1

গল্প - মৌসুমী পুপুল

Posted in

গল্প


আবীরের রং ধূসর
মৌসুমী পুপুল



।প্রথম পাঠ।

সেবার দোল পূর্ণিমা আরো এক চুটকি রঙ যেন বেশি গুলে দিয়েছিলো বাঁড়ুজ্জেদের রাসমঞ্চে রাখা বিশাল পিতলের গামলাটায়। বাড়ির পাঁচিলে উঠোনে কুয়োতলায় লাল, সবুজ রঙের কলঙ্ক কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে সকালের রঙিন লীলার। সূর্য তখন তার ক্লান্ত গেরুয়া উত্তরীয় টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে, তার মাধুকরী সারা হলো সেদিনকার মতো। সারাদিন পথে পথে ফাগের ঘুর্ণী উড়িয়ে পাগলা হাওয়াটা গিয়ে শালের পাতায় পাতায় নাচন লাগিয়ে দিয়েছে। বুড়ো শালপাতারা এ পাগলামি সইতে পারে না মোটে, তারা ঝরঝর খরখর করে ক্রমাগত খসে পড়ে প্রতিবাদে। মরচে ধুলোর পথঘাটে পথিকের পায়ের নিচে মুড়মুড় করে ভেঙে যায় তাদের বেলাশেষের অভিমান। একটু পরে তামার টাটের মতো চাঁদ উঠবে, মহুয়ায় ঝিমঝিম করবে সাঁঝবেলার বাতাসটা। অনেক দূরে নদীর পাড়ের গৌরাঙ্গ মঠে প্রার্থনার ঘন্টা পড়বে থেমে থেমে... ঠং ঠং ঠং....

দ্রুতগতিতে সাইকেল চালিয়ে রাঙামণি বাড়ি ফিরছে। ওর ঢোলা পাজামা পত পত করে উড়ছে। কপালে গুলাবী আবীরের গুঁড়োর পাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তেষ্টায় ঠোঁট মুখ শুকিয়ে এসেছে ওর। সন্ধ্যের আগে বাড়ি পৌঁছতেই হবে। পনের বছরের রাঙামণির কাঁধে বিরাট একটা দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে তার বড় বো'ঠান্। বাঁড়ুজ্জেবাড়ির বড় বৌমা। রাঙাদের বৌদি নয় শুধু, বর্তমানে বাড়ির ক্যাপ্টেন। মেজ বো'ঠান তো মাত্র দু' বছর হলো এসেছে এবাড়িতে।

ঠাকুরঘরের দালানে ফুট কড়াই, গুলিকদমা, গোলাপী-হলুদ মঠ, নোনতা গজার হরির লুট শুরু হবে একটু পরেই। পাড়ার বাচ্চাকাচ্চার দল কাড়াকাড়ি করে কুড়োবে। তার আগে বাড়ি ঢুকে খবরটা দিতেই হবে।

এই তো একটু আগে হাসপাতালের লম্বা করিডোরে কাঠের বেঞ্চে বসেছিলো সে, চোখ ভেঙে ঘুম নামছিলো, ঘাড় বারবার এলিয়ে পড়ছিলো ফুলদা'র কাঁধে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিরক্তি দেখিয়ে ফুলদা বলেছিলো -- রাঙা, এখন ঘুমোবার সময় না। মেজ বো'ঠান কত কষ্ট পাচ্ছেন জানিস! বড় বৌদি,মেজদা, সেজদা সেই কখন থেকে ওই ঘরটার সামনে। নার্সেরা ছোটাছুটি করছে, বড় ডাক্তার এসে দু'বার ঘুরে দেখে গেলেন, দেখতে পাচ্ছিস তো! বিপদের সময়... তোর সাইকেলের চাকা ঠিক আছে তো?

রাঙামণি একটু লজ্জা পেল, সত্যি এখন কেউ ঘুমোয়! ও একটু নড়েচড়ে বসলো, আসলে বন্ধুদের চাপাচাপিতে একটুস্ সিদ্ধি খেয়েছে আজ। ফাগুয়ায় এটাই রেওয়াজ এখানে, আর খেয়েছে দু'চামচ রসমালাই। তাতেই একটু মৌতাত।

শ্যামকিষনের বাড়ির গলিতে সবাই মিলে হুটোপুটি করে সারা সকাল হোলি খেলেছে। বাড়ি ফিরে স্নান খাওয়া সেরে একটা লম্বা ঘুম দেবে মনে করেই সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিলো রাঙা, পোস্ট অফিসের মোড়ে দেখে ফুলদা উদভ্রান্তের মতো হেঁটে আসছে। ওকে দেখে যেন হাতে চাঁদ পেল।

-- রাঙা! শিগগির চল। হাসপাতাল। হাসপাতাল। মেজ বো'ঠানকে নিয়ে ওরা এগিয়ে গেছে মাথুর সাহেবের গাড়িতে। আমারও যাওয়ার দরকার। বিপদের সময়....

ক্যারিয়ারে ফুলদাকে বসিয়ে টিকিয়া উড়ান্ স্পীড তুললো রাঙা।

সেজদা গম্ভীর মানুষ, আজ আরও যেন গম্ভীর। করিডোরের অন্যদিকটায় দাঁড়িয়েছিলো ঠায়। ভুরুতে চিন্তার ভাঁজ। রাঙাকে দেখে বলেছিলো -- তুই আবার এখানে কেন? এঃ! রঙ টঙ মেখে... যা বাড়ি চলে যা।

সেজদাকে খুব ভয় রাঙার, ও তৎক্ষণাৎ ফিরে যাচ্ছিলো। বড় বো'ঠান ভিজিটার রুম থেকে বেরিয়ে এসে সেজদাকে ডেকে বললো -- না সেজ্ঠাকুরপো,ও একটু অপেক্ষা করে যাক, ঠাকুরঘরের ব্যবস্থাটা....ওর সাইকেল আছে, ওই খবরটা নিয়ে যাবে খ'ন।

রাঙা প্যাডেলে চাপ দিলো আরও জোর। সাদা তোয়ালে মোড়া এত্তটুকু একটা পুঁচকে! কিঁও কিঁও করে কাঁদছে.. বড় বো'ঠানের কোলে।

-- নাও মেজ ঠাকুরপো, তোমার কন্যে! দেখো দোলের দিনে বাঁড়ুজ্জেবাড়িতে লক্ষ্মী এলো গো!

সেজদার ভুরু সোজা হয়েছে এতক্ষণে, হাসি মুখ। মেজদা কেমন লাজুক মুখ করে তাকালো সবার দিকে, চোখের কোনায় চকচক্ করছে জল। ফুলদা একগাল হেসে বললো – হেঃ! বাঁড়ুজ্জেবাড়ির নতুন জেনারেশনও শুরু হয়ে গেল! বাঃ! আমরা তাহলে বুড়ো হতে চল্লাম! হে হে...

ফুলদা'টা এমনই কথা বলে। কে বলবে ওর বয়স এখন উনিশ বছর মোটে!

বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোট কাকুমণি, ঘন ঘন চুরুটে টান দিচ্ছে। উনি বাড়ির ছোট কর্তা। রাঙা দেখলো তার মা দাঁড়িয়ে ঠাকুর দালানে, হাতে বেতের মস্ত ধামা। রাজ্যের বাচ্চাকাচ্চা হল্লা লাগিয়েছে তাকে ঘিরে। কাকুমণি ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো,জিজ্ঞেস করলো -- কি সংবাদ হে দূত?

থতমতো খেয়ে রাঙা বলে -- ওই তো, চার পাউন্ড না কতো যেন! মাথায় অনেক চুল। খুব কাঁদছে।

রাঙার মা পাশে চলে এসেছে ততক্ষণে -- কি জ্বালা! ওরে ছেলে হয়েছে না মেয়ে সেটা জানিস না হতভাগা?

একগাল হেসে রাঙা বললো -- ওই তো, একটা মেয়ে হয়েছে। মা আর বেবি ভালো আছে নার্সটা বললো।

-- যাক্ বাবা। জয় রাধানাথ। রাঙার মা বলে। -- ও ঠাকুরমশাই... কাল থেকে মন্দিরে ভোগ দিতে পারবেন না তো, জল তুলসী দিতে হবে শুধু... শুভ অশোচ শুরু হোল...দুলু বাবার মেয়ে হয়েছে...

কাকুমণি ধমকে ওঠেন -- বাড়িতে রাধারাণী এলো আর তোমরা রাধানাথের ভোগ বন্ধ করে দিচ্ছো! আশ্চর্য!!

-- এ্যাই ঘোষাল ঠাকুর... আমাদের না'হয় বারণ আছে, তুমি এই ক'দিন নিজের গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে বৃন্দাবন পণ্ডিতের দোকান থেকে শুদ্ধ্ ঘীউ কা লাড্ডু, বালুসাই, কালাকান্দ আনিয়ে ভোগ চড়াবে, দুধ মালাই চড়াবে আমি বলে দিলাম।

বাড়ির বড় কর্তা সতীশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাঙার জেঠাবাবু চটি ফট ফটিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন এরই মধ্যে। ছোটকর্তা ভয় খেলেন এবার। সতীশ হলেন তাঁর বড়দা, জেলা আদালতে হাকিম ছিলেন।এখন অবসর নিয়েছেন। সতীশ হলেন ঋষি দুর্বাশার অবতার,সাংঘাতিক রাগ তাঁর। তেমন বাছ বিচার। তিন বেলা জপ আহ্নিক করেন। রামায়ণ, ভাগবত নিয়েই তাঁর দিন কাটে। শনির দশা, মঙ্গলের দৃষ্টি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান আজকাল বড্ড বেশী।

মেজো বউমার কন্যা সন্তান হয়েছে জানলে তিনি কি রিয়্যাকশন দেবেন, তা কাকুমণির অজানা। রাঙার মাও তাড়াতাড়ি সরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সতীশ জলদ গম্ভীর স্বরে ভাতৃবধূকে বললেন -- ছোটবাবু ঠিকই বলচেন, বৌমা। শুভ অশৌচে রাধানাথের পরমান্ন সেবা বন্ধ রাখা হলেও তাঁর জন্য নিত্য মিষ্টান্ন সেবার ব্যবস্থা করো। আর তোমার বড়দি গেলেন কোথায়? শাঁখ টাক বাজানোর কথা কি আমায় বলে দিতে হবে? শোন বৌমা... আজ হরির লুটে বাচ্চাগুনো কে প্রাণ ভরে মঠ, কড়াই, মেঠাই খাওয়াও। আমরা সব নতুন ঠাকুরদা ঠাকুরমা হলুম যে!

এরপর যা শুরু হলো বাড়ি জুড়ে! জোড়া শাঁখ বেজে উঠলো, উঠোনে বাচ্চারা হুটোপুটি করে লুটের মিষ্টি কুড়োতে লাগলো, মেজো কর্তা সন্তোষ আছেন বেঙ্গলী ক্লাবে,তাঁকে খবর দিতে লোক ছুটলো। বাড়ির আর বাকি সদস্যরা এঘর ওঘর ছোটাছুটি করে সবাই সবাইকে আনন্দ সংবাদ জানাতে লাগলো। ঠাকুরদালানে ঘোষাল ঠাকুর জোরে জোরে ঘন্টা দুলিয়ে দিলেন।

বাঁড়ুজ্জেবাড়ির সর্বময়ী কর্ত্রী বুড়ো কর্তাদের মা অতিবৃদ্ধা 'খাঁদি ঠাকরুণ' তাঁর সান্ধ্যকালীন আফিমের চটকা ভেঙে জেগে উঠে বল্লেন -- ও ছোটখোকা আ... আমার গুড়গুড়িটা ঝি বেটি কোথায় নুকিয়ে রেখেছে দ্যাখ্ না বাবা!

ওদিকে আমিষ রান্নাঘরে পলি, গোপারা তাদের সেজদার আনকোরা নতুন বৌকে নিয়ে লেগে পড়েছে ডিমের চপ বানাতে। আজকে বড় আহ্লাদের দিন যে!

মাইল তিনেক দূরে জেলা হাসপাতালের সাদা চূনকাম করা, সবুজ পর্দার আড়াল দেওয়া ছোট কেবিনে ঘুমিয়ে আছে নতুন মা, পাশের কটে তোয়ালে জড়ানো শিশুটিও। বাচ্চার বাবা অদূরে বসে ঘুমন্ত মুখ দু'টির দিকে তাকিয়ে থাকে। আশ্চর্য হয়ে ভাবে, মাত্র কয়েক ঘন্টায় কেমন করে যেন জীবনের ছন্দ বদলে গেলো! কোথা থেকে এত মায়া এসে ঘিরে ধরলো মন?

পকেটে রাখা ছোট্ট নোটবইটা বার করে সে, ডট্ পেনটাও। কয়েকটা ছোট ছোট শব্দ লেখা হয়, কাটা হয়,আবার লেখা হয়। জিজ্ঞাসা চিহ্ন পড়ে...

চৈতালি?

চৈতী?

রাধিকা?

নন্দিনী?

আবীরা!!!!

শেষতম নামটি অস্ফুটে উচ্চারণ করে নতুন বাবা ভারী খুশী হয়ে ওঠে। আবীরা!!

আনন্দের আতিশয্যে ঝুঁকে পড়ে মেয়ের মুখের ওপর। রেশম রেশম চুলে ভরা ছোট্ট মাথাটাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে -- আমার ছোট্ট আবীরা, আমার আবু তুই।

আবু তখন ঘুমের মধ্যেই টুক্ করে হেসে ফেলে তার বাবার কাণ্ড দেখে।



(সেই আবীরা আজ অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে এসেছে, সামনে আরও কিছু পথচলা বাকি আছে হয়তো... চলার পথে কত জনকে হারিয়েছে, পেয়েছে নতুন কত জনকে... এই সময়ে তার মাঝে মাঝেই পিছন ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে...আবুর জীবনের আরো কিছু কথা আগামী পর্বে শোনাবো, কথা দিলাম...)

1 comment:

  1. আশায় রইলাম, শুনতে চাই।

    ReplyDelete