0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in



তখন ভোর হয়ে আসছে। একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে আকাশের রঙ। কালচে ধূসরের মধ্যে মিশে যাচ্ছে কমলা-হলুদ। সূর্যের বর্ণচ্ছটার মধ্যে দিয়ে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে শিশির। উত্তাল সমুদ্রপথ পেরিয়ে আমাদের জাহাজ পৌঁছেছে ডোভার বন্দরে। বাসের জানালা দিয়ে দেখলাম বাইরে পাতুদা দাঁড়িয়ে। আমরা ইংল্যান্ড পৌঁছলাম।

এর আগের কিস্তিতে ব্রিটিশ ফুডের সঙ্গে আমাদের প্রথম সরাসরি সাক্ষাতের কথা লিখেছিলাম মনিকা কাকিমার হাতে ভাজা বেকন খাওয়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে। কিন্তু সাহেবি হেঁশেল নিয়ে লিখতে বসলে রীতিমত লেখাপড়া করার প্রয়োজন। প্রথমত ব্রিটিশ বলতে আমরা যা বুঝি, তার শ্রেণীবিন্যাস অনেক আর ঠিক কোন সরণি ধরে এই রন্ধন সংস্কৃতি বয়ে গেল এক শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীর দিকে, সে এক অতি রোমাঞ্চকর কাহিনী। প্রথমত ব্রিটিশ রান্নাবান্না বলতে আমরা যা বুঝি, তার ভাগ অনেক। স্কটিশ, ওয়েলশ বা আইরিশ খাবারের সঙ্গে ইংলিশ ফুডকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না একেবারেই। আজ যা ইংলিশ বলে বিখ্যাত, তার মধ্যে মার্কিনী, চিনা এবং ভারতীয় প্রভাব বিপুল। এর কারণ দুটো। এক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটেনে অভিবাসী মানুষের ঢল আর দুই, বিদেশ থেকে রান্নার উপকরণের আমদানি, যার সূত্রপাত ঘটেছিল অনেক আগেই। মধ্যযুগ থেকেই সৌখিন খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখার জন্য ইংল্যান্ডের বিত্তবান সম্প্রদায় দূরদূরান্ত থেকে নিজেদের পছন্দমতো খাদ্য উপকরণ আনাতেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল বিভিন্ন দেশ থেকে রাজত্ব করতে আসা জনজাতির খাদ্য সংস্কৃতির নিবিড় প্রভাব। যেমন রোমানরা নিয়ে এসেছিল ফলমূল এবং সবজি খাওয়া এবং রান্নার অভ্যেস। স্কান্ডিনাভিয়া থেকে এল মাছ-মাংস স্মোকিং আর ড্রায়িং এর কৌশল। আর নর্মানরা শেখালো ওয়াইন খেতে। বানিজ্যিক সম্পর্ক, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ব্যবসায়িক আদান-প্রদানের ফলে সাহেবি রান্নাঘর ভরে উঠলো জাফরানের গন্ধে। নির্মিত হলো স্বতন্ত্র এক রন্ধন-সংস্কৃতি।

১৯৩৯ এ যখন যুদ্ধ লাগলো, নাৎসি জার্মানি অতলান্তিক দখলে রাখার লড়াইয়ে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ব্রিটেনমুখী জাহাজগুলির পথ অবরোধ করে সাধারণ মানুষকে এক কঠিন সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য চালু হয় ‘ফুড রেশনিং’ – যা অনেকাংশে বদলে দেয় সে দেশের খাওয়া-দাওয়ার ধরন-ধারণ। বলা যায় এই সন্ধিক্ষণ থেকেই শুরু হয়ে গেলো ক্যানড বা প্যাকেজড ফুডের যুগ। কিন্তু তার আগে একটু উঁকি মেরে দেখে নেওয়া যাক প্রভাবশালী ব্রিটিশ হেঁশেলটির অন্দরমহলে।

কিপার্স। এই মহার্ঘ বস্তুটি আসলে কী? মনে আছে, এর আগে জার্মানিতে বিশেষ বিশেষ সময়ে হেরিং মাছ খাওয়ার গল্প করেছিলাম? কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল অনেক পরে। ইংল্যান্ডের রান্নাবান্নার মধ্যে স্মোকিং-এর কৌশল জনপ্রিয় হওয়ার পর একটি পদ ওদেশের খাবার টেবিল আলো করেছিল অনেকদিন, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত, যতদিন না ‘ফাস্ট ফুড’ বিশ্বব্যাপী ঝড় তুলেছে। হেরিং মাছকে প্রথমে লম্বালম্বি চিরে নিয়ে পোড়ানো হতো। তারপর তাতে মাখানো হতো নুন বা আচার। এইবার এই মাছটিকে হুকে ঝুলিয়ে ‘স্মোক’ করা হতো। এই প্রথা জন্ম দেয় একটি ইংরেজি শব্দেরও – tenterhook বা ‘আশঙ্কার দোলাচল’ আর এই শেষ পর্যায়টিই কিপারিং বলে বিখ্যাত হয়েছিল এবং এই পদটির নাম হয়েছিল কিপার্স। শেষমেশ পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজন বা নৈশভোজ সর্বত্রই চোখে পড়তে লাগলো এই খাদ্যটি। শুধু বদলে যেত তার অনুষঙ্গ।

তা সেই প্রথমবার বিলেতে পা দেওয়ার আগে পর্যন্ত এই বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। যা হলো উইন্ডসর ক্যাসেল থেকে ফেরার পথে। সেটা ছিল একটা রবিবার। নানুকাকা আমাদের বললেন, চলো, তোমাদের উইন্ডসর ক্যাসেলটা দেখিয়ে আনি। আমাদের সেই অস্থায়ী বাসস্থান থেকে ঘণ্টাদুয়েকের পথ। নয়নাভিরাম সেই যাত্রা। এর আগে এবং পরে অন্যান্য দেশের প্রকৃতির (যার মধ্যে স্বদেশও আছে) সঙ্গে নানান সাক্ষাৎকার হয়েছে, যার মধ্যে ইতালির আমালফিও আছে কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে এই দেশের প্রকৃতির সঙ্গে অন্যদের একটা মৌলিক পার্থক্য ধরা পড়ে। সেই তফাৎটা হলো ব্রিটিশদের বাগান করার স্বাভাবিক প্রবণতা, যা ওদেশের প্রকৃতিতে যোগ করেছে আলাদা একটি মাত্রা। সেই আশ্চর্য সুন্দর যাত্রার শেষে যেখানে পৌঁছনো গেলো, বিগত এক হাজার বছর ধরে যেখানে ব্রিটেনের রাজপরিবার বসবাস করে আসছে। বিশেষ ধরণের পাথর দিয়ে তৈরি এই দুর্গটিতে আছে প্রায় আড়াইশোর কাছাকাছি ঘর! আসবাব এবং অন্দরসজ্জা নিয়ে মন্তব্য করতে গেলে আর্ট হিস্টোরিয়ান হওয়া ভালো। ভিতরে ঢোকার পর আমাদের ঘোর যতক্ষণে কাটলো, ততক্ষণে আমরা ক্ষুধার্ত। নানুকাকা আমাদের নিয়ে গেলেন কাছেই, একটি রেস্তোরাঁয়। অনেকেই দেখলাম সেই বস্তুটি পরখ করে দেখছেন। নানুকাকার পরামর্শে আমরাও ঠিক করলাম কিপার্সই খাবো। ঘ্রাণ যদি অর্ধেক ভোজনের কারণ হয়, আমাদের সেদিন তা হয়েছিল একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অতঃপর স্যালাড সহযোগে ধোঁয়াগন্ধী, ঈষৎ টক স্বাদের (সম্ভবত আচার ব্যবহারের কারণে) সেই মাছটি তারিয়ে তারিয়ে খেয়েছিলাম। আর এই পুরো সময়টা খেতে খেতেই নানুকাকা তাঁর কৌতুকী দৃষ্টি মেলে রেখেছিলেন আমাদের ওপর।

ব্রিটিশ বেকনের কথা তো আগেই লিখেছি। প্রথমবারের সেই বিলেতযাত্রায় আরেকটি বস্তুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। ইয়র্ক হ্যাম। হ্যাম তৈরি হয় শুয়োরের পিছনের পায়ের মাংস থেকে। খাদ্যরসিক মানুষ জানবেন এই হ্যাম প্রস্তুতির সুদীর্ঘ নেপথ্য কাহিনী। আর কোনও কোনও অঞ্চলের চিজ বা ওয়াইন, বিশেষত শ্যাম্পেনের মতোই এই হ্যামও ভীষণভাবে আঞ্চলিক ও আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত। এবং প্রতিটি এমন এলাকার বিশেষ ভৌগলিক ও যুগ-যুগান্ত ধরে মানুষের যাপনের ইতিহাস এর স্বাদ-গন্ধের সঙ্গে যেভাবে জড়িয়ে আছে, যা প্রায় অবিশ্বাস্য। সেই কারণেই এই ইয়র্ক হ্যাম, জার্মানির হ্বেস্টফালিয়ান হ্যাম, স্পেনের জামন সেরানো বা পারমা হ্যাম কিংবদন্তিপ্রতিম। আমরা ইংল্যান্ড পৌঁছনোর আগেই জার্মানিতে সেরা ঘরানার হ্যাম চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। অনেক পরে অবশ্য ইতালিয়ান প্রোসিউতোর স্বাদ রসনায় গ্রহণ করার পর মনে হয়েছিলো তা সর্বোত্তম। পারমার ঢেউখেলানো সবুজ প্রান্তরের মতোই হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়া ছিল সেই আস্বাদন। শোনা যায় ইয়র্ক হ্যাম কিওরিং-এর জন্য একসময় ব্যবহার হতো ওক কাঠের গুঁড়ো। যে ওক কাঠ নাকি ব্যবহার হয়েছিলো ‘ইয়র্ক মিন্সটার’ ক্যাথিড্রাল নির্মাণের কাজে। কিন্তু শুধুমাত্র লোকগাথা নয়। কোনও খাদ্যবস্তুকে লম্বা রেসের ঘোড়া হতে গেলে সর্বোচ্চ মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হয়।

স্মোকিং-এর কথা যখন উঠলোই স্মোকড হ্যাডক বা স্যামনের প্রসঙ্গ আসবেই। আর সেই প্রসঙ্গে আসবে স্মোকড হ্যাডক সহযোগে তৈরি একটি পদ যার উৎপত্তিস্থল ভারত এবং কালক্রমে যা অর্জন করেছিলো ব্রিটেনের জাতীয় খাদ্যের পদাধিকার। কেডগেরি, যে নামটি এককথায় খিচুড়ির অপভ্রংশ। শতাব্দী-প্রাচীন যে রান্নাটি ভারতের প্রতিটি প্রদেশে আলাদা আলাদা চেহারায় পাতে জায়গা করে নিয়েছে স্বাস্থ্যকর এবং স্বাদু ভাবমূর্তি নিয়ে, ঔপনিবেশিক ভারত থেকে সেই ‘ওয়ান পট’ মিল ধারণ করলো আরেকটি নাম। ১৭৯০ সাল নাগাদ একটি রেসিপি বইতে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। বাকিটা ইতিহাস। ভারতীয় খিচুড়ি থেকে বিদায় নিলো ডাল। প্রবেশ ঘটলো স্মোকড বা পোচড মাছ আর সিদ্ধ ডিমের। কেমন দাঁড়াচ্ছে তাহলে বিষয়টা? গোড়াতেই ডিমটা সিদ্ধ করে নিতে হবে। তারপর ভাত রান্নার পালা। এরপর স্মোকড হ্যাডক বা ওইধরনের কোনও মাছ থাকলে ভালো অন্যথায় মাছের ফিলেগুলো দুধে পোচ করে নিতে হবে। এরপর মেশানোর কাজ। মাখনে পেঁয়াজ অল্প ভেজে নিয়ে তাতে দিতে হবে ছোটো এলাচ আর তেজপাতা, এইবার কারি পাউডার দিয়ে রান্না করা ভাতটি মিশ্রণের মধ্যে দিয়ে কয়েক মিনিট রান্না করতে হবে যতক্ষণ না সেটি সোনালী হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। তারপর মাছের টুকরো আর ডিমকে চার ভাগ করে সেই খিচুড়ি বা কেডগেরিকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার কাজ। শেষে ওপরে টাটকা পার্সলি ছড়িয়ে দিলেই পদটি পরিবেশনযোগ্য। ডোভার থেকে ফেরার বাস ধরবো যে বিকেলে, সেদিনই দুপুরে মনিকা কাকিমা আমাদের জন্য রান্না করেছিলেন খিচুড়ির তখনও পর্যন্ত অজানা এই অবতার।

সেবারের ইউরোপ ভ্রমণের পর দেশে ফিরে এক ঘরোয়া আড্ডায় আমি রান্না করেছিলাম কেডগেরি, যেখানে হ্যাডকের পরিবর্তে ব্যবহার করেছিলাম আমাদের অতিপ্রিয় ভেটকি। খাওয়া শেষ হওয়ার পর বন্ধুদের চোখে-মুখে পরিতৃপ্তির ছাপ দেখে মনে হয়েছিলো সেই নিরীক্ষা বিফল হয়নি। সবচেয়ে বড়োকথা রোস্ট বিফ, ইয়র্কশায়ার পুডিং, কিডনি পাই বা ফিশ অ্যান্ড চিপস্‌-এর প্রচলিত ধারণার বাইরেও যে ব্রিটিশ ফুড বলে আরও কিছ হয়, দীর্ঘ পথ যাত্রা করা, এক মহাদেশ থেকে অন্য আরেক মহাদেশের খাদ্যজগতে নবরূপে নিজের একটা নিজস্ব জায়গা তৈরি করা সহজ ছিল না। আপাত-নিরীহ এই জিনিসটি যা নিশ্চিতভাবেই করতে পেরেছে।

0 comments: