0

গল্প - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in










নিতাই এসে বলল, “ঠাকুর মশাই এখনো আসেননি”। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে আমি ঘড়িটা দেখালাম; সকাল নটা। এতো দেরি কোন দিন হয়না। এই বাড়িতে আমরা তিন জন থাকি। আমি, চাকর নিতাই চারণ আর কুলদেবতা শ্রীশ্রী নারায়ণ। এটা আমার কথা নয়। ঠাকুর-দেবতায় আমার কোন বিশ্বাস নেই। তবে বাবা বলতেন, “আমি চলে গেলে তোমরা তিন জনে ভালো হয়ে থেকো!” নারায়ণ শিলাটি ঠাকুর দাদা তীর্থে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। আমাদের মতো নিচু জাতের বাড়িতে নারায়ণ থাকলে গ্রামের নাকি অকল্যাণ হবে। এই অজুহাতে জমিদার ঠাকুরদাদাকে একঘরে করা দিয়েছিলেন। শুনেছি তখন এই ঠাকুর মশাইয়ের বাবা এগিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকে চলছে নারায়ণ সেবা। ঠাকুর মশাইয়ের বয়েস এখন তিরানব্বই। আমিও ষাট পেরিয়েছি। বাবা চলে যাওয়ার পর এখন ঠাকুর মশাই আমার অভিভাবক। আমাদের একমাত্র মিল, আমরা দুজনেই অকৃতদার। তবে অমিল অনেক। তিনি সারা দিন পূজার্চনা জপ ধ্যান নিয়ে থাকেন আর আমি থাকি শেয়ার মার্কেট নিয়ে। শেষ কবে পুজোর ঘরে গিয়েছি মনেই পড়ে না।

ঠাকুর মশাই একা মানুষ, কাছেই থাকেন। তড়িঘড়ি তাঁর বাড়ির দিকে যেতে গিয়েও ফিরে এলাম, চশমাটা নেওয়া হয়নি। ওটা ছাড়া আজকাল অসুবিধা হচ্ছে। রোজ সাতসকালে এ বাড়িতে এসে তিনি পূজা-পাঠ শুরু করেন। দুপুরে আমরা রোজ এক সঙ্গে খাই। শুধু সেই সময় টুকুই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা নয়। তিনি বড় একটা কোথাও যান না। শুনেছি সারাদিন সেভাবে আর কিছু খানও না। সূর্য ডোবার পরে, জল পর্যন্ত নয়।

তিরানব্বই বছরের কেউ মারা গেলে তেমন দুঃখ হবে না। এমন ভাবতে ভাবেতে যাচ্ছি সেই সময় রাস্তায় তাঁর গলা পেলাম, “ব্যস্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছিলে?”

-“এত বেলা হয়ে গেল… আপনি আসছেন না দেখে ভাবলাম…”।

রহস্যময় হেসে তিনি বললেন, “আমাকে নিয়ে ভেবো না। তোমার বাবা যাওয়ার আগে তোমার দায়িত্বটা তো আমাকেই দিয়ে গেছেন!... এখনো সময় হয়নি।”

দুপুরে খেতে বসে প্রশ্ন করলাম, “আজ আপনি এতো দেরি করলেন কেন?”

-“ভোরে একজন প্রণাম করতে এসেছিল! সে চলে যাওয়ার পরে স্নান করে ধ্যানে বসেছিলাম, তাই –“।

এমন কথা তাঁর কাছে আগেও শুনেছি। পরিচিত মৃত আত্মারা যাওয়ার আগে নাকি তাকে প্রণাম করে যায়। তখন তিনি আত্মার মুক্তির জন্যে ধ্যানে বসেন। বিষয়টা আমার নিতান্ত ফালতু বলেই মনে নয়। তবে বয়স্ক মানুষকে এসব কথা বলা যায় না। বাবা যেদিন চলে গেলেন সেদিন ঠাকুর মশাই একটা ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। সাতটা নাগাদ আমার দরজায় ঘা পড়ল। আমি ঘুমচ্ছিলাম। দেখলাম নামাবলি, সাদা ফুলের মালা, তুলসী পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঠাকুর মশাই। বললেন, “তোমার বাবা চলে গেছেন। তাঁর খোলসটা সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে”।

খবরটা ভুল ছিল না। আগের রাতে বাবার হাতে-পায়ে ব্যথা হচ্ছিল। আমি অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর সেবা করেছিলাম। শুয়ে শুয়ে বাবা শোনাচ্ছিলেন পুরনো দিনের গল্প। একসময় বললেন, “এবার শুতে যা। কাল সকালে ঠাকুর মশাইকে দরজা খুলে দিতে হবে!” আমি বেরিয়ে আসতে বাবা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। সকালে দরজাটা আমাদের ভাঙ্গতে হয়েছিল। অবশ্য আমার ধারণা, ঠাকুর মশাই জানলা দিয়ে দেখেছিলেন। যদিও কথাটা আমি কাউকে বলিনি। ঠাকুর দেবতা বা অলৌকিক আমি যেমন বিশ্বাস করিনা তেমনই আমার অবিশ্বাসের কথা ফলাও করে বলারও আমি পক্ষপাতী নই। আমি শেয়ার মার্কেটের ওঠা পড়া নিয়ে থাকতেই পছন্দ করি!

খাওয়া শেষ করে ঠাকুর মশাই একটা পান মুখে দিলেন। দাঁত নেই বলে নিতাই হামানদিস্তায় থেঁতলে দেয়।

-“তোমার চোখের সমস্যা শুনলাম! ডাক্তার দেখিয়েছ?”

-“ছানি পড়েছে, অপারেশন করতে হবে” আমি বললাম, “আজকাল রাতে মাছ খেতেও অসুবিধা হয়”।

-“দিনের বেলা খেলেই পারো!”

-“কি যে বলেন! আপনি নিরামিষ খাবেন, আর পাশে বসে আমি আমিষ খাবো, তাই হয় নাকি!”

-“কেন হবে না! একবেলা নিরামিষ খাওয়া আমার বহুদিনের অভ্যাস। এটা করে আমি ভালো থাকি। আমিষ খেয়ে তুমি ভালো থাকো। এ দুইয়ের মধ্যে তো কোন বিভেদ নেই! আমাকে ভালো রাখতে গিয়ে তুমি নিজে খারাপ থাকবে… না না ওটা কাজের কথা নয়!”

-“কিন্তু ছোঁয়া যদি লেগে যায়?” আমি প্রশ্ন করলাম।

-“যুক্তিবাদী মানুষ হয়ে তুমি ছোঁয়া বিশ্বাস করো?”

-“বিশ্বাস করিনা! তবে কারো বিশ্বাসে আঘাত করতেও চাই না!”

দরজার দিকে পা বাড়িয়ে ঠাকুর মশাই বললেন, “এই শরীরটাই একটা আমিষের ডিপো বুঝলে। এনিয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাস দুটোই ছেলেমানুষি”।

মাঝে মাঝে ঠাকুর মশাইয়ের কথা আমি ঠিক ধরতে পারি না। তাঁর আমিষ-নিরামিষ মতামতটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু আজ তিনি যে কথা বললেন সেটা শুনে আমার একেবারেই ভালো লাগলো না। খাওয়ার পর আমি বললাম, “আগামী সপ্তাহে ছানি অপারেশন করাবো। এখন খবরের কাগজ পড়তেও বেশ কষ্ট হচ্ছে। শেয়ার মার্কেটের সংখ্যা গুলো কাগজে খুব ছোট ছোট করে ছাপে, দেখেছেন তো?”

শুনে ঠাকুর মশাই কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন, তারপর বললেন, “অপারেশনটা আগামী পূর্ণিমার পরে করলে কেমন হয়?”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন বলুন তো? পূর্ণিমার আগে কি শুভদিন নেই?”

চলে যেতে যেতে ঠাকুর মশাই মৃদু হেসে বললেন, “ধরে নাও তাই!”

অনেকদিন আগে একবার শুভদিন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি বলছিলেন, “সব দিনই ঈশ্বরের তাই সব দিনই শুভ!” আর আজ… মনে হচ্ছে সব মানুষই অল্প বিস্তর হিপক্রিট। ভাবলাম তাকে না জানিয়ে চুপিচুপি অপারেশনটা করে ফেললে কেমন হয়। পরে মনে হল, তিনি আমার অভিভাবক। নিজের অবিশ্বাস জাহির করতে গিয়ে তাঁকে লুকিয়ে কিছু করাটা আমার ঠিক হবে না। না হয় অপারেশনটা কদিন পরেই হবে। এই সব সাতপাঁচ ভেবে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দিন বদলে নিলাম।

আজ পূর্ণিমা। খাটে বসে আমি আকাশের দিকে চেয়েছিলাম। আমার চোখে এখন সবকিছুই ঘোলাটে। তবে আমি জানি অপারেশনটা হয়ে গেলেই আমি আবার আগের দৃষ্টি ফিরে পাবো। ভেতরে ভেতরে একটু অস্থির লাগছে, এমন সময় নিতাই এসে বলল, “ঠাকুর মশাই এসেছেন”। রাতের বেলা তাঁকে আমি কোনদিন দেখিনি। তাঁকে খানিকটা বিভ্রান্ত লাগছে। বললেন, “কেন জানিনা মনে হচ্ছে, গীতার শ্লোক গুলো ভুলে যাচ্ছি। পরপর মুখস্থ বলতে পারবো না! আমার একটা পরীক্ষা নেবে?” বলে তিনি আমার হাতে গীতা ধরিয়ে দিলেন, “আমি মুখস্থ বলে যাবো তুমি মিলিয়ে মিলিয়ে দেখবে। এখানে বাংলাতেই লেখা আছে”। বিষয়টাকে আমার পাগলামি বলেই মনে হল। বললাম, “আমি এখন চোখে ভালো দেখি না ঠাকুর মশাই, পরশু আমার অপারেশন”। তিনি উত্তর দিলেন না। আমি বড় আলোটার নিচে বইটা খুলে বসলাম।

মেঝেতে আসন পেতে বসে ঠাকুর মশাই সুরেলা কণ্ঠে একটানা গীতার শ্লোক বলতে লাগলেন। আমি একটু পরে খেই হারিয়ে তাঁর মধুর গীতা পাঠে ডুবে গেলাম। সমস্তটা শেষ করে শিশুর মতো হেসে তিনি বললেন, “যাক, মনে আছে দেখছি। আচ্ছা এখন তাহলে চলি। ভোরবেলা দেখা হবে”।

ভোরবেলা কেন দেখা হবে বুঝলাম না। আজকাল নিতাই তাঁকে দরজা খুলে দেয়। যাই হোক, রাতের খাওয়া শেষ করে আমি শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরে! চোখ মেলতেই মনে হল, সব কিছু আমি খুব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমার আর অপারেশনের কোন প্রয়োজনই নেই। আনন্দে তক্ষুনি আমার ঠাকুর মশাইকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হল। তাঁর বাড়ির কাছাকাছি যেতেই তিনি বেরিয়ে আসলেন। বললেন, “তুমি এসেছ! আমি তোমার জন্যেই অপেক্ষা করে ছিলাম। এবার চলো এক সঙ্গে যাওয়া যাক”।

0 comments: