0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সৌম্য ব্যানার্জী

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বুরা না মানো, হোলি হ্যায়
সৌম্য ব্যানার্জী


আমার বাবার পিঠের নিচের দিকে, কোমরের ঠিক উপরে, অনেকগুলো জড়ুলের একটা জটলা আছে। জন্মদাগ, বলা বাহুল্য। কিন্তু আমি ছোটবেলায় একটা আজগুবি ব্যাপারের সঙ্গে সেটাকে সম্পৃক্ত করে ফেলেছিলাম। তখন বোধহয় বছর পাঁচেক বয়স আমার। এক দোলের সকালে বাবার হাত ধরে বেরিয়েছিলাম। কোত্থেকে দু’টো বাচ্চা মেয়ে... বয়স প্রায় আমারই মতন... ছুটে এসে বাবার পিঠের নিচের দিকে ওই জায়গাটায়, মানে যত অবধি ওদের হাত যায়, রঙের ছোপ দিয়ে পালিয়ে গেলো। বাড়ি ফিরে বাবা যখন জামা খুললো, সেই প্রথমবার আমি বাবার কোমরের জড়ুলগুলোকে ভালো করে খেয়াল করলাম... এবং কেন যেন আমার ধারণা হলো, ওগুলো সেইদিন ওই রঙের ছোপ থেকেই হলো! মেয়েগুলোর উপর খুব রাগ হলো বাবার পিঠটা ওরকম করে দেওয়ার জন্য। বাবা-মাকে বললামও সে কথা। বাবা-মা কি উত্তর দিয়েছিলো, সেটা আর মনে নেই, কিন্তু আমার ধারণাটা পাল্টাতে পারেনি। সেটা বহুকাল অবধি ছিলো। যেমন ছিলো সেই মেয়ে দু’টোর ছুটে এসে রঙের ছোপ মেরে পালিয়ে যাওয়ার স্মৃতিটা। বস্তুত, সেটা এখনও আছে। এটাও মনে আছে যে দু’টোর মধ্যে একটা মেয়ের মাথা ন্যাড়া ছিলো। সম্ভবত সেই আমার প্রথম দোলের স্মৃতি।

তারপর তো দোল-হোলিকে কেন্দ্র করে কত স্মৃতি! সবারই থাকে। শৈশবে পরিবারের সঙ্গে, কৈশোরে বন্ধুদের সঙ্গে, যৌবনে প্রেমাস্পদদের সঙ্গে এবং এখন এই অস্তগামী যৌবনে এসে আবার পরিবারের সঙ্গে – এই তো আমাদের মতন ছাপোষা মানুষের উৎসবপালনের গ্রাফ। হোলিই বা তার থেকে আলাদা হবে কেন? তবু হোলি যেন আমাদের বাদবাকি সব উৎসবের থেকে সত্যিই একটু আলাদা। একে তো রঙের উৎসব, তার উপর আবার বসন্তকালের প্রেম-মহোৎসব। সেরকম বললে অবশ্য বাঙালির নিজস্ব প্রেমের উৎসব সরস্বতী পুজো তো আছেই। কিন্তু দোলের উদ্দাম শারীরিকতাটুকু তাতে নেই। নেই ভাং বা সুরার মদির আবেশটুকু। তাই উৎসব হিসেবে দোল বা হোলির বৈশিষ্ট্য একটু অন্যরকম।

পৌরাণিক দিক থেকে দেখতে গেলে হোলি এবং দোলের প্রেক্ষিত দুটো কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। হোলিকাদহনের সঙ্গে রঙ খেলার কোনও সম্বন্ধ নেই। হিরণক্যশিপুর বোন রাক্ষসী হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে অগ্নিপ্রবেশ করেছিলো বিষ্ণুভক্ত ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করে দাদাকে নিষ্কন্টক করার উদ্দেশ্যে। তার অঙ্গে ছিলো অদৃশ্য অগ্নিরোধক শাল। কিন্তু আগুনে প্রবেশ করা মাত্র ভগবান বিষ্ণুর ইচ্ছায় সে শাল হোলিকার শরীর থেকে উড়ে গিয়ে প্রহ্লাদের শরীরকে বেষ্টন করে তাঁর প্রাণ রক্ষা করে। পুড়ে ছাই হয় হোলিকা। চিরন্তন ধর্মের জয়, অধর্মের নাশ। সেই ঘটনারই আধুনিক উদযাপন হোলির আগের রাতের হোলিকাদহন বা চাঁচর উৎসব।

এই বীভৎস ঘটনার অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বৃন্দাবনের দোলযাত্রা। আমাদের চিরকালীন প্রেমিক দেবতাটির দুষ্টুমির উৎসব। নন্দগাঁও থেকে দলবল নিয়ে কৃষ্ণ যেতেন রাধারাণীর গ্রাম বরসানাতে, দোল খেলতে। তারপর কি হতো, জয়দেব গোস্বামীর পদাবলী থেকে আরম্ভ করে গতকাল মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবিটির গানেও তার অপর্যাপ্ত বর্ণনা আছে, এবং সেসব বর্ণনার অনেকটাই আদিরসাত্মক... এবং এখানেই দোলযাত্রা বা হোলির (দুটি উৎসবই এখন এক হয়ে গেছে) মাহাত্ম। এই উদ্দামতায়। যৌবনের আত্মনির্ঘোষে। বসন্তের ফিরে আসায়। শৈবশাস্ত্র অনুযায়ী, ভগবান মহাদেব তাঁর ধ্যানভঙ্গ করার অপরাধে কামদেব মদনকে তৃতীয় নয়নের আগুনে ভস্মীভূত করেছিলেন। কিন্তু মুহূর্তের সেই রোষ প্রশমিত হবার পর তিনি উপলব্ধি করেন যে ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। বেচারা মদন সদুদ্দেশ্যে পার্বতীকে সাহায্যই করছিলেন, মহেশ্বরের ধ্যান ভাঙিয়ে তাঁর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। শিব দেখলেন, স্বামীর এই দশার জন্য মদনের স্ত্রী রতি এবং স্বয়ং পার্বতীও ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তারপর যখন রতি চল্লিশ দিন ধরে কঠিন তপস্যা করলেন স্বামীর জীবন ফিরে পাবার জন্য, তখন আর ভোলানাথ পারলেন না। পুনর্সঞ্জীবিত করলেন ‘অনঙ্গ’ মদনকে। মদনভস্মের চল্লিশ দিন পরের সেই দিনটিই নাকি বসন্ত পঞ্চমী, যেদিন কামদেবের পুনর্জীবনপ্রাপ্তি হয়। তাই সেদিন বসন্ত উৎসব, কামের অর্চনা। উৎসবটি কবে, কিভাবে দোলপূর্ণিমার সঙ্গে একাকার হয়ে গেলো, তা বলা কঠিন। প্রাচীন ভারতে এ উৎসব অত্যুৎসাহে পালিত হতো বলে শোনা যায়। হবে না-ই বা কেন? এমন মধুর রসসিক্ত উৎসবকে বাধা দেওয়ার জন্য তো তখন সংস্কৃতির চৌকিদাররা ছিলো না। সম্ভবত মানুষের মনে এত ঘৃণা, বিদ্বেষ, ছুঁৎমার্গও ছিলো না। সে সব অনেক পরের কথা। আজ থেকে সাড়ে চারশো বছর আগে সম্রাট আকবর যখন এই আক্ষরিক অর্থের মিলনোৎসবটির পুনর্প্রচলন করার চেষ্টা করেন, ততদিনে ভারতবর্ষের জনমানসকে চেপে ধরেছে ঘৃণা-বিদ্বেষ-অবিশ্বাসের ফাঁস।

সে যাই হোক, আমরা আজ দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, একটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ এবং বহু ঘৃণা, বহু বৈরি পেরিয়ে এমন একটা সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখান থেকে সামনে এবং পিছনে, দুটো পথই খোলা। কোন দিকে যাবো, সেটা একান্তই আমাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমাদের মতন ছাপোষারা, চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের ভাষায় যারা ‘‘...দোল খেলো হাজরাতে, উঠে বসো মাঝরাতে, পুষে রাখো পাঁজরাতে চোরা মফস্বল’’, শুধু এই একটা দিনের সুযোগে গতপ্রায় যৌবনকে খানিকক্ষণের জন্য হলেও একটু ফিরে পেতে চাই... রঙ আর ভাঙের মদিরতায় ইষৎ স্খলিতকন্ঠে একবার অন্তত বলে উঠতে চাই... বুরা না মানো, হোলি হ্যায়!

0 comments: