0

গল্প - ঝানকু সেনগুপ্ত

Posted in



আমার নাম স্বাধীন! ১৯৪৭ সালে জন্মেছিলাম বলেই হয়তো মা বাবা ঐ নামটা রেখেছিলেন! এখন আমি একজন বয়স্ক নাগরিক। জীবনের সাথে কথাবার্তায় যেটা সার বুঝেছি, বেশ ভালই কাটলো সময়টা; না না কিছু কিছু বিপদ এবং বিপন্নতা তো সবার জীবনেই থাকে! ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই! মোদ্দা কথা আমি মধ্যবিত্ত, সুতরাং ভারতবর্ষের ৯০ শতাংশ মানুষের থেকে আমি ভাল ছিলাম এবং ভাল আছি!

এই মুহূর্তে আমি চারতলার একটা ফ্ল্যাটের ছোট্ট বারান্দায় বসে আছি! বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। নীচে বিশাল মাঠ। নেতাজী স্পোর্টস কমপ্লেক্স। মাঠের মধ্যে ঘাসেরা আপনমনে বড় হয়ে চলেছে! শালিক পাখিদের আনাগোনা প্রায় নেই বললেই চলে! অথচ গতকাল এই সময়ে ওদের বিশাল সভা বসেছিল! ওদের সভা একটু অন্যরকম! চার-পাঁচজনের এক একটা দলে যেন গোল টেবিল বৈঠক! গতকাল ওদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল নাগরিকপঞ্জি!

সত্যি বলতে কি এই নাগরিকপঞ্জি নিয়ে আমি কিছুদিন ধরেই কষ্ট পাচ্ছিলাম! অসহায়ের মত বিহ্বলতার অবসাদে ডুবে যাচ্ছিলাম!

এই মুহূর্তে আমি শালিকদের সভার কথা ভাবছিলাম!

একটা শালিক মাঠের মধ্যে থাকা ছোট্ট আধলা ইটের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে চলেছে—‘এভাবে চলতে পারে না! এত বছর এখানে ছিলাম! আমার বাপ, ঠাকুরদা, বড় ঠাকুরদা, তাঁর বড় ঠাকুরদা, তাঁর বড়, তাঁর বড়—কত পুরুষের বাস! বহুবছর ধরেই এই আদিগঙ্গার অববাহিকা থেকে, আসেপাশের জলাভূমি থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল! তবু, ঠিক আছে—যে সহে, সে রহে ভেবে আমরা এডজাস্ট করলাম! অনেকে যারা পারল না, তারা হারিয়ে গেল! শকুনি মামারা নেই! চিল মেসোরা নেই! কাক দাদাদের সংখ্যা কমেই চলেছে! চড়ুই ভাইরাও হাতে গোনা! আমরা তবু বেঁচে বর্তে আছি! এখন নেতাজীর নামে স্পোর্টস কমপ্লেক্স করে—আমাদের তাড়িয়ে দেবে? আমরা হতে দেব না।’ পাশ থেকে একজন মধ্য বয়স্কা শালিক বলে উঠলেন—‘প্রতিবাদ করছ—ভাল কথা! কিন্তু শুনেছি ওরা নাকি নাগরিকপঞ্জি করছে’!

‘তো’—একজন যুব শালিক ডান দিকে মুখটা নাচিয়ে বলে উঠল! ওর বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠল!

এবার যুব শালিকের পালা! আগের নেতৃস্থানীয়া মহিলা-যুব’কে এগিয়ে দিল আঁধলা ইটের উপর! যুব বিচিত্র ভঙ্গিমায় নানান ছন্দে নাচতে নাচতে, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বলল—‘বন্ধুরা, ওরা অত সহজে আমাদের হার মানাতে পারবে না! মানুষদের মধ্যে ওরা ধর্মের বিভাজন করে অদ্ভুত একটা থিয়োরি আনার চেষ্টা করছে! ৭১ সালের পরে যারা এসেছে—তারা সবাই নাগরিকপঞ্জির বাইরে! কিন্তু যারা হিন্দু তারা শরণার্থী, আর যারা মুসলিম তারা অনুপ্রবেশকারী! বিচিত্র সব যুক্তি! ওরা মানবজাতি তাই মানবতার বাইরে! খেতে দেবার মুরোদ নেই—কিল মারার গোঁসাই’!

‘আরে ওদের কথা শুনে কী হবে? আমাদের শালিকজাতির কথা বল!’ —পাশ থেকে একজন বৃদ্ধা শালিক গলাটা বাড়িয়ে বলে উঠল!

‘আরে বাবা—পারসপেকটিভটা তো বুঝতে হবে!’—যুব বলল।

এবারে নেতৃস্থানীয়া মহিলা শালিকটি আবার বলতে শুরু করল—‘দেখ ভায়া—আমাদের নাগরিকপঞ্জি করে লাভ নেই! আমরা আর কতদিন বাঁচি বল! খুব বেশি হলে তিন-চার বছর! বিষয়টা অন্য! যে ভাবে পরিবেশ পাল্টাচ্ছে, তাতে শালিক জাতির প্রজন্মটাই প্রশ্নের মুখে! সেই ডারউইন—‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’! চড়ুই প্রায় শেষ! কাকেরাও অন্তত শহরে প্রায় অমিল! আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে, আমাদের পূর্বপুরুষরা ভোরবেলা কাকেদের কা-কা ডাকে বুঝতে পারতেন এবারে খুঁটে খাওয়ার পালা শুরু করতে হবে!



আর এখন কাকেরা আর সে ভাবে ডাকে না! টুনটুনি, বুলবুলি, দোয়েল, শ্যামা, কোকিল, টিয়া কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে! তালগাছ নেই! পুকুর নেই। নদী চুরি হয়ে যাচ্ছে! বড় গাছেরা সব কোথায় চলে গেল! দু-চারটে বট গাছ, তাতে এমন শনির দৌরাত্ম্য—জাস্ট ভাবা যায় না’!

এইসব ভাবতে ভাবতে আমি ঝিরঝির বৃষ্টি দেখছি আর শালিকদের সভার কথা ভাবছি; অপেক্ষা করছি, কখন সেই যুব শালিকটা আসবে!

প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল—যুব প্রেমে পড়েছে! ফিয়াসেকে নিয়ে মাঝে মাঝেই আমার গ্রিলে এসে বসে! আড়চোখে আমার দিকে তাকায় আর প্রেমিকার সাথে মিচির-মিচির, পিড়িংপিড়িং করে গল্প করে, আবার আদরও করে!

ভাবতে ভাবতেই যুব এসে হাজির! আমার সাথে ওর কথা হয় ইঙ্গিতে! আমি চোখের ইশারায় মনে মনে বললাম—‘কি হে শল্যপুত্র, আজ যে একা!’

ঠোঁট দিয়ে ডানদিকের পাখাটা খুঁটতে খুঁটতে বলল—‘আর বল না, দাদু! এই বৃষ্টিতে ওর ঠাণ্ডা লেগে গেছে!’

—‘সে-কী, ইস! তো ওষুধ খাবে? রাসটক্স ৩০? এই বৃষ্টিতে বেশ ভাল কাজ হয়!’

—‘না, না-ওই ঘাসের গোঁড়ায় থাকা দু-চারটে কেঁচো খেলেই ঠিক হয়ে যাবে!’

—‘হুম, তো খেয়েছে?’

—‘কী?’

—‘ওই কেঁচো!’

—‘ও-ঠিক খেয়ে নেবে।’

—‘আরে তুমি তো ওকে একটু হেল্প করতে পারতে!’

—‘আপনাদের মতো আমরা অত ন্যাকামো করি না! নিজেরটা নিজেই জোগাড় করবে। ওই তো এসে পড়েছে!’



শল্যপুত্র আর তার বান্ধবী দুজনে এসে একেবারে আমার পায়ের কাছে খেলতে শুরু করল!

‘ন্যাকামো’ কথাটা আমার ইগোতে লাগল! আমি ওদের দিকে না তাকিয়ে সোজা দিগন্তের দিকে তাকালাম। মাঠের ওপারে একটা জি+১২ ফ্ল্যাটের কন্সট্রাকশনে আমার চোখ আটকে গেল! দিগন্তকে পেলাম না! বাধ্য হয়েই চোখ নামিয়ে মাঠের ঘাস দেখতে লাগলাম। শালিক জোড়ার দিকে না তাকিয়েই মনে মনে বললাম—‘টু ফর জয়’! ডান হাতটাও অভ্যাসবশত কপালে উঠে বুক ছুঁয়ে নীচে নেমে এল!

যুব আড়চোখে ব্যাপারটা খেয়াল করে বলে উঠল—‘তা আজ যে আমাদের দিকে না তাকিয়েই ‘টু ফর জয়’ বললে, দাদু!’

আমি কথার উত্তর না দিয়ে মাঠের একপাশে বিজ্ঞাপনের হোরডিঙ’টার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম!

যুব বোধহয় কিছু বুঝতে পেরেছে! গলাটা উঁচু করে বলল—‘দাদু, তুমি আমার উপর রাগ কর না। ওই ‘ন্যাকামো’ কথাটা আমি তোমাকে বলিনি। ওটা ইন-জেনারেল তোমাদের মানব জাতির ধর্ম!’ অবশ্য, কথাটা শেষ না করেই যুব উড়ে গিয়ে বারান্দায় গ্রিলের উপর বসে প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল!

‘দেখ, শল্যপুত্র’—এবারে আমি শুরু করলাম—‘আমরা মানে, ওই মানে আমরা—’

শল্যপুত্রের বান্ধবী ফোঁড়ন কাটার ঢঙ্গে ধরিয়ে দিয়ে বলল—‘মানুষরা—’

—‘হ্যাঁ, আমরা, মানুষরা তোমাদের মতন নয়! আমার বৌয়ের জ্বর টর হলে, আমি রীতিমতো হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দেই! এই যেমন ধর—রাসটক্স, অ্যাকোনাইট, ব্রায়োনিয়া, বেলেডোনা, কালিমুর, ফেরমফস—অবশ্য সিম্পটম বুঝে!’

—‘হুম, সবই ঠিক। কিন্তু দাদু, তোমরা আসল সিম্পটম’টাই বোঝ না!’

—‘মানে? আমরা বুঝি না? সবই তোমরা বোঝ?’

—‘হুম, আমরা যেটা বুঝি, সেটা তোমরা বোঝ না!’



—‘কত এক বুঝদার এসে গেছে! যত্তসব! নেহাৎ তোমাদের সাথে একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে-তাই! তা না হলে—’

- ‘তা না হলে কী? তাড়িয়ে দিতে?’

- ‘ না, না, আমি কি তাই বলেছি?’ আমি ঢোঁক গিলে বললাম! মনে মনে ভাবলাম, শালিক জোড়া আসে বলেই আমার একটু সময় কাটে! আজকাল ঘুম ভাল হয় না! ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে যায়!

আমার বৌ তো আরও ভোরে ওঠে! দুজনে একসাথে চা খাই। দু-চারটে স্বাভাবিক সাংসারিক কথাবার্তার পর বৌ উঠে পড়ে! ও’র নাকি অনেক কাজ! তারপর সারাদিন খুচখাচ–টুকটাক লেগেই আছে! যাক, তবু কাজকর্ম পুজো-আরচা নিয়ে হয়তো ও’র মতন করে ভালই আছে!

আমি এই বারান্দায় এসে বসি। সকালটা তবু শালিকদের সাথে কাটে! তারপর সারাদিন শালিকদের কথা ভাবতে ভাবতে সময় চলে যায় নিজের মতন করে! এখন ওরাই আমার আশ্রয়! ওদের নিয়ে একটা নাটক করলে কেমন হয়! যুবকে প্রস্তাবটা দেব ভাবছি! বেশি তো ক্যারেকটার নয়! চার-পাঁচ জন হলেই যথেষ্ট! গতকাল শালিকদের সভা শুনে ঠিক করেছি—শালিকপঞ্জির উপর’ই নাটকটা করব! কিন্তু একটা খটকা আছে! প্রশ্নটা হল ওদের কি ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড আছে? না থাকলে তো দ্বন্দটা ঠিক আনতে পারব না! ক্লাইমেক্সে পৌঁছাব কী ভাবে?

-‘এই যে, শুনছ?’- বৌয়ের ডাকে আমার ভাবনার ঘোর কাটল! ‘এই রুটির টুকরোটা ওদের দিয়ে দাও।‘ বলতে বলতেই বৌ এসে দাঁড়াল বারান্দায়। রুটির টুকরোটা আমার হাতে দিয়ে বলল—‘দাও ওদের। যতসব পাগলামো! বেশি দেরি কর না! আজ খিচুরি বসেয়েছি! যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে!’

রুটির টুকরোটা পেয়ে শালিক দুটো খুব খুশি! চিৎকার চেঁচামেচি করে আরও কিছু শালিককে ডেকে নিল! আমি গুনে দেখলাম প্রায় ৭-৮টা শালিক!



হঠাৎ বলে ফেললাম—‘এই তোমাদের নিয়ে একটা নাটক করব ভাবছি!’

আমার কথায় ওরা খুঁটে খাওয়া বন্ধ করে, স্তম্ভিত হয়ে গলা উঁচিয়ে, ঠোঁট দুটো ফাঁক করে একসাথে বলে উঠল—‘নাটক!’

আমি মনে মনে ভাবলাম, এতো কোরাস! বললাম—‘হ্যাঁ, নাটক!’ এবারে একটু দম নিয়ে ভারী গলায় নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলাম—‘আসলে বন্ধুরা, ছোটবেলা থেকেই আমার নাটক করতে খুব ভাল লাগে’!

—‘বুঝলাম! কিন্তু আমরা কী করে ওসব করব? আমাদের সময় কোথায়?’ —মধ্যবয়স্কা একজন শালিক বলল!

—‘প্লিজ, ভাই, একটু সময় বার কর! দারুন সাবজেক্ট!’

—‘তা সাবজেক্টটা কি’? —যুব বলল।

—‘প্রথমে ভেবেছিলাম, তোমাদের শালিকপঞ্জি নিয়ে করব। কিন্তু তোমাদের তো আইডেনটিটি কার্ড নেই! তো এখন ভাবছি এলিয়েনেশন!’

ওরা সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল!

আমি বললাম—‘এলিয়েনেশন মানে বিচ্ছিন্নতা!’

ওরা চুপ করে রইল!

আমি এবারে মরিয়া হয়ে বললাম—‘বুঝলে না? আচ্ছা বেশ আমার একটা কবিতা শোন,

সবাই যে যার মতো!

ক্ষয়ে যাচ্ছে ভূমি

ভেঙ্গে পড়ছে ইমারত-প্রেম,

মায় বিপ্লবের দরজাও-!’

—‘ওসব বিপ্লব-টিপ্লব তোমাদের সমস্যা!’ —একজন বলল!



—‘যতসব আতলামো’—পাশ থেকে কেউ একজন টিপ্পনী কাটল!

আমি হতাশ হয়ে যুব’র দিকে তাকালাম! যুব বোধহয় আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারল, উড়ে গিয়ে বারান্দায় গ্রিলের উপর বসে একটা ছোটোখাটো বক্তৃতা শুরু করল—‘দেখ বন্ধুরা, এটা ঠিক আমরা এক্ষুণি হয়তো এই একা হয়ে যাওয়াটা বুঝতে পারব না! কিন্তু যে ভাবে সমস্ত পরিবেশটা পাল্টে যাচ্ছে, তাতে আজ না হয় কাল অথবা পরশু আমরাও ওই টুনটুনি অথবা চড়ুই-এর মত একা হতে হতে হারিয়ে যাব!’

যুব’র কথায় সমস্ত পরিবেশটা পাল্টে যেতে শুরু করল! শালিকরা উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকাবার চেষ্টা করল! ওদের চোখ আটকে গেল বারান্দার ছাদে!

আমার মনে হতে লাগল যুব যে ভাবে হারিয়ে যাবার কথা বলছে, আমি ঠিক সেটা বলতে চাই নি! বিছিন্নতা ব্যাপারটা একটা অন্য রকম যন্ত্রণা! পাখিদের হারিয়ে যাওয়া বা গাছেদের হারিয়ে যাওয়া আর মানুষের হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা তফাৎ আছে! মানুষের প্রজন্ম তো হারাচ্ছে না, হারাচ্ছে অন্য কিছু!

‘আরে এবার স্নান-টান কর! কটা বাজে খেয়াল আছে? গরম জল হয়ে গেছে’! —বৌয়ের ডাকে চিন্তার সূত্রটা হারিয়ে গেল! আমি উঠে দাঁড়ালাম।—‘ঠিক আছে, আমায় একটু সময় দাও। বিষয়টা যাই হোক না কেন তোমাদের নিয়ে নাটকটা করবই’!

হঠাৎ যুব’র প্রেমিকা বলে উঠল—‘তুমি, মানে তোমাদের বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-জনেদের দিয়ে নাটকটা করছ না কেন?’

ওর কথার কোনও উত্তর দিতে পারলাম না! আসলে ওই কেনটা তো আমিও খুঁজছি!



এখন বিকেল। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে! মাধবী মানে আমার বৌ বারান্দায় এসে বসেছে। একটু পরে মেয়ের ফোন আসবে! আমি দু-কাপ চা আর এক বাটি মুড়ি নিয়ে এসে মাধবী’র পাশে বসব! মাধবী একটু হেসে বলবে—‘বাঃ! তুমি আজকেও চা করে এনেছ!’ তারপর আমি আর মাধবী, মাধবী আর আমি বৃষ্টি ভেজা বিকেলে মেঘের বারান্দায় বসে চা খাব! চা খেতে খেতে মাধবী মেয়ের কথা বলবে! আমি হু-হাঁ করে, বাইরের উদাস হাওয়ায় মাটির গন্ধ নেবার জন্য বেরিয়ে পড়ব! আমার বৈকালিক ভ্রমনের জন্য মাধবী কিছু বলবে না! কারণ এখন মাধবী খুশি থাকবে! মেয়ের ফোন আসবে!

—‘হ্যালো, মা’

—‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল বল’

—‘কি করছ মা?’

—‘এই তো বারান্দায় বসে আছি।’

—‘নীচের মাঠে বাচ্চারা খেলছে?’

—‘না রে মা। সকাল থেকেই বৃষ্টি! বৃষ্টি হলে বাচ্চারা আর কি করবে!’

—‘যাঃ! তাহলে তো তোমার ভারী মুশকিল!’

—‘হ্যাঁ, তো! মানুষজন খুব একটা নেই! বাইকে করে কানে দুল পরা ওই কালো গেঞ্জি ছেলেটা চক্কর কাটছে! মেয়েটা এখনও এসে পৌঁছয় নি! একটা উবের আসছে, বোধহয় কাছেই থামবে! হ্যাঁ, পাশের অবন্তিকা ফ্ল্যাটের তিন তলার মিঃ শর্মা আর ওনার মিসেস। কোনও মল থেকে মার্কেটিং করে আসল! তোর বাবার বন্ধুরা মাঠের চারদিকে হাঁটছে। তোর বাবাও ওদের সাথে যোগ দিল। ওই তো!’

—‘কী মা?’

—‘ওই তো দুষ্টু আর মিষ্টি—দুই ভাই বোন মাঠের দিকে ছুটতে ছুটতে আসছে! ওরা কাউকে না পেয়ে দু হাত পাখির মতো করে ওড়ার ভঙ্গীতে ছুটছে! কী মিষ্টি লাগছে ওদের! আমার মনে হচ্ছে আমিও ওদের মতো ছুটছি ছুটছি আর ছুটছি গোল্লাছু—ট!’

—‘মা সত্যি তুমি না!’



ঠিক এভাবেই প্রতিদিন বিকেলের সূর্যের রঙে মা আর মেয়ের কথা চলে! ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের গোলাপ পরশ লাগে মাধবীর চোখে মুখে! মাধবী খুশী হয়! খুশী থাকে! মাধবীর সাথে আমিও খুশী থাকি!

মাধবীর কথা রেখেছে আমাদের একমাত্র মেয়ে মানালী! চাকরিটা পাওয়ার পর মানালী চারতলায় এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল মা’র কথা ভেবে! আমি বাইরে চাকরি করতাম! টের পাই নি, ভিতরে ভিতরে নিরন্তর কোনও এক অজানা পরিবেশের হাতছানিতে হারিয়ে গিয়েছিল আমাদের পুরনো পাড়ার চেনা পরিসর! মাধবী’র কথাবার্তা বলার, আড্ডা মারার, খুনসুটি করার বান্ধবীরা হারিয়ে গিয়েছিল! মাধবী একা হয়ে গেল!

সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হল! রাস্তঘাট শুনসান! মানালী’র ইনটারভিউ! মানালীকে বের হতেই হল! ঝড় বৃষ্টি বেড়েই চলেছে! সন্ধ্যে হল! রাত হল! মানালীকে ফোনেও পাচ্ছে না! আমি বাইরে থাকি, চিন্তা করব বলে আমাকেও কিছু বলল না! একটু দূরেই রাস্তা। জানালা দিয়ে দেখা যায় না! গাড়ির শব্দ ভেসে আসে! তবুও জানালায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইল মাধবী, মানালী’র জন্য!

গভীর রাতে একটা গাড়ি এসে থামল! এম্বাসাডার গাড়ির শব্দটা একটু অন্যরকম, কাঁপতে থাকে ইঞ্জিনটা! শব্দটা কান পেতে শুনে, মাধবী বুঝল এটা ট্যাক্সি! এবারে নিশ্চয়ই মানালী! দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে মানালীকে জড়িয়ে ধরে মাধবী বলল—‘মানু, তুই আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল, যেখানে আমি রাস্তা দেখতে পারি!’

আজ বৃষ্টিটা ধরেছে! রোদ উঠেছে! ঝলমলে নীল আকাশে ছোট ছোট শিমূল মেঘের দল! মেঘবালিকা! ভেসে চলেছে স্বাধীনতার জন্য! এই বুঝি কালো মেঘের পাহাড় আসে—


১০

সেই ভয়ে চুপি চুপি পালিয়ে যাওয়া!

—‘কি দাদু, কবি হয়ে গেলে যে!’ —যুব এসে ফোঁড়ন কাটল!

আমি অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে ইঙ্গিতে বললাম—‘তুমি কী করে বুঝলে?’

—‘আমরা সব বুঝতে পারি! তোমাদের বিচিত্র ‘মুডে’র খেয়াল না রাখলে আমরা টিকে থাকব কী করে?’

—‘বাবা! এত ইংরেজি বলছ?’

—‘হুম, আজকাল একটু আধটু ইংরেজি না বললে সমাজে ঠাই পাওয়া যায় না! যাক সে সব কথা! তা তোমার নাটকের কত দূর?’

আমি শল্যপুত্রের কথায় অতি উৎসাহে প্রায় চিৎকার করে বললাম—‘আরে! সত্যি তোমরা নাটক করবে?’

—‘নিশ্চয়ই করব’, ডানা ঝটপটিয়ে যুব উত্তর দিল! তারপর ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে বারান্দার গ্রিলের উপর উঠে নিজস্ব ভঙ্গিমায় ঘাড় কাত করে বলল—‘আসলে দাদু, চিন্তা করে দেখলাম আমাদেরও একটু সংস্কৃতি মনস্ক হওয়া উচিত!’

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম!

—‘অবাক হচ্ছ তো? আসলে কী জান তো দাদু, সংস্কৃতি মনস্ক না হলে প্রতিবাদ ব্যাপারটা হারিয়ে যায়! রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত থেকে আজকের শঙ্খ ঘোষ—সবাই তো প্রতিবাদী!’

আমি চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলাম—‘কি রকম?’

—‘শিল্পীরা সাধারণ ভাবেই ভিতরে ভিতরে স্বাধীন, আর এই অন্তরের স্বাধীনতা থেকেই উঠে আসে প্রতিবাদ!’

শল্যপুত্রের কথাবার্তা আর যুক্তির বুননে আমি বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—‘তুমি এত কিছু জানলে কী করে?’


১১

ঠোঁট দিয়ে গ্রিলের উপর দু’বার ঠুকে আমার পায়ের কাছে উড়ে এসে শল্যপুত্র সুর করে গান ধরল— “সেদিন ভোরে দেখি উঠে
বৃষ্টি বাদল গেছে ছুটে,
রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে
বাঁশের ডালে ডালে।
ছুটির দিনে কেমন সুরে
পুজোর সানাই বাজায় দূরে,
তিনটে শালিক ঝগড়া করে
রান্না ঘরের চালে”।

এবার সুর থামিয়ে নাচতে নাচতে বলল—‘হুম, সেই রবীন্দ্রনাথের সময় থেকেই আমাদের সংস্কৃতি চর্চা শুরু!’

আমি ঘোর কাটিয়ে মনে মনে বললাম—‘সংস্কৃতি চর্চা?’

—‘হুম, আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে গল্পটা শোনা! তিনটে শালিককে ঝগড়া করতে দেখে রবীন্দ্রনাথই প্রথম বলেছিলেন- “ভায়া- বাজে সময় নষ্ট না করে একটু পড়াশুনা করলেও তো পার”!... তারপর থেকেই শুরু’!

—‘কী?’

— ‘ওই সংস্কৃতি চর্চা।‘

—‘আর শিল্পীর অন্তরের স্বাধীনতার সাথে প্রতিবাদের সম্পর্কটা? আই মীন, তুমি যে ভাবে বললে—’

বেশ কিছুক্ষণ কথার উত্তর দিল না সে! ঘাড় ঘুরিয়ে ছন্দময় অভিব্যাক্তি—ডাইনে, বাঁয়ে, উপরে, নীচে! তারপর হঠাৎ করেই প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে বলল—‘আচ্ছা দাদু, ...এই


১২

পৃথিবীতে জন্মানো কোনও মানুষের বা পাখিদের বা গাছেদের বসবাসের জন্য আইনি স্বীকৃতির প্রয়োজন... —ব্যাপারটা খুব বোকা বোকা নয় কি’?

আমি হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি! মাথাটা ঝিমঝিম করছে! কোনও রকমে বললাম— ‘তোমাদের সেদিনের নাগরিকপঞ্জি থুড়ি, শালিকপঞ্জির সভাটা আমি শুনেছি!’

—‘হুম, জানি তো! সেইজন্যই কথাটা তোমায় বলছি—তোমরা মানে মানুষরা স্বাধীনতার কনসেপ্টটাই গুলিয়ে ফেলেছ!’

ওর কথা শুনে আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম! মাথা কাজ করছে না! সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে! শুধু বুঝতে পারছি—শল্যপুত্রের কথা গুলো কী ভীষণ সত্যি!

আমার অবস্থা দেখে শল্যপুত্র যেন একটু মুচকি হাসল! তাপর বলল—‘দাদু, একটা কথা আমার মনে হয় জীবন যাপনের যাবতীয় দায় ও দায়িত্ব রাষ্ট্রের! সমাধান করা বা সমস্যা সৃষ্টি করা সবটাই ওদের হাতে! রাষ্ট্র ইত্যাদি তো একটা ধারণা! পিছনে যারা আছে, যারা রাষ্ট্রকে পরিচলনা করছে, ওরা কে হে, আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেবার? আমরা ওসব মানি না! মানব না। তাই বলছিলাম ভিতরের স্বাধীনতা থেকেই তো প্রতিবাদের ধরণটা বেরিয়ে আসে! পৃথিবীটা আমাদের এটাই শেষ কথা! সুতরাং নাটকের বিষয়বস্তু এটাই হওয়া উচিত! ওই দেখ ওরা সবাই এসে গেছে। তুমি মহড়া শুরু কর!’

ইতিমধ্যে যুব’র প্রেমিকার নেতৃত্বে একদল শালিক এসে হাজির!

আমি মহা উৎসাহে মহড়া শুরু করবার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে নিতে ভাবছি—কী ভাবে শুরু করব! তারপর ভাবতে ভাবতে, ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে চোখ পড়তেই দেখি- মেঘবালিকার দল আপন খেয়ালে ভেসে চলেছে—ভেসেই চলেছে!

আমার মেয়ের একটা প্রমোশন হল! ও এখন মুম্বাইতে। একটা বেশ নাম ডাকআলা অ্যাড এজেন্সির মার্কেটিং হেড! এইচ.আর.ডি-তে এম.বি.এ. করেছিল! জয়েন করেছিল পুনাতে,


১৩

জোনাল হেড, এইচ.আর.ডি! মাত্র ৮ মাসের মাথায় মুম্বাইতে, তাও আবার মার্কেটিং! ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না! আজ দুপুরে খবরটা জানিয়েছিল ওর মা’কে। আমি তখন দিবা নিদ্রায় ব্যস্ত! ঘুম থেকে উঠে চা করার সময় মাধবী আমায় খবরটা দিল। তারপর কিছুক্ষণ মনমরা হয়ে বসে রইল!

আমি বললাম—‘কী হল? মেয়ের প্রমোশন হল, তুমি এতো চুপচাপ?’

—‘দূর ভালো লাগছে না!’

—‘সে কি কথা! কেন?’

—মানালী বলেছে, ‘আজ ও বিকেলে ফোন করতে পারবে না! ও’র নাকি মিটিং আছে!’

—‘হ্যাঁ ও এখন যে পোস্টে আছে ওর এখন কাজই শুধু মিটিং করা! মার্কেটিং টিমকে মোটিভেট করা!’

—‘আর আমার মোটিভেশনটা!’

—‘হুম, সেটাও একটা কথা বটে!’

—‘জান তো আজ মাঠে বাচ্চারা সবাই আসবে! ওরা গোল্লাছুট খেলবে!’

—‘গোল্লাছুট? ভ্যাট! ওসব এখন কেউ খেলে নাকি?’

—‘না খেলবে, খেলবে ব্যস’—বলেই মাধবী বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগল! ‘আমি মানালীকে গোল্লাছুটের ধারাবিবরণী শোনাবো... হ্যাঁ, মানালী খেলা শুরু হয়ে গেছে! দুষ্টু আর মিষ্টি ছুটছে! ওই তো হুর রে গোল্লাছুট গোল্লাছুট!’

আমি মাধবীকে জড়িয়ে ধরলাম! ও আমার বুকের উপর মুখ রেখে জামার বোতামটা আস্তে আস্তে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল—‘আজ তোমায় বের হতে হবে না!’


১৪

আমার টেক্সট-এর জবাবে মানালী লিখল—‘হ্যাঁ, বাবা আমি তোমাকে রাতের দিকে ফোন করব। ৮’টা নাগাদ!’

৭.৩০ টা থেকেই মানালী’র ফোনের অপেক্ষায়! মাধবী এইমাত্র ঘরে চলে গেল! ও এখন সিরিয়াল দেখবে! আমি একা বারান্দায়। মানালীর কথা ভাবছি। মেয়েটা যেন হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেল! ভাবতে ভালো লাগছে ও এখন রিজিওনাল হেড মার্কেটিং! এরপর কর্পোরেট হেড মার্কেটিং, তারপর হয়তো অন্য কোনও কর্পরেটে সি.ই.ও.!

নীচে আলো ঝলমলে নেতাজী স্পোর্টস কমপ্লেক্সে কোনও উৎসবের প্রস্তুতি! প্রায়ই কিছু না কিছু লেগেই আছে! রাতের আকাশের তারাগুলো আর দেখাই যায় না! শুধু আলো আর শব্দ, শব্দ আর আলো! সম্ভবত স্বাধীনতা উৎসবের আয়োজন! হুম, আর কিছুদিনের মধ্যেই তো ১৫ই আগস্ট! স্বাধীনতা দিবস! ‘স্বাধীনতা’ মানেটা আজকাল কেমন গুলিয়ে যায়! বড় ভয় চারিদিকে! এই ভয়টা অন্যরকম! বোঝা যায় না! বোঝানোও যায় না! শালিক পাখির কথা অনুযায়ী ভিতরের স্বাধীনতা কি বাইরের শাসনে হারিয়ে যাচ্ছে? আমার চিন্তাগুলো কেমন বেসামাল হয়ে উঠছে! কোনও এক অজ্ঞাত অনুশাসনের শিকলে নিজের অজান্তেই একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি!

হঠাৎ’ই নীচের মাঠটায় একসাথে অনেক আলো জ্বলে উঠল! বড় বড় ভ্যাপার ল্যাম্পের আলো আর তার সাথে ডি.জে-তে প্রচণ্ড আওয়াজে গান ভেসে আসল—‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...!’

মানালী’র ফোন বেজে উঠল! —‘হ্যাঁ, মা বল, বল... কনগ্রাচুলেশন.. অ্যাঁ আর বলিস না ওই নীচের মাঠে গান বাজছে! হ্যালো, হ্যাঁ, বল। কোন ডিপার্টমেন্ট? ও বুঝেছি! ভিসুয়াল অ্যাড? হ্যাঁ হ্যাঁ হোরডিঙ! বাঃ বাঃ! ... ঠিক আছে, সাবধানে থাকিস। হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভাল! কাল সকালে ফোন করিস। কাল তো ছুটি! ১৫ই আগস্ট! ওকে গুডনাইট!’


১৫

রাত ১২টা বাজল! কলকাতা বন্দরে সব জাহাজের সাইরেন একসাথে বেজে উঠল! কলকাতার বহুদিনের প্রথা! উন্মত্ত উৎসবের আওয়াজে হারিয়ে যাওয়া জাহাজের ভোঁ এখন যেন এক রূপকথা!

নীচের মাঠে আপাত দুষ্টু ছেলের দল ডি.জের তালে উদ্দাম নেচে চলেছে! আসেপাশের হোস্টেলের মেয়েরাও আছে! স্বাধীনতার এই তো সময়!

অনেক রাত পর্যন্ত ছটফট করতে করতে হয়তো শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়েছি! এখন আমি বুড়ীবালামের তীরে! হঠাৎ কাচের জানালায় ঠুক ঠুক শব্দ! ঘুম ভেঙে পাশ ফিরে অবাক হয়ে দেখি, শল্যপুত্র আর ওর ফিয়াঁসে বার বার উড়ে এসে জানালায় ঠুক ঠুক শব্দ করছে! ভোর হয়েছে। দূরে কোথাও একটা কাকের আওয়াজ! বিছানা ছেড়ে জানালাটা খুলে হাসি মুখে শল্যপুত্রকে বললাম—‘কি হে! এত ভোরে? আজ কি তোমারও স্বাধীনতা দিবস?’

শল্যপুত্র মুখটা নীচু করে এপাশ থেকে ওপাশে ঘাড় কাত করে চলেছে অনবরত! আমার দিকে না তাকিয়ে কোনও কথা না বলে বারান্দার দিকে উড়ে গেল ওরা! ওদের মুখের চেহারাটা আমার ঠিক ভাল লাগল না! চিন্তিত হয়েই বারান্দার দরজা খুলে প্রথম আকাশটা চোখে পড়লো না! সামনে কোথাও দৃষ্টিটা আটকে গেল যেন!

শল্যপুত্র গম্ভীর হয়ে বলল—‘চশমাটা পড়ে এসো! আর শোন তুমি তো আবার প্রোস্টেটের পেশেন্ট! বাথরুম করেই এসো! আর হ্যাঁ ইনহেলারটা অবশ্যই, সবমিলিয়ে ব্যাপারটা ভাল নয়!’

ইতিমধ্যে মাধবীও উঠে পড়েছে! চা বসিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বলল—‘কী ব্যাপার আজ এতো ভোরে উঠে পড়লে? কাল তো অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলে!’


১৬

আমি বললাম—‘হুম!’ বাথরুম থেকে বেরিয়ে চশমাটা পড়ে, বারান্দায় এসে আমি ঠিক কি করব বুঝতে পারছিলাম না! সামনের মাঠটা দেখা যাচ্ছে না! মাঠের উপরে বিশাল হোরডিং! একটা বিজ্ঞাপনের ফ্লেক্সের পিছনের সাদা অংশটা শুধু দেখা যাচ্ছে! আকাশ নেই! সকালের আলো নেই! ফুরফুরে মনমাতানো হাওয়া নেই! মন খারাপ করা কতগুলো লোহার বিন বিশ্রী দাঁত বের করে যেন বলছে—‘স্বাধীনতা? দেখ কেমন লাগে!’

ইতিমধ্যে মাধবী’ও এসে দাঁড়িয়েছে! ওর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে! চোখ দুটো ঘোলাটে! বারান্দার গ্রিলে অসহায় হাত দুটো রেখে বিপন্ন বিমুঢ়তায় অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে—‘আমার গোল্লাছুট!’

একছুটে বাইরে বেরিয়ে এলাম! ইতিমধ্যে এই ফ্ল্যাটের অথবা আসেপাশের আরও কিছু মানুষ এসে জড়ো হয়েছে বিজ্ঞাপনের কাছে!

বিজ্ঞাপনের বিশাল হোরডিঙে বেশির ভাগ অংশ জুড়ে অনেক মানুষের মুখ! বিভিন্ন প্রদেশের, বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন পেশার! সবার মুখেই একটা আপাত শান্তির ছাপ! সুখী সুখী হাসি হাসি! উপরে জাতীয় পতাকার আভাস! তার নীচে লেখা “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়?” পরের লাইনে লেখা—‘ভোট দিন স্বাধীনতায়!’ ( নির্বাচন কমিশন; ভারত সরকার দ্বারা প্রচারিত।)

ভীড়ের মধ্য থেকে মধ্যবয়স্ক একজন বললেন—‘স্বাধীনতা আর ভোট বেশ ইন্টারেস্টিং তাই না?’

বৃদ্ধ মিত্র মশাই ফোঁড়ন কাটলেন—‘স্বাধীন ভাবে ভোট! সেটা কীরকম?’ পাশ থেকে আর একজন কিছু একটা মন্তব্য করলেন! তারপর আরও একজন! আরও আরও! আমার কারো কথাই কানে আসছিল না! মাথাটা দপদপ করছে! মাধবীর ছন্নছাড়া মুখটা মনে পড়ল!

লিফটটা আটকে আছে তিনতলায়! হয়তো কেউ দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে নি! সিঁড়ি বেয়েই উঠতে শুরু করলাম! হাঁপানির টানটা বেড়ে গেল! তাড়াহুড়োয় ইনহেলারটাও নিয়ে বের হই নি! তিনতলায় এসে কোনোক্রমে লিফটের দরজা বন্ধ করে ঘরে এসে রীতিমতো হাঁপাচ্ছি! এক্ষুণি ইনহেলারটা নিতে পারলে ভাল হত! না


১৭

আগে মাধবীর কাছে যাই! হাঁপাতে হাঁপাতে বারান্দার দিকে যেতে গিয়ে মাধবীর গলা পেলাম, বোধহয় মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলছে! অজানা আশঙ্কায় বুকের ধড়ফড়ানিটা আরও বেড়ে গেল! বারান্দায় এসে দেখি মাধবী মেয়ের সাথে কথা বলে চলেছে, চোখ

দিয়ে অবিরত জলের ধারা! ‘হ্যাঁ, মা ওই তো দুষ্টু আর মিষ্টি, দুই ভাই বোন! হ্যাঁ আরও অনেক বাচ্চারাও এসেছে। কী মজা ওরা এখন গোল্লাছুট খেলবে! ওই তো খেলা শুরু হয়ে গেছে! ওরা সবাই ছুটছে! গোল্লাছুট গোল্লা-ছু-উ-উ-ট!’

ফোনটা প্রায় কেড়ে নিলাম মাধবীর কাছ থেকে—‘হ্যালো’

—‘ও বাবা! তোমায় খুঁজছিলাম! শোন না, বাবা আমার নতুন কোম্পানিতে আমি একটা কনসেপ্ট দিয়েছি! সারা ভারতে ওই বিজ্ঞাপনটা থাকবে নির্বাচন কমিশন থেকে! অনেক মুখ আর জাতীয় পতাকার আভাস, নীচে লেখা—‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে...! চারিদিকে হৈ হৈ পড়ে গেছে! সবাই বলছে, দারুণ কনসেপ্ট! ভাল হয়েছে না বাবা স্বাধীনতার সাথে ভোট?’

—‘হ্যাঁ মা! খুব সুন্দর!’ আমি আর কথা বলতে পারছি না!

ও পাশ থেকে আমার একমাত্র মেয়ে, মুম্বাইয়ের একটি নামজাদা অ্যাড এজেন্সির মার্কেটিং হেড বলে চলেছে—‘বাবা কী হল? তুমি চুপ করে আছ কেন? বাবা শরীর ঠিক আছে? বা-বা-আ-আ..!’

ফোনের ওপার থেকে মেয়ের চিৎকারে আমার সম্বিৎ ফিরে এল!

—‘না মা, সব ঠিক আছে! আসলে আমি অন্য কিছু ভাবছিলাম! শোন আমি আর তোর মা কাল থেকে কিছুদিন থাকব না!’

—‘কোথায় যাবে বাবা?’

—‘দেখি!... তোর ‘কপি’টা অসাধারণ! ...“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়”!’

0 comments: