প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
তিতাস পাড়ের অদ্বৈতের বহুমাত্রিকতা
মনোজিৎকুমার দাস
বাংলাদেশের অখ্যাত ঘোটকর্ণ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদীর পাড়ের অন্ত্যজ শ্রেণির এক অখ্যাত পরিবারের থেকে উঠে আসা ছেলে অদ্বৈত। পারিবারিক পদবী সহ পুরো নাম অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১)। তিতাস পাড়ের অদ্বৈত একটি উপন্যাসেই সাহিত্যাঙ্গনে আজ চিরঞ্জীব। তাঁর কালজয়ী সেই উপন্যাসটির নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। শৈশব, কৈশোর, বয়ঃসন্ধিক্ষণ আর যৌবনের প্রারম্ভের সাথী তিতাস নদী। এই তিতাস নদী ও তার পাড়ের নারী,পুরুষ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, শিশু ও প্রকৃতিকে নিয়েই অদ্বৈতের কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ লেখা। উপন্যাসটির ভূমিকায় অদ্বৈত যা লিখেছেন, তা থেকে এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু উঠে এসেছে অনবদ্য আঙ্গিকে। তিনি ভূমিকায় লিখছেন: ‘তার কূলজোড়াা জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াাইতে বসে, কিন্তু পারে না।’
অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর জন্য একনামে পরিচিত। তিতাস পাড়ের অদ্বৈতের বহুমাত্রিকতা কালজয়ী উপন্যাসটির আড়ালে ডাকা পড়ে আছে। অদ্বৈত মল্লববর্মণের ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক পরিচয়ের বাইরেও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পাদচারণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী এই লেখককে প্রচারের আলোয় আনার ক্ষেত্রে অন্যধারার চলচ্চিত্রকার প্রয়াত ঋত্বিক ঘটকের অবদান প্রশংসার দাবি রাখে। ঋত্বিক ঘটকই প্রথম অন্ত্যজ শ্রেণির নরনারীর জীবনসংগ্রামের কাহিনী ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রে রূপদান করে অদ্বৈতের মতন লেখককে লাইমলাইটে নিয়ে আসেন।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের অকাল প্রয়াণেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসাধারণ প্রতিভা অন্তরালেই থেকে গেছে। ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক ছাড়াও অদ্বৈত একজন প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অনুবাদক, কবি ও লোক-সাহিত্য গবেষক হিসাবে বাংলা সাহিত্যে যে বিশেষ অবদান রেখেছেন, তা তুলে ধরার আগে তাঁর পোড় খাওয়া জীবনের কাহিনী তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ব্রিটিশ ভারতের কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার তিতাস নদী তীরবর্তী গোকর্ণঘাট গ্রামে মালোপাড়ায় এক হতদরিদ্র পরিবারে ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ। ধীবর অর্থাৎ জেলে গোষ্ঠীর নাম মালো। পেশা মাছ ধরা, মাছের কেনাবেচা। শৈশবেই বাবা-মাকে হারান তিনি। গ্রামের জেলেদের অর্থিক সাহার্যে তাঁর লেখাপড়ার খরচ চলে। ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের অন্নদা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কারণে ১৯৩৪ সালে শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে।
জীবিকার জন্য তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানে মাসিক ‘ত্রিপুরা’র সাংবাদিক হিসেবে শুরু হয় কর্মজীবন। ১৯৩৬ সালে শ্রীকাইলের ক্যাপ্টেন নরেন দত্তের ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় যোগ দেন। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। অদ্বৈত কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহকারী হিসেবে সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৭-এ তিনি নবশক্তি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৯৪১ পর্যন্ত সম্পাদকরূপে দায়িত্ব পালন করেন। একটানা ৭ বছর চলার পর ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের মালিকাধীন সাপ্তাহিক নবশক্তি, অদ্বৈতের স্মৃতি-বিজড়িত সাপ্তাহিক নবশক্তি বন্ধ হয়ে যায়। নবশক্তির পাতায় নামে বেনামে অনেক বিচিত্র লেখা ছাপা হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় নবকিশোর ছদ্মনামে কিছু কবিতা মোহম্মদীতে প্রকাশ পায়।
নবশক্তি পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’র মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় আবুল কালাম শামসুদ্দীনের মনোনয়নে তারই সহকারী রূপে অদ্বৈত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় যোগদান করেন। ক্রমে ক্রমে মোহাম্মদীর সম্পাদনার ক্ষেত্রে মূল কর্তাব্যক্তিতে পরিণত হন অদ্বৈত। তিনি নামে-বেনামে মোহাম্মদীতে বেশ কিছু রচনার প্রকাশ করেন। ১৯৪৫ পর্যন্ত তিন বছর মোহাম্মদীতে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে একই সঙ্গে ‘আজাদ’ ও ‘কৃষক’ পত্রিকায় পার্ট টাইম কাজ করেন।
প্রকাশনা জগতের পুরোধা কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠী। এক সময় অদ্বৈত তাদের অন্যতম সাহিত্য বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দেশ’ এর স্বনামধন্য সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সাহচর্যে আসেন। ১৯৪৫ সালের দিকে অদ্বৈত সাগরময় ঘোষের সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন। তিনি সাহিত্য পত্রিকা ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ৬ বছর কাজ করেন। তাঁর বেশ কিছু কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও অনুবাদ দেশ ও অন্যান্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াা পরবর্তীতে নবযুগ, কৃষক ও যুগান্তর পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বভারতীর প্রকাশনা শাখায় খণ্ডকালীন চাকরিও করেন। প্রসঙ্গত বলতে হয়, ১৯৩৯ সালে তিনি চয়নিকা পাবলিশিং হাউস গঠন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বন্ধুরা- যথা কালিদাস মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস চক্রবর্তী, সতীকুমার নাগ, সনৎকুমার নাগ প্রমুখ। ঠিকানা : ৭ নবীন কুন্ডু লেন, কলকাতা। ১৯৪০ সালে তিনি ‘দলবেঁধে' গল্প সংকলন সম্পাদনা করেন। যৌথ সম্পাদক ছিলেন কালিদাস মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস চক্রবর্তী, সতীকুমার নাগ। প্রকাশক : সনৎকুমার নাগ।১৯৪৩ : ‘ভারতের চিঠি-পার্ল এস বাককে' গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন নিজেদের চয়নিকা পাবলিশিং হাউস থেকে।
তিতাস পাড়ের মৎস্যজীবী জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে তুলে ধরে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামে কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেন। মর্মস্পর্শী এ উপন্যাস প্রথমে মোহাম্মদী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু কয়েকটি অধ্যায় প্রকাশের পর পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। পরে বন্ধু ও পাঠকদের অনুরোধে আবার কাহিনীটি লেখেন। মৃত্যুর আগে কাঁচড়াাপাড়াা যক্ষ্মা হাসপাতালে যাবার আগে পাণ্ডুলিপিটি বন্ধুদের দিয়ে যান। ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করার কয়েক বছর পর উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ মৎস্যজীবী ‘মালো’সম্প্রদায়েরই মানুষ হয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সুগভীর অন্তঃদৃষ্টির আলোকে ধীবর সমাজের নিষ্ঠুর জীবনসংগ্রামের সাধারণ কাহিনীকে অসাধারণ নৈপূন্য উপস্থাপন করেছেন, যা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে উচ্চাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছাড়াও তিনি ‘রাঙামাটি’ও ‘শাদা হাওয়া’ নামে আরো দুটি উপন্যাস রচনা করেন। ‘শাদা হাওয়া' রচনা শেষ করেন ১৯.১২.১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। ‘সোনারতরী' পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯৪৮ বা ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে।
অন্যদিকে,‘রাঙামাটি' উপন্যাসটি ১৯৪৩-৪৫ সময়ের লেখা। তা মাসিক ‘চতুষ্কোণ' পত্রিকায় ১৩৭১-এর বৈশাখ থেকে চৈত্র ১২ সংখ্যায় ১টি বাদ দিয়ে ১১ দফায় ছাপা হয়।
বক্ষ্যমান নিবন্ধের বিষয়ে ফিরে গিয়ে চেষ্টা করবো প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অনুবাদক,কবি, লোক সাহিত্য বিষয়ক লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণকে উপস্থাপন করতে। পত্রিকায় চাকুরীর কারণে পেশাগত দ্বায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করার সুযোগ পান। স্বল্পকালীন জীবনে অদ্বৈত মল্লবর্মণ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। এছাড়াও তিনি বহু শিশুপাঠ্য কবিতাও রচনা করেছেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরোলেও চল্লিশের দশকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমূখের পাশাপাশি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'এক পয়সায় একটি' গ্রন্থ সিরিজ আকারে লিখে তিনি বিশেষভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রসঙ্গত বলতে হয়, অদ্বৈত মল্লবর্মণের মত একজন লেখককে নিয়ে যতটা গবেষণা হওয়া উচিত ততটা এ পর্যন্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে সম্প্রতি কলকাতার দে’জ পাবলিকেশন থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর অচিন্ত্য বিশ্বাসের সম্পাদনায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনা সমগ্র সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। অচিন্ত বিশ্বাসের লেখা থেকে জানা যায়, তিনি রচনা সমগ্র প্রকাশের পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্যমোদীদের আমন্ত্রণে একবার অদ্বৈতের জন্মস্থান গোকর্ণঘাট গিয়েছিলেন। তিনি কিছু দুষ্প্রাপ্য লেখা উদ্ধার করে অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনা সমগ্র প্রকাশ করেছেন।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ প্রবন্ধ,অনুবাদ, গল্প, কবিতা, লোক সাহিত্য সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন যাতে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অসাধারণ নৈপূণ্য পরিস্ফুট। আমরা এখানে ‘প্রাবন্ধিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ, ‘অনুবাদক অদ্বৈত মল্লবর্মণ,‘গল্পকার অদ্বৈত মল্লবর্মণ, ‘কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ,‘ লোক সাহিত্য সংগ্রহাক অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘ শিরোনামে তাঁর সৃজন কর্মের পরিচয় তুলে ধরবো।
প্রাবন্ধিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ: অদ্বৈতের লেখা প্রবন্ধগুলোর মধ্যে যেগুলোর হদিস পাওয়া যায় সেগুলো হলো:১. ভারতের চিঠি – পার্ল এস বাককে, ২. নাটকীয় কাহিনী, ৩.নাটকের গোড়া পত্তন, ৪.পাত্রপাত্রী নির্বাচন, ৫. প্রয়োজন, ৬.প্রথমপাঠ,৭. প্রথম মহড়া, ৮.আরো মহড়া, ৯. ফ্রেশ রির্হাসেল, ১০. নাটকে নাট্যকারের স্থান, ১১.সিরাজের কাল, ১২. কাব্য সমালোচনা (একটি চিঠি), ১৩.প্রথম রজনী, ১৪. প্রথম রজনীর পর, ১৫. প্রাচীন চীনাচিত্রকলার রূপ ও রীতি, ১৬.ছোটদের ছবি আঁকা, ১৭.এদেশের ভিখারী সম্প্রদায়, ১৮.আম্রতত্ত্ব, ১৯. বর্ষার কাব্য, ২০. মৈত্রী সম্মেলন, ২১. বেগম রোকেয়া জীবনী পুস্তক সমালোচনা, ২২. টি এস এলিয়ট, ২৩. সম্পাদকীয়-স্তম্ভ * সাহিত্য ও রাজনীতি, ২৪. জিজ্ঞাসা, ২৫.লোক গণনা, ২৬ ভারতীয় সংস্কৃতি ইত্যাদি।
আমরা অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা ‘সিরাজের কাল’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর রচনা শৈলীর কিছুটা পরিচয় নেবো। তাঁর লেখা এই প্রবন্ধটি মাসিক মহম্মদী ১৩৪৭ সাল আষাঢ় ১৩শ’ বর্ষ, নবম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। “সিরাজের কাল- অদ্বৈত মল্লবর্মণ --- ’ থেকে: ‘ ইতিহাস সাহিত্যের অঙ্গীভূত। ইতিহাসের মধ্য দিয়া কোন ব্যক্তি বা জাতির অবমাননা করিলে সেই অবমানার জন্য দায়ী সাহিত্যই। সাহিত্য ইতিহাসকে বুকে করিয়া রাখিয়াছে, কাজেই সে বুকে করিয়া রাখিয়াছে ইতিহাসের সত্য- মিথ্যা সকল দায়িত্বকে।’ -- এই প্রবন্ধে তিনি আরো লেখেন, ‘অদ্যবধি সিরাজের যুগ অন্ধকারে রহিয়াছে। বহুকালের এই পুঞ্জীভূত মিথ্যা সরাইয়া সিরাজকে তাঁহার স্বদীপ্তিতে প্রভাবিত করা দুই একজন ঐতিহাসিকের কাজ নহে। আজ ইংরাজ জাতি এরূপ অবস্থায় পতিত হইলে কেবল সাহিত্যের প্রাচুর্য্যে মধ্য দিয়াই তাহারা এতদিনে জাতির ভাগ্য করিয়া নির্ণয় লইত।’
অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর লেখা অনেক প্রবন্ধেই কবি সাহিত্যিকদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তা করতে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিতে পিছপা হননি। এ প্রসঙ্গে আবারো তাঁর লেখা ‘সিরাজের কাল’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি করা যেতে পারে। তিনি এই প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শুদ্ধ সাহিত্যে যাঁহারা সিরাজের প্রতি অবিচার করিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে সর্বাগ্রে স্বর্গীয় কবি নবীন সেনের উক্ত হইয়া থাকে। স্বর্গীয় অক্ষয়কুমার মৈত্রয় মহাশয় পর্যন্ত নবীন সেনকে ক্ষমা করেন নাই- পরবর্ত্তীগণকে যে ক্ষমা করিবেন না, উহা বলাই বাহুল্য। নবীন সেন ঐতিহাসিক উপকরণ লইয়াছেন ইংরেজদের নিকট হইতে ধার করিয়া, আর কাব্যিক উপকরণ লইয়াছেন কিছুটা স্বকপোল কল্পনা হইতে আর কিছুটা বিজাতীয় কবির কাব্য হইতে।’
অদ্বৈতের ‘নাটকীয় কাহিনী’, ‘নাটকের গোড়া পত্তন’, ‘পাত্রপাত্রী নির্বাচন’, ‘ফ্রেস রির্হাসেল’, ‘নাটকে নাট্যকারের স্থান’, ‘আম্রতত্ত্ব,’ ‘মৈত্রী সম্মেলন’, টি এস এলিয়ট, ইত্যাদি প্রবন্ধ প্রশংসার দাবী রাখে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘দেশ’ পত্রিকায় থাকাকালে টি.এস. এলিয়ট সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। সেটা ছিল ১৯৪৮ সাল। টি.এস. এলিয়টের উপর প্রবন্ধ লেখার দায়িত্ব ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে অদ্বৈতকে দেওয় হয়েছিল। ‘ভারতের চিঠি -পার্ল এস বাককে’ শীর্ষক প্রবন্ধে অদ্বৈত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের যন্ত্রণাকাতর মানুষের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা কালের গণ্ডী পেরিয়ে প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে। অদ্বৈত এই প্রবন্ধে লিখেছেন,‘আজকের দিনে ব্যক্তিত্বের বড়ো দুর্দশা; মহাস্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দাও, দেখবে সে স্রোত আবর্ত বুকেও তোমার ব্যক্তিকে করুণায় ঠিক রেখেছে; বেঁকে বসো, তাহলে দেখবে সে ব্যক্তিত্ব খণ্ড খণ্ড হয়ে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে।’ এ সময় নবশক্তিতে দুটো বারো মাসী গান, ‘এদেশ ভিক্ষারী সম্প্রদায়’পল্লী সঙ্গীতিতে পালা গান সহ বিভিন্ন প্রবন্ধ বের হয়।
অনুবাদক অদ্বৈত মল্লবর্মণ: অদ্বৈত মল্লবর্মণ অনুবাদক হিসাবে স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্যে পরিচয় দিয়েছেন ভিন্ন ভাষার উপন্যাস ও কবিতা অনুবাদ করে। শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগগের এর জীবন অবলম্বনে আরভিং স্টোনের লেখা ‘লাস্ট ফর লাইফ’ এর বঙ্গানুবাদ করেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘জীবনতৃষা’ নামে।
বিদেশী ভাষার কবিতা অনুবাদ করে অনুবাদ সাহিত্যে তিনি পারঙ্গমতার পরিচয় রেখেছেন। কবি পত্রিকা, বৈশাখ ১৪২১ সংখ্যায় ‘যোদ্ধার গান’ নামে অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হয়। উক্ত কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করলে অনুবাদ কর্মে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ঋদ্ধতার পরিচয় পাওয়া যায়। যোদ্ধার গান: কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ (ত্রয়োদশ শতাব্দীর একটি আরবি কবিতার তাঁর বঙ্গানুবাদ )। করুণায় আর গৌরবের সুমহান / আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে নুয়াইনি কভূ শির / উপলাকীণ্র্ বন্ধুর পথে ধরি কর – অঙুলি / চালায়েছ মোরে চিরবিজয়ের পথে-/ দিয়েছে আমার সম্পদ রাশি, দিয়েছে সিংহাসন,/ হস্তে দিয়েছে বিজয়ী তরবারি।/ অজানা দেশেতে আমারে জানার গৌরব দিয়াছেন, / মোর রাজ-ছায়া দিয়ে তিনি ধরারে টানিয়াছেন / অজ্ঞাত ছিনু , অখ্যাত ছিনু, তাহা কি মোহর বাণী / দিকে দিকে মোরে বিজয় দিয়েছে আনি। / তার শত্রুরা পালাইয়া গেল / মোর সম্মুখ হতে। / তিনি চাহিয়াছিলেন করুণা করিতে,/ নিলো না সে দান তারা/ জাহান্নামের চির তমসায় সব শয়তনী সহ/ বিরাম লভিল তারা। কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ : বাংলা সাহিত্যে তাঁর আর একটি পরিচয় কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তাঁর পিতা অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ বসতভিটে ছাড়া আর কিছু ছিল না।এমনকি তার মাছ ধরার জন্য নৌকা বা জাল ছিল না। অধরচন্দ্র নিরক্ষর হলেও কিন্তু গান বাঁধতে পারতেন। পিতার গান বাঁধার সূত্র ধরে পিতার মৃত্যুর আগে শৈশবকাল থেকেই অদ্বৈতের মধ্যে গান ও কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা জেগে উঠে। অদ্বৈতের লেখা ’তমালেরি ডালে বসি কোকিলায় কি বলে রে’ গানটি থেকে তার গানটি তারই দৃষ্টান্ত। এখানে এই গানটি উদ্ধৃত করা অপ্রসঙ্গিক হবে না।
‘তমালেরি ডালে বসি কোকিলায় কি বলে রে / কোকিলায় কি বলে শ্যাম বেইমানে কি বলে রে। / টিয়া পাললাম, শালিক পাললাম / আরো পাললাম ময়নারে / সোনামুখী দোয়েল পাললাম, / আমায় কথা কয় না রে।’
তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালে প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগে তিনি ‘তিতাস ‘নামে তিনটি কবিতা লেখেন। কলেজে পড়ার আগেই তাঁর লেখা কবিতা শিশুসাথী, খেলাঘর ও মাস পহেলা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। পিতার কাছ থেকে পাওয়া গান বাঁধার গুণে তিতাস নদী তীরবর্তী এলাকায় ‘গানদার’ বলে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে অদ্বৈতের। তাঁর লেখা কবিতাগুলোর মধ্যে ১.বিদেশী নায়িকা, ২.শুশুক, ৩. যোদ্ধার গান, ৪. আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবস, ৫. ধারা শ্রাবণ, ৬. মোদের রাজা মোদের রাণী, ৭. ত্রিপুরা লক্ষ্মী, ৮. শ্রীমতি শান্তি বর্মণকে, ৯. সন্ধ্যা- বিরহিনী, ১০. মোহনলালের খেদ, ১১. সিরাজ, ১২. পলাশী, ১৩. হলওয়েল স্তম্ভ, ১৪. হীরামতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। স্বল্প জীবনের অধিকারী অদ্বৈতের লেখা এখানে ওখানে অবশ্যই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার প্রমাণ মেলে পশ্চিম বঙ্গের অভিজিৎ ভট্ট এবং অধ্যাপক মিলনকান্তি বিশ্বাস সম্পাদিত 'অগ্রন্থিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ' গ্রন্থে 'বিস্ময়', 'জাল ফেলা জাল তোলা', 'তমোনাশের মন' এবং 'আশালতার মৃত্যু ' এই চারটি গল্পের সন্ধান পেয়ে। বলা বাহুল্য অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাসের সম্পাদিত গ্রন্থে উপরে উল্লিখিত ‘স্পর্শদোষ ', ' সন্তানিকা ', ' কান্না', এবং 'বন্দী বিহঙ্গ' এই চারটি গল্পের কথা পাঠক মাত্রই আগে থেকেই জানেন। আজ পর্যন্ত পাওয়া অদ্বৈতের লেখা গল্পে সংখ্যা : ৮টি
প্রেমেন্দ্র মিত্রের নবশক্তি ছেড়ে আসার পর অদ্বৈত সম্পাদনা করেন ‘দলবেঁধে’ গল্পগ্রন্থ।
তাঁর এই গল্পগুলোর রচনা শৈলী, ভাষা অসাধারণ। দুঃখ বেদনার অনুষঙ্গ তিনি তুলে ধরেছে বিশেষ আঙ্গিকে। তাঁর স্বল্পস্থায়ী জীবনে তাঁর মেধা মনন, চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর অন্যান্য রচনায় উপস্থাপন করেছেন।
লোক সাহিত্যের সংগ্রহক ও গবেষক অদ্বৈত মল্লবর্মণ: প্রসঙ্গক্রমে লোক সাহিত্যের উপর লেখাগুলোর দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে পারা যায় লোকজ সাহিত্যকে অনুসন্ধানী দৃষ্টির আলোকে উপস্থাপন তাঁর গবেষণার ফসল। তিনি লোকজ সাহিত্যকে সাহিত্যের ভাণ্ডারে সন্নিবেশিত করেছেন। লোকজ সাহিত্যের উপর অদ্বৈতর লেখাগুলো হচ্ছে: ১. অপ্রকাশিত পল্লীগীতি, ২. ত্রিপুরার বারমাসী গান, ৩. তিনটি বার মাসী গান, ৪. সীতার বারমাসী, ৫. পল্লী সঙ্গীতে পালা গান, ৬. বিনোদের পালা, ৭. কটু মিঞার পালা, ৮. শেওলার পালা, ৯. বরজের গান, ১০. জলসওয়া গীত, ১১. নাইওরের গান, ১৩. নাইওরের গান, ১৪. পাখির গান, ১৫. ভ্যমর দূত, ১৬. মেওয়া মিছরির গান, ১৭. উপাখ্যানমূলক সঙ্গীত, ১৮. বানিয়ার গান,১৯. ভাই ফোঁটার গান, ২০. মাতৃস্নেহসূচক কয়েকটি অপ্রকাশিত প্রাচীন গান, ২১. পরিহাস সঙ্গীত, ২২. মাঘ মণ্ডল, ২৩.অপ্রকাশিত পুতুল বিয়ের ছড়া, ২৪. অপ্রকাশিত বাউল সঙ্গীত ইত্যাদি। এই সমস্ত লোক সাহিত্য কালের করালগ্রসে হারিয়ে যেতে বসেছিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণ এইগুলোকে সংগ্রহ করে লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন, যা তাঁর একটি অসাধারণ কাজ নিঃসন্দেহে। অদ্বৈত মল্লবর্মণে প্রথম প্রকাশিত পুস্তক ভারতের চিঠিঃ পার্ল এস বাককে কেবল তাঁর জীবৎকালে প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৯৫৬ সালে কলকাতার পুথিঘর প্রাইভেট লিঃ থেকে প্রকাশিত হয় তিতাস একটি নদীর নাম। ১৯৬১ সনে ভারতের চিঠি পার্লবাককে পুনর্মুদ্রিত হয় কলকাতার বিশ্ববাণী থেকে। ১৯৯০ সনে দেবীপ্রসাদ ঘোষ সাপ্তাহিক নবশক্তি থেকে ১৮টি এবং দেশ ও আনন্দবাজার থেকে ৪টি মোট ২২টি নাতিদীর্ঘ রচনা সংগ্রহ করে বারমাসী গান ও অন্যান্য নামে প্রকাশ করেন। ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে যথাক্রমে প্রকাশিত হয় শাদা হাওয়া ও রাঙামাটি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ যে নিজের সম্পর্কে অত্যন্ত নির্লিপ্ত ছিলেন তার প্রমাণ মেলে তাঁরই লেখা একটি চিঠি থেকে। কাঁচরাপাড়া টিবি হাসপাতালের বি-৩ ওয়ার্ডে থাকাকালে অদ্বৈত ১৩৫৭ সনের ২৮ বৈশাখ চন্দ্রকিশোর মল্লবর্মণের নামে তাঁর এক স্নেহভাজনকে পোস্টকার্ডে লিখেছিলেন ‘আমি এখনো হাসপাতালেই আছি। আর কতদিন থাকতে হইবে তাহার কোন নিশ্চয়তা নাই। যতদূর মনে হয় আমি আরও এক বৎসর এই হাসপাতালেই থাকিতে পারিব। আমার জন্য কোন চিন্তা করিও না। আমার যতদিন ভোগ কপালে লেখা আছে ততদিন অবশ্যই ভুগিতে হইবে।’
অদ্বৈতে’র জীবনকাল ছিল মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের। অপরপক্ষে তারাশঙ্কর বেঁচেছিলেন ৭৩ বছর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ৪৮ বছর, সমরেশ বসু ৬৪ বছর আর বিভূতিভূষণ বেঁচেছিলেন ৫৬ বছর। অদ্বৈত ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল কলকাতার নারকেলডাঙ্গার ষষ্ঠীতলায় তখনকার দুরারোগ্য টিবি রোগে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে ধুঁকে ধুঁকে মুত্যুবরণ করলেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হওয়া সত্ত্বেও জীবদ্দশায় তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে অকালে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন- এটা বড় দু:খের ও বেদনার। অন্ত্যজ শ্রেণী থেকে উঠে আসা মানুষটি তাঁর বিপন্ন জীবন থেকেই জ্ঞানের দীপ্তি ছড়িয়েছিলেন তাঁর বহুমাত্রিক অসাধারণ সব লেখায়। এই মানুষটি তাঁর জীবৎকালে অন্য পাঁচজন লেখকের মত লইমলাইটে না এলেও চিরায়ত বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন অত্যুজ্জ্বল ধ্রুবতারা।
0 comments: