0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in

ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত


।।৩০।।

বারুদ মারন গন্ধ মেখে শয়তান প্রতিভূ /তবু যে মমতা বন্ধন 

গোরাচাঁদ 

মিলিটারি জজ ট্রায়াল কাউন্সিল ও আরও পাঁচজন অফিসারকে নিয়ে যে ট্রাইব্যুনাল নিশুতি রাত অব্দি এই জঙ্গলে সৌমজিতের ট্রায়াল করছিল সেটা অবশ্য তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক চার্জশিট দায়ের করা হচ্ছিল। এটা গোরাচাঁদ বুঝতে পেরেছিলেন। এরপর তিনমাস ওকে হাজতে কাটাতে হবে। তারমাঝে একবার সেন্ট্রাল ডিফেন্স এ আরো একবার কোর্ট মার্শাল বসবে। সৌমজিতের ভাগ্য ভালো, যে সেনাবাহিনীর টুকড়ি গায়েব হয়েছিল তারা পরদিন সকালে ছাউনিতে ফিরে এসেছে। কিন্ত বস্তিগুলোতে একটাও বনবাসিকে ফিরে আসতে দেখা যায়নি। কোথায় যে বেমালুম হাপিস হয়ে গেছে কেউ বুঝতে পারছেনা। অবশ্যই এর সম্পূর্ণ দায়ভার পড়েছে সৌমজিতের ওপরে । সহকারী বিগ্রেডিয়ার ইকবাল কায়েফের বয়ান অনুযায়ী সৌমজিতের আদেশে ওদেরকে ট্রাকে বোঝাই করে দুধঝর্ণার খাদে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এতে সৌমজিত ও কয়েকজন সুবেদার ল্যান্সনায়েক জোর আপত্তি তুলেছিলেন কিন্তু কয়েকটি মিলিটারি সাঁজোয়া গাড়ির ময়দানের ছোটো খাদে হেলে পড়া দেখে ট্রায়াল কোর্ট একমত হয়েছেন এটি একটি জেনোসাইডের দৃষ্টান্ত। তাছাড়া সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ অফিসার সৌমজিতের বিরুদ্ধেই ছিল সেটা বোঝা গেল। বিশেষ করে ইকবাল ছিল তার ঘনিষ্ঠ সহকারী। তার ডান হাত। কিন্ত সে তখন প্রতিটি বিষয়ে সৌমজিতকে দোষী প্রমাণিত করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। ট্রাইব্যুনাল সৌমজিতকে ভারতীয় দন্ডবিধি পি ও এ নিয়মে দন্ড দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। আই পি সি ধারা তিনে মানবাধিকার উল্লঙ্ঘনের সাজাও সৌমজিতকে পেতে হবে।এছাড়া কেস সিভিল কোর্টে উঠবে তখন সৌমজিতকে সেখানেও কয়েকবার যেতে হবে। মাইনিং ডিপার্টমেন্টে এই নিয়ে তদন্ত চলবে। ফরেস্ট রাইটস এ্যাক্ট নিয়মে সরকারী দপ্তরে তদন্ত এবং আরও অনেককিছুর দুর্ভোগ আবর্তে এখন সৌমজিতকে পিষতে হবে ভেবে গোরাচাঁদের চোখ বারবার জলে ভরে আসছিল । ইতিমধ্যে রাশিয়ান মেজর জেনারেল ভারতীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রকে দুষ্প্রাপ্য ভেষজের ইচ্ছাকৃত ধ্বংস করার অভিযোগ মেল করে দিয়েছেন। এই ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছেন না গোরাচাঁদ। মামলা বহুদূর গড়াবে। রাজনৈতিক দিক দিয়েও তো বটেই। শিমুলিয়াকে উগ্রবাদী অধ্যুষিত এলাকা ঘোষণা করা ও সেখানকার নির্দোষ বঞ্চিত জঙ্গল জনজাতিরা যে হার্ডকোর টেররিস্ট তা ঘোষণা করে মিলিটারিদের চিরুনি তল্লাশি করে মেরে ফেলার অর্ডার দেওয়ার পিছনে সরকারী দপ্তরের কার লোভ ও কি চক্রান্ত আছে ও সেটা যে হয়েছে সৌমজিতের হাত ধরেই এ নিয়ে তো জোর তদন্ত চলবে। আর এর একটা বিহিত হওয়া অতি অবশ্যই চাই। সত্য আর কতদিন চাপা থাকবে। কতদিন ধরে চলবে এই মিথ্যাচার। কতদিন নির্দোষ অবলা মানুষেরা শোষিত নিপীড়িত হয়ে থাকবে। গোরাচাঁদ বহু বছর ধরে চাইছিলেন শিমুলিয়ার জনজাতির এই অপার দূর্ভোগের অবসান হোক। এবার বুঝি ঈশ্বর মুখ তুলে চেয়েছেন। তবে যখন সৌমজিতকে প্রায় দুশো জন বনবাসির একসাথে নিধনের দোষে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছিল তখন প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। জানতেন ঢাকের সাংকেতিক ম্যাসেজ সবাইকে দুধঝর্ণার আড়ালে এক গোপন দুর্গম জায়গায় যেতে বলা হয়েছে। সেখানে জেরেকাও গেছে। ওরা নিরাপদে আছে। এই ব্যাপারটা কিন্তু কারোর জানার কথা নয়। কিন্ত ওদের এই নিখোঁজ হওয়াতে যে সৌমজিতের কোনো হাত নেই সেটা ইচ্ছে করলেও গোরাচাঁদ সেখানে বলে উঠতে পারেন নি। গভীর রাত অব্দি ময়দানে ওপেন কোর্টে ট্রায়াল চলেছে। কোর্ট ডিসমিস হতে ধীরে ধীরে ময়দান ফাঁকা হয়ে গেল। গোরাচাঁদ সেই যে মুখ নিচু করে বসে রইলেন একা কখন যে ভোর হয়ে গেল বুঝতেই পারলেন না। সৌমজিতকে নিয়ে দীর্ঘদিন একটা ক্ষোভ ও দ্রোহ তাঁকে তিষ্ঠোতে দিত না এখন সেটা হঠাৎ করে সব হারানোর ব্যথা হয়ে বুক ঠেলে উঠছে। কিন্ত কিছু করার নেই। দম্ভ ও লোভ সমুকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছিল তার ফল তো ভোগ করতেই হবে। অবশ্য এলাকার জঙ্গল বাসিন্দাদের কল্যাণের জন্য যা হয়েছে তা ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
গোরাচাঁদ চোখ মেলে চারপাশটা দেখলেন। মাঠের কিনারায় মর্টার ও কামানের গোলায় প্রায় ধুলিস্যাত আদিবাসীদের কয়েকটি ঝোপড়ি। কয়েকটি মিলিটারি গাড়ি উল্টে পড়ে রয়েছে মাঠের ধারে। একদিকে ফাঁকা দিগন্ত ছোঁয়া দুরে দেখা যায় ছোট্টো সাদা মেঘ। গোরাচাঁদ জানেন ওটা মেঘ নয় আসলে ওটা দুধঝর্ণা থেকে উঠে আসা জলীয়বাষ্প। তিনি উঠে পড়লেন। ওই ওখানেই এখন তাঁকে যেতে হবে।

0 comments: