0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in




আমার ভারতবর্ষ-৫

চারমিনার

ইতিহাস খুঁজতে গেলে হাজার বছর পেরোবে। এই প্রিয় শহরটিকে এখন লোকে 'হায়দরাবাদ' নামে চেনে। মধ্যযুগের আগে তার যাই পরিচয় থাক, মুঘল পর্ব থেকেই তার নামডাক। দু'দল তুর্কো-ইরানি ভাগ্যান্বেষীর দৌলতে গড়ে উঠেছিলো এই শহর। ষোলো শতকের গোড়ায় কুতব শাহি শাসন বাহমনিদের থেকে দখল নিয়েছিলো গোলকুণ্ডা দুর্গের। পঞ্চম সুলতান মহম্মদ কুলি কুতব শাহের সময় থেকে দক্কনে সে কালের বিচারে একটা নতুন ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন হয়। যাকে এদেশের ইতিহাসে গঙ্গা-জমনি তহজিব বা সংস্কৃতি বলা হয়ে থাকে। মহম্মদ শাহ ছিলেন যেন এক্জন উপকথার সুলতান। কবি, শিল্পী, সংস্কৃতি প্রেমী, উদার-হৃদয় নৃপতি, যাঁর সৃষ্টি এই হায়দরাবাদ শহর। চারমিনার থেকে শুরু করে আদি উর্দুভাষা বা রেখতা তাঁরই অবদান। তাঁর প্রিয় সঙ্গিনী, নর্তকী ভাগমতী বা হায়দরমহলকে নিয়ে কিংবদন্তি অন্তহীন। তাঁর সময়
দিল্লির অধীশ্বর ছিলেন বাদশাহ আকবর। মানসিকতার প্রসার বিচার করতে গেলে মহম্মদ শাহের চিত্তসম্পদ ও উদারতা গ্রেট মুঘল আকবর বাদশাহকেও ছাপিয়ে যেতো। যেসব দূরদর্শী মুসলিম শাসকদের প্রযত্নে এদেশে আক্রমণকারী বিদেশী রাজাদের ধর্ম ইসলাম বা তাঁদের ভাষা ফার্সি, দেশীয় ধর্মসংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বিত হয়েছিলো, মহম্মদ শাহ ছিলেন তাঁদের অগ্রপথিক। তাঁর সময়েই গোলকোণ্ডা রাজত্বে তেলুগু, রাজভাষার মর্যাদা পেয়েছিলো। এই সুলতান সম্বন্ধে মানুষের কৌতুহল ও প্রীতি বহুবিস্তৃত।

মহম্মদ কুলি কুতব শাহ নির্মাণ করেছিলেন দেশের একটি অতি বিখ্যাত দিকচিহ্ন, হায়দরাবাদের চারমিনার। ১৫৯১ সালে তাঁর নতুন শহরে মারাত্মক প্লেগের উপদ্রব হয়। তিনি শহরের কেন্দ্রে একটি স্থানে বসে রোগশান্তির জন্য প্রার্থনা করেন। প্রতিজ্ঞা করেন যদি মহামারী দূর হয়, তবে এই স্থানেই একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই অনুযায়ী ঐ স্থানে নির্মিত হয় বিখ্যাত মক্কা মসজিদ। সুদূর মক্কা থেকে নাকি ইঁট নিয়ে আসা হয়েছিলো এই কাজে। এর স্থাপত্য আর কারিগরি আজও আমাদের অবাক করে। ত্যাভার্নিয়র সাহেব এটি দেখে মন্তব্য
করেছিলেন, " It is about 50 years since they began to build a splendid pagoda in the town which will be the grandest in all India when it is completed. The size of the stone is the subject of special accomplishment, and that of a niche, which is its place for prayer, is an entire rock of such enormous size that they spent five years in quarrying it, and 500 to 600 men were employed continually on its work. It required still more time to roll it up on to conveyance by which they brought it to the pagoda; and they took 1400 oxen to draw it."

শাহজহানের নির্মাণ করা দিল্লির জামা মসজিদের প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে মহম্মদ কুলি কুতব শাহের তৈরি মক্কা মসজিদ দেশের বৃহত্তম মসজিদ ছিলো। এখনও সেখানে একসঙ্গে বিশ হাজার লোক প্রার্থনা করতে পারেন।

চারমিনার ছিলো ইসলামি স্থাপত্যের বিজয়তোরণ। একটি মৌলিক ও শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। বর্গাকার চারটি মিনারের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই নির্মাণটি ছিলো নতুন শহরের কেন্দ্রবিন্দু। মক্কা মসজিদের দ্বারপথ। তৈরি হয়েছিলো গ্র্যানাইট, চুনাপাথর, সুরকি
আর মার্বলপাথরের গুঁড়ো দিয়ে। এর উপর দাঁড়ালে সারা হায়দরাবাদ শহরের চারদিক দেখতে পাওয়া যেতো। একটা কিংবদন্তি আছে। গোলকোণ্ডা দুর্গ থেকে চারমিনার পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিলো। মূল কারণ দুর্গ আক্রান্ত হলে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছোনোর উপায়। অন্যটা কিংবদন্তি। মহম্মদ কুলি কুতব শাহ নাকি গোলকোণ্ডা থেকে সুরঙ্গপথে এসে হায়দরাবাদে ভাগমতীর সঙ্গে মিলিত হতেন। সুড়ঙ্গটি অবশ্য এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। চারমিনারকে ঘিরে চোদ্দো
হাজার বিপণী,বসতবাড়ি, সরাইখানা, হম্মাম, মক্তব-মদ্রাসা এবং মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন সুলতান। তার মধ্যে দর-উল-শিফা (হাসপাতাল) এবং আরও কয়েকটি বিশাল ভবন এখনও টিকে আছে। গোলকোণ্ডা পতনের পর অওরঙ্গজেব হায়দরাবাদ শহরের জাঁকজমক দেখে চমৎকৃত হয়ে যান। যদিও বেশিরভাগ নির্মাণই ১৬৮৭ সালে তাঁর সঙ্গে আসা মুঘল সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো।



0 comments: