1

গল্প - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়







শুনশান মহাশ্মশান। জনমানবের চিহ্ণ নেই চারিদিকে। বসন্তের ফুল ফুটে আছে গোল ছোট্ট সবুজ সাজানো বাগানটায়। এই বাগানকে ঘুরে শববাহী গাড়িগুলো মৃতদেহ নামিয়ে বেরিয়ে যায়। আজ কোন গাড়ি নেই পার্কিং-এ। কেবল একটা হলুদ কুকুর দিনের শেষ হলুদ আলো মেখে আলসেমি করে শুয়ে আছে বাগানটার পাশে। সে একাই আছে। তার সাথীরা কোথায় তা সে-ও জানে না। কদিন খাওয়া হয়নি সেরকম। অন্যসময় বিস্কুট পাউরুটির টুকরো বা এটা সেটা ছুঁড়ে দেওয়া, আদর করে দেওয়া খাবার খেয়ে দিব্যি চলে যায় দিনগুলো। কিন্তু কদিন শ্মশানের সামনে চা-বিস্কুটের দোকানগুলোও বন্ধ। শেষ মানুষটা বিদায় নিয়েছে প্রায় একঘন্টা আগে। কোন একটা মড়ার সাথে এসেছিল। পোড়ানোর পর ডোম ইলেকট্রিক চুল্লির নিচে নেমে তার হাতে মাটির সরায় অস্থির টুকরো দিয়ে দিয়েছিল। সেটা নিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়েও এসেছে সাথীদের সাথে। পুলিশে তাড়া দিয়েছিল তাড়াতাড়ি করার জন্যে। প্রিয় স্ত্রীর বিদায়ের শোকটাও ঠিকমত বুঝতে পারল না লোকটা। একটু বেশি সময় থাকতে চেয়েছিল যেখানে শেষবারের মত চোখে দেখেছিল। একরকম জোর করেই সাদা পোশাকের পুলিশ চলে যেতে বলে। ভাল করেই বলেছিল। আন্তরিক অথচ দৃঢ় ছিল পুলিশের ভাষা। সেই থেকে আর একটাও লোককে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। কতকগুলো টিয়াপাখি সবুজের ঢেউ তুলে এগাছে ওগাছে ছুটোছুটি করছে। শালিকের কিচিরমিচির ঝগড়ার বিরাম নেই। পায়রারা মাটি থেকে কিসব খুটে খুটে খাচ্ছে আর গলা ফুলিয়ে বকবকম আওয়াজ করছে।

একটা সাদা শববাহী গাড়ি লোহার গেট পেরিয়ে ঢুকে এসে চুল্লির দিকে এগিয়ে যাবার সিঁড়ির কাছে দাঁড়াল। তার পেছন পেছন একটা কালো পুলিশের গাড়ি। শববাহী গাড়ি থেকে ড্রাইভার ও সহযোগী নেমে এল। তাদের মুখ মাথা ঢাকা। পুলিশের ভ্যান থেকেও মাথা মুখ ঢেকে এক ইনস্পেকটর ও চারটে কনস্টেবল তাড়াহুড়ো করে নেমে এল। ইনস্পেকটর নেমেই সোজা চলে গেল কর্পোরেশনের অফিস ঘরে।

নাম?

সন্দীপ বোস

বয়স?

৬৩

কর্মচারীর প্রশ্নের জবাব দিতে দিতেই ইনস্পেকটর মৃতের আধার কার্ড এগিয়ে দেন। কর্পোরেশনের কর্মচারী সেটা দেখে খাতায় লিখতে থাকেন।

‘কী করতেন ভদ্রলোক?’ কৌতুহল বশে কর্মচারীটির প্রশ্ন।

‘ওষুধের দোকান ছিল’, ইনস্পেকটর নিচু গলায় জবাব দেন, ‘নিজে মাল্টিন্যাশানাল ড্রাগ কোম্পানীতে বড় পোস্টে ছিলেন।’

‘ইটালি ফেরত?’

‘না, না, মাস কয়েক আগে বিদেশ গেছিলেন ছেলের কাছে, আমেরিকায়।’

‘হ্যাঁ, টিভিতে দেখলাম, এই প্রথম শহরে থেকেই আক্রান্ত ও মৃত্যু। ও, ইনিই সেই লোক?’

ইনস্পেকটর মাথা নাড়িয়ে হাতে স্লিপ নিয়ে চলে গেলেন যেখান থেকে বাঁশের মাচা, ঘট, সরা, পাটকাটি দেওয়া হয়। কনস্টেবল চারজন পেছনে পেছনে চলল। শুধু বাঁশের মাচাটা নিয়ে চলে গেল শববাহী গাড়ির কাছে। পুরোহিতকে দূরে থাকতে ইশারা করে ইনস্পেকটর ডোমকে বলে দিলেন চুল্লির মুখ খুলে রাখতে। ডোমের নাকে-মুখে গামছা বাঁধা। সে চলে গেল চুল্লির কাছে। গাড়ির স্ট্রেচার থেকে সরাসরি বাঁশের মাচায় বডি ট্রান্সফার হয়ে গেল। গ্লাভস হাতে চারজন কনস্টেবল শবদেহ নিয়ে চললেন চুল্লির দরজার দিকে। সিঁড়ির ছটা ধাপ সাবধানে পার হয়ে একেবারে লোহার সেই মোটা পাতের ওপর শুইয়ে দিলেন। ডোম চুল্লির পাশে হাতলে টান দিতেই চুল্লির মুখ খুলে গেল আর মাচায় শোয়ানো দেহটা একফুট ওপরে উঁচু হয়ে ঢুকে গেল হাঁ-করা গনগনে ইলেকট্রিক আভেনের ভেতর। শরীরটা ঢুকতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। তখন ঘড়িতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। পশ্চিমের আকাশে দু-এক টুকরো মেঘ গৈরিক উত্তরীয়ে ঢেকে রয়েছে। কমে আসছে দিনের আলো। বেড়ালের মত ওঁৎ পেতে রয়েছে সন্ধ্যে। যেমন এসেছিল তেমনই বেরিয়ে গেল শববাহী গাড়ি আর পুলিশের কালো ভ্যান।

একটা মৃত্যু এত নির্জন, নির্বান্ধবও হতে পারে! কোন কান্নার রোল নেই। নেই ফুলের মালা, স্তবক। ধুপের চড়া ধোঁয়া আর গন্ধ সেও নেই। নেই অগরু সেন্টের বাস। একটা শবদাহ এত নিঃশব্দ! অগ্নিকে সমর্পন করার আগে ‘হরিবোল’ বলল না কেউ মৃদুস্বরে। কেউ অপেক্ষা করার নেই দাহ হবার পর অস্থিটুকু সংগ্রহ করার। তাকে কোনো অজানা লোকের উদ্দেশ্যে সরার মধ্যে মাটি চাপা দিয়ে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেবার জন্যে কেউ শোকে মুহ্যমান হয়ে বসে রইল না। মানুষ কাঁদতে কি ভুলে গেল? কী এমন আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে যে শ্মশানের শূন্যতা ও নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সারা শহরে! শুধু শহরেই বা বলি কেন, সারা রাজ্যে, সব রাজ্যে, দেশে। দেশে দেশে শব সৎকারের এই একই নিঃসঙ্গতার দৃশ্য।


শুধু আমাদের দেশই নয়, পৃথিবীব্যাপী স্থলভূমি জনমানবহীন। রাস্তা, অফিস, ব্যবসাকেন্দ্র, দোকান, বাজার, মল, রেল স্টেশন। ট্রেন, বাস, প্লেন, জাহাজ চলাচল বন্ধ। সব রকমের যানবাহন এমনকি সাইকেল চলাও বন্ধ। লোকে পায়ে হেঁটেও কোথাও যেতে ভয় পাচ্ছে। বিনোদনের সবকিছু অন্ধকার। সমুদ্র সৈকত নিরিবিলি পড়ে রয়েছে। তীরে ভাঙা ঢেউয়ের আওয়াজ হাহাকার হয়ে বেজে যায় সাগর বেলায়। পৃথিবীতে যে মানুষ আছে তার কোন চিহ্ণ আজ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানবকৃত কোন শব্দ কোথাও শোনা যাচ্ছে না। না বাড়িতে, না বাইরে। নেই অট্টহাসি, কলরোল। বন্ধ ঝগড়া, বিবাদ। রাস্তায় নেই কোন ফেরিওয়ালা।

‘এমন নৈশঃব্দের শহর কেউ কখনও দেখেছে?’ রাতে খেতে বসে সন্দীপ তার স্ত্রী রীমাকে বলে। ‘দোকানে কী ভিড়। লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মাস্কের জন্যে। স্যানিটাইজার সাপ্লাই আসার দুঘন্টার মধ্যে উধাও। মাস্কও আজ শেষ হয়ে গেল। ওষুধও যেন মুঠো মুঠো খাবে লোকে। থলে ভর্তি করে ওষুধ নিয়ে যাচ্ছে।’

রীমা খেতে খেতে বলে, ‘তা ওষুধ রেশন করে দিলেই পারো। সবাই যাতে কিছু কিছু পায়। তোমায় আর একটা রুটি দি?’

‘করতে গেছিলাম রেশন। সে কী হুমকি!’

‘রুটি দি?’

‘না গো। ভাল লাগছে না খেতে। বোধহয় গ্যাস হয়েছে। মাছটা আর খেলাম না।’

‘একটা ওষুধ খেয়ে নাও।’

সন্দীপ টেবিল ছেড়ে ঊঠে হাতমুখ ধুয়ে ওষুধ খেল। সারা দিনে ও রাতে অনেকগুলোই ওষুধ খেতে হয়। ডায়াবিটিস, কোলেস্টেরল, ব্লাড প্রেসার, থাইরয়েড সব রকম রোগই শরীরে বাসা বেঁধেছে প্রায় দশ বছর আগে থেকে। হালে আবার প্রস্টেট দেখা দিয়েছে। খাবারদাবার যতটা পারেন নিয়ম মেনেই চলেন। রোজ মর্নিংওয়াক, কিছুটা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, সবই করেন। সেই দশ বছর আগে থেকে।

একটা নামকরা মাল্টিন্যাশানাল ড্রাগ কোম্পানিতে চাকরীতে ঢোকেন সেলসম্যান হয়ে। তখন সেলস এক্সিকিউটিভ বলা শুরু হয় নি। তা প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। ডাক্তার হবার বাসনা বিফলে যায় জয়েন্টে চান্স না পাওয়ায়। বাবার ইচ্ছেমত ফার্মাসিউটিক্যাল বি ফার্মা কোর্সে ভর্তি। সেখান থেকে সসম্মানে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে এই নামকরা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে জয়েন। ধাপে ধাপে উন্নতি। এরই মধ্যে কোম্পানির খরচে বিদেশে গিয়ে ম্যানেজমেন্ট করে এসেছেন। উন্নতির সাথে সাথে বিবাহিত জীবন, সংসার সব নিয়ম করে এগিয়ে চলে। স্ত্রী রীমাও ব্যাঙ্কের প্রবেশন অফিসার থেকে ক্রমোন্নতি। মাঝেমাঝেই বিদেশ যেতে হত সন্দীপকে, সেসময় রীমাই সংসার সামলাতেন। মেয়ে বড়, তারপর ছেলে। বাবার ইচ্ছানুসারে মেয়ে ডাক্তার, বিয়েও হয় ডাক্তারের সাথে। বর্তমানে চণ্ডীগরে দুজনেই। জামাই হৃদয় দেখে, মেয়ে স্নায়ু। সন্তান নেই। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, এম টেক করে ম্যানেজমেন্ট পাশ করে আমেরিকায় পাকাপাকি বসবাস। বছরে একবার আসার চেষ্টা করে। বছর ছয় আগে ওখানেই এক ইতালিয়ান মেয়েকে বিয়ে করে। দু বছর আগে ওদের এক সন্তান হয়।

সন্দীপ অবসর নিয়ে নেন আটান্ন বছর বয়সেই। একরকম জোর করেই। তার পাঁচ বছর আগে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রমোশন হবার পরই মধ্য এবং পশ্চিম এশিয়ার পুরো দায়িত্ব সামলাতে হত সন্দীপকে। সেই চাপ বোধহয় শরীর নিতে নারাজ হয়। নানা ব্যাধি আসতে শুরু করে। সাতান্নয় একটা মাইল্ড অ্যাটাকও হয়ে যায়। সেই থেকে সিদ্ধান্ত নেন অবসরের। পরের বছর তা কার্যকর হয়। কিন্তু কাজের মানুষরা না পারে বিনা কাজে বাড়িতে বসে থাকতে আবার কাজের মানুষদের ছাড়েও না কর্মক্ষেত্র। একটা অন্য নতুন কোম্পানি প্রস্তাব দেয় মার্কেটিং ও ডিলারশিপের কনসাল্টেনসি। কয়েকমাস করার পর ভাল লাগে না। বাড়ির কাছে একটা ওষুধের দোকান দেন। কিছুদিনের মধ্যেই দোকানের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। বেশ আছেন এই দোকান আর সেখানের গোটা দশেক কর্মচারী নিয়ে। মাস ছয়েক আগে সিনিয়র ম্যানেজার হয়ে ব্যাঙ্ক থেকে রিটায়ার করেন রীমা। তারপরেই ওনারা কয়েকমাসের জন্যে ছেলের কাছে আমেরিকায় চলে যান। পুত্রবধু মিশেল আবার সেসময় কিছু দিনের জন্যে নিজের দেশে যায়। সে ফেরার পর বোস দম্পতি আমেরিকা থেকে ফিরে আসেন জানুয়ারির শেষে। ততদিনে চিনে এক নতুন ভাইরাসের আক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এই নতুন ভাইরাসের নাম করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯।


কোভিড-১৯ নিয়ে খবর সন্দীপ ও রীমা আমেরিকা থাকতেই জেনেছিল। আর তা নিয়ে আলোচনাও হত। চিনের উহান থেকে ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। মিশেল স্বাস্থ্যকর্মী, তার কাছ থেকে আরও অনেক তথ্য জানতে পারে তারা। কিন্তু ওরা যতদিনে আমেরিকা থেকে দেশে ফেরে তার অনেক আগেই চিনে এই রোগ মারণ আকার নিয়েছে এবং মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্য কয়েকটা দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। বোস দম্পতি অবশ্য নির্বিঘ্নে শহরে ফিরে এসেছেন। সন্দীপ আবার দোকানে যেতে শুরু করেছেন।

‘হ্যাঁগো, মিশেল তো সুস্থই ছিল। ওর তো কোন লক্ষণ দেখিনি, তাই না?’ মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খেতে বলেই ফেলেন রীমা একদিন। সেটা ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহ। রীমা কাগজে পড়েছেন টিভিতে দেখেছেন চিন থেকে ইতালি সহ ইওরোপের অনেক দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকায় থাকতেই মিশেল ইতালি থেকে ফিরেছে তাই তার মনে একটা আশঙ্কা ও সেই সাথে আতঙ্ক উঁকি মারছে। আমেরিকাতেও থাবা বসিয়েছে এই রোগ।

‘না, না, তাহলে এতদিনে সিম্পটম দেখা দিত। ওসব নিয়ে তুমি ভেব না। ও নিজে হেলথ ওয়ার্কার, ও জানবে না?’ আশ্বস্ত করেন সন্দীপ।


রীমার বিদেশি সাহিত্য পড়ার ঝোঁক আছে। কামুর ‘দ্য প্লেগ’ পড়ে শিউরে উঠেছিল। কেন যেন ঘুম আসতে চাইছিল না সেই রাতে। বারবার ঘুরেফিরে তিনটে উপন্যাসের কথা মনে আসছিল। তার মধ্যে অবশ্যই কামুর বইটা। দ্বিতীয় সিনক্লেয়ার লুইসের ‘অ্যারোজস্মিথ’ আর তৃতীয়টা জো সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’। পৃথিবীর তিনটে ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভাষায় রচিত তিনটে মহামারী-আক্রান্ত মন খারাপ করা রচনা। মহামারীর জন্যে বাইরের জগতের থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ। অবরুদ্ধ তার জীবন। অভিন্ন সংকট ও জীবন জিজ্ঞাসায় শিহরিত মানুষ। মৃত্যুভয়তাড়িত এবং অস্তিত্বশূন্যতার ভয়াবহ মানবীয় পরিস্থিতিকে লেখকেরা ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত নিপুণ দক্ষতায়। তবে কি চলমান বৈশ্বিক মহামারী করোনার বাস্তব চিত্র দেখতে পাচ্ছে রীমা? দেখতে পাচ্ছে প্রতিটা মানুষ একা, অবরুদ্ধ, বিচ্ছিন্ন এবং সঙ্ঘজীবন থেকে অস্তিত্বের প্রশ্নে বিতাড়িত। ঘেমে ওঠে রীমা। শেষ ফাগুনের রাতের হাওয়া তাকে আরাম দেয় না। দরজা জানালা বন্ধ করে। এসিটা চালিয়ে দেয়। বাথরুম ঘুরে এসে ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে কিছুটা সময় বসে আরাম কেদারায়। ভাবে, কেন গেছিল গত সপ্তাহে গুরুগ্রামে। জামাইয়ের এক আত্মীয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল। আর্জি জানিয়েছিল মেয়েকে, বলেছিল যেভাবে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে ভারতে তাতে ওদের না যাওয়ার সিদ্ধান্ত। কোন অনুরোধই মানতে চায় নি মেয়ে, বলেছিল নাহলে সম্মানে বাধবে। অগত্যা মেয়ের সম্মান রক্ষার্থে যেতে হয়েছিল গুরুগ্রাম। কী বিশাল আয়োজন দেখে চমকে গেছিল। তবে চমকটা ভয়ে পরিণত হল যখন দেখে বিদেশী পুরুষ মহিলারা সংখ্যায় বেশ বেশি এবং তারমধ্যে কয়েকজন সম্প্রতি এসেছে।

দুদিন থেকে ফিরেও এসেছে ভালয় ভালয়। জল খেয়ে শুতে যাবে খক খক করে দুবার কেশে উঠল সন্দীপ। রীমাকে বলল, ‘শীত শীত করছে, এসিটা বন্ধ করে দাও।’

অন্ধকারেই ফিরে তাকালো সন্দীপের দিকে। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। কপালে হাত দিল সদীপের। না, জ্বর নেই। গায়ে চাপাটা দিয়ে দিল।

এসি বন্ধ। আবার জানালাটা খুলে দিল। দরজা খুলে ব্যালকনিতে দাঁড়াল। হালকা হিমেল হাওয়া বইছে। অমাবস্যা আসছে। রাতের তারারা জেগে উঠেছে। কিন্তু শহরে রাতে এত তারা দেখা যায় না তো! মনে পড়ল বাতাসে দূষণের পরিমাণ কমে গেছে, যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ করেছে সরকার। কিছুতেই ঘুম আসছে না। সেদিন অত রাত পর্যন্ত বিদেশীগুলোর সাথে রাতে আড্ডা না মারলেই হত। কে জানে, কে মারণ ভাইরাস দেহে নিয়ে ঘুরছে। অনেকটা সময় ব্যালকনিতে বসে বসে তন্দ্রা আসছিল। সন্দীপের আবার কাশি। সন্দীপ পাশ ফিরে শুলো।

ঘুম আর দুশ্চিন্তা দুটোই একসাথে এসে গেল। ফলে যা হবার তাই হল। স্বপ্নে ইঁদুরের উৎপাত। বাড়ির প্রতিটা ঘরে বড় বড় ধেড়ে ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছুটে ছুটে এঘর ওঘর করছে। রান্নাঘরের প্রতিটা তাকে ইঁদুর। এবার ইঁদুর যখন বিছানায় উঠে পড়ল তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর উঠেই পড়ল। সন্দীপের কপালে হাত রাখল। ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে মনে হল। আর ভাবতে পারে না রীমা। আবার ব্যালকনিতে এল। মধ্য বসন্তের ঊষা চোখের সামনে। একটা পাখির তীক্ষ্ণ স্বরে জেগে উঠল আরও অনেক পাখি। নড়ে উঠল গাছের পাতারা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল। এমন ভোর হওয়া অনেকদিন দেখেনি সে। চা খাবার ইচ্ছে হল।

বাথরুম সেরে রান্নাঘরে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল। নিজেই হেসে ফেলল। ও তো স্বপ্নে ছিল। ওদের বাড়িতে ইঁদুর নেই। জল চাপিয়ে আবার ব্যলকনিতে গেল। এবার পূবমুখী লিভিং রুম লাগোয়া ব্যালকনিতে। আকাশের কপালে তখন টকটকে রাঙা সিঁদুর।

বেড সাইড টেবিলে সন্দীপের চা রেখে ডাকল। চাদরটাকে আরও জড়িয়ে অন্য পাশ ফিরে বলল, ‘আবার কি শীত ঘুরে এল?’

আবার কপালে হাত। হ্যাঁ, কপাল গরম। ডিজিটাল থার্মোমিটার বগলে রাখল। সাঁইত্রিশ। এরই মধ্যে দুবার কাশিও হল। উঠেই পড়ল সন্দীপ। চা-টা খেয়ে বাথরুমে যেতে গিয়ে একটু টলে গেল। সামলে নিল অবশ্য। সব লক্ষ্য করছে রীমা।

সাড়ে আটটা বেজে গেল। দোকান থেকে অনির ফোন এসেছে। অনি হচ্ছে সন্দীপের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মচারী। ওর অনুপস্থিতিতে অনিই দোকানের ব-কলমে মালিক। ফোন শেষ করে বেরিয়ে গেল সন্দীপ। কাশিটা রয়েই গেছে। হাঁটাপথে দোকান।

বারোটায় ফিরে এল অনির সাথে। চোখ লাল হয়েছে। রীমা জ্বর দেখল, উনচল্লিশ। ডাক্তার ডাকল রীমা। ‘শ্বাসকষ্ট হচ্ছে?’ ফোনেই জিগ্যেস করে ডাক্তার। ‘না’ শুনে ওষুধ বলে দেন। অনি দোকান থেকে তখনই দিয়ে যায়। বিকেলের দিকে জ্বর কমে। কাশিও কমে যায়।


আমেরিকায় হু হু করে বাড়ছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। রাতে ফোন এল ছেলের। মিশেল কোয়ারান্টাইনে গেছে। ও একা ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে আছে। রীমাও বলল সন্দীপের জ্বর কাশির কথা। ‘সেরকম বুঝলে আলাদা একটা ঘরে ব্যবস্থা কর বাবার’ ছেলে শুনে বলল। রীমার কপালে ভাঁজ। নানা চিন্তার জট মনে। একা কী করে সব সামাল দেবে। কীভাবে মানুষটা সব ছেড়ে আলাদা থাকবে।

ভারতে দিনে দিনে ছড়াচ্ছে রোগ। মারা যাচ্ছেও অনেকে। সরকারী ও প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে অনেকে। সন্দেহ হলেই লোকে গিয়ে দেখিয়ে আসছে, নিশ্চিত হতে চাইছে যে করোনায় আক্রান্ত নয়। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিবাদন ও উদ্বোধিত করতে এক রোববার পাঁচ মিনিটের জন্যে হাততালি, ঘন্টা ইত্যাদি বাজাতে বলেন। সেদিন আবার জনতা কার্ফু সারাদিন। মেয়ে ফোন করে জানালো কী ঘটা করে সব মিছিল বের করে সেই আদেশ পালন করেছে। ডাক্তাররা সবাই বিরক্ত।

জনতা কার্ফু শেষ হতেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় সন্দীপের। রীমা আর দেরি করে না। ড্রাইভার ডেকে নিয়ে চলে যায় চেনা এক ডাক্তারের পরামর্শে এক নামী প্রাইভেট হাসপাতালে। সঙ্গে সঙ্গে আই সি ইউ তে ঢুকিয়ে দিয়ে অক্সিজেন শুরু করে দেয় ডাক্তার। রীমা, অনি বাইরে বসে থাকে। মেয়েকে খবর করে রীমা।

‘এখন স্টেবল। আপনারা বাড়ি যান’, ডাক্তার রীমাদের বলে। ওরা বাড়ি চলে আসে।

সকালের ফ্লাইটেই মেয়ে চলে আসে মার কাছে। দুপুরে দেখতে যায় ওরা সন্দীপকে। সঙ্গে অনি। ডাক্তার জানায় প্রাথমিক পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ। আবারও পরীক্ষার জন্যে নমুনা ইনসেড পাঠানো হয়েছে। রীমার হাত পা ছেড়ে যায়। ওদের তিনজনকে আলাদা একটা ঘরে আইসোলেটেড করে দেওয়া হয়। অন্য হাসপাতাল থেকে লোক এসে পরীক্ষা করে রক্ত ও লালারসের নমুনা সংগ্রহ করে ওদেরও।

টিভিতে প্রচার হয়ে যায় খবর। এবার বিদেশ ফেরত নয়, শহরে থাকতেই আক্রান্ত করোনায়। তাহলে কি সমাজে ছড়িয়ে পড়ল রোগটা? কড়া আদেশ সরকার থেকে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে। বাইরে বেরনো একেবেরে বন্ধ।

সেই রাতেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল রীমা, তার মেয়ে খুকু আর অনিকে। রেখে দেওয়া হল আলাদা জায়গায়, হাসপাতাল নয়, কোন এক বাড়িতে। চেনে না ওরা। এটা কোয়ারান্টাইন ক্যাম্প। পরের দিন এক জোড়া খারাপ খবরে মুষড়ে পড়েছে সবাই। সন্দীপকে ভেন্টিলেটরে দেওয়া হয়েছে, আর ওদের তিনজনেরই পজিটিভ। দোকানের অন্য কর্মচারীদের পরীক্ষা চলছে। তাদেরও আলাদা জায়গায় রাখা হয়েছে। বারবার প্রশ্ন আসছে ওদের কাছে, কোথায় গিয়েছিল তারা। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির সম্মান রাখতে সত্যিকে স্বীকার করার আর ক্ষমতা নেই রীমার।

রাত নটায় ওদের খবর দেওয়া হল দ্বিতীয় পরীক্ষাতেও পজিটিভ বেরিয়েছে।

রাত দশটায় খবর এল সন্দীপ মারা গেছে। মৃতদেহের কাছে ওদের যেতে দেওয়া হবে না। অন্য কোন আত্মীয়কেও যেতে দেওয়া হবে না। সরকার থেকে যথাসময়ে সৎকার করা হবে।


পরদিন দুপুরে রীমাদের জানানো হয় বিকেলে মৃতদেহ দাহ করা হবে। সন্ধ্যের পর ওদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে বলেও জানিয়ে দিল।

পশ্চিম দিকটা ধু ধু প্রান্তর। রীমা জানলার পাশে এসে দাঁড়ায়। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে খুকু বলে, ‘এ কী হয়ে গেল মা! কী হোল!’

দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত স্বরে রীমা বলে, ‘জানিস খুকু, আমার ছোট বেলার একটা দৃশ্যের কথা খুব মনে পড়ছে। ভাদ্র মাসে অমাবস্যায় গঙ্গায় খুব বড় বান আসত। আমরা গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। বান আসার আগে তীরে বাঁধা নৌকো মাঝিরা জলে ভাসিয়ে নিয়ে যেত মাঝ নদীতে। বড় বড় ঢেউ সেই নৌকোগুলোকে মোচার খোলার মত দোলাতো। কোনো দাঁড় টানত না, পালও তুলতো না, শুধু হালটা শক্ত করে ধরে থাকত। ঠাকুমা বলতেন, প্রকৃতির রোষের সময় প্রকৃতির স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে হয়, কিন্তু শক্ত থাকতে হবে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলেই সমূহ বিপদ। কেন জানি না আজ সেইটাই বারবার মনে পড়ছে।’

সারা দিনের কাজ সেরে সূর্য রক্তিম আভা ছড়িয়ে বিদায় নেবার সময় সরাসরি পূর্বদিকে তাকিয়ে ফেলে আসা জীবনটাকে দেখে নিচ্ছে শেষবারের মত। নিঃশব্দে।

1 comment: