ ১৭৪৪ সালে মারা যান, ব্যবসার দায়িত্ব স্থানান্তরিত হয় ফতেচাঁদের দুই নাতি শেঠ মহাতব রাই আর মহারাজা স্বরূপচাঁদের ওপর। তাদের দুজনকেও জগৎশেঠ নামেই ডাকা হতে থাকে।
মুর্শিদকুলি অবশ্য ততদিন বেঁচে ছিলেন না, তিনি মারা গেছেন কৃষ্ণচন্দ্র রাজা হবার বছর তিনেক আগেই, ১৭২৫ সালে। পারস্যের খোরাসান অঞ্চলের উত্তরপুরুষ তার জামাই সুজা খাঁ হয়েছেন বাংলার নবাব। মির্জা মহম্মদ নামে এক তুর্কীর দুই ছেলে হাজি আহমেদ আর আলিবর্দী খাঁ সুজা খাঁর প্রিয়পাত্র। হাজি আহমেদ সুজার আলবোলা বয়ে বেড়ায় আর আলিবর্দী সেনাবাহিনীর ফাইফরমাস খাটে। কিন্তু হাজির প্রভাব নবাবের ওপরে এতটাই যে সে হয়ে গেল নবাবের পরামর্শদাতা, আর তার পরামর্শে ১৭২৯ সালে তার ভাই আলিবর্দী খাঁকে করে দেওয়া হলো বিহার প্রদেশের রাজ্যপাল। মাত্রই বছরখানেক হয়েছে তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে আসীন হয়েছেন। আর সেই বছরেই জন্মেছেন আলিবর্দীর পছন্দের ছোট ভাইপো জৈনুদ্দিনের ছেলে মির্জা মহম্মদ, যাকে সবাই সিরাজুদ্দৌলা বা সিরাজ বলে ডাকে।
চোদ্দ বছর শান্তিতে রাজ্য চালিয়ে সুজা খাঁ ১৭৩৯ সালে দেহ রাখলে তার ছেলে সরফরাজ খাঁ বিপদে পড়ে গেলেন বাপের প্রিয়পাত্রদের চালিয়াতিতে। আলিবর্দীকে বিহার প্রদেশের দেওয়ান করে দেওয়ার পেছনে জগৎশেঠের হাত ছিল। সরফরাজ প্রকৃতিতে অলস ও চরিত্রহীন, দু-হাতে পয়সা ওড়াতে ভালবাসে। টাকাকড়ি নিয়ে ঝামেলা তো হচ্ছিলই, শেঠদের বাড়ির মেয়েদের প্রতি কু-দৃষ্টি দেওয়ায় জগৎশেঠ চাইছিলেন এই বংশ যেন রাজ্য চালাতে না পারে, তাই তলে তলে ঘনিষ্ঠতা হয় হাজি আর ভাই আলিবর্দীর সাথে। হাজি তখন মুর্শিদাবাদে আর আলিবর্দী পাটনায়। হাজির যুদ্ধে পটুত্ব নেই, সেই সুযোগে আলিবর্দী ভাইদের শত্রুদের বিনাশ করার অছিলায় গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজকে হারিয়ে মুর্শিদাবাদে জাঁকিয়ে বসলেন। সেটা ১৭৪১ সাল।
আলিবর্দী অবশ্য শান্তিপ্রিয় মানুষ, রক্তপাত একেবারে পছন্দ করতেন না। ইচ্ছে করলেই সরফরাজ আর তার অনুগামীদের মুন্ডু কেটে লালদিঘির জলে ভাসিয়ে দিতে পারতেন, সাধারণত মুসলমান শাসকেরা রাজ্যদখল করলে সেই রকম কিছুই করতো – অনেকসময় নিজের জন্মদাতা বাপকেও কেটে ফেলতে দ্বিধা করতো না – কিন্তু আলিবর্দী তার ধার দিয়েও গেলেন না। ওদেরকে নজরবন্দী রেখে রাজ্যশাসনে মন দিলেন।
কিন্তু তিনি শান্তি চাইলেই তো শান্তি তাকে চাইবে, এমন কোন কথা নেই। রাজ্য দখলের পরের বছরেই মূর্তিমান বিভীষিকার মত হাজির হল মরাঠা দস্যুর দল। মোগলদের যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে মারাঠারা চৌথ নামে রাজস্বের এক চতুর্থাংশ যে কর তাদের প্রাপ্য বলে স্বীকার করিয়ে নিয়েছিল, তা মোগলদের অধিকৃত সমস্ত জায়গা থেকেই আদায়ের ছলে আক্রমণ করতে ধেয়ে এলো শস্যভাণ্ডার বাংলায়।
দশ বছর ধরে চললো এই নিরন্তর অত্যাচার। মহারাষ্ট্রের পূবদিক পেরিয়ে উড়িষ্যা হয়ে তারা ঢুকে পড়তো বাংলার মধ্যে, আর একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে লুঠপাট করত ঘরবাড়ি। তাদের আক্রমণে ছারখার হয়ে গেল রাঢ় বাংলা। ভাগীরথী পেরোলেই এপারে কলকাতা, মানে ইংরেজদের ঘাঁটি, আর নদীয়া, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারি।
আলিবর্দী সহজে হার মানার পাত্র নন, তিনি বর্গীদের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধে নিরত রইলেন। আর এই যুদ্ধের খরচাপাতি তোলার জন্যে রাজশাহী, দিনাজপুর আর নদীয়ার জমিদারদের কাছে পত্র পাঠালেন। আলিবর্দীর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন নন্দকুমার, তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে পাঠালেন বারো লাখ টাকা নজরানার বিল। নদীয়া এলাকায় বিশাল হলে কী হবে, রাজস্ব উৎপাদনে তেমন সড়গড় নয়। এলাকায় প্রচুর পতিত ও নিষ্কর জমি। কোনোক্রমে বারো লক্ষ টাকা জোগাড় করে কৃষ্ণচন্দ্র পাঠালেন আলিবর্দীর রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী সাজোয়াল সুজন সিং-এর হাতে, সে ব্যাটা টাকাটা আত্মসাৎ করে দিলো। আলিবর্দী খবর পেলেন, নদীয়ার জমিদার টাকা দেয় নি, ফলে কৃষ্ণচন্দ্রকে মুর্শিদাবাদের কারাগারে বন্দী করা হলো।
বেশিদিন অবশ্য কারাগারে থাকতে হয় নি। গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় আলিবর্দী ধর্মপ্রাণ কৃষ্ণচন্দ্রের নানা সদ্গুণের পরিচয় পান। রাজা উর্দুভাষায় রামায়ণ-মহাভারতের অংশ অনুবাদ করে নবাবকে শুনাতেন, তাতে নবাব খুব খুশি হতেন। এছাড়াও কৃষ্ণচন্দ্রের বন্দী হওয়ার খবরে রাজ্যজুড়ে হিন্দুসমাজে উদ্বেগের খবর পাওয়া যায়, সে খবর পৌঁছায় আলিবর্দীর কানেও। তিনি কৃষ্ণচন্দ্রকে মুক্তি দেন বার্ষিক পঁচিশ হাজার টাকা অতিরিক্ত কিস্তি দেবার প্রতিশ্রুতিতে।
তাতে অবশ্য বর্গী সমস্যার সমাধান হলো না। দিল্লীর শাসন শিথিল, আলিবর্দী তাদের সাথে এঁটে উঠছেন না, গঙ্গার পশ্চিমের জমিদাররা মারাঠাদের কর দেওয়া শুরু করেছে। বড় বড় জমিদাররা পালাচ্ছে দেশ ছেড়ে। কৃষ্ণনগরের অনতিদূরে অগ্রদ্বীপ, পাটুলি জ্বলছে বর্গীদের মশালের আগুনে। মাত্র পঁচিশ মাইল দূরে দাঁইহাটিতে বিরাট চম্পূ বা শিবির স্থাপন করে গেড়ে বসেছেন বর্গীদের নেতা স্বয়ং ভাস্কর পণ্ডিত। সেতু পেরোলেই এপারে পলাশি, নবদ্বীপ। মুর্শিদাবাদও বেশি দূরে না, আলিবর্দী তার পরিবারের লোকজনদের সরিয়ে দিয়েছেন গোদাবাড়ি গ্রামে। কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান রঘুনন্দনের বাস্তুভিটে যে গ্রামে, সেই চাঁড়ুল আর তার পাশের গ্রামগুলো সব শ্মশান। পলাশিতে বর্গীরা থানা বসিয়ে দিয়েছে। যে কোনোদিন তারা কৃষ্ণনগরে হানা দিলেই কৃষ্ণচন্দ্রের দফারফা। রঘুনন্দনের পরামর্শে রাজপরিবারের নিরাপত্তা রক্ষা করতে রাতারাতি রাজধানী উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো কৃষ্ণনগর থেকে ষোলো মাইল দূরে এক জলাশয়স্নিগ্ধ জঙ্গলঘন গ্রামে, তার নাম শিবনিবাস। কলকাতায় যখন মহাসমারোহে কাটা হচ্ছে মারাঠা ডিচ, কৃষ্ণচন্দ্রের নতুন রাজধানী রক্ষা করতে তার চারদিক ঘেরা হচ্ছে জলাশয় দিয়ে। যে জলা সেখানে আগেই ছিল, তার সাথে খাল কেটে পূবদিকে পদ্মার শাখানদী ইছামতী আর মাথাভাঙার সাথে মিলিয়ে দেওয়া হলো, পশ্চিমে তিনমাইল খাল কেটে মিলিয়ে দেওয়া হলো কৃষ্ণনগরের কাছে হাঁসখালি গ্রামের উত্তর দিয়ে বয়ে যাওয়া অঞ্জনার সঙ্গে। এর ফলে কঙ্কণের মত গোলাকৃতি জলবেষ্টিত এক ভূখণ্ডের সৃষ্টি হলো, এর নাম রাখা হলো কঙ্কণা। ইছামতী-মাথাভাঙা-চূর্ণীখালের মিলন হওয়ায় শিবনিবাসও হয়ে গেল এক ত্রিবেণীসঙ্গম। রাজবাড়ির পাশেই স্থাপন করা হল বিশাল বিশাল শিবের মন্দির। নগরে প্রবেশে পথ রইল শুধু পূবদিকে। উত্তর-পূবে এক গঞ্জ বানিয়ে তার নাম রাখা হলো কৃষ্ণগঞ্জ। কাছের অন্যান্য জলাশয়ের একটির স্বত্ত্ব দেওয়া হলো দেওয়ানকে, লোকমুখে তার নাম হয়ে গেল দেওয়ানের বেড়।
আলীবর্দী উপায় না পেয়ে ভাস্কর পণ্ডিতের শর্ত মেনে কর দিতে রাজি হওয়ায় বাংলায় বর্গী হাঙ্গামা কমে গেল শেষমেষ। কৃষ্ণচন্দ্র অবশ্য শিবনিবাস থেকেই নদীয়ার জমিদারি চালাতে লাগলেন।
নদীয়ায় হিন্দু-মুসলমান দু’সম্প্রদায়েরই অনেক প্রজা, তিনি তাদের অভাব অনুযোগ শোনেন ও রীতিমত চেষ্টা করেন তাদের মন রাখতে। নিজে বৈষ্ণব, অথচ শাক্তদের বিন্দুমাত্র অপছন্দ তো করেনই না, বরং সবাইকে নিয়ে চলার পক্ষে তিনি। নৌকাযোগে কলকাতা যাবার পথে হালিশহরের ঘাটের পাশে উচ্চ সুরেলাকণ্ঠের শ্যামাসঙ্গীত শুনে রাজা তার নৌকা ঘাটে ভিড়াতে বলেন। আলাপ করেন গানের শিল্পীর সঙ্গে। পরদিন সকালে সেই শিল্পীর হাতে রাজার চিঠি আসে – তিনি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন মাসিক বৃত্তি দিয়ে তাকে সভাকবি করার। শিল্পী সবিনয়ে রাজার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও রাজা অখুশি হননি, বরং তাকে একশো বিঘা জমি আর কবিরঞ্জন উপাধি দান করেন। মাঝে মাঝেই হালিশহর কাছারিবাড়িতে তাদের মোলাকাত হতে থাকে। রাজা সন্ধ্যের দিকে তাকে অনুরোধ করেন, রামপ্রসাদ, নতুন কোন গান বাঁধলে নাকি?
রামপ্রসাদ ভক্তিভরে তাকে শোনায় মায়ের গান –
অন্নপূর্ণার ধন্য কাশী।
শিব ধন্য কাশী ধন্য, ধন্য ধন্য আনন্দময়ী।
ভাগীরথী বিরাজিত, প্রবাহে অর্ধ শশী।
উত্তরবাহিনী গঙ্গা জল ঢালিছে দিবানিশি।
শিবেরত্রিশূলেকাশী, বেষ্টিতবরুণা-অসি
তন্মধ্যে মরিলে জীব, শিবের শরীরে মিশি।
কী মহিমা অন্নপূর্ণার, কেউ থাকে না উপবাসী।
ওমা, রামপ্রসাদ অভুক্ত তোমার, চরণধূলার অভিলাষী।
রাজা চোখ বুঁজে এই গানের রস গ্রহণ করেন, শেষ হলে সাধু সাধু করতে থাকেন। রামপ্রসাদের মত তিনিও কিছু কিছু সঙ্গীত রচনা করেছেন, এমনকি শ্যামা মায়ের বন্দনাও।
অতি দুরারাধ্যা তারা ত্রিগুণা রজ্জুরূপিণী
না সরে নিঃশ্বাস পাশ, বন্ধনে রয়েছে প্রাণী।
চমকিত কী কুহক অর্জিত এ তিন লোক।
অহংবাদী জ্ঞানী দেখে তমোরজ্যোতি ব্যাপিনী।।
বস্তুত রাজ্যচালনার চেয়ে গান-বাজনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপারে তার অদম্য উৎসাহ। তার সভায় এসব বিষয়ে যারা চর্চা করেন, তাদেরই রমরমা। নবরত্নের মত সভা আলো করে রয়েছেন পুরাণবিশারদ পণ্ডিত গদাধর তর্কালঙ্কার, সংস্কৃতজ্ঞ কালিদাস সিদ্ধান্ত ও কন্দর্প সিদ্ধান্ত, রাজজ্যোতিষী অনুকূল বাচস্পতি, রাজবৈদ্য আয়ুর্বেদাচার্য গোবিন্দরাম, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্তর মত পণ্ডিত মানুষেরা। মহারাজের নিত্য সহচর শঙ্কর তরঙ্গ ও রামবোল, সভার ভারপ্রাপ্ত কর্তা গোপাল চক্রবর্তী, সেনাবাহিনীর কোষাধ্যক্ষ বা বক্সী নন্দগোপাল রায়, মুনশি অর্থাৎ ফার্সিভাষায় লেখক ও সচিবপ্রধান কিঙ্কর লাহিড়ী, ঘড়িয়াল বা সময়রক্ষক কার্তিক, আমিন নীলকণ্ঠ রায়, দেওয়ান ও আমিনের পেশকার বিশ্বনাথ বসু ও কৃষ্ণ সেন, হাবসী প্রহরী ইমামবক্স ও দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র। জব চার্ণকের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই যে শোভা সিং রহিম খাঁর বিদ্রোহে হুগলি-বর্ধমান বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেই অরাজকতার সময় রামকৃষ্ণ মিত্র নামে একজন পৈতৃক কোন্নগর গ্রাম ছেড়ে নদীয়ায় চাঁড়ুল গ্রামে বাসা বাঁধেন, তার পৌত্র এই রঘুনন্দন। কৃষ্ণচন্দ্র রাজা হওয়ার বছরেই তিনি সামান্য মুহুরীর কাজে বহাল হয়ে বারো বছরের পরিশ্রমে নদীয়ার দেওয়ানপদে উন্নীত হন ও রাজসভার মন্ত্রণাদাতাদের অন্যতমরূপে পরিগণিত হন। রঘুনন্দন খুবই করিৎকর্মা পুরুষ, তার পরামর্শেই নদীয়ারাজ্যে স্থাপিত হয়েছে বহু টোল, চতুষ্পাঠী, বহু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও বিদ্যার্থীর বৃত্তির ব্যবস্থা হয়েছে, দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতরা প্রায়ই আসে নদীয়ারাজ্যে। তিনিই জমি জরিপ করিয়ে রাজ্যের আয় বৃদ্ধি করেন।
বস্তুত সারা বাংলায় নদীয়াতেই তখন পণ্ডিত মানুষের ছড়াছড়ি। ছিলেন শ্রীকান্তঃ কমলাকান্তো বলরামশ্চ শংকরঃ। এই চারজন পণ্ডিত একত্রে একপক্ষে থাকলে নাকি স্বয়ং সরস্বতীও অন্যপক্ষ অবলম্বন করে জিততে পারেন না। ছিলেন স্মার্ত পণ্ডিত গোপাল ন্যায়ালঙ্কার, যিনি নির্ণয় শীর্ষক একগাদা সংস্কৃত পুস্তক লিখে খ্যাতিলাভ করেছেন। ছিলেন বুনো রামনাথ নামে খ্যাত নির্লোভ মহাপণ্ডিত রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর পাণ্ডিত্য ও আর্থিক অনটনের কথা জেনে কিছু অর্থসাহায্যের জন্যে তাঁর বাড়ি যান, গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, পণ্ডিতমশাই, আপনার কোনো অসঙ্গতি আছে?
ন্যায়শাস্ত্রে অসঙ্গতি মানে অসমন্বয়। পণ্ডিত বললেন, না, কোনো অসঙ্গতি নেই। আমি ছাত্রদের কাছে সকল পাঠেরই সঙ্গতি প্রদর্শনের সমর্থ হয়েছি।
রাজা দেখলেন, একে তো ইঙ্গিতে বোঝানো মুশকিল, তাই সরাসরি বিষয়ে এলেন, বললেন, আপনার টাকাকড়ির অনটন আছে?
পণ্ডিত বললেন, না। আমার আহারাদির জন্যে টাকাকড়ির প্রয়োজন তো নেই। ক্ষেতে শস্য আছে, তা থেকে গিন্নী চাল প্রস্তুত করেন আর ঐ যে তেঁতুল গাছ দেখছেন, ওর পাতার ঝোল দিয়ে আমি পেট পুরে ভাত খাই।
রাজা নিরাশ হয়ে ফিরে গেলেন।
পণ্ডিতের স্ত্রীও কম তেজস্বিনী নন। একদিন গঙ্গার ঘাটে স্নানে গেছেন, সেখানে তখন গেছেন দাসদাসী-পালকি-বেহারা পরিবৃত হয়ে রাজরাণীও। রামনাথের স্ত্রী ঘাটের এক পাশে নিঃশব্দে স্নান করে কলসীতে জল ভরতে যাবেন, অমনি তাকে এক দাসী বলে উঠল, কে গা তুমি? তোমার সাহস তো কম না। দেকচো না রাণীমা স্নানে এয়েচেন? তুমি একেনে বসে জল ঘোলা কচ্চো?
পণ্ডিতের স্ত্রী শান্তভাবে বললেন, বাছা, ভদ্রভাবে কথা বলো। আমি তোমার চেয়ে বয়সে ও মানে ঢের বড়।
উদ্ধত দাসী মুখ ঝেমটে বললো, আ গেলো যা। হাতে তো ঐ একগাচি লাল সুতো, তার আবার দেমাগ কত!
ব্রাহ্মণী হেসে বললেন, তুই মূর্খ স্ত্রীলোক, তোকে কী বোঝাবো এই লালসুতোর মর্ম। এই সুতো যতদিন আমার হাতে থাকবে, এই নদীয়ার মান-যশ ততদিন থাকবে।
সে যশ-মানের অধিকারী প্রকৃতই ছিলেন বুনো রামনাথ। তাবড় তাবড় দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতদের তর্কে পরাজিত করেছিলেন তিনি।
আর এক অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। বাংলার তাবড় রাজারাজড়া নবাব বাহাদুর তো বটেই, শোনা যায় বর্গীদের প্রধান ভাস্কর পণ্ডিতও তাঁকে সম্মান জানিয়েছিলেন।
কৃষ্ণচন্দ্রের সভা গমগম করে এইসব বিদ্বান ও করিতকর্মা যুগপুরুষদের উপস্থিতিতে। এরা ছাড়াও গোপাল তো আছেই সভাস্থল উজ্জীবিত রাখতে। তার সঙ্গে রাজা খুঁজে পেয়েছেন আর এক রত্নকে। রাজার ধারণা সে ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি।
তার নামটিও ভারত। বর্ধমানের পান্ডুয়ায় তার জন্ম, সে রাজার প্রায় সমবয়সী। বাবা নরেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন জমিদার। কিন্তু জমি নিয়ে খোদ বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তার বিবাদ লাগলে তিনি রাজার মাকে গালাগালি দেন। ফলে রাজার সেনাপতি এসে চড়াও হয়, কীর্তিচন্দ্র পালিয়ে বাঁচেন, ভারত এসে আশ্রয় নেয় নওয়াপাড়া গ্রামে মামার বাড়িতে। কাছে তাজপুর গ্রামের টোলে ব্যাকরণ আর সাহিত্য পাঠ শুরু হয় তার। চোদ্দ বছর বয়সে বিয়েও করে ফেলে। শুধু সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোন ভাষা শেখেনি, এই বলে তার দাদারা ভর্ৎসনা করলে সে গিয়ে ভর্তি হয় বাঁশবেড়িয়ার কাছে দেবানন্দপুরে, সেখানে রামচন্দ্র মুন্সীর কাছে শেখে ফার্সী ভাষা। মাত্র পনের বছর বয়সে সত্যনারায়ণ পুজো উপলক্ষ্যে পাঁচালির আকারে সত্যপীরের কথা লিখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।
ভারতের আত্মীয়েরা পরামর্শ দেয় তাকে বর্ধমানে ফিরে গিয়ে জমিজায়গা দেখাশুনা করার। এদিকে নিয়মিত খাজনা না দেওয়ায় সে জমি বর্ধমানের রাজা কেড়ে নিয়েছেন, ভারত মোক্তার হিসাবে তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানালে তাকে ধরে গারদে পুরে দেওয়া হয়। ভারত গুণী ছেলে, কারারক্ষীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহারের জন্যে তার ওপর সদয় হয়ে একজন তাকে বের হতে দেয়, রাতের অন্ধকারে গোপনে পালিয়ে গিয়ে সে আশ্রয় নেয় উড়িষ্যার সুবেদার শিবভট্টর কাছে। সেখানে কিছুকাল কাটিয়ে আবার ফিরে আসে বাংলায়।
চন্দননগরে তখন ফরাসী উপনিবেশ। তার দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় মেলে ভারতের। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে ইন্দ্রনারায়ণের নিয়মিত সাক্ষাৎ হয়, সেখানে ভারতচন্দ্রের সঙ্গে মোলাকাৎ হয় তার। এই রকম একজনকেই তো খুঁজছিলেন তিনি। কৃষ্ণনগরের রাজসভায় উঠিয়ে নিয়ে আসেন ভারতচন্দ্রকে। চল্লিশ টাকা বেতনে সে নিযুক্ত হয় সভাকবি হিসাবে।
রাজার আদেশে ভারতচন্দ্র রচনা করে তিনখণ্ডে অন্নদামঙ্গলকাব্য। ভাষা, ছন্দ, কাব্য সবকিছুতেই তার অগাধ নিয়ন্ত্রণ। কাব্যের শুরুতে সেই সময়কার বাংলার অবস্থা, বর্গী আক্রমণ ও তার ফলে নদীয়ারাজ্যের অবস্থা, সব লিখেছে সে অনুপম পয়ারে।
স্বপ্ন দেখি বর্গি রাজা হইল ক্রোধিত।
পাঠাইলা রঘুরাজ ভাস্কর পণ্ডিত।।
বর্গি মহারাষ্ট্র আর সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি।
আইল বিস্তর সৈন্য আকৃতি-বিকৃতি।।
লুটি বাঙ্গালার লোকে করিল কাঙ্গাল।
গঙ্গা পার হইল বান্ধি নৌকার জাঙ্গাল।।
কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি।
লুটিয়া লইল ধন ঝিউড়ী বহুড়ী।।
পলাইয়া কোঠে গিয়া নবাব রহিল।
কী কহিব বাঙ্গালার যে দশা হইল।।
লুটিয়া ভুবনেশ্বর যবন পাতকী।
সেই পাপে তিন সুবা হইল নারকী।।
নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়।
বিস্তর ধার্ম্মিক লোক থেকে গেল দায়।।
এই নরক থেকে উদ্ধার পাওয়া কি সহজ কাজ! খাদ্য-অর্থ লুটে নিয়ে গেছে মারাঠী বর্গী, নদীয়ার অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু তাই বলে নবাবের খাজনা তো মকুব হবে না। রাজ্যের যখন এই অবস্থা, প্রজাবৎসল রাজা তাদের কাছে খাজনা জোগাড়ের কী উপায় করবেন! কিন্তু মুর্শিদাবাদের নবাব এতে কর্ণগোচর করার লোক নয়। তারা রাজাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুরে দিলো গারদে।
মহাবদ জঙ্গ তারে ধরে লয়ে যায়।
নজরানা বলে বার লক্ষ টাকা চায়।।
লিখি দিলা সেই রাজা দিব বার লক্ষ।
সাজোয়াল হইল সুজন সর্ব্বভক্ষ।।
বর্গিতে লুটিল কত কত বাসুজন।
নানা মতে রাজার প্রজার গেল ধন।।
বদ্ধ করি রাখিলেন মুরশিদাবাদে।
কত শত্রু কত মতে লাগিল বিবাদে।।
ধীরস্থির রাজা হতাশ হলেন না, নিজের প্রতি তাঁর বিশ্বাস অগাধ। বন্দী অবস্থাতেই তিনি দেবী অন্নপূর্ণার স্তব করলেন। দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাঁকে দেবীর পূজার আয়োজন করে দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের উপদেশ দিলেন। সেই মতো –
দেবি পুত্র দয়াময় ধরা পতি ধীর।
বিবিধ প্রকারে পূজা করিল দেবীর।।
চৌত্রিশ অক্ষরে বর্ণাইয়া কৈলা স্তব।
অনুকম্পা শ্রবণে হইল অনুভব।।
অন্নপূর্ণা ভগবতী মুরতি ধরিয়া।
স্বপন কহিল মাতা শিয়রে বসিয়া।।
শুন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র না করিহ ভয়।
এই মূর্ত্তি পূজা কর দুঃখ হবে ক্ষয়।।
আমার মঙ্গল গীত করহ প্রকাশ।
কয়ে দিলা পদ্ধতি গীতের ইতিহাস।।
চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে অষ্টমী নিশায়।
করিহ আমার পূজা বিধি-ব্যবস্থায়।।
সভাসদ তোমার ভারতচন্দ্র রায়।
মহাকবি মহাভক্ত আমার দয়ায়।।
তুমি তারে রায়গুণাকর নাম দিও।
রচিতে আমার গীত সাদরে কহিও।।
আমি তারে স্বপ্ন কব তার মাতৃবেশে।
অষ্টবাহ গীতের উপদেশ সবিশেষে।।
সেই আজ্ঞামত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
অন্নপূর্ণা পূজা করি তরিল সে দায়।।
সেই আজ্ঞা মত কবি রায়গুণাকর।
অন্নদামঙ্গল কহেন বরসভর।।
দেবী অন্নপূর্ণা বা সতীর মাহাত্ম্য এই অন্নদামঙ্গল কাব্যে। হরগৌরীর মিলন, বিবাদ, অন্যান্য দেবদেবীদের ভূমিকা সব কিছু নিয়ে এর বিস্তৃতি। শিব যখন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে সতীর দেহত্যাগের পর, তার সেই অংশের বর্ণনা শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। রাজা বারবার শুনতে চান এ অংশটা, ভারত, আবার পড়ো ঐ জায়গাটা, ঐ যে ধিয়া তাধিয়া তাধিয়া। ভারত পড়তে থাকে –
ধিয়া তাধিয়া তাধিয়া ভূত নাচে।
উলঙ্গী উলঙ্গে পিশাচী পিশাচে।
সহস্র সহস্র চলে ভূত দানা।
হুহুঙ্কারে হাঁকে উড়ে সর্প বীণা।
চলে ভৈরব ভৈরবী নন্দী ভৃঙ্গী।
মহাকাল বেতাল তাল ত্রিশৃঙ্গী।
চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে।
চলে শাঁকিনী প্রেতিনী মুক্ত কেশে।
গিয়া দক্ষ যজ্ঞে সবে যজ্ঞ নাশে।
কথা না সরে দক্ষরাজে তরাসে।
রাজা বলেন, হুম, বেড়ে লিখেছ। কী যেন ছন্দটা বলছিলে সেদিন? নিহতসর্প না কী যেন –
ভারতচন্দ্র বলে, ভুজঙ্গপ্রয়াত মহারাজ। এই যে পরের লাইনেই লিখেছি –
অদূরে মহা রুদ্র ডাকে গভীরে।
অরেরে অরে দক্ষ দেরেস তীরে।।
ভুজঙ্গপ্রয়াতে কহে ভারতী দে।
সতী দে সতী দে সতী দে সতী দে।।
রাজা খুশি হয়ে ভারতচন্দ্রকে রায় গুণাকর খেতাব দিয়েছেন। তার সঙ্গে মূলাজোড় গ্রামটিও দান করেছেন তাকে, ছশো টাকা বার্ষিক রাজস্ব আসে সেখান থেকে। কবি হিসাবে ভারতচন্দ্রের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়।
সম্প্রতি রাজার ইচ্ছায় ভারতচন্দ্র লিখতে শুরু করেছে রসমঞ্জরী। নরনারীর কামনা-বাসনা নিয়ে সংস্কৃতে এতগুলো সরস কাব্যগ্রন্থ আছে, মহর্ষি বাৎস্যায়ণ বিরচিত গ্রন্থটি তো অতি উৎকৃষ্ট। এ ছাড়াও ভানুদত্ত মিশ্রের রসমঞ্জরী, জয়দেবের রতিমঞ্জরী, রূপ গোস্বামীর উজ্জ্বল নীলমণি, কল্যাণমল্লের অনঙ্গরঙ্গ – এ বিষয়ে গ্রন্থের অভাব নেই। বাংলায় কেন এই বিষয়ে উৎকৃষ্ট কাব্য থাকবে না, ভারতচন্দ্রের মত গুণী কবি যেখানে রয়েছে!
মাঝে মাঝেই রাজ-উদ্যানে ভারতচন্দ্রের রসমঞ্জরীর পাঠের আয়োজন হয়। রাজা নিমন্ত্রণ পাঠান যাবতীয় পাত্র-মিত্র-অমাত্যদের। এদিনও ডাক গেল সবার কাছে। সকলেই নির্দিষ্ট সময়ে হাজির, শুধু গোপালের দেখা নেই।
রাজা উদ্যানের দ্বারপালকে বলে রাখলেন, গোপাল এলে যেন তাকে সহজে ঢুকতে না দেওয়া হয়।
নীলমণি সমাদ্দার নামে এক গায়ক ভারতচন্দ্রের রচনায় সুর দেয়। তার গাওয়া কিছু গানের পর শুরু হল রসমঞ্জরী থেকে পাঠ। বয়োবিভাগ অংশ থেকে পাঠ করছে ভারতচন্দ্র, তার বিষয় যৌবনের বিভিন্ন ভেদ, পুরুষ ও নারীর। ভারতচন্দ্র পড়ে চলেছে –
নারীর যৌবন বড় দুরন্ত।
শরীর মাঝে পোষে বসন্ত।।
বিনোদ বিননে বিনায়ে বেণী।
পুরুষে দংশিতে পোষে সাপিনী।।
কত কত অলি নয়নে ঘোরে।
মধুবাক্যে কত কোকিল ঝোরে।।
মলয় বাতাস শ্বাসেতে বহে।
সৌরভে সুরভি গৌরব নহে।।
শুনে মহারাজ ঘন ঘন মাথা নাড়াতে লাগলেন। আর একবার পড়ো, ভারত, কী লিখেছ, নারী শরীর মাঝে পোষে বসন্ত! আহা আহা।
সভা চলাকালীন গোপালের সশব্দ প্রবেশ ঘটেছে। তাকে তো দারোয়ান কিছুতে ঢুকতে দেবেনা। রাজার হুকুম! অনেক অনুনয়-বিনয়ে কাজ না হলে গোপাল শেষে তাকে বুঝিয়েছে, দ্যাখো বাপধন, তুমি তো জানো, রাজা আমাকে কত ভালবাসেন, প্রতিদিনই কিছু না কিছু উপহার দেন। আজ যা দেবেন, তার অর্ধেক তোমার।
ঘুষ পেলে পাথরও গলে যায়, এ তো সামান্য প্রতিহারী। আর রাজা তো বারণ করেন নি, বলেছেন, সহজে যেন ঢুকতে না পারে। এতক্ষণ অনেক ধানাই পানাই করেছে। সে দরজা খুলে দিয়েছে।
সভায় তখন চলছে ভারতচন্দ্রের জাতিকথন অংশের পাঠ। স্ত্রীজাতি চারি প্রকারের। পদ্মিণী, চিত্রিণী, শঙ্খিনীর পর শেষটির নাম হস্তিনী। তার স্বরূপ কেমন?
স্থূল কলেবরস্থূল পয়োধরস্থূল পদকর ঘোরনাদিনী।
আহার বিস্তরনিদ্রা ঘোরতরবিহারে প্রখর পরগামিনী।
ধর্ম্ম নাহি ডরদন্ত ঘোরতরকর্ম্মেতে তৎপর মিথ্যাবাদিনী।
সুপ্রশস্ত কায়বহু লোম হয়মদ গন্ধ কয় সেই হস্তিনী।
সেই বর্ণনা শুনে রাজা তো হেসে গড়াগড়ি। তোমার ধর্মপত্নীটি কোন প্রকারের, ভারত?
সভায় ব্যাঘাত ঘটলো গোপালের অস্বাভাবিক আচরণে। সে গিয়ে ধড়াম করে অসভ্যের মত গিয়ে পড়ল একজনের ঘাড়ে। খাদ্য, পানীয় যা রাখা ছিল সেখানে সব ছত্রাকার হয়ে গেল। একজন গোপালকে কী বলতে গেল। গোপাল তাকে বলল, তোর বাপের কী রে শালা?
রাজার চোখের সামনে এসব ঘটনা ঘটছে। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তিনি বললেন, এক্ষুণি কান ধরে একশোবার ওঠবোস করো। আর তোমার আজ বিশ টাকা জরিমানা।
গোপাল সঙ্গে সঙ্গে কান ধরে ফটাফট পঞ্চাশবার ওঠবোস করল। দশটাকা রাজার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, বাকি পঞ্চাশবার ওঠবোস করবে আর দশটাকা জরিমানা দেবে আপনার দ্বারপাল। ওর সঙ্গে চুক্তি আছে আজকে আমার যা প্রাপ্য হবে, তার অর্ধেক ওর।
রাজা মুহূর্তে বুঝে গেলেন কী ঘটেছে। কিন্তু এ নিয়ে মস্করা অধিক অগ্রসর হবার আগেই সভায় প্রবেশ করল রাজার বিশ্বস্ত সেনা-অনুচর। কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে তুলে দিল সে একটা চিঠি। চিঠির বিষয় খুবই সংক্ষিপ্ত। তাকে অবিলম্বে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ যেতে হবে, ধনী জগৎশেঠের প্রাসাদে, বিশেষ প্রয়োজনে। (ক্রমশ)
2 comments: