ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিকবাহরিনের হেঁশেল
নব্বইয়ের গোড়াতেই কিছু ঘটনা ঘটলো। তার মধ্যে আমাদের পুত্রের জন্ম নিশ্চয়ই একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কিন্তু অন্যত্রও এলো কিছু পরিবর্তন। খবরেরর কাগজে একদিন চোখে পড়ল একটি বিজ্ঞাপন। বাহরিনের একটি মুদ্রণ সংস্থা তাদের সেলস এবং মার্কেটিং টিমের জন্য লোক খুঁজছে। তেমন কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার, ইন্টেরভিউতে ডাকও এসে গেলো। বম্বেতে (তখনও মুম্বাই হয়নি) টিসিএস-এর অফিসে হওয়া সেই সাক্ষাৎকারের পরই জেনে গিয়েছিলাম আমার ডাক আসছে।
দিল্লি থেকে গালফ এয়ারের বিমানে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে সেদিন যখন বাহরিনের মানামা ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্টে নামলাম, দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। বাতাসে হিমেল ভাব। ইমিগ্রেশান, কাস্টমসের পাট চুকিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে যখন পা রাখলাম ওরিয়েন্টাল প্রেসের এইচ আর ম্যানেজার অনিল কুমার ততক্ষণে একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। অতঃপর অনিলের গাড়িতে চড়ে পৌঁছলাম আমার আগামী ছ’মাসের বাসস্থানে। সেই দু'কামরার ফ্ল্যাটে পদার্পণ করে জানতে পারলাম আমার সঙ্গে সেখানে সেই মুহূর্তে আছে নীরজ সেহগাল, আমার রুমমেট, দিল্লির ছেলে। চৌখশ। বয়সে আমার চেয়ে বেশ ছোট। আর তখনও জানি না, আরও এক মাস পরে খালি ঘরটিতে আসবে প্রভিন। প্রভিন সুভারনা। সূত্রপাত হবে এক নতুন বন্ধুত্বের। সে আলাদা কাহিনি। কিন্তু সেদিন সেই দুপুর-বিকেলে ওখানে পৌঁছে যে অভিজ্ঞতা হলো, তা মনে রয়ে গেছে আজও।
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটটি দেখলাম একদল পাকিস্তানি ছেলের ডেরা। আমি নতুন সেখানে হাজির হয়েছি শুনে তাদেরই একজন, নাম মনজুর, আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। ওরা তখন খেতে বসেছে। সেই মুহূর্ত পর্যন্ত জানি না আমি ওদের সঙ্গে একই থালা থেকে খাবার ভাগ করে খেতে চলেছি। সালটা ১৯৯৫। দ্বিতীয় পোখরান বা কারগিল যুদ্ধ তখনও না ঘটলেও ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক আজকের মতো সেদিনও মধুর ছিল না। কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষের উদরপূর্তি এমন এক ব্যাপার, রাজনৈতিক বা অন্যান্য ব্যাবধান সেখানে মুছে যায়। আর এই যে একই থালা থেকে খাওয়ার সংস্কৃতি, এর শিকড় এত গভীরে আর এমন অদৃশ্য যোগাযোগ স্থাপন হয় এতে, সেদিনের আগে জানতাম না আর সেইদিনই প্রথম খেলাম ‘কাবুশ’ – যার সঙ্গে আমাদের ‘নান’এর খুব মিল। উপকরণ নিয়ে পরে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখেছি, নান-এর মধ্যে ডিম আর দইয়ের ব্যবহার আর কাবুশ-এ অলিভ অয়েলের অনিবার্য উপস্থিতি। এর পরের ছ’মাসের প্রবাসে নান-সদৃশ এই খাদ্যবস্তুটির শরণাপন্ন হতে হয়েছে বারবার।
ওদেশে পদার্পণ করার আগে সে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না আমার। পরে জানতে পেরেছিলাম আরব ভূখণ্ডের ছোট্ট এই দেশটির সঙ্গে প্রাচীন দিলমুন সভ্যতার নিবিড় যোগাযোগের কথা। জেনেছিলাম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে বাহরিনের স্বাধীনতার দিন আমাদের মাত্র একদিন আগে। ১৪ আগস্ট। ওইসময় এই তথ্য আবিষ্কার করে অবাক হয়েছিলাম যে বাহরিনি জনসংখ্যার প্রায় আশিভাগ বহিরাগত। ভারতীয় উপমহাদেশের। ফলত সেই দেশের সামগ্রিক সংস্কৃতি, বিশেষত খাদ্য সংস্কৃতিতে যে জোরালো ‘বিদেশী’ প্রভাব থাকবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার খুব অবকাশ আছে কি?
দক্ষিণ ভারত, বিশেষত, কেরালা থেকে মালয়ালি জনজাতির ভাগ্যান্বেষী মানুষ পেটের তাগিদে পাড়ি দেওয়া শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি বা বাহরিনের মতো দেশগুলিতে। অনেক সময় এই সংখ্যাটা ছাপিয়ে যাচ্ছিল স্থানীয় জনসংখ্যাকেও। এর অনিবার্য প্রভাব পড়ল দেশগুলির খাদ্য-সংস্কৃতিতেও। তাই যখন আমি আচমকা এই সুযোগ পেয়ে আমার প্রথম কর্মপ্রবাস বাহরিনে হাজির হলাম, দেখলাম ওদেশের শুধু খাদ্য-সংস্কৃতি নয়, সামগ্রিক জীবনযাত্রাতেও ‘বিদেশী’ প্রভাব।
আমি যখন ওখানে পৌঁছই, তখন রমজান (অথবা রমাদান) চলছে। তাই দিনের বেলা সব দোকান বন্ধ থাকতো। কিন্তু আমাদের মতো ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে থাকা মানুষদের তাহলে কি হবে? মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি তিনঘণ্টার। দুপুর বারোটা থেকে তিনটে। সময়টা কম নয়। খাওয়া ছাড়াও এই সময়ের মধ্যে একটা ছোটোখাটো ঘুমও হয়ে যায় খুব ভালোভাবে। কিন্তু ঘুম তো পরে। আগে তো খাওয়া। তাই খাওয়ার জন্য আধখোলা যে রেস্তরাঁয় পৌঁছলাম, তার মালিক একজন গুজুভাই। গুজরাটি হেঁশেল যদিও ব্যাপক এবং বিস্তৃত, এবং প্রতিটি অঞ্চলের একটি নিজস্বতা আছে, কিন্তু কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য সব অঞ্চলগুলিকে এক করে দেয়। তিন ধরণের স্বাদের প্রভাব সহজেই টের পাওয়া যায়। মিষ্টি, নোনতা এবং ঝালজাতীয়। অনেক পরে যখন একটি গুজরাটি সংস্থার সঙ্গে কর্মসূত্রে যুক্ত হলাম, তখনও লক্ষ করেছিলাম এই বিষয়টি। যাইহোক, সেই গুজরাটি রেস্তরাঁয় খেতে গিয়ে যা পেলাম, তা হচ্ছে একটি টিপিক্যাল থালি, যার মধ্যে রয়েছে ডাল, ঘি-মাখানো দুটো (ফুলকা) ছোট রুটি, অল্প একটু ভাত, দুটো সবজি, যার মধ্যে বেশির ভাগ দিনই থাকতো মসালা ভিন্ডি, একটা ফাফরা (বেসন থেকে তৈরি একধরণের মুচমুচে নোনতা), কয়েক ধরণের চাটনি, কাড়ি (দই আর বেসন দিয়ে টকমিষ্টি গুজরাটি পদ) আর অবশ্যই মিষ্টি কিছু। এইভাবে চলল মাসখানেক। এর মধ্যে স্বাদবদল করার জন্য মালয়ালি খানাও চেখে দেখে নিয়েছি বেশ কয়েকবার, যার মধ্যে সত্যি কথা বলতে কি তেমন কোনও বৈচিত্র্য খুঁজে পাইনি সেইসময়। ঠিক এইরকম একটা সময়ে আবির্ভাব (হ্যাঁ, প্রায় তাইই) ঘটলো প্রভিনের। আমারই সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করলো পাশের ঘরে। অফিসেও পাশাপাশি বসতাম আমরা দুজন। একদিন আমরা দুজন মানামাতেই আবিষ্কার করলাম এক বিশুদ্ধ বাঙালি খ্যাঁটন ক্ষেত্র। এতদিন পরে আর নামটা মনে নেই, কিন্তু হাওড়ার এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক সেটা যে চালাতেন, তা স্পষ্ট মনে করতে পারি। তা সেইখানে শুরু হলো প্রতিদিন অন্তত একবার খাওয়া। প্রভিনের জন্ম, বেড়ে যদিও সবই মুম্বাইতে, প্রভিন আদতে ম্যাঙ্গালোরের ছেলে। মাছ খেতে ওস্তাদ। তাই এখানে একটা অদৃশ্য যোগসূত্র স্থাপন হলো। অতঃপর শুরু হলো আলুপোস্ত, বিউলির ডাল, সরষে মাছ সহযোগে দুপুর বা রাত্রে খাওয়া। দেখতে দেখতে প্রভিনও কেমন বাঙালি রান্নার সঙ্গে নিজেকে চমৎকারভাবে মানিয়ে নিলো। এক একবার আমরা চলে যেতাম কোনও পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে কাবাব খাওয়ার জন্য। কিন্তু এইসবের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের হেঁশেলের সম্পর্ক কি? এ তো বড়জোর প্রবাস যাপনকালে নিজেদের শিকড়ের সন্ধান। পৃথিবীর এই অঞ্চলটির সুখাদ্য সর্বত্র জনপ্রিয়। সব দেশেই লেবানিজ বা ইজিপ্সিয়ান রেস্তরাঁর সামনে লম্বা লাইন দেখা যায়। তাহলে কাকে বলবো খাঁটি মধ্যপ্রাচ্যীয় খাবার? কি তার বিশেষত্ব? এ প্রসঙ্গে একটা ব্যাপার হয়তো এখানে উল্লেখ করা যায়। মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের অনেক দেশেই রয়েছে ভেড়া বা মুরগির মাংস খাওয়ার চল। গরুর মাংস প্রায় বিরল। আমাদের অনেকের চিন্তাই এখানে হোঁচট খেতে পারে, কিন্তু সেটাই সত্যি। বিশ্বায়নের দৌলতে নানা প্রান্তের রান্না এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। সেই সুবাদে হুমুস, ফালাফেল বা মানাকিশ-এর স্বাদ এখন আমাদের কাছে পরিচিত। কিন্তু উম আলি? মিশরীয় এই ব্রেড পুডিংটি আমার বিচরণ ক্ষেত্রে এখনও প্রত্যক্ষ করিনি। রুটির টুকরো, দুধ, চিনি, বাদাম, কিসমিস, আখরোট আর নারকেল কুচির এই মিশ্রণটি বেক হয়ে আভেন থেকে একটু পুড়ে যাওয়া, এক অপরূপ চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক জনশ্রুতিও। আর যে পদটির কথা না বললে আমাদের হেঁশেলে এই অঞ্চলের সরাসরি প্রভাব ঠিক বোঝা যাবে না, তা হলো দোলমা। এই বস্তুটির জন্মস্থান নিয়ে অনেক দাবী, পাল্টা দাবী থাকলেও এর রেসিপি নিয়ে তেমন সংশয় নেই। বিভিন্ন ধরণের সব্জির পেটের মধ্যে একটা পুর ভরে দেওয়া। এই হলো মোদ্দা ব্যাপার! মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে সাধারণত রোদে সামান্য সেঁকে নেওয়া আঙুর পাতায় মুড়ে দেওয়া হয় রকমারি মাংস, এমনকি ভাতও। আমরা বাঙালিরা এর একটু অদল-বদল ঘটিয়ে সৃষ্টি করলাম এক অনবদ্য পদ – পটলের দোলমা। এক হেঁশেলর সঙ্গে আরেক হেঁশেল এইভাবে মিশে গেলো।
0 comments: