1

গল্প - সমীক্ষণ সেনগুপ্ত

Posted in


গল্প


মণিমামার কাহিনী অথবা একটি ছবির গল্প
সমীক্ষণ সেনগুপ্ত




স্কুল থেকে হুড়মুড় করে ফিরে ধুপ করে ব্যাগটা রেখেই রুনু বলে উঠলো, "উফফ, আজকে একটুর জন্য প্রাইজটা মিস করলাম, জানিস!"

যার উদ্দেশ্যে বলা, সে হলো রুনুর দুবছরের বড় দাদা – রোনটু। রোনটু কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে স্কুল থেকে, ফিরে গা-হাত-পা ধুয়ে স্টেটসম্যানটা খুলে পড়তে বসেছে।

সে এখন ক্লাস টেন-এ পড়ে, স্কুলের অসীম স্যার বলেছেন রোজ ইংরিজি খবরের কাগজ পড়তে, তাতে নাকি লেখার হাত নাকি ভালো হয়। সামনে কাগজটা খোলা আছে বটে, কিন্তু তার মনটা পড়ে আছে কখন রুনু স্কুল থেকে ফিরবে তার দিকে।

তারপর খেয়ে-দেয়ে তারা সোজা চলে যাবে দত্ত বাগানের মাঠে, সন্তু, বিতান, অবিন, শ্যামলদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে...

রান্নাঘর থেকে মায়ের রুটি সেঁকার হাল্কা গন্ধ আসছে, সঙ্গে বোধয় আলু-ফুলকপির তরকারি। রোনটুর খিদে খিদে পাচ্ছিল, সে জিজ্ঞাসা করলো, "কেন রে? কোথায় ছড়ালি?"

"আরে ছড়াই নি রে ভাই..." বলে চেঁচিয়ে শুরু করতে যাচ্ছিলো রুনু...

"আরে আস্তে... আস্তে... মা কিম্বা দিদি শুনতে পেলে..." রোনটু ওকে সাবধান করে দেয়। স্কুলে শেখা "নতুন" বুলিগুলো দুই ভাইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকাটা বাঞ্ছনীয়।

রুনুর গলার আওয়াজ পেয়ে পাশের ঘর থেকে দিদি রিমি বেরিয়ে আসে। সদ্য কলেজে ওঠা রিমি ইদানিং একটু গম্ভীর ভাব দেখানোর চেষ্টা করছে ভাইদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে। সে জিজ্ঞাসা করে, "কি হয়েছে রে রুনু? এতো হই হই করছিস কেন?"

"আরে আর বোলো না গো... আজকে তো কুইজ ছিলো, বেশ ভালো খেলছিলাম আমি আর কিঞ্জল...", উৎসাহ নিয়ে রুনু শুরু করে এবার, "কয়েকটা দারুণ দারুণ কোয়েশ্চেনের উত্তরও দিলাম... যেমন, ক্রিকেটে থার্ড আম্পায়ার প্রথম কোন ব্যাটসম্যানকে আউট দিয়েছিলো... তারপর ল অফ রোবটিক্সের জনক কাকে বলা হয়... মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসস্তূপ কে আবিস্কার করেছিলেন... এইসব..."

একটু থেমে রোনটুকে বলে, "তারপর কি জিজ্ঞাসা করলো জানিস? ক্রিকেটে সব চেয়ে কম বয়সে ক্যাপ্টেন হওয়ার রেকর্ড কার..."

খিদে পেলেও রোনটু মন দিয়ে শুনছিলো, বলল, "জিম্বাবোয়ের তাতেন্দা তাইবু, না?"

অস্থির হয়ে রুনু হাত ছুঁড়ে বলে, "আরে না রে, ওটাই তো লোকে ভুল করে... তাইবু এই কিছুদিন আগে অবধি ছিলো। এখনকার সবচেয়ে কম বয়সের ক্যাপ্টেন হচ্ছে..."

"রশিদ খান, আফঘানিস্তানের ক্যাপ্টেন!!!"

সবাই চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালো।

দরজায় যে ছ ফুটের মানুষটা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর পরনে জলপাই রঙের জ্যাকেট আর পুরনো সবজেটে-নীল রঙের জিনসের প্যান্ট, জ্যাকেট-জিন্স কোনওটাই বোধয় অনেকদিন সাবানের সংস্পর্শে আসে নি। কাঁধে তাঁর একটা বড় ক্যাম্বিসের ব্যাকপ্যাক আর হাতে একটা মিষ্টির বড় হাঁড়ি। পুরুষ্টু গোঁফের ফাঁক দিয়ে ভদ্রলোক অমায়িক হাসি হাসি চোখদুটো নিয়ে ভাই-বোনেদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

"মণিমামা!!!" তিনজনই একসঙ্গে লাফিয়ে উঠলো। ইতিমধ্যে চেনা গলা শুনে মা-ও রান্নাঘর থেকে চলে এসেছিলেন।

"বড়দা, তুই! কখন এলি?" বলে মা একগাল হেসে গলায় আঁচল জড়িয়ে প্রণাম করলেন।

"আরে, থাক থাক..." বলে মানুষটা শশব্যাস্ত হয়ে উঠলেন।

রুনুর কুইজের গল্প আর ফুটবল খেলতে যাওয়া ইচ্ছা সাথে সাথে উড়ে পালাল… মণিমামার হাত থেকে ব্যাগ আর মিষ্টির হাঁড়িটা নিয়ে মাকে দিতে তার যেন তর সইছিলো না, সে বলে উঠলো, "মণিমামা, তুমি কোথা থেকে এলে এবার? বিদেশ থেকে? নাকি দেশেই ছিলে? এই, তোমার ব্যাগে এয়ারলাইন্সের ট্যাগ দেখলাম মনে হলো? কি ওয়েস্ট-জেট না কি... কোথাকার গো ওটা? ক্যানাডা??..."

"হা হা" করে হাসতে হাসতে বারান্দার চেয়ারটায় বসে জুতো ছাড়তে ছাড়তে মণিমামা বললেন, "...বলবো, বলবো...আরে বাবা, আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি..."

"দাদা, চা খাবি তো?" মা জিজ্ঞাসা করলো।

"হ্যাঁ রে, যেমন খাই, লিকার, দুধ ছাড়া, চিনি দেওয়া..." বললেন মণিমামা।



চা পর্ব আর ছেলেদের খাওয়া-দাওয়া মিটতে মিটতে মিনিট কুড়ি লাগলো। তারপর দোতলার বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে ভাই বোনেরা মণিমামাকে ঘিরে ধরে বসলো।

বছর পঁয়তাল্লিশের মণিমামা চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন বোধয় হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি না টিচারী কি একটা দিয়ে। তারপর হেন কোনও পেশা নেই যাতে তিনি না ঢুকেছেন বা ঢোকার চেষ্টা না করেছেন – ছোটখাট প্রাইভেট অফিসে অ্যাকাউনটসের কাজ থেকে শুরু করে টুরিস্টদের দোভাষীর কাজ, সাংবাদিকতার কাজ, হোটেলে শেফের কাজ, ওয়েব-ডেভেলপারের কাজ, ফটোগ্রাফারের কাজ, এমনকি আমেরিকায় ট্যাক্সিচালকের কাজ পর্যন্ত করেছেন ভদ্রলোক। বিয়ে-থা করেন নি; মণিমামা বলেন কোনও কাজ-ই অসম্মানের নয়, আর কোনও কাজই ২-৩ বছরের বেশি করা উচিত নয়, তাতে নাকি মানুষ "বসে" যায়।

তাই তিনি সারা পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছেন, নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন, আর সেই সঙ্গে আছে তাঁর লেখা-লেখি। ইংরিজি, বাংলা, হিন্দি তো বটেই, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান ভাষাতেও তিনি লিখতে পারেন! আরও বারোটা ভাষা তিনি জানেন এবং অনায়াসে বলতেও পারেন।

আর হবে নাই বা কেন, কতো নাম-না-জানা শহরে থেকেছেন, কতো বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে, কতো অদ্ভুত পশু-পাখি এবং মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন তিনি!!! এই তিনি বলিভিয়ার লা পাজ থেকে কোরওইকোর ৪০ মাইল রাস্তা ট্রেক করছেন, তো এই তিনি টানজানিয়ার সেরেঙ্গেটি ন্যাশানাল পার্কে সিংহ, হাতি, জিরাফের ছবি তুলছেন। আগের বছরই জুন মাসে স্পেনের সেগোভিয়াতে গেছিলেন ২০০০ বছরের পুরনো রোমান অ্যাকুইডাকট দেখতে, তারপরেই শোনা গেলো নভেম্বরে লাইম রেগির মিউজিয়ামে হানা দিয়েছেন মেরি অ্যানিং-এর সংগ্রহশালা দেখার উদ্দেশ্যে!!

যে কোনও জায়গা যাওয়ার আগে ইনটারনেটে সেখানকার সম্বন্ধে ভালো করে পড়াশোনা করে নেন, তারপর পৌঁছে মোটামুটি সস্তার একটা জায়গায় গিয়ে ওঠেন। তারপর জায়গাটা মন দিয়ে ঘুরে দেখে, সেখানকার লোকজনের সঙ্গে মিশে যদি ভালো লাগে,তাহলে কিছুদিন সেখানে থেকে যান। একটা ছোট খাট কাজ-ও জুটিয়ে নেন, যাতে থাকা-খাওয়ার অসুবিধা না হয়। তারপর সেখানকার মাটিতে ঘুরে বেরিয়ে, সেখানকার ফল-মুল আস্বাদন করে, পশু-পাখি-মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে মিশে হয়তো কিছু লিখলেন। সেগুলো হয় এক একটি রত্ন!

মণিমামা বলেন যে কোন জায়গারই একটা হৃদয় আছে, সেটার নাড়ির স্পন্দন যদি টের পাওয়া যায়, তাহলে তার চেয়ে আনন্দের আর কিছু হয় না।

এমনিতে ধূমপান করলেও, ছোটদের সামনে করবেন না বলে মণিমামা তামাকের পাউচটার দিকে একটু তাকিয়ে সেটাকে দূরে সরিয়ে রাখলেন। তারপর মোটা কাশ্মিরি কার্পেটের উপর জুত হয়ে বসে তাকিয়াটা টেনে নিয়ে বললেন, "আমার গল্প তো শুনবি, তার আগে বল রুনুদের স্কুলের কি কুইজের কথা বলছিলি?"

রোনটু বলছে যাচ্ছিলো, রুনু-ই হই-হই করে বলে উঠলো, "আরে আমাদের স্কুলের কুইজ গো, ঠিক উত্তর দিয়েও পয়েন্ট পেলাম না, রানার্স হয়ে গেলাম। কুইজ-মাস্টারটাই ভুল-ভাল জানে!! তাতেন্দা তাইবু এই কিছুদিন আগে অব্দি বয়সে সবচেয়ে ছোট ক্যাপ্টেন ছিলো, এখন সেটা রশিদ খান!!"

হা হা করে হেসে উঠলেন মণিমামা, বললেন, "জানিস আমারও স্কুল-লাইফে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিলো! কুইজ-মাস্টার ভুল জানতো, আর আমি জানতাম একদম ঠিক উত্তর দিয়েছি।"

গল্পের একটা আলাদা স্বাদ আর গন্ধ থাকে, যারা এই স্বাদটা পেয়েছে, তারা জানে গন্ধটা কিরকম। সেই গন্ধ পেয়েই ভাইবোনেরা মণিমামার কাছে ঘেঁসে বসলো, রিমি জিজ্ঞাসা করলো, "কি প্রশ্ন গো মণিমামা?"

একটু দম নিয়ে মণিমামা বললেন, "তাহলে তো অনেক কথা বলতে হয়..."



"আমি তখন রুনুর বয়সী, ক্লাস এইট না নাইনে পড়ি। আমাদের জয়চাঁদ মেমোরিয়াল স্কুলটা দারুণ নাম-করা কিছু না হলেও, পড়াশোনাটা ভালই হতো সেখানে। বিশেষ করে হেডমাস্টারমশাই বিশ্বম্ভর বাবুর দাপটে আমরা সবাই তটস্থ হয়ে থাকতাম। অকৃতদার মানুষটার ধ্যান-জ্ঞান ছিলো আমাদের এই ছোট স্কুলটাকে ঘিরে। যেমন দুর্ধর্ষ ফিজিক্স পড়াতেন, তেমনি ছিলো তাঁর বেতের ঘা, পুরো F=ma, নিউটনের দ্বিতীয় সুত্র, আমরা বলতাম!! যাইহোক, তাঁকে ভয়-ভক্তি দুটোই করতাম, আর তিনি প্রতি বছর কুইজের আসর বসাতেন। বাইরে থেকে কুইজ-মাস্টার নিয়ে এসে কুইজ পরিচালনা করা হতো।

তো সেরকমই একটা কুইজে শেষ প্রশ্নে একটা ছবি দেখানো হয়েছিলো। কোন ছবিটা জানিস?

ভারতীয় চিকিৎসা- শাস্ত্রের জনক যাকে বলা হয়, সুশ্রুত, তিনি তাঁর ঋষি-সুলভ চেহারা নিয়ে একজন রোগীর উপর অস্ত্রোপচার করছেন। রোগীর হাত-পা ধরে রেখেছেন কয়েকজন, সম্ভবত তাঁরা রোগীর বাড়ির লোক অথবা সুশ্রুতের সহকারী, যাতে সে ব্যথায় বেশি নড়া-চড়া না করতে পারে...অ্যানেস্থেসিয়া আবিষ্কারের আগে অবধি এভাবেই শল্য-চিকিৎসা করা হতো। ছবিতে আরও কয়েকজন রয়েছে, যারা খুব সম্ভবত সুশ্রুতকে এই "অপারেশন"-এ সাহায্য করছে...

তোরা ছবিটা দেখে থাকবি নিশ্চয়ই, এই দেখ এই ছবিটা..." বলে মণিমামা পকেট থেকে ফোন বার করে গুগুলে সার্চ করে ছবিটা দেখালেন।

"তো প্রশ্ন ছিলো ছবিটি কার আঁকা? আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী টিম সাধারণ ভুলটাই করে বসলো - তোর ওই তাতেন্দা তাইবুর মতো। বলল, এটা রাজা রবি বর্মার আঁকা ছবি। আঁকার স্টাইল ও বিষয়বস্তু দেখে রবি বর্মার আঁকা ছবি বলেই মনে হয় বটে।

কিন্তু আমি কিছুদিন আগে লাইব্রেরির কি একটা বইতে সম্পূর্ণ অন্য কথা পড়েছিলাম। বললে হয়তো অবাক লাগবে, কিন্তু এ ছবিটা আদৌ কোনও ভারতীয় শিল্পীর আঁকাই নয়!!

আমি জবাব দিলাম, রবার্ট থম!

বছর পঁচিশের চঞ্চল কুইজ-মাস্টারের মুখটা দেখে মনে হলো জীবনে কোনদিন নামটা শোনেননি। যথারীতি আমার উত্তরটা নাকচ হয়ে গেলো। রাজা রবি বর্মার দল জিতে গেলো, আর আমরা হলাম রানার্স আপ!

কুইজের শেষে আমার পার্টনার চিন্ময় আমাকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "কি উত্তর দিলি ওটা?"

জবাবে গম্ভীরভাবে আমি বললাম, "ঠিকই দিয়েছি। এটা যে রাজা রবি বর্মার আঁকা, সেটা একটা "মিথ"!" চিন্ময় আর বেশি ঘাঁটাল না।"

"কিন্তু ওটা কি সত্যিই রবার্ট ভম-এর আঁকা ছবি?" রোনটু জিজ্ঞাসা করলো।

মণিমামা হাসলেন, বললেন, "হ্যাঁ, কিন্তু রবার্ট ভম নয়, রবার্ট থম। আমেরিকার একজন সাধারণ কমার্শিয়াল ইলাস্ট্রেটর।

১৯৪৮ সালে মিশিগানের একটি বড় ওষুধের কোম্পানি পার্ক-ডেভিস রবার্ট থমকে পঁচাশিটা অয়েল পেইন্টিং-এর বরাত দেয়। তার মধ্যে চল্লিশটির বিষয় হবে ‘গ্রেট মোমেণ্টস ইন ফারমেসি’ আর বাকি পঁয়তাল্লিশটির হবে ‘গ্রেট মোমেণ্টস ইন মেডিসিন’। এই সিরিজের মধ্যেই আঁকা হয়েছিলো সুশ্রুতের ছবিটি, তলায় ক্যাপশান দেওয়া হয়েছিলো ‘Susruta - Surgeon of Old India’।

পরে ছবিটা দারুণ বিখ্যাত হয়ে যায় এবং অনেক জায়গায় সেটা পুনর্মুদ্রিত হয়। লাইফ ম্যাগাজিনেও বেরিয়েছিলো, বোধয় ১৯৫৯ সালে, পার্ক-ডেভিসেরই বিজ্ঞাপনে। তলায় লেখা ছিলো প্রাচীন ভারতে সুশ্রুত প্লাস্টিক সার্জারি করতে ব্যস্ত।

এই হলো ছবিটার ইতিহাস। পরে এটা অনেক জায়গায় আবার নতুন করে আঁকা হয় বটে, যেমন লিওনার্দোর মোনালিসার ক্ষেত্রে হয়েছিলো। রাজা রবি বর্মার আঁকার স্টাইলের সাথে মিল আছে বলে অনেকে ভুল করতে শুরু করলো ওঁর আঁকা বলে। ধীরে ধীরে মানুষ রবার্ট থমের কথা ভুলে গেলো..." বলে মণিমামা থামলেন।



সবাই চুপচাপ শুনছিলো মন দিয়ে। মফস্বলে শীতের সন্ধ্যে, চারপাশটা এর মধ্যেই নিঝুম হয়ে গেছে, বাড়ির পাশের গলিটা দিয়ে একটা রিকসা চলে গেলো প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে... বাবার অফিস থেকে ফেরার টাইম হয়ে এলো বোধয়। অন্যান্য দিন রুনু-রোনটু এই সময়ে হর্লিক্স খেয়ে যে যার ঘরে পড়তে বসে যায়। আজকে অবশ্য আলাদা ব্যাপার... প্রায় বছর খানেক পর মণিমামার আগমন ঘটেছে এ বাড়িতে!

হঠাৎ রুনু বলে ওঠে, "আচ্ছা মণিমামা, ওটা যে সুশ্রুতেরই ছবি, সেটা রবার্ট থম জানলেন কি করে? আর প্রাচীন ভারতে সুশ্রুতই যে প্লাস্টিক সার্জারি করেছিলেন, তার-ই বা প্রমাণ কোথায়? মানে আমরা সবাই জানি উনি সুশ্রুত-সংহিতা লিখেছিলেন, কিন্তু সেটা আবিষ্কার হয়েছিলো কি ভাবে?" একদমে অনেক গুলো কথা বলে রুনু থামল।

"হুঁ, ভালো প্রশ্ন করেছিস। কিন্তু সে তো অনেক বড় গল্প...

পৃথিবীর সর্বপ্রথম ম্যাগাজিন বলতে যেটাকে বোঝায় সেটা হলো এডওয়ার্ড কেভের প্রতিষ্ঠিত "দ্য জেণ্টলমেন্স ম্যাগাজিন"। সেখানে ১৭৯৪ সালের অক্টোবর ইস্যুতে একটা অদ্ভুত ছবি ছাপা হয়েছিলো। ছবিতে দেখা যায় কাওসজি নামে একজন মারাঠি ভদ্রলোকের উপর একটি "অপারেশন" চলছে। নকল নাক তৈরি করার অপারেশন, যাকে আজকের দিনে বলে রাইনোপ্লাসটি।

কালো, সুঠাম দেহের কাওসজি অ্যাংলো-মাইসোর যুদ্ধে ইংরেজের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলো। কিন্তু মনিবদের পরাজয় হওয়ার দরুন টিপু সুলতান শাস্তিমূলকভাবে তার নাক কেটে নেন। প্রাচীন ভারতে এটা অত্যন্ত কমন শাস্তি ছিলো। রামায়ণের সূর্পণখার গল্প তো শুনেছিস...

তো যাইহোক প্রায় এগারো মাস নাক-হীন অবস্থায় থাকার পর কাওসজি পুনের কাছে একজন কুম্ভকারের সন্ধান পান যিনি নকল নাক বানাতে পারেন। কাওসজি সেজে-গুজে এসে তার কাছেই "নাক বানাচ্ছেন"।

অপারেশনটি দু’জন ইংলিশম্যান প্রত্যক্ষ করেছিলেন – জেমস ফিন্ডলে আর টমাস ক্রুসো বলে বম্বে প্রেসিডেন্সির দুজন ডাক্তার। তাঁরাই "দ্য জেণ্টেলমেন্স ম্যাগাজিন"-এ এই অভূতপূর্ব ঘটনার সচিত্র বিবরণ পাঠান।

বিবরণ অনুযায়ী "কুমহার" বা কুম্ভকার প্রথমে কাওসজির কাটা নাকের উপর মোমের একটা প্লেট লাগিয়ে মোমের নাক তৈরি করে। তারপর সেই প্লেটটাকে কপালে চ্যাপ্টা ভাবে পেতে দেয়। তারপর পরিমাপ মতো কপালের চামড়া কেটে উলটে নিয়ে মোমের নাকের উপর বসিয়ে দেয় এমনভাবে যাতে চামড়ার অংশটি দেহ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন না হয়ে দুচোখের মাঝখানের অংশ দিয়ে জুড়ে থাকে। এই অংশটা শরীরের সঙ্গে রক্ত চলাচল বজায় রাখে। তারপর এঁটেল মাটি দিয়ে চামড়াটি জুড়ে, তুলো ব্যবহার করে নাকের উন্নতভাব তৈরি করে "পেশেণ্ট"কে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা হয়।

ফিন্ডলে আর ক্রুসোর তো এরকম অপারেশন দেখে চক্ষু চড়কগাছ!! বলা বাহুল্য, তাঁরা জীবনে কোনওদিন এ জিনিস দেখেননি। প্রাচীন মিশরে "নাক মেরামতি"র খবর পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সে তো মৃত ফারাওদের। বেঁচে থাকা অবস্থায় কারুর নাকের উপর এরকম শল্য চিকিৎসা করা হচ্ছে, আর তাও কিনা করছে একজন নিচু-জাতীয় কুমোর, এ তো ভাবাই যায় না!!! কিন্তু "কুমহার"কে জিজ্ঞাসা করে জানা গেলো এই পদ্ধতি নাকি ভারতবর্ষে বহুকাল ধরেই চলে আসছে, এবং এর আবিষ্কর্তা নাকি বৈদিক যুগের শল্য-চিকিৎসক সুশ্রুত!

ফিন্ডলে আর ক্রুসোর রিপোর্ট পড়ে লন্ডনের ডাক্তারি মহল নড়ে-চড়ে বসলো। "নোজ জব" বা রাইনোপ্লাসটির এই "chirurgical" প্রসিডিওর তাদের বেশ ভালো লেগেছে, বিশেষ করে কপালের চামড়াটাকে যেভাবে শরীর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন না করে সেটাকে "মৃত" হওয়ার থেকে রোধ করা হচ্ছে, সেই পদ্ধতিটা। তাহলে তো শরীরের যে কোন অংশই এভাবে মেরামত করা যাবে!

যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বিলেতের শল্যবিদরা উঠে পড়ে লাগলো এ প্রসিডিওর নকল করতে বা একটু রকম-ফের করে নিতে। এই ভাবেই ইওরোপে আধুনিক প্লাস্টিক সার্জারির জন্ম ঘটলো, এবং ১৮১৫ সালে জোসেফ কার্প বলে একজন চিকিৎসক দাবি করে বসলেন পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র নিপুণভাবে কাটা নাক বানিয়ে দিতে পারেন। বলা-বাহুল্য, এই পদ্ধতি যে ভারতবর্ষ থেকে আগত, সে কথা পণ্ডিতমহলের সবাই চেপে গেলেন!"


এক টানা অনেকক্ষণ বলে মণিমামা একটু দম নিলেন। রুনু-রোনটু-রিমির তো মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করছে। কিছুক্ষণের জন্য তারাও যেন কোওাসজি-ফিন্ডলেদের দুনিয়ায় চলে গেছিলো। মা মণিমামার জন্য চা নিয়ে এলো বলে আবার যেন তারা বর্তমান জগতে ফেরত এলো...

ধোঁওয়া-ওঠা লিকার চায়ে একটু চুমুক দিয়ে মণিমামা আবার শুরু করলেন... "সাহেবরা তাদের গর্বোদ্ধত অহমিকায় আসল আবিষ্কারকের নাম চেপে গেলে কি হবে, একটা জিনিস সব সময়ে জানবি, সত্যি কখনও চাপা থাকে না, একদিন না একদিন সেটা প্রকাশ পাবেই।

আর সুশ্রুত সংহিতার ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি করে প্রযোজ্য। এর আবিষ্কারের গল্প যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়!!!" বলে একটু থেমে চায়ে চুমুক দিলেন।

"বলো না, কি গল্প..." রুনু-রোনটু কাতরভাবে বলে উঠলো।

মণিমামা হাসলেন। তারপর উদাস মুখে বলতে শুরু করলেন, "এর ইতিহাস জানতে আমাদের যেতে হবে লাদাখে...১৮৯০-র দশকের লাদাখে...

১৮৮৮ সালের মার্চ মাস নাগাদ অ্যান্ড্রু ডাগ্লিশ নামক একজন স্কটিশ ব্যবসায়ী কারাকোরামের লে থেকে যাত্রা শুরু করেন ইয়ারকান্দের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী হলেন কয়েকজন আনদিয়ানি তীর্থযাত্রী ও ডাগ্লিশের কয়েকজন ব্যক্তিগত চাকর।

লে-লাদাখের এই অঞ্চল তাঁর কাছে খুবই পরিচিত, প্রায় বছর দশেক হয়ে গেলো তিনি এখানে আছেন। এখানকার প্রচলিত উইঘুর ভাষা তাঁর ভালো-মতন রপ্ত, এমনকি বিবাহ করেছেন একটি আনদিয়ানি মেয়েকে। মোটকথা, ১৮৭৩ সালে রবার্ট বেকলি শ-র উৎসাহে এখানে আসলেও, জায়গাটা তাঁর সেকেন্ড হোম হয়ে গেছে।

কিন্তু ব্যবসায়ের পাশাপাশি তাঁর আরেকটি পরিচয়ও ছিলো- তিনি ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর!

সেই সময়ে, ব্রিটেন এবং রাশিয়ার মধ্যে একে অপরের উপর গুপ্তচরবৃত্তির "খেলা" শুরু হয়েছিলো, সরকারি পরিভাষায় যাকে বলা হয় "দ্য গ্রেট গেম"। এর কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া আফঘান যুদ্ধে ব্রিটিশরা বাজেভাবে পরাজিত হওয়ার পর রাশিয়ানরা ইন্ডিয়াতে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছিলো, এবং ইংরেজরা তাদের ঠেকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। অ্যান্ড্রু ডাগ্লিশ এই বিশাল খেলার মধ্যে ছিলেন সামান্য একটি স্ক্রু বা বোলটু মাত্র।

তো যাইহোক, ডাগ্লিশ ঘুণাক্ষরেও জানতেন না এই লে থেকে ইয়ারকান্দ যাত্রাই তাঁর শেষ যাত্রা!

পথে কিছুটা যাওয়ার পরে দাদ মহম্মদ বলে একজন পাঠান ব্যবসায়ী ডাগ্লিশের সঙ্গী হলো। দাদ মহাম্মদের ব্যবসায় মন্দা চলছিলো তখন, হাতে পয়সাকড়ি একদমই নেই।

প্রায় মাস-খানেক চলার পর সেই কারণেই হোক, বা প্রভুর জাত হিসাবে আত্ম-অহমিকার কারণেই হোক, ডাগ্লিশ তাকে একদিন বেশ কিছুটা জ্ঞান দেন। ততদিনে দলটি কারাকোরাম পাস অতিক্রম করে কিছুটা দূরেই তাঁবু ফেলেছে।

অনাবশ্যক জ্ঞান শুনে পাঠানের মাথা গেলো গরম হয়ে। ব্যাস, আর যাবে কোথায়, রাগের মাথায় সে বন্দুক আর তরবারি দিয়ে ডাগ্লিশকে খুন করে বসলো!!

খুন তো করে ফেলেছে, এবার সঙ্গী আনদিয়ানি তীর্থযাত্রীরা যদি কাউকে বলে দেয়,তাই কোরান ছুঁয়ে শপথ করিয়ে দাদ মহম্মদ সেখান থেকে সোজা কেটে পড়লো। কিন্তু সে যেটা জানতো না, সেটা হলো ওখানকার স্থানীয় উপজাতি – আনদিয়ানি, বোটি,ইয়ারকান্দিদের মধ্যে ডাগ্লিশ বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তাই দাদ মহম্মদ পালানোর পরই তারা স্থানীয় ইয়ামেনের কাছে এই খুনের ঘটনা বিস্তারিতভাবে রিপোর্ট করে দিল। শোনা যায়, একজন আন্দিয়ানি নাকি এটাও বলেছিলো, "আমরা জবান দিয়েছি মুখ থেকে,কিন্তু মন থেকে কখনই নয়!"



এদিকে খুনের অভিযোগ তো দায়ের হলো, কিন্তু সেন্ট্রাল এশিয়ার পাহাড়-মরুভূমিতে ভরা ধুধু প্রান্তরে একজন দাদ মহম্মদকে খুঁজে বার করা খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার থেকেও কঠিন! কিন্তু ব্রিটিশদের ল অ্যান্ড অর্ডার তো জানিস, অপরাধীকে শাস্তি না দেওয়া অবধি কোনও ছাড়াছাড়ি নেই।

তাই পরবর্তী গ্রীষ্মেই হ্যামিলটন বোয়ার নামের একজন ইণ্টেলিজেন্স অফিসারকে পাঠানো হলো দাদ মহম্মদকে ধরে আনতে। এই মিশনে গিয়েই বোয়ার অত্যাশ্চর্য আবিস্কারটি করে বসেন!

রাশিয়ান সাহায্য নিয়ে বোয়ার মহম্মদকে খুঁজতে খুঁজতে বরফে-ঢাকা তিয়ান শান পর্বতমালার পার্শ্ববর্তী পথ ধরে তিনি কুছার বলে একটি গ্রামে এসে পৌঁছান। সেখানে একটি তুর্কি লোকের সাথে তাঁর আলাপ হয়। তার সাথে রোজ তিনি আড্ডা দিতেন, একদিন কথা প্রসঙ্গে সে বলে যে এই জায়গায় প্রাচীনকালে নাকি একটি শহর ছিলো, যেটা এখন মাটির তলায় চাপা পড়ে গেছে! বোয়ার জানতেন যে তুর্কি ভদ্রলোক ভারতে ঘুরে গেছেন ব্যবসা-সুত্রে। এই ধরনের গল্প তো ভারতে অনেক শোনাই যায়, তাই বোয়ার তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে সে গোবি মরুভুমির তলায় চাপা পড়া শহরের কথা বলছে কিনা। উত্তরে তুর্কি বলে যে না, এখানকার প্রাচীন শহরটির মানুষজন নাকি নিজেদের ইচ্ছাতেই মাটির তলায় চলে গিয়েছে, ধুলোর ঝড়ের জন্য না। তুর্কি আরও জানাল যে সে তার বন্ধুদের সাথে একদিন খোঁড়াখুঁড়ি করেছিলো, কিন্তু একটি পুরনো বই ছাড়া আর কিছুই পায়নি।

বইয়ের কথা শুনে বোয়ারের কৌতূহল হলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তুর্কি লোকটিকে সেটা দেখাতে বললেন, তুর্কি বইটা আনলে বোয়ার দেখেন সেটি বার্চ গাছের বাকলের উপর সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি পুঁথি!! বোয়ারের সংস্কৃত জ্ঞান না থাকলেও, পুঁথিটি যে অমূল্য,সেটা বুঝতে সময় নিলেন না, তিনি তুর্কির কাছ থেকে সেটি সংগ্রহ করে নিলেন।"

"এই পুঁথিটাই কি সেই..." রুনু আর উত্তেজনা চাপতে না পেরে বলে উঠলো।

রিমি মন দিয়ে শুনছিলো, বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, "আরে, শোনই না...উফফ, মাঝখানে ব্যাগড়া দিস কেন..."

মণিমামা আবার শুরু করলেন... "পুঁথি হস্তগত করার কিছুদিন পর বোয়ার দাদ মহম্মদকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন এবং ভারতে ফেরার জন্য রওনা হন। পথে মহম্মদ আত্মহত্যা করে, কিন্তু পুঁথিটির আবিষ্কারের খবরে এসব "তুচ্ছ" খবর চাপা পড়ে যায়।

বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটির হাতে বোয়ার পুঁথিটি তুলে দেন। তখন এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেণ্ট খুব সম্ভবত হেনরি বেভারিজ সাহেব। তখন সারা দেশ জুড়ে ভারত-চর্চার জোয়ার এসেছে, সভ্যতার নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে, কতো নতুন রাজাদের নাম, তাদের রাজত্বের নাম উঠে আসছে, স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে আমাদের সভ্যতা কতো প্রাচীন, কতো উৎকৃষ্ট, কিন্তু বিস্মৃত! এই মহাযজ্ঞের পুরধা ছিলেন স্যর উইলিয়াম জোন্স, তিনিই বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপন করেন। তাঁর কথা পরে একদিন বলবো তোদের...


যাইহোক, পুঁথিটির পাঠোদ্ধারের দায়িত্ব পড়ল রুডলফ হোয়ারনেল নামক একজন সাহেবের উপর। এই হোয়ারনেল সাহেব জাতে ছিলেন জার্মান, কিন্তু জন্মেছিলেন আগ্রার কাছে সেকেন্দ্রায়। তারপর জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করে তিনি আবার ভারতে ফিরে আসেন। ইংল্যান্ডে পড়াশোনাকালীন তিনি লন্ডনের ইয়ুনিভার্সিটি কলেজে থিওডোর গোল্ডস্টাকারের তত্ত্বাবধানে সংস্কৃত শিখেছিলেন। বেনারস হয়ে কলকাতায় এসে তিনি ক্যালকাটা মাদ্রাসার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তখন। এমন সময়ে তাঁর হাতে এসে পড়ল বোয়ারের পাণ্ডুলিপি বা "বোয়ার ম্যানুস্ক্রিপট"!

আমাদের “অসাধারণ” পাঠ্যক্রমের কল্যাণে রুডলফ হোয়ারনেলের নামটা বোধয় তোরা কোনদিনই শুনবি না, কিন্তু ভদ্রলোক প্রায় সারাটা জীবন সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে আগত নানা রকম পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার করে কাটিয়েছেন। স্যর অরেল স্টেইনের পাঠানো অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকে তিনি ব্রাহ্মী লিপির একটি আলাদা ক্যাটালগ বানান, যার গুরুত্ব অপরিসীম।

"বোয়ার ম্যানুস্ক্রিপট"-টি পড়তে গিয়ে হোয়ারনেল সাহেব দেখলেন সেটি সাতটা খণ্ডে বিভক্ত – দুটি ভবিষ্যৎ গণনার উপর লেখা, দুটি বৌদ্ধ আচার-আচরণের বিষয়ে এবং তিনটি প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রের ম্যানুয়াল, বিস্তারিত বিবরণ-সহ।

এই তিনটি ম্যানুয়ালের মধ্যেই উল্লিখিত আছে প্রাচীন দশ জন ঋষির নাম, যাঁরা হিমালয়ে বসবাস করতেন এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে দক্ষ ছিলেন। তাঁরা হলেন আত্রেয়, হরিত, পরাশর, করলা, বশিষ্ঠ, গর্গ, শাম্ভ, কাপ্য, ভেল, চরক এবং সুশ্রুত। বিশেষ করে শেষ তিনজনের নানা রকম কীর্তির বিবরণ আছে সেখানে। এছাড়াও লেখা রয়েছে সুশ্রুতের সুশ্রুত-সংহিতার কথা, এবং তাঁর অন্যান্য শল্য চিকিৎসার কথা। রয়েছে ৭৬ রকমের চোখের রোগ এবং চিকিৎসার বিবরণ, ১২১ রকমের যন্ত্রপাতির কথা যেগুলো অপারেশনে ব্যবহার হয়, ৪২ রকমের সার্জারির বিবরণ, যার মধ্যে একটি আমাদের "রাইনোপ্লাসটি" বা নাক লাগানোর পদ্ধতি!!!

পুঁথিটি পড়ে বোঝাই যায় যে যখন এটি লেখা হয়েছিলো, তখন সুশ্রুতের শল্য চিকিৎসার পদ্ধতি ব্যাপক-ভাবে অনুসৃত হচ্ছে।

ব্যস, সুশ্রুত-সংহিতার "সলিড" তথ্য-নির্ভর প্রমাণ এতদিনে পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে এটাও প্রমাণ হয়ে গেল যে আধুনিক শল্য চিকিৎসার জনক আর কেউ নন, স্বয়ং সুশ্রুত-ই। প্রায় একশো বছর পর গেঁয়ো যোগী ভিখ পেলো!"

বলে মণিমামা থামলেন, তারপর একটু জল খেলেন।

রুনু-রোনটু-রিমি যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলো। কোথায় পুনের কাছে কাওসজির নাক অপারেশন, তারপর কোথায় সুদূর তুর্কিস্তানে আবিষ্কৃত বোয়ার ম্যানুস্ক্রিপট, আর সেটি পাঠোদ্ধার হলো কোথায়, না খোদ কলকাতায়!!! সত্যি, ইতিহাস যে কিসের সঙ্গে কি মিলিয়ে দেয়, বলা মুস্কিল!!!

রুনুই প্রথম মুখ খুলল। সায়েন্স তার প্রিয় বিষয় হলেও ইতিহাস পড়তে তার দারুণ লাগে, সে সময় পেলেই রেফারেন্স বইটা গল্পের মতো পড়ে।

সে জিজ্ঞাসা করলো, "আচ্ছা, এই বোয়ার ম্যানুস্ক্রিপটটা কবে লেখা হয়েছিলো কিছু জানা যায়?"

মণিমামা বললেন, "হোয়ারনেল সাহেবের মতে পুঁথিটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা চতুর্থ শতাব্দীতে লেখা হয়েছিলো, কিন্তু আমরা এখন কার্বন-ডেটিং-এর মাধ্যমে জানি যে এটির রচনাকাল কম-সে-কম ৬৫০ খ্রিস্টপূর্ব! এর মানে বুঝতে পারছিস, রুনু!! এর মানে তার আগেই সুশ্রুতের চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে তখনকার লোকজন ভালো মতন পরিচিত ছিলো!!!"

দাদা যখন কিছু জিজ্ঞাসা করেছে, তখন রোনটু তো আর চুপ করে থাকতে পারে না। তাই সে অনেক ভেবে চিনতে জিজ্ঞাসা করলো, "আচ্ছা মামা, এই ম্যানুস্ক্রিপটটা এখন কোথায় আছে?"

রিমি বলল, "কেন? তুই কি চুরি করবি?"

"উফফ, মামা বলো-ই নাআআআ..."

হা হা করে মণিমামা হেসে বললেন, "ওটা খুব সম্ভবত আছে পুনেতে, ভাণ্ডারকর রিসার্চ ইন্সটিটিউটে... কেন, তুই যাবি নাকি দেখতে? আমি তো ভাবছিলাম পরের বছর পুনে-নাসিক-অজন্তা-ইলোরা একবার ঘুরে আসবো..."

"হ্যাঁ হ্যাঁ!!!" বলে রুনু-রোনটু লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিলো, এমন সময়ে দেখলো বাবা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছে। বাবা অফিস থেকে এসে গেছে তাহলে! তাই দুই ভাই শলাপরামর্শ করে একটু থিতিয়ে গেলো...

কিন্তু সেটা আপাতত-ই। খাওয়াদাওয়ার পর মণিমামা যখন বাবার সাথে গল্প করতে বসলেন, তখন রোনটু রুনুকে বলল, "মণিমামার সাথে বেড়াতে যাবো, বুঝলি, মাকে একটু পটিয়ে রাখতে হবে..."

রুনু জবাব দিল, "হ্যাঁ রে, আর দিদিকেও দলে টানবো, তাহলে আর ব্যাগড়া দিতে পারবে না... তুই ভালো করে পড়াশোনা কর, বুঝলি... আমাকেও মাধ্যমিকটা ভালো করে দিতে হবে..."

মণিমামার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে দুই ভাই ঘুমিয়ে গেলো সেদিনকার মতো। বাইরে তখন একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর নারকোল গাছের পাতার মাঝে হাওয়ার সড় সড় শব্দ, আর দূরে রেলগাড়ির আওয়াজ... কোথায় যাচ্ছে সে কে জানে...!

1 comment: