0

বিশেষ ক্রোড়পত্র - আন্তর্জাতিক নারী দিবস

Posted in

আমরা জানি যে বহু আন্দোলন ও আলোচনার পরে ১৯১৩ সাল থেকে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। ভারতে দেখা গেছে যে উদারিকরণ নীতির সঙ্গে সঙ্গেই আন্তর্জাতিক নারী দিবসেরও বাজারিকরণ ঘটেছে । আন্তর্জাতিক নারী দিবস যেন ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ তে পরিণত হয়েছে। এই ঐতিহাসিক সংগ্রামী দিনটি এখন শাড়ি, গয়না, বিউটি ট্রিটমেন্ট, চকোলেট ইত্যাদি বিক্রির সুবর্ণ সুযোগ হয়ে উঠেছে ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, UK এবং অস্ট্রেলিয়ায় মার্চ মাসে ‘নারীদের ইতিহাসের মাস’ উদযাপন করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে রাশিয়ায় কিছু স্বেচ্ছাসেবীরা মার্চ মাসে ইন্টারনেটে নারীদের ইতিহাসের মাস পালন করছেন। ক্যানাডায় নারীদের ইতিহাসের মাস অক্টোবর মাসে পালন করা হয়।

নারী আন্দোলন ও নারীদের জীবনকে কেন্দ্র করেই নারীদের জীবনের নানান গঠনমূলক কাজ ও চিন্তার ক্ষেত্র নিয়ে ঋতবাকের এই ক্রোড়পত্র । ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি দমন, পীড়ন ও রক্ষণশীলতা। ভারতীয় সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে নারীদের ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের অধিকারকে অস্বীকার করার উদাহরণ আমরা পাই প্রতিদিন । খুবই হতাশ লাগে যখন আমরা দেখি যে দেশের উচ্চ ন্যায়ালয়গুলিও নারীর অধিকারকে অস্বীকার করে।

দুঃখ আর হতাশার বহু নিদর্শন তো আছেই। কিন্তু নারীদের ক্ষমতায়ণের বিভিন্ন প্রচেষ্টা স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, গ্রাম-বস্তি, ঘরে-বাইরে চলছে। আফ্রিকান-আমেরিকান কবি মায়া অ্যাঞ্জেলু লিখেছেন ‘আমি আবার জেগে উঠি’। এমনই জেগে ওঠার কিছু কথা এই সংখ্যায় রয়েছে।

- অঞ্চিতা ঘটক


সূচীপত্র

১. মেয়েদের লেখাপড়া - চিত্রিতা বন্দোপাধ্যায়
২. The Indigenous Woman's Question in Education - Rahi Soren
৩. নাচ : শরীর ও মনের সংযোগ - সোহিনী চক্রবর্তী
৪. কোভিড ১৯ পরবর্তী সময় ও প্রতিবন্ধী মেয়েদের ক্ষমতায়ণ - কুহু দাস
৫. সব কিছুই কী কাল্পনিক? - অঙ্কন বিশ্বাস
৬. নারী যৌনকর্মী ও স্বাধিকার - পারমিতা চৌধুরী
৭. নার্সিং : একাল ও সেকাল – স্নেহা স্যানাল
৮. Discovering the Power of Cooking - Pritha Sen
=====================================


ইস্কুলের গল্প

চিত্রিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখক পরিচিতি : চিত্রিতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারী স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক এবং নারী অধিকার রক্ষার আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক।

পড়াতে গিয়েছিলাম গ্রামে। মেয়েদের স্কুল। সব স্থানীয় চাষী আর ইঁটভাটার মজুরদের মেয়ে। বাবা - মায়েদের খুব ইচ্ছে মেয়েরা পড়ুক। রেজাল্ট বেরনোর দিন স্কুলের সামনে সারা গ্রাম উঠে আসত।

সোনামণি আর ওর দিদি রুম্পা খাতুনকে মনে আছে। বাবা নেই, মা কলকাতায় কাজে যেতেন ভোরবেলা, শনিবার বাদে। তাই শনিবার শনিবার এসে খোঁজ নিতেন কেমন লেখাপড়া করছে মেয়েরা। নিজে পড়তে জানতেন না তাই পরীক্ষার খাতা দেখানোর সময় পাশের বাড়ির কলেজ পড়ুয়া এক মেয়েকে নিয়ে আসতেন। ওরা দুইবোনই স্নাতক হবার পর ফোন করে জানিয়েছিলেন। দিনকতক আগে সোনামণিরা ফেসবুকে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠালো। খুশি হয়ে লিখলাম, ছাত্রীরা যখন বন্ধু হয় সে বড় সুখের সময়। জানলাম একজন আইসিডিএসে চাকরি করছে আরেকজন একটা ইস্কুলের কম্পিউটার শিক্ষিকা।

তখনও মিড ডে মিল চালু হয়নি। প্রায়ই প্রথম পিরিয়ডের শেষে বেশ কিছু মেয়ে কাতর হয়ে পড়ত পেটব্যথা কি মাথাঘোরায়। ঐটুকু মেয়েদের মাথা ঘোরে কেন ? জানা গেল, বাড়ি থেকে কিছুই খেয়ে আসে নি, পড়া শুনবে কি! উপনিষদের সেই কথা, ‘জ্ঞান অন্নময়’, আরো একবার বোঝা গেল। বি এড পড়ার সিলেবাসে তো এ সমস্যার পাঠ নেই। এমনসব হাজারো অসুবিধে সাথী করেই গরিবের মেয়েরা পড়তে আসে। স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে, প্রয়োজনে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরি করার স্বপ্ন দেখে। বিষয়টা শুনতে হয়ত খুবই মামুলি, কিন্তু যে পরিবেশে ওদের বেড়ে ওঠা সেখানে এই স্বপ্ন দেখা, তাকে যত্নে লালন করে পরিণতি দেওয়া ওদের এক প্রজন্ম আগেই ছিল অবাস্তব কল্পনাবিলাস। তবে এখনও বড় সহজ নয়। রুকসানার স্বপ্নভঙ্গের গল্পটা বলি তাহলে।

রুকসানা ছিল পড়ুয়া মেয়ে। প্রতিদিন সব পড়া তৈরি করে সবার আগে স্কুলে হাজির, তবু পরীক্ষার দিন ঘোষণা হলেই ওর উদ্বেগ শুরু হত। ক্লাশঘরের বাইরে কি সিড়িঁর মুখে, বারান্দায় বা আমাদের ঘরের সামনে এসে কোন না কোন বিষয়ের বই নিয়ে ওর হাজারো প্রশ্নের উত্তর আদায়ের নিরলস চেষ্টায় আগ্রহী উৎসুক মুখটা মনে পড়ে। তুমুল বৃষ্টি আর সাথে বিদ্যুৎবিভ্রাটে আঁধার ঘনিয়ে আসা ক্লাশঘরে একবার দাবি উঠল আজ আর পড়া নয়, গল্প শোনাতে হবে। সবাই খুশি শুধু ব্যাজার মুখে বই উল্টোতে লাগল রুকসানা। হেসে জিগেস করলাম, ‘কী হল তোমার ?’ গোমড়া মুখে বোধহয় আমাকেও ঈষৎ ধিক্কার দিয়ে বলল, এই পড়া বন্ধ করে গল্পগুজব ওর মোটে পছন্দ নয়।

একবার ওদের কথাচ্ছলে জিগেস করেছিলাম, পড়াশোনা করে কী করতে চাও? রুকসানা বলল, আমি সরকারি অফিসার হতে চাই ম্যাডাম। আমি বললাম, কেন ? বলল, মেয়েরা পড়ালে বা অন্য কোনো চাকরি করলেও ছেলেরা তাদের ওপর জোর খাটাতে পারে কিন্তু সরকারি অফিসার হলে তার দাপটে ছেলেরাও জোর খাটাতে পারবে না। তখন ও সবে ক্লাশ এইট। কেন এমন ধারণা ওর হল তা তখন যুক্তি দিয়ে বলতে পারেনি বটে তবে এই বিশ্বাসটা যে ওর অটল তার প্রত্যয় ওর মুখেচোখে ছিল। জেনেছিলাম ওর মা একটা স্কুলে সহায়িকার কাজ করেন আর বাবা দোকান চালান।

প্রতি পরীক্ষায় প্রথম হত রুকসানা। স্কুলে ভরতি শুরু হলেই দেখা যেত ও নতুন ক্লাশে ভরতির জন্য হাজির। শুধু সেবারে তখন ও ক্লাশ নাইনে উঠল, ভর্তি হতে এল না দুদিন পেরিয়ে যাবার পরেও। আমরা ভাবছি, হলো কী মেয়েটার! এবার একটু খোঁজখবর করতে হয়। এমন সময়ে এলেন ওর প্রতিবেশী আলাউদ্দীন ভাই, তাঁর কাছে জানা গেল বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ওর। আর পড়বে না। ছুটলাম আমরা ওর বাড়ি। ফলে সেবছর পড়ল মেয়েটা। বাড়ির সবার খুব আপত্তি ছিল বটে, শুধু ওর মা চাইছিলেন মেয়ে পড়ুক। বার বার বলছিলেন যে আমি তো সবাইকে বলি মেয়ে স্যায়না হলে, নিজের পায়ে দাঁড়ালে, নিজের বুঝ হলে তবে বে দাও। এখন আমার মেয়ের বিয়ে হলে তো আমার মুখটাই পুড়বে দিদি। আপনারা এসে জোর করলেন বলে মেয়েটা বাঁচল। অবশ্য পরের বছর আর বাড়ির লোক ভুল করেনি, বার্ষিক পরীক্ষাশেষের ছুটিতেই তারা স্যায়না না হওয়া মেয়েই পার করেছিল। ছেলে কিছু করে না বটে তবে তার বাপের দোকান আছে। সে সেখানে বসবে ভবিষ্যতে, আরেকটু স্যায়না হোক - জানালেন ওর বাবা আর ঠাকুমা,মা পাশে দাড়িঁয়ে চোখের জল ফেলছিলেন।

এসব গল্প বেশ পুরনো। তারপর থেকে ক্লাশে ক্লাশে নিয়মিত সচেতনতার চেষ্টা চলে। তবু মাঝে মাঝে বেশ কিছুদিন কেউ না এলে খোঁজ নিলে জানা যায় বিয়ে দিয়ে দিয়েছে পরিবার। তবে এই সংখ্যা কিছু হলেও কমছে। মেয়েরা শুধু পড়ছে না তারা কলকাতার কলেজে পড়তে আসছে। এও এক লং জাম্প বৈকি। ইস্কুলে এসে তারা হাসি মুখে জানিয়ে যায় এ সাফল্যের খবর। মেয়েরা দেখছি দ্রুত ছেলেদের পেছনে ফেলে এগোচ্ছে। স্কুলছুট ছেলেদের হার কখনো কখনো মেয়েদের থেকে বেশি। এরফলে বদল হচ্ছে মেয়েদের চিন্তাতেও।

ঠাঁইনাড়া হয়ে অন্য এক গ্রামে এসে ঠেকেছি। একযুগেরও বেশি হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়ে। একবার হৈ হৈ করে ক্লাস টেনের মেয়েরা সিঁড়িতে দেখেই ঘিরে ধরল। তাদের শান্ত করার পর জানা গেল এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জনৈক মাস্টারমশাই বিষয় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন “মেয়েরা শিক্ষিত হোক কিন্তু তাদের সম্মানের স্থান বাড়ির ভেতরেই”। তো এ’হেন মোশনের পক্ষে কোনো মেয়েতো বলবেই না, এমনকি ছেলেরাও বলবে না। এতে আমাদের সস্মিত সম্মতি দেখে ক্ষুব্ধ মাস্টারমশাই জানতে চাইলেন ছেলেরা বললে ওদের আপত্তি কেন? চমৎকার উত্তর দিয়েছিল ওরা। বলেছিল, তাহলে ওরা ইশকুল থেকে ভুল শিখে যাবে। বাড়িতে তো ওরা এসব কথা শোনেই কিন্তু ইশকুল থেকে শুনে গেলে সে কথার জোর বাড়ে। অগত্যা বিষয় বদলাতেই হল।

মনে আছে, সেবার স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, তো আলোচনা চলেছে কী কী খেলা থাকবে তা নিয়ে। ছেলেদের জন্য বেশিরভাগই শক্তিপ্রদর্শনের খেলা বাছা হল। কিন্তু মেয়েদের বেলা গতানুগতিক খেলা আর বৈচিত্র্য আনার জন্য ভাবা হল কিছু গেরস্থালির কাজ নিপুণভাবে করার খেলা। মেয়েরা বলল, ওরা ছুঁচে সুতো পরাবে না; লংজাম্প দেবে, লোহার বল ছুঁড়বে, উইকেটে বল ছুঁড়বে বা এক শটে গোলে বল ঢোকাবে। এমনকী সেবার থেকে আমাদেরও খেলতে হলো এইসব,আমাদের খেলার আগে দরকারি টিপস্ দিল ওরা। গ্রামের লোকজন আর স্কুলের ছেলেরাও বিপুল উৎসাহে দেখল সে খেলা।

শুনেছিলাম অভিভাবকেরা চান না মেয়েরা গান বা নাচ শিখুক, লেখাপড়া শিখলেই হল। কিন্তু ওরা উৎসাহী, শুধু নাচ শিখল তাই নয়, আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় নাচলও। পরের বছর যখন প্রতিযোগিতার জন্য ওদের তৈরি করা হচ্ছে তখন সেভেন আর এইটের ছেলেরা এল আর্জি নিয়ে। ওরাও নাচ শিখে প্রতিযোগিতায় যেতে চায়। তৈরি হল ওদের নাচের দল। শুধু নাচের প্রতিযোগিতাতেই নয় আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক উৎসবেও ডাক পড়ল ওদের। এই সাফল্যে ভারি খুশি ওরা। বাপমায়েরাও দেখলাম বেশ খুশি।

কত বিষয়ে যে অনায়াস দক্ষতা ছেলেমেয়েদের, শুধু একটু প্রথাগত শিক্ষায় তা শাণিত করে নিলেই হয়। পারভেজ ছিল ভাল ছাত্র। কিন্তু ও যে দারুণ ইলেকট্রিশিয়ান সে কথা জানলাম যখন ওর বাবার সঙ্গে সমান তালে খেটে ও পুরো স্কুলের বিদ্যুত্সংযোগের কাজ অনায়াসে করে ফেলল। তখন ও ক্লাশ সেভেনের ক্ষুদে পড়ুয়া।

রুকবানুরের বাবা ওদের ছেড়ে অন্য সংসার পাতলেন। সে তখন ক্লাশ নাইন। মা দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে গেলেন ভাইদের কাছে। বাবার সঙ্গে আলোচনা ক’রে তার কাছ থকে সংসারখরচের টাকা আদায়, অসুস্থ মাকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা করানো, বাড়িতে নিজেদের জন্য রান্না, ভাইকে পড়া দেখানোর ফাঁকে নিজে পড়ে শুধু ভালো ফলই করত না, তারসঙ্গে অন্য সবেতেও ওর অংশ নেওয়া চাই। ক্লাশ এইটে পড়ে যখন নিজে খেটেখুটে একবার স্কুলের ইতিহাস শুরুর পর্ব থেকে লিখে ছবি সেঁটে এনে দেখালো। যুব সংসদ প্রতিযোগিতায় অংশ নিল, সবাইকে তৈরির দায়িত্ব নিল। তারপর যখন প্রথম হয়ে এল ওর আনন্দ দেখে কে!

একবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে নাটক লিখে ফেলল রুকবানুর। সে নাটক অভিনয়ও হল। তাতে বিপ্লবীরা বেশিরভাগই নারীচরিত্র আর বিশ্বাসঘাতক ও অত্যাচারী পুলিশ হলো ছেলেচরিত্র। একদিন মহড়ার সময়ে কথাকাটাকাটি, হৈচৈ - ছেলেরা ভয়ানক আপত্তি জানাচ্ছে এমন একপেশে চরিত্রায়নের কিন্তু মেয়েরা সব এককাট্টা। তাদের বক্তব্য ইতিহাস বইয়ে বিপ্লবী নারী চরিত্র তারা পেয়েছে, কিন্তু ছেলেরা যদি একজনও বিশ্বাসঘাতক বা অত্যাচারী মেয়েপুলিশের নাম দেখাতে পারে তবে ওরা নাটক বদল করবে নয়ত হবে না। সে যাত্রা একটুও না পাল্টে ঐ নাটকই করতে হলো।

এই চলার পথ অবশ্য মোটেই নির্বিঘ্ণ নয়। সযতন সুরক্ষায় শিক্ষার আঙিনায় কাটবে যে নির্ভার কৈশোর তাকে যেতে হয় পাড়ায় জুটব্যাগের কারখানা বা ভিনরাজ্যের অন্য কলে-কারখানায়। মেয়েদের কাঙ্ক্ষিত বিকাশের জন্য সামাজিক সুরক্ষার আর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কত জরুরি তার প্রমাণ পেয়েছিলাম কামদুনির ঘটনার পর। সেবছর ঐ এলাকার স্কুলগুলোতে মেয়েদের ভর্তির হার কমে গিয়েছিল। আতঙ্কিত মা-বাপ মেয়েদের ইস্কুলে পাঠাতে রাজি হচ্ছিলেন না। বারে বারে স্কুলের দিদিমণিরা (অধুনা, ‘ম্যাডাম’রা) গ্রামে গিয়ে বললে পরে অবশেষে তাঁরা পাঠাতে রাজি হন।

‘সুযোগ’ বড় দরকারি এক ছোট্ট শব্দ, যা পাওয়া আর না পাওয়ায় বদলে যায় জীবন। সামান্য শিক্ষার সুযোগ পেয়ে ছেলেমেয়েরা অন্ধকার পেরিয়ে যায়, দেওয়াল ভাঙে বাধার। ছোট ছোট হাতেপায়ে প্রতিবন্ধকতাগুলো ঠেলে ঠেলে একটু একটু করে ওরা বাড়িয়ে নিচ্ছে নিজেদের চারণভূমি। এই চলায় আমরা বড়জোর ওদের আনন্দিত সহযাত্রী, তবে ওদেরই মনের মাঝে আসল জোরটার রাজত্ব। শুধু অন্যের চাওয়ায় অগণিতের ষাত্রাপথ কবেই বা নিরঙ্কুশ হয়েছে!

----------------------------------------------------

The Indigenous Women’s question in education

Dr. Rahi Soren
Ph.D.
Assistant Professor
School of Oceanographic Studies
Jadavpur University, Kolkata

The journey of the women of Indian Diaspora as carriers of culture and preservers of identity was no easy one because of the circumstances in which they made the journey and the patriarchal nature of Indian society. Such is most evidently in the indigenous community where they have been doubly marginalized for being a Tribal as well as a second class citizen for being a woman. Women in most tribal societies in our nation are perhaps not subjected to exclusion and deprived of basic rights and mobility. However, tribal societies are patriarchal enough to bar the young girl child to access quality education in comparison to their male counterparts. The voice of the silent majority, i.e. woman, has been rarely heard in the historical documents which record the statements of the literate and thoughts of the influential. Indian indentured women have tended to be portrayed as dependents and spouses, reluctant to migrate, and of negligible labour value, or as lone females of dubious virtue. As a result, the position that women had was never recorded in a sympathetic manner. Thus, in a patriarchal culture, even those women who try to break gender barriers to seek the path of education, several hindrances await them. Many lose out in the pursuit in the early phases. Even for those who cross this hurdle successfully, many professions can make them invisible- not rising farenough to step into leadership roles, and not getting recognition.The women’s question, like the untouchability question or the communal question, emerged during the national movement as a political question that had to be solved to give shape to the vision of a free Indian nation (Majumdar, 1985). One can thus estimate the perils of the marginalized community children and the double marginalized indigenous girl child. This aspect of women’s equality or inequality has been skilfully neglected, helping to perpetuate many misconceptions, obscurities and leads to the devaluation of the issue. Thus, in this article it is my intention to focus on the issue of the education of the indigenous girl child.

The demography of illiteracy: Adivasis at margins

One Indian in three is illiterate. Ten million Indian children have never entered school. Among those who have, the dropout rate is alarming. Only 5-6 percent of our school population is enrolled in Classes XI and XII – and the number dips down further for higher education (Sukanta, 2010). Such is the scenario in twenty-first century India; even after two decades of Sarva Shiksha Abhiyan (SSA), as mandated by the 86th amendment to the Constitution of India, making free and compulsory Education for Children of the 6-14 years age group a Fundamental Right. The status of education among the tribal population at the margins goes to a further grim picture.

One of the major constraints of tribal education at the planning level is the adoption of a dual system of administration. The Tribal Welfare Department deals with tribal life and culture and administers development work at the local level, including education. The lack of sensitivity to the problems and failure in understanding tribal social reality, coupled with faulty selection and appointment of teachers in tribal areas, have resulted in poor student academic performance and teacher absenteeism in tribal schools. Literacy rate (LR) is defined as the percentage of literates among the population aged seven years and above. Although literacy levels of Schedule Tribes (ST) have improved, the gap in literacy levels, both for tribal men and women, has not declined significantly. In fact, the gap increased between 1971 to 1991, falling thereafter, to a little above the 1971 level.

Gender Parity Index (GPI) for Scheduled Tribes students: The Gap in Women’s Inclusion

Gender parity Index (GPI) is a parameter indicating the parity of education received in males and females. GPI “1” indicates equal parity. A value less than one indicates a disparity in favour of boys, whereas, a value greater than one indicates a disparity in favour of girls. However, the interpretation is desired to be in the other way around for indicators that ideally approach 0% (e.g. Repetition, dropout, illiteracy rates, etc.). However, this index does not show whether improvement or regression is due to the performance of one of the gender groups (Ministry of Tribal Affair, 2013

The most prominent reason for being unable to reach the goal of SSA is it lacks the vision into the psyche of tribal women or the girl child. It is of great urgency to be understood that social structure in a standard Tribal household is different that a non-tribal one. As I belong to the Santal community, the Santal ethos and worldview is taught at an early age; incorporated within the Santal worldview. The tribal ethos is embedded with traditional knowledge, knowledge of genesis, cultural practices and a strong Santal consciousness. Eminent scholars, anthropologists, historians have been documenting the aspects of linguistics, folk tales, tribal medicine as well as rituals since the colonial period. However, the gap in knowledge lies in interpretation of cues such as traditional songs into the understanding of the social system and ideologies which one may define to be the “codes of culture”. It is particularly possible to try and bridge the gap of knowledge in this light of cultural evolution.

The study to understand the Santal’s way of life is not new. However, it is of utmost importance that the tribal knowledge system be an integral part of formal education. Ethno-biologists and ethno-ecologists suggest that linguistic ecologies and biological ecologies are mutually related through human knowledge, use, and management of the environment and through the languages used to convey this knowledge and practices. Most tribal communities in India do not have the privilege of accessing education in their mother tongue. Language acts as the main repository of tribal knowledge system, and the vehicle of transmission for knowledge, particularly through the mediation of traditional ecological knowledge. As both users and managers of the natural resource base, women have an extensive knowledge of their environment which can then be incorporated within the folds of formal education. The inclusiveness and integration of the knowledge system is the way to look forward into successful incorporation and bridging the gap towards education of the indigenous girl child.

-----------------------------------------------------------

নাচ : শরীর ও মনের সংযোগ

সোহিনী চক্রবর্তী

লেখক পরিচিতি : সোহিনী চক্রবর্তী 'কলকাতা সংবেদ' এর অধ্যাক্ষ এবং প্রতিষ্ঠাতা। উনি ভারতে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ডান্স মুভমেন্ট থেরাপি প্রচার করেন।

ভারতীয় সমাজে রীতিনীতিগুলো মূলত: পুরুষতান্ত্রিক। সুতরাং এই সমাজ নারী ও মেয়েদের দেহকে শুধুমাত্র বস্তু, বিশুদ্ধতার প্রতীক এবং সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম হিসেবে দেখে এবং বিশ্বাস করে। নারী, পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের শরীরকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কখনোই উদ্ভাবনী শক্তি, বা সৃজনশীল মাধ্যম হিসেবে চিন্তা করতে শেখানো হয় না।

সমাজ আমাদেরকে সৌন্দর্যের বাতাবরণে নাচকে দেখতে শিখিয়েছে। সাধারণ ভাবে ‘নাচ’ বা ‘নৃত্য’ শব্দটা শুনলে আমাদের মনে ও চোখের সামনে বিশেষ কিছু ছবি ভেসে ওঠে। যেখানে নাচের অভিব্যক্তি, জীবনীশক্তি বা প্রাণশক্তির চেয়ে তার বহিরঙ্গের সাজ বড় হয়ে ওঠে। আজও এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা শুধু সেই সৌন্দর্যের দিকটারই চর্চা করে যাচ্ছি। নাচকে অন্যভাবে দেখবার চোখ ও মন আমরা তৈরী করতে পারি নি। নাচের শৈল্পিক দিক এবং নান্দনিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা যখনই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন তা বদলানোর দরকার আছে।

নাচ নিয়ে ভিন্ন ধারার বৈপ্লবিক কাজ আমাদের দেশে অনেক হয়েছে তাদের মধ্যে অমলা শংকর, চন্দ্রলেখা, মঞ্জশ্রী চাকী সরকার, রঞ্জাবতী সরকার, মায়া কৃষ্ণা রাও, অনিতা রত্নম, মল্লিকা সারাভাই প্রমুখরা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এদের নাচে আমরা প্রথাগত ছককে বারবার ভাঙতে দেখেছি সমস্ত শৈল্পিক ও নান্দনিকতা বজায় রেখে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হচ্ছে যে সমাজের সর্বস্তরের কাছে / বৃহত্তর ক্ষেত্রে সেই কাজ পৌঁছোচ্ছে কিনা ? নাকি এটি শুধুমাত্র একটি শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। শুনতে খারাপ লাগলেও তা হয়তো শুধু অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেই আবদ্ধ রয়ে গেছে। রঞ্জাবতী সরকার (1993) একবার ভারতীয় নাচ প্রসঙ্গে তার একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে ভারতীয় নাচের প্রশিক্ষণের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতিফলন দেখা যায়।

আমরা কতজন নিজের ইচ্ছেতে নাচি? আর আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাতাবরণে এমন এক চিন্তা ভাবনার অনুশীলনের ফাঁদে বেড়ে উঠি যে নাচ সম্পর্কে একটা 'ট্যাবু' সমাজ সমানেই প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। বহু বছর ধরে নাচ সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে প্রান্তিক হয়ে আছে। আজও দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করা হয় যে 'নাচ' সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যম হতে পারে না। কোনো মেয়ে নাচ করার কথা ভাবলে ছেলেবেলা থেকে একটা উদাহরণ দিতে শুনেছি নেচে কি হবে? বিয়ের পর তো আর নাচা যাবে না। বরং গানটাই শেখ বিয়েতে কাজে লাগবে। আবার উল্টোদিকে ছেলেরা নাচ করলে আমরা খুব সহজ ভাবে কিন্তু 'মেয়েলি' বলে দি। আসলে নাচের সাথে শরীর, ও যৌনতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। নাচের মধ্যে দিয়ে শরীরে মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়, পাওয়া যায় স্বর্গীয় আনন্দ। নাচের মধ্যে দিয়ে শরীর-মনের মেলবন্ধন ঘটে যাতে মন অনেক মুক্ত ভাবে প্রকাশ করতে পারে,ভাবতে পারে। এই আনন্দ পাবার বেলাতেই সমাজের প্রবল আপত্তি। মেয়েদের নাচতে না দেবার কারণের পিছনে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক বিরাট রাজনীতি। (চক্রবর্তী,২০২১ )

আমরা কি জানি যে নাচের মধ্যে দিয়ে মানুষকে সুস্থ করে তোলা যায়? আমরা কি ভাবতে পারি নাচের মধ্যে দিয়ে সমাজ বদলের কথা বলা যায় ? নাচের মধ্যে দিয়ে সামাজিক লিঙ্গ - বৈষম্য দূরীকরণের কাজ করা যায়। আমরা সবাই জানি যে নাচ মানুষের জীবন এবং অভিব্যক্তি প্রকাশের সবথেকে প্রাচীন ভাষা। কিন্তু নাচ নিয়ে আমরা গভীরভাবে ভাবি না বিশ্লেষণও করি না বরং তার উল্টোটাই করি যা আমাদের চিন্তা করতে, ভাবতে, দেখতে ও অভ্যেস করতে শেখানো হয়েছে। আর তাই আমরা নাচকে শুধুই প্রথাগত শিল্পের মাধ্যম এবং বিনোদনের অংশ হিসেবেই দেখতে ভালোবাসি এবং পুরুষতান্ত্রিকতার দৃষ্টিভঙ্গির বেড়াজাল দিয়ে নাচকে বেঁধে রাখি।

সর্বোপরি সমাজের সর্বস্তরে নাচ নিয়ে নানা ধরণের বিধিনিষেধ আছে যেমন মেয়ে হলে “একটা বয়সের পর নাচ করা যাবে না ", "নাচলে মেয়েরা খারাপ হয়ে যায়", "দেখতে সুন্দর না হলে নাচ করা যায় না।" আমার ব্যক্তিগত জীবনের একটি অভিজ্ঞতা বলি আমার ছোটবেলায় আমি স্কুলে, পাড়ার অনুষ্ঠানে একটি বড় জিনিস লক্ষ্য করতাম - যে মেয়ের গায়ের রং কালো, বা যে মোটা সে নাচে সুযোগ পাবে না বা নিলেও তাকে শেষ লাইনে দাঁড়াতে হবে যাতে বেশি দেখা না যায়, তা সে যতই ভালো নাচুক। এই বৈষম্য বড়ই যন্ত্রণাদায়ক। সেদিন আমার ছোট্ট মনে প্রশ্ন জেগেছিলো নাচের জন্য গায়ের রং ফর্সা বা কালো রোগা না মোটা এগুলো বড় হয়ে দাঁড়ায় কেন। নাচ তো প্রাণের আনন্দ আর মনের প্রকাশ। হয়তো সেদিন কোথাও আমার মানসিকতার গভীরে নাচ দিয়ে সামাজিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখার বীজ বপন করা হয়ে গেছিলো যা ধীরে ধীরে বড় হয়ে ডাল পালা মেলেছে আর এখন পূর্ণতা পেয়েছে ‘কলকাতা সংবেদ’ এর ডান্স মুভমেন্ট থেরাপির কাজের মধ্যে দিয়ে। আর সেই কারণে ‘কলকাতা সংবেদ’ যখন নাচ নিয়ে কাজ করে তখন আমাদের প্রথম কাজ হয় প্রতিটি মানুষ বিশেষতঃ মেয়েরা যেন আমাদের নাচের মধ্যে দিয়ে জীবনে মুক্তির স্বাদ খুঁজে পায়।

ডান্স মুভমেন্ট থেরাপি একজন ব্যক্তিকে একটা নতুন অভিজ্ঞতা দেয় যা তার পুরোনো প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা এবং অন্যরকম এবং যার মধ্য দিয়ে নিজের শরীর মন ও আত্মাকে স্পর্শ করা যায়, ভালোবাসা যায়, নিজের শরীরের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা যায়। এখন মনে হতে পারে এ কিভাবে সম্ভব ? নাচ তো শুধু দেখার জিনিস এবং উপভোগের জিনিস আর কিছু বিশেষ লোক তা পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমরা সবাই নাচতে পারি কারণ আমাদের ৯০% অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম হলো মুভমেন্ট। মানুষ জন্মের পর কথা বলার আগে নড়াচড়া / চলাফেরা করে। শরীরের অভিব্যক্তি দিয়ে মনের অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করে যার কেন্দ্রে থাকে শরীর আর শরীর ও মনের সংযোগসাধন।

আবার এটাও ঠিক যে নৃত্য একটি শিল্পকলা যা আয়ত্ত এবং আত্মস্থ করবার জন্য নান্দনিকতা, যোগ্যতা এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে যা শিল্পকলার অঙ্গ কিন্তু সেখানেই নাচের পরিসর শেষ হয়ে যায় না। এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে আমি নাচের বৃহত্তর পরিসরের কথা ভাবতে বলছি। নাচের বৃহত্তর অবদানের কথা প্রতিফলিত করছি যা আমাদের প্রতিটি মানুষের মধ্যে আছে এবং এর মাধ্যমে আমরা নিজেকে আবিষ্কার করতে পারি। আমাদের শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া গুলো যখন বিশেষ প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে এক সচেতনতা দেয় তখন তা হয়ে ওঠে ডান্স মুভমেন্ট থেরাপি। ডান্স মুভমেন্ট থেরাপি হলো নাচ এবং মুভমেন্টের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবহার যা একজন ব্যক্তির শরীর, আবেগ, বুদ্ধি র মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। একটি সৃজনশীল পদ্ধতি হিসেবে ডান্স মুভমেন্ট থেরাপির প্রধান কাজ হলো মুভমেন্ট এবং আবেগের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরী করা। স্বতঃস্ফূর্ত নাচ, মুভমেন্টের সৃজনী ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার গুণে একজন মানুষ খুব সহজেই নিজেকে হালকা করতে পারে আর ভারমুক্ত করে নিজেকে স্বাধীন করতে পারে। আর তখনই তৈরি হয় শরীর মনের সংযোগ সাধন। এই পদ্ধতি একজন মানুষকে সাহায্য করে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক পুনর্বাসনে।

এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী সৃজনশীলতার মাধ্যমে নিজে যে স্বতঃস্ফূর্ত নাচ সৃষ্টি করে তা তার নিজের ক্ষমতায়ণের পথ প্রশস্ত করে। যখন একজন ব্যক্তি তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রতিফলন শরীরের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে তখন তা প্রকৃত অৰ্থে হয়ে ওঠে তার নিজের নাচ যা অন্যকে খুশি করবার জন্য নয়। যা বয়ে আনে শরীরে ও মনে স্বাধীনতা আর মুক্তি। শরীর-মনের এই স্বাধীনতাই তৈরী করে এক অনন্য বুনিয়াদ যা প্রথমে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়, মানুষকে নতুন ভাবে বেঁচে থাকার পথ দেখায়, সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখায় ও বৃহত্তর ক্ষেত্রে সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্য দূর করবার জন্য মানুষের মানসিকতা ও চিন্তাভাবনায় বদল আনে।

প্রথাগত ছক ভাঙা খুব সহজ কাজ নয়। এই ঘুণধরা সমাজে সেটা যদি আবার নাচের মাধ্যমে হয় তাহলে তো পুরো কাজটাই একটা সামাজিক ‘ট্যাবু’। কলকাতা সংবেদ এই কঠিন কাজটাই ডান্স মুভমেন্ট থেরাপির মাধ্যমে করে। কলকাতা সংবেদ সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, ঝুঁকিপূর্ণ, প্রান্তিক নারী, শিশু ও যুব সমাজের কাছে নাচকে একটি মাধ্যম হিসেবে তুলে দেয় যাতে সে নিজস্ব ক্ষমতার আবিষ্কার করে নিজেকে সমাজে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

নাচের এই মুক্ত স্বাধীন রূপকে সমাজ আর শেখালো কোথায়? বা হয়তো কখনোই শেখাবে না। তা বলে কি আমরা শিখবো না বা আমরা সে খোঁজে নিজেদের নিয়ে যাবো না। আজ সেই খোঁজ করবার দিন। নাচ এমন একটি প্রাচীন ভাষা যা প্রকাশ করার জন্য নিজের শরীরটুকুই যথেষ্ট। নাচকে ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে তাকে বদ্ধ পাঁকে ডুবিয়ে না দিয়ে শরীরের মধ্যে দিয়ে তার প্রকাশ করি ও বিকাশ ঘটাই। এই মুক্তির আকাঙ্খা মানুষ হিসেবে আমাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকে। তার জাগরণ ঘটে নৃত্যের মাধ্যমে। অথচ সারাজীবন আমরা সেই নাচকে শুধু মঞ্চের এবং বিনোদনের পরিসরে আটকে রাখি। আসুন না আমরা আজ নিজের সাথে নিজে শপথ নি যে নিজের জন্য নাচবো, নিজেকে মুক্তি দেবার জন্য, নিজের অন্তরের আলোর বিকাশ ঘটানোর জন্য নাচ তৈরী করবো। এর মধ্যে দিয়েই একজন মানুষ নিজের আত্মা ও শরীরকে ভালোবাসতে শিখবে, সম্মান করতে শিখবে। নিজের মুক্তির আলোয় সমাজের মুক্তির পথ প্রসস্ত করবে।।

---------------------------------------------------

কোভিড ১৯ পরবর্তী সময় এবং প্রতিবন্ধী মেয়েদের ক্ষমতায়ণ

কুহু দাস

লেখক পরিচিতি : নারী, প্রতিবন্ধকতা ও উন্নয়ন কর্মী

বিভিন্ন নারী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য মেয়েদের/ নারীদের প্রতি বৈষম্যের অবসান ঘটানো ও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হোল মেয়েদের ক্ষমতায়ণ – বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন বিষয়ে মেয়েদের বোঝার ক্ষমতা, পরিচালন ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা ইত্যাদি বাড়ানোর মধ্যে দিয়ে মেয়েদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করা।

বিশ্বের প্রায় সব দেশই, তা গরীব হোক বা ধনী হোক সবাই শামিল হয়েছে মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য।, প্রচুর আন্দোলন, প্রচুর পরিশ্রম এবং অনেক ওঠা -পড়ার মধ্যে দিয়ে অনেক অধিকারকে মেয়েরা ছিনিয়েও নিইয়েছেন এবং মেয়েদের সার্বিক অবস্থানে লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এই পরিবরতন কি সব মেয়েদের জন্য হয়েছে? তা হয় নি কারণ মেয়েদের সবাইকে একই ভাবে এক শ্রেণীতে ফেলা যায় না। আর্থিক, সামাজিক, জাতি, ধর্ম, ক্ষমতা – অক্ষমতা, শিক্ষা -অশিক্ষা, ভৌগলিক অবস্থান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আর সকলের মতই মেয়েদের অবস্থাকে প্রভাবিত করে। সে কেমন থাকবে, কিরকম ভাবে জীবন কাটাবে, সমাজ তাকে কি চোখে দেখবে, তার সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করবে তার বেশিটাই প্রভাবিত হয় বা নির্ধারিত হয় তার সার্বিক অবস্থানের ওপরে। প্রতিবন্ধী মেয়েদের ক্ষেত্রেও এই সব কারণগুলো তাদের জীবনকে একইভাবে প্রভাবিত করে আর তাদের ক্ষেত্রে আরও কতগুলো কারন যুক্ত হয়ে তাদের জীবন – জীবিকা ও সসম্মানে বেঁচে থাকাকে অসম্ভব রকম কঠিন করে তোলে। প্রতিবন্ধী মেয়েদের অবস্থাকে সক্ষমতা – অক্ষমতার ভিত্তি প্রবল্ভাবে প্রভাবিত করে। এ কথাও আমরা অবশ্যই জানি যে কোনও মানুষই পূরণাঙ্গরূপে সক্ষম বা অক্ষম হতে পারে না।

যাই হোক সেই বিতর্কে না গিয়ে বরং একটু দেখা যাক প্রতিবন্ধী মেয়েদের অবস্থাটা ঠিক কিরকম এবং তাদের অধিকার আর তাদের ক্ষমতায়ণ নিয়ে সরকার বা সমাজ কোথায় দাঁড়িয়ে।

আমরা আজ এমন একটা সময়ে রয়েছি যখন কোভিড অতিমারি বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। গরীব, বড়লোক, অক্ষম, সক্ষম, পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে সবাইকে এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। তবে তার প্রভাব কিন্তু সবাইকে এক অবস্থানে আনে নি বা তার প্রভাব সবার উপরে একইরকম হয় নি। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ আজ বিভিন্ন অবস্থানে, বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। তবে অর্থনৈতিক ভাবে যারা প্রান্তিক, দুর্বল আর গরীব যেমন প্রতিবন্ধী মানুষ ও মেয়েরা কোভিড তাদের জীবন – জীবিকাকে গভীর সংকটের মধ্যে ফেলেছে।

সভ্যতার প্রায় শুরু থেকেই প্রতিবন্ধী মানুষ বঞ্চনা, অবহেলা, শোষণ আর অত্যাচারের শিকার। প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে আবার প্রতিবন্ধী মেয়েরা মেয়ে হবার কারণে ও প্রতিবন্ধকতার কারণে দুগুন, তিনগুন, অনেক সময়ে আরও বেশি অত্যাচার, বঞ্চনা, শোষণ আর অবহেলার শিকার। তাদের অধিকার, তাদের ক্ষমতায়ণ এগুলো এখনও আমাদের রাষ্ট্রকে তেমনভাবে নাড়া দিতে পারে নি বা ভাবিয়ে তুলতে পারছে না– এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং গভীর চিন্তার বিষয়। এই মুহূর্তে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা হল – প্রতিবন্ধী মেয়েদের কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য কী সহযোগিতা দরকার কিভাবে তারা তাদের তথাকথিত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে – এগুলো নিয়ে সরকার বা সমাজ কোনও কথা বলে না, কোথাও কোনও আলোচনা হয় না বা কোথাও কোনও বিশেষ সরকারি বা বেসরকারি প্রকল্পের কথা বা সাহায্যের কথা ঘোষণা করা হয় নি।

প্রতিবন্ধী মেয়েরা যারা অনেক লড়াই করে, অনেক সমালোচনা, অনেক প্রতিকূলতা, অনেক লাঞ্ছনাকে উপেক্ষা করে পড়াশোনা করছিল তারা কিভাবে আবার শিক্ষায় ফিরবে তা নিয়ে যারা শিক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্বে আছেন তারা একটি শব্দও খরচ করেন নি। প্রতিবন্ধী মেয়েদের জীবিকা -রোজগারকে সুনিশ্চিত করার জন্য বিশেষ আর্থিক সহায়তা, বা তাদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো এগুলো নিয়ে কোন প্রকল্পের খবর চোখে পড়েনি বরং এ বছরে কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নের খাতে বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে।

আমরা সবাই জানি, খবরেই দেখেছি লকডাউনের সময়ে মেয়েদের ওপর গার্হস্থ্য হিংসা কিভাবে বেড়েছে। এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে লকডাউনে বহু প্রতিবন্ধী মেয়েদের উপর গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা ঘটেছে, বেড়েছে এবং এখনও ঘটে চলেছে।

১৯৯৫ সালে The Persons with Disabilities (Equal Opportunities, Protection of Rights and Full Participation) Act, 1995 এসেছিল। তার পরেও বেশ কিছু আইন এসেছে যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ২০১৬ সালে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারের আইন Rights of Persons with Disabilities Act 2016। খাতায় কলমে অনেক অধিকারের কথা বলা হয়েছে কিন্তু তার পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ তো দূর অস্ত, অর্ধেকেরও কম বাস্তবে লাগু করা হয়েছে বা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রতিবন্ধী মেয়েরা এখনও –

# ২ শতাংশের কম স্কুলে যায়। তার মধ্যে বেশীর ভাগই স্কুলের গণ্ডিতেই শিক্ষা শেষ করে। উচ্চশিক্ষাতেও কয়েকজন যায় বটে তবে বেশীর ভাগই কলেজ পর্যন্তও পৌঁছতে পারে না।

[সরকারি কোনও পরিসংখ্যান নেই]

# চাকরীর ক্ষেত্রে বর্তমানে ৪ শতাংশ আসন সংরক্ষিত কিন্তু তাতে প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই ফলে কতজন প্রতিবন্ধী মেয়ে সরকারি কাজের সুযোগ পায় খোঁজার জন্য মাইক্রোস্কোপ লাগে। আর বেসরকারি ক্ষেত্রে কথা বলার কোন সুযোগই নেই।

[সরকারি কোনও পরিসংখ্যান নেই]

# শিক্ষা বা কাজের বা স্বাস্থ্যর ক্ষেত্রে যে accessibility and reasonable accommodation এর অধিকার ২০১৬ র আইনে দেওয়া হয়েছে ৪ বছরেরও বেশী সময় কেটে গেছে তার কোনটাই এখনও পর্যন্ত করা হয় নি।

# স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য ন্যূন তম উপযুক্ত ব্যবস্থাগুলো এখনও করা যায় নি। ফলে বেশীর ভাগ প্রতিবন্ধী মেয়েরাই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধাগুলি নিতে পারেন না। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে যৌন স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য বা মাতৃত্বকালীন পরিষেবা থেকেও প্রতিবন্ধী মেয়েরা তার বেশী ভাগ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হন কারণ পুরো ব্যবস্থা বা সিস্টেমটাই mostly inaccessible অর্থাৎ প্রতিবন্ধীদের জন্য অনুকূল নয়। # মেয়েদের উপর গার্হস্থ্য হিংসা ও যৌন হিংসা যা বিশ্ব জুড়ে একটি অতন্ত্য গুরুত্পূর্ণ বিষয় এবং একটি ভয়ানক সামাজিক সমস্যা বলেই স্বীকৃত এবং প্রায় ৭০% প্রতিবন্ধী মেয়েরাই যার সম্মুখীন হন তা বন্ধ করার জন্য আজ পর্যন্ত উপযুক্ত ব্যবস্থার প্রভূত খামতি খুবই প্রকট ভাবে চোখে পড়ে। আমরা যারা এই নিয়ে কাজ করি তারা খবরে, কমিউনিটি থেকে বা অনান্য সুত্রে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধী মেয়েদের উপর হিংসার ঘটনার খবর জানতে পারি। NCRB র কাছে কিন্তু তা বিশেষ ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। তারা একে পরিসংখ্যানে যুক্ত করাটা বাহুল্য বলেই বোধহয় মনে করে। কাজেই সঠিক সরকারী সুরক্ষা ব্যবস্থাও তৈরি করা হয় না।

এসব থেকে কোভিড পরবর্তী সময়ে প্রতিবন্ধী মেয়েদের অবস্থা অতন্ত্য সংকটজনক বললে কম বলা হয়। যে ২% মেয়ে স্কুলে যেত তার কতজন যে আর স্কুলে ফেরত যায় নি বা যাবে না তার সংখ্যা হয়তো আমরা অনেক পরে বুঝে উঠতে পারব। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় অন লাইন

ক্লাসের সুবিধা বেশীর ভাগ প্রতিবন্ধী মেয়েরাই সদ্ব্যবহার করতে পারে নি – প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্র্যেরর কারণে এবং এই পিছিয়ে পড়াটাকে রাষ্ট্র কিভাবে পূরণ করবে তার কোন রূপরেখা আমাদের সামনে এখনও নেই।

জীবিকা – চাকরী – রোজগার এগুলোর কথা আগেই বলেছি তার আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। তবে একথাটা না বললেই নয় যে কাজের ক্ষেত্রে, রোজগারের ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ণ ও প্রয়োজনীয় আর্থিক,কারিগরি সহায়তা, স্বনির্ভর ব্যবসার মাধ্যমে রোজগারের জন্যে সুযোগ সুবিধা, ও বাজার ব্যবস্থাকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে সরকারী – বেসরকারি রূপরেখা এগুলো প্রতিবন্ধী মেয়েদের ক্ষমতায়ণের জন্য আগেও প্রয়োজনীয় ছিল তবে কোভিড পরবর্তী সময়ে তা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখন নারীদের ক্ষমতায়ণ নিয়ে সর্বত্র আওয়াজ আর দাবী উঠছে। সেই দাবীতে প্রতিবন্ধী মেয়েদেরও ক্ষমতায়ণের দাবী যদি সমানভাবে গুরুত্ব আর জায়গা না পায় তাহলে তা অতন্ত্য দুর্ভাগ্যজনক। আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি এই বাদ দেওয়াটা – এই “exclusion” নারীর অধিকারকে এবং নারী আন্দোলনকে আদতে দুর্বল ও ভঙ্গুর করছে এবং আগামী দিনে আরও করবে।

------------------------------------------

সব কিছুই কি কাল্পনিক?

অঙ্কন বিশ্বাস

কলকাতা

লেখক পরিচিতি : অঙ্কন বিশ্বাস একজন রূপান্তরকামী পুরুষ এবং পেশাগত দিক থেকে একজন আইনজীবি, বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিসরত। এই নিবন্ধের অনেকাংশই তাঁর বাস্তব জীবনের ঘটনা।


স্থান -- পশ্চিমবঙ্গস্থিত কোনো এক জেলা কোর্টরুম, বিচার-প্রার্থী, উকিল বাবু, পুলিস সমেত আদালত সংক্রান্ত লোকজনে ভর্তি। এহেন সময়ে, মানবসমাজের চোখে এক কিম্ভূতকিমাকারের প্রবেশ। বলে রাখা ভালো, সে সদ্য পাশ করে, এনরোলমেন্ট নিয়ে ওকালতি পেশায় এসেছে। পরনে তার আইনজীবিসুলভ পুরুষোচিত পোষাক। গলার স্বর একটু গম্ভীর এবং পুরুষোচিত। মামলার ডাক হলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলো। পেছন থেকে হঠাৎ মানব-কন্ঠে আওয়াজ, 'হুক্কা হুয়া'

চকিতে সে পেছন ফিরে দেখলো! কিন্তু শব্দের উদ্রেককারীকে সে খুঁজে পেলো না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সামনে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে কিঞ্চিৎ পর কোনোমতে শেষ করে কোর্টরুম থেকে বেরোলো। কোর্টরুমের বাইরে তখন দুজন লেডি কনস্টেবল দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টায় মশগুল। তাকে আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখে পরস্পরের মধ্যে আকারে ইঙ্গিতে বোঝার চেষ্টা করলো, আসলে তার লিঙ্গ পরিচয় কি! কয়েক মূহুর্তের পর, ওদিক থেকে ভেসে এলো তার দিকে, " এই দিদি, এটা ছেলে নাকি মেয়ে নাকি মওগা রে??" এবং তারপর যথার্থই, তাচ্ছিল্যভরে, অট্টহাস্য!


স্থান -- পশ্চিমবঙ্গস্থিত কোনো একটি কো-এড স্কুল। শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রীময় ভর্তি স্কুল। একটি মেয়ে, বয়স ধরুন এই ১৬-১৭। কো-এড স্কুলে পড়ে স্কুলের মেয়েরা শাড়ী পড়ে-বেনী দুলিয়ে স্কুলে আসে। ওরও খুব শাড়ী পড়ে বেনী দুলিয়ে আসতে ভারী ইচ্ছে হয়। কিন্তু ও তা পেরে ওঠেনা। কো-এড স্কুল হবার দরুণ ওকে ছেলেদের দিকে বসতে হয় কিন্তু সেটা শেষ বেঞ্চিতে, একা। কোনো এক অজানা ভয়ে একা একা জড়োসড়ো থাকে -- না জানি কেমন একটা সবার কাছে ধরা পড়ে যাবার ভয়! কেন জানেন?

কারণ, সমাজ ওর অন্তরের নারীসত্বা কে স্বীকৃতি দেয় না!

ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর-সুকুমার-সদ্য গোঁফ ওঠা পুরুষ হয়ে উঠতে চলা ছেলেটিকে ও ওর 'কিশোরী' মন দিয়ে ফেলেছে! কিন্তু সেই 'কিশোরী' মনের হদিস সেই যুবক হয়ে উঠতে চলা কিশোরটি জানে না। তারও এখন বয়স সন্ধিঃক্ষণের সময়! এই নবযৌবনরাগে, তার যে বড়ো পছন্দ হয় তাদেরই ক্লাসের সহপাঠী, তার আদর করে দেওয়া নাম 'ইন্দুরানী' থুড়ি অভিজাত পরিবার থেকে উঠে আসা ইন্দ্রানীকে!

সেই সুন্দর সুকুমার কান্তি কে সেই 'নারীসত্বা'য় পাত্তা না পাওয়া কিশোরী লুকিয়ে লুকিয়ে রোজই দেখে তারই সহপাঠী ইন্দ্রানীর সাথে, তাদের স্কুলেরই পলাশ-শিমূল গাছের ছায়ায়। তারা একসাথে বসে ভাবের আদান প্রদান করে, গান গায় মেয়েটি, ছেলেটি আবৃত্তি করে! আর দূর থেকে আমাদের মেয়েটি বিরহ-কাতর হয়ে, হতাশ মননে জয় গোস্বামীর 'মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়' আওড়ায়।

বলে, 'ওদের ভালো হোক'।

ধরা যাক ওর পিতৃদত্ত নাম অমিত। কিন্তু ওর নিজের জন্য বড়ো প্রিয় একটি নাম ও বেছে নিয়েছে, 'লাবণ্য'! হ্যাঁ, রবি ঠাকুরের অমিত-লাবণ্যময়ী! বড্ড প্রিয় ওর। ছুটির দিনে দুপুরবেলায় যখন বাড়ির সবাই বিশ্রাম নেয়, তখন ও তেতলার কোণের ঘরে মায়ের শাড়ী-গয়না-সাজার জিনিস নিয়ে বসে সত্যিই লাবণ্যের মতন সাজায় নিজেকে। নিজেকে প্রিয়তমের চোখে করে তুলতে চায় অপরূপ! কিন্তু যখন আয়নায় নিজেকে দেখে; নিজের মুখমন্ডলে সদ্য প্রস্ফুটিত গুম্ফরেখা দেখে, চুলের পুরুষালী ছাঁট দেখে চরম ঘৃণায়-রাগে-ক্ষোভে আছড়ে পড়ে নিজের উপর! মুখ থেকে বেরিয়ে আসে নিজের জন্য একটিই শব্দ, 'ছিঃ'!

এত রাগ, এত অভিমান --- এত মনের কষ্ট, কাউকে বলতে না পারার কষ্ট! স্কুলে মেয়েলী বলে শিক্ষক শিক্ষিকার আচরণ-সহপাঠীদের হাসিঠাট্টা! ওফ্! অসহ্য! গুমরে গুমরে একদিন সকলের দৃষ্টির আড়ালে এক সুন্দর সকালে, মায়ের শাড়ী পরিধান করে সে গলায় দেয় দড়ি! হ্যাঁ, অমিতের আর লাবণ্য হওয়া হয়ে উঠলো না!

বছরের পর বছর, দিনের পর দিন এরকম সমাজের চোখে 'কিম্ভূতকিমাকার' উকিল নিজের প্র্যাকটিস চালাতে থাকে। কিন্তু আবার এই গল্পের দ্বিতীয় ভাগের 'লাবণ্য'র মতন বহু কিশোর-কিশোরী কে পড়াশুনা ছাড়তে হয়, হারিয়ে যেতে হয় এমন অমানুষিক, অমানবিক যন্ত্রণা নিয়ে! তাদের খবর কেউ রাখেনা। কেন জানেন? আপানাদের চোখে ওরা 'অদ্ভূত', অস্বাভাবিক!

কারা এরা? এই মানুষ গুলো কোথা থেকে আসে? কেন আসে? আসলে আমরা যারা 'সমাজ' নিয়ে চলি, তারা এদের দেখেও দেখিনা! নিজের পরিবারে যদি কেউ এমন থাকে, পারতপক্ষে এড়িয়ে যাই! ওদের বাঙ্ময় চিৎকারটা না রাষ্ট্র শোনে, না আমরা শুনি! আসলে বোধহয়, ওরা মানুষ হয়েও মানুষ নয়! আমাদের দেশের সংবিধান ওদেরকেও আইন চোখে, রাষ্ট্রের চোখে আমার আপনার মতন সমান অধিকার নিয়ে বাঁচার অধিকার দেয়! আমার-আপনার পাশে দাঁড়িয়ে ওরাও ভোট দেয়! লক্ষ্য করে দেখবেন, চলা ফেরার পথে কখনও যদি বিপদে পড়েন, আসেপাশে এরকম একজন 'অদ্ভূত' মানুষ থাকলে, আমার আপনার মতন ভদ্রজনের চেয়ে এরাই আগে ছুটে আসে!

কিন্তু ওদের শ্রম-শিক্ষা-যোগ্যতা-ভালোবাসা-সংসারের দাম নেই! আমি আপনি ওদের সাথে ভালোবাসার - কাজ দেবার অভিনয়টুকু করতে পারি, নিজের কাছে নিজেকে মহান দেখানোর জন্য! কিন্তু ওদের নূন্যতম অধিকারগুলির জন্য কথা বলতে ওদের পাশে দাঁড়াতে পারিনা!

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এরা থাকে কোথায়! এরা আমার আপনার চারপাশেই থাকে। ঠিক যেমন আমাদের কিম্ভূতকিমাকার উকিল সকাল ১০.৩০ থেকে সন্ধ্যা ৬.৩০ পর্যন্ত পড়ে থাকে কোর্টে, সারাদিন পর যদি সামান্য কিছু টাকার মুখ দেখতে পায়, তাহলে সারাদিনের পরিশ্রম একটু সার্থক হয়। ঘরের মানুষদের মুখে একটু হাসি ফুটে!

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন আচ্ছা এরা জন্মের সময় কোন যৌনচিহ্ন নিয়ে জন্মায়! উত্তরটা খুব স্বাভাবিক, আপনি আমি যেমন যৌনচিহ্ন নিয়ে জন্মেছি তারাও তাদের মতন জন্মেছে। এবং আপনার এই প্রশ্নের দ্বিতীয় উত্তরে বলতে পারি, জন্মগত লিঙ্গেই যে একটি শিশুর সারাজীবনের পরিচয় হয়ে উঠবে তা নাও হতে পারে! আসলে আমি-আপনি বড্ড শরীর কেন্দ্রিক ভাবনা চিন্তা করি তো! মানসিক স্বাস্হ্যের কোনো পড়াশুনা কিম্বা ভাবনা চিন্তা আমাদের নেই কিনা! তাই বলছি, সময় থাকতে থাকতে হাতের স্মার্ট ফোনটা খুলে নিয়ে একটু ওই জেন্ডার এবং সেক্সুয়ালিটি নিয়ে পড়াশুনা করুন আর ভাবুন। ভাবুন মশাই, ভাবাটা প্র্যাকটিস করুন!

আজও আমি আপনি ওদেরকে দাবিয়ে রেখেছি। পণ ধরেছি যে ওদের জন্য কিচ্ছু করতে দেবো না, সামান্য একটা টয়লেট পর্যন্ত বানাতে দেবো না ওদের জন্য। ওরা যদি কাজ পায়, ইন্টারভিউ বোর্ডে উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে ওদের শিরদাঁড়া ভেঙ্গে দেবো! যদি স্কুলে পড়াশুনা করতে যায়, রোজ রোজ অদ্ভূত আচরণের জিগীর তুলে ওদের কে নিয়ে হাসাহাসি করবো যাতে কৈশোরই ভেঙ্গে যায় মাথা তুলে বাঁচার স্বপ্ন; যাতে প্রতিটা মূহুর্তে সমাজের উল্টোদিকে চলছে--সমাজ মানবে না, বাড়ির লোক তাড়িয়ে দেবে এই চিন্তায় শৈশব কৈশোর যৌবন সবটা যায় বিষিয়ে! যদি বিয়ে করে, তাহলে ওদের ছবি তুলে সোশাল মিডিয়ায় দিয়ে ভাইরাল করে ওদের কে 'পাব্লিকের খোরাক' করবো! বিয়ে করবার অধিকার চেয়ে কোর্টে মামলা করলে বলবো, এ সব অস্বাভাবিক বিষয়। ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না। আইনী অধিকার দেওয়া পার্লামেন্টের বিষয়। কোর্ট যেন অযথা নাক গলিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি না করেন। এক সাথে থাকুক না! আবার বিয়ে কেন! এত আস্পর্ধা আসে কোথা থেকে!

শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে জীবনের ক্ষেত্রে --- মানে সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে শুতে যাওয়া অবধি শুধু সকলের সাথে যুদ্ধ আর যুদ্ধ! এদের বেশীরভাগের কাছেই তো আবার ঐ রাত্রে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর জন্য নূন্যতম আশ্রয়টুকুও থাকেনা। তাহলে? তাহলে সর্বদিক থেকে চেপে খুন করো ওদের! কাজের ঠিকানা নেই --- আজ আছে কাল নেই ---- বাড়ি নেই, ঘর নেই ---- শিক্ষা নেই! হসপিটালে সঠিক ওয়ার্ড এবং ডাক্তার নেই! ওদের যৌন হেনস্হা, রাষ্ট্রের চোখে হেনস্হা নয়, ওদের 'ধর্ষণ' হয়না! ওদের সাথে 'প্রতারণা' হয়না। শুধু নেই আর নেই! কিন্তু তাও আমি-আপনি ওদের ঠেকিয়ে রাখতে পারিনা। ওরা যেন সেই পুরাণে উঠে আসা রক্তবীজের বংশধর!

দীর্ঘজীবি হোক এই রক্তবীজের বংশধরেরা, বেঁচে থাকুক ওদের লড়াই। শেষ করছি, কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গান দিয়ে,

'আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।
আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভূত।
আমরা বেড়া ভাঙি,
আমরা অশোকবনের রাঙা নেশায় রাঙি।
ঝঞ্ঝার বন্ধন ছিন্ন করে দিই— আমরা বিদ্যুৎ।
আমরা করি ভুল—
অগাধ জলে ঝাঁপ দিয়ে যুঝিয়ে পাই কূল।
যেখানে ডাক পড়ে জীবন-মরণ-ঝড়ে আমরা প্রস্তুত।'

----------------------------------------

নারী যৌনকর্মী ও স্বাধিকার

পারমিতা চৌধুরী

লেখক পরিচিতি : পারমিতা চৌধুরী নারী আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী।

বৃহত্তর নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে থেকেই যৌনকর্মীদের প্রত্যক্ষ করেছি। দেখেছি নারী আন্দোলনকর্মীদের একাংশ যৌনকর্মীদের অধিকারের আন্দোলনের পক্ষে ননl যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তাদের আপত্তি আছে এবং তার বহু যুক্তিও তাদের কাছে রয়েছে। যৌনকর্মী শব্দটিও আসলে বহু আন্দোলনের ফসল। এই শব্দটি ব্যবহারেও অনেকের আপত্তি আছে।

সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যৌনকর্মীদের নিয়ে আপত্তি আছে আর তাই তারা নানা বিধি-নিষেধ বৈষম্যমূলক আচরণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যৌনকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। বিভিন্নভাবে খারাপ মেয়ে তকমা দিয়ে তাদের আলাদা করে রাখে। যৌনকর্মীরা অনেকেই এই ধারণার বশবর্তী হয়ে নিজেদের ‘খারাপ’ ভাবেন ও এই পেশাকে অসম্মান করেন। এই পেশা থেকেই বহু নারী রোজগার করেন, সংসার চালান ও সন্তান পালন করেন। যৌনকর্মীদের রোজগারের টাকা দিয়ে জমি বাড়ি ব্যবসা ইত্যাদি সবই হয় কিন্তু যৌনকর্মীরা তাদের যোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত থাকেন।

আমি কালীঘাট এলাকায় যেতাম যৌনকর্মীদের সঙ্গে তাদের স্বপ্ন দেখানো ও বাস্তবায়ন নিয়ে একটা গবেষণামূলক কাজে। সালমার (নাম পরিবর্তিত) বাড়ি মুর্শিদাবাদে। কালীঘাটে থেকে যৌন পেশা করতেন। ওনার স্বপ্নই ছিল বয়স হলে দেশে গিয়ে নিজের বাড়িতে থাকবেন পরিবারের সবার সঙ্গে। ওনার মায়ের চোখে ছানি ছিল তার অপারেশন করাবেন খুব তাড়াতাড়ি। নিজের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টও ছিল না। ভাই ও মায়ের যে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল সেখানেই টাকা রাখতেন। "আমার ভাই খুব ভালো। ও আমাকে খুব সম্মান করে" বলতেন। অগাধ বিশ্বাস। মাঝে মধ্যে বাড়িতে যেতেন আর ফিরে এসে গ্রামের, বাড়ির গল্প করতেন।

কাজটা যখন শেষের পথে দেখতাম সালমা দি অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন। শুনতাম শরীর ভালো নেই। শেষে একদিন এলেন। চুপচাপ, মুখখানা শুকনো। কথাও কম বললেন সেদিন। ঠিক লাগলো না। মনে হলো শুধু শরীর খারাপ হয়তো না। কাজের পরে থেকে গেলাম সালমাদির সঙ্গে কথা বলব বলে। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। মায়ের চোখের অপারেশন হয়ে গিয়েছে। মা ভালই আছেন। কিন্তু ওনার স্বপ্নের বাড়িতে ওনার নিজের জায়গা হয় নি। ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা ও ভাই মিলে ওনাকে ওই বাড়িতে ঢুকতে মানা করে দিয়েছেন। ওরা বলেছেন সালমার মত মেয়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখা খুব অন্যায়। অথচ তার রোজগারের টাকায় তৈরি বাড়িতে থাকতে কিন্তু পরিবারের সম্মানহানি হচ্ছে না।

যৌনকর্মীদের রোজকার জীবনেও নানা নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক বৈষম্য খুব সাধারণ ঘটনা। বছর দশেক আগেও টিটাগড় এলাকার যৌনকর্মীদের সালোয়ার কামিজ পরা নিয়ে বিধি নিষেধ জারি করেছিলো এলাকার মস্তানরা। কারণ সালোয়ার কামিজ "ভদ্র" মেয়েরা পরে। তাই যৌনকর্মীরা সেই পোশাক পরতে পারবেন না।

আবার পেশাগত জায়গাতেও সম্মান ও সামাজিক স্বীকৃতি না থাকার দরুণ তারা বহু

ধরণের ঝুঁকির মুখোমুখি হন। তাদের ওপর শারীরিক ও যৌন অত্যাচার হলেও মুখ বন্ধ করে থাকতে হয়।বিনামূল্যে যৌন পরিষেবা দিতে হয় ক্ষমতাসীন মানুষদের। বাড়ির মালিকরা যৌনকর্মীদের বাড়ি ভাড়ার রসিদ দিতে চান না কারণ বাড়ি মালিকরা যৌন পেশায় ঘর ভাড়া দিয়েছেন প্রমাণ রাখতে চান না কারণ তা আইটিপি আইন অনুযায়ী অপরাধ।

সর্বোপরি আছে পুলিশি অত্যাচার। যৌন পেশায় যারা এসেছেন তারা সবাই পাচার হয়ে এসেছেন এই মনোভাব নিয়ে পুলিশ যৌনকর্মীদের উদ্ধার করার উদ্যোগে প্রায়ই যৌনপল্লী এলাকায় রেইড ও ধরপাকড় করে। এই ধরনের রেইডের ফলে যৌনকর্মীরা কতটা উপকৃত হন তা জানা নেই তবে কিছু পুলিশকর্মীর অর্থনৈতিক উন্নতি তো ঘটেই।কলকাতার একটি পল্লী এলাকায় একবার দেখেছিলাম যে পুজোর সময় যখন যৌনকর্মীদের রোজগার ভালো হয় কারণ সেই সময় অনেক মক্কেল বা কাস্টমার এলাকায় আসেন তখন পুলিশ সাদা পোশাকে অটো নিয়ে এলাকার চারপাশে টহল দেয় ও ধরপাকড় করে। এলাকার আইন-শৃঙ্খলা এতে কতটা উন্নতি হয় তা জানা নেই তবে অনেক ক্রেতা ও যৌনকর্মীর পকেট কাটা যায়।

যৌনকর্মী ও পুলিশের সম্পর্ক নিত্যদিনের। থানায় গেলে যৌনকর্মীদের বসার জায়গাটাও জুটত না আগে। পরে সংগঠন গড়ার ফলে অবস্থা পাল্টে ছিল। একবার দেখেছিলাম এক যৌনকর্মীকে কোন কারণে পুলিশ ভ্যানে তোলার আগেই একজন পুলিশকর্মী তাকে ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পড় মারলেন। কোন কারণ ছাড়াই একটা অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও নারী বা কোন মানুষের গায়ে এই রকম হাত তোলা যায় বলে জানা নেই।

পুলিশি অত্যাচারের চরম শুনেছিলাম মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানের ঘটনায়। সেখানে গঙ্গার ঠিক পাশ ঘেঁষেই কয়েকটি ঘরে যৌন পেশা চলত। রাতে যখন মক্কেলের সঙ্গে যৌনকর্মী ব্যস্ত তখন পুলিশবাহিনী সময় বেছে ও বুঝে রেইড করত। মক্কেলদের ধরে নিয়ে যেত আর যৌনকর্মীরা পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য ঝপাঝপ জলে ঝাঁপ দিতেন ওই কনকনে ঠান্ডায়। পুলিশ যতক্ষণ না যেত তারা উঠতেন না কারণ তারা জানতেন যে আর যাই হোক পুলিশ ওই ঠান্ডায় জলে তো ঝাঁপাবে না!!! ফলে যৌনকর্মীদের কিছুটা টাকা বাঁচতো

আবার যৌনকর্মীর ঘরে যদি কোন কম বয়সী মেয়ে থাকে তবে তাকে ধরে নেওয়া যায় আইনি ভাবে। কালনায় একবার পুলিশ এইভাবে রেইড করে বেশ কিছু অল্প বয়সী মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল। একজন নাকি এমন ছিল যে তখন স্কুল যাবে বলে স্কুল ইউনিফর্ম পরে ভাত খেতে বসেছিল তাকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সে বারে বারে বলে যে সে তার মায়ের সঙ্গে থাকে ও স্কুলে পড়াশুনা করে কিন্তু তার কথা শোনা হয় নি কারণ এলাকাটি যৌনপল্লী!!! আর যৌনকর্মী মা আবার ওই এলাকায় থেকে সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছে!!! সেতো হতেই পারেনা। সুতরাং পাকড়াও।

ভারতীয় আইন কিন্তু যৌন পেশা সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে কিছু বলেনি। একদিকে পেশা গ্রহণ করার কথা বলে আইটিপিএতেও সরাসরি যৌন পেশাকে বেআইনি বলা নেই। কিন্তু যৌন পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলি, যেমন কোনো ঘর যদি যৌন পেশার জন্য ব্যবহৃত হয, কিংবা কেউ যদি প্রকাশ্যে যৌন পেশার জন্য দরদাম করেন অথবা ১৮ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তি যদি যৌন পেশার রোজগারের ওপর নির্ভরশীল হয়, এইগুলিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।এর ফলে পুলিশের হাতে অনেক আইনী ব্যবস্থা আছে যা প্রয়োগ করে যৌনকর্মী এবং তার মক্কেলদের হেনস্থা করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল কেন? কোনও উপার্জনশীল মানুষের সন্তান যার বয়স ১৮ বছরের উর্ধ্বে অথবা তার বয়স্ক বাবা-মা যদি তার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল হয় তাহলে কি তাকে জেলে পোরা যায়? তাহলে যৌন পেশার ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম কেন? উত্তরটা আসলে আমাদের মানসিকতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে।

নারীর গার্হস্থ্য শ্রম ও,যৌনতা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত হয় পরিবার, ধর্ম, বিবাহ ও অন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে। নারীর যৌনজীবনে সম্মতির স্থান কম। যৌনতা উপভোগ করার আনন্দ ও তা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ওপরেও সমাজের বিধি নিষেধ আছে। নারীর যৌনতাকে শুধুমাত্র বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যেই বেঁধে রাখা হয়। যে নারী যৌনতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন এবং স্পষ্টভাবে নিজের যৌন পছন্দ অপছন্দ ব্যক্ত করেন তার গায়ে খারাপ মেয়ের তকমা লাগে। নারীর শরীরের ও যৌনতার ওপরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তার মৌরসিপাট্টা চালিয়ে এসেছে।

ঠিক এইখানেই যৌনকর্মীদের নিয়ে সমাজের আর রাষ্ট্রের এত নৈতিক অসুবিধা।কিছু নারী যে পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে নিজেদের শরীরকে আর যৌনতাকে স্বেচ্ছায় ব্যবহার করে উপার্জন করছে তারা মেনে নিতে পারে না। নারীর যৌনতা যা কিনা বিনামূল্যেই পাওয়া যায় তার মূল্য যদি নারী নিজেই নির্ধারণ করেন তা সমাজের পছন্দ হয়না।আবার যদি সেই নারী স্পষ্টাক্ষরে যৌনতায় সম্মতি না দেয় তবে তাদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে সমাজ পিছপা হয় না।

তাই উদ্ধার করার নামে আইনের অপপ্রয়োগ করে সামাজিক কলঙ্ক আরোপ করা হয় যৌন পেশায় নিযুক্ত নারীদের। কর্মরত নারী হিসেবে সমাজ আর রাষ্ট্র তাদের অধিকার হনন করে বিভিন্নভাবে। পিতৃতান্ত্রিক এই নৈতিকতার ধারণা থেকেই যৌনকর্মীদের অন্য পেশায় পুনর্বাসনের জন্য প্রকল্প বানায়।যৌনকর্মীরা যে স্বনিযুক্ত পেশাদার শ্রমিক হতে পারেন এই ভাবনাটাই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মাথায় আসে না। যৌনকর্মীদের জন্য যে প্রকল্পগুলি গঠিত হয় সেইগুলি তৈরির ক্ষেত্রে যৌনকর্মীদের প্রতিনিধিত্বও থাকে না এবং যৌনকর্মীরা সেইসব প্রকল্পগুলি থেকে কোনোভাবেই উপকৃত হন না।

তাই আজ এই উত্তরণের যুগে নিজেদের ভাবনা নতুন আলোয় ফিরে দেখার প্রয়োজন আছে। যৌনকর্মীদের অধিকার হরণের মূল উৎস রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নিয়ন্ত্রণের ভাবনার মধ্যে। তাই নারীর যৌনতার স্বাধীকারের আন্দোলন ও যৌনকর্মীদের অধিকারের আন্দোলন পাশাপাশি চালাতে হবে। তবেই নারী স্বাধীনভাবে নিজের যৌনতা পছন্দ- ব্যক্ত করতে পারবেন, উপভোগ করতে পারবেন এবং যৌনতা নিয়ে যে লুকোচুরি আছে তা বন্ধ হবে। নারীর যৌনতায় নারীর নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। যৌনকর্মীদের নিয়েও সমাজের নৈতিক খুঁতখুঁতানি বন্ধ হবে ফলের তারাও শ্রমিক নারী হিসেবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন।

---------------------------------------

নার্সিং : একাল ও সেকাল

স্নেহা সান্যাল
পি. এইচ.ডি গবেষিকা
ইতিহাস বিভাগ
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।


একাল :

কলকাতা শহরে রাস্তাঘাটের সাথে যারা পরিচিত, তারা জানেন বিভিন্ন অলিগলিতে বহু মজার বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যায়। এমনি এক বিজ্ঞাপন সম্বন্ধে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিজ্ঞাপনটি নিম্নরূপ :

শহরবাসীর এই বিবিধ প্রয়োজন বোধ হয় কোন নামী ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার পক্ষেও মেটানো অসম্ভব। ভারতে অবাক লাগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক অন্যতম স্তম্ভ যে নার্সিং যাতে প্রয়োজন আধুনিক প্রশিক্ষণ, তা পাইকারী হারে সরবরাহ করছে এই ভুইফোঁড় সংস্থাগুলি। এই লেখার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত বাকী পেশাগুলির অপমান নয় বরং আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক দ্বিচারিতাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরা।

কয়েক বছর আগে আনন্দবাজার পত্রিকার একটি প্রতিবেদন আমাদের বুঝিয়েছিল যে আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নার্সিংকে কোনো ভাবেই ব্রাত্য করা যাবে না : “বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আজ গণছুটিতে গেলেন এইম্‌সের প্রায় পাঁচ হাজার নার্স। যার জেরে অচল হয়ে পড়েছে হাসপাতালের গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থা। পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্তত ৯৯০ টি আস্ত্রোপচার। বন্ধ রয়েছে জরুরী বিভাগও। রোগী ফেরাতে বাধ্য হচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।” (১৯ মার্চ, ২০১৭) উপরোক্ত ঘটনা থেকে এতটুকু উপলব্ধি করা যায় যে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নার্সিং শুধুমাত্র একটি অপরিহার্য অঙ্গই নয়, একটি সুষম পরিকাঠামো গঠনে এর অবদান ঢের ঢের বেশী। অথচ জনস্বাস্থ্য নার্সদের যে সম্মান বা অধিকার পাওয়ার কথা ছিল সমাজ তা দেয়নি। আর তা যে শুধু ভারতবর্ষের চিত্র ছিল তা নয়, ভারতের বাইরেও এর নজির পাওয়া যায়।

সালটা ছিল ১৯৭১, যখন ইংল্যান্ডে অমর্ত্য সেন ক্যানসার চিকিৎসায় প্রায় সাত ঘন্টা সার্জারির পর অ্যানেস্থিসিয়ার প্রভাব কাটিয়ে ডিউটিতে থাকা নার্সের কাছে জানতে চেয়েছিলেন নিজের অবস্থার কথা। ডিউটিতে থাকা নার্স কিন্তু কিছুই বললেন না। কারণ বলার অধিকার নেই, বলার মধ্যে শুধু বলেছিলেন “ন’টায় ডাক্তার এলেই জানতে পারবেন না।” কিন্তু তাতে পেসেন্টের অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়, আর তা লক্ষ করে নার্সের ভেতরটা উসখুশ করছিল। শেষে একটা সুন্দর হেয়ালী ধরলেন নার্স। বললেন, “জানেন তো ডাক্তাররা খুব প্রশংসা করছিলেন আপনার”, অর্থাৎ আড়েঠাড়ে বুঝিয়ে দিলেন যে নতুন করে তার ক্যানসার ধরা পড়েনি। আর সেটাই যে রোগীর প্রশংসিত হওয়ার কারণ সেটা আর না বললেও চলছিল।

আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নার্সিং এর সামাজিক মর্যাদা কতটা ? কেন আজও নার্সদের সমতার জন্য লড়তে হবে ? কেন আজও বেঁচে থাকার লড়াইতে এদের দেশান্তর গমন হতে হয় ? সেবা মানেই স্ত্রী জাতির কাজ, এই ভাবনা থেকে নার্সিং মানেই মেয়েলি পেশা কেন এই ভাবনা আজও আমাদের মনে ? এই সমস্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন সমাজ বিজ্ঞানীরা।

এ প্রসঙ্গে বলা যায় পাঞ্চালী রায়ের গবেষণার কথা – সেখানে তিনি দেখিয়েছেন বর্তমান কলকাতা শহরে নার্সিং পেশার মধ্যে যে বিভাজন রয়েছে (আধুনিক প্রশিক্ষনের নিরিখে), যার ফলশ্রুতি হল এক শ্রেণীর মহিলাদের প্রতিনিয়ত বঞ্চনার শিকার হওয়া। কলকাতা শহরের হাসপাতাল এবং নার্সিংহোম গুলিতে কর্মরতা প্রায় ১০০ নার্সের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে আধুনিক প্রশিক্ষণ ( General Nursing and Midwifery, অথবা সংক্ষেপে GNM কোর্স), ‘সেমি–স্কিল্ড’ নার্সদের তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক এবং সম্মান থেকে বঞ্চিত করছে। বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই অসাম্যের কারণ অনুসন্ধানে ইতিহাসের ছাত্রী হিসাবে আমি ফিরে গিয়েছিলাম ব্রিটিশ ভারতে – নার্সিংএর ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার কী কিছু রয়েছে ?

সেকাল :

১৯৯০ এর দশকে সামাজিক ইতিহাসের এক নতুন ধারা হিসাবে “History of Medicine” এর উদ্ভব ঘটে। যেখানে ঐতিহাসিকরা জনস্বাস্থ্য, মহামারী, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই আখ্যানে নারীস্বাস্থ্য ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের প্রবেশ ঘটে একটু দেরিতে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন পেশা নিয়ে আলোচনা হলেও, নার্সিং, যেখানে প্রধান কুশীলব নারী, এই ইতিহাসে ব্রাত্যই থেকে গেছে।

নার্সিং বলতে যার কথা আমাদের মনে আসে, তিনি হলেন ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল (১৮২০-১৯১০) – “The Lady with the Lamp”। শুধু ইউরোপীয় ইতিহাসে নয়, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও নার্সিং-এর প্রতিষ্ঠানিকরণেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি ব্রিটিশ আধিকারীকদের নার্সিং-এর গুরুত্ব সম্বন্ধে অবহিত করেছিলেন, শুধু তাই নয় প্রদান করেছিলেন এক বিশদ ‘ব্লু-প্রিন্ট’।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে ১৮৫৭ এক মাইল ফলক। মহাবিদ্রোহের অবসানে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার যখন ড্যামেজ কন্ট্রোলে ব্যস্ত, বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে এলাহাবাদের মিলিটারি হাসপাতালে কয়েকজন মহিলা নার্সের নিয়োগ ছিল অন্যতম। এর অনতিবিলম্বে (১৮৬৯) কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনজন নার্স কাজ শুরু করে। এর ঠিক দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ক্যালকাটা হসপিটাল নার্সেস্‌ ইনস্টিটিউশন (১৮৫৯)। এই দাতব্য প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ছিল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং প্রেসিডেন্সী জেনারেল হাসপাতালের ইউরোপীয়ান ওয়ার্ডে নার্সিং পরিষেবা প্রদান।

১৮৭৩ সালে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের আর্থিক আনুকুল্যে প্রতিষ্ঠিত “লেডি ক্যানিং হোম” এবং পূর্বের প্রতিষ্ঠানটির সংযুক্তি (১৮৭৬) নার্সিংকে আরো সুসংগঠিত করেছিল। ১৮৮১ সালে ব্রিটেন থেকে আগত পেশাদার নার্সরা (Clewer sisterhood ) কলকাতা শহরে শিক্ষানবিশদের প্রশিক্ষনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। “ঢাকা প্রকাশ” পত্রিকার এক প্রতিবেদনে (১৮৮৮) তারা নার্সিং এর বিপুল চাহিদা পূরণে শুধু ইউরোপীয়ানদের নয়, ইউরেশিয়ান মহিলাদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়োগ করার কথা বলে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত “ডাফ্‌রিন ফান্ড” ভারতীয় মহিলাদের ডাক্তারি, মিড্‌ওয়াইফ, নার্সিং প্রভৃতি পেশায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ছিল এক যুগান্তকারী প্রচেষ্টা।

বঙ্গভঙ্গের কারণে সারা বাংলা যখন রাজনৈতিক ভাবে উত্তাল, সেই সময়ই কার্জন-পত্নীর অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত হল “ Scheme for the Provision of trained nurse (s) for attendance on Europeans in India”। তার উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় নার্সদের নিয়ে এক “নার্সিং সার্ভিস” গঠন যা সম্পূর্ণ ভাবে ভারতবর্ষের বসবাসকারী ইউরোপীয় জণগনের সেবায় নিয়োজিত হবে। স্বাভাবিক কারণেই ব্রিটিশ সরকার এই পরিকল্পনার সার্বিক রূপায়নে বদ্ধ পরিকর হয়। এই সময়ই প্রতিষ্ঠিত হয় Lady Mentor’s Indian Nursing Association (১৯০৬)। স্থির হয় কলকাতা সহ সমগ্র বাংলা প্রদেশে তারা প্রশিক্ষিত নার্স সরবরাহ করবে।

পরিশেষে বলা যায় Trained Nurses’ Association of India-র প্রতিষ্ঠা (১৯০৮) নার্সিং-কে এক দৃঢ় ভিত্তির উপরে স্থাপন করে। যদিও বলা হয়েছিল এই সংগঠন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত, কিন্তু এর প্রথম দিকের প্রতিনিধি তালিকা দেখলে রোজি সিং (এলাহাবাদ কর্মরতা) নামক একজন মাত্র ভারতীয় নার্সের সন্ধান মেলে।

ভারতীয় মহিলাদের নার্সিং পেশায় প্রবেশ তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯২২ সালে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের এক বিতর্ক সভায় বিজয় প্রসাদ সিংহরায় নামে একজন জনপ্রতিনিধি প্রশ্ন করেছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরতা সমস্ত নার্সই কি ইউরোপীয় অথবা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বংশদ্ভুত ? যদি তাই হয় তবে সরকার ভারতীয়দের প্রশিক্ষনের ব্যাপারে কি ভাবছে ? শুধু সমকালীন রাজনীতির আঙ্গিনাই নয়, ভারতীয় সমাজেও সমান ভাবে বিষয়টি চর্চিত হয়েছিল। ‘বঙ্গলক্ষী’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে নিম্নলিখিত আবেদনটি জানানো হয় (১৯২৮) :

“প্যারিসের The Newyork Herald এ প্রকাশিত হইয়াছে যে, অত্রত্য ‘আমেরিকান হসপিটাল’ হইতে সম্প্রতি ১৪ জন বালিকা ‘নার্স গ্রাজুয়েট’ হইয়া বাহির হউইয়াছে। এই এই নার্স গ্রাজুয়েটদের মধ্যে ষ্টকহলম্‌ (সুইডেন) ইস্পাহান (পারস্য), সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়া প্রভৃতি বহুদেশের বালিকাই আছে। এতৎ প্রসঙ্গে ডা: তারকনাথ দাস আমাদিগকে পত্রে জানাইয়াছেন। “We need thousands of Indians girls to be trained as nurses and doctors”। আমরা দেশবাসীকে এই বিষয়ে ভাবিয়া দেখিতে বলি।”

স্বাধীনতার ৭৪ বছর পর স্বাভাবিক ভাবেই নার্সিং-এর ভারতীয়করণ হয়েছে। কিন্তু নার্সিং সম্বন্ধে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যে বিষয়গুলি ওয়াকিবহাল মহলকে চিন্তিত করেছিল, একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এসেও সেই বিষয় গুলিকে আমরা কি সম্পূর্ণ ভাবে সমাধান করতে পেরেছি ?

: তথ্যসূত্র :
১) Healey, Medelaine, Indian Sister : A History of Nursing and the State, 1907-2007 New Delhi : Routhledge, 2013.
২) Mukherjee, Sujata, Gender, Medicine and Society in Colonial India : Women’s Health Care in Nineteenth and Early Twentieth Century Bengal, New Delhi : Oxford University Press, 2017 .
৩) Roy, Panchali., Politics of Precarity : Gendered Subjects and the Health care Industry in Contemporary Kolkata. New Delhi : Oxford University press, 2019.
৪) Sanyal, Sneha, ‘Institutionalization of Nursing as Profession in the Early Twentieth Century Bengal’ Indian Journal of History of Science, Vol. 52, No. 3, September 2017, PP. 297-315.

বর্তমান প্রবন্ধটি আমার শিক্ষিকা স্বর্গীয়া শ্রীলতা চ্যাটার্জির স্মৃতির উদ্দেশ্য নিবেদিত।

------------------------------------------------

Discovering the Power of Cooking

Pritha Sen

She is a former journalist and her work on sustainable livelihoods led her to research and document the history of food of different communities.

A question I often got asked as a young, single woman was “what do you do for food or what do you eat?” In the beginning I could never figure out the rationale behind this query. Then it slowly dawned on me that cooking was viewed as a married woman’s domain and a ‘bachelor’ girl in their mind survived on Maggi and tomato sauce.Times have changed and I know many married ladies who would happily serve the same to their families which has resulted in the new phenomenon of the cheerful ladle-wielding husband.

This, however, is not a discourse on equity in the kitchen. It’s about discovering the power of cooking. As a working woman, spending 12-14 hours out of the home, all I yearned for at the end of the day was a simple home cooked meal. Just the sight of burgers and pizzas or chholebhaturasmade my stomach turn. It was then that I decided that whatever time I got home, I would cook myself a simple meal, even if it was plain dal-chawal. As an ill-paid, overworked journalist, time and resources both were at a premium. Most times, the best meal one ever had was dal, steamed spinach and egg curry.

However, very soon I realised that for a palate honed by my mother’s cooking, this meal soon turned into a boring repeat of the same. What did one do with a handful of ingredients, shoe-string budgets and little time for elaborate meals? I took up the challenge in earnest and the journey began with me in competition with myself. I started playing around with permutations and combinations, dals with different temperings, dals with veggies, dals cooked with pickle masala, spinach with dal, spinach in poppy seed paste, spinach with potatoes, spinach with brinjal, plain egg curry, egg curry with coconut milk, eggs in mustard paste, eggs poached on a bed of spiced steamed spinach with onion rings, khichdi with spinach and eggs and my list grew each day. I started getting excited at the prospect of entering the kitchen after a long, hard day, wondering what surprising combination I would conjure up and surprise myself with.

Cooking ceased to be drudgery. It turned into a stressbuster that culminated in a sense of achievement at the end of it all. Music came back into my life. I would play music of my choice and sing along while I cooked. Somewhere down the line I realised that the activity helped me think better and soon the opening lines for any story I was working on started popping up in the midst of staring at the dal, willing it to boil quickly. Ideas for new ways to handle and report on the same story came to me while I ground the mustard paste. Much like I used the same ingredients to cook a different dish each time, I learnt how to take one issue and turn it into three different stories and maximise on the efforts that went into reporting and information gathering.

As my innovations in the kitchen started gathering momentum, I found ways to minimise on effort and time. One thing I learnt through the years was if the fridge was planned, you were set in the kitchen. By that I don’t mean planning your menus a week in advance. That is quite impossible. I mean being prepared for every exigency – tired bones, no time to think, late night, carrying work home and so on. So on weekends, I would boil small quantities of different dals and freeze them. They then just needed to be tempered and would thaw in the karhai itself. I would make ginger, garlic and onion pastes (and that is because I don’t much care for the ready-made ones) and freeze those too in ice trays, taking out a cube at a time.

Suddenly I realised that such planning was opening up whole new avenues of lateral thinking at the workplace too. My skills of research and planning ahead began to improve; I anticipated roadblocks and doubts thrown at me by editors and had my solutions and answers ready. I learnt to think smart on my feet. I learnt about positioning and strategy. How? For instance, among others, I developed a range of one-dish meals which were a combination of protein, vitamins, fibre and most important – taste. More importantly, I gave every dish a special name. Why so? Because it conveyed respect for the food I cooked and passed on the same message to anybody else I cooked for. This was positioning. Secondly, I expounded on the technique, making passing references to retaining the real taste and texture of fresh vegetables or meats. This was a strategy that made people look closer at the food and left them impressed and me with a sense of achievement. Needless to say, I applied the same techniques at work. I began to find unique selling points in activities that I had so far found drab and mundane.

It was however not all about a hard-nosed approach to cooking. Food, I realised was also about emotions. When I cooked with a lot of love for special people, the end product turned out superb. The day it felt like a chore, it turned out pretty much substandard. The food I put out somehow became a dipstick for the range of emotions that I felt through life. And soon I realised any work done in an agitated, depressed, uncaring or toxic state of mind would never translate into a showstopper. What I finally realised is that food at the end of it all is identity. It is who one is and we are what we eat. It reflects our emotions, inspires creativity, encourages innovations, is one of the most powerful social levellers and last but not the least teaches one how to take pride in one’s own work and keep striving for perfection. Unfortunately, much as food binds, it can divide too as easily. It is this binding agent that I discovered through my explorations in the kitchen and I haven’t looked back since.

0 comments: