ধারাবাহিক - অসিত কর্মকার
Posted in ধারাবাহিকপর্ব ৪
এখনও ভোর পেরিয়ে ভাল করে সকাল হয়নি। পুবাকাশের রক্তাভ ছাই ছাই মুখ। ভুলন আর ফকরাকে সঙ্গে নিয়ে গয়ান চলেছে ঝগড়ুর কাছে। কাল রাতে হোপনা সোরেন তার দলবল নিয়ে গয়ানের বাড়ি এসে গয়ানকে শাসিয়ে গেছে। মিটিংএ গয়ানের মুখ খোলা চলবে না। যা বলার নেতা বাবুরা বলবে আর নেতাদের পাশে গয়ানকে বসতেই হবে। হোপনা সোরেনের কথাগুলো চুপ থেকে শুনে গেছে গয়ান। টু শব্দটি করেনি গয়ান। গয়ান মনে করে, এখন মাথা ঠান্ডা রেখে ধৈর্য ধরে তাদের এগোতে হবে।
কিন্তু হোপনা সোরেনের অন্যায্য দাবিতে বাহামনির মাথায় আগুন চড়ে। আর ধৈর্য রাখতে পারে না বাহামনি। সে চিৎকার করে বলে ওঠে, তুমহার ই কী অল্যায্য আব্দারট আছে গ, বুঢঢা মিটিনট ডাকল আর সিখানে কথাট বলবেক অই লিতাবাবুরা! কিনহ? বড় বড় চোখ করে আগুন ঝরায় বাহামনি।
সি কইফিয়তট তমাকে দিবক লাই।ই হামার অডারট আছে! হোপনা সোরেনের গলায় তীব্র আদেশের সুর।
হুঃ, অডার! বাহামনির শারীরিক ভঙ্গিমায় আর কন্ঠস্বরে তাচ্ছিল্য, অডারট না মানলেহ কী করবেক? বুঢঢাকে মারবেক? উঃ, সব লিতা হইয়েছে গ! ইত্ত বছ্ছরে ইকটা বিরিজট বানহাইবার ক্ষমতাট লাই, আবার লিতা হইয়েছে! কাজট ত তুমহাদের খালি ভোটট লুট করহা! হোপনা সোরেনের মুখের উপর আঙুল তুলে কথাগুলো বলে যায় বাহামনি।
দেখে প্রমাদ গোনে গয়ান। বুঢঢি, তু চুপ যা! বাহামনিকে থামাবার চেষ্টা করে গয়ান।
হামি চুপট না করলে উয়ারা কী করবেক শুনহি, হামাদের মারবেক? মারিট দিখখুক লা, হামাদের হাঁসুয়া ভি রক্তট লিবেক! বাহামনি গলা ছেড়ে চিৎকার করে ঘোষণা করে। আলোআঁধারিতে তার গনগনে মুখমণ্ডলে চোখদুটো ভয়ঙ্কর হয়ে জ্বলছে। যেন হাঁসুয়াটা হাতে পেলে এক্ষুনি সে হোপনা সোরেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
তারপর থেকে গয়ানের দুশ্চিন্তা, এই মিটিংএর ডাকে ঝগড়ুও আছে।সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে ঝগড়ু। রাতে ভাল করে ঘুমোতে পারেনি গয়ান। কখন রাত ফুরিয়ে ভোর নামে পৃথিবীতে। সেই অপেক্ষায় খালি ছটফট করে কাটিয়েছে। ঝগড়ুকে সাবধানে থাকার কথা বলতে হবে। মাথা ঠান্ডা রাখে যেন সে। উত্তেজনার বশে বেফাঁস কোনও কথা যেন না বলে বসে। তাহলেই সব আয়োজন মাটি।ঝগড়ু এই লড়াই আন্দোলনের মাথা। বয়স গয়ানের শরীর মনের জোস্ কেড়ে নিয়েছে। বুদ্ধি পরামর্শটুকু দেওয়াই এখন তার সার কাজ।
গয়ানের সঙ্গে ভুলন, ফকরা আর কালকের প্রচারের অনেক যুবকও আছে। আছে কিছু বয়স্ক মানুষও। বয়স্কারা গয়ানকে এই সকালে এতজনের সঙ্গে হাঁটতে দেখেই বুঝেছে, নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যাপার আছে। তাই গয়ানের পাশে দাঁড়াতে তার সঙ্গ নিয়েছে। ঘটনা কী জানতে চেয়েছে। চলতে চলতে গয়ান ওদের কাল রাতের ঘটনাটা বলে। শুনে ওদের শরীরের রক্ত যেন গরম হয়ে ওঠে। হোপনা সোরেনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। ব্রিজটা এবার ওরা আদায় করে ছাড়বেই!
ঝগড়ুর ঘরদোরের এ কী ছারখার অবস্থা! দেখে ভিড়টা আৎকে ওঠে। অচেতন ঝগড়ু উঠোনের একপাশে পড়ে আছে। গয়ান বুঝে যায়, এ নির্ঘাত হোপনা সোরেনের কাজ। যা সে আশঙ্কা করছিল। পুরো ভিড়টা একরকম দৌড়ে ঝগড়ুর কাছে এল। গুটিগুটি পায়ে গয়ান ওদের মাঝে এসে দাঁড়াল। বুকের ভেতরটা তার কষ্টে ছেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে ভেঙ্গে পড়ার কথা মনেও আনল না।
মারিট ফিলে লাই ত? শঙ্কাকাতর গয়ান চিৎকার করে ফের বলে, দিখ দিখ, ওয়ার লিশশাসট পড়ছহে কিনা দিখ। বুকটর ধুকপুকট আছহে কিনহা দিখ।জলট লিইহে আয়, মুখটয় ঝাপটাট মার। গাটয় বারবার ধাক্কাট মার।
ওরা মুহূর্তের মধ্যে একেক জন একেকটা কাজে হাত লাগায়। একজন ঝগড়ুর নাকের সামনে হাত রাখে।শ্বাসপ্রশ্বাস খোঁজে। একজন বুকের উপর হাত রাখে। হৃৎস্পন্দন খোঁজে। একজন চোখের পাতা টেনে অক্ষিগোলকে প্রাণের অস্তিত্বের চিহ্ন খোঁজে। একজন দৌড়ে যায় জল আনতে। জ্ঞান ফেরাতে হবে। কয়েকজন মিলে ধাক্কা দিতে থাকে। যাতে এই করেই জ্ঞান ফেরানো যায়।
গাটয় মিলা জ্বর গ, লাঠির বাড়িটর দাহগ ভি অনহেক।
হাঁ, ধুকপুকট আছহে মনে লয় গ খুড়া।
হাঁ হাঁ, নিশশাসট ভি পড়ছহে গ খুড়া। জলটর ঝাপটাট মার ইখহন বেশহিট করহে।
চখ দুটা ভি কথাট বুলছে খুড়া।
মার ধাক্কাট, মার জোর! পিছনের ভিড়টা চিৎকার করে ওঠে।
ভিড়টা ঝগড়ুর নাম ধরে বারবার ডাকতে থাকে। কিছুক্ষণ বাদে ঝগড়ু হাল্কা করে চোখ মেলে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কেঁপে ওঠে। জলের স্বাদ নিতে জিভটা একটু বার করে ঠোঁটদুটো চাটার চেষ্টা করে। ভিড়টা আশান্বিত হয়ে ওঠে, বেঁচে আছে ঝগড়ু! আরও কয়েকবার ডাকতে ঝগড়ু পুরোপুরি চোখ মেলে তাকায়। জলও খায় খানিকটা। সম্বিতে ফেরে সে। চোখের সামনে গয়ানকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
খুড়া গ, দিখ, হোপনা খুড়া হামার কী দশাট করিছে, দিখ।হামি ইকলা অতগুলানের সঙ্গি লড়াইট দিতহে পারলাম লা গ খুড়া। হামার লাঠিট লা সরাই লিলে উয়াদের ক্ষমতাট ইকবার দিখতাম গ খুড়া! ঝগড়ুর কন্ঠস্বরে তেজ ফুটে ওঠে।
হোপনা হামাকে ভি শাসাইট গিইছহে। ইখন তু চুপ যা ঝগড়ু, শরীলট তর ভাল লাই। গয়ান বলে।
সবাই মিলে ঝগড়ুকে ধরাধরি করে দাওয়ার চারপেয়েতে শুইয়ে দেয়। ব্যথায় কাতর ঝগড়ু জিজ্ঞেস করে, অ খুড়া, ইকটা ডালে অনহেক পাতা, ইক ইকটা পাতা মানেট হল ইক ইকট মানহুষ, লয় খুড়া? ইর মানিট হল, ইকট ডালহে অনহেকগুলহা মানহুষ, লয় গ?
শুনে অবাক হয় গয়ান। ওদের সম্প্রদায়ের মাথারা জমায়েতে ডাক দিলে সঙ্গে গাছের ডাল রাখে। কিন্তু কেন? এ প্রশ্ন গয়ানের মনে কখনও জাগেনি। এতদিন এটাকে গয়ান নিয়ম বলেই জেনে এসেছে। কারণ, এই নিয়ম কেন, কী জন্য তা তার বাপঠাকুর্দাদের কাছ থেকে গয়ান কিছু জানতে পারেনি। তারা শুধু বলেছে, ইটা লিতে হয়। ব্যস এটুকুই। কিন্তু আজ ঝগড়ু যে ব্যাখ্যাটা দিল তা বড় ভাল লাগল গয়ানের। মন থেকে মেনেও নিতে কোনও দ্বিধা মনে জাগছে না তার। বলল, তু ঠিকহিট বুলেছিস ঝগড়ু। হামাদের জমায়েতট হইল গাছটর সবুজ ডালটর মতহ, একজায়গাটয় অনহেক পাতহার মানহুষ ।
কী আশায় ঝগড়ুর চোখদুটো সহসা চকচক করে ওঠে। তার মুখমণ্ডলজুড়ে সকালের এক ফালি নরম আলো। ওই আলোটুকুই যেন গয়ানের কথায় তার মনে জ্বলে ওঠা আশার আলোর বহিঃপ্রকাশ। বলল, তাহলে খুড়া, হামাদের সকলটর হাতহে হাতহে ডালট থাকহার মানিট হল আরও অনহেক অনহেক মানহুষ!
হাঁ ঝগড়ু, তু ঠিকহি ত বুলেছিস। গয়ান বারকয়েক মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
ঝগড়ুর পাশে এখন অনেকেই। বিশেষ করে গয়ান। মার খেয়ে ঝগড়ু এখন বেপরোয়াও। লড়াইয়ের জমি সে এক ইঞ্চিও ছাড়তে চায় না। তার এই বেপরোয়া মনের জোসই যেন তার শারীরিক যত অক্ষমতাকে দ্রুত ধুয়েমুছে সাফ করে দিচ্ছে। ফলে সে সুস্থ বোধ করছে। উঠে বসে। গয়ান বাধা দিতে এলে বলে, হামাকে শুইহেট থাকলেক হবেক লাই গ খুড়া। সময়ট কম আছহে। গাঁভর মিছিলট ফির ঘুরাইতে হবেক।তমহার বলা দাবির কথাগুলহান মানহুষগুলহানের মনটয় গিঁথহে দিতে হবেক। অই ডালগুলহান হবেক হামাদের জমায়েতেট ডাকার নিশানা আর হামাদের লড়াই আন্দোলনহের পতাকা ভি।
দুলকিগাঁয়ের লড়াই আন্দোলনকারী মানুষগুলোর পতাকা এখন ওদের হাতে হাতে ধরা গাছের সবুজ ডাল।গয়ান সায় দেয় ঝগড়ুর কথায়।
ঝোড়ো বাতাস কী দিনের আলোর চেয়েও দ্রুত সারা গাঁয়ে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। গেল রাতে হোপনা সোরেন তার দলবল নিয়ে এসে গয়ান সরদারকে শাসিয়ে গেছে। আর ঝগড়ুকে তো মেরেই ফেলেছিল প্রায়। সেইসঙ্গে ঝগড়ুর ঘরদোরের অবস্থা লন্ডভন্ড করে রেখে গেছে। ওদের অর্ডার না মানার শাস্তি। সারা গাঁ এখন তাই হোপনা সোরেনের বিরুদ্ধে রাগে ক্ষোভে গনগনে আঁচে ফুটছে যেন।
ওদের মিছিলটা দুলকিগাঁয়ের পথে পথে ক্রমশই বড় হচ্ছে। যেই মিছিলে পা মেলাচ্ছে সেই কাছেপিঠের গাছ থেকে ছোটবড় যাই হোক একটা ডাল ভেঙ্গে নিয়ে হাতে নিচ্ছে। দূর থেকে দেখে মনে হয়, চলমান এক সবুজ বনানী, নদীর মতো বয়ে চলেছে। তা থেকে তারুণ্যের জোস ভরা কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে ওদের দাবি। হোপনা সোরেনের ভিটির সামনে এসে মিছিলটা থমকে দাঁড়ায়। ওদের কন্ঠস্বর এখন আরও তীব্রতর। স্লোগানে নতুন কথা যোগ হয়। হোপনা সোরেন নিপাতট যাও, হোপনা সোরেনটর কালো হাত ভাঙি দাও গুড়াই দাও! মিছিল আরও উত্তাল হয়ে ওঠে।
ঘরে বসে হোপনা সোরেন প্রমাদ গোনে, এবারে ভোট লুঠ করা কঠিন হবে না তো! কিন্তু সহজে হাল ছাড়ার মানুষ হোপনা সোরেন নয়। আসল সময়ে পার্টিকে না দেখলে সারা বছর পার্টিই বা তাকে দেখতে যাবে কেন? আর পার্টি না দেখা মানেই তো তার প্রভাব, প্রতিপত্তি সবই গেল। আর প্রভাব প্রতিপত্তি না থাকলে সমাজে তার দামটাই বা কী থাকবে।
হোপনা সোরেনের মন তাই আরও জটিল প্যাঁচ কষতে থাকে। কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বিরুদ্ধে চলে যাওয়া এই মানুষগুলোকে স্বপক্ষে আনা যায়!
ক্রমশ...
0 comments: