ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৫)
হাসিমারা টি এস্টেটের কুলি লাইনে এসেই প্রভাকর রাজবংশী বলে একজনের সাথে আলাপ হল। লোকটা সত্যি বেশ মজাদার। কথায় কথায় জানাল যে তার সাথে নেপালী আর মদেশীয়াদের খুব ভাব। প্রভাকর সাড়ে তিনবছর হয়ে গেল জনমুক্তি পার্টীতে জয়েন করেছে। তার আগে সে নিজেও একসময়ে এই টি-গার্ডেনে কুলিসর্দারের কাজ করেছে হাতেকলমে। সবচেয়ে বড় কথা যে স্বয়ং সি.এম ওকে নামে চেনেন। দেখলেই বোঝা যায় লোকটা বেশ দিলখোলা, দামাল ও একই সাথে অগোছালো প্রকৃতির। সনৎদা কলকাতাতেই ওকে বলেছে যে চা বাগানগুলোর কুলি লাইনে ওর বেশ জনপ্রিয় প্রভাব রয়েছে। ওকে এখানকার সবাই যেমন ভালবাসে আবার তেমনি মানেও। সমুদ্রকে বাস স্ট্যান্ডে আনতে ও নিজেই এসেছিল। প্রভাকর যদিও লোকাল সেক্রেটারী কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নিজেই ওর স্যুটকেসটা হাতে তুলে নিতে নিতে বলল 'কমরেড! লাল সেলাম! সেই কলকাত্তা থিকে আসছ! হিহানে দু' রোজ তো বিশ্রাম নাও! হাওয়া পানি বুঝে নাও, তারপর তো কাজ শুরু করা যাবে!'
ওকে সঙ্গে নিয়ে কুলি লাইনের বস্তির শেষ প্রান্তে একটা চালা ঘরের দরজায় এসে টোকা দিতেই একজন বুড়ি নেপালী মহিলা বেরিয়ে এল। প্রভাকর তাকে বলল - ' উনি কলকাত্তাকা হুঁয়! আভা ইয়াহাঁম রাহেনেছা!' তারপর সমুদ্রের দিকে একগাল হেসে বলল - 'কমরেড থাপার স্ত্রী ইনি, আমাদের মাতং দাদী! এখন ওর এখানেই থাকো কিছুদিন '। তারপর দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট বুড়ির হাতে গুঁজে দিয়ে চলে যাবার সময় বলল - ' আভি খানাপিনা করকে আরাম কর লো কমরেড। সাঁঝ মে ম্যঁয় লেনে আউঙ্গা ঔর তুমকো বাজার লে চলেঙ্গে...'!
ছোট দুখানা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের একটিতে নেয়ারের খাট পাতা আছে। তার পাশের একটা টুলের ওপর আছে জলের কুঁজো। আর বাড়তি থাকার মধ্যে আছে একটা ধূমসো ভূটানী কম্বল। এরকম একটা ঘরে থাকার কথা সমুদ্র এর আগে কখনো ভাবেনি। সি.এম তো নোটবুকে এভাবেই নিজেকে ভেঙেচুরে গড়ে নিতে বলেছেন।
তবুও প্রথমটায় কলকাতায় নিজেদের বাড়িটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার। বাবা আর মা নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তা করবে এখন। যদিও একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছে..তাও। রিমি'টার কথাও মনে পড়ছে খুব। ওর এবার ক্লাস নাইন হবে। এই বুর্জোয়াতন্ত্রের অধীনে লেখাপড়া করে পাশ করা মানে আদতে ডিগ্রীধারী শোষিতের সাপ্লাইলাইনকেই বাড়ানো। রিমি'টাকে ও-ই ইতিহাস আর বাংলাটা দেখিয়ে দিত। আসলে মা'র কলেজ আর বাড়ি সামলিয়ে নিজের জন্য কিই বা সময় বাঁচত। আর বাবা মানুষটাকে ওদের পার্টী সন্দেহ করলেও সমুদ্র নিজে তো জানে যে মানুষটা আসলে কতটা সৎ। সব কংগ্রেস সাপোর্টারই শ্রেণীশত্রু হয় না কি? বাবা যে বস্তির কয়েকটা ছেলের পড়াশোনার খরচ দেয় মা'কে লুকিয়ে, সেটাও কি বিপ্লবের পথে রসদ জোগানো নয়? সমুদ্রের মনটা একটু বিষণ্ণ হয়ে আসে।
একটু পরে বুড়ি এসে জিজ্ঞাসা করল যে ও রুটি আর কুঁদরী ভাজা খায় কিনা। কারণ আজ বাজার হয়নি। এইটুকুই তাদের এবেলার সম্বল।
এক অন্য ভারতবর্ষের সাথে আস্তে আস্তে পরিচয় হতে চলেছে সমুদ্রের। কলকাতা ছেড়ে আসার অভিমানটা কতদিনে ফিকে হয়ে যাবে কে জানে?
**********
" মৃত্যুও ঋতুকাল চিনেছি বাবা চলে যেতে
সাদাফুল ভিতর ঘরে বুনে দিয়ে মা চলে গেল---
এ শরীরে জল মিশে মোহনায় হেঁটে গেলে
জলস্রোত চিনেছি। ডেকেছি বহুবার তোমার ডাকনাম ধরে।
সেখানে এখনো আদর আসে। ঘাটের কিনারায় সে আদর
ছুঁয়ে জলস্রোত বাজে ছলাৎ ছল... তোমার নামে। ছুঁয়ে দেখো....
ভালোবাসা হে, আগামীবার আমায় একবারও
ডাকবে কি প্রিয় নদী নাম ধরে ...!"
আজ বাবার মৃত্যুদিন বলে নিজের ডায়রির পাতায় এই সব হিজিবিজি লিখছিল সাগরিকা। এইদিনটা এখানে কাটাতেই এবছর আসা।
মা এর সাথে বেরিয়ে অনেকগুলো শ্বেতপদ্ম আর দুটো প্রদীপ কিনে এনেছে সকালে। স্নান সেরে ওগুলো নিয়ে গিয়ে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে আসবে ওরা। বাবা খুব সাদা রঙ ভালবাসত। এই অতলান্ত নীল জলের বিছানায় বাবা যেন আজন্মকাল শুয়ে থাকবে। যুগের পর যুগ কেটে যাবে তবুও যেন আর কখনো বাবা সেই ঘুম থেকে উঠে এসে পিঠে হাত রেখে 'রিমি' বলে ডেকে নতুন কোন বই বা দেশ পত্রিকাটা এনে হাতে ধরিয়ে মোটা কাঁচের চশমার আড়ালে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবেনা। বাবার প্রিয় পটলের দোর্মার ভিতরে চিংড়ির পুর ভরতে ভরতে বাবাকে স্নানের জন্য মা আর কখনো তাড়া দেবেনা রোববারগুলোয় অথবা কালবৈশাখী ঝড়ের পর হঠাৎ নামা বৃষ্টিতে চুপ্পুড় ভিজে দাদা বাড়ি ঢুকে ভিজে যাওয়া সিগারেট আর দেশলাই টা ওর হাতে চট করে ধরিয়ে দিয়ে বলবেনা 'জলদি! পাখার তলায় রেখে শুকিয়ে দে! এর বেশী ভিজে গেলে আর ধরানো যাবে না..'
বুকের মধ্যে এইসব স্মৃতিগুলোই বাঘনখ দিয়ে আঁচড়ায়। আসলে মুঠো গলে সবটাই কখন নিজের অজান্তে ছড়িয়ে গেছে বোঝাই গেল না।
********
আজ অনেকদিন বাদে হেঁটে একটু হাঁপিয়ে গেল সমুদ্র। পঞ্চায়েৎ অফিস থেকে সেবায়তন বড়জোর দু কিলোমিটার রাস্তা হবে। জেলের থার্ড ডিগ্রীতে পাএর এই অবস্থাটা না হলে আধাপঙ্গু শরীরটার ভার বইতে হত না।
এক এক সময় নিজের মনে ভাবে যে সেই আগুনের দিনগুলো কি ভাবে নিষ্ফলা করে দিল প্রতিক্রিয়াশীলের দলগুলো। আসলে খুনের রাজনীতিটাকে প্রশ্রয় দেওয়াটাই ছিল আন্দোলনের অভিমুখটাকে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার একটা কূট কৌশল। হেমন্ত বসুর মত জননেতাকে প্রকাশ্যে খুন করে ফেলাটা সি.এমএর নোটবুকে লেখা ছিল কি? তবুও পার্টী হাত নোংরা করল এসব করে। গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলে একটা সমান অধিকারের সমাজ আর গড়ে উঠতে পারল না? মাঝখান থেকে কিছু প্রমিসিং তরুণ তরুণী কামানের খাদ্য হয়ে জাস্ট উড়ে গেল।
সুখমণি বাগানে চেয়ার পেতেই রেখেছিল। ওর হাত থেকে ক্রাচটা নিয়ে বলল-
' এখন একটু চা খাবেন তো ? করে আনি?'
কোমড়ের তলা থেকে ব্যথাটা বেড়েছে এইটুকু হাঁটার ফলে। ঝোঁকের মাথায় রিক্সা না নিয়ে এভাবে অনভ্যাসের হাঁটাটা উচিত হয়নি। সুখমণিকে চা আনতে বারণ করল সমুদ্র। চেয়ার টেনে বসতে বসতে স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো -
" না! বস আগে। জরুরী কথা আছে তোমার সাথে!"
(চলবে)
0 comments: