1

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়






















সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবার সময় পর্যন্ত বাংলার বুকে যে সকল জমিদার তথা রাজপরিবারগুলির উত্থান-পতন ও রাজ্য পরিচালনার কাহিনি শোনা যায় বর্ধমান রাজপরিবার নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম। জমিদারির আয়তন ছিল প্রায় পাঁচহাজার বর্গমাইল জুড়ে। বর্ধমান ছাড়া বাঁকুড়া, মেদিনীপুর,হাওড়া, হুগলী ও মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন অঞ্চল ছিল এই জমিদারির অন্তর্গত। একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, বর্ধমান রাজবংশ দ্বারা শাসিত এই অঞ্চলটি কিন্তু স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য ছিল না। সেই সময় বাংলায় ত্রিপুরা ও কোচবিহার ছাড়া আর কোন রাজ্য স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত ছিল না। তৎসত্ত্বেও আয়তন, মান-মর্যাদা, রাজকীয় বৈভব, দান-ধ্যান, এবং বৃহত্তম করদাতাদের অন্যতম বলে বর্ধমান রাজপরিবারটি বাংলার অন্যতম রাজবংশ রূপে চিহ্নিত এবং রাজা নামে খ্যাত।
.
সম্রাট আকবরের সময় সুদূর পঞ্জাব থেকে আগত এই বস্ত্র ব্যবসায়ী পরিবারটি বর্ধমানে এসে ব্যবসার সুবাদে বসবাস শুরু করেন ও ক্রমে নবাবের নেকনজরে আসেন। ক্রমশঃ স্বীয় বুদ্ধি ও পরিশ্রমের বলে বংশানুক্রমে উন্নতি ও রাজা হওয়া এক ইতিহাসে পরিণত হয় যা বর্তমানে অনুসন্ধান এবং গবেষণার বিষয়রূপে বহু আলোচিত, বহু চর্চিত।
এই রাজবংশটির তিনশ বছরের রাজত্বকালে রাজত্ব করে গেছেন প্রায় কুড়িজন রাজা বা জমিদার(সতেরো-আঠারো পুরুষ ধরে)। এইসব রাজপুরুষদের নাম-ধাম, বংশমর্যাদা, কার্যকলাপ, রাজ্যশাসন, দান- ধ্যান-মহিমা, নির্মাণের নানান কাহিনি নানাভাবে নানা জায়গায় বর্ণিত, লিখিত, আলোচিত। কিন্তু রাজপরিবারের মহিলাদের মধ্যে কয়েকজন রমণীমাত্র ব্যতিরেকে রাজপরিবারের অন্তঃপুরবাসিনীরা রয়ে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। জনমানসে প্রতিবিম্বিত এই কয়েকজন রমণী ছাড়াও এই বিরাট রাজমহলে ছিলেন অনেক মহিষী, অনেক রাজকন্যা, রাজপুরনারীরা যাদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষমতা রাখতেন বিদ্যা ও বুদ্ধির। এদের মধ্যে কেউ কেউ বেছে নিতে পেরেছিলেন স্বাধীন মুক্ত জীবন, কেউ বা পেরেছিলেন নিজেকে সম্পুর্ণরূপে ঈশ্বরের পায়ে সমর্পণ করতে। আবার কেউ বা চার দেওয়ালের মধ্যেই কাটিয়েছেন রাজঅন্তঃপুরিকার জীবন।
.
একদা বাংলার বিখ্যাত এই পরিবারটির সঙ্গে সুদূর পঞ্জাব থেকে শুরু করে স্থানীয় অনেক নারীর ভাগ্যই যুক্ত হয়েছিল বিবাহ সূত্রে। রাজপরিবারের উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িত হয়েছিল তাঁদের ভাগ্য। রাজপরিবারের সঙ্গে সঙ্গে এঁদেরও কারো কারো জীবনে নেমে এসেছিল ভাগ্যের বিড়ম্বনা, কারো হয়েছিল ভাগ্য পরিবর্তন, কারো বা জীবন নির্ধারিত হয়েছিল অন্য পথে। আবার কেউ কেউ তা কাটিয়ে ঊঠে প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজপরিবারের সৌভাগ্য। কারো কারো দান-মহিমার কারণে গড়ে উঠেছে মন্দির, দেবালয়, অতিথিশালা। আবার কোনো সুচতুরা নারীর চাতুর্য্যে রাজপরিবারের কোনো ব্যক্তিজীবনে নেমে এসেছিল বিড়ম্বনা। কোন রমণীর ত্যাগ, তিতিক্ষার কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজপরিবারের মহিমা, আবার কখনও বা তার বিপরীত খেলা।
.
রাজপুরুষদের খ্যাতির মহিমা কীর্তন করা হলেও আড়ালে রয়ে গেছে সেই সব নারীদের জীবনের ইতিহাস যা কোন না কোনভাবে যুক্ত হয়ে আছে রাজপরিবারের কাহিনির সঙ্গে। কেমন ছিল সেইসব নারীদের জীবন? কেমন ভাবেই বা লালিত-পালিত হত সেইসব রাজকুমারীদের শৈশব, তাঁদের বিবাহিত জীবন? কিভাবে কাটত সেই রাজবাড়ির দিনগুলি? বিখ্যাত এই রাজপরিবারটিকে ঘিরে অনেক কৌতুহল, অনেক জিজ্ঞাসা। নানান গল্পগাথা ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। প্রকাশিত হয়েছে অনেক তথ্য, আবার আড়ালেও রয়ে গেছে অনেক। প্রায় বছর পাঁচেক আগে সুযোগ হয়েছিল এই পরিবারের কনিষ্ঠ মহারাজকুমারের সঙ্গে সেদিনের সেইসব দিন ও সেইসব নারীদের নিয়ে কথা বলার। এই রচনা সেই কথা বলার, আলোচনার ফসল মাত্র।
বর্ধমান রাজপরিবারের কনিষ্ঠ মহারাজকুমার শ্রী প্রণয়চাঁদ মহতাব প্রায় প্রতিবছরই দূর্গাপূজার সময় তিনি বর্ধমানে আসেন। বর্ধমান রাজপরিবারের পটের দূর্গাপূজার কথা হয়তো অনেকেরই জানা আছে। কনিষ্ঠ মহারাজকুমারের নিজস্ব উপস্থিতিতে ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবীর বোধন, অষ্টমীতে কুমারী পূজা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে এবং এই সময়ে কয়েকদিন তাঁর সঙ্গে কথাবলার মতো সময় তিনি আমায় দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে রাজপরিবারের এই দিকটি নিয়ে আলোচনার পরেই এবং অনুমতিক্রমেই বর্ধমান রাজঅন্তঃপুরের রমণীদের নিয়ে আমি লিখতে প্রবৃত্ত হই। আলোচনার সূত্র ধরেই উঠে এসেছে অনেক অজানা কাহিনি, অনেক তথ্য যেখানে রাজকীয় বৈভব, সম্মান আর মর্যাদাপূর্ণ জীবনের আড়ালে রয়েছে সাধারণ মানুষের মত চাওয়া-পাওয়া। যেখানে কঠোর শৃঙ্খলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে মাতৃত্বের আস্বাদ। কখনো বা আত্মাভিমান ও অহংকারের আড়ালে লুকিয়ে ছিল স্নেহ, প্রেম ও ত্যাগের সুকুমারবৃত্তি, আবার কখনো বা প্রকাশিত হয়েছে লোভী কুটিল চরিত্র। বর্ধমান রাজপরিবারের নারীদের মধ্যে ছিল এই সকল রকমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সকল রকম নারীদের মিলমিশ নিয়ে এক অন্দরমহল যার কিছুটা আঁচ হয়তো আমরা পেতে পারি এই রচনার মধ্য দিয়ে। কেমন ছিলেন সেইসব নারীরা, তাঁরা কারা...? সেই আলোচনাই ‘ বর্ধমান রাজঅন্তঃপুর’ রচনায়......।

(১ম পর্ব)

বর্ধমান রাজপরিবারের অন্তঃপুরনারীদের মধ্যে সকলের আগে যাঁর নাম তাঁরা সকলে এখনও গর্বের সঙ্গে মনে রাখেন , তিনি হলেন বর্ধমান রাজ কৃষ্ণরাম রায়ের কন্য সত্যবতী। মহারাজকুমার শ্রী প্রণয়চাঁদ মহতাবের মতে, এর আগের বিশেষ কোন রাজকন্যা বা রাজমহিষীদের নাম সেভাবে জানাও যায় না। হয়তো তাঁর বীরত্ব, তেজস্বীতার জন্যই মহারাজকুমারী সত্যবতীর নামটি রাজপরিবারে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। চিতুয়া বরদার শোভা সিংহের বর্ধমান আক্রমণ ঐতিহাসিক তথ্য। শোভা সিংহের বর্ধমান রাজপুরীতে মৃত্যুও ঐতিহাসিক ঘটনা। বর্ধমান নৃপতি কৃষ্ণরাম রায়ের কন্যা সত্যবতীর মর্য্যাদা স্খালনের চেষ্টা করলে সত্যবতী ছুরিকাঘাতে শোভা সিংহকে হত্যা করেন। কাহিনি এইরকমই শোনা যায়। তাঁর অসীম সাহস, আত্মমর্যাদাবোধ এবং শোভা সিংহ কে সমূলে বিনাশ করার জন্য বর্ধমান রাজপরিবার এই সাহসিনীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। যদিও, সেযুগে সঠিক কি ঘটনাটি ঘটেছিল, আজ আর তা জানার কোনো উপায় নেই, তবু বংশানুক্রমে চলে আসা বীরগাথাটি এখনও তাঁদের গর্ব ও আত্মসম্মানের বিষয় বলে তিনিও মনে করেন।
.
সত্যবতীর পর যে রাজপুরনারীর নাম উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন রাণী ব্রজকিশোরী, রাজা কীর্তিচাঁদের মহিষী। রাণী ব্রজকিশোরীর নাম দান-ধ্যান, পুষ্করিণী খনন, দেবালয় প্রতিষ্ঠা এসব কাজের সঙ্গেই বেশি যুক্ত এবং রাজকার্য পরিচালনায় তাঁর তেমন কোন ভূমিকা দেখা যায় না, তবু সে যুগের একজন নারী, তিনি রাণী হলেও রাজঅন্তঃপুরের ঘেরাটোপের মধ্যে পর্দানশীন হয়ে না থেকে এতরকম কাজ করতে পেরেছিলেন, সেটি একটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে করা যেতে পারে। বর্ধমান রাজপরিবারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র বা সবচেয়ে উজ্জ্বল নারী চরিত্র বলতে মহারাণী বিষেনকুমারী বা বিষ্ণুকুমারীর নাম সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। শ্রী প্রণয়চাঁদ মহতাবের মতে, মহারাণী বিষ্ণুকুমারীর মত মহিলা রাজপরিবারে না থাকলে বর্ধমান জমিদারির অনেকখানিই ব্রিটিশদের হাতে বাজেয়াপ্ত হত।
.
মহারাণী বিষ্ণুকুমারী ছিলেন মহারাজ তেজচাঁদের মাতা। প্রথম যৌবনে তেজচাঁদ ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল, রাজকার্যে অমনোযোগী। তাঁর অমনোযোগিতার কারণে জমিদারি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। কিন্তু সেইসময় মহারাণী বিষ্ণুকুমারী তাঁর জমিদারী রক্ষার জন্য সচেষ্ট হন এবং মহারাণী বিষ্ণুকুমারীর পরামর্শে মহারাজ তেজচাঁদ ও বিষ্ণুকুমারী উভয়ে জমিদারি রক্ষার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করেন। যার ফলে ইংরাজ সরকার তাঁদের প্রতি বিরূপ হলেও তাঁদের কোনভাবেই দমন করতে পারেনি। শেষমেশ ইংরাজ সরকার তাঁদের কয়েকবার গৃহবন্দী বা নজরবন্দী করে রাখলেও ইংরাজদের অধীনস্থ হতে হয়নি এবং ইংরাজ সরকার কোনমতেই কিছু আদায় করতে পারেনি। কখনও মাতা পুত্রের নামে, কখন পুত্র মাতার নামে ক্রমাগতঃ একের পর এক মামলা চালিয়ে যাবার জন্য, এবং ইংরাজ সরকার পূর্বতন মামলার নিষ্পত্তি ব্যতিরেকে পরবর্তী মামলার রায় দান না করতে পারার জন্য একের পর এক পুনঃ পুনঃ মামলা চলার ফলে বারে বারেই ব্রিটিশ সরকারকে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়েছে, কিন্তু রাজপরিবারের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। যার জন্য পরবর্তী কালে মহতাবচাঁদ তাঁর জমিদারির অনেকখানি পেয়েছিলেন সুরক্ষিত অবস্থায়। এবং তার পরপরই বর্ধমান জমিদারিতে পত্তনিদার প্রথা চালু হয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার বর্ধমান রাজের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু সুবিধা করতে পারেনি। ফলে জমিদারিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখ থেকে রাজমাতা বিষ্ণুকুমারীর বুদ্ধিবলেই রক্ষা পায়।
.
পূর্ববর্তী মহারাজ ত্রিলোকচাঁদ ছিলেন অত্যন্ত ব্রিটিশবিরোধী। কিন্তু পরবর্তী মহারাজা মহতাবচাঁদ বুঝেছিলেন যে ব্রিটিশরাজ সেইসময় পুরোপুরি এদেশে রাজত্ব কায়েম করেছে। তখন ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে শত্রুতা করার চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ধরে রাখতে পারলে বা দেখালে আর যাই হোক জমিদারির দিক দিয়ে তা লাভবান হবে। তাই তাঁর আমল থেকেই বর্ধমানের জমিদারিতে ব্রিটিশ বিরোধী হাওয়ার বদলে কিছুটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তার সুফলও মেলে অচিরেই। ইংরাজদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখার জন্য তাঁর আমলেই তিনি প্রথম ‘His Highness Maharajadhiraj’ উপাধি পান। যদিও এই জমিদারি এবং তার আয়ের জন্য মহারাজা মহতাবচাঁদ ও তাঁর পরিবার অনেকখানি মহারাণী বিষেণকুমারীর বা বিষ্ণুকুমারীর কাছে ঋণী। তিনি না হলে এবং তেজচাঁদের সঙ্গে যৌথভাবে সেই সময় কৌশলে জমিদারি রক্ষার উপায় অবলম্বন না করলে এই বিশাল জমিদারির অনেকখানিই শেষ হয়ে যেত। তাই বর্ধমান রাজপরিবারে তিনি একজন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য নারী বলা যেতেই পারে। বর্ধমানের অনেক দেবালয়, পুষ্করিণী রাণী বিষ্ণুকুমারীর সময়ে স্থাপিত।
.
বর্ধমান রাজপরিবারে যতজন রাজা রাজত্ব করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই মহারাজা তেজচাঁদ এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। ভালো-খারাপ দুই অর্থেই তাঁর সুনাম ও বদনাম আছে বলা যায়। খামখেয়ালী, উচ্ছৃঙ্খল, বিলাসী, যৌবন মদমত্ত রাজা বলা যাতে পারে তাঁকে। আবার পরবর্তীকালে তিনিই প্রজাদের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। তাঁর সম্বন্ধে নানারকম গাল-গল্প প্রচলিত আছে। অনেকের মতে তিনি সাপে কামড়ানোর ঔষধ জানতেন। কিন্তু শ্রী প্রণয়চাঁদের মতে পারিবারিক ইতিহাসে এই বক্তব্যের সমর্থনের কোন হদিশ তিনি পাননি।
.
মহারাজ তেজচাঁদের ছিল ৮জন মহিষী। বর্ধমান রাজপরিবারে তাঁদের ভূমিকা কি ছিল এবং আদৌ কিছু ভূমিকা ছিল কিনা স্বাভাবিকভাবেই তা মনে হতে পারে । কথা প্রসঙ্গে জানা গেল তেজচাঁদের প্রথমা, দ্বিতীয়া এবং তৃতীয়া পত্নীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল একই দিনে। শুধু তাই নয়, তাঁর চতুর্থ বিবাহটিও সম্পন্ন হয় প্রথম তিনটি বিবাহের এক সপ্তাহের মধ্যেই। তেজচাঁদের বিবাহের ঘটনাও চমকপ্রদ। বর্ধমান রাজপরিবারেও এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। সাধারণভাবে এই ঘটনা অস্বাভাবিক মনে হলেও বিবাহের ঘটনাটিও মহারাজ তেজচাঁদের চরিত্রের মতই খামখেয়ালীপনায় পরিপূর্ণ। বর্ধমান রাজপরিবারের নিয়মানুযায়ী বিবাহ হত পাত্র ও পাত্রীর করকোষ্ঠীর মিল দেখে। মহারাজা তেজচাঁদের এই তিন রাণীর সঙ্গে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হবার আগে আরো একজায়গায় করকোষ্ঠীর গণনা কার্য চলার সময়ই এই তিন বিবাহ একসঙ্গে হয়। কিন্তু ওদিকে করকোষ্ঠীর মিল হওয়ায় পাত্রীর পিতা বর্ধমান রওনা হয়ে জানতে পারেন যে ইতিমধ্যেই তার আগের দিন মহারাজার তিনজন কন্যার সঙ্গে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়েছে। রাগে এবং দুঃখে সেই পাত্রীর পিতা মহারাজার নামে আদালতে মামলা করেন। সুতরাং বাধ্য হয়ে একসপ্তাহের মধ্যেই সেই নারীটিকেও চতুর্থ পত্নী হিসাবে গ্রহণ করেন। পরে পঞ্চম পত্নী হিসাবে পাণি গ্রহণ করেন পরাণচাঁদ কাপুরের ভগিনী কমলকুমারীকে। কমলকুমারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি পঞ্চমবার বিবাহ করেন। কিন্তু মহারাজের এই পাঁচপত্নীর একজনেরও সন্তানাদি না থাকায় আবার বিবাহ করেন ষষ্ঠ বার, নানকী দেবীকে। একমাত্র নানকী দেবীর গর্ভেই জন্ম নেন তাঁর একমাত্র সন্তান প্রতাপচাঁদ। পরবর্তী কালে এই প্রতাপচাঁদকে ঘিরেই বর্ধমান রাজপরিবারে ঘটে নানান সমস্যা, নানান গল্প গাথা, নানান মামলা, মোকদ্দমা ইত্যাদি।
অনেকের মতে প্রতাপচাঁদের গৃহত্যাগের পিছনে আছে রাণী কমলকুমারীর ষড়যন্ত্র। কমলকুমারী ছিলেন প্রখর বুদ্ধিশালিনী। মহারাজ তেজচাঁদের প্রিয় মহিষী হ’বার সুবাদে রাজপরিবারের অনেক ঘটনার পিছনেই ছিল তাঁর মস্তিষ্ক। অনেকের মতে রাণী কমলকুমারী এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পরানচাঁদ কাপুরের ছিল অর্থলিপ্সা ও উচ্চাভিলাষ। দুয়ের ষড়যন্ত্রে প্রতাপচাঁদ রাণী কমলকুমারীর ফাঁদে পা দেন কিন্তু পিতার মহিষী মাতৃসমা রাণী কমলকুমারীর আচরণে লজ্জ্বিত ও দুঃখিত প্রতাপচাদ বর্ধমান রাজপরিবার ও বর্ধমান ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ফিরে এলে শুরু হয় জাল প্রতাপচাঁদের মামলা। কিন্তু সে অন্য ইতিহাস। রাজপুরনারীদের জীবনবৃত্তান্ত বা রাজঅন্তঃপুরবাসিনীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। যদিও, মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ জাল প্রতাপচাঁদের ঘটনা বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে প্রতাপচাঁদের সপক্ষে কোন রকম রেকর্ডই পাওয়া যায় না।
.
সেকালে জাল প্রতাপচাঁদের মামলা ঘিরে বর্ধমান এবং সারা বাংলা যথেষ্ট আলোড়িত হয়। রবীন্দ্র পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও এই মামলার একজন সাক্ষী হিসাবে আদালতে উপস্থিত হয়ে প্রতাপের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। অনেকের মতে, দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ‘কার এন্ড ট্যাগোর’ কম্পানীর একজন কর্মকর্তা, বর্ধমান রাজপরিবারের আইনী পরামর্শদাদা ছিলেন ‘কার এন্ড ট্যাগোর’ কোম্পানী। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি বর্ধমান রাজপরিবারের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ঘটনা যাই হোক না কেন, শ্রী প্রণয়চাঁদও বিশ্বাস করেন যে প্রতাপচাঁদ মারাই গিয়েছিলেন। তাছাড়া প্রতাপচাঁদ ছিলেন সুরাসক্ত। নিজের দুই স্ত্রী প্যারীকুমারী এবং আনন্দকুমারী ছাড়াও তাঁর ‘বিলাতী খামুন’ নামে এক বিদেশিনী রক্ষিতা ছিল, যে মহিলা আবার ছিলেন সেই সময়ের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টারের বান্ধবী। অর্থাৎ প্রতাপচাঁদ মদ এবং নারীতে আসক্ত ছিলেন। অতিরিক্ত সুরাপানে তাঁর মৃত্যু হওয়া স্বাভাবিক ছিল। প্রতাপচাঁদের দুই মহিষীর অনুরোধে রাজপরিবারের তহবিল থেকে প্রতাপের মৃত্যুর পর(রাজপরিবারের মতে প্রতাপের মৃত্যুই ঘটেছিল) কালনায় প্রতাপের নামে একটি অসাধারণ টেরাকোটা কারুকার্য মন্ডিত মন্দির নির্মিত হয় যা প্রতাপেশ্বর শিব মন্দির নামে খ্যাত এবং এই মন্দিরটি প্রতাপের নাম এখনও বহন করে চলে...
(ক্রমশঃ)
(রচনাটি পূর্ব প্রকাশিত)
ছবি---মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ মহতাব ও লেখিকা



1 comment: