0
undefined undefined undefined

গল্প - সুমন্ত চ্যাটার্জী





পিঠে চার ঘা পুলিশের ডান্ডা পড়তেই শরীরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে কিষেণলালের। অসহায় গোঙানি শোনা যায়, ‘বেপারটা এরকম হয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি গো স্যার! রোজ রাতেই তো এমন করতাম ...!’ ভয়ে চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে আসে! হাড়জিরজিরে চেহারা, গালে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি, পরনে ধুলিধূসর রদ্দি ফতুয়া-প্যান্ট আর চোখেমুখে এক অজানা আতঙ্ক নিয়ে হাতজোড় করে লক আপের মেঝেতে বসে থাকে কিষেণলাল যাদব। থানার বড়োবাবু একটা কাঠের চেয়ার টেনে এনে বসেন বৃদ্ধ বিহারী হকারের মুখোমুখি। বাঁ-পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা কনস্টেবলটিকে বাল্ব জ্বালানোর ইশারা করে কর্কশ কন্ঠে বলেন, ‘আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয়! জেলার যে কোনও ক্রিমিনালকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখ, অপরাধীদের ত্রাস এই রুদ্রনাথ ঘোষ! আবারও বলছি, কাল রাতে যা যা ঘটেছিল পুরোটা বল্, লুকোবি না একটুও! তোর বন্ধুর অবস্থা কিন্তু সঙ্কটজনক, ওর কিছু হয়ে গেলে এমন কেস দেবো, সারাজীবন থানা-পুলিশের চক্কর কাটতে কাটতেই চলে যাবে!” দু’বার ঢোক গেলে কিষেণলাল, কনস্টেবলের এগিয়ে দেওয়া জলের বোতল থেকে জল খায় কয়েক চুমুক, তারপর নিজের হাঁটুদুটোকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘এসব ঝামেলায় কে পড়তে চায় সায়েব! আমি খেটেখাওয়া মানুষ, যা বলেছি ঠিকই বলেছি।’ বড়োবাবু কনস্টেবলকে আঙুলের ইশারায় আবার মার শুরু করতে বলেন।

কনস্টেবল ডান্ডা নিয়ে এগিয়ে আসতেই ফের কাঁপতে শুরু করে কিষেণলাল, বলে, ‘বলছি, বলছি স্যার! আ...আ...আমি আর হারু ট্রেনের হকার। হাওড়া লাইনের লোকাল ট্রেনে হকারি করতাম দু’জনে। ও মসলা মুড়ি বেচতো, আর আমি রুমাল, গামছা। ভিনপাড়ার হলেও একই গেরামের। একই সময়ে ট্রেনে চাপতাম, আবার কাজ শেষ করে ছাতিমতলায় দাঁড়িয়ে খৈনি খেয়ে বাড়ি ফিরতাম দু’জনে। এমনই চলতো স্যার। তারপর এলো লকডাউন, করুনা রোগ। ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল। মাসখানেক তো না খেতে পেয়ে মরে যাওয়ার মত হল! তারপর বড়ো ছেলেটার সাথে বেরিয়ে পড়লাম ঠেলাগাড়ি করে ফল বেচতে। সেখানেও পবলেম, একদিন তো আপনাদের হাতে বেশ মারও খেলো ছেলেটা! ঘরেই বসেছিলাম, সেইসময় ওপরবালার ইচ্ছায় হারু একটা কাজের কথা বলে। করুনা রোগের টিকা লিতে নাকি রোজই লম্বা লাইন পড়ে। আকাল চলে, ঝগড়া-মারামারি পয্যন্ত হয়! হারু বলে, ‘চল্ বিহারী, আমরা মাঝরাতে হাসপাতালে লাইন দিবো আর পয়সা কামাবো’। তো আমরা রোজ রাতেই ঘর থেকে চলে যেতাম স্যার, লাইন দিতাম গিয়ে হাসপিটালের গেটের সামনে। বিড়ি ফুঁকতাম, খৈনি খেতাম, গল্প কোরতাম। সকালে যে সব মানুষ লাইন দিয়ে ভেক্সিন লিতে আসতো তিনশো টাকা করে লিয়ে তাদের লাইন ছেড়ে দিতাম। এইভাবেই চলছিল স্যার কয়েক হপ্তা, তো কাল রাতে হাঙ্গামা হয়ে গেল!’

আরও কয়েকঢোক জল খায় কিষেণলাল, তারপর আবার বলতে শুরু করে। ‘মাঝরাতে আমরা লাঠি লিয়ে বেরোতাম। কুত্তায় জিনা হারাম করে দিত ফাঁকা রাস্তায়। কিন্তু কাল রাতে দেখি রাস্তায় শালা একটাও কুত্তা নাই, পুরা শুনশান! হারু’র ভাইপো হায়দেরাবাদে কনোসটেরাকশনের কি একটা কাজ করতো। ও হারু’কে ওখান থেকে নানা জিনিষ এনে দিত স্যার। কখনও ঘড়ি, কখনও চাবির রিং, জুতো, সেন্ট, বেল্ট এসব। সেবার হারু’র ভাইপো কি একটা মসলার প্যাকেট লিয়ে এসেছিল। হারু সুধু আমাকেই বলেছিল ব্যাপারটা। ওটা মুড়িতে মেশালে নাকি দারুণ সোয়াদ হয়, গন্ধও বেরোয় একদম আলেদা! কিন্তু হারুর ভাইপো ওকে বারবার সাবধান করেছিল, ঐ মসলা মাখিয়ে মুড়ি যেন কোনও গর্ভবতী মহিলাকে না দেয়! মসলাটা ওকে দারুণ বিজনেস দিয়েছিল স্যার! ট্রেনে সবাই খুব নাম করতো ওর!’ কনস্টেবল একটা গুটখার প্যাকেট ছিঁড়ে সেটাকে মুখে ঢেলে নিয়ে ধমক দেয়, “আহ, সাহেব যা জানতে চাইছে সেটা বল! এদিক-সেদিক অত গালগল্পের কি আছে, হ্যাঁ?’

কিষেণলাল চুপ করে যায়। দু’জনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, “ওটাই তো বইলচি স্যার। হারু একদিন দুপুরের ট্রেনে লাল শাড়ি পরা এক মারোয়াড়ি পেগনেন্ট ভদ্দরমহিলাকে সেই মসলা মাখিয়ে মুড়ির ঠোঙা এগিয়ে দেয়। বিজনেসের লোভ ওকে এমন পেয়ে বসেছিল যে বান্দা ভুলে গেছিল সব! অন্ধ হয়ে গেছিল গো স্যার, কি আর বলবো আপনাদেরকে!” একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস নেয় বুড়ো হকার, তারপর আবার শুরু করে, “তার তিনবছর পর কাল রাতে আমরা দু’জন হাসপিটালে লাইন দেওয়ার জন্য বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় কুত্তা ছিল না একটাও, একটাও না! ক’টা হবে? এই ডেডটা-পৈনে দুটা নাগাদ। হাসপিটালের গেটের কাচাকাচি গিয়ে দাঁড়াই। আমি পোসসাব করতে পাশে যাই একটু, ওষুধের দোকানগুলোর পেছনে। ফিরে এসে কলে হাত ধুই, তারপর পকেট থেকে কোটো বার করে খৈনি বানাতে শুরু করি। হারু কেন জানি না বেশ ঘামছিল! ওকে খৈনি দিতে গেলে ও নেয় না। বলে, ‘বিহারী, পাঁচমাথার মোড়ে ঐ ফেস্টুনের নীচে কাউকে দেখতে পেছিস?’ আমি সেদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পাই না। হারু কিন্তু একদিস্টে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল, চোখমুখ কেমন যেন হয়ে যায় ওর! তারপর ধপাস করে পিচ রাস্তাতেই বসে পড়ে, কেমন একটা অজানা ভয়ের সঙ্গে বইলতে শুরু করে, ‘সেই মারোয়াড়ি বৌ এখানে কিকরে! লাল শাড়ি, সেই একই মুখ, এগিয়ে আসছে ক্যানে?’ আমি খুব ভয় পেয়ে যাই পোথোমে, তারপর মনে হয় হারু হয়তো মজা করছে আমার সাথে! এরকম মজা আগেও ও অনেকবার করেছে অনেকের সাথে! আমি হেসে উড়ানোর চেষ্টা করি কথাগুলো, কিন্তু আহিস্তে আইস্তে বুঝতে পারি হারু অ্যাক্টিং কইরচে না! সত্যিই কাউকে দেখতে পেয়ে ভয় পেচে খুব! তারপর ও চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘শাড়ি সরিয়ে রক্তকিনকিনে পেট ক্যানে দেখাচ্চিস আমায়! দূর হ, হতচ্ছাড়ী! আর কাছে আসবি না, আর না, না, কাছে আসবি না ...’! তারপরই ও জ্ঞান হারায়, হাসপিটাল খুলতেই ওকে ভর্তি করি সেখানে। তারপর আমি আর কিচ্ছু জানি না গো সায়েব, বিশ্বাস করেন! বজরং বলীর দিব্যি করে বলছি!’ কিষেণলালের সমস্ত কথাগুলো মন দিয়ে শুনে কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকেন বড়োবাবু, তারপর শান্তভাবে একটা সিগারেট ধরান।



ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে একটানা দুটো ঘোলা বিহারী চোখের দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে থেকে ঘোষবাবু প্রশ্ন রাখেন, আগে কোনওদিন তোর বন্ধু ঐ মাড়োয়াড়ি মহিলাকে দেখেছিল?

-না স্যার।

-ফিট হওয়া, বা মৃগীরোগের মত কিছু ছিল ওর?

-না স্যার।

-ডান্ডা না পড়লে সত্যি বেরোয় না, তাই না? হসপিটাল আমাদের জানিয়েছে, হারুচরণ দাস আজ ভোরে হার্টফেল করেছে। প্রচণ্ড একটা শক্ পেয়েছিল!

-বললাম তো স্যার, যা যা হয়েছিল সবই তো বললাম আপনাকে, কিচ্ছু লুকাইনি গো!

-হুম, পাপবোধ আসলে বিছের মত, কামড়ে চলে সবসময়! ভ্রমও হয়েছিল, যা বোঝা যাচ্ছে। বেশ, তুই বাড়ি যেতে পারিস।

হাতজোড় করে বড়োবাবুর পায়ে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে বৃদ্ধ কিষেণলাল। কনস্টেবল এসে ওকে ধরে তুলে দিলে আস্তে আস্তে থানা থেকে বেরিয়ে আসে আতঙ্কের সাথে, নিঃশব্দে। একটু দূরে বটগাছটার তলায় এসে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে, তারপর পকেট থেকে খৈনির ডিব্বা বার করে, হাতে কিছুটা খৈনি ঢেলে চুন মিশিয়ে ডলতে থাকে কাঁপা কাঁপা হাতে। থানার বিল্ডিং-এর দিকে একবার তাকিয়ে পুরো খৈনিটাকে মুখে পুরে নেয় আলতো করে। তারপর পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে, সেখানে লাল শাড়ি পরা এক মাড়োয়াড়ি স্ত্রী’র ছবি দেখে চোখের জল মোছে আঙুল দিয়ে। তারপর কেমন একটা হাসির ঝিলিক খেলে গিয়েই মিলিয়ে যায় মুখ থেকে! মানিব্যাগটাকে পকেটে ভরতে ভরতেই বাজারের দিকে হাঁটা দেয় কিষেণলাল যাদব।

0 comments: