0

গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য

Posted in






















‘আরে, চলুন, মশাই। দু’ফ্যামিলি গেলে টাকাটা কম লাগবে। দু’ভাগ হয়ে যাবে। জায়গাটা দেখাও হবে। যাবে। আর খরচ ও আদ্দেক। লাভই লাভ মশাই-’

অমলের দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপে হেসেছিলো ওই লোকটা। রবীন সরকার। কেন যে ওর কথা শুনে, সস্তায় বাজিমাতের আশায় রাজী হয়েছিল! এই আতান্তরে পড়ে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। উঃ, কী হবে এখন!

অথচ যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল কত আনন্দ মনে। খাজুরাহো আসার মূল প্ল্যানটা অবশ্য অমলের বৌ, সুতপার। অনেক দিন ধরেই বলছে, ‘শোনো না, মেয়েরা ছোট থাকতে থাকতেই চলো খাজুরাহোটা ঘুরে আসি। এরা আর একটু বড় হয়ে গেলে, আর কিন্তু ওরকম সব জায়গায় যাওয়া যাবে না’।

‘কোনও রকম জায়গায়?’ একটা উইংক করে জিজ্ঞাসা করেছিল অমল। ‘ইয়ার্কি কোরো না তো। এই তো পরের মাসেই ২৬ জানুয়ারি, সরস্বতীপুজো, রোববার- সব মিলিয়ে ভালো ছুটি পাওয়া যাবে। চলো ঘুরে আসি।’

‘হুম্, আইডিয়াটা মন্দ না। তবে এত শর্ট নোটিসে কি ট্রেনের টিকিট পাব?’-একটু অনিশ্চয়তার সুরে বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে অমল।

'তাহলে ফ্লাইটে যাব। দ্যাখো, এত সুন্দর ছুটি কিন্তু চট্ করে পাওয়া যায় না। এটাকে ইউটিলাইজ করতে হবে।’

‘সে তো বুঝলাম। কিন্ত প্লেনের টিকিটের যা দাম! এতগুলো টাকা শুধু শুধু…’

অমলকে কথা শেষ করতে দেয় না সুতপা।

‘থামো তো। কিপ্টে কোথাকার! এইটুকুও আ্যফোর্ড করতে না পারলে, দু'জনের চাকরি করার মানেটা কী বলো তো?’

অকাট্য যুক্তি।

‘নাও, নাও, ল্যাপটপখানা খোলো’

সুতপার তাড়ায় তখনই ল্যাপটপের সামনে বসে পড়ে অমল। আর, প্লেন নয়, ভাগ্যক্রমে ট্রেনের বুকিংই পেয়ে যায় ।

‘হোটেল বুকিং হলো না কিন্তু। নেটে যে ক'খানা দেখলাম, হয় খুব এক্সপেনসিভ, না হলে রুম দেখে পছন্দ হলো না। ওখানে পৌঁছে দেখে নিতে হবে। শোনো, ভালো হোটেল না পেলে ঝামেলা কোরো না যেন। হোটেল নিয়ে তোমার এত রকম স্পেসিফিকেশন!’

'শোনো, আমি তো আর অবুঝ না। এত অল্প সময়ে সব ব্যবস্থা করা…একটা মোটামুটি হোটেল হলেই হবে'- যেন মস্ত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে, এমনভাবে বরের দিকে তাকিয়ে বড় করে হাসে সুতপা।

নেক্সট উইকেই যাওয়া। গোছগাছ করতে করতেই, পুরো সপ্তাহটা যেন চোখের পলকে শেষ হয়ে গেলো।

দুটো বাচ্চা নিয়ে যাওয়া! সোজা কথা তো নয়। বুবলী না হয় ক্লাস টু-এ পড়ে। একটু বড় হয়েছে। ডাম্পু তো খুবই ছোট। এই দুইয়ে পড়েছে। এমনিতেই জানুয়ারীর ঠাণ্ডা! এখানেই এই। মধ্যপ্রদেশে আরো কত ঠাণ্ডা হবে ভাবো! সুতরাং প্রচুর জামা, সোয়েটার, মোজা, টুপি, এসব তো নিতেই হচ্ছে। তাছাড়াও বাচ্চাদের জন্যে, শুকনো খাবার রে, বিস্কুট রে, গুঁড়ো দুধ রে, ওষুধ রে-কী না নিতে হচ্ছে!

তিনটে বড় বড় সুটকেস হয়েছে। কম মাল! আর কুলী যখন সেই মাল ট্রেনের সীটের নীচে আ্যডজাস্ট করে রেখে দিল, তখন সুতপা, এই এক সপ্তাহের চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা আরাম করে ছাড়তে পারলো।

‘শোনো, খাজুরাহোর একটা নিয়ম আছে'- ট্রেনের দুলুনিতে মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে, সুতপার গা ঘেঁষে বসে বললো অমল। মুখে একটা ফিচকে হাসি।

‘কি নিয়ম?’ মুখে ক্রীম ঘষতে ঘষতে জিজ্ঞেস করলো সুতপা।

'ওই আর কী, দিনের বেলা মন্দিরের ভাস্কর্যগুলো দেখতে হয়, আর রাত্রে সেগুলোই…’

‘চুপ করো তো। মেয়েরা রয়েছে- আশ্চর্য! তুমি ওপরে তোমার সীটে উঠে যাও। আমি শোবো'- রাগের সুরে বলে সুতপা। যদিও ভেতরে ভেতরে সে যথেষ্ট পুলকিত।

ঘুম অমলেরও পেয়েছে। নানা কাজে সারাদিন খাটুনি তো কম যায়নি। তাই সুতপাকে ছোট্ট করে একটা গুডনাইট বলে, আর ঘুমন্ত মেয়েদের একটু আদর করে, ও ওপরের বাঙ্কে উঠে যায়।

এই অবধি তো ভালই ছিল। কিন্ত সাতনায় নামার পর থেকেই ঐ উটকো ঝামেলাটা অযাচিতভাবে কপালে এসে জুটল। তখন অবশ্য তাকে উটকো ঝামেলা বলে অমলের মনে হয়নি। মনে হয়েছিলো-মা লক্ষ্মীর আর্শীবাদ। সুতপার অবশ্য তখনই আপত্তি ছিল। কিন্ত অমল তাকে পাত্তা দেয়নি। বরং রাস্তার একপাশে নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় তাকে বুঝিয়েছিল, 'আরে শোন না, ছোটো গাড়ি তো নেই। বড় গাড়িই নিতে হবে। ওরাও যদি যায়, টাকাটা ভাগাভাগি হয়ে যাবে। তাছাড়া এত করে রিকোয়েস্ট করছে'- এই শেষের 'ছে'টা একটু টেনে বলে সুতপার দিকে বেড়ালছানার মতো তাকিয়ে থাকে অমল। এটাই ওর কাজ হাসিলের কায়দা। আর সেকথা জেনেও, সুতপা আবার সেই ফাঁদে পা দেয়।

'ঠিক আছে। ওরাও চলুক'

‘ওরা’ মানে হচ্ছে, সাতনা স্টেশনে আলাপ হওয়া ভদ্রলোক, যিনি নিজের নাম বললেন রবীন সরকার, তাঁর স্ত্রী আর বছর তিনেকের একটা মেয়ে।

সেই থেকেই একসাথে। প্রায় পুরো ট্যুরটা। খাজুরাহোতে গিয়েও তাদের সঙ্গে একই হোটেলে যে শুধু উঠলো তাই নয়। সারাটাক্ষণ এটুলীর মতো সেঁটে রইলো।

‘চলুন একসাথে মন্দির কমপ্লেক্সগুলো দেখে আসি'

‘একসাথেই খাবার নিয়ে নিই, বুঝলেন। আপনারা দুজন, বড়মেয়ে আর আমরা দুজন। এই পাঁচ ভাগে টাকাটা ভাগ হয়ে যাবে। আরে সস্তায় হয়ে যাবে মশাই'

এইই সমানে চললো। সুতপার এইসব একেবারেই ভালো লাগছিলো না। বেড়াতে এসে অচেনা লোকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, হে হে করা, তার দু’চোখের বিষ। কিন্ত যতই বলো, বেড়াতে এসে সন্ধ্যেবেলার গেলাসের একটা সঙ্গী পাওয়া আর টাকা ভাগ হয়ে যাবার সুখ- সে কি আর অমল ছাড়তে পারে!

সুতপার ইচ্ছে ছিল খাজুরাহোতেই দিন পাঁচ ছয় থাকে। কিন্ত চতুর্থ দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে হোটেলের জানলার পর্দা সরাতেই সে দেখতে পেল, অমল ওই রবীন সরকারের সঙ্গে বাগানে গভীর আলোচনায় মগ্ন। একটু বাদেই ঘরে ঢুকে জ্যাকপট জেতার মতো মুখ করে অমল তাকে জানালো-' দারুণ একটা সুযোগ পাওয়া গেছে, বুঝলে'

‘কী সুযোগ'?

‘বাঘ দেখতে যাবে? জ্যান্ত বাঘ?’

‘মানে?’

‘মানে হচ্ছে, বান্ধবগড়ে যাবে? রবীনরাও যাবে বলছে। মানে প্রপোজালটা ওরই। একটা টাটা সাফারির সঙ্গে ও কথাও বলে নিয়েছে। আর দেখ, টাকাটাও দুভাগ হয়ে যাবে। সস্তায় বেড়িয়ে আসা যাবে।। কী বলো?’

‘সব ব্যবস্থা যখন করেই এসেছো, তখন আমি কী 'বলি' সেটা কী আর ম্যাটার করে?’- গলায় অসীম বিরক্তি নিয়ে বলে সুতপা।

‘আহা, রাগ কোরো না। তাছাড়া দেখ ওদের মেয়ে মনা, ডাম্পুর সঙ্গে কেমন খেলা করে। তুমিও তো ওর মিসেসের সাথে কথাবার্তা বল দেখি'

অমলের কথার আর কোনও উত্তর না দিয়ে সুতপা রেডি হতে শুরু করে। বেড়াতে এসে আর তর্ক বিতর্ক করতে ইচ্ছে করে না।

এই বেড়ানোটা একরকম আনপ্ল্যানড্ই তো হচ্ছে। তাই চলুক। আর সুতপা তো কখনও জঙ্গলে যায়নি। সে অভিজ্ঞতাটাও না হয় হয়ে যাক।

কিন্ত সুতপা রেডি হলেই তো হলো না, অন্য পার্টিকেও তো রেডি হতে হবে। এই বেরোচ্ছি, এই বেরোচ্ছি করে রবীন সরকাররা বেলা গড়িয়ে দিল। সাতনা পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বিকেল। সেই ব্রেকফাস্টের পর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।

সাতনা স্টেশনের পাশ দিয়েই ঘুরে বান্ধবগড়ের দিকে যেতে হবে। তাই স্টেশনের পাশের রেস্টুরেন্টেই খেয়ে নেওয়া গেল। আর খাওয়া দাওয়া সেরে বাইরে আসতেই রবীন সরকার বোমাটা ফাটালো।

স্টেশনের বাইরের বড় ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, 'এই তো আর আধঘন্টার মধ্যেই জব্বলপুরে যাবার ট্রেন'।

‘চলো, উঠে পড়ি। রাতের খাওয়া শ্বশুরবাড়িতেই হোক'

এই বলে বউয়ের দিকে তাকিয়ে এক চোখ মেরে, দুলে দুলে হাসতে থাকে রবীন সরকার।

হতভম্ব কনফিউসড অমলের মুখ থেকে একটা শব্দই বেরোয়- 'মানে?!’

‘এই যে আমার গিন্নী, তার বাপের বাড়ি তো জব্বলপুরে। এখন জব্বলপুরের ট্রেন প্রায় এসে গেছে, আর এখন তাকে যদি বাপের বাড়িতে না নিয়ে যাই তবে তো আমার গর্দান যাবে'- একটা চোখ টিপে হ্যা হ্যা করে হাসতে থাকে সে।

‘কুলি, এই কুলি ইধার আও', বলেই গাড়ি থেকে ধপাধপ নিজেদের মালগুলো নামিয়ে ফেলে বৌ মেয়ে নিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা দিল। যাবার আগে অবশ্য বলেছিল, 'এই পর্যন্ত টাকা কত হতে পারে! তার আদ্দেকটা না হয় আমিই…'

'থাক। লাগবে না', বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল অমল।

‘আচ্ছা, চলি', বলে আরও একবার হ্যা হ্যা করে হেসে স্টেশনে ঢুকে গিয়েছিল রবীন সরকার।

‘হলো তো সস্তায় বেড়ানো? গলায় যতটা সম্ভব শ্লেষ ঢেলে বলেছিল সুতপা।

'না, মানে কী করে বুঝবো বলো? লোকটা এমন ধড়িবাজ…’

‘চুপ করো তো। সব সময়…’

‘এখন না বেরোলে পৌঁছাতে অনেক দেরী হয়ে যাবে, স্যর। রাস্তার কনডিশন ভালো না। তার উপর জঙ্গলের পথ, তাছাড়াও খতারনক জন্ত জানোয়ার…’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখনই রওনা হবো'-

ড্রাইভারের কথা শেষ না হতেই, স্বামী স্ত্রী একবাক্যে বলে ওঠে। আর শুধু মুখেই বলে না, তাড়াতাড়ি করে রওনাও হয়ে পড়ে সাতনা থেকে।

ড্রাইভার ভুল কিছু বলেনি। খুবই খারাপ রাস্তা। গাড়ি তেমন স্পীড নিতে পারছে না। তবু এবড়ো খেবড়ো পথে, তারই ঝাঁকুনিতে বমি হয়ে যাবার যোগাড়।

শীতের বেলা। দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে আসছে। চিন্তায় ভাবনায় অমল আর সুতপার মাথা খারাপ হবার অবস্থা। রাস্তার দু’পাশে মানুষ জন, বাড়িঘর কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধুই গাছপালা। ড্রাইভারকে জিগ্যেস করে জানা গেল, জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। সুতপার মুখ ভয়ে আরও শুকিয়ে যেতে লাগলো। তারই মধ্যে রাস্তার একপাশে একটা বাঁদরদের ফ্যামিলি দেখে দুই মেয়ে আনন্দে আটখানা।

ক্রমশ অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠলো। হেডলাইটের আলোর বাইরে কিছু দেখাই যাচ্ছে না। কাঁপা গলায় আর কত দূর, সুতপার এই প্রশ্নের উত্তরে, ড্রাইভারের ‘লগভগ আ হী গয়ী।' যখন সুতপার মনের ফুলঝুরিটা সবে ফাটতে যাবে, তখনই গাড়িটা বড় বড় কয়েকটা হেঁচকি তুলে একেবারে চুপ হয়ে গেল।

‘কী হলো ভাই?’, স্বামী স্ত্রীর যৌথ চিৎকার।

‘তেল নেই, স্যর। তাছাড়া অনেকক্ষণ ধরেই ট্রাবল দিচ্ছিল…মেকানিক দেখাতে হবে'

‘তো দেখাও। আমরা গাড়িতেই বসছি', সুতপা ভয়টা চেপে রেখে তাড়াতাড়ি বলে।

‘না ম্যাডাম, কাল সকালের আগে মেকানিক পাওয়া যাবে না'

‘তাহলে এখন কী করবো?’ প্রায় কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল অমল।

‘ওই একটু দূরে দেখুন আলো দেখা যাচ্ছে। ওটাই ট্যুরিস্ট লজ। ওখানে গেলেই জায়গা পেয়ে যাবেন। আমি দেখছি, কাউকে পাই যদি। ধাক্কা দিতে দিতে গাড়িটাকে ওখানে নিয়ে যেতে পারি 'নিশ্চিন্ত গলায় বলে সে।

'কিন্ত এত মালপত্র, বাচ্চা, ম্যাডাম ও রয়েছে। কীভাবে অত দূর…'

'পয়দল চলা যাইয়ে। নজদিক হী হৈ। সঙ্গে টর্চ আছে তো?’’

'নাহাহা' অমলের গলা প্রায় কেঁপে ওঠে।

'ঠিক আছে। কোনও অসুবিধা নেই। চলে যান। শুধু একটু হুঁশিয়ার থাকবেন। অনেক সময় রাতে জানোয়ার চলে আসে। জঙ্গল এরিয়া তো।

‘মালগুলো এখানেই থাক, কী বলো?’, সুতপার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে অমল।

‘না।’ দাঁতে দাঁত চেপে বলে সুতপা। ‘সস্তায় বেড়ানো হচ্ছে!! এবার মালপত্র চুরি গেলে এক কাপড়ে থাকতে হবে’

‘কিন্তু এত মাল। দুজন বাচ্চা…’

‘একদম নাকে কাঁদবে না। তুমিই এর জন্য দায়ী। ন্যাএএকা…। চুপচাপ মালগুলো নাও। আমি বুবলী, ডাম্পুকে দেখছি।’

আর কথা না বাড়িয়ে, মাল টানতে টানতে মোবাইলের ছায়া ছায়া আলোয় গল্পের গোপাল ভাঁড়ের মতন, দূরের ট্যুরিস্টলজের আলোর আশায় বুক বেঁধে, চলতে শুরু করে অমল।

আর তার পেছনে বুবলীর হাত ধরে আর ডাম্পুকে কোলে নিয়ে সুতপা।

হে ভগবান! কী কুক্ষণে যে ঐ ধড়িবাজ লোকটার সাথে দেখা হয়েছিল, আর ওর পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিল! অনুতাপে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।

আর কোনওদিন কারও অযাচিত বন্ধুত্ব যদি স্বীকার করেছে। এই সে নাক কান মুলছে। সব শালা স্বার্থপর খচ্চর।

নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করে, ক্লান্তিতে ভারী হয়ে আসা শরীর আর ভারী ভারী মালপত্রগুলোকে টানতে টানতে, ভয়ে ভাবনায় দিশেহারা অমল নিকষ অন্ধকারের মধ্যে প্রায় হাতড়ে হাতড়ে চলতে থাকে।

ঐ যে, ট্যুরিস্ট লজের আলোগুলো আরও কাছে এসেছে মনে হচ্ছে না? বাড়িঘরের আভাস ও যেন পাওয়া যাচ্ছে। যাক্ বাবা, এ যাত্রা বোধহয় রক্ষে হলো।

হঠাৎই একটু দূরে বাঁদিক থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ কানে এল। নিমেষে অমলকে যেন কেউ মাটির সঙ্গে গেঁথে দিলো। এক পা ও নড়ার ক্ষমতা নেই। সুতপাও ন যযৌ ন তস্থৌ।

আর ঠিক তখনই তাদের খুব কাছেই জ্বলে উঠলো একজোড়া নীলচে চোখ । ‘বাবা, বাঘ' বলে বুবলী চিৎকার করে কেঁদে উঠতেই মায়ের কোলে কাঁচা ঘুম ভেঙে ডাম্পুও চিৎকার জুড়ে দিল। আতঙ্কে অমলের হৃদপিণ্ড যেন বুকের খাঁচা থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

‘ওওওটা কী গো?’, সুতপার কাঁপা কাঁপা স্বর অমলের ভয়কে যেন চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে গেল। সুটকেসগুলোকে ধপ্ করে মাটিতে ফেলে দিয়ে সে চট্ করে বুবলীকে কোলে তুলে নিলো। সুটকেস বাঘে খাক্, চোরে নিক- তার আর কিচ্ছু যায় আসে না। সে বুবলীকে নিয়ে আর সুতপা ডাম্পুকে নিয়ে দৌড় লাগাবে। তারপর যা থাকে কপালে।

এবার ডানদিকে শব্দ। শক্ খাবার মতো ঝটকা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখে, একটা সাইকেল আর তার উপর একটা লোক।

‘রুকিয়ে ভাইসাব, রুকিয়ে’, কঁকিয়ে কঁকিয়ে পাশ থেকে বলে উঠলো সুতপা।

লোকটা সাইকেল থেকে এক পা মাটিতে নামিয়ে, ড্রাইভারের মতনই হিন্দিতে বলে উঠলো, ‘এ কী! সাতটা বেজে গেছে, এ অবস্থায় লেডিস, বাচ্চা নিয়ে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

‘ট্যুরিস্ট লজে। গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে।’ নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে অমল।

‘ওই যে বাঘ’, কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে বুবলী।

‘না, বেটি। ওটা শেয়াল টেয়াল কিছু হবে। তবে বাঘ যে আসবে না এমন কথা বলা যায় না। আমরা তাই আলো থাকতে থাকতেই বাড়িতে ঢুকে পড়ি। আজ আমার একটু দেরি হয়ে গেছে। চলুন আপনাদের ট্যুরিস্ট লজে দিয়ে আসি। আমার কাছে টর্চ আছে।’



ট্যুরিস্ট লজে পৌঁছে অবশ্য লাভ কিছুই হলো না। সব রুম ফুল। দু’দিনের আগে নো ঘর।

‘এখন তাহলে আমি কী করবো!’ ক্লান্ত হতাশ শরীরটাকে বাগানের একটা আধভাঙা চেয়ারে ছেড়ে দিয়ে যেন স্বয়ং ঈশ্বরকেই প্রশ্ন করে অমল। একটা সর্বহারার হাহাকার তার গলা ভেদ করে বেরিয়ে আসে।

সাইকেল আরোহী লোকটি, এইমাত্র ট্যুরিস্টলজের এক বেয়ারার ডাক থেকে অমল জানতে পেরেছে যার নাম ‘শিউজী’, মাথা চুলকোতে চুলকোতে তার সামনে এসে চিন্তিত স্বরে বলে, ‘কুছ তো করনা পড়েগা’। যেন সব দায় তারই। তারপর ভেবে চিন্তে বলে, ‘ফরেস্ট লজটা অবশ্য আছে। চলুন দেখি, ওটা যদি ফাঁকা থাকে। এই রাত্তিরে বিপদে পড়েছেন। ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে।’

আবার হাঁটা শুরু ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে। ভরসা শুধু শিউজীর টর্চের একটু মিটমিটে আলো।

ফরেস্ট বাংলোয় গিয়ে জানা গেল, ঘর আছে বটে, কিন্ত অফিসারের পারমিশন ছাড়া পাওয়া যাবে না। আর অফিসার বাড়ি চলে গেছেন।

অনেক ছুটোছুটি করে শিউজীই অফিসারের বাড়ির ফোন নাম্বার যোগাড় করে, বেয়ারাকে দিয়ে অফিস ঘর খুলিয়ে, ফোনের তালা খুলে, ডায়াল করে অমলের হাতে ধরিয়ে দিল।

অফিসার তো প্রথমে ঘর দিতেই চান না। অমলের শত কাকুতি মিনতিতেও কাজ হলো না। সেই শিউজীকেই অফিসারকে রাজি করাতে হলো। তালা খুলিয়ে, অমলদের ঘরে ঢুকিয়ে, বেয়ারাকে অন্তত ক'খানা রুটি সবজি বানাতে বলে তবে শিউজী বাড়ি গেলেন। যাবার আগে তাদের বারবার সতর্ক করে গেলেন যে, কোনোরকম আওয়াজ পেলেও তারা যেন দরজা না খোলে।

সুতপার ইচ্ছে করছিলো শিউজীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে। এমন মানুষও আছে পৃথিবীতে! এমন অযাচিত উপকার! এত সাহায্য প্রায় বিনা আলাপে! প্রিয় বন্ধুর মতো ব্যবহার! শ্রদ্ধায় সুতপার মাথাটা নীচু হয়ে আসে। ‘কী মানুষ না!’ অমলের কথার উত্তরে সুতপার চোখ জলে ভরে যায়। অন্যমনস্ক হাতে বাচ্চাদের সারাদিনের নোংরা জামা ছাড়িয়ে, রাতের পোশাক পরাতে থাকে।

শিউজী যাবার কিছুক্ষণ পরে গরম গরম রুটি আর অমৃত মনে হওয়া আলুর তরকারিও এসে গেল।

ঘরে একটাই বেড। খাওয়া মিটিয়ে তাতেই কৃতার্থ হয়ে চাপাচাপি করে তারা চারজন শুয়ে পড়ল। একঘুমেই রাত কাবার।


সকালে অমলের ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখে, ভোরের নরম আলোয় চারদিক কী মায়াময় হয়ে উঠেছে। যেন প্যাস্টেল রঙে আঁকা ছবি!

কোথাও আগের রাতের ভয়ের আতঙ্কের চিহ্ন মাত্র নেই। সব যেন এক জাদু শক্তি বদলে দিয়েছে!

ফরেস্ট বাংলোর বাগানে কয়েকটা ময়ূর স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত সবুজ! কত পাখির ডাক! কখন সুতপা আর বুবলীও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, অমল বুঝতেই পারেনি। তার ঘোর ভাঙলো বুবলীর গলার আওয়াজে।

‘বাবা, দেখ, কত ময়ূর! কত পাখি! ও বাবা, আমরা জঙ্গলে যাব না বাঘ দেখতে?’

‘যাবে তো বিটিয়া। এখনই যাবে।’

স্নান সেরে এরমধ্যেই ধোপদুরস্ত প্যান্টশার্ট পরে নিয়েছে তাদের ড্রাইভার।

‘গাড়ির কী খবর?’

‘একদম ফার্স্টক্লাস, স্যর। গাড়ি একদম রেডি। এখন শুধু গেটের কাছে গিয়ে, জঙ্গলের পারমিট করিয়ে নিলেই হলো। আপনারা রেডি হয়ে নিন। আমি গাড়ির কাছে আছি।’

‘ঠিক’, বলে পেছন ফিরতেই অমল দেখে এক উর্দি পরা বেয়ারা দাঁড়িয়ে আছে।

মুখে বিগলিত হাসি।

‘আসুন স্যর, ব্রেকফাস্ট ও রেডি। আপনি শিউজীর দোস্ত। ভালো করে খাতিরদারী করতে হবে।’

‘হ্যাঁ, খাওয়াটা সেরে নিই। তারপর মালপত্র নিয়ে একেবারে বেরিয়ে যাব। জঙ্গলটা ঘুরে নিয়ে সোজা সাতনা। বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছতে হবে। কী বলো?’

সুতপার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে অমল। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় সুতপা। তারপর ঘরের ভেতরে চলে যায় ডাম্পুকে ঘুম থেকে তুলতে।

সকাল সকাল রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। দেখা যাক্, যদি সস্তায় বাঘের দর্শন মেলে!

0 comments: