0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in

[আমাদের পরিবার সালের দেশভাগের সর্বনাশী আতংকের মধ্যে ১৯৫০ সালে ওপার বাংলা থেকে সাতপুরুষের ভিটেমাটি খুইয়ে প্রাণ হাতে করে পদ্মা পেরিয়ে এপার বাংলায় এসেছিল। আমার জন্ম কোলকাতার ভাড়াবাড়িতে। ওসব আমার কাছে রূপকথা, দাদু-ঠাকুমা ও মায়ের মুখে শোনা, তাঁদের স্মৃতি। রিফিউজি শব্দটি আমার অবচেতনে সাঁতার কাটে। ঘটনাচক্রে কলেজের পাঠ শেষ করা, চাকরি, সংসারপাতা সবই ছত্ত্রিশগড়ে। ধীরে ধীরে আমার চেতনায় জায়গা করে নেয় এই নতুন দেশ, নতুন ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এক অবুঝ ভালবাসা। রিটায়ার করার মুখে কিনে ফেলি এক ডুপ্লে ফ্ল্যাট ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে। সবাইকে বোঝাই যে ভাড়াবাড়ির দিন শেষ। নতুন কমপ্লেক্স।তাতে চার চারটে বাঙালি পরিবার। আমাদের ফ্ল্যাটটি বড়, তাই সবার আড্ডা এবং উৎসবের দিনে খাওয়াদাওয়া সব আমাদের ঘরে। সে বড় সুখের দিন। ছ’টি মাস এভাবেই কেটে গেল।

তারপর একদিন।

একটি পত্রিকার থেকে তাগাদা এসেছিল ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের--রাজনৈতিক, ধার্মিক বা পেটের তাড়না, যে কারণেই হোক - কথা নিয়ে কিছু লিখতে, কিছু ভাবতে চাইছিলাম। সংবেদনশীল বিষয়, কিন্তু গুছিয়ে ভাবতে পারছিলাম না।

এমন সময় আমাকেই হতে হল বাস্তুহারা। যে বিলাসপুর শহরে আমার এত বন্ধুবান্ধব, নব্বইয়ের দশক থেকে একটানা উনিশবছর কাটালাম -- সেখান থেকে দিতে হল পিঠটান! তবে কি আমি সত্যিকারের ছত্তিশগড়িয়া হতে পারিনি? এখানকার লোকের চোখে বাঙালীই রয়ে গেলাম? নিজের সম্বন্ধে যা ভাবতাম তা আসলে মানসিক বিলাসমাত্র? তাহলে আমার ঠাঁই কোথায়? আগামী বছর রিটায়ার করে কোথায় আস্তানা গাড়বো? এই কীটস্য কীট জীবনের তৃতীয় ইনিংস কোথায় খেলবে হরিদাস পাল? কোন মাঠে? কোন পিচে? বড়মেয়ে শোনালো শাহরুখ খানের কোন হালে রিলিজ হওয়া ফিলিমের ডায়লগ, যার সারমর্ম হল- বরফের নিয়তি হল তার উৎসে মিশে যাওয়া। তবে কি কোলকাতা? কিন্তু আমার চেনা কোলকাতা তো কবে হারিয়ে গেছে। আজকের কোলকাতায় পা’ রাখা মানে গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে গেলে মিষ্টির বাক্সহাতে সেখানে দেখা করতে যাওয়া।

কি করবো? উত্তর জানা ছিলনা। তাই এলোমেলো ভাবনাচিন্তাগুলো আজ এক দশক বাদে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা।]



প্রথম পর্ব

ভয়ের ত্রিমাত্রিক চেহারা

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯, দিনটা ছিল শনিবার। সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেল। মহালর প্রিয় গান ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু' শুনতে ক্যাসেট চালালাম। যারা ভোরে ডাকতে বলেছিলো তাদের কাউকেই ডাকা হয়নি। সামান্য অপরাধ বোধ নিয়ে ব্যাংকে গেলাম ডিউটি করতে ট্রেন ধরে। আগামী অষ্টমীর দিন ছুটি নেবো। গাড়ি নিয়ে সপরিবারে যাবো দেড়শ’ কিলোমিটার দূরে ইস্পাতনগরী ভিলাইয়ে, ভাইবৌ - ভাইঝির কাছে। আমার মা - বৌ - মেয়ে ওখানে কালীবাড়ির পূজোয় অঞ্জলি দেবে, আমি প্রসাদ খাবো। রাত্তিরে পূজোপ্যান্ডেলের স্টেজে ভাইবৌ - ভাইঝির গ্রুপের গান শুনবো, বিশেষ করে হিন্দিতে গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত।

সেসব তো অনেক পরের কথা। আপাতত : শনিবার, ব্যাংকে হাফ - ডে মজদুরি করে মুম্বাই - হাওড়া মেল ধরে বিলাসপুর ফিরবো, দুই মেয়ে দিল্লি থেকে দুপুরেই বাড়ি পৌঁছে মায়ের হাতের রান্না মাংসভাত খেয়ে টেনে ঘুম দিচ্ছে। আমি ফিরলে রাত্তিরে জমিয়ে আড্ডা দেবে যে! কাল রোববার, পরশু সোমবার --- টানা দু’ দিন ছুটি।

" মন যে খুশি - খুশি আজ ' গুনগুন করতে করতে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ি ‘বৈশালী প্রাইড ' এ ঢুকছি। কিন্তু কোথাও বেসুর বাজলো। গ্রাউন্ড ফ্লোর কিরকম অন্ধকার, অন্ধকার! অথচ অধিকাংশ ফ্ল্যাটে আলো আছে। আমাদের ফ্ল্যাটেও।

একি! সিঁড়ির নীচে যেখানে একটা বোর্ডে সবার মিটার লাগানো সেখানে দুজন বিজলী কর্মচারী কাজ করছে, প্যানেল ডোর খোলা , আমাদের ঘরের হ্যারিকেন - মার্কা এমার্জেন্সি লাইট হাতে আমার গিন্নি দাঁড়িয়ে, আর কোমর থেকে ঝুঁকে গভীর মন : নিবেশ করে মেরামতির কাজ দেখছেন হরিয়ানাওয়ালা মি : সর্দানা, 210 ফ্ল্যাটের ভাড়াটে।

হ্যাঁ, এছাড়া ওঁর আঅরেকটি পরিচয় বেশি প্রাসংগিক। বিল্ডার এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে দাঁড়িয়ে এখন শুধু আমরা দুই পরিবার। বাকি ফ্ল্যাটওলারা হয় বিল্ডারের আপাত শক্তিশালী স্থানীয় পলিটিক্যাল সোস রে ওলা শিবিরে যোগ দিয়েছে, আর নইলে " সক্কালে অফিস যাই, রাত্তিরে বাড়ি ফিরে শাকভাত খেয়ে চুপচাপ পাশ ফিরে শুই' – কাজেই জলে নেমে কুমিরের সংগে বিবাদ! ‘পাগল নাকি’- বলে ‘পতলী গলী' তে সেঁধিয়েছে।

সিঁড়ির বাঁকে দাঁড়িয়ে পড়ি। -- ক্যা বাত হ্যায়?

প্রবীণ সর্দানা বিরক্তিতে খিঁচিয়ে ওঠে। --- মত পুছিয়ে! ইন শালোঁ কী হারামীপন্থী সে উব গয়া হুঁ। ফির হামারে মিটার সে হুকিং। আজ রঙ্গে হাত পকড়া হুঁ। ওহি চার মনি্‌জল কে সর্দার। শালে ফ্ল্যাট কা রেজিস্ট্রেশন নহী কিয়ে, বিজলী মিটার নেহি লিয়ে। পর ডাক্ট লগাকর সেনট্রালাইজড - এসি চালা রহে, তিন কমরেঁ মেঁ। ওহি বিল্ডার কে লাইনম্যান সে হুকিং কর রহা থা। ভাগ কে চৌথা মনি্‌জল মে সর্দারকে ফ্ল্যাটমেঁ ছুপ গয়া।

মিসেস বল্লেন -- ফিউজ কল আফিসে কমপ্লেন নিচ্ছিল না। চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে ফোন করায় দুজন গাড়ি করে এসে ধরেছে। মিস্ত্রিটা প্যানেলের তারগুলো খোলা রেখে পালিয়েছে। বড় রকম শর্ট সার্কিট হতে পারতো। এখন বিভাগের লোকজন চেক করছে।

আমি হাসিমুখে ঘরে উঠি। লিফট কাজ করছে না। আজ হাঁফ ধরলো না। হেঁটে তিন তলায় উঠে ঘরে উঠি। বাড়িতে হৈচৈ চলছে। দুই মেয়ে ও বড়টির বয়ফ্রেন্ড এসেছে।

কিন্তু আবার হিন্দমোটর থেকে বড় শালি এসেছেন। শ্বশুর মশায়ের ক্যান্সারে গত হওয়ার পর ভাইবোনদের কাগজে কিসব সই চাই। ইতিমধ্যে রেণুবালা গুপ্তা ঢোকে হৈহৈ করে। -- মি : রায়, শুনেছেন? দু’ দিন লিফট চলবেনা, জলের ও কষ্ট হতে পারে। কারণ বিজলী বিভাগের ওরা কমন লাইনের মিটার সীল করে দিয়েছে। বলেছে - কাল পরশু ছুটি। মঙ্গলবার এসে লোড চেক করবে। তদ্দিন এই লাইন বন্ধ।

আমি ভাবি --- অবোধের গোবধে আনন্দ। মেয়েগুলো এসেছে। এখন জলের কষ্ট?

--- আরে রায়! বাঙালীরা সহজে মুষড়ে পরে। চিয়ার আপ। লাইন বন্ধ হওয়ায় তিনটি ফ্ল্যাটে অন্ধকার নেমেছে। ঐ সর্দারের, গুড্ডি সেনগুপ্ত, আর বিল্ডারের বৌয়ের ‘বচপন’ স্কুলের প্রিন্সিপালের। মানে বুঝলেন? ওরাই কমন মিটারের থেকে হুকিং করছিলো। এখন তিনদিন ওদের আলো - হাওয়া বন্ধ। প্লাস অপরাধীরা টেকনিক্যালি ধরা পড়লো।

--- দুত্তোর! ওদের বাড়িতে ছোট ছেলে মেয়ে আছে, কি করে ভ্যাপসা গরমে রাত কাটাবে? তাও তিনদিন? নিঘ্‌ঘাত মরিয়া হয়ে কিছু করবে।

---- ধুর! আপনিও যেমন! মিসেস রায়ের কমপ্লেনে কাল করপোরেশনের কমিশনার এসে এখানে কন্‌স্‌ট্‌রাকশন চেক করে গেছে। ওরা ভয় পেয়েছে। আর সর্দারের বাড়িতে বাচ্চা কোথায়? সর্দারনী তো বাঁজা মেয়েমানুষ।

-- কি যে বাজে বকো রেণু!

আসি তবে বলে রেণু হাসিমুখে চলে যায়।

বড়দি বল্লেন - মেয়েটি বেশ হাসিখুশি, ভালো দেখতে। কিন্তু কথাবার্তা কেমন যেন ক্রুড।

আমি বলি -- হরিয়ানার স্টাইল ঝাড়ে। কিন্তু অন্যের দুর্দ্দশায় খুশি হওয়ার কি আছে?

মিসেস বল্লেন -- রন্‌জনের কথায় কান দিস না। ওরা রেণুকে মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে একমাস আগেই 15 দিন জেলে রেখেছিল। জামিন হতে দেয় নি। জেলে পয়সা খরচ করে ওকে প্রায় না খাইয়ে রেখেছিলো। ডাক্তর খালি মরফিন দিয়ে শুইয়ে রাখতো। শরীর ভাঙছে। ও একটু আনন্দ করতেই পারে, তোমাকে তো ভুগতে হয় নি! হলে বুঝতে।

আমার খালি এয়ারকুল পোয়ারোর মত মনে হয়- যেন খুনের গন্ধ পাচ্ছি।

0 comments: