0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমৃত অধিকারী

Posted in





হিংসা প্রবৃত্তিটা যে অন্যান্য সব প্রাণীর মতোই মানুষ নামক দ্বিপদ স্তন্যপায়ীটিরও অন্তর্গত রক্তের ভিতর নিরন্তর খেলা করে, সে কথা প্রমাণ করতে মনোবিজ্ঞানী থেকে আরম্ভ করে জীনবিশারদ অবধি, কেউ কোনও কসুর করেননি। বিবর্তনের পথে প্রতিযোগীদের পিছনে ফেলে এতখানি এগিয়ে আসার পরেও যে তার সেই প্রবৃত্তির নিরসন ঘটেনি, সে কথাও স্বতঃসিদ্ধ। সমাজব্যবস্থার চাপে পড়ে খানিকটা হয়তো অবদমিত হয়েছে, কিন্তু যখন সেই চাপ কাটিয়ে লাফ মেরে বেরিয়ে আসে, তখন তাকে দেখে কে বলবে যে এই প্রাণীটিই হাজার হাজার বছর ধরে শান্তি-সৌহার্দ্যের কথা বলে বসুধা জুড়ে কুটুম্বিতা স্থাপন করার চেষ্টা করে চলেছে!

সিগমন্ড ফ্রয়েডের কূটকচালির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা এ বিষয়টা জানেন। ফ্রয়েড বলেছিলেন, থ্যানাটোস (Thanatos) হলো আমাদের অন্তর্গত সেই প্রবৃত্তি, যা আমাদের আত্মধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। তবে কেন আমরা সবাই পটাপট আত্মহত্যা করে ফেলি না? সেরকমটা হলে তো আজ আর জনসংখ্যাস্ফীতি নিয়ে জাতির জ্যাঠামশাইদের এত ব্যতিব্যস্ত হতে হতো না। ফ্রয়েড বলছেন, সেখানে বাধ সাধে ইরস (Eros), অর্থাৎ আমাদের অন্তর্লীন বেঁচে থাকার ইচ্ছা। এই দুই প্রবৃত্তির সংঘাতে যে ইরসই সাধারণত জয়ী হয়, বলা বাহুল্য। তারপরেও অবশ্য একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সহজাত ধ্বংসকামিতা আমাদের নিরন্তর হিংসা, পরস্পর হানাহানির পথে চালিত করে না কেন? প্রাণীজগতে তো সেরকমই হয়। তার উত্তরও ফ্রয়েড সাহেব দিয়েছেন। তাকে বলে ক্যাথারসিস (Catharsis), যা কিনা অল্প রাগারাগি করে বা নিছক কোনও হিংসাত্মক ঘটনা দেখে জিঘাংসা নিবারণের নামান্তর... যা থেকে প্রমাণ হয়, সলমান খানের ছবিরও একটা শুভঙ্কর দিক আছে!

সে যাই হোক, এখন বিষয়টা হলো এই যে, সিগমন্ড ফ্রয়েডের এই থ্যানাটোস, যা কিনা নিতান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হিংসাপ্রবৃত্তি, তাকে তো সামাজিক নিয়মকানুন দিয়ে যা হোক করে চেপেচুপে রাখা যায়। নিতান্তই ঠেলে বেরোলে রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে ঠেঙিয়ে ঠাণ্ডাও করা যায়। কিন্তু সেই রাষ্ট্রযন্ত্রই যখন হিংসাকে মূলধন করে ব্যবসায় নেমে পড়ে, তখন আমার-আপনার মতন ছাপোষাদের কি কর্তব্য?

ব্যাপারটা আমাদের কারওরই সম্পূর্ণ অজানা নয়। একটু অস্বস্তিকর, তাই আমরা, মানে অধিকাংশ ছাপোষারা, বিষয়টা থেকে আমাদের শান্তিপ্রিয় মনকে সরিয়ে রাখতে পছন্দ করি। আরে, আমাদের ঘরে তো আর ঘটছে না ওসব! কি লাভ খামোখা ওসব নিয়ে ভেবে? সলমান খান না পোষালেও হলিউড তো আছেই আঙুলের ডগায়, নির্ঝঞ্ঝাট চিন্তার অপর্যাপ্ত খোরাক জোগানোর জন্য। আপাত-স্থিতিশীল একটা আর্থসামাজিক বাতাবরণের ঘেরাটোপে ড্রয়িং রূমের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বসে মাঝে মাঝে চ্যানেল পাল্টে নিউজ় আপডেট নেওয়া... এই তো বিশ্বনাগরিকের দায়িত্ব। আর কিই বা করার আছে আমাদের?

করার কিছু না থাকলেও, ভাবা যেতেই পারে। তবে এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গেলে একটু আগে থেকে শুরু করতে হবে। বেশি না, গোটা পঁচাত্তর বছর। সুমহান ইওরোপীয় সভ্যতার অন্যতম ধ্বজাধারী একটি দেশের মহত্তর নেতৃত্ব তখন একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের পাইকারি হারে গ্যাস চেম্বারে ঢোকাচ্ছে আর এক এক করে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর মহাবিক্রমে চড়াও হচ্ছে। এমন কি সেই ধুন্ধুমার কাণ্ডের গোটা দুয়েক স্যাঙাৎও জুটিয়ে ফেলেছে! শেষমেষ একটা বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে তাদের কোনওক্রমে ঠেকানোও গেলো। সেই অত্যাচারিত, হতপ্রায় জনগোষ্ঠীটির পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও হলো সদ্ধর্মের অনুশাসন মেনে পৌরাণিক প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের একটি ভূখণ্ড অধিগ্রহণ করে। সারা বিশ্বের ছাপোষারা ছলোছলো সমবেদনায় ভাবলো, আহা রে! বেচারাদের যা হোক একটা হিল্লে তো হলো! বিষয়টা নিয়ে এখন ভাবলে কেমন যেন মনে হয় না, যদি চট্টগ্রাম বা শ্রীহট্ট অধিগ্রহণ করে কাশ্মীর থেকে উৎখাত হওয়া পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হতো, তবে কেমন হতো? জায়গাগুলোর নাম শুনেই তো বোঝা যায় যে পুরাকালে সেখানে বৈদিক আর্যদেরই... সে যাক গে! স্বপ্নবিলাস করে লাভ নেই। ঘটনা হলো এই যে, সেই গোটা ব্যাপারটা সারা বিশ্বের জাতির জ্যাঠামশাইদের ধুদ্ধুরি নাড়িয়ে দিলো। তাই তো! যথোচিত শক্তিবৃদ্ধি করতে পারলে এমন কাণ্ড তো যে কেউ করতে পারে... অর্থাৎ, রাতারাতি পাশের দেশের ঘাড়ে চেপে বসে বলতে পারে, অ্যাইও! কাল থেকে সব ট্যাক্সো আমায় দেবে, কারণ আমার গায়ে জোর বেশি। এরকমটা তো হতে দেওয়া যায় না! কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে হয়!

ব্যবস্থা নেওয়াও হলো। এতদিনের নির্বিষ ঢোঁড়া League of Nations মহানাগ রাষ্ট্রসঙ্ঘের রূপ ধারণ করে বিশ্বরাজনীতির মাথার উপর ছাতা মেলে ধরলো। এই ব্যবস্থারই ভৌগোলিক অর্থে একটু সুদূরপ্রসারী ফলস্বরূপ ভারতবর্ষ পেয়ে গেলো তার স্বাধীনতার পড়ে পাওয়া বাকি ছ’ আনা। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। এখানে কথা হলো, রাষ্ট্রসঙ্ঘ তৈরি হওয়ার তাৎক্ষণিক যে ফলটি ফললো, সে হলো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের অন্তত কাগজেকলমে ইতি। কিন্তু সভ্যতার সেই জয়ধ্বনি সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তার আরেকটি ফলশ্রূতি জ্যাঠামশাইদের সামনে প্রকট হয়ে দাঁড়ালো। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশ্বসৌহার্দ্যের পরিবেশে আগ্রাসন নেই, আর আগ্রাসন নেই মানে শত্রুও নেই। শত্রু না থাকলে যুদ্ধটা হবে কার সঙ্গে? এই যে এত কাঠখড় পুড়িয়ে, এতগুলো বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এত অস্ত্রশস্ত্র, এরকম নিশ্ছিদ্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হলো, সেগুলোর এবার কি হবে? পড়ে পড়ে জং ধরবে?

সেরকম তো হতে দেওয়া যায় না। বিনিয়োগের দিকটাও তো ভাবতে হবে! মানবসভ্যতা এর আগে কোনওদিন এই পর্যায়ের বিনিয়োগ দেখেইনি! তো, সেই বাজারটাই যদি আর না থাকে তাহলে এই বিনিয়োগের হবে কি? সুতরাং, আশু কর্তব্য, যুদ্ধের একটা নতুন বাজার তৈরি করা। ব্যাপারটা প্রাথমিক পর্যায়ে খুব কঠিনও হলো না। ডান-বাঁয়ের তাত্ত্বিক লড়াই তদ্দিনে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে রাজনৈতিক বিশ্বের দু’প্রান্তে। এমনকি অরাজনৈতিক বিশ্বের ছাপোষারাও বেশ সুবিধাজনকভাবে দু’পক্ষে বিভক্ত। চায়ের পেয়ালাতে নিয়মিত তুফান উঠছে। আর সব চাইতে বড় সুবিধার বিষয়টা হলো, যে যুদ্ধটা আদপে করতেই হবে না, শুধু তাল ঠুকে, পাঁয়তারা কষে মাঝে মাঝে হুঙ্কার ছাড়লেই হবে, তার থেকে বেশি বিক্রয়যোগ্য আর কি আছে? তাই শুরু হয়ে গেলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঠাণ্ডা যুদ্ধ। চার দশকব্যাপী সেই রোমহর্ষক যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় অস্ত্র এবং আরও হরেক রকম যুদ্ধসরঞ্জামের পাশাপাশি সংযোগ মাধ্যম, সংবাদ মাধ্যম, বইপত্র থেকে নিয়ে সিনেমা পর্যন্ত আরও কত শত ব্যবসা যে কত হাজার কোটি টাকার মুনাফা লুটলো, সে সব আমাদের মতন ছাপোষাদের যৎসামান্য বিষয়বুদ্ধির অগোচর। আমরা শুধু দেখলাম, স্যাম চাচার ধনতন্ত্রের সঙ্গে চোখ-রাঙানি আর হুমকি-হুমকি খেলতে খেলতে সুমহান সমাজতন্ত্র একসময় হুমড়ি খেয়ে পড়লো... আর সেই সঙ্গে তৎকালীন পৃথিবীর সব থেকে বড় show biz সেই Cold War-এরও ইতি!

বলা বাহুল্য, ব্যাপারটা আমাদের জন্য যতখানি আকস্মিক ছিলো, জ্যাঠামশাইদের জন্য ততখানি ছিলো না। তাঁদের শ্যেণদৃষ্টি সর্বকালে, সর্বত্র, সর্বদা নিবদ্ধ। তাঁরা অনেকদিন আগেই বুঝেছিলেন, সমাজতন্ত্রের ভিত টলমল করছে। তাই তাঁরা অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই প্রস্তুতিটা ছিলো বড় মজাদার ব্যাপার। আমাদের চোখের সামনে, প্রায় নাকের ডগায় বছরের পর বছর ধরে হয়েছে, কিন্তু আমরা দেখতে পাইনি। কারণ, আমাদের মুখ ঘোরানো ছিলো ধর্মের দিকে। ধার্মিকদের কথা বলছি না। তাঁদের মুখ চিরকালই ধর্মের দিকে ঘোরানো, এবং শুধুমাত্র তাঁদের নিজেদেরটি ছাড়া আর বাদবাকি সব ধর্মের অপসারণ ঘটলেই যে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে – তাঁদের এই বদ্ধমূল বিশ্বাসও ঈর্ষনীয়। কিন্তু তাঁদেরই প্রতিবেশী আমাদের মতন কতিপয় আক্ষরিক অর্থে ধর্মভীরুও তো আছে, ধর্মসংক্রান্ত কোনও কিছু দেখলেই যাদের ভয়ে পালাতে ইচ্ছে করে! সেই আমাদের কথা বলছিলাম, আর কি। আমাদের মুখও ধর্মের দিকেই ঘোরানো ছিলো। বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমরা ভাবছিলাম, সেই ধর্মের জন্যই যদি এখনও মরতে হয়, মারতে হয়, তাহলে সভ্যতার পথে অ্যাদ্দূর এগিয়ে লাভটা কি হলো? আমরা বুঝিনি, ধর্মের ঘেরাটোপের আড়ালে সযত্নে তৈরি হচ্ছিলো মানবতার নতুন শত্রু। সেই শত্রুর নাম – ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ।

সত্তরের দশক পর্যন্ত মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই কারও কারও? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফুটন্ত কড়াই থেকে নিরাপদ দূরত্বে তাদের দিন কাটছিলো। ধর্ম ছিলো, কিন্তু তার চোখ-রাঙানি ছিলো না। সামাজিক বিধিনিষেধও ছিলো, কিন্তু তখনও তারা মনুষ্যত্বের গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসেনি। কিন্তু ফাঁসের গিঁঠ বাঁধা হচ্ছিলো ধীরে ধীরে। সেই ফাঁসে প্রথম টান পড়লো আশির দশকের গোড়ায়, যখন প্রাচীন পারস্যের দুই বংশধর দেশ মধ্যপ্রাচ্যের আর্থসামরিক প্রাধান্য লাভের জন্য প্রকাশ্যে দাঁত নখ বার করলো। সেই কামড়াকামড়িতে একদিকে যেমন প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিলো স্যাম চাচার ধনতন্ত্রের, অন্যদিকে তেমনি উষ্ণ উস্কানি ছিলো সুমহান সমাজতন্ত্রের। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, যে সাম্যবাদী সমাজতন্ত্র অ্যাদ্দিন ধর্মের টিকিটি দেখতে পেলেই রক্তচক্ষু হয়ে উঠতো, কেমন নির্বিকারে সে সেই ধর্মকেই কাজে লাগিয়ে ফেললো ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে। আমরা পুলকিত হয়ে উপলব্ধি করলাম, একটা গোলাকৃতি গ্রহের বাম আর ডান প্রান্ত দু’টো কি বিপজ্জনক রকমের কাছাকাছি... এমন কি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমাপতিত!

তারপর একসময় পশ্চিম এশিয়ার এক কোণে দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো... আর সমাজতন্ত্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সে আগুন দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়লো সারা মহাদেশের দক্ষিণপশ্চিম অংশ জুড়ে। আমাদের কানে আসতে লাগলো এক এক করে মুজাহিদিন, তালিবানের মতন কিছু অশ্রূতপূর্ব নাম। তারপর একদিন শুরু হলো আমাদের মহান দেশের ইতিহাস পুনর্লিখন। মহোল্লাসে ভাঙা হলো এক বিদেশী আক্রমণকারীর তৈরি মাত্র সাড়ে চারশো বছরের অর্বাচীন সৌধ... আর আমরাও আমাদের জনগণমন ভাগ্যবিধাতার একটি মোক্ষম চালে হয়ে পড়লাম সেই যুদ্ধখেলার প্রস্তুতির শরিক!

তারপরের ইতিহাস কারও মনে না থাকার কথা নয়। গণমাধ্যমের সৌজন্যে গত শতাব্দীর শেষ থেকেই পৃথিবীটা ছোটো হতে হতে প্রথমে বোকা বাক্সতে, আর তারপর আমাদের হাতের মুঠোতে বন্দী হয়ে গেছে। জাতির জ্যাঠামশাইরা আমাদের যা দেখাতে চান, সে সব কিছু আমরা এখন অবলীলায় দেখতে পাই... আর, যে মানুষ ঐশ্বর্য্য দেখতে পায়, অথচ তার নাগাল পায় না, কেন পাচ্ছে না সেটাও ঠিক করে বুঝতে পারে না, তার নিষ্ফলা ক্রোধের থেকে বড় অস্ত্র রাজনীতির জন্য আর কিছু নেই। এবং, সেই অস্ত্রে অগ্নিসংযোগ করার জন্য ধর্ম-বর্ণ-জাতিবিদ্বেষের থেকে বড় ইন্ধনও আর কিছু নেই। সম্প্রদায়-বিদ্বেষ ব্যাপারটাই রাজনীতির জন্য সবিশেষ সুবিধাজনক। একটা জাতি বা সম্প্রদায়ের হীনম্মন্যতাকে, বিপন্নতাবোধকে বিদ্বেষে রূপান্তরিত করতে পারলেই কেল্লা ফতে। বস্তুত, কাজটা অর্দ্ধেক হয়েই থাকে। আর বাকিটুকু অবলীলায় করে দেওয়ার জন্য তো এখন গণমাধ্যম আছেই। কত রকমের ভয়... অমুক সম্প্রদায় বিপজ্জনকভাবে সংখ্যায় বাড়ছে এবং দেশের সমস্ত আর্থসামাজিক সমস্যার মূলে তাদের সেই সংখ্যাবৃদ্ধি, তমুক দেশ সন্দেহজনকভাবে শক্তিবৃদ্ধি করছে এবং যে কোনও সময় আক্রমণ করে বসতে পারে, দেশদ্রোহী দিগ্গজগুলো দশকের পর দশক ধরে ভুল ইতিহাস পড়িয়ে আসছে, যাতে কেউ কোনওদিন জানতে না পারে এই দেশের মানুষ কি মহদাশয় মহাবীর ছিলো, ইত্যাদি, ইত্যাদি! আমরা ছাপোষারা একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবনযাপনে ক্লান্ত হয়ে এইসব ভয় নিয়ে চায়ের পেয়ালায় বা মদের গেলাসে তুফান তুলি, পাঁচ বছরে একবার করে উজ্জ্বল মুখে ভোটের লাইনে গিয়ে দাঁড়াই, আর জ্যাঠামশাইরা মুচকি হাসতে হাসতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়াতে থাকেন। সেই সব মহাজাগতিক অঙ্কের অর্থ দিয়ে কি কেনা হয়, কেন কেনা হয়, আদৌ কিছু কেনা হয় কিনা, সে সব আমরা ছাপোষারা কোনওদিন জানতেই পারি না, কারণ সে সব রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার বিষয়। আমরা শুধু নিশ্চিন্ত থাকি এই ভেবে যে জ্যাঠামশাইরা আমাদের যথাসম্ভব নিরাপদে রাখছেন।

এই যে সেদিন আমাদের সবার সব থেকে বড় জ্যাঠামশাই ব্যাজার মুখে বিশ্ববাসীকে জানালেন যে, অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং তাদের প্রয়োগকৌশলে প্রশিক্ষিত, দস্তুর মতন একটি বিমানবাহিনী এবং তিন লক্ষাধিক লোকবল সম্পন্ন আমাদের পড়শী দেশের সেনাবাহিনী নাকি এই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণকারীদের, যাদের একটি বিমান পর্যন্ত নেই, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেই রাজি নয়! শুনে আমরা তো আমরা, তাবড় তাবড় গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত হো হো করে হেসে উঠলেন। এত ভীরুও হয় কোনও সেনাবাহিনী? তাও আবার মাথার উপর বড় জ্যাঠামশাইয়ের অভয়হস্ত থাকা সত্ত্বেও? ঠিক হয়েছে তাহলে। এরকমই হওয়া উচিত! বেশ করেছে জ্যাঠামশাইয়ের লক্ষ্মীসেনারা ব্যাটাদের ছেড়ে চলে গিয়ে।

কিন্তু মজার বিষয় হলো, আমরা কেউ কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করলাম না, ওদের এত প্রশিক্ষিত, এমন সমৃদ্ধ সেনাবাহিনী পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাহায্য নিয়েও একটা সন্ত্রাসবাদী বাহিনীর মোকাবিলা করতে চাইছে না কেন? ওদেশের মানুষদের তো কোনওদিন কাপুরুষতার দুর্নাম ছিলো না। বরং চিরকাল তো উল্টোটাই শুনে এসেছি। তাহলে?

তাহলে একটাই ব্যাখ্যা হয়। সেনাবাহিনীর উপর সেইরকমই নির্দেশ আছে। অর্থাৎ, এই আগ্রাসনের কোনওরকম প্রতিরোধ না করাটাই তাদের বিধেয়। ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধব্যবসার পরিপন্থী বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আবার একটু পিছিয়ে ভাবুন, এবং এবার কোনওরকম রাখঢাক গুড়গুড় না করেই ভাবুন। আশির দশকের আফগানিস্তানে সোভিয়েত প্রভাব... সেই প্রভাব খণ্ডন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরন্তর প্রচেষ্টা... রোনাল্ড রেগনের মুজাহিদিন-সমর্থন নীতি... সোভিয়েত রাশিয়ার পতন... মুজাহিদিনের দানব হয়ে ওঠা... এবার তাকে দমন করার জন্য তালিবানের ক্ষমতায়ন... মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন-দানব ওসামা বিন লাদেনের আত্মপ্রকাশ... গোটা নব্বইয়ের দশক জুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাস... ৯/১১/২০০১... মার্কিনবাহিনীর আফগানিস্তান আক্রমণ... তালিবানের পতন। বেশ একটা সযত্ন-পরিকল্পিত নকশা দেখতে পাওয়া যায় না?

এইবার একটু এগিয়ে ভাবুন। মানে বছর দশক পরের কথা, আর কি। অতখানি সময় এই দফায় নাও লাগতে পারে যদিও। এই যে আজকের এই তালিবান ২.০ কি সুন্দর ভদ্র, মার্জিত আচরণ করছে, মুগুর হাতে কি মিষ্টি করে ‘ভয় পেও না, ভয় পেও না, তোমায় আমি মারবো না’ বলছে, জ্যাঠামশাইদের প্রশংসা পাচ্ছে, সমর্থন পর্যন্ত পাচ্ছে... এর মধ্যেও কেমন একটা পরিকল্পিত নকশার আভাস দেখা যাচ্ছে না? আরে, দানব মারার অস্ত্র দিয়ে কি বামন মারা উচিত? সেটা উলুবনে মুক্তো ছড়ানো হয় না? কিন্তু সমস্যা হলো, দানব মারার অস্ত্র প্রয়োগ করার জন্য তো দানব চাই! তাই, বামনকে দানব হয়ে ওঠার সময় দিতে হবে। তারপর হবে আসল খেলা। তদ্দিন আমরা ছাপোষারা জুলজুল করে দেখবো। যারা একটু সংবেদনশীল, তারা জাতি-বর্ণ-ধর্মকে গালাগাল দেবো, আর নিজেদের অজান্তেই আরও, আরও জড়িয়ে যেতে থাকবো জ্যাঠামশাইদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়।

Long live war! যুদ্ধং দেহি!

0 comments: