0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





অন্তিম পর্ব



রত্নার পরিশ্রমে সূচনাকে অধিকার কানুনের মাধ্যমে বিজলী বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে নোটিস ধরানো হল।

-- আমাদের মিটার বিল্ডার জ্বালিয়েছে, কিন্তু আপনার ইঞ্জিনিয়ার কিচুতেই পোড়া মিটারের টেকনিক্যাল রিপোর্ট দিচ্চে না।

লিখে দিচ্ছে-- মিটার জ্বলে গেছে আর কিছু বলা সম্ভব নয়। কে দায়ী বলা সম্ভব নয়।

আমরা স্পেসিফিক্যালি জানতে চাইছি মিটারের কোন তারটি জ্বলেছে? পাওয়ার কেবল? কি অন্য কিছু!

এই টেকনিক্যাল রিপোর্ট পাওয়ার জন্যে নিয়ম অনুযায়ী ২৫০/- ফি দিতে রাজি, কিন্তু দিচ্ছে না।

এখনো আমাদের বন্ধ মিটারে রিডিং আসছে, অর্থাৎ এখনো হুকিং হচ্ছে। কিন্তু আপনার অফিস অস্বীকার করছে।

কর্পোরেশনে মর্টগেজ রাখা ফ্ল্যাট বিল্ডার বিক্রি করে দিয়েছে। কর্পোরেশন নোটিস দিয়েছে। আমরা আর টি আই এর ধারা অনুযায়ী জানতে চাইছি যে ঐ মর্টগেজ ফ্ল্যাটে কি করে বিদ্যুৎ কর্পোরেশন মিটার লাগাল? বলছে সেল ডীড আছে।

জানতে চাইছি ওই ডিড এর সার্টিফায়েড কপি দিন।

বলছে বিল্ডারের পারমিশন ছাড়া দেয়া যাবে না।

এবার আপনি আমাদের ওই ইনফর্মেশন গুলো দিন। কারণ, আলটিমেটলি আপনিই কাস্টমারদের কাছে রেস্পন্সিবল্‌।

একমাসের মাথায় জবাব এল--- সব ঠিক আছে। আমার ইঞ্জিনিয়ার গিয়ে ওই অ্যাপার্টমেন্টে সব চেক করে এসেছে। কোথাও কোন বেআইনী কাজ/হুকিং কিস্যু হচ্ছে না।

আর ওই সব দস্তাবেজ আইনের ধারা ৮ অনুযায়ী বিল্ডারের অনুমতি ছাড়া দেয়া যাবে না।

হরিদাস পাল জবাব পড়ে দাঁত বের করে।

ইতিমধ্যে রত্না আর টি আই এর মাধ্যমে কর্পোরেশন থেকে জানার চেষ্টা করে যে রত্নাদের ফ্ল্যাট ২০৫ এবং ৩০৫ অ্যাপ্রুভড্‌ নক্‌শা অনুযায়ী পূবদিকে কি না। আর যে ফ্ল্যাটে ওদের থাকতে দেয়া হয়েছিল সেটা আসলে নকশা অনুযায়ী ২০৬/৩০৬ কি না? আর ওদুটো পূবের বদলে পশ্চিমে লোকেটেড কি না? বা পূবমুখী কি না?

আর নকশায় কমন প্যাসেজে দেখানো লিফট আসলে ওদের ফ্ল্যাটের ( যেটায় থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল) ড্রয়িং রুমে ঢোকানো আছে কি না?

কিন্তু অবাক হয়ে ও দেখে যে কর্পোরেশনের স্টাফদের ব্যবহার, বডি ল্যাংগোয়েজ পাল্টে গেছে।

ভবন অধিকারী রত্নাকে স্রেফ হাঁকিয়ে দিলেন।

-- আপনি যা যা চাইবেন সব ইনফর্মেশন আপনাকে দিতে আমরা বাধ্য নই। অনেক দিয়েছি, আর নয়। এবার আপনি আসুন। আমরা আপনার চাকর নই।

রত্না রাগে মসমস করতে ঘরে ঢোকে।

হরিদাস পাল গান ধরে-- "" দ্য হোল থিং ইজ দ্যাট, সবসে বড়া রূপাইয়া।''


ছত্তিশগড় রাজ্য সূচনা আয়োগ, অর্থাৎ কমিশনার, স্টেট লেভেল অ্যাপেলেট ফোরাম ফর রাইট টূ ইন্‌ফর্মেশন অ্যাক্ট এর এজলাস।

আজ রত্না ও রঞ্জন অনেক আগে থেকেই এখানে এসে বসে আছে। রঞ্জনের হাতে আর টি আই অ্যাক্টের বই। তাতে আবার উকিলি কায়দায় পেজ মার্ক লাগানো।

রত্না এখানে অ্যাপীল করেছিল যে কর্পোরেশন ও বিজলী বিভাগ ইনফর্মেশন দিচ্ছে না। কমিশনার দেড় মাস পরে আজকের তারিখ শুনানির জন্যে ধার্য্য করেছেন, সব পক্ষকেই নোটিস গেছে।

রত্নাকে বলেছেন--- আপনি নিজে, বা অন্য কেউ, বা কোন উকিল এখানে এসে আপনার পক্ষ পেশ করতে পারেন।

তাই ও হরিদাস পালকে নিয়ে এসেছে।

ঘন্টা খানেক পরে প্রচন্ড বৃষ্টি মাথায় করে কমিশনার ও তাঁর সহযোগী এলেন।

হরিদাস পাল দেখাল কেন ধারা ৮(২) এবং ৯ অনুযায়ী ওরা ইনফর্মেশন দিতে বাধ্য।

কমিশনার কর্পোরেশনকে সাতদিনের মধ্যে রত্নাদের ফ্ল্যাট দেখে ভেরিফিকেশন রিপোর্ট জমা করতে বল্লেন।

বিদ্যুত বিভাগের দেখানো সেল ডিডের ফোটো কপি এতই ফিকে যে উনি রেজিস্ট্রার অফ ল্যান্ডকে ডেকে অরিজিনাল রেকর্ড থেকে সার্টিফায়েড জেরক্স কপি রত্নাকে নিখরচায় দিতে বল্লেন।

তারপর দেখা গেল যে একটি নাটকের সেমিনারে অল্পবয়সী কমিশনার ও আধবুড়ো হরিদাস পাল দুজনেই নিমন্ত্রিত।

ওদের পুলক আর ধরে না। ওরা খানিকক্ষণ নিজেদের পিঠ নিজেরা চুলকে নিল।


ইতিমধ্যে রত্না-রঞ্জন-হরিয়ানভী পরিবারের যুক্তফ্রন্টে ফাটল গভীরতর।

একদিকে রত্না রেণুর মাতব্বরি আর রঙ চড়িয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য দেয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করায় রেণু ওদের ""ভীতু'' বলে।

রত্না বেজায় চটে ওকে বলে-- তোমাদের আগে থেকেই আমরা বিল্ডারের সঙ্গে আইনী রাস্তায় লড়ে যাচ্ছি। তোমরাই বিল্ডারের ইলেকট্রিশিয়ানকে মারলে, বন্দুক এনে ওদের ভয় দেখাতে ব্ল্যাংকশট ফায়ার করলে । ফলে আমাদের লেজিটিমেট লড়াইকে ওরা বদনাম করে ডাইভার্ট করার সুযোগ পেল। ব্যাকফুট থেকে ফ্রন্টফুটে চলে এল। অন্য সব দোনোমোনো ফ্ল্যাটওয়ালাদের ওদের পক্ষে মবিলাইজ করতে পারলো।

বেসিক্যালি তোমরা আর বিল্ডার একই প্রজাতির। খালি দুর্ভাগ্যক্রমে তোমাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি।

তবে একটা কথা শুনে রাখ। আমরা তোমাদের ইশারা অনুযায়ী বাড়িয়ে বা রং চড়িয়ে কিছু কোর্টে বলব না। যা দেখেছি, যা আগে লিখে দিয়েছি--- তাই বলব শেষপর্য্যন্ত।

এরপর দুই মহিলার মধ্যে বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে যায়। রেণু কিছু জানতে বা জানাতে হলে শুধু " মি: রায়" হরিদাস পালের সঙ্গেই কথা বলে, ফোনায়।

কিন্তু এক শারদপ্রাতে রত্না চমকে ওঠে। সক্কাল ছ'টায় কে এতবার করে কলিংবেল বাজাচ্ছে?

দরজা খুলে দেখে জাঠপুঙ্গব প্রবীণ সরদানা, রেণুর ওকিলসাহাব।

--- আগে একটু জল আর চা দিন ভাবীজি, তারপর সব বলছি।


প্রবীণ এসে রঞ্জনের হাত ধরে,- আপনার কম্পিউটারে এই পেনড্রাইভ লাগিয়ে খালি সিডিতে লোড করা যাবে?

রঞ্জন সতর্ক হয়। বলে-- আমার কম্বো ড্রাইভ খারাপ, সারানো হয় নি। আর গত মাসে আমার ড্রামা টিমের পেনড্রাইভ এটাতে ঢোকানোর পর ভাইরাস ভরে গেছল, মাত্র ফরম্যাটিং করিয়েছি। আপনি প্লীজ মার্কেট খুললে কোন আইটি কাফে থেকে করিয়ে নেবেন।

রত্না বলে--কিন্তু হয়েছেটা কি? পেনড্রাইভে কি আছে?

প্রবীণ জল খায়, ঢোঁক গেলে, তারপর বলে-- ভালবেসে নিজের ঘর ভেঙেছি; আমার নির্দোষ বৌ-ছেলেমেয়েকে ছেড়ে এসেছি, তাই ভগবান সাজা দিয়েছেন। রেণু এখন আগরওয়াল ট্রান্সপোর্টের মালিক বিনীত আগরওয়ালের ঘাড়ে চেপেছে।

--মানে?

--দিদি! কি আর বোলবো! রেণুর বড় লোভ, ওর অনেক টাকা চাই। স্বামীর থেকে ডিভোর্স নিয়ে আমার সঙ্গে এসেছিল, কিন্তু ওখান থেকে খোরপোষ আদায় করছিল। এখন উনি মারা গেছেন। টাকা আসা বন্ধ হয়েছে। অথচ রেণু খরচা কমাতে রাজি নয়। আগরওয়াল অবিবাহিত, ওর কোম্পানিতে ও সর্বেসর্বা। কাউকেই পার্টনার বানাক, কেউ কিছু বলতে পারে না। এখন রেণু আমাকে বলে কি আমি যেন হরিয়াণায় ফিরে যাই; ওখান থেকে সস্তায় ট্রাক হায়ার পারচেজে ডিল করে পাঠাই । ছত্তিসগড়ে বিজনেস ও আর আগরওয়াল সামলাবে! আমি ওদের নৌকর হয়ে থাকবো, ওদের এঁটো খাব? কতবার বুঝিয়েছি রেণু ইয়ে পাপ কী কামাই ফলতী নহীঁ।

-- কিন্তু রেণু তো বোলতো তোমার প্রপার্টির দামও দু'কোটির বেশি, তাহলে তোমাকে আজ অবহেলা কেন?

-- দিদি , আজ আমার প্রপার্টি নিয়ে দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে মামলা চলছে। ওরা বাবার উইলকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কবে নিষ্পত্তি হবে কে জানে! রেণুর তো এখনই সবকিছু চাই। আগরওয়াল অবিবাহিত, ষাট-সত্তরটি ট্রাকের মালিক। ওই ব্যাটাও রেণুতে মজেছে, যেমন আমি মজেছিলাম। এখন আমি না ঘরকা, না ঘাটকা!


জাঠপুঙ্গবের গাল বেয়ে গঙ্গা-যমুনা বইতে থাকে।

হরিদাস পালের তো স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে সিট্টি-পিট্টি-গুম্‌!

কিন্তু কিন্তু করে বলে-- প্রবীণ, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে? নিজের বৌ-বাচ্চার কাছে ফিরে যাওয়া যায় না?

-- যায় রায়সাব! সেদিনও ফোনে কথা হয়েছে। ও খুব ভাল। বলেছে- সব তো আপনার, আপনি একদিন ফিরে আসবেন সেই ভরসাতে আগলে বসে আছি। ডিভোর্স দিতে রাজি হইনি কারণ তাহলে ওই চুড়েল আপনার সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে আমাকে ছেলেমেয়ে শুদ্ধু পথে বসাতো। আপনারা পুরুষেরা এত ভোলা হন!

-- পেনড্রাইভে কি আছে?

-- সত্যি কথা বলতে রেণুর আর আমার সম্পর্কটা এখন এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে আমি ঘরে ওর তৈরি খাবার খেতে ভয় পাচ্ছি। আদ্দেক দিন না খেয়ে থাকি। চা নিজে বানিয়ে খাই, যদি কিছু মিশিয়ে দেয়? আমি একসপ্তাহের জন্যে দিল্লি গিয়েছিলাম, ও রায়পুরেই ছিল। জানতাম ও খালিবাড়িতে আগরওয়ালকে ডেকে আনবে। তাই চুপচাপ বেডরুমে স্পাই-ক্যামেরা লাগিয়েগিয়েছিলাম। এগুলো তার তোলা ছবি। ঘরে চালিয়ে দেখতে পারি না, রেণু বড় সতর্ক। তাই আপনাকে বলছি, দেখবেন নাকি চালিয়ে?

হরিদাস পালের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়।

-- না, আপনি কোন কাফেতে গিয়েই দেখুন, সিডিতে লোড করান, যা আপনার মর্জি।

রত্না জলখাবার নিয়ে আসে।

-- এটুকু খেয়ে নাও ভাই! আর বলি কি এই ছত্তিশগড় ছাড়। ফিরে যাও হরিয়ানায়, বৌ-বাচ্চার কাছে। এখানে শুধু কোর্টের জন্যে যতটুকু ততটুকু আসলেই চলবে। আর আমরাতো আছি।

-- কিন্তু দিদি, আগরওয়াল পাওয়ারফুল লোক, পুলিশের হাই লেভেলে কন্ট্যাক্ট। রেণুর প্রথমবার জামানত ওই করিয়েছিল। আর আর্মস্‌ অ্যাক্ট এবং হরিজন অ্যাক্টের দুটো কমপ্লেনের দফারফা করতে ওর সাহায্য চাই যে!

- সাহায্য নাও না! কে মানা করছে, কিন্তু রেণুর ওপর অধিকার বোধ ছাড়। ও কারো নয়। ইগো সামলে ঘরে ফিরে যাও।

-- তাই হবে দিদি।

জাঠপুরুষ আবার রুমাল বার করে।


একদিন রায়পুরের হরিজন থানা থেকে ডিএসপির পিএ'র ফোন এল।

--রত্না রায় ম্যাডাম? আধঘন্টার মধ্যে আমাদের অফিসে চলে আসুন, আর্জেন্ট!

ওরা দুজন মুখচাওয়াচাওয়ি করে। কি হতে পারে? হয়তো কেস খতম হয়ে গেছে, তার রিপোর্ট সাইন করে নিতে হবে। কিন্তু রত্নার মন কেমন কু-ডাক ডাকছে।

রঞ্জন বলে-- যাও, হয়তো কোন স্টেটমেন্টে সাইন করতে বলতে পারে। না পড়ে সাইন করবে না, গন্ডগোলের মনে হলে সময় নেবে, আমাকে মোবাইলে ডাকবে। তোমাকে এভাবে অ্যারেস্ট করবে মনে হয় না। করলে উকিল চাইবে, আমাকে মোবাইলে ডাকবে।

-- যদি মোবাইল সিজ্‌ করে? কাউকে যোগাযোগ করতে না দেয়?

-- আমি একঘন্টা অপেক্ষা করবো। তার মধ্যে তোমার কোন খবর বা ফোন না পেলে সোজা দুজন স্টাফ সঙ্গে নিয়ে ওই থানায় যাবো। বেস্ট অফ লাক, যাও!

পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে রত্নার ফোন পেয়ে রঞ্জন নিশ্চিন্ত হয় এবং একঘন্টার মধ্যে রত্না ফিরে আসে। ওর হাতে একটা নোটিস। তাতে বলা হয়েছে যে হরিজন থানার কমপ্লেন প্রাথমিক তদন্তে সত্যি প্রমাণিত হওয়ায় পুলিশ কোর্টে চালান পেশ করবে । তাই আগামী সোমবার রত্না রায় যেন বিলাসপুরের আদালতে উপস্থিত হয়, না হলে ওকে গ্রেফতার হতে হবে।

খানিকক্ষণ ওরা কেউ কোন কথা বলে না। তারপর রঞ্জন বলে-- হ্যাঁ, টাকায় কি না হয়! দেখতেই পাচ্ছি।

-- ওই ইনভেস্টিগেটিং অফিসার বারবার আমাকে শোনাচ্ছিল যে দুর্গে ভিলাইয়ের পাশে ওর বাড়ি তৈরি হচ্ছে, বড্ড বেশি টাকা লাগছে, জিনিসপত্তরের দাম বেড়ে গেছে। বিল্ডার অমিত শর্মার পক্ষে ওকে শস্তায় বা ফ্রিতে মাল সাপ্লাই করা তো সোজা।

রঞ্জন ভিলাইয়ে ফাইল নিয়ে বন্ধু উকিল রাজেশ বর্মার সঙ্গে বসে। রাজেশ জানায় এতে ভাবীজির বিরুদ্ধে কোন কেস দাঁড়ায় না। কিন্তু দহেজ অত্যাচারের মত হরিজন অত্যাচার আইনও বেশ কড়া। এতে অ্যান্টিসিপেটরি বেইল হবে না। প্রথমে গ্রেফতার করে সিজিএম কোর্টে চালান পেশ করবে, ও বেইল রিজেক্ট করবে, তখন সেশনে হিয়ারিং হবে, সেখানে একচান্সে বেইল হবে। আমি দুটো অ্যাপ্লিকেশন বানিয়ে রাখছি, দেখব যাতে ওনাকে গ্রেফতার না হতে হয়, কোর্টে সারেন্ডার করিয়ে বেইল করাবো। সোমবার সকালে ভাবীজিকে আমার চেম্বারে পাঠিয়ে দিন। রঞ্জন কিছু মুদ্রা অগ্রিম দেয়।

সোমবার সকালে রত্না বেলা দশটা নাগাদ একা বিলাসপুর স্টেশনে নেমে বাইরে এসে অটোরিকশা খুঁজছে এমন সময় পেছন থেকে কে যেন দিদি-দিদি করে ডাকলো। ফিরে দেখে একটি ইন্ডিগো কার থেকে নামছে প্রবীন সারদানা।

-- দিদি, অটোরিকশা ছাড়ুন, আমার গাড়িতে আসুন, পৌঁছে দিচ্ছি।

-- না, না, অটো ঠিক হয়ে গেছে।

-- তাতে কি, ছেড়ে দিন। আপনার উকিলের কাছে যাচ্ছেন তো? আমি

পৌঁছে দেব। তার আগে আমার গাড়িতে বসুন, কিছু দরকারি কথা আছে।

--কি কথা? ওই রেণুকে নিয়ে আবার কোন সমস্যা?

রত্নার পিত্তি জ্বলে যায়।

-- আরে না-না, শুনুন, এত সহজে হাল ছাড়িনি। কাল বিকেলে আমাদের জাঠ সমাজের চাঁইদের নিয়ে গেছলাম পুলিশের বড়কর্তার কাছে। রাত্তির অব্দি উনি আমাদের আর্গুমেন্ট মেনে নিয়ে ফাইল দুটো নিজের কাস্টডিতে নিয়ে নিয়েছেন। এগুলোতে ডিউ কোর্সে ক্লোজার রিপোর্ট লেখাতে হবে। আর বিলাসপুর পুলিসের কাছেও নির্দেশ গেছে। ফলে আজ কোর্টে পুলিশ চালান পেশ করতে অ্যাপিয়ার হবে না। এখন আপনি যদি গিয়ে একতর্ফা জামিনের জন্যে আবেদন দেন তখন জজসাহেব অর্ডার করবে যেন পুলিশ জজের সামনে চালান পেশ করে। তখন আগামী তারিখে রায়পুরের পুলিশের বড়কত্তাকেও ফাইল বিলাসপুরে পাঠাতে হবে। ফলে আমাদের ঘুঁটি মারা পড়বে, খেল কেঁচে যাবে। প্লীজ, আমার কথা শুনুন; আমার কথা বিশ্বাস নাই করলেন। আপনার উকিল রাজেশের কাছে চলুন, আমি ওকে সব খুলে বলছি। তারপর ও যা বলে তাই করবেন।

রত্না হরিদাস পালকে ফোন লাগায়। ও বলে -- বাত জম রহা হ্যায়। দেখ রাজেশ কি বলে!

রাজেশ বলে -- ঠিক বলেছেন সর্দানা। ভাবিজী সোজা রায়পুরে ফিরে যান, নিশ্চিন্ত হয়ে। কিস্যু হবে না। বরং বেইলের আবেদন দিলেই খুঁচিয়ে ঘা করা হবে।

রাত্তিরে রঞ্জন দাঁত বের করে।--- ফের সেধে-বাঁশ-পোঁদে-ঢোকাচ্ছিলে?

--এবার আমি তোমার বিরুদ্ধে মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারের কাছে কমপ্লেন করব, যাতে নর্দমার মত নোংরা মুখটা পার্মানেন্টলি সীল করে দেয়া যায়।


স্টেট লেভেল কনজিউমার ফোরাম এর দিন এগিয়ে আসছে।

উকিল জানাল আগামী পরশু ১৯ মার্চ ফাইনাল আর্গুমেন্ট। তারপর রায় বেরোবে।

রত্না বলল, তাহলে আমরা ১৯ তারিখ আপনার আর্গুমেন্ট শুনতে আসছি।

উকিল বলল-- কি দরকার! ওখানে তো সব ডকুমেন্ট আন্ডার এফিডেভিট জমা হয়ে গেছে।

রঞ্জন বলে-- আমি যে ওদের জবাবের রিজয়েন্ডার বানিয়ে আপনাকে দিয়েছিলাম তাকে ওকালতি ভাষায় মুড়ে সময়মত পেশ করেছেন তো!

-- অবশ্যই! এখন শুধু ফাইনাল আর্গুমেন্ট। আপনারা আসতে চান, আসুন, কিন্তু অনাবশ্যক।

রত্না বলে-- হোক অনাবশ্যক। আমাদের যাওয়া উচিৎ। এই উকিলের অল্পদিনের প্র্যাকটিস, একে তুমি কতটুকু চেন? আমি ওকে ডিজনেস্ট বলছি না, কিন্তু এর আর্গুমেন্টের কোয়ালিটি?

রঞ্জন দাবড়ানি দেয়।-- বলছি তো, কোন দরকার নেই। ও বন্ধু গৌতমের একটি ছ'হাজারের অ্যাপীল কেস জিতিয়ে ছিল। আর এটাতে বেশি সুক্ষ্ম বিচারের কি দরকার। রাইট টু ইনফর্মেশনের পিটিশনের জবাবে কর্পোরেশনের ভবন আধিকারী সার্টিফিকেট দিয়েছে আমাদের পক্ষে যে আমাদের রেজিস্ট্রি অনুযায়ী ফ্ল্যাটের যা নম্বর তা সামনের রো' তে , নকশা অনুযায়ী। কিন্তু বিল্ডার দিয়েছে পেছনের রো' তে। আবার কমন লিফট প্যাসেজের

বদলে আমাদের ড্রইংরুমের ভেতর দিয়ে গিয়েছে।

আমরা জিতছি। দরকার হল ধারা ৪২০ এর ক্রিমিনাল কেসে হাজির থাকা। সেখানে তো আমরা নিয়মিত দেড় বছর ধরে হাজির থাকছি।

রত্না-- সে তো বুঝলাম, তাতে কার কি উবগারটা হয়েছে শুনি? হতচ্ছাড়া

ঘুষখোর জজ দেড়বছর ধরে নানা বাহানায় কেস রেজিস্টার করছে না, খালি ঘোরাচ্ছে।

-- কিন্তু আমাদের ডকুমেন্ট এত সলিড আর আর্গুমেন্ট এত ভাল যে এটা ক্রিমিনাল কেস হয় না, আপনারা সিভিলে যান বলে খারিজ করতেও পারছে না। সেটা খেয়াল করেছ?

-- কত্রেছি।

-- আর সেই একই ডকুমেন্টগুলো কনজিউমার ফোরামে লাগানো হয়েছে। আমরা জিতছি, হ্যান্ডস্‌ ডাউন। তার চেয়ে ভাব যখন জিতবো তখন বিল্ডার কম্প্রোমাইজ করতে এলে কি কন্ডিশন রাখবে?

ওরা দিল্লিতে ছোটমেয়ে, মিডলবরোতে বড়মেয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয়,- জিতছি, বিল্ডার কম্প্রোমাইজ্‌ করবে। তারপর এই ফ্ল্যাট ওকেই আমরা সেল করে দেব আমাদের দামে।

ছোটমেয়ে স্বপ্ন দেখে ওর সব লোন শোধ হয়ে গেছে। ও চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন রেস্ট নিচ্ছে, যেটা নিতে ডাকতার অনেকদিন ধরে বলছে।

বড়মেয়ে স্বপ্ন দেখে ওর এডুকেশন লোন শেষ হয়ে যাচ্ছে বাড়ি বিক্রি করে পাওয়া টাকার সামান্য এক টুকরোয়।


রত্না স্বপ্ন দেখে -- আমাদের হিসেব মত ক্ষতিপূরণ শুদ্ধু টাকা দিয়ে দিলে আমরা আমাদের ফ্ল্যাট ওদের সেল করব। যাতে পরে বিক্রি করে টাকা তুলে নিতে পারে। সামনে বিশাল মল তৈরি হচ্ছে। পেছনে ছোট রেলস্টেশনটা বড় হচ্ছে। ফ্লাই ওভারটা শেষ হয়ে এল। এবার এই প্রপার্টির অনেক দাম বাড়বে।

কিন্তু আমরা বদলা নেব না, ওদের জেলে পাঠাব না। একসময় বৌদি বলে ডেকেচিল বটে! প্রতিহিংসা মানুষকে ছোট করে, বিকৃত করে।

রঞ্জন স্বপ্ন দেখে এখানকার পাট চুকিয়ে দিয়ে কোলকাতায় ফিরে যাবে।

ইতিমধ্যে উকিল জানায় যে ২৩ মার্চ রায় বেরিয়ে গেছে। উকিল রায় দেখেনি।

বলল-- আপনারা রায়পুরে আসেন রাজ্য উপভোক্তা আয়োগের আফিসে গিয়ে সার্টিফায়েড কপি নিন।

ইতিমধ্যে হটাৎ মোবাইলে একটি মেসেজ আসে: "" রায়পরিবারকে হোলির বধাই।'' সেন্ডারে সস্ত্রীক বিল্ডার ও ওদের বাচ্চা ছেলের নাম।

কি ব্যাপার! হটাৎ ভূতের মুখে রামনাম!

রঞ্জন বলে-- সম্ভবত: হোলির মেসেজ কপি করে পাঠাতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে আমাদেরও পাঠিয়েছে। এটা সিরিয়াসলি নেবার দরকার নেই।

রত্না ভাবে- হতে পারে হেরে গিয়ে সম্পক্কো ভাল করতে চাইছে।


২৩ তারিখ রঞ্জন বিলাসপুরে ওর এনজিও'র মান্থলি রিভিউ মিটিংয়ে ব্যস্ত। রত্নার ফোন আসে-- রায়ের কপি দিতে বড্ড ঘোরাচ্ছে, এখন ওদের লাঞ্চ হয়ে গেছে। আধাঘন্টায় দেবে। আমিও ছিনে জোঁকের মত লেগে আছি।

আধঘন্টা পরে আবার ফোন: রায় হাতে এসেছে।পড়ে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।

-- ক'পাতার রায়?

-- চোদ্দপাতা।

-- শোন। শেষপাতায় যাও, অপারেটিভ পার্ট বলে লাস্ট চ্যাপটার। তার লাস্ট লাইনটা পড়।

-- এতে লিখেছে ,"" Petition Dismissed. '' কী হল, কিছু বলছ না যে? অ্যাই রঞ্জন?

-- আবার পড়, কোথাও কোন ভুল হচ্ছে না তো?

-- না, না, স্পষ্ট লিখেচে যে পিটিশন ডিসমিসড্‌।

-- তার মানে আমরা হেরে গিয়েছি, বিল্ডার জিতেছে।

-- এত অন্যায়! এমন কেন হবে?

-- আমি নেক্‌স্‌ট ট্রেনে রায়পুর ফিরে আসছি। রাত সাড়ে আটটা হবে। রায়টা পড়ে দেখতে হবে।

ইংল্যান্ড থেকে বড়মেয়ের স্কাইপে জিগায়,-- রায় বেরিয়েছে?

-- হ্যাঁ, আমরা হেরে গিয়েছি।

-- সবসময় তোমার কেঠো ইয়ার্কি ভাল লাগেনা, ঠিক করে বল।

-- ঠিকই বলছি, মাকে জিগ্যেস কর।

এবার বড় মেয়ে চুপ হয়ে যায়। তারপর ফুঁপিয়ে ওঠে-- আমাদের কি কোনদিন সোজাসুজি ন্যায় মিলবে না? আমাদের সঙ্গেই কেন এমন হয়?

-- বাজে বকিস না। পয়সার বা পাওয়ারের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে অনেক সময়ই এমন হয়। কিন্তু এটাই শেষ নয়।

রত্নার গলার আওয়াজ অসম্ভব শান্ত।- অনেক হল। সারাজীবন কি একটা ফালতু বিল্ডারের সঙ্গে ঝগড়া করেই সময় কাটাতে হবে? ওকে ভুলে যাওয়া ভাল। কোর্ট তো বলছে যে এই ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটটাই আমাদের। তাই দালাল লাগিয়ে ফ্ল্যাট বেচে লোন চুকিয়ে বাকি পয়সা ব্যাংকে রেখে চল কোলকাতায় যাই, নাটক দেখি, ক্ল্যাসিক্যাল গান শুনি। তুমি আবার ভায়োলিন শেখা শুরু কর। আমি একটু কত্থক শিখি। ফিট থাকবো।

হরিদাস পাল বলে-- এবার বৃন্দাবন গেলে হয় না?


এপ্রিল মাস। নানান জায়গা থেকে শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ আসছে।

ঘুরে ফিরে একই কথা,-- কি পেলে? অনেক তো হল। এ দেশের কিছু হবে না।

মেয়েরা বলে- তোমাদের সারা জীবনে আরো অনেক তো সাধ-আহ্লাদ আছে। কতদিন আর একটা বিল্ডারের পেছনে সময় নষ্ট করবে? ওর জীবনে পয়সা আর ক্ষমতা ছাড়া কিছু নেই। এটাই ওর এজেন্ডা। তোমাদের তো তা নয়, এখন ক্লান্তি লাগে না? ওকে ভুলে যাও।

কেউ কেউ বলেন-- তুমি রাস্তা দেখিয়েছ, এবার ক্ষ্যামা দাও।অন্য ফ্ল্যাট ওয়ালারা যদি মবিলাইজ না হয়, ভয় পেয়ে বিল্ডার-প্রোমোটারের ছাতার তলাতেই থাকে, তুমি একা কি করতে পার!

তোমাদের কব্জা তো ফ্ল্যাটটায় আছে, টাইটেল ডীড আছে। পারলে বিক্রি করে কোলকাতায় চলে এস, বা অন্য কোথাও ফ্ল্যাট কেন।

কথাটা মন্দ নয়। বয়েস অনেক হল। এখন খাব-দাব, বই পড়বো, গুরুচন্ডালিতে লিখবো, কোন অনুবাদ যদি কেউ ছাপে তো দু'পয়সা পাবো; সেসবে সময় দেবে , তা না--?

কিন্তু, একটা কথা মনের মধ্যে ঘোরে । সব কিছুই তো ঠিক ছিল। ডকুমেন্ট হরিদাস পালের পক্ষে। তবে কেমন করে উল্টো রায় হল? রঞ্জন তো এত নিশ্চিন্ত ছিল যে একদিন ও কনজিউমার কোর্টে যায় নি। তবে?

উকিল কে ফোন করায় বলে- কি করে এমন হল জানিনা, যান, তিরিশদিনের মধ্যে দিল্লিতে ন্যাশনাল ফোরামে আপিল করুন।

এবার ডিটেল্ড প্রসিডিং ও রায় নিয়ে আসা হল।

পড়ে তো হরিদাসবাবুর চক্ষু চড়ক গাছ। ওর উকিল পিটিশন হিন্দিতে বানিয়ে ছিল, কিন্তু স্টেট লেভেলের জাজমেন্ট ইংরিজিতে। তাহোক গে, জজসাহেব বা ফোরামের অন্য সদস্যেরা তো হিন্দি ভালই জানেন।

তাহলে রঞ্জনের পিটিশনের মূল বক্তব্য জজ অমন করে পাল্টে দিলেন কি করে?

আর তথ্য তো ভুল দিয়েছেন। উনি বলছেন-- ৭/১/১০ এ প্রার্থী রঞ্জন রায় নিজে একটি সার্টিফিকেট দিয়েছে যে ও ফ্ল্যাটের সম্পূর্ণ কব্জা উইথ ফুল স্যাটিসফ্যাকশন পেয়ে গিয়েছে। অতএব--।

রঞ্জন তন্নতন্ন করে সমস্ত এনক্লোজড ডকুমেন্ট হাতড়ায়-- কোথাও এমন কোন ডকুমেন্ট নেই। যে সার্টিফিকেট প্রেসার দিয়ে বিল্ডার এপ্রিল ২০০৯ এ সাইন করিয়েছিল, তাতে কোন তারিখ নেই। আর আর এটা কি?

টাউন প্ল্যানিং এর একটা জাল নকশা! তাও কোন সার্টিফিকেশন নেই! মূল কপি নয়, ফোটোকপি! সেটাই জজ মেনে নিয়েছেন? আর রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্টে অ্যাপ্লাই করে রত্না যে সার্টিফায়েড কপি জমা করেছে সেটাকে জজ পাত্তাই দিলেন না?

কিন্তু এই জাল নকশা নিয়ে রঞ্জনের উকিল ওকে জানায়নি কেন?


-বিল্ডার ও তো এই লড়াইয়ে অনেক রক্তাক্ত হয়েছে। উকিল, পুলিশ, জজ সব জায়গাতেই পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এখন তুমি যদি ফ্ল্যাট পচ্ছন্দমত দামে বেচে দাও তাহলে ওরও হাড়ে বাতাস লাগবে। নিশ্চয়ই ও আপদ গেল, ভেবে চুপচাপ থাকবে। যা হয়েছে অনেক। ভবিষ্যতে ও কারও সঙ্গে এ'রকম করার আগে দু'বার ভাববে।

- কিন্তু ন্যাশনাল ফোরাম অফ কনজিউমার'স গ্রিভ্যান্স রিড্রেসাল এ অ্যাপীল করা উচিত। নইলে মনে হবে যে আমরা মামলাবাজ, খামোকা লোকটাকে বদনাম করতে মিথ্যে মামলা করে বেড়াই, যেটা ও বলছে।

দিল্লিতে ট্যাক্স কন্সাল্ট্যান্ট ছোট মেয়ের সঙ্গে কথা হয়।

ভাল উকিল খুঁজতে হবে। প্রসিডিওর জানতে হবে। কিন্তু তিরিশদিন সময় যে ফুরিয়ে এল।

মেয়ের কথানুযায়ী জাজমেন্টের কপি ও নিজের নোটস্‌ পাঠানো গেল।

পরের দিন মেয়ের উত্তেজিত গলা।

-- বাবা, তুমি করেছ কি? এই উকিল কোত্থেকে ধরেছিলে? কার কথায়? ওর ক্রেডেনশিয়াল কি?

পুরো প্রসিডিংস থেকে দেখা যাচ্ছে যে ও বিল্ডারদের ফলস্‌ স্টেটমেন্ট ও জালি নকশার ব্যাপারে রিজয়েন্ডার জমা করেনি। আর মূল পিটিশন ও বেশ উইক। ইস্যুটা একেবারে এলেবেলে ভাবে তুলে ধরেছে।

-- আমি জিগ্যেস করেছিলাম। ও বল্লো ওর‌্যাল রিজয়েন্ডার দিয়েছিল।

-- মিথ্যে কথা! রিজয়েন্ডার আর তার সঙ্গে এফিডেভিট ইন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হয়; ওর‌্যাল হয় না। শুধু আর্গুমেন্ট ওর‌্যাল হতে পারে। ও তোমাদের সঙ্গে বিল্ডারের টাকা খেয়ে বেইমানি করেছে। আর যদি কোন কারণে ও জমা করে ত্থাকতো বা ওর‌্যাল দিয়ে থাকতো, তাহলে প্রসিডিংস এ লেখা থাকত। উল্টে জজ রায়ে বলছে যে আবেদক কোন এভিডেন্স ঠিকমত দেয় নি। এই পিটিশন ম্যালিশিয়াস মনে হচ্ছে। আমাদের বরাবরের উকিলকে কেন কেস দাও নি? আমি নিয়মিত বলেছি, উকিল ভাল তো?

রত্না বলে,-- কতবার তোর বাবাকে বলেছি যে কনজিউমার কোর্টের প্রসিডিংস এ চল। উকিল খালি বলে -আসার দরকার নেই। তোর বাবা আলসে। এড়িয়ে যেতে পারলে বাঁচে। ৪২০ এর ক্রিমিনাল কেসটায় আমরা নিয়মিত কোর্টে যাই, উকিলের চেম্বারে গিয়ে ফলো আপ করি। তাতে লাভ হয়েছে। যদিও ওখানেও ম্যাজিস্ট্রেট টাকা খেয়ে আমাকেই ধমকাচ্ছিল, আর সমানে তারিখ বাড়াচ্ছিল। দেড় বছরেও কেস রেজিস্টার করেনি। এটাও দেখবি খারিজ হয়ে যাবে। চল, সব ছেড়েছুড়ে কোলকাতায় যাই।

রঞ্জনের মাথা নুয়ে পড়ে।

ভাঙা গলায় বলে---ভুল হয়ে গেছে রে! বড় ভুল। আমাদের রেগুলার উকিল চোখে ছানি পড়ায় অপারেশন করাচ্ছিল। আমি অধৈর্য্য হয়ে এক বন্ধুর কথায় একে লাগালাম। ও ৬০০০/- টাকার একটি অ্যাপীল জিতিয়েছিল।

-- করেছ কি বাবা! এই ব্যাকগ্রাউন্ডের উকিলকে তুমি কুড়ি লাখ টাকার স্টেট ফোরামের কেস দিয়েছ? আর ও যে পিটিশন বানিয়েছে সেটা বাজে, ইন্‌কমপিটেন্ট ফুল!

শোন, আমি দিল্লিতে এই লাইনেরই খুব বড় হাউসকে ধরেছি। তিনটে সিটিং হয়েছে। ওঁরা কনভিন্সড্‌; উকিল বেইমানি করেছে। ওর ডকুমেন্টের বেসিসেই বার কাউন্সিলে কমপ্লেইন করে ওর লাইসেন্স বাতিল করানো যাবে।

আপাতত: হিন্দি ডকুমেন্ট গুলোর সুপ্রীম কোর্টের অথরাইজড্‌ ট্রানে্‌স্‌লটর কে দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে দিতে হবে।

-- দেখ না! উকিল বাড়ি বানাচ্চে। নিঘ্‌ঘাৎ মেটিরিয়াল্‌স আমাদের বিল্ডার ফোকটে সাপ্লাই দিয়েছে। তোর বাবা হল একচক্ষু হরিণ, আর আলসে।

বল্লেই আমাকে রবীন্দ্রনাথ শোনাবে -- মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ!

এই জন্যেই কোলকাতার ছেলে বিয়ে করতে চাইনি। খালি মার্কস আর কবিতা শোনাবে, চা-সিগ্রেট খাবে। কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা।


--- আসলে আমি বড্ড টায়ার্ড। রিটায়ারের সময়। ব্যাংকে নতুন সিস্টেম-- কোর ব্যাংকিং শুরু। আমার কোন ট্রেনিং নেই।

যাতে কোন ভুল না হয়, টাকাপয়সা ভরতে না হয়, টার্মিনাল বেনিফিট গুলো ঠিকমত পাই তার টেনশন। আবার তোর দিদিকে পড়তে বাইরে পাঠাতে হবে তার টেনশন। ট্রেনে রোজ চারঘন্টার আসাযাওয়া। আবার ১২০কিমি দূরে বিলাসপুরে গিয়ে কোর্টের ফলো আপ! কোথাও নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার দোষেই সব হল। কোথাও আমার অহংকার হয়েছিল। আমি বেশি জানি, বুঝি। তোর মা ঠিক ছিল।


-- আমি বলি কি, যা হয়েছে, হয়েছে। তোমরা যা সাধ্যে কুলোয় করেছ, ভাল ফাইট দিয়েছ। এখন তোমার শরীর খারাপ না হয়ে যায়! আর অ্যাপীল করতে হবে না। ৪২০ এর পিটিশন এদ্দিনেও রেজিস্টার হয় নি তো? উকিলকে বলে উইড্র করিয়ে নাও। এজেন্ট কে বলে ফ্ল্যাট বেচার বন্দোবস্ত কর। আমার লোন ক্লোজ করে দিয়ে এই চ্যাপটারটা ব্যাড ড্রীম ধরে নিয়ে ভুলে যাওয়া ভাল। চল , কিছুদিন দিল্লি শিফ্‌ট করে আমার সঙ্গে থাকবে।

আবার তুমি-আমি-মা-ঠাকুমা মিলে ফ্যামিলি-ফ্যামিলি খেলব, কাজের চাপে টাকার পেছনে দৌড়ে অনেকদিন খেলিনি বাবা!

-- আমেন!!


ওম্‌ শান্তি! ওম্‌ শান্তি!

রঞ্জনের মনে পড়ে গৌতম ঘোষের "" পার'' ফিল্মে গাঁ থেকে উচ্ছেদ হওয়া ওরা

দুজন বুধিয়া ও তার স্বামী( নাসিরুদ্দিন ও স্মিতা পাটিল) কোলকাতায় এসে নিরুপায় হয়ে গঙ্গায় শুয়োর পার করানোর কাজ নিয়েছিল।

এখন বাড়ির ভাঙা জানলা, দরজার নেট ও ভাঙা পাল্লা সব মেরামত করে লোক লাগিয়ে দু'বছরের জমে থাকা ময়লা সাফ করিয়ে ফ্ল্যাটটিকে বিক্রয়যোগ্য করে তুলতে হবে।

রত্না ওর প্রাক্তন কিছু ছাত্র যারা আজ জমিবাড়ি কেনাবেচার দালালদের সিন্ডিকেটে কাজ করছে তাদের জনাদুইকে নিয়ে ওই অ্যাপার্টমেন্টে যায় ।

গেটে অচেনা সিকিউরিটি আটকে দেয়। কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে দেখা করতে--সব রেজিস্টারে লিখুন, মোবাইল নাম্বার লিখুন, তবে যেতে পারবেন।

রত্না হাসে। বলে আমি এই বাড়ির দুটো ফ্ল্যাটের মালিক। আমাকে নিশ্চয়ই সাইন করতে হবে না?

সিকিউরিটি ভেতরে কার সঙ্গে যেন কথা বলে, ত্যারপর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে --যাইয়ে।

লিফট দিয়ে ওপরে উঠতেই চারদিকে দরজার আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি ফিসফাস শুরু হয়ে যায়। পুরনো কাজেরমাসি মেয়েটি এগিয়ে এসে প্রণাম করে,--দিদি, কতদিন পরে এলে?

রত্না ওকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়, বলে-- কিছু পুরনো জামাকাপড় আর রান্নাঘরের কাজের জিনিস আছে। তোর যা যা লাগবে নিয়ে নে।

ক'দিনের মধ্যে বাড়ির মেরামতের কাজ শুরু হয়ে যায়।

রঞ্জনকে জলের লাইন জুড়ে দিতে অনুরোধ করতে হয় সামনের বাঙালী পরিবারকে। ওরা বলে,-- আপনারা চলে আসুন। কেন রায়পুরে খামোকা ভাড়াবাড়িতে আছেন? সব ঠিক হয়ে যাবে।

রত্না হেসে রঞ্জনকে বলে-- আশ্চর্য! এরাই না দু'বছর আগের সেই রাতে গুন্ডা-পুলিশের সাথে গলা মিলিয়ে চেঁচাচ্ছিল- রায়ম্যাডামকে টেনে ঘর থেকে বের করে দু'ঘা দাও। ওই বেশি কানুন ঝাড়ে! আমরা কি ভুল শুনছি।

রাত্তিরে রঞ্জনের মোবাইলে সোসাইটির সেক্রেটারির ফোন আসে।

--আ জাইয়ে রায়সাব! আপনি আমাদের আদরণীয়। এখানে জল-টল আরো কিছু সমস্যা আছে। কমিটির ও নতুন করে ইলেকশন হবে। আপনার পরামর্শ খুব কাজে আসবে। প্লীজ, চলে আসুন।

ব্যাপারটা কি!


ব্যাপারটা বোঝা গেল কদিন পরেই।

দিল্লি থেকে হরিয়ানভী দম্পতির ফোন এল। ওরা একসঙ্গেই আছে। ওদের ভেতরের ব্যাপারে রঞ্জনেরা আর নাক গলাবে না, ঠিক করে ছিল।

হরিয়ানভী পরিবার দিল্লি গিয়ে কিছুদিন ঢিলে দিয়েছিল। বলেছিল, --ওদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র-পলিটিক্যাল সোর্স-মন্ত্রী-শান্ত্রী সব খরচ করতে দিন। ততদিন ধৈর্য্য ধরে থাকুন। আর আমাদের বিরুদ্ধে, মিসেস রায়ের বিরুদ্ধে ফল্‌স্‌ কেসগুলো( হরিজন অত্যাচার নিরোধক আইন এবং অস্ত্র আইন) ঠান্ডা হয়ে বস্তাবন্দী হতে দিন।

তারপর আমরা দরজা ভেঙে মারপিট-লুটতরাজের কেস কে ফার্স্ট ফরওয়ার্ড করে দেব। দেখবেন, তখন পালাতে পথ পাবেনা।

এখন আগের ডিজি'র দস্তখতে ওই বানানো কেস গুলো এনকোয়ারি রিপোর্টে ""ফ্যাব্রিকেটেড, নীড নো অ্যাকশন'' নোটিং হয়ে তাকে তোলা হয়ে গেছে।

এখন সরদানা পরিবার নিয়মিত কোর্টে হাজির হচ্ছে। কড়া মেজাজের মহিল্লা জজ বিল্ডারের বৌ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ শুদ্ধু চালানে যে আঠেরো জনের নাম আছে তাদের প্রত্যেক হিয়ারিং এর সময় সব কাজকম্মো ছেড়ে কোর্টে এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করছে।

ভবিষ্যতে রায়দম্পতিকেও সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে সাক্ষী দিতে হবে। তাতে সবকটার বিভিন্ন মেয়াদের জেল হওয়ার সম্ভাবনা। মুখুজ্যের ছেলেদুটোর সরকারি চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা শুণ্যি হয়ে যাবে।

তাই চেষ্টা হচ্ছে রায়দম্পতির সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করার।

হরি হে, তুমিই সত্য।


ঠিক হয়, সময় আসলে আমরা সাক্ষী দেব। যা সত্যি দেখেছি তাই বলব, না কম, না বেশি।

যাকগে, মরুকগে। যখন বেচেই দেব, তাহলে আর ঝগড়া রাখি কেন? কেন রিটয়ারের পর দিল্লিতে ন্যাশনাল কমিশনে এক লাখটাকা খরচা করে কেস লড়ি? গরীবের ঘোড়া রোগ! এসব আইন আদালত আমাদের জন্যে নয়।

রত্না ভাবতে চেষ্টা করে যে কবে বিল্ডার ওকে বৌদি বলে ডেকেছিল, কবে ওর কথায় জ্বর নিয়ে ওর সঙ্গে দাঁড়িয়ে সামনের রাস্তা পাকা করতে সাহায্য করেছিল। কবে ভেতরের লাক্সারি হিডেন লাইট, ফলস্‌ সিলিং, ঘোরানো সিঁড়ি ওর কথামত বদলে দিয়েছিল।

না:, বদলা নয়, বদল চাই। আমরা বড়। বড়প্পন দেখাতে হবে। আমাদের একটা বিল্ডারকে শিক্ষা দেয়া ছাড়া জীবনে আর কোন কাজ নেই কি!

কনজিউমার ফোরাম তো মায়ের ভোগে গেছে, এবার ৪২০টাও যাবে। তার আগে আমরাই কেন উইথড্র করে নিই না? এখনো তো রেজিস্ট্রি হয় নি।


রঞ্জন রওনা হয় বিলাসপুর। আর এসবের পেছনে খরচা করা নয়। বুনো হাঁসের পেছনে দৌড়নো নয়। কোর্টে গিয়ে উকিলের সহকারীকে বলে-- আমার লাগানো ৪২০ ধারার ক্রিমিনাল কেসটা উইথড্র করতে চাই। রেজিস্ট্রি হয় নি দেড় বছরেও, তার চেয়ে সিম্পল অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে--।

লাফিয়ে ওঠেন অ্যাডভোকেট বর্মা,"" কি বলছেন কি মি: রায়! আজকেই আমি আর্গুমেন্ট করে আপনার কেস রেজিস্টার করিয়েছি। নতুন ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমে খারিজ করতে চাইছিলেন। বলছিলেন যখন দেড় বছরেও আগের উনি কিছু করেন নি, তার মানে পিটিশনে কোন দম নেই।

আমি বল্লাম,-- দম আছে বলেই উনি খারিজও করে যান নি। প্লীজ, আগে আমার আর্গুমেন্ট শুনুন। ম্যাজিস্ট্রেট কনভিন্সড্‌। অর্ডার করেছেন কেস রেজিস্টার্ড করে বিল্ডারকে নোটিস দিতে। আপনি নোটিসের জন্যে কয়েক হাজার জমা করে দিন।


ইতিমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজা এবং করুণানিধির মেয়ে কানিমোঝি জেলে গেছে। রিলায়েন্সের এবং অন্য কয়েকটি হাই প্রোফাইল কোম্পানির সি ই ও গ্রেফতার হয়েছে। বিজেপির কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পাকে ইস্তফা দিতে হয়েছে।

এবং বিনায়ক সেন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।

হাওয়ামোরগের মুখ ঘুরে যায়। ওরা চারজন হটাৎ আইপিএলে কেকেআর এর সাপোর্টার হয়ে "" করব, লড়ব, জিতব রে'' গাইতে থাকে।

রঞ্জন দিল্লি দৌড়য়।

মেয়ে নিজের পেশার সুবাদে ন্যাশনাল ফোরামের জন্যে বেশ অভিজ্ঞ নামজাদা অ্যাডভোকেট ধরেছে। সব শুনে তিনি কেস অ্যাকসেপ্ট করলেন। কিন্তু জানালেন যে ওখানে অনুমানের পেন্ডিং কেসের বিপরীত লম্বা লাইন। এখন ২০০৪ এর কেসগুলোর ফয়সালা হচ্ছে। কাজেই কেস কোর্টে রেজিস্টার হবার পরে এক রাউন্ড নোটিস ও জবাব হবার পরে ডাক পাবে ২০১৬-১৭তে।

তারপর ফয়সালা ফেভারে গেলে বড়জোর মূল দাম ও এক-দুই লাখ ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে। অ্যাদ্দিন পর ওইটুকু পেয়ে কার কি উবগার হবে?

তারচেয়ে ৪২০ এর ক্রিমিনাল কেস এগুলো বিল্ডার ভয় পাবে,একটা স্টেজের পরে আউট অফ কোর্ট সমঝোতা করতে পারে। তাতে বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা।

এবার ওরা হতভম্ব হয়ে অ্যাকশনের জন্যে প্লান-এ, বি, সি ঠিক করতে বসে যায়।


নতুন ডেভেলপমেন্ট।

এক, কনজিউমার ফোরামের ন্যাশনাল লেভেলে গিয়ে হেরে গেছি। এক পাগলা ফ্রাস্টেটেড জজ( বহুদিন প্রমোশন পাননি, একটা ঘটনায় বুক হয়েছিলেন) কেস রেজিস্টার না করে রায় দিলেন-- একবার ফ্ল্যাট কিনে থাকতে শুরু করে বিল্ডারের খুঁত ধরা! ইয়ার্কি পেয়েছ? ওসব চলবেনা। কেস খারিজ উল্টে পিটিশনার রঞ্জন রায় সাতদিনের মধ্যে দশহাজার টাকা ফাইন দাও। দেরি করলে ৬% সুদ দাও!!!

সিনিয়র অ্যাডভোকেট রেগে গিয়ে বল্লেন--তুঘলকি ফরমান।লিগ্যালি রং, আন -অ্যাক্সেপ্টেবল। সুপ্রীম কোর্টে অ্যাপীল করলে কেস রেজিস্টার হবে, পেনাল্টি খারিজ হবে।

-- তাতে খরচা কত?

-- কমপক্ষে দশহাজার টাকা।

রঞ্জন মেয়েকে বলে -যাব না। ফাইন জমা করে দে।

এবার তো ফ্ল্যাট বিক্রি করে কোলকাতায় যেতে বাধা নেই। লোকজন ফ্ল্যাট দেখতে আসছে।


এদিকে হাইকোর্টে হরিদাস পালের পিটিশন অ্যাকসেপ্ট হয়ে কর্পোরেশন এবং বিল্ডারের ভাল বাঁশ হয়েছে। কর্পোরেশন বিল্ডারের থেকে অফিসিয়ালি দুই লক্ষ বাষট্টি হাজার টাকা জরিমানা আদায় করতে বাধ্য হয়েছে।

কিন্তু এখনো আরও কাজ বাকি। রঞ্জন রিজয়েন্ডার জমা করে। বিল্ডারের পার্টনারদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়েচে। খবরের কাগজে নোটিস ছেপে আর্বিট্রেশনে যাচ্ছে।

আরও ভাল খবর।

ওদের মার খাওয়ার ঘটনায় পুলিশ পয়সা খেয়ে সেকশন বদলে দিয়েছিল। ৪৫২; অধিকতম শাস্তি সাত বছর। মহিলা ম্যাজিস্ট্রেট হরিদাস পাল ও তার স্ত্রীর সাক্ষ্য শুনে ধারা কড়া করে দিলেন। ৪৫৮; অর্থাৎ শাস্তি ম্যাক্সিমাম ১৪ বছর। এবং ঊনিশ জনের বিরুদ্ধে নন-বেইলেবল্‌ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

হরিদাস পাল গিন্নিকে বলে--আজ বিরিয়ানি করলে হয় না?

-- বেশি লাফিও না। ওরা এত সহজে হার মানবে না। বাঙালী অল্পে সন্তুষ্ট কেন?

২৩ তারিখ শুনানির তারিখ, অপেক্ষা কর। তারপর বিরিয়ানি।

কথাটা ঠিক।

হরিজন অট্রোসিটির মিথ্যে মামলায় গিন্নির বিরুদ্ধে এফ আই আর ছিল, একটা আর্মস্‌ অ্যাক্ট ও লাগানো আছে। অ্যাদ্দিন প্রাথমিক তদন্তের পরে ঠান্ডা বস্তায় ছিল।

ফোন আসে।

-- আমি ডিএসপি হরিজন থানা বলছি। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা আছে।

-- আগে আমাকে বলুন।

-- ওনার বিরুদ্ধে পুরনো কেস ছিল। শেষ হয় নি। তাই কোর্টে যেতে হবে, বিলাসপুরে।

হরিয়ানার জাঠ দম্পতি ফোন তুলছে না। যে তারিখ বলব তখন গিয়ে সব শুনে কোর্ট যদি বন্ধ করার যুক্তি মেনে নেয় তো ঠিক আছে, নইলে চালান পেশ করতে হবে। উকিল সঙ্গে নিয়ে আসবেন।

-- আমাদের জাঠ দম্পতির সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই। (মিথ্যে কথা!)। যেদিন বলবেন আদালতে হাজির হব।

রত্না বলে-- কোথাও কোন গন্ধ পাচ্ছি। নইলে তিন বছর ঠান্ডাবস্তায় পড়ে থাকা কেসগুলো আজকেই মাথা তুলছে কেন? ট্র্যাপ?

উকিল জানায়-- সম্ভবত: ট্র্যাপ। কারণ পুলিশ যদি "খাতমা" রিপোর্ট পেশ করতে চায় তার জন্যে কারো যাওয়ার দরকার হয় না। আপনারা তো অপরাধী নন। চালান দিতে আগে অপরাধ কায়ম করতে হবে। যাবেন না। চালানের সূচনা পেলে অ্যান্টিসিপেটরি বেইলের আবেদন দেব। কোর্ট রিজেক্ট করবে। তখন বৌদিকে সারেন্ডার করিয়ে রেগুলার বেইল চাইব। হয়ে যাবে। কারণ কেসে কোন দম নেই। খারিজ হওয়ার যোগ্য।

কিন্তু এই প্রসেসে হয়তো খুব বেশি হলে বৌদিকে দিন দুই জেলে থাকতে হতে পারে।

রত্না হাসিমুখে বলে-- দিনদুই মাটিতে শুতে হবে, নোংরা কম্বল, মাটির পাতিলে পটি, পাখা ছাড়া থাকা, মশা। এইতো! সাতদিন থেকে যাব। তুমি খালি জামাকাপড় দিয়ে যেও। একবার বেরিয়ে আসি। ওদের অস্ত্র শেষ। তরপর কি করবে?

-- দাঁড়াও। আমার সময় চাই। আগে ৬ মে অব্দি মাকে কোলকাতায় রেখে আসি। তদ্দিন টাইম কিল করতে হবে।

-- হয়ে যাবে। আমাদের শহর পাল্টানোর খবর পুলিশ জানে না। আমরা অপরাধী নই। ট্রেস করতে করতে দিন পনের। অন্য জেলা। প্রসেস। তারপর ধরতে পারলে সমন দেবে, আর কি? তখন হাজির হব কোর্টে। তদ্দিন অচেনা কোন ফোন ধরব না।

রঞ্জন বিচলিত।

ফোন আসে। ডি এস পি'র অফিস, মোবাইল, অন্য অচেনা নম্বর থেকে। বেলা এগারোটা থেকে রাত সাতটা পর্য্যন্ত। রত্না ধরে না, মুচকি হাসে।

-- মুখ গোমড়া করে থেক না। টেক ইট অ্যাজ এ স্পোর্টিং গেম।


আজ ডিএসপির কাছ থেকে কল আসেনি। বুঝে গেছে অচেনা নম্বর হলে আমরা ধরব না।

ভাবছি ওদের নেকস্ট মুভ কী হবে?

আমাদের গেস্‌ ২৩ তারিখ। সেদিন দরজা ভেঙে হামলার কেসে ( আই পি সি সেকশন ৪৫৮) শুনানির দিন। সেদিন ওদের ১৯ জনের নন-বেইলেবল ওয়ারেন্টের ভাগ্য নির্ধারণ, কিছু লোকের জামিন হবে, কিছু লোকের রিজেক্ট হবে। তারপর ওদের সেশন কোর্টে গিয়ে জামিন করাতে হবে।

হরিয়ানী পরিবারটি বিজনেসের খাতিরে বাইরে গেছে। সেদিন ফরিয়াদী(মহিলাটি) এবং উকিল (পুরুষ) হিসেবে ওদের বিলাসপুর কোর্টে আসতেই হবে। তখন ওদের হরিজন অত্যাচার অধিনিয়মের কেসের সামন ধরাতে পারে। দেখি, কি হয়। সেই দেখে আমাদের ট্যাকটিস ঠিক হবে।

ততদিন অপেক্ষা করা। ১৪ এপ্রিল কোলকাতায় যাব রাজারহাটের ফ্ল্যাট দেখে ফাইনাল করতে। তারপর ২৩।

আপাতত: এইটুকু।



দু’বছর পর।

এখন ভাল আছি।

সেই বিল্ডার অন্য এক চিটিং কেসে ফেঁসে গতবছর কোরবা শহরের একটি হোটেল থেকে গ্রেফতার হয়েছে। ওর বিজনেস লাটে উঠেছে।

বিলাসপুরের ফ্ল্যাট বেচতে বেগ পেতে হয়েছিল। সব পোটেনশিয়াল কাস্টমারকে ওখানের কয়েকটি পরিবার মিলে ভাগিয়ে দিত। অগ্রণী ছিল একজন বাঙালী মহিলা, যাঁর স্বামী আমার ব্যাংকেই কাজ করত, এবং যাকে আমি দুবার ডিফেন্স সাজিয়ে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন থেকে বাঁচিয়েছিলাম। অবশেষে ২০১২ তেই ঠিক দামে বেচতে পেরেছি।

কোলকাতায় আমার পুরনো পাড়ায় আপাততঃ ভাড়াবাড়িতে আছি। কাছেই আমার একগাদা কাজিন ও নাকতলা স্কুলের প্রাক্তন বন্ধু ও বন্ধুনীর দল। দিব্যি আছি। বই পড়ছি, নাটক দেখছি, গান শুনছি, গুরুতে আড্ডা দিচ্ছি, তক্কো করছি। হিন্দিতে বললে-- দশো উঙ্গলি ঘিউ মেঁ বা! দশটা আঙ্গুল ঘিয়ে ডোবানো!

দুই মেয়েই প্রফেশনাল লাইফে প্রতিষ্ঠিত। ফলে নো টেনশন, শুধু এনজয়মেন্ট। আপাতত কয়েকমাসের জন্যে দিল্লিতে ছোট মেয়ের কাছে আছি।

আপনারা ভাল থাকুন। 


 শেষ

0 comments: