ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
আহিরণ নদী সব জানে
রঞ্জন রায়
৪
মুশকিলে পড়েছে অলগুরাম সতনামী। থাকে গাঁয়ের প্রান্তসীমায় সতনামী পাড়ায়। সাপ্তাহিক হাটবাজারের চৌক পেরিয়ে পঞ্চায়েতের কাঞ্জিহাউসের পাশে সতনামী পাড়া শুরু। প্রায় চল্লিশ ঘর। তিনটে গলি, মাটি আর কাঁকর বিছানো। দুপাশে গায়ে গায়ে বাড়ি, সব মাটির দেয়াল, জঙ্গলের কাঠ কেটে চৌকাঠ, বিম আর দরোজা। উঁচু উঠোন, গোবরে নিকানো বারান্দা আর ভেতরের উঠোন। ভেতরে কয়েকটি বাড়িতে আছে কোলাবাড়ি,শহুরে ভাষায় কিচেন গার্ডেন। তাতে একটি কাঁচা কুয়ো, পাড় বাঁধানো। সেখানে লংকা, ধনিয়া, বেগুন, টম্যাটো লকলকিয়ে বাড়ে।
অলগুরাম মুরুব্বি মানুষ। ওর পেছনের আঙিনায় বাঁধা রয়েছে দুটো মোষ আর একজোড়া হাল-বলদ। ওর ঘরের দেওয়ালগুলোতে চুন-সুরকি আর ইঁটের গাঁথনি।
আর ওর ঘরটি হলো পাড়ার মধ্যে একটা চৌমাথায় সতনাম সম্প্রদায়ের জৈতখাম্বা,মানে বিজয়স্তম্ভের সামনে। সতনাম সম্প্রদায় গুরু ঘাসীদাসের অনুগামী। ছত্তিশগড়ে অনুসূচিত জাতির মধ্যে ওঁর স্থান ডঃ আম্বেদকারের চেয়ে কম নয়। গিরোদপুরী গাঁয়ে জন্মানো এই সন্ত প্রচার করেন যে কেউ অছুৎ নয়। মনুবাদীদের,মানে উচ্চবর্ণের চেয়ে নিজেদের খাটো বা হীন মনে করার কোন কারণ নেই। দরকার নিজের ইন্দ্রিয়ের উপর বিজয় প্রাপ্তির। তাই ওঁর নির্দেশ সাদা সরল জীবন যাপন কর। হীন জীবিকা ছেড়ে দাও। মাসাহার, মদ্যপান ইত্যাদি ছেড়ে দাও। আর সৎ বা সত্যনাম এর প্রচার কর। সতনামী সম্প্রদায় দলিতদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো সম্প্রদায় এবং এরা নিজেদের অন্য দলিত,যেমন রামনামী বা মুচিদের থেকে উঁচু মনে করে।
এদের প্রত্যেক পাড়ায় রয়েছেএকটি করে ‘জৈতখাম’ বা জয়স্তম্ভ, মানে প্রায় দশফুট উঁচু একটি খুঁটি তাতে সাদা রঙ করা, মাথায় পতপত করে ওড়ে সাদা পতাকা। বিশেষ বিশেষ দিনে এরা এর সামনে জড়ো হয়ে বন্দনা গায় ও নাচে। এইভাবে ছত্তিশগড়ে বিকাশ ঘটেছে “পন্থী” নামের একটি লোক নৃত্যশৈলীর।
সাদা ধুতি ও সাদা গেঞ্জি গায় একজন মাদলবাদক ও বড়ো করতাল নিয়ে এরা গোল হয়ে বুক চাপড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে একরকম পুরুষালী নাচ নাচে। প্রথমে একজায়গায় দাঁড়িয়ে তাল দেয়, বুক চাপড়ে পা ঠুকে; তারপর বৃত্তাকারে ঘুরে নাচে, লয় বাড়তে থাকে।
গানটি হলো “সত্যনাম সত্যনাম সত্যনাম সার, গুরুকে মহিমা অপার”।
লয় দুনি ছাড়িয়ে চৌদুনে পৌঁছলে বৃত্তের মাঝখানে ওরা নাচের তালে তালে জনাকয়েক নর্তক আর্চ করে ছোট একটি বেদি বানায়, ওর উপরে উঠে দাঁড়ায় আরও কয়েকজন। এভাবে একটি ত্রিস্তর পিরামিড তৈরি হয়, আর তার শীর্ষবিন্দুতে উঠে দাঁড়ায় মাদল বাদক। দর্শকদের আবেগ তখন চরমে। মিনিট খানেক এই ‘দিব্য উন্মাদনা’ থাকে, তারপর ওরা একইভাবে নেমে এসে আগের মত বৃত্ত বানিয়ে লয় কমিয়ে মুখড়ায় ফেরে।
অলগুরাম নাচতে পারে না। কিন্তু ওর ছেলে ফিরতরাম পারে। তাই গাঁয়ের নবযুবকদের টোলিতে ওর খুব কদর। তবে অলগুরামের কদর কম নয়। আশপাশের দশটা গাঁয়ে কেউ ওর মত ইঁট বানাক দেখি। কমবয়সে ও গাঁয়ের আদিবাসী হোমরাচোমরা আনন্দরামের ইঁটখোলায় কাজ করত। গাঁয়ের সীমানা বা সরহদের বাইরে আহিরণ নদীর পাড়ে পড়তি জমির ইজারা নিত আনন্দরাম। নামেই ইজারা, আসলে একটা থোক টাকা পঞ্চায়েতকে দিলেই হলো। নদীর পারে শুনশান এলাকায় পড়ে থাকা জমিতে কে কতটা মেপে নিচ্ছে আর কেই বা মাপতে আসছে!
তবে আহিরণের পাড়ে এঁটেল মাটিতে বালুর ভাগ মন্দ নয়; ইঁট তৈরির জন্যে একেবারে ফিট। অলগুরাম প্রথম জীবনে বড়ো ওস্তাদ মিস্ত্রির কাছে কাজ শিখেছে। মন দিয়ে করেছে কাঠের সাঁচায় কাদা মাটির তাল ভরে ইঁট বানিয়ে থোক দিয়ে সাজিয়ে তাতে কাঠকয়লা ও ধানের তুষ দিয়ে আগুনে পোড়ানো। এগুলোকে বলে বাংলা ভাট্টা, চিমনি ভাট্টার তুলনায় এতে খরচা অনেক কম কোয়ালিটি বা ‘গুণবত্তা’র কথা যদি বলো তো কোন সরকারি কাজে এই ইঁট নেওয়া হবে না। কোরবার কাছে যে কোয়ার্টারগুলো উঠছে তাতেও সরাসরি যাবে না। কিন্তু গাঁয়ে গঞ্জে স্কুলবাড়ি, কাছারি, থানার কোয়ার্টার,পঞ্চায়েত ভবন, লোকজনের ঘর বাড়ি, কুয়োর পাড় বাঁধানো, মন্দির তৈরি—সবতাতেই এই ইঁট চলে।
আবার সরকারি কাজে ঠেকেদাররা টেন্ডারে বাংলাভাট্টার কথা বললেও কাজের মাঝখানে চালিয়ে দেয় আনন্দরামের ইঁট; একবার তার উপর সিমেন্ট মশলা লেপা হয়ে গেলে কার সাধ্যি ভুল ধরে।
এইখানেই অলগুরামের হাতের কাজ। ওর হাতে তৈরি ইঁট ‘গুণবত্তা’র জোরে চিমনিভাট্টার সঙ্গে টক্কর দেয়। ধীরে ধীরে আনন্দরামের বাংলাভাট্টার ইঁট একধরণের অলিখিত ব্র্যান্ডনেম হয়ে দাঁড়ায়। যার হেডমিস্ত্রি হলো অলগুরাম। ওর মজুরি বা ‘বনিভূতি’ অন্যদের তুলনায় বেশ বেশি।
কয়েকবছরের মধ্যে অলগুরাম কিনে ফেলে একফসলী দশ একর জমিন; বাড়ির ছাদে খাপরার জায়গায় টালি লাগে। আর পেছনের উঠোনে একজোড়া হালবলদ ছাড়া দুটো দেশি গাই।
বাংলাভাট্টার কাজ শুরু হয় দীপাবলী উৎসবের সময় থেকে, ছ’মাস। ফাগুন-চোতে কাজ শেষ; ইঁট পাকানো চলে। আর তখন থেকেই ঠেকেদারের দল দর- দস্তুর ‘বোলি’র জন্যে আসতে থাকে। বাতচিৎ জম গয়া তো ট্রাক নিয়ে,ট্রাকটর নিয়ে মায় গরুর গাড়ি নিয়ে ইঁট তোলা শুরু হয়। আষাঢ় এর বৃষ্টি নামার আগে সব শেষ করতে হবে। নইলে ‘নুকসান’। তাই ‘নীলনবঘনে আষাঢ়গগনে’ দেখা দিলেই মালিকের কপালে ভাঁজ পড়ে।
তবে মনসুনের প্রথম দিকের একটা দুটো পশলায় তেমন কিছু হয় না। ইঁট গলে না। কিন্তু তখন থেকেই রেট নামতে থাকে; মার্জিন কম থাকুক, নিয়ে তো যাক। বেশি লোভ করলে ইতোনষ্টঃ ততোভ্রষ্টঃ!
ঘনবর্ষার দিনে দেখা যাবে মাঠ ফাঁকা। আকাশ আর মাটি লেপে একাকার। তিনদিন ধরে ক্রমাগত ধারাবর্ষণ। ক্ষেতে লাল-নীল-সবুজের সমারোহ, রঙিন লুগরা গাছকোমর করে মেয়েরা ধান রুইতে নেমেছে। কখনো কেউ গান ধরেছে ‘রিমির ঝিমির বরষে পানি’। পুরুষ কন্ঠে শোনা যায় ‘বর্ষারাণী ঝুমকে বরষো’।
তবে শুনশান ইঁটাভাট্টায় চোখে পড়বে নিভে যাওয়া চুল্লির ভগ্নাবশেষ; বিক্রি না হওয়া কিছু ইঁটের পাঁজা। আর যেখান থেকে মাটি কেটে তোলা হয়েছিল – ধরিত্রীর বুকের সেই বিশাল ক্ষত রাতারাতি ভোল ধরেছে এক গেরুয়া জলের পুকুরের। অমন পুকুর পাড়ে পরিত্যক্ত ইঁটের পাঁজা কিন্তু প্রাণহীন নয়। ক্রমশঃ বুকে হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আসছে করেইত, চন্দ্রবোড়া ও ডোমহির (কেউটে)পরিবার। মাঝে মাঝে বৃষ্টি একটু দম নিলে আকাশে ফোটে সাতরঙা ইন্দ্রধনুষ। সেই মায়াবী আলোয় জেগে ওঠে জরৎকারু-জরৎকারী-আস্তিকের দল। কখনও কোন মাঠের উপর দিয়ে ছাতা মাথায় শর্টকাট পথ ধরে বাড়িফেরা পথিকের চোখে পড়ে সেই বিরল দৃশ্য—সাপের শঙ্খলাগা।
চমকে ওঠা লোকটি দু’হাত তুলে নমস্কার সেরে বাড়ি ফেরে আনন্দসাগরে ভেসে। বৌকে জানায় শিগিরই কোন ভাল কিছু ঘটতে চলেছে। হয়ত ছেলেটার মন এলোমেলো ঘুরে না বেড়িয়ে ঘরের পোষা ময়না হয়ে দাঁড়ে বসবে। হয়ত এ শীতকালে নদীর পাড়ে তরমুজের ক্ষেতি ভাল দাম পাবে।
বৌ ভাবে হয়ত ভরা পোয়াতি ছোট মেয়েটার শ্বশুরবাড়ি থেকে নাতি হওয়ার খবর আসবে।
কিন্তু আজকে অলগুরাম যখন নিজেদের ইঁটভাট্টার পাশ দিয়ে ছাতি মাথায় মাঠ পার করছিল তখন পড়ন্ত বড়ো ভাট্টার আড়ে চোখে পড়ল শঙ্খলাগা। নাগ-নাগিন নয়; এ যে মানব-মানবী। আর জোয়ান লেইকাটি যে চেনা চেনা লাগে!
আজ নির্বিরোধী অলগরাম, বিবাদ ঝগড়া ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে চলা ভালোমানুষ অলগু, বাজের গুরুগুরু আওয়াজে গর্জে ওঠে—কউন হ্যাঁয় রে! কউন হো তুমন! কোন গাঁওকে? কা করথো ইঁহা?
ওরা লুকিয়ে পড়ে। অলগরাম বুঝতে পারে পাঁজার আড়ে দু’জোড়া অদৃশ্য চোখ ওকে নজরে রেখেছে। ও দ্রুত পায়ে পাঁজার দিকে এগোয়। ওদিকে কোন হলচল নেই। অলগু একটু থমকে দাঁড়ায়। তারপর ছাতাটা শক্ত হাতে বাগিয়ে ধরে দৌড়ুতে শুরু করে। কিন্তু হঠাৎ একটা জলভরা গর্তে পা আটকে ও পিছলে পড়ে। এবার ও চিৎ অবস্থা থেকে কাত হয়ে দুহাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে; পারে না। মনে হয় ডানপায়ের গোড়ালি মচকেছে। অসহায় মুখ দিয়ে একটা কাতরানি বেরিয়ে আসে।
কিন্তু একজোড়া তরুণ হাত ওকে শক্ত করে ধরে তোলে।
--উঠ যা কক্কা! কাবর চিখলা মা উছল-কুদ করথস? উমর লা কৌন খয়াল করহি?
ওঠ কাকু! কেন যে এই পেছল কাদার মধ্যে দাপাদাপি করিস? বয়সের খেয়াল না করলে চলে? নে,আমার কাঁধে হাত রাখ; আস্তে আস্তে চল। বাড়ি গিয়ে কাকি কে বলিস চুণ-হলুদ গরম করে লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিতে।
চলতে থাকে অলগুরাম। মেয়েটা কে? যেই হোক বড্ড ভাল। অনেক যত্ন করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এই সপসপে ভিজে মেয়েটার গা থেকে কেমন একটা সোঁদা গন্ধ,কেমন একটা ভাপ উঠছে; যেন গরম ধূলো ভরা মাটিতে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা।
--তঁয় কৌন হস ও নোনি? কা’কর বেটি?
-- ময় দুরুপতী বাঈ, ছোটকি ছুরি কে।
-- কৌন দুরুপতী? ও ভালু-মার দুরুপতী?
খিলখিলিয়ে হাসে মেয়েটি; মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আর অলগুরাম দেখতে পায় ওর কপালে একটা আড়াআড়ি দাগ; পুরনো সেলাইয়ের।
এবার অলগুরামের পাড়া দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা অন্য পথ ধরবে।
--একঠন গোঠ লা সুন; ও টুরা কউন রইসে?
একটা কথা শোন; ছেলেটা কে?
--কউন টুরা?
-- তোর সংগ যোউন রইসে?
--তোর ঘর আ গয়ে কক্কা; ঘর যা। দাওয়া-দারু কর। ফালতু কে লকরধকর লা ছোড়।
দ্রুত পায়ে ছোটকি ছুরির পথ ধরেছে দ্রুপতী বাঈ; ঝেঁপে বৃষ্টি এল।
অবাক অলগুরাম ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মাটির ভেজা দাওয়ায় উঠতে গিয়ে পায়ে বিদ্যুতের ঝিলিক, গুঙিয়ে ওঠে ও। সেই আওয়াজ শুনেই বোধহয়, দৌড়ে এল ধনরাসিন বাঈ।
ধনরাস গাঁয়ের মেয়ে, তাই নাম পড়ল ধনরাসিন বাঈ। সেই নামেই শ্বশুর শাস, দেড়শাস সবাই ডাকতে লাগল। ক্রমে ক্রমে ও নিজেও ভুলে গেল যে ওর বাপ-মায়ের দেওয়া নামটি—পার্বতী বাঈ।
স্ত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে দাওয়ায় উঠে বালতি লোটার সদব্যবহার করে ভিজে ফতুয়া ছেড়ে খাটিয়ায় বসেছে অলগুরাম। বৌকে মিষ্টি করে বলল—শুন না ও! মোলা বুখার বুখার লাগথে। এইসন কর, এক গিলাস ঠান্ডি চায় পিলা দে মোলা!
বৌয়ের চোখ কপালে! মানুষটা এখন মদ খাবে? এটা তো দুপুরের খাওয়ার সময়। ও যে যত্ন করে লহসুন অউ মিরচি দিয়ে পোই ভাজি ( পুঁইশাক) আর তিওরার ডাল (খেঁসারি) রেঁধে রেখেছে তার কী হবে? ও নিজে এখনো না খেয়ে রয়েছে। অভিমানে গলা ধরে আসে।
অলগুরাম বৌয়ের মনের ভাব বুঝতে পারে, একটু ভয়ও পায়। ধনরাসিনের মনটা ভাল। ওর খুব যত্ন করে। কিন্তু যদি একবার খেপে যায় পাড়ার অন্য বৌদের মতো চেঁচিয়ে কেঁদে কেটে একশা করবে না। শুধু তিনদিন কথা বলবে না।
আর এটাই সবচেয়ে বড়ো শাস্তি। সব কথা বৌয়ের সঙ্গে না বললে অলগুরামের যে পেট আইঢাই করে। এখন মাঠের কাজ শেষ, ইঁট প্রায় বিক্রি হয়ে গেছে। তবে হাতে সব পয়সা আসতে এখনও এক-দেড় মাস। আর খেতের কাজকম্ম মনে হয় ঠিকই চলছে। ইন্দ্রদেব প্রসন্ন হয়েছেন। ধান রোয়া শুরু হয়ে গেছে।
তাই একটু অনুনয়ের স্বরে বলে—নারাজ ঝন হোবে তঁয়,লাইনপাড়া কে ধীরহে গুরুজির কে ঘর মা বনি এক বোতল মহুয়া পরশু লায়ে হন। দু –গিলাস পী লেব, ওলা দাওয়া-দারুকে কাম করহি। পানি মা ভারি ভিগা গয়ে ও। হাত- পাও- সর অত্তি পীড়তে, ওকর বাদ ভাত খাবো।
রাগ করিস না। লাইনপাড়ার ধীরহে মাস্টারের ঘরে তৈরি এক বোতল মহুয়া পরশুদিন এনেছিলাম। দু-গেলাস খেলে ওষূধের মতন কাজ করবে। জলে ভিজে একশা, হাত পা গা টাটাচ্ছে; ওর পরে ভাত খেয়ে নেব।
দু’গেলাস শুদ্ধ মহুয়া টেনে মেজাজ ফুরফুরে হলে জানতে চাইল ছেলে কোথায়?
আরে ছেলেকে তো তুমিই মাঠে পাঠিয়েছ; ধানের চারা কী অবস্থায় আছে, ধান রোয়া কতটুকু বাকি আর রেজাদের বনিভুতি (মজদুরি) কত দিতে হবে সেসব দেখতে বলেছ, মনে নেই?
চমকে ওঠে অলগু; মনে পড়ছে, অনেক কিছু মনে পড়েছে।
আচ্ছা, ছেলেটা কোন জামাটা গায়ে চড়িয়ে বেরিয়েছে বলতে পারবে?
কাঁসার থালায় ভাত বাড়তে বাড়তে ধনরাসিন অবাক চোখে ওর ছেলের বাপকে দেখে। হলো কী লোকটার!
কেন কী ওসব ছাড়, ঠিক করে বল, কোন জামাটা? লাল রঙাটা?
না না; গতবার দীপাবলীর দিনে কোরবা থেকে কিনে দিয়েছিলে না, সেই যে চকোলেট রঙা চকরা বকরা? সেইটা।
ঠিক সে গোঠিয়া; তোলা পক্কা মালুম?
ঠিক করে বল, মনে পড়ছে?
অলগুরাম গুমসুম হয়ে যায়।
ভিজে মাঠে পিছলে পড়ার আগে চোখে পড়েছিল ইঁটভাটার পেছন থেকে উঁকি মারছে একটা চেহারা,তার গায়ে চকোলেট রঙা জামা, চকরা বকরা।
দু-তিন গরাস খেয়ে ও ডাল মাখা ভাতে জল ঢেলে দিয়ে উঠে পড়ে।
ধনরাসিন বাঈয়ের পিত্তি জ্বলে যায়। বাড়া ভাতে জল ঢেলে দেওয়া?
শান্ত হিমশীতল গলায় জিজ্ঞেস করে পতিদেবতাটি জুয়োয় হেরে এসেছেন কি না?
জুয়োয় হারা অলগুর কাছে নতুন কিছু নয়। ও জুয়ো খেলতে বসে হেরে যাবার আনন্দে। ইঁটভাট্টার কাজ শেষ হলে ও কিছু টাকা আলাদা করে রাখে; খেলে হারবে বলে।
বৌকে কিছু না বলে ও কাঁথা মুড়ি দিয়ে শোয়। জ্বর আসছে হু-হু করে।
0 comments: