0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অভীক কুমার চৌধুরী

Posted in

মোহনবাগান বেমক্কা হেরে গেলো সেদিন রাতে , মনমেজাজ খুব খারাপ। তাই হরিদার চায়ের দোকানে একটু আড্ডা দিতে গেলাম, যদিও এইসময় আমার বন্ধুরা কেউ আড্ডা দিতে আসে না, ওদের সময় দশটার পরে। তবুও পা বাড়ালাম।

এইতো এসে গেছে ব্যাঙ্কের লোক, আসুন আসুন। ভিতর থেকে কেউ ডাক দিলো - আরে দাদা যে , কি মনে করেছেন আপনারা। দেশের অর্থনীতির কি যে ক্ষতি করছেন আপনারা বোঝেন?-- চায়ের দোকানের ভিতরে বসে থাকা মুখচেনা কেউ একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো। জানিনা উনি অর্থনীতির ছাত্র কিম্বা শিক্ষক কিনা।

পাশ থেকে আর একজন ফুট কাটলো -- টানা চারদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ ,কি মজা , সরকারি ব্যাঙ্কের বাবুরা সব ঘরে বসে মাইনেটি পাবেন । একদম অচেনা একজনের হা-হুতাশ -- সাধারণ মানুষের কি যে কষ্ট তা যদি ওরা বুঝতো .....

হরি দা আদা দিয়ে বড় এক ভাঁড় চা দাও দেখি -- আমি দোকানের ভিতর সেঁধিয়ে গেলাম। দোকানে চারটে বেঞ্চি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আটদশজন বসে আছে। একটি কমবয়সী ছেলে সাতসকালের বাসি খবরের কাগজ গোগ্রাসে গিলছে। ছেলেটি আমায় বললো, কাকু ভালো আছেন?

আমি মৃদু হাসলাম। প্রথমজন আবার জানতে চাইলেন, কি হলো দাদা?

সত্যি টানা চারদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ, খুব অসুবিধা তাইনা? সকলকে উদ্দেশ্য করে বললাম।

তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বলি, আচ্ছা যদি এই সরকারি ব্যাঙ্কগুলো যদি একদম বন্ধ হয়ে যায় তবে?

হরিদা মুখ বেঁকিয়ে বললো, আর ভাবছো কেন চৌধুরী, ওরা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে যাবে। কতোদিনকার সাধ।

হরিদার বিদ্যের দৌড় বড়জোর পাঁচ কেলাস, কবে বিহারের সুদূর গ্রাম থেকে এসে এখানে চায়ের দোকান দিয়েছে । কিন্তু আমি জানি হরিদা বোধ, বুদ্ধি, চেতনা ও মননে অনেকের থেকে উন্নত।

আমি মানুষের মুখগুলো ভালোভাবে দেখলাম, একজন সরকারি পেনশনভোগী, একজন প্রাইভেট অফিসে কাজ করে,একজন আধা রাজনীতিক আর বাকিদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানিনা। শুধু কমবয়সী ছেলেটির কোন আগ্রহ নেই।

আমিও একটি সরকারি ব্যাঙ্কে চৌত্রিশ বছর কাজকরে অবসর নিয়েছি, কাজেই এরকম প্রশ্ন বা তাচ্ছিল্যের অনেকবার মুখোমুখি হয়েছি। মোটামুটি যে মন্তব্য বা প্রশ্নগুলি এতবছর ধরে শুনে আসছি সেগুলো লেখার শুরুতেই পেয়েছি। এমনই আরো অনেক অনেক প্রশ্নের মধ্যে - আর কত মাইনে বাড়াতে হবে এদের (ধর্মঘট মানেই জানে মাইনে বাড়ানোর দাবি, যদিও যাদের বাড়ির কেউ ব্যাঙ্কে কাজ করে তারা জানে আসল অবস্থা) / ব্যাঙ্কের পরিসেবা (ষেবা লিখলাম না ইচ্ছে করে) খুব খারাপ / স্টাফেরাতো আমাদের মানুষ বলে মনেই করে না / কোনোদিন পাসবুক আপডেট হয়না (কেউ কেউ একইদিনে জমা দিয়ে ও তুলে প্রতিক্ষেত্রে পাসবুক মেলে ধরেন ) / আমাদের টাকায় মাইনে পাচ্ছে (মানে যা জমা দিচ্ছে তার থেকেই .....)

আরো এইধরণের হাজারো অভিযোগ।

আর সকলের একটাই নিদান - ব্যাঙ্ক গুলো বেসরকারি করে দাও , তবে বাছাধনেরা টের পাবে।

ওপরের অভিযোগগুলির উত্তর বা প্রতিবাদ, পক্ষে বা বিপক্ষে অনেকে অনেকভাবে বিভিন্ন ফোরামে পরিসংখ্যান দিয়ে অনেকদিন ধরে লিখেছেন, বলেছেন বা আজ প্রতিমুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়াতে চর্চা চলছে , তাই আমি আর বিশেষ কিছু বলবো না। চায়ের দোকান থেকে অনেকক্ষণ চলে এসেছি আর বেশি কিছু না বলে।

আমি শুধু যে ব্যাঙ্কে তিনদশকের বেশি সময় কাটিয়ে এলাম তার বিষয়ে কিছু বলি। বিবাদী বাগে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের উল্টোদিকে যে, "তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে / সব গাছ ছাড়িয়ে / উঁকি মারে আকাশে .. " সেখানেই পেয়ে গেলাম জীবনধারণের অক্সিজেন, দু দুটো কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির প্রলোভন ছেড়ে। তারপর কত শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা এসেছে গেছে, তবুও বসন্ত দরজায় কড়ানাড়া দিয়েছে বারবার। চাকরি করতে করতে কত অচেনা মানুষ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখদুঃখের সাথী করে নিয়েছে সেটা নিয়ে লিখতে গেলে অনেক শব্দ খরচ করতে হবে, তাই সেকথা অন্য কোনোদিন। আজ শুধু আমার অভিজ্ঞতা একটু ভাগ করেনি। আমি নিজে এটিএম, গুগুল পে, নেট ব্যাঙ্কিং, মোবাইল ব্যাঙ্কিং ইত্যাদি নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত বলে ব্যাঙ্কে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু এবারে যেতেই হচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে, সাইনবোর্ড পাল্টে গেছে। ভিতরে ঢুকে মনে হলো সব কিছুতেই কেমন "উল্টে দেখুন পাল্টে গেছে" বিজ্ঞাপন, যেখানে দশজন স্টাফ ছিল, সেখানে মেরেকেটে তিন থেকে চার। চেনা কেউ নেই বলেই চলে, বাংলা ভাষাটাই যেন অনেকের কাছে অচেনা। অবশ্যই দুএকজন খুব আন্তরিক কর্মী আজও আছে, তাদের কাজ করার আগ্রহ বা চেষ্টা কোনোকিছুর ঘাটতি নেই। তবে তারাও নিধিরাম সর্দার, হাতে বন্দুক নেই, বন্দুক আছেতো টোটা নেই, টোটা আছেতো কিভাবে ছুঁড়তে হবে জানা নেই, সব কিছু আছেতো অন্তর্জাল ছিঁড়ে গেছে। ওরা কাজ করবে কি ভাবে? পেনশনের দিন কখন পেনশন জমা পড়বে কেউ জানে না। জমা টাকার সুদে যাদের দিন চলে তাদের ন্যায্য পাওনাও অনিয়িমিত, কোনোরকমে নাগাদ জমা - তোলার কাজ চলছে। স্বল্পসঞ্চয় আমানতকারী প্রতিনিধিদের তিনমাসের বেশি কাজ বন্ধ , আর মানে পেটের ভাত বন্ধ । কর্তৃপক্ষের কিছু এসে যায় না , তারা সবেতেই সংযুক্তিকরণের মালা জপছে। সবদিকে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা।

অথচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আরো অনেকের সাথে অসুস্থ বৃদ্ধা, অশক্ত বৃদ্ধ। পেনশন তুলতে পারলে তবে ওষুধ কেনা যাবে, সুদের টাকা না পেলে কাল কি হবে কেউ জানেনা। নিজের কোনো পরিচয় না দিয়েই কোনোরকমে কিছু কাজ সেরে বেড়িয়ে এলাম, জানিনা বাকি কাজ কি করে হবে। সত্যি তো, সাধারণ মানুষের দুঃখের কথা কে ভাবে?

তবে মানতে হবে, মাননীয় সরকার বাহাদুরের কানে গেছে আমজনতার দাবি, বাছাধনদের টের পাওয়াতে হবে। সরকারি ব্যাঙ্কগুলো মিলিয়ে মিশিয়ে একদম ঘ্যাঁট পাকিয়ে দিতে হবে, তারপর কোন এক সুদিনে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বেচে দিতে হবে বেনিয়াদের হাতে। তবেই না বাছাধনরা টের পাবে, অবশ্য বাছাধন মানে তখন শুধু ব্যাঙ্কের কর্মী অফিসাররা নয়, আপামর সাধারণ জনতা। তাই ব্যাঙ্ক লাঠে উঠলেও এক লক্ষ টাকার বেশি কেউ পাবে না, যত টাকাই আমানত থাকুক। অতএব আনন্দ করুন, আনন্দ করুন প্রাইভেট ব্যাঙ্কে যাবেন, মোটা টাকা রাখবেন। এটিএম, ক্রেডিট কার্ড সব পাবেন, ধাঁ চকচকে অফিস। তবে হ্যাঁ, ব্যাঙ্কের কাউন্টারে বসে থাকা সেই ছেলিটিকে আর কোনোদিন পাবেন না যার কাছে গিয়ে অকপটে জানাতেন আপনার ব্যক্তিগত সমস্যা। আর ছেলেটিও হাসিমুখে আপনার সমস্যা মেটাতে সচেষ্ট থাকতো।ম্যানেজারের চেম্বারে আর কাউকে হয়তো পাবেন না, যিনি সব জরুরি কাজ ফেলে আপনার জন্য তৎপর হয়ে উঠতেন। সে ছেলেটি আজ শত খুঁজলেও পাবেনা ক্রিস্টমাসের আগের দিন নিজের হাতে তৈরি কেক নিয়ে ব্যাঙ্কে হাজির মিস ক্যাথরিন, হাই হিরো, মেরি খ্রীষ্টমাস (জীবনে ওই একজনই আমাকে হিরো বলে সম্বোধন করতেন )। কিম্বা আলী চাচার সেই দরদমাখা স্বর, হ্যাঁরে বাছা, তোর মুখটা এতো শুকনো লাগছে যে, জ্বর রয়েছে নাকি, তুই আজ অফিসে এলি কেন?

আর কি খুঁজে পাওয়া যাবে সেইসব ভালোবাসার সম্পর্ক রেখা বৌদি, সুনীলদা, রত্নামাসি, চ্যাটার্জী খুড়োদের? এখন সবাই শুধুই কাস্টমার। নামহীন,  গোত্রহীন সংখ্যার দল।

এইভাবেই অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে - আমাদের গৌরবময় ইতিহাস, উত্তুঙ্গ পর্বত থেকে মালভুমি, মরুভুমি হয়ে নদী বিধৌত সমভূমি আর উপকূল ঘিরে সাগরের অতল জলের আহ্ববান। বিষিয়ে যাচ্ছে আমাদের আকাশ, বাতাস, পরিবেশ। বিকিয়ে যাচ্ছে আমাদের ব্যাঙ্ক, ভারতীয় রেল তার ট্রেন প্লাটফর্ম সমেত, ভারতীয় জীবন বীমা, বিমান বন্দর, জাহাজঘাটা, কয়লা, লোহা আরো সব খনিজ রত্ন ভান্ডার আর সুজলাং, সুফলাং শস্যশামলাং দেশমাতৃকা । কিন্তু তাতে আমাদের কি আসে যায়?

আমরা মেতে থাকি ধর্মে ও সিরিয়ালে আর 'ঘন্টাখানেক সঙ্গে ঘুমোন', ভাবতে থাকি সেবায়েতরা এখন বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছেন কিনা, শুনতে থাকি মানবসেবায় নিয়োজিত প্রাণ দিদি দাদাদের অভিনয় ছলচাতুরী আর অমৃতকথন। আর আপাতত ব্যাঙ্কের (থুড়ি ,কর্মচারীদের) পিন্ডি চটকানো চলুক, চারদিন কেন ব্যাঙ্ক বন্ধ (দুদিন শনি, রবি ) এই নিয়ে। পরে দুদিন আবার বীমা শিল্পে ধর্মঘট। তারপর কোনো এক শুভক্ষনে পবিত্র গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে আসি।

কিন্তু না, অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। তাই কেউ কেউ চোখ খোলা রাখে, প্রতিবাদ হয়, ধর্মঘটে নামতে হয়। ঘরে বসে সবেতন ছুটি নয়, প্রতি ক্ষেত্রে মাইনে কাটাতে হয় (সুযোগ সন্ধানীরা অবশ্য ফাঁকফোকর খোঁজে)। ব্যাঙ্ক বাঁচলে তবেই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ বাঁচবে। তাই ব্যাঙ্ককে ও দেশের সম্পদকে লুঠেরাদের হাত থেকে বাঁচাতে সর্বাত্মক প্রতিরোধে নামতেই হবে - "অনেকতো দিন গেলো বৃথা এ সংশয়ে , এস এবার সকল দ্বিধা পার হয়ে..."।

ধ্বংসের মুখমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের সকলকে লড়তে হবে একসাথে, বন্ধু তুমিও থেকো আমাদের পাশে। নাহলে একদিন সেইদিন সঙ্গীবিহীন পথ খুব তাড়াতাড়ি মিশে যাবে কৃষ্ণগহ্বরে।

পরিশেষে আবার স্মরণ করি ১৯৩৭ সালের মহামানবের আবির্ভাবের পুণ্যদিনে কবিগুরুর সেই অমোঘ সাবধানবাণী।

"নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস--
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে। " ---শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

0 comments: