গৌরচন্দ্রিকাঃ
আজকে বুড়োদের আড্ডায় চা হয় ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছ, নয় পাজামা লুংগিতে ছলকে পড়ছে, তবু কারও হেলদোল নেই। তর্ক-বিতর্ক শেষ হয়ে এখন যা হচ্ছে তাকে ভারতীয় তর্কশাস্ত্রের ভাষায় বিতণ্ডা বললেই ঠিক হয়, অথবা কোন চ্যানেল বিশেষের বাগযুদ্ধ। কেউ কারও কথা শুনছে না, শুধু নিজের ডেসিবেল চড়িয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হল অ্যাস্টেরিক্স কমিকের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে গান ধরেছে ক্যাকোফোনিক্স।
এরমধ্যে মিত্তির, ভবানীপুরের ঘটি , আমাকে মিষ্টি করে জিগাইলেন—খুব গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ? বলি কাগজপত্তর ঠিক আছে তো? আফটার অল, তোমরা তো ওপার থেকে এয়েচ!
আমার ভ্যাবাগঙ্গারাম চেহারা দেখে উনি টীকা করলেন—আরে এন আর সি হলে প্রমাণ দিতে হবে না যে তুমি আসলে তুমিই, কোন অনুপ্রবেশকারী নও, বিদেশি নও? কাগজ আছে তো?
আরেকজন সদ্য দেশপ্রেমিক খিঁচিয়ে উঠলেন।
--ফালতু ভয় পাওয়াবেন না তো, সত্যজিৎ রায় যদি ভারতের নাগরিক হন তো শ্রীমান রঞ্জন রায়ও নাগরিক। হিন্দু, কায়স্থ এবং আদি বাড়ি, মানে বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে অবিভক্ত ভারতের ময়মনসিং জেলার গ্রাম।
-- ও, তাহলে বাঙালী হিন্দুদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলছ? যত ঝামেলা শুধু মোচলমানের?
আমি সাততাড়াতাড়ি সবার চেহারা দেখে নিলাম। এই গলিতে কোন মুসলমান প্রতিবেশি নেই। আমার বন্ধু আবদুল মতীনের বাড়ি দু-কিলোমিটার দূরে, অন্য পাড়ায় ।
--দেখুন, মাননীয় কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন যে এই নতুন সংশোধনী বিল বা ক্যাব কারও বিরুদ্ধে নয় । ভারতীয় মুসলমানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই বিল কাউকে বাদ দেওয়ার জন্যে নয় , তিনটে পড়শি দেশে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত রিফিউজিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যে।
--বেশ, তাহলে আসামে যে এন আর সি হল তাতে ১৯ লাখ লোক সন্দেহের তালিকায় ঢুকল, কিছু ডিটেনশন ক্যাম্পে গেছে। তাদের মধ্যে হিন্দুই বেশি। এটা কী করে হয়?
--দেখুন, এন আর সি আলাদা আর ক্যাব আলাদা। দুটো গোলাবেন না । ওটা সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে ওদের নজরদারিতে হয়েছে। এবার গোটা দেশে হবে।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ, মাননীয় এটাও বলেছেন যে খুঁজে খুঁজে সবকটা অনুপ্রবেশকারীকে ধরে দেশের বাইরে ছুঁড়ে ফেলব। এগুলো হল ঘুণপোকা।
--ভুল কি বলেছেন? সব পিলপিল করে কাঁটাতারের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ে। শস্তায় ঘরের কাজ, চা -পান-বিড়ির দোকান শুরু করে , আধার কার্ড, ভোটার কার্ড বানায়। তারপর খাবড়াগড়ের মত বোম বানায়। অথচ ভোটব্যাংকের তাগিদে দিদি বলছেন এন আর সি বঙ্গে হতে দেব না।
রিটায়ার্ড ইকনমিক্সের অধ্যাপক বাঁড়ুজ্জে হাত তুললেন।
--এইসব আইসোলেটেড ঘটনা নিয়ে ফোবিয়া তৈরি করে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে জিডিপি নামতে নামতে ৪% হচ্ছে, ৪৫ বছরের মধ্যে এমপ্লয়মেন্ট সবচেয়ে কমেছে। ব্যাংকে ফ্রড আর ব্যাড লোন বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজস্ব ঘাটতি। জিডিপি কালেকশন কমছে। শিক্ষা খাতে বাজেট কমছে। ভাঁড়ে মা ভবানী অথচ গোটা দেশে এন আর সি করে যজ্ঞে ঘি ঢালতে হবে?
--মানে?
--- আসামের যা খরচা হয়েছে (১২৫০ কোটি টাকা) তাকে জনসংখ্যা ৩ কোটি দিয়ে ভাগ করলে পাই মাথাপিছু খরচা ৪০০ টাকা। তাহলে ১৩৭ কোটির দেশে সবকটা রাজ্যে এন আর সি নামক অশ্বমেধের ঘোড়া দৌড়লে মোট খরচা হবে ৫৪৮০০ কোটি টাকা। বঙ্গে ৯ কোটি জনসংখ্যা; খরচা দাঁড়াবে অন্ততঃ ৩৬০০ কোটি টাকা। রাজকোষের যা হাল তাতে এটাই কি এখন টপ প্রায়োরিটি?
--- দেখুন, ভারত এখন ফাস্টেস্ট গ্রোইয়িং ইকনমি। এতবড় দেশ, তার কাছে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হাজার কোটি কতটুকু? মনরেগা প্রোগ্রামেও প্রায় অতটাই লাগে না? দেশের সুরক্ষা আগে; ঘুণপোকা না মারলে ভেতর থেকে ধ্বসে যাবে ।
পুরনো সিপিএম হালদার দেখলেন এই সুযোগ।
--আসামের অভিজ্ঞতা কী বলে? জেলে যাচ্ছে গরীব গুর্বো, খেটে খাওয়া মানুষেরা। যারা বুঝতেই পারেনি কি কি কাগজ চাই, কেন চাই, কোথায় পাওয়া যাবে? তাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বুড়োও জেলে যায়, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির ফকরুদ্দিন সাহেবের পরিবারের লোকেরও একই হাল। এত খরচা করে হল কি! এখন শাসক দল বলছে ভুল হয়েছে, আর একবার করতে হবে। লে হালুয়া!
আমার কান ঝালাপালা। আমি বুঝভম্বুল। আমি ক্রেংকটাকৃষ্ট হয়ে মিত্তিরের এঁটো চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কমরেডের আধখাওয়া পানামায় একটা কষে টান মেরে কাশতে থাকি। সভা হল নিস্তব্ধ।
মিনমিন করে বলি—আমাকে একটু সময় দিন। কালকের আড্ডায় আমি পেশ করব আমার দলিল, মানে ভারতে নাগরিক আইন কি বলে? মানে কারা এই দেশের নাগরিক আর কারাই বা অনুপ্রবেশকারী? এন এন আর সি আর ক্যাব ব্যাপারটা কী? খায় না মাথায় দেয়? এটাও দেখব সংবিধান কী বলে? আর কারও ভয় পাওয়ার কোন কারণ আছে কিনা।
মিত্তির ওঁর আধ কাপ চা মেরে দেওয়ায় খচে গেছলেন।
--বাঙাল আমাদের হাইকোর্ট দেখাবে? তুমি কে হে? কবে থেকে উকিল হলে?
আমি সবিনয়ে জানাই যে আমি উকিল-টুকিল নই, হরিদাস পাল। জ্ঞানগম্যি বিশেষ নেই। তবে আইনের স্নাতক, ওই টুকে পাশ করা। এই আড্ডায় কমনসেন্সের কথা বলব। বাকি আপনারা দেখে নেবেন। চোখে আঙুল দিয়ে ভুল ধরিয়ে দেবেন।
আমার দলিলঃ
ভাগ-১ (প্রশ্নোত্তরে সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট)
প্রশ্নঃ ভারতের নাগরিকত্ব আইন কবে তৈরি হল? তাতে কী কী পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা বলা হয়েছে, একটু ঝেড়ে কাশো দিকি।
উত্তরঃ প্রথমে বলা দরকার যে ভারতে নাগরিকত্ব ‘রক্ত সম্পর্কের অধিকার’ নীতি (জাস স্যাঙ্গুইনিস) মেনে তৈরি, ‘জন্মস্থানের অধিকার’ ( জাস সলি) নীতি মেনে নয়। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। আমেরিকার নাগরিকত্বের ধারণার ভিত্তি হল ‘জন্মস্থানের অধিকার’ (জাস সলি) নীতি, অর্থাৎ যেকোন দেশের অধিবাসী বা ভিন দেশের নাগরিকের কোন সন্তান যদি আমেরিকায় জন্মায় তাহলে বাচ্চাটি স্বতঃ আমেরিকান নাগরিক হবে, তার বাবা-মা’র নাগরিকতা এখানে বিচারণীয় নয়। কিন্তু ভারতবর্ষের নাগরিকতা মূলতঃ ভারতবর্ষীয় মূলের লোকজনের জন্যে। অর্থাৎ বাপ-মা যদি ভারতীয় উপমহাদেশের লোক বা স্বাধীনতার আগের বৃটিশ ভারতের লোক হয় তবেই সন্তান ভারতের নাগরিকতা পেতে পারে। এমনকি সে ভারতের বাইরে জন্মালেও বিশেষ শর্তের মোতাবিক। বিদেশি নাগরিকের সন্তান ভারতের নাগরিকত্ব পেতে হলে তাকে দীর্ঘকাল এদেশে নিয়মিত বাস করতে হবে এবং অন্যদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করে আবেদন করতে হবে। ভারত একাধিক দেশের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না।
ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৫ অনুযায়ী চারভাবে এদেশের নাগরিক হওয়া যায়; জন্মসূত্রে বা ভারতে জন্মালে, ভারতীয় নাগরিকের বংশজ হওয়ার সূত্রে, পঞ্জীকরণের সূত্রে এবং ন্যাচারালাইজেশন বা দীর্ঘকাল ভারতে বসবাসের সূত্রে।
ধারা-৩ জন্মসূত্রে।
ক) (ভারতীয় মূলের) কেউ যদি ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০ বা তার পরে এবং ১লা জুলাই, ১৯৮৭ পর্য্যন্ত ভারতে জন্মেছে তবে তাকে ভারতের নাগরিক বলে গণ্য করা হবে।
খ) পরে সংশোধিত হয়ে (ভারতীয় মূলের) যারা ১লা জুলাই, ১৯৮৭ থেকে নাগরিকতা সংশোধন আইন, ২০০৩ অনুযায়ী ৩রা ডিসেম্বর, ২০০৪ পর্য্যন্ত ভারতে জন্মেছে তারাও ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হবে যদি তাদের মাতা-পিতার মধ্যে কোন একজন ভারতের নাগরিক হয়ে থাকে।
গ) নাগরিকতা সংশোধন আইন, ২০০৩ অনুযায়ী যারা ৩রা ডিসেম্বর, ২০০৪ এর পরে জন্মেছে তারা গণ্য হবে যদি বাবা-মা’র দুজনই ভারতীয় নাগরিক হয় বা একজন ভারতীয় নাগরিক এবং অন্যজন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী না হয়।
টীকা ১ খেয়াল করুন, পাকিস্তানের নাগরিকও মূলতঃ আদি ভারতীয় উপমহাদেশের লোক; সে ধর্মে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ এবং ক্রিশ্চান—সবই হতে পারে ।
টীকা-২ তাহলে বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী কে ?
উত্তরঃ কোন বিদেশি যে যাতায়াতের বৈধ দস্তাবেজ, যেমন পাসপোর্ট-ভিসা, ছাড়া এ দেশে ঢুকেছে।
অথবা, যে বৈধ কাগজ পত্র নিয়ে এলেও অনুমোদিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় এদেশে রয়েছে।
ধারা -৪ বংশসূত্রেঃ
যে লোকটি ভারতের বাইরে জন্মেছে এবং জন্মের সময় তার বাবা-মার অন্ততঃ একজন ভারতীয় নাগরিক ছিল; সে যদি জন্মের ১ বছরের মধ্যে নিকটস্থ ভারতীয় দুতাবাসে পঞ্জীকরণ করিয়ে থাকে তাহলে আবেদন করে এই ধারা অনুযায়ী নাগরিকত্ব পেতে পারে।
ধারা -৫ পঞ্জীকরণ সূত্রেঃ
এটা তাদের জন্যে প্রযোজ্য যারা বিয়ে বা পারিবারিক সূত্রে কোন ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে যুক্ত।
ধারা-৬ ন্যাচারালাইজেশন বা দীর্ঘকালীন বসবাসের সূত্রেঃ
নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ এর ধারা ৬ বলছে আবেদককে প্রাকৃতিকবিধির অধীন নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দেওয়া যেতে পারে যদি সে ক) বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী নয়, খ) আবেদনের ঠিক আগে লাগাতার ১২ মাস ভারতে বসবাস করেছে, গ) ওই ১২ মাসের আগের ১৪ বছরে অন্ততঃ ১১ বছর ভারতে বাস করেছে।
ঘ) নতুন সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৯ বা ক্যাব এ ওই ১১ বছর কমিয়ে ৫ বছর করে দেওয়া হয়েছে।
ব্যতিক্রমঃ ভারত সরকার যদি মনে করে যে আবেদক বিজ্ঞান, দর্শন, কলা, সাহিত্য বা বিশ্ব শান্তির ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে তাহলে ওপরের সবকটি শর্ত সরিয়ে দিয়ে তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারে । তিব্বতি ধর্মগুরু দলাইলামা এবং পাকিস্তানি গায়ক আদনান সামী এই নিয়মের অধীন ভারতের নাগরিক হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিখ্যাত বৃটিশ বায়োলজিস্ট এবং স্ট্যাটিস্টিশিয়ান যে জে বি এস হ্যালডেন প্রশান্ত মহলানবিশের অনুরোধে কোলকাতায় নবগঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাস্টিস্টিক্যাল ইন্সটিট্যুটে যোগদান করেন। পরে তিনি বৃটিশ নাগরিকত্ব ছেড়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন—এই ধারায়।
মিত্তিরমশায় একটু গলেছেন। নরম সুরে বললেন—তাহলে ভায়া আমরা কোন ধারায় পড়ব, আর কেউ এসে ক্যাঁক করে চেপে ধরলে কী কাগজপত্তর দেখিয়ে বলব – হিন্দু হ্যায় হম, বতন হ্যায় হিন্দোস্তাঁ হমারা।
হালদার লাফিয়ে উঠেছেন—ধীরে ধীরে রজনী, ধীরে। অত উতলা হবেন না। ইকবালের লেখা ওই গানটার লাইনটি হল ‘হিন্দি হ্যায় হম’, হিন্দু-টিন্দু নেহি। ইকবাল ধর্মে মুসলমান ছিলেন ।
নবীন দেশপ্রেমিক মিনমিন করে বললেন—কিন্তু আমি যে সংস্কারভারতীর শাখায় ‘হিন্দু হ্যায় হম’ গাইতে শুনেছি।
প্রফেসর মুচকি হাসলেন। --ওরা ইতিহাস থেকে শুরু করে অনেককিছুই নিজেদের সুবিধেমত পালটে নিচ্ছে। ‘বন্দে মাতরম’ গানটিও গায় ‘কোটি কোটি কন্ঠ কলকলনিনাদকরালে ,কোটি কোটি ভুজইধৃতখরকরবালে’। কারণ ‘সপ্তকোটি’ কন্ঠ গাইলে ধরা পড়ে যাবে বঙ্কিম গানটি আদৌ গোটা দেশের কথা ভেবে লেখেননি, ওঁর সময়ের অবিভক্ত বাংলার জনসংখ্যার কথা ভেবে লিখেছিলেন। ক্রস চেক করুন, দাড়িদাদুর ‘সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী’।
মিত্তির ফের খচে গেলেন,- কাজের কতা হোক, আমার প্রশ্নের জবাব পেলুম নাকো।
--চিন্তা করবেন না । আমরা এখানে যারা গুলতানি করছি তারা সবাই ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ এর পরে এবং ১লা জুলাই, ১৯৮৭ তারিখের আগে জন্মেছি। কাজেই আমরা সবাই জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক—ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ, অ্যাক্ট, ১৯৫৫এর ধারা ৩ (১) (ক) অনুযায়ী। প্রমাণ হিসেবে আধার কার্ড, ভোটার আইডি, পাসপোর্ট এর যেকোন একটাই যথেষ্ট; কিন্তু আধার ও পাসপোর্টের ওজন বেশি। অধিকন্তু ন দোষায়। তবে দেখে নেবেন—নামের বানানটান যেন ইউনিফর্ম থাকে। মুখার্জি বা মুখোপাধ্যায়, যাই পছন্দ করুন সবজায়গায় একরকম হতে হবে। মোহম্মদ, মুহম্মদ বা মোঃ –কোন একটা সব কাগজে হওয়া চাই। সংশোধনের পদ্ধতি আছে, অনলাইনেও হয়। এটা একটু দেখে নেবেন।
সরকার খুশি হয়ে বললেন—ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো ভায়া। চা আনাও, আমি পয়সা দেব। কিন্তু ছেলেমেয়েরা? সবাই ভারতে জন্মেছে কিন্তু।
--যদি ১ জুলাই, ১৯৮৭র পরে না জন্মে থাকে তবে আপনার মতই –ধারা ৩(১)ক। যদি ১ জুলাই, ১৯৮৭ থেকে ৩রা ডিসেম্বর, ২০০৪এর মধ্যে জন্মে থাকে তাহলে ধারা ৩(১)খ। মানে ওর জন্মের সার্টিফিকেট এবং আপনার বা গিন্নির (বাবা-মা) আধার কার্ড যথেষ্ট। আর আপনার নাতি-নাতনী? যদি ৩রা ডিসেম্বর, ২০০৪ এর পরে ভারতে জন্মে থাকে, অর্ত্থাৎ ধারা ৩(১)গ, তাহলে ওদের বার্থ সার্টিফিকেট এবং আপনার ছেলে ও ছেলেবৌ –দুজনেরই আধার ও ভোটারকার্ড লাগিয়ে দেবেন। আবার বলি, এসব ক্ষেত্রে অধিকন্তু ন দোষায়।
সবার মুখে হাসি ফুটেছে। কিন্তু অধ্যাপক মাথা চুলকোচ্ছেন। হল কী?
--এই সব লেকচার আমার কোন কাজে লাগবে না। কারণ আমি জন্মেছি ৭ই জানুয়ারি, ১৯৫০। আমার কী হবে?
সবাই চুপ।
উনি বিড়বিড় করতে থাকেনঃ সংবিধান জন্ম নিল ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০ আর আমি জন্মালাম ১৯ দিন আগে। ক্যান? আর উন্নিশদিন পরে জন্মাইলে কি হইত? কেডা মাথার দিব্যি দিছল?
মিত্তির গুণগুণ করেন—ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ড কোথায় পেলি? সত্যিই তো, ভারত স্বাধীন হল, দেশভাগ হল। কিন্তু যারা সংবিধান হওয়ার আগে মাউন্টব্যাটেন জমানায় জন্মালো তাদের জন্যে আম্বেদকর কোন ব্যবস্থা করেননি? একি অনাসৃষ্টি!
নবীন দেশপ্রেমিক জোরগলায় বলেন সেইসব ভুল, অব্যবস্থা দূর করতেই তো মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী “ক্যাব” সংশোধন এনেছেন। যারা পাকিস্তান থেকে এসে সত্তর বছর ধরে নাগরিকতা পায়নি তারা এবার পাবে।
একটা ঝগড়া শুরু হয় আর কি! আমি প্রায় রায়ট পুলিশের মত ঝাঁপিয়ে পড়ি।
--আপনারা থামবেন? ওঁরা এত বোকা ছিলেন না। একবার সংবিধান সভার ডিবেটগুলো পড়বেন। ওগুলো ইন্টেলেকচুয়াল অ্যাসেট।
যাকগে, সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের বিষয় হল নাগরিকত্ব-- আর্টিকল ৫ থেকে আর্টিকল ১১ পর্য্যন্ত ।
আর্টিকল ৫(ক) বলছে সংবিধান পাশ হওয়ার সময় যারা ভারতের ভুখন্ডে জন্মেছে এবং ভারতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেছে তারা সবাই ভারতের নাগরিক। আপনি তো জন্মের পর থেকে ভারতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, পড়াশুনো, চাকরি সব এখানে। ভোটার কার্ড, আধার সবই হয়েছে, কোথাও আটকায়নি?
--না; এমনকি পাসপোর্ট বানিয়ে আটালান্টাতে ছেলের কাছে গিয়ে নাতির মুখেভাত করিয়ে এসেছি।
--দেখলেন তো? আপনি আর্টিকল ৫(ক) হিসেবে নাগরিক। নইলে পাসপোর্ট দিত? আরও দেখুন। আর্টিকল ৬ অনুযায়ী যাদের বাবা-কাকারা ১৯শে জুলাই, ১৯৪৮ এর আগে পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন তারা সবাই ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে।
এবার হালদারের অবাক হওয়ার পালা। আমার বাবা তো জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে খুলনা থেকে কোলকাতায় এলেন। কিন্তু ওঁর ভোটার কার্ড হয়েছিল। সেটা কি বে-আইনি?
--আদৌ নয়। উনি নিশ্চয়ই আসার ছ’মাস পরে নিয়মমাফিক ভারত সরকারের অধিকৃত অফিসারের কাছে নিয়মমাফিক আবেদন করেছিলেন, তাই রেজিস্টারে নাম উঠেছিল।। (আর্টিকল ৬(খ)(১) (২)।
--আচ্ছা, আমার নাতি তো আমেরিকার আটালান্টায় জন্মেছে? ওর জন্যে কী করতে হবে?
--কিচ্ছু করতে হবে না। আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী ও জন্মসূত্রে ( জাস সোলি) ওদেশের নাগরিক। বাকিটা ওর বাবা-মাকে ভাবতে দিন। আপনার কিসে ইল্লি হচ্ছে? কমরেডের নাতি সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার নাগরিক? ধুত্তেরি! সে রামও নেই , সে অযোধ্যাও নেই।
-- এবার এন আর সি, ক্যাব এবং আসাম নিয়ে দু’পহা হোক।
--কালকে; আজ গলা শুকিয়ে গেছে।
ভাগ-২
নাগরিক পঞ্জী, ক্যাব এবং আসাম সমঝোতা ১৯৮৫
ভারতে প্রথম ১৯৫১ সালে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন (এন আর সি) শুরু হয়। তারপর কোন সরকারই ওই পঞ্জী বা রেজিস্টার আপডেট করার প্রয়োজন অনুভব করেনি।
কিন্তু নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ বেশ কয়েকবার সংশোধিত হয়েছে। যেমন, ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩। ওই ২০০৩ এর সংশোধন সরকারকে এন আর সি ম্যান্ডেটরি বলে নির্দেশ দিল। কেন? এ না হলে আসাম সমঝোতা ১৯৮৫ অনুযায়ী ‘বিদেশি’চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না।
তাহলে আগে আসাম সমঝোতা ১৯৮৫ নিয়ে কথা বলা দরকার। এটি পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের (পড়ুন মুখ্যতঃ বাঙালী হিন্দু) বে-আইনি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ছ’বছর গণ আন্দোলনের ফসল। এই সমঝোতায় ১৫ অগাস্ট, ১৯৮৫ তারিখে ভারত সরকার, আসাম রাজ্য সরকার, অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদ দস্তখত করে।
আপনাদের খারাপ লাগতে পারে কিন্তু দার্জিলিং এর গোর্খাদের মত আসামীদেরও ভয় যে বাঙালীরা( হিন্দু বা মুসলিম), বিশেষ করে যারা বাংলাদেশ থেকে জীবিকার বা আশ্রয়ের খোঁজে আসামে প্রবেশ করছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেলে খোদ আসামীদের জীবিকা, সংস্কৃতি এবং স্বতন্ত্র পহচান বিপন্ন হবে।
আসাম সমঝোতা ১৯৮৫ এবং নাগরিকতার রাষ্ট্রীয় পঞ্জীকরণ (এন আর সি)
.১ ওই সমঝোতার ফলে আসামের জন্যে নাগরিকত্বের কাট -অফ ডেট হল ১লা জানুয়ারি ১৯৮৭ না হয়ে ২৪ মার্চ, ১৯৭১। কারণ, ১৯৭১এ স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে হিন্দু (বাঙালী) শরণার্থী আসামে ঢোকে ।স্থানীয় অভিবাসীদের ভয় এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেলে বাঙালী সংস্কৃতির আগ্রাসনে অহোমিয়াদের পরম্পরাগত ভাষা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তাই ২৪ মার্চ ১৯৭১ এর পরে বাইরে থেকে যাঁরা আসামে এসেছেন তাঁদের আসামে বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী ‘বিদেশি’ বলে গণ্য করা হবে।
২ আসামের জন্যে এন অ্যার সি বা নাগরিকত্বের রাষ্ট্রীয় পঞ্জীকরণের তারিখটিও ওই ২৪ মার্চ ১৯৭১। এর মানে যাঁরা আসামে বসবাস করছেন কিন্তু এখানকার স্থানীয় বাসিন্দে নন, তাঁদের দস্তাবেজী প্রমাণ দিতে হবে যে তাঁরা ২৪ মার্চ ১৯৭১ বা তার আগে থেকেই আসামে এসেছিলেন বৈধ নাগরিক হিসেবে বা উপযুক্ত কাগজপত্র নিয়ে ।
নইলে তাঁদের অনুপ্রবেশকারী ধরে নিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে পুরে দেওয়া হবে। তার আগে এইসব চিহ্নিত মানুষজনদের ফরেন ট্রাইব্যুনালের কাছে আপিল করে নিজেদের বৈধ অধিবাসী বলে প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হবে।
আসাম সমঝোতার ধারা ৫.৮ অনুযায়ী ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ বা তার পরে আসামে অনুপ্রবেশ করা বিদেশিদের চিহ্নিত করে ভোটার লিস্ট এবং নাগরিক পঞ্জী থেকে তাদের নাম কেটে দেওয়া হবে এবং শেষে তাদের রাজ্য থেকে বের করে দেওয়ার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিদেশি চিহ্নিতকরণের পদ্ধতিটি বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী (ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে) আইন, ১৯৮৩তে বর্ণিত রয়েছে, তবে এটা শুধু আসামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই আইনটি ২০০৫ সালে সুপ্রীম কোর্ট সংবিধানের পরিপন্থী বলে খারিজ করে দেয়। আবেদক সর্বানন্দ সোনওয়াল (বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী) তখন বলেছিলেন যে এর ধারাগুলো এমন কড়া যে বাস্তবে এর সাহায্যে বে-আইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণ এবং নির্বাসন প্রায় অসম্ভব।
২০১৩ সালে ‘আসাম পাবলিক ওয়ার্কস’ নামে একটি এনজিও’র আবেদনে রায় দিয়ে সুপ্রীম কোর্টের খবরদারিতে আসামে এই কাজ শুরু হয়। শেষ হলে দেখা গেল ৩ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১৯ লক্ষ চিহ্নিত হলেন অনাগরিক হিসেবে। ফলে ১০০ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ করিয়ে নতুন করে অনেক ডিটেনশন ক্যাম্প বানানো হচ্ছে। বিজেপির মুসলিম অনুপ্রবেশের সমস্ত গল্পকে ভুল প্রমাণ করে দেখা গেল এদের মধ্যে বেশিরভাগই বাঙালী হিন্দু। অসমিয়ারা চান ওই ১৯ লক্ষ ‘বিদেশি’দের আসাম থেকে গলাধাক্কা দিতে; আপাততঃ সব নাগরিক সুবিধে থেকে বঞ্চিত করে ডিটেনশন ক্যাম্পে। কিন্তু বিজেপি যে বাঙালি হিন্দুদের ‘তোমাদের কিচ্ছু হবে না’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়েছিল!
হতাশ বিজেপি নেতৃত্ব বললেন এই সার্ভে ভুল। আবার নতুন করে হোক। সুপ্রীম কোর্ট রাজি নয় । তখন দ্রুত এল আরেকটি সংশোধন—সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল বা ক্যাব, যা ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখে রাষ্ট্রপতির মোহর লেগে আইন হয়ে গেছে। এর সঙ্গে আসাম সমঝোতা, ১৯৮৫র এবং আসামে বর্তমান ক্যাব বিরোধী আন্দোলনের সম্পর্ক নিয়ে এরপরে বলছি ।
ক্যাব বা নাগরিকত্ব সংশোধন বিল, ২০১৯
এই সংশোধন অনুযায়ী প্রতিবেশী নির্দিষ্ট তিনটি রাষ্ট্র, যথা পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ এবং তার আগে ধর্মীয় উৎপীড়নের ফলে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি এবং ক্রিশ্চানদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এতে মুসলিমরা বাদ।
বলা ভাল যে ভারতে বেআইনি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া বা শরণার্থী বলে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে কোন রাষ্ট্রীয় নীতি ছিল না। স্বরাষ্ট্র দপ্তর রিফিউজি বলে দাবি করা বিদেশের নাগরিকদের ব্যাপারে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে বিচার করে হয় ওয়ার্ক পারমিট (তিব্বতি রিফিউজি, চাকমা শরণার্থী) বা দীর্ঘকালীন ভিসা দিত (তসলিমা নাসরিন)। লক্ষণীয় যে ভারতের নাগরিকত্ব আইনে (১৯৫৫) অল্পসংখ্যক বা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোন ধারা ছিল না। বর্তমান সংশোধনে সেই অভাব দূর হল; কিন্তু নাগরিকতা প্রদান করার ভিত্তি হল ধর্মীয় পরিচয় যা সংবিধানের মূল ভাবনার পরিপন্থী। তবে ভারতের সংবিধানের আর্টিকল ৬ অনুযায়ী প্রাক্তন পশ্চিম(বর্তমানে শুধু পাকিস্তান) ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) থেকে জুলাই, ১৯৪৮এর আগে ভারতে আগত শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তাতে শরণার্থীদের মধ্যে ভাষা বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কোন বিভেদ করা হয়নি।
এই প্রথম এবিষয়ে একটি আইন করা হল। কিন্তু মুসলিমরা বাদ কেন ?
কারণ হিসেবে সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে ওই তিনটি রাষ্ট্র ঘোষিত ভাবে ইস্লামিক দেশ। ফলে সেখানে মুসলিমদের ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হবার প্রশ্ন ওঠে না। এবং এই তিনটি দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হতে পারে না। সত্যিই কি তাই?
লক্ষণীয়, পাকিস্তানে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় সংবিধান সংশোধন আইনে মুসলিম বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। ওদের পক্ষে পাকিস্তানে নিজেদের মুসলিম ঘোষণা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। ওদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানে ইসলামের সুন্নী শাখাকে একমাত্র খাঁটি ইসলাম বলে রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়ায় অল্পসংখ্যক শিয়া শাখার অনুগামীরাও উৎপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন। আফগানিস্তানে হাজিরাদের উপর অত্যাচার নিয়ে ‘কাইট রানার’ উপন্যাস এবং সিনেমা এখন গোটা বিশ্বের নজরে। আর বর্তমান বাংলাদেশে নাস্তিকতার কারণে উগ্র ইসলামিক সংগঠন যাদের হত্যা করেছে তাদের মধ্যে হিন্দু এবং মুসলিম দুইই আছেন। প্রশ্ন ওঠে, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ তো বন্ধু রাষ্ট্র। তাদের সরকারের কাছে আমরা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন নিয়ে কিছু বলেছি কিনা।
বাদ যাওয়া অন্য প্রতিবেশি দেশগুলো -
বাদ গেছ শ্রীলংকা, মায়ানমার এবং চিনের নামও।
চিনে উইঘুর উপজাতি মুসলিমদের উপর অত্যাচারের কথা কয়েক দশক ধরে প্রকাশ্যে আসছে। ইদানীং বিখ্যাত জার্মান ফুটবলার মেসুট ওজিল এ নিয়ে প্রতিবাদ করে হইচই ফেলে দিয়েছেন।
২০১৬ সালে আমেরিকার কমিশন ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের উল্লংঘনের দায়ে টিয়ের-১ দেশ বোলে চিহ্নিত করেছে। এই কমিশনই আবার ডিসেম্বর ২০১৯শে ভারতের ক্যাবকে ডিস্ক্রিমিনেটরি বলে সমালোচনা করেছে। অগাস্ট ২০১৯শে ইউ এস, ইউকে এবং কানাডা চিন ও পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর উৎপীড়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গিয়া মুসলিমদের উপর অত্যাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা চলছে। শ্রীলংকায় তামিলদের উপর অত্যাচারএর ইতিহাস তো কয়েক দশকের। ইদানীং মুসলিমদের উপরও শুরু হয়েছে। শ্রীলংকা এবং ভূটানের স্টেট রিলিজিয়ন হল বৌদ্ধধর্ম। অমিত শাহের যুক্তি তাতে কি, ইসলাম তো নয়।
তাহলে একমাত্র ইসলামিক দেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার হয়?
অমিত শাহ সংসদে জোর গলায় তিনটে কথা বলেছেন।
এক, কোন রোহিঙ্গিয়া মুসলিম শরণার্থীকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া হবে না ।
দুই, ভারতের সমস্ত রাজ্যতে এন আর সি করিয়ে সমস্ত অনুপ্রবেশকারী ঘুণপোকাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা হবে।
তিন, ভারতের নাগরিক মুসলমানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় উক্তিগুলিকে আমরা একটু খুঁটিয়ে দেখব।
লক্ষণীয় যে মুখে যাই বলা হোক, মূল আইনের টেক্সটে ‘ধর্মীয়’ না বলে কেবল ‘উৎপীড়িত সংখ্যালঘু’ বলা হয়েছে।
প্রশ্নঃ বর্তমান ভারতে অনুপ্রবেশকারী কে ও কারা? কারা সেই ঘুণপোকা?
প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন পাকিস্তান-বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে আসা লক্ষ কোটি অমুসলিম শরণার্থী এদেশে ‘রাষ্ট্রহীন’ পরিচয়ে চিহ্নিত হয়ে নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে হীন জীবন যাপন করছেন। এই সংশোধনের ফলে তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে মানবিক দায়িত্ব পালন করা হবে। বেশ কথা। কিন্তু সরকারের চোখে এই শরণার্থীদের বাস্তব সংখ্যাটি কত? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে ২০১৬ সংসদে জানানো হয়েছিল যে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ পর্য্যন্ত এই সংখ্যাটি হল ২,৮৯,৩৯৪। এর মধ্যে সব ধর্মের লোকই আছে।
রাষ্ট্র শরণার্থী
বাংলাদেশ ১,০৩,৮১৭
শ্রীলংকা ১,০২,৪৬৭
তিব্বত ৫৮, ১৫৫
ম্যানমার ১২, ৪৩৪
পাকিস্তান ৮,৭৯৯
আফগানিস্তান ৩,৪৬৯
অন্যান্য ২৫৩
_______________
মোট ২,৮৯,৩৯৪
(সূত্রঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯, পৃ-১৬)।
দেখুন, শ্রীলংকা এবং মিয়ানমার বাদ! তাহলে আসল ব্যাপারটা কী?
প্রশ্নঃ এই আইন কি ভারতের সব রাজ্যে সমান ভাবে প্রভাবশীল হবে?
উত্তরঃ না ; বাদ যাবে সিকিম (আর্টিকল ৩৭১এর উপধারায় বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজ্য), এবংত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয় এবং আসামের চিহ্নিত আদিবাসী অঞ্চলটুকু (সংবিধানের ষষ্ঠ তালিকায় আছে বলে)। এছাড়া বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন ১৮৭৩ এর অধীন ইনার লাইন পারমিট (যাতে বাইরের লোকের এলাকায় ঢুকতে বেরোতে স্পেশাল পারমিট নিতে হয়) ব্যবস্থার ফলে প্রায় সম্পূর্ণ নাগাল্যান্ড, মিজোরাম এবং অরুণাচল প্রদেশ এই আইনের আওতার বাইরে থাকবে।
প্রশ্নঃ এই আইনে কাদের লাভ? কাদের লোকসান?
উত্তরঃ আফগানিস্থান, পাকিস্থান এবং বাংলাদেশ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের আগে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি এবং ক্রিশ্চান সম্প্রদায়ের লোকজন যদি ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করে নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করে তবে তাদের কোনরকম দস্তাবেজি প্রমাণ ( কোন তারিখে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং ধর্মীয় কারণে প্রতাড়িত হয়েছে তার প্রমাণ?)ছাড়াই চটপট নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে।
ইদানীং আসামে যে এন আর সি হয়েছে তাতে দস্তাবেজি প্রমাণের অভাবে যে ১৯ লক্ষ লোককে ‘বিদেশি’ দেগে দিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে ফেলে রাখা হয়েছে তাদের বৃহৎ অংশটিই হিন্দু। তারা এই নতুন সংশোধনের ফলে মুক্ত হয়ে কোন দস্তাবেজ ছাড়াই নাগরিক হয়ে যাবে। তাদের আবেদনে খালি বলতে হবে যে তারা ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে অমুক দেশ (ওই তিনটির কোন একটি) থেকে পালিয়ে এসেছে।
কিন্তু দেগে দেওয়া মুসলিমরা এই সুযোগ পাবে না। ফলে তাদের বন্দী হয়ে থাকতে হবে নইলে অন্য কোন দেশে ঠেলে দেওয়া হবে। কে নিতে চায়?
প্রশ্নঃ আসামের লোকজনের ,বিশেষ করে বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা দলগুলির এই আইন নিয়ে রাগারাগির কারণ কী?
উত্তরঃ দেখুন , শাসক দলের মন্ত্রীরা বলছেন এন আর সি এবং এই ক্যাব বা সংশোধনী আইন আলাদা। কিন্তু আসামের লোকজন সেটা মানছে না । বলছে ওদের দাবিতে এইমাত্র এন আর সি হল। আসাম সমঝোতা অনুযায়ী ১৯ লক্ষ অনাবাসীদের চিহ্নিত করা গেল, এবার বের করে দেওয়া যাবে। এ’ব্যাপারে ওদের হিন্দু-মুসলিম নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। অনাবাসী বাঙালীদের বের করতে হবে। কিন্তু এই সংশোধনী আইনের ফলে হিন্দু বাঙালীরা, মানে ১৯ লক্ষের সিংহভাগ লোকজন নাগরিকত্ব পেয়ে আসামে মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসবে। এ তো আসাম সমঝোতা ১৯৮৫র মূল ভাবনার পায়ে কুড়ুল মারা! এ তো বলতে গেলে বিশ্বাসঘাতকতা!
প্রশ্নঃ ভারতের মুসলিমদের আদৌ ভয় পাওয়ার কোন কারণ আছে?
উত্তরঃ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারংবার বলছেন—ভয় নাহি, ভয় নাহি, রে ভয় নাহি! এই সংশোধনের উদ্দেশ্য কাউকে দেশ থেকে বের করা নয়, বরং কিছু সহায়সম্বলহীন শরণার্থীদের সসম্মানে নাগরিকের স্বীকৃতি দেওয়া। এতে মুসলমানদের ক্যান ইল্লি হচ্ছে?
ঠিক কথা, এই আইনে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মুসলমানের বিরুদ্ধে একটিও শব্দ নেই; তবে?
কিন্তু উপরের আসামের উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট যে এন আর সি হয়ে দস্তাবেজের অভাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়া মুসলমানদের জন্যে এই সংশোধনে কোন গাছের ছায়া নেই। এবং অমিত শাহ সমানে হুঙ্কার দিচ্ছেন যে আসামের পর সমস্ত রাজ্যে ওভাবেই এন আর সি হবে আর বে-আইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে দেশের বাইরে বের করে দেওয়া হবে।অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে অশিক্ষিত গরীব খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে ঠিকমত কাগজপত্র সামলে রাখা এবং অফিসারের সামনে পেশ করা বেশ কঠিন। তাই ওই ১৯ লক্ষের মধ্যে ওরাই বেশি। ভবিষ্যৎ এন আর সিতেও এই গরীবগুর্বো চাষাভুষো কুলিমজুরের দলই বেশি করে সন্দেহভাজনের তালিকায় উঠবে। তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ইসাই সবাই থাকবে কমবেশি। কিন্তু নতুন সংশোধনীর সুযোগে রেহাই পাবে অন্য সবাই। আটকে যাবে মুসলিমরা। ওরা কোথায় যাবে? পাকিস্তানে? বাংলাদেশে?
সবচেয়ে বড় কথা, এই আইন মুসলিমদের বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তোমরা বাকি সবার থেকে আলাদা। তোমাদের অস্তিত্বকে আমরা ভুলে যাই বা কোনরকমে সহ্য করি।
সন্নাটা! সন্নাটা!
গলা খাঁকারি দিয়ে হালদার বললেন—একটা কথা। আমার ছেলে কাল আটালান্টা থেকে ফোনে বলল যে এই আইনে নাকি ‘ও সি আর’ কার্ড হোল্ডারদের সুবিধে দেওয়া হয়েছে যে তারা বিনা ঝামেলায় ভারতে আসা যাওয়া, পড়াশুনো বা কোন প্রজেক্টে কাজ করতে পারবে?
--অ, তাহলে আপনার পার্টির ডাকা প্রতিবাদ মিছিলে যাচ্ছেন না ?
-- কি যে বলেন মিত্তিরদা!
1 comments: