0

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


গীতারহস্যামৃতম
(তৃতীয় অধ্যায়)
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী

(৭) 

যাইহোক, কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যখন পৃথিবীর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মঞ্চ তৈরি তখন সর্বনাশের মাথায় বাড়ি মেরে অর্জুন যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেন। 

সপ্তম রিপু ডিপ্রেশনের চাপে পড়ে অর্জুন কি বলেছিলেন শোনা যাক (প্রথম অধ্যায় - অর্জুন বিষাদ – ২৯নং শ্লোক)- 

সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি। 
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।। 
(আমার গাত্র সকল অবসন্ন হচ্ছে এবং মুখ পরিশুষ্ক হচ্ছে। 
আমার শরীরে কম্প ও রোমহর্ষ হচ্ছে।।) 

সবশেষে, (প্রথম অধ্যায় - অর্জুন বিষাদ – ৪৬নং শ্লোক)- 

যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ। 
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ।। 
(যদি অস্ত্রহাতে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ প্রতিকারবিমুখ 
অশস্ত্র অবস্থায় আমাকে রণে হত্যা করে, তাও আমার মঙ্গলতর হবে।) 

এই বলে শোকগ্রস্ত অর্জুন গাণ্ডীব বিসর্জন দিয়ে রথের আসনে বসে পড়েন। 

এদিকে কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেন না বলে নিজের নোবেল শান্তি পুরস্কারটাও (সেই আমলে নোবেলের বদলে অন্য কিছু থাকতে পারে হয়ত) প্রায় বাগিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু অর্জুনের এই অবিমৃষ্যকারিতায় তখন তাঁর কূল আর রাধা দুটোই হাতছাড়া হবার যোগাড়! 

এদিকে পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজিয়ে ভদ্রলোক তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছেন। বিপক্ষ পার্টি নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরে তীর / বর্শা / ভল্ল ইত্যাদি না ছুঁড়ে অবাক হয়ে ওনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে ওনারা দুজনে মিলে কি কুবুদ্ধি আঁটছেন। কৃষ্ণের তো আবার এই বিষয়ে যথেষ্ট সুনাম ছিল, তাই নয় কি! 

প্রথমে ভীষণ অবাক হলেও পরে প্রচণ্ড রেগে গেলেন কৃষ্ণ এবং উপহাসসহ প্রচণ্ড ভর্ৎসনাও করলেন অর্জুনকে। 

দেখা যাক তিনি কি কি বাক্য প্রয়োগ করেছিলেন (সাংখ্যযোগ-২/৩নং শ্লোক)- 

কুতস্তা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম। 
অনার্যদুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন ।। 
ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতং ত্বয্যুপপদ্যতে। 
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তবোত্তিষ্ঠ।। 

( হে অর্জুন, এই বিষম কালে এপ্রকার অনার্য ব্যক্তির মত স্বর্গের প্রতিবন্ধক অকীর্তিকর মোহ তোমার কোথা থেকে উপস্থিত হল? / হে পার্থ, ক্লৈব্য পেও না, তোমার উপযুক্ত নয়; ক্ষুদ্র হৃদয় দৌর্বল্য ত্যাগ করে ওঠ।) 

এর পরেও যখন অর্জুন যুদ্ধ করব না বলে গোঁ ধরে থাকলেন তখন কৃষ্ণ জন্মের পর মৃত্যুই একমাত্র সত্য কিন্তু আত্মা অবধ্য, মৃত্যুর পর আত্মা নতুন দেহের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়; অতএব শোক করার কোন কারণই থাকা উচিৎ নয় ইত্যাদি অনেক জ্ঞানের কথা বললেন। তারপর এই ধর্মযুদ্ধে যোগদান করে স্বর্গলাভ সুনিশ্চিত করার কথা বলে প্রলোভনও দেখালেন। আর এই ধর্মযুদ্ধ না করলে পাপগ্রস্ত হবার ও লোকনিন্দায় আত্মসম্মান হারানোর ভয়ও দেখালেন। 


(৮) 

এরপরেও যখন অর্জুন কোন সাড়াশব্দ করলেন না, তখন কৃষ্ণ সাংখ্যযোগের ৩৯নং শ্লোক থেকে গীতার দার্শণিক বিবৃতি আরম্ভ করলেন। 

তারপর কর্মযোগে এসে ফলের আশা ত্যাগ করে কর্মবন্ধে না পড়ে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার উপদেশ দিলেন। 

এত কিছু করার পরও কিন্তু অর্জুনকে কিছুতেই যুদ্ধে নামানো যাচ্ছে না। অর্জুনও কৃষ্ণের দার্শণিক উপদেশের ব্যাখ্যা চাইতে শুরু করে দিয়েছেন। এ যেন অনেকটা কৃষ্ণের অগ্নিবাণের মোকাবিলায় অর্জুনের বরুণ বাণ ক্ষেপণ। 

অর্জুন প্রশ্ন করলেন (কর্মযোগ- ৩৬নং শ্লোক), 

অথ কেন প্রযুক্তয়ং পাপঞ্চরতি পুরুষঃ। 
অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ।। 

(হে কৃষ্ণ, তবু কিসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পুরুষ অনিচ্ছুক হয়েও জোর করে পাপ আচরণ করে।) 

অর্জুনের মুখ থেকে এইসব তাত্ত্বিক প্রশ্ন শুনে কৃষ্ণ অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন কিনা গীতায় সেটা বলা নেই তবে মাথা ঠান্ডা রেখে কৃষ্ণ অর্জুনের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। কৃষ্ণের তখন উভয়সঙ্কট। ভেতরে ভেতরে রেষ্টলেস ফিল করলেও মুখমিষ্টি বজায় রেখে অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্রে নামাতেই হবে। চলতে থাকল পাহাড় প্রমাণ জ্ঞানের তত্ত্বকথা। না হলে কৃষ্ণের সমস্ত লীলা খেলাই তো পুরে মিট্টি মে গির যা সকতা হ্যায়! 

এরপর জ্ঞানযোগের প্রথমেই কৃষ্ণের দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসলেন অর্জুন! কৃষ্ণ যখন বললেন যে তিনি এইসব তত্ত্বকথা সূর্যকে (বিবস্বান) বলেছিলেন, সূর্য তৎপুত্র মনুকে বলেছিলেন, মনু তৎপুত্র ইক্ষাকুকে বলেছিলেন; এইভাবে আর সব রাজর্ষিগনেরা পরম্পরার মাধ্যমে এই গুহ্যকথা জানতে পারতেন, তখন দুম করে অর্জুন প্রশ্ন করে বসলেন (জ্ঞানযোগ- ৪নং শ্লোক)- 

অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ। 
কথমেতদ্ বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি।। 

(তোমার জন্ম অদূরে, বিবস্বানের জন্ম দূরে; তুমি আদিতে বলেছিলে এ কি করে জানব?) 

অর্জুনের এই গুগলিতে বাধ্য হয়ে কৃষ্ণকে গীতার সেই সবচেয়ে বেশি টি.আর.পি যুক্ত শ্লোকটা আবৃত্তি করতে হয় (জ্ঞানযোগ- ৭ / ৮ নং শ্লোক)- 

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। 
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।। 
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিণাশায় চ দুস্কৃতাম। 
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভমামি যুগে যুগে।। 

অর্জুন মনেপ্রাণে কৃষ্ণের এই যুক্তি মেনে নিতে পেরেছিলেন কিনা জানা নেই তবে জ্ঞানযোগের শেষে যখন কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন তখনও পুরো প্রসেসটাকে ডিলে করাবার জন্য অর্জুন আবার কর্ম সন্ন্যাস আর কর্ম যোগের মধ্যে কি প্রভেদ তার ব্যাখ্যা চেয়ে বসলেন সন্ন্যাসযোগের প্রথমেই। তারপর আলোচনা চলল ধ্যানযোগ, জ্ঞান-বিজ্ঞানযোগ, অক্ষর-ব্রহ্মযোগ, রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগ পর্যন্ত। 

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল যে ধ্যানযোগ পর্যন্ত অর্জুন তবু কয়েকটা করে প্রশ্ন করছিলেন, তারপর বাকি পরের তিনটি অধ্যায়ের বিষয় এত গম্ভীর ছিল যে মনে হয় যেন অর্জুন একটু ব্যাকফুটে চলে গেছিলেন। 


(৯) 

এরপর বিভূতিযোগ অধ্যায়ে কৃষ্ণের “আমিই ব্রহ্ম, আমিই সব” টাইপের কথাবার্তা শুনে অর্জুন বোধহয় যুদ্ধের শুরুওয়াতটা আরও দেরি করাবার জন্য কৃষ্ণের ভক্ত হিসেবে কৃষ্ণকে ভগবান মেনে নিয়ে পর পর সাত-সাতটা শ্লোক আউরে ফেলেছিলেন (বিভুতি যোগ – ১২-১৮ নং শ্লোক)! 

কৃষ্ণও খুশি মনে নিজের মাহাত্য বোঝানোর জন্য “আমি আদিত্যগনের মধ্যে বিষ্ণু, জ্যোতিষ্কগনের মধ্যে অংশুমান রবি, আমি নক্ষত্রগনের মধ্যে চন্দ্র...।“ ইত্যাদি আরও কিছু সর্বশ্রেষ্ঠতার উদাহরণ দেবার সময় “আমি পান্ডবগনের মধ্যে ধনঞ্জয়” (বিভুতি যোগ – ৩৭ নং শ্লোকের মুখরা) বলে মনেহয় অর্জুনকে একটু অ্যাপেল পলিশিং করেছিলেন। 

এরপর ঘটল আসল ঘটনা। 

কৃষ্ণ এরই মধ্যে ৩৪১টা শ্লোক খরচ করে ফেলেছেন। কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। মনে মনে কৃষ্ণ যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন বলেই মনে হয়। এবার ওনারও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবার অবস্থা। কিন্তু অর্জুনকে ছাড়া তো তাঁর চলবেও না। তাই এবার তিনি অতি সুকৌশলে কার্য উদ্ধার করার কথা ভাবলেন। 

অর্জুনও তাঁর সাথে কথার পিঠে কথা চালাতে চালাতে ওনার বিভূতিযোগের সর্বশেষ ৪২নং শ্লোক- “বিস্টভ্যহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিত জগৎ” (আমি এই সমস্ত জগৎ একাংদ্বারা ধারণ করে আছি) শুনে কৃষ্ণের টোপটা গিলে নিয়ে ওনার বিশ্বরূপ দেখার জন্য বায়না ধরে বসলেন। 

ব্যস! এই সুযোগটার জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। 

তার্কিকেরা বলেন অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখানোটা আর কিছুই নয় আসলে খুবই উচ্চস্তরের সন্মোহন। বলা যেতে পারে আমজনতার চোখের সামনে থেকে আমাদের সরকার মশাইয়ের তাজমহল অদৃশ্য করে দেবার মতই রোমাঞ্চকর ঘটনা। সেই পদ্ধতিতেই অর্জুনকে সন্মোহিত করে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দানবাকৃতি এক রূপ দেখিয়ে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিলেন। 

ভয়ের চোটে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে করজোড়ে সামনে, পেছনে, সর্বদিকে (360°) নমস্কার করে কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললেন (বিশ্বরূপদর্শণযোগ-৪৬নং শ্লোক)- 

কিরীটিনং গদিনং চক্রহস্ত-মিচ্ছামি ত্বাং দ্রষ্টুমহনং তথৈব। 
তেনৈব রূপেণ চতুর্ভুজেন সহস্রবাহো ভব বিশ্বমূর্তে।। 

(আমি তোমাকে সেই রূপেই কিরীটধারী গদাধারী চক্রহস্তে দেখতে ইচ্ছা করি। 

হে সহস্রবাহো বিশ্বমূর্তে, সেই চতুর্ভূজ রূপেই আভির্ভুত হও।।) 

এরপর ভক্তিযোগ, ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ, গুনত্রয়বিভাগযোগ, পুরুষোত্তমযোগ, দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ, শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগের সোপান পার হয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এনে ফেললেন মোক্ষযোগ অধ্যায়ে। 

এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ মোটামুটি পেছনের সবকটা অধ্যায়ের সারাংশ করেছেন। 

আসক্তি ত্যাগ করে কর্ম করার কথা বলেছেন, কর্ম ফলের আশা ত্যাগ করে কর্ম করা বলেছেন, বলেছেন সত্ত্ব-রজো-তম গুনের কথা, বুদ্ধিযোগ আশ্রয় করে ব্রহ্মপরায়ণ হওয়া্র উপদেশ দিয়েছেন, সর্বত অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হলে উনিই রক্ষা করবেন ইত্যাদি এইসব কথাও বলেছেন।

0 comments: