0
undefined undefined undefined

গল্প - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবীরবাবুকে বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করতে দেখলেই বোঝা যায়, কাগজওয়ালার আসার সময় হয়েছে। নিতাই সাইকেল থামাতেই তিনি বলে ওঠেন, ‘একদম ছুঁড়বে না; হাতে দাও!’ তিনি থাকেন একতলায়। নিতাই দোতলা, তিনতলা ও চারতলা লক্ষ করে কাগজ ছোঁড়ে। যেন জীবনের সব অভিমান নিংড়ে দিচ্ছে। এভাবে সংবাদপত্র ছুঁড়ে দেওয়া প্রবীরবাবু একেবারেই পছন্দ করেন না।

কাগজ নেওয়ার পর, চা বানিয়ে তিনি স্ত্রী তন্দ্রার ঘুম ভাঙ্গাবার চেষ্টা করেন। সে কিছুক্ষণ বিছানায় আড়মোড়া ভাঙ্গে। এই সময়ে প্রবীরবাবু স্ত্রীকে রাশিফল পড়ে শোনান। তারপর কোথাও রেল বা বাস অবরোধ আছে কিনা; কিংবা জল বা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সম্ভাবনা, খুঁজে দেখেন। তেমন খবর না থাকলে আরাম করে চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবেন, ‘যাক, আজ রান্না ও ঝাড়-পোঁচ দুজনই আসবে।‘ এরপর টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান মালায় চোখ বোলান। পরিশেষে ক্রস ওয়াড খুলে বসেন। এতক্ষণে তন্দ্রা উঠে পড়েন। কিংবা বিছানায় আড়-কাত মেরে চায়ে চুমুক দেন। স্ত্রীর চা-পান শেষ হলেই প্রবীরবাবু কাগজ গুটিয়ে সোফার পাশে রেখে বাজারে চলে যান। সারাদিনে কাগজ পড়ার সুযোগ বা ইচ্ছা তার আর হয় না।

কয়েক বছর হল প্রবীরবাবু সংবাদপত্রের অফিস থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি প্রিন্টিং সেকশনে ছিলেন। তাই রাতের পর রাত অফিসে থাকতে হতো। তখন সুন্দর এক অবসর জীবনের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। আর এখন মনে হয় অফিসটাই ভালো ছিল। ছেলে বিদেশে, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি। থাকার মধ্যে একমাত্র স্ত্রী। যার সঙ্গে তার কথাই হয়না। আজকাল একটু নড়ে বসতেও তন্দ্রার যেন কষ্ট হয়। দু-দুটো কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও প্রবীরবাবু দিনরাত খাটেন। তন্দ্রা বসে বসে টিভি দেখে আর এক তরফা সংবাদ করে। ‘কি গো শুনছো… চা দাও, পান দাও, চিরুনি দাও, ওষুধের ডাব্বাটা দাও, গামছাটা মেলে দাও, ভাত বেড়ে দাও…’ ইত্যাদি। প্রবীরবাবু মনে মনে ভাবেন, ‘তিনি সংবাদপত্র থেকে আর তন্দ্রা সংসার-পত্র থেকে অবসর নিয়েছে!’

গতকাল তার ঘুম ভাঙ্গে স্ত্রীর ধাক্কায়। ‘হতচ্ছাড়া নচ্ছার ছেলে কোথাকার। এক চড়ে তোর কান ছিঁড়ে দেবো।‘ এহেন গালাগালের গুঁতোয় ধরমর করে উঠতে গিয়ে লুঙ্গিতে জড়িয়ে পড়ে গেলেন তিনি। তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজা খোলার আগেই; নিতাই ভাগলবা। সকালে ওঠার এটাই মূল কারণ। নইলে নিতাইয়ের অদ্ভুত কায়দায় ছুঁড়ে দেওয়া কাগজ বারান্দা পেরিয়ে জানলার গ্রিলের ফাঁক গলে তন্দ্রার মুখের উপর এসে পড়ে।

কোন চান্স নয়। আজ অ্যালার্ম দিয়েই উঠলেন প্রবীরবাবু। টেবিল ঘড়ির কর্কশ শব্দে পাশ ফিরতে ফিরতে তন্দ্রা বলল, ‘মরণ’। সে কথায় কান না দিয়ে প্রবীরবাবু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন। নিতাইকে আজ দু-চার কথা শোনাতেই হবে। সাইকেল থামতেই তিনি বললেন, ‘এই যে, তোমার কি কোন আক্কেল নেই। ঐ ভাবে কেউ খবরের কাগজ ছোঁড়ে?’

-‘তাহলে কিভাবে ছুঁড়বো?’

-‘ছুঁড়বে কেন! খবরের কাগজকে সম্মান দিতে শেখো। এটা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, মনে রাখবে। খবরের মূল্য তো বোঝ না?’

-‘বুঝি বলেই ঐ ভাবে ছুঁড়ি। মুরোদ থাকলে ছুঁড়ে দেখান না। যতসব!’ নিতাই চলে গেল।

এমন আঘাত তিনি বহুদিন পাননি। ঠিক করলেন পুরনো কাগজ গুলো আজই বিদায় করবেন। এবং কাল থেকে কাগজ নেওয়া বন্ধ! সোফার পাশে কাগজের স্তূপটা স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। নিতাই কে ফোন করলেন প্রবীরবাবু। রিং হচ্ছে। এমন সময় বিছানা থেকে তন্দ্রার চিৎকার শোনা গেল, ‘কি গো, চা কোথায়?’ হতাশ নয়নে তাকালেন তিনি। স্তম্ভ মাত্রই ভার বহন করবে, এমন নয়। তবুও অপ্রয়োজনীয় এইসব সঙ্গ ত্যাগ করা কঠিন। সত্যিটা আরও একবার অনুভব করলেন প্রবীরবাবু। তারপর ধীর পায়ে চললেন চা বানাতে।

0 comments: