0

প্রবন্ধ - সমীক্ষণ সেনগুপ্ত

Posted in











Dithee (2019)

Directed by SumitraBhave
Produced by Mohan Agashe
Screenplay by SumitraBhave
Story by D. B. Mokashi&SumitraBhave
Running Time – 87 mins

সত্যি বলতে কি, আমি সিনেমার কিচ্ছু বুঝি না।

মানে একটা সিনেমা কি করে তৈরি করতে হয়, কিরকম আলোর ব্যবহার করেন ডিরেক্টার, কিরকম মুডের জন্য কিরকম পিকচার টোন হবে যাতে গল্পটার শুরুতেই দর্শকের কাছে বার্তা চলে যায় সিনেমাটি কি গোত্রের - থ্রিলার, নাকি সায়েন্স ফিকশান, নাকি আদ্যন্ত একটি সামাজিক আখ্যান, নাকি সব মিলিয়ে কিছু একটা।

Nolan, Speilberg, Satyajit Ray দেখিয়ে দিয়েছেন এই তিন (এবং আরও অনেক কিছু সামঞ্জস্য-পূর্ণ ভাবে মিলিয়ে) এক-একটি মাস্টারপিস হতে পারে। আবার ঠিক মতো মেলাতে না পারলে কিরকম জগাখিচুড়ি হতে পারে, সেটাও অনেকেই দেখাচ্ছেন।

যাইহোক, যে প্রসঙ্গে আমরা ছিলাম। আমি সিনেমার কলা-কৌশল বিশেষ কিছু বুঝিনা, আমি এখানে শুধুমাত্র গল্পটা নিয়ে আলোচনা করবো।

গল্প


"দিঠি"র পটভূমিকায় আছে মহারাষ্ট্রের একটি ওয়ারকারি সম্প্রদায়ের গ্রাম। ওয়ারকারিরা সর্বভারতীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, ভক্তি আন্দোলন সম্পৃক্ত। তাদের উপাস্য দেবতার নাম ভিত্তল {যিনি বিষ্ণুর এক অবতার),পান্ধারপুরে তিনি অধিষ্ঠান করেন, প্রতি বছর জুলাই মাসে সেখানে "ওয়ারি" বা তীর্থযাত্রা তাদের কাছে বিশেষ পুণ্যের ব্যাপার।

এই গ্রামের বিশিষ্ট সজ্জন ব্যক্তি রামজি, ভিত্তলের চরণাশ্রয়ী, বিগত ৩০ বছর ধরে তিনি ওয়ারিতে যাচ্ছেন। গ্রামের মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি বড় দাদার মতো পাশে আছেন, তাঁর মুখে ভগবানের কথা শুনে শান্ত হয়েছে অনেক শোকগ্রস্ত মন।

এই হেন রামজির যুবক পুত্র একদিন নদীর জলে ভেসে গেল। হঠাৎ, অকস্মাৎ আঘাত করলো মৃত্যু !রামজি শোকে পাথর হয়ে গেলেন। তাঁর একমাত্র সন্তান, প্রৌঢ় বাবার থেকে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছিল একটু একটু করে, হঠাৎ-ই সব শেষ হয়ে গেল। রামজি সারাদিন দাওয়ায় বসে থাকেন, খাওয়া দাওয়া করেন না। তাঁর পুত্রবধূ তখন আসন্নপ্রসবা, তার কাছে রামজি তাঁর পুত্র সন্তান চেয়ে বসলেন। কিন্তু পুত্রবধূ তুলসী জন্ম দিল একটি কন্যা সন্তানের। রামজি তাঁর বহু আকাঙ্খিত সান্ত্বনা পেলেন না, সদ্যজাত শিশুর কান্না তাঁর কাছে হয়ে উঠল অসহ্য !!

এখানেই আমাদের শহুরে তথাকথিত "উচ্চশিক্ষিত" মনে প্রশ্ন জাগে - সন্তান তো সন্তানই, তার আবার ছেলে-মেয়ে হয় নাকি? এই সদ্যজাত শিশুটির মুখ চেয়ে রামজি ভুলে যেতে পারতেন না কি তাঁর সন্তান হারানোর শোক? অন্তত কিছুটা তো লাঘব করাই যেত, নয় কি?

নিশ্চয়ই যেত, কিন্তু এটাই হচ্ছে মানব মনের অদ্ভুত রহস্য। আমরা নিত্যদিন যে বোঝা বহন করে বেড়াই, তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় হয়তো আমাদের সামনেই থাকে। কিন্তু আমরা শুধু তা "দেখতে" পাই না। বাধ সাধে আমাদের মজ্জাগত বিচার, সংস্কার। যে রামজির কথা শুনে মানুষ এককালে মনে জোর পেত, সেই রামজিই আজ স্তব্ধ। চোখ দিয়ে অনবরত তাঁর পড়ে জল, সর্বশক্তিমান ভিত্তলের উপর তাঁর বিশ্বাস উঠে গেছে, তিনি প্রশ্ন করেন "ভিত্তল সত্যি না মিথ্যে?", তিনি নিজে সত্যি না মিথ্যে, "এই জগত সত্যি না মিথ্যে"। তিনি ভগবানের কাছে তাঁর ত্রিশ বছরের তীর্থযাত্রার জবাবদিহি চান।

নামগান

অবশেষে প্রবল বর্ষণের মধ্যে অন্য গ্রামবাসিরা রামজিকে নিয়ে যান ভগবানের সাপ্তাহিক নামগানের আসরে। রামজি বেরোবার আগে তাঁর পুত্রবধূকে বলে যান ফিরে এসে তার মুখদর্শন করতে চান না !!

নামগানের প্রতিটা কথা রামজির কানে শূলের মতো বেঁধে। একটা সময়ে তিনি ছিলেন এই আসরের মধ্যমণি।

নৃত্যগীত পরিবেশন দ্বারা ভগবানের সান্নিধ্য পাওয়া - ভক্তি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি এখানে উপস্থিত, অনেকটা আমাদের গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতই। গানের ভাষা ও সুর অত্যন্ত শ্রুতিমধুর।

এমনই সময়ে হঠাৎ রামজির ডাক আসে। গ্রামের গোপালক কানাইয়ের গরু আসন্নপ্রসবা। ধাত্রী হিসাবে পারদর্শী রামজির সেখানে উপস্থিতি একান্ত জরুরী।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে রামজি নামগান ছেড়ে উঠে যান, নিচু জাতের গোপালকের সাহায্যে। প্রবল বারিধারার মধ্যে কোন অদৃশ্য বল তাঁকে যেন টেনে নিয়ে যায় গ্রামের অপর প্রান্তে। কানাইয়ের বাড়িতে পৌঁছে শুরু হয় জীবনের লড়াই।

অভিযান

আমরা যারা সাধারণ জীবন যাপন করি, তারা হয়তো তার পূর্বের বা তার পরের অবস্থা সম্বন্ধে খবর রাখি না, হয়তো যারা চিকিৎসক, নিরন্তর যাঁদের এপার-ওপার নিয়ে কারবার, তাঁরা রাখেন। প্রত্যন্ত গ্রামের রামজিও বোধয় সেই দলে পড়েন। আর খবর রাখেন তাঁরা, যারা প্রিয়জনের মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। প্রিয়জনের মৃত্যুর আগে-পরে মানুষ পাল্টে যায়। হয়তো একটি জীবনের শেষ হয়ে যাওয়ার শোক একমাত্র লাঘব করতে পারে অন্য একটি জীবন-আনয়নের আনন্দ।

সারা রাত বাইরে প্রবল বারিধারার মধ্যে লড়াই করলেন রামজি, নতুন জীবন ভূমিষ্ঠ করার লড়াই, সহায় সম্বল তাঁর অভিজ্ঞতা, ধৈর্য আর গ্রাম্য প্রাথমিক কিছু জিনিসপত্র, যেমন নারকল তেল, গরম জল, ইত্যাদি। আর আমরা দর্শকরা দম বন্ধ করে বসে থাকি, রামজি মুক্তি পাবেন কিনা দেখার জন্য।

অবশেষে আসে রৌদ্রোজ্জ্বল নতুন সকাল, বৃষ্টিতে যার কলঙ্ক সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। সকলে চেয়ে দেখল ভূমিষ্ঠ হয়েছে একটি সুস্থ সবল গোশাবক ! রামজি যেন তাঁর দৃষ্টি ফেরত পেলেন।

অবশেষে চশমা মুছে তাঁর মনে হোল কোথায় যেন এরকমই একটি শিশুর কান্না শুনেছিলেন - তাঁর নিজের বাড়িতে। তাঁর সদ্যজাত নাতনীর কান্না। এক ছুটে বাড়ি এসে দেখলেন তুলশী জিনিসপত্র গুছিয়ে চিরদিনের বেরোতে উদ্যত। এবার তার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন রামজি, চোখ খুলে দেখলেন তিনি, পারলেন তিনি তাঁর শোক জয় করতে, সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে। আর এই প্রথমবার তাঁর নাতনীকে কোলে নিলেন তিনি।


এদিকে নামগান তো সমাপ্ত হয়নি। কাজেই গ্রামের  অন্য মানুষরা সেখানেই বসে রাত্রিযাপন করেছেন।
রামজি উপস্থিত হলেন সেখানে, সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, যেন নবজন্ম হয়েছে তাঁর। ঠিক যেখানে কাল রাতে নামগান থেমে গেছিল, ঠিক সেখান থেকেই শুরু হোল আজ।


অসাধারণ এই গল্পটি সুমিত্রা ভাবের পরিচালিত শেষ সিনেমা। ১৯ এপ্রিল ২০২১ এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। অদ্ভুত দক্ষতায় আধ্যাত্মিকতা ও মনস্তত্ত্ব মিশিয়েছেন তিনি এই গল্পে। আমরা অনুমান করতে পারি মারাঠি সিনেমার আরেক স্তম্ভ মোহন আগাসে - যিনি এই ছবিতে প্রযোজনা ও অভিনয় করেছেন, যিনি পেশাগত-ভাবে মনস্তত্ত্ববিদ, তাঁর নিশ্চয়ই কিছু অবদান থেকে থাকবে এই গল্পে। বস্তুত মনস্তত্ত্ব নিয়ে সিনেমা সুমিত্রা ভাবে আগেও করেছেন। "দেবরাই", "অস্তু", "কাসাব" এই ছবিগুলি দেখার ইচ্ছা রইল।


প্রশ্ন হচ্ছে - এই ধরণের ছবি বাংলায় আমরা দেখি না কেন?

আমাদের তো উপাদানের অভাব নেই। অভাব নেই শক্তিশালী অভিনেতার। সৃজিত মুখোপাধ্যায় কি সময় নিয়ে, পরিচালনায় যত্নবান হয়ে এই ধরণের একটি সিনেমাও করতে পারেন না? স্বদিচ্ছার অভাব, নাকি "চলবে না" বলে প্রযোজকদের পিছিয়ে আসা? নাকি বাংলায় এরকম সিনেমা আছে, কিন্তু আমরা শুধু জানতে পারি না।

সৃজিত বাবুকে বাদ দিলে ভরসা জাগায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের কাজ। "বাস্তু সাপ", "শব্দ", "খাদ", "ছোটদের ছবি" , "বিসর্জন" ব্যতিক্রমী এবং যথেষ্ট উচ্চমানের কাজ। তাঁর হাত থেকে "দিঠি"র মতো একটি ছবি বেরিয়ে আসতে পারে কি?

দেখা যাক, সেটা ভবিষ্যতই বলতে পারে।

0 comments: