0

সম্পাদকীয়

Posted in



সম্পাদকীয়


হলুদ বরন মেখলায় তার যৌবন উছলায় 
লাল ওড়নার আড়াল দিয়া চক্ষু দুটি চায় 
খোঁপায় টগর ময়না বুঝি আমায় খুঁজে হায় 
বসন্তে এ বিহুর লগন উত্তাল হয়ি যায়...

'হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে, হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি তবুও ফুটেছে জবা, দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে, তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক'               - নির্মলেন্দু গুণ

বসন্ত মানেই অকারণের সুখ, বসন্ত মানেই সাজিয়ে তোলা বিরহ বেদনা!

আজ দোল পূর্ণিমা, বসন্তোৎসব। 
সূর্য-ঘড়ি সাত সকালে, ফাগুন রাঙ্গা শাড়ি পরে দিন গোনে আজ কার? 
বাসন্তিরা সবুজ টিপে, লাল সাদা আর হলুদ পাড়ে হাত ধরেছে তার

খুব ছোটোবেলায় মনে পড়ে, দোলের দিন সকালবেলা আমাদের বড়ো বাড়ীর উঠোনে নাচ গান হতো। বাসন্তী-রঙা লাল-পাড় শাড়ী গাছকোমর করে পরিয়ে দিতো মা। হাতে গলায় পলাশ ফুলের গয়না। দিদিদের পিছু পিছু আমিও নাচতুম... 
ও চাঁপা, ও করবী...তোরে ক্ষণে ক্ষণে চমক লাগে 

আবীর - ফুটকড়াই - মঠ...

যখন সদ্য কিশোরীবেলা, আমার এক নীরব প্রেমিক, ধরুন তারও নাম 'উত্তীয়' , নিউ আলিপুর থেকে একটা পুরনো রঙ-চটা জামা গায়ে চড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসতো আমাদের ভবাণীপুরের বাড়ীতে - সবার চোখের আড়ালে গালে কপালে এক ফোঁটা আবীর ছোঁয়াবে বলে!

'অনেক আশ্চর্য কথা বলেছি তার কানে, 
হৃদয়ের কতটুকু মানে
তবু সে-কথায় ধরে!!' - প্রেমেন্দ্র মিত্র

আর একটু বড়ো হয়ে, অনেক বছর এই দিনটা আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কাটিয়েছি শান্তিনিকেতনে। 

তখন সবকিছু ছিলো অন্যরকম। কত রঙ ছিলো, কত উচ্ছ্বলতা, কত উজ্জ্বলতা! 

জীবনের মধ্যাহ্নবেলায় এসে মনে হয় - স্মরণের তুলিতেই কবিত্বের রঙ ফোটে ভালো। 

তাই বলি, এত কথার দরকার কিসের? থাক পড়ে আর সব কথা, শুধু একরাশ বাসন্তী শুভেচ্ছা

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সৌম্য ব্যানার্জী

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বুরা না মানো, হোলি হ্যায়
সৌম্য ব্যানার্জী


আমার বাবার পিঠের নিচের দিকে, কোমরের ঠিক উপরে, অনেকগুলো জড়ুলের একটা জটলা আছে। জন্মদাগ, বলা বাহুল্য। কিন্তু আমি ছোটবেলায় একটা আজগুবি ব্যাপারের সঙ্গে সেটাকে সম্পৃক্ত করে ফেলেছিলাম। তখন বোধহয় বছর পাঁচেক বয়স আমার। এক দোলের সকালে বাবার হাত ধরে বেরিয়েছিলাম। কোত্থেকে দু’টো বাচ্চা মেয়ে... বয়স প্রায় আমারই মতন... ছুটে এসে বাবার পিঠের নিচের দিকে ওই জায়গাটায়, মানে যত অবধি ওদের হাত যায়, রঙের ছোপ দিয়ে পালিয়ে গেলো। বাড়ি ফিরে বাবা যখন জামা খুললো, সেই প্রথমবার আমি বাবার কোমরের জড়ুলগুলোকে ভালো করে খেয়াল করলাম... এবং কেন যেন আমার ধারণা হলো, ওগুলো সেইদিন ওই রঙের ছোপ থেকেই হলো! মেয়েগুলোর উপর খুব রাগ হলো বাবার পিঠটা ওরকম করে দেওয়ার জন্য। বাবা-মাকে বললামও সে কথা। বাবা-মা কি উত্তর দিয়েছিলো, সেটা আর মনে নেই, কিন্তু আমার ধারণাটা পাল্টাতে পারেনি। সেটা বহুকাল অবধি ছিলো। যেমন ছিলো সেই মেয়ে দু’টোর ছুটে এসে রঙের ছোপ মেরে পালিয়ে যাওয়ার স্মৃতিটা। বস্তুত, সেটা এখনও আছে। এটাও মনে আছে যে দু’টোর মধ্যে একটা মেয়ের মাথা ন্যাড়া ছিলো। সম্ভবত সেই আমার প্রথম দোলের স্মৃতি।

তারপর তো দোল-হোলিকে কেন্দ্র করে কত স্মৃতি! সবারই থাকে। শৈশবে পরিবারের সঙ্গে, কৈশোরে বন্ধুদের সঙ্গে, যৌবনে প্রেমাস্পদদের সঙ্গে এবং এখন এই অস্তগামী যৌবনে এসে আবার পরিবারের সঙ্গে – এই তো আমাদের মতন ছাপোষা মানুষের উৎসবপালনের গ্রাফ। হোলিই বা তার থেকে আলাদা হবে কেন? তবু হোলি যেন আমাদের বাদবাকি সব উৎসবের থেকে সত্যিই একটু আলাদা। একে তো রঙের উৎসব, তার উপর আবার বসন্তকালের প্রেম-মহোৎসব। সেরকম বললে অবশ্য বাঙালির নিজস্ব প্রেমের উৎসব সরস্বতী পুজো তো আছেই। কিন্তু দোলের উদ্দাম শারীরিকতাটুকু তাতে নেই। নেই ভাং বা সুরার মদির আবেশটুকু। তাই উৎসব হিসেবে দোল বা হোলির বৈশিষ্ট্য একটু অন্যরকম।

পৌরাণিক দিক থেকে দেখতে গেলে হোলি এবং দোলের প্রেক্ষিত দুটো কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। হোলিকাদহনের সঙ্গে রঙ খেলার কোনও সম্বন্ধ নেই। হিরণক্যশিপুর বোন রাক্ষসী হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে অগ্নিপ্রবেশ করেছিলো বিষ্ণুভক্ত ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করে দাদাকে নিষ্কন্টক করার উদ্দেশ্যে। তার অঙ্গে ছিলো অদৃশ্য অগ্নিরোধক শাল। কিন্তু আগুনে প্রবেশ করা মাত্র ভগবান বিষ্ণুর ইচ্ছায় সে শাল হোলিকার শরীর থেকে উড়ে গিয়ে প্রহ্লাদের শরীরকে বেষ্টন করে তাঁর প্রাণ রক্ষা করে। পুড়ে ছাই হয় হোলিকা। চিরন্তন ধর্মের জয়, অধর্মের নাশ। সেই ঘটনারই আধুনিক উদযাপন হোলির আগের রাতের হোলিকাদহন বা চাঁচর উৎসব।

এই বীভৎস ঘটনার অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বৃন্দাবনের দোলযাত্রা। আমাদের চিরকালীন প্রেমিক দেবতাটির দুষ্টুমির উৎসব। নন্দগাঁও থেকে দলবল নিয়ে কৃষ্ণ যেতেন রাধারাণীর গ্রাম বরসানাতে, দোল খেলতে। তারপর কি হতো, জয়দেব গোস্বামীর পদাবলী থেকে আরম্ভ করে গতকাল মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবিটির গানেও তার অপর্যাপ্ত বর্ণনা আছে, এবং সেসব বর্ণনার অনেকটাই আদিরসাত্মক... এবং এখানেই দোলযাত্রা বা হোলির (দুটি উৎসবই এখন এক হয়ে গেছে) মাহাত্ম। এই উদ্দামতায়। যৌবনের আত্মনির্ঘোষে। বসন্তের ফিরে আসায়। শৈবশাস্ত্র অনুযায়ী, ভগবান মহাদেব তাঁর ধ্যানভঙ্গ করার অপরাধে কামদেব মদনকে তৃতীয় নয়নের আগুনে ভস্মীভূত করেছিলেন। কিন্তু মুহূর্তের সেই রোষ প্রশমিত হবার পর তিনি উপলব্ধি করেন যে ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। বেচারা মদন সদুদ্দেশ্যে পার্বতীকে সাহায্যই করছিলেন, মহেশ্বরের ধ্যান ভাঙিয়ে তাঁর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। শিব দেখলেন, স্বামীর এই দশার জন্য মদনের স্ত্রী রতি এবং স্বয়ং পার্বতীও ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তারপর যখন রতি চল্লিশ দিন ধরে কঠিন তপস্যা করলেন স্বামীর জীবন ফিরে পাবার জন্য, তখন আর ভোলানাথ পারলেন না। পুনর্সঞ্জীবিত করলেন ‘অনঙ্গ’ মদনকে। মদনভস্মের চল্লিশ দিন পরের সেই দিনটিই নাকি বসন্ত পঞ্চমী, যেদিন কামদেবের পুনর্জীবনপ্রাপ্তি হয়। তাই সেদিন বসন্ত উৎসব, কামের অর্চনা। উৎসবটি কবে, কিভাবে দোলপূর্ণিমার সঙ্গে একাকার হয়ে গেলো, তা বলা কঠিন। প্রাচীন ভারতে এ উৎসব অত্যুৎসাহে পালিত হতো বলে শোনা যায়। হবে না-ই বা কেন? এমন মধুর রসসিক্ত উৎসবকে বাধা দেওয়ার জন্য তো তখন সংস্কৃতির চৌকিদাররা ছিলো না। সম্ভবত মানুষের মনে এত ঘৃণা, বিদ্বেষ, ছুঁৎমার্গও ছিলো না। সে সব অনেক পরের কথা। আজ থেকে সাড়ে চারশো বছর আগে সম্রাট আকবর যখন এই আক্ষরিক অর্থের মিলনোৎসবটির পুনর্প্রচলন করার চেষ্টা করেন, ততদিনে ভারতবর্ষের জনমানসকে চেপে ধরেছে ঘৃণা-বিদ্বেষ-অবিশ্বাসের ফাঁস।

সে যাই হোক, আমরা আজ দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, একটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ এবং বহু ঘৃণা, বহু বৈরি পেরিয়ে এমন একটা সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখান থেকে সামনে এবং পিছনে, দুটো পথই খোলা। কোন দিকে যাবো, সেটা একান্তই আমাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমাদের মতন ছাপোষারা, চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের ভাষায় যারা ‘‘...দোল খেলো হাজরাতে, উঠে বসো মাঝরাতে, পুষে রাখো পাঁজরাতে চোরা মফস্বল’’, শুধু এই একটা দিনের সুযোগে গতপ্রায় যৌবনকে খানিকক্ষণের জন্য হলেও একটু ফিরে পেতে চাই... রঙ আর ভাঙের মদিরতায় ইষৎ স্খলিতকন্ঠে একবার অন্তত বলে উঠতে চাই... বুরা না মানো, হোলি হ্যায়!

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in
প্রবন্ধ


তিতাস পাড়ের অদ্বৈতের বহুমাত্রিকতা
মনোজিৎকুমার দাস


বাংলাদেশের অখ্যাত ঘোটকর্ণ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদীর পাড়ের অন্ত্যজ শ্রেণির এক অখ্যাত পরিবারের থেকে উঠে আসা ছেলে অদ্বৈত। পারিবারিক পদবী সহ পুরো নাম অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১)। তিতাস পাড়ের অদ্বৈত একটি উপন্যাসেই সাহিত্যাঙ্গনে আজ চিরঞ্জীব। তাঁর কালজয়ী সেই উপন্যাসটির নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। শৈশব, কৈশোর, বয়ঃসন্ধিক্ষণ আর যৌবনের প্রারম্ভের সাথী তিতাস নদী। এই তিতাস নদী ও তার পাড়ের নারী,পুরুষ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, শিশু ও প্রকৃতিকে নিয়েই অদ্বৈতের কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ লেখা। উপন্যাসটির ভূমিকায় অদ্বৈত যা লিখেছেন, তা থেকে এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু উঠে এসেছে অনবদ্য আঙ্গিকে। তিনি ভূমিকায় লিখছেন: ‘তার কূলজোড়াা জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াাইতে বসে, কিন্তু পারে না।’

অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর জন্য একনামে পরিচিত। তিতাস পাড়ের অদ্বৈতের বহুমাত্রিকতা কালজয়ী উপন্যাসটির আড়ালে ডাকা পড়ে আছে। অদ্বৈত মল্লববর্মণের ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক পরিচয়ের বাইরেও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পাদচারণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী এই লেখককে প্রচারের আলোয় আনার ক্ষেত্রে অন্যধারার চলচ্চিত্রকার প্রয়াত ঋত্বিক ঘটকের অবদান প্রশংসার দাবি রাখে। ঋত্বিক ঘটকই প্রথম অন্ত্যজ শ্রেণির নরনারীর জীবনসংগ্রামের কাহিনী ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রে রূপদান করে অদ্বৈতের মতন লেখককে লাইমলাইটে নিয়ে আসেন।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের অকাল প্রয়াণেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসাধারণ প্রতিভা অন্তরালেই থেকে গেছে। ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক ছাড়াও অদ্বৈত একজন প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অনুবাদক, কবি ও লোক-সাহিত্য গবেষক হিসাবে বাংলা সাহিত্যে যে বিশেষ অবদান রেখেছেন, তা তুলে ধরার আগে তাঁর পোড় খাওয়া জীবনের কাহিনী তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ ব্রিটিশ ভারতের কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার তিতাস নদী তীরবর্তী গোকর্ণঘাট গ্রামে মালোপাড়ায় এক হতদরিদ্র পরিবারে ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ। ধীবর অর্থাৎ জেলে গোষ্ঠীর নাম মালো। পেশা মাছ ধরা, মাছের কেনাবেচা। শৈশবেই বাবা-মাকে হারান তিনি। গ্রামের জেলেদের অর্থিক সাহার্যে তাঁর লেখাপড়ার খরচ চলে। ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের অন্নদা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কারণে ১৯৩৪ সালে শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে।

জীবিকার জন্য তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানে মাসিক ‘ত্রিপুরা’র সাংবাদিক হিসেবে শুরু হয় কর্মজীবন। ১৯৩৬ সালে শ্রীকাইলের ক্যাপ্টেন নরেন দত্তের ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় যোগ দেন। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। অদ্বৈত কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহকারী হিসেবে সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৭-এ তিনি নবশক্তি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৯৪১ পর্যন্ত সম্পাদকরূপে দায়িত্ব পালন করেন। একটানা ৭ বছর চলার পর ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের মালিকাধীন সাপ্তাহিক নবশক্তি, অদ্বৈতের স্মৃতি-বিজড়িত সাপ্তাহিক নবশক্তি বন্ধ হয়ে যায়। নবশক্তির পাতায় নামে বেনামে অনেক বিচিত্র লেখা ছাপা হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় নবকিশোর ছদ্মনামে কিছু কবিতা মোহম্মদীতে প্রকাশ পায়।

নবশক্তি পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’র মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় আবুল কালাম শামসুদ্দীনের মনোনয়নে তারই সহকারী রূপে অদ্বৈত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় যোগদান করেন। ক্রমে ক্রমে মোহাম্মদীর সম্পাদনার ক্ষেত্রে মূল কর্তাব্যক্তিতে পরিণত হন অদ্বৈত। তিনি নামে-বেনামে মোহাম্মদীতে বেশ কিছু রচনার প্রকাশ করেন। ১৯৪৫ পর্যন্ত তিন বছর মোহাম্মদীতে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে একই সঙ্গে ‘আজাদ’ ও ‘কৃষক’ পত্রিকায় পার্ট টাইম কাজ করেন।

প্রকাশনা জগতের পুরোধা কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠী। এক সময় অদ্বৈত তাদের অন্যতম সাহিত্য বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দেশ’ এর স্বনামধন্য সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সাহচর্যে আসেন। ১৯৪৫ সালের দিকে অদ্বৈত সাগরময় ঘোষের সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন। তিনি সাহিত্য পত্রিকা ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ৬ বছর কাজ করেন। তাঁর বেশ কিছু কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও অনুবাদ দেশ ও অন্যান্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াা পরবর্তীতে নবযুগ, কৃষক ও যুগান্তর পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বভারতীর প্রকাশনা শাখায় খণ্ডকালীন চাকরিও করেন। প্রসঙ্গত বলতে হয়, ১৯৩৯ সালে তিনি চয়নিকা পাবলিশিং হাউস গঠন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বন্ধুরা- যথা কালিদাস মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস চক্রবর্তী, সতীকুমার নাগ, সনৎকুমার নাগ প্রমুখ। ঠিকানা : ৭ নবীন কুন্ডু লেন, কলকাতা। ১৯৪০ সালে তিনি ‘দলবেঁধে' গল্প সংকলন সম্পাদনা করেন। যৌথ সম্পাদক ছিলেন কালিদাস মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস চক্রবর্তী, সতীকুমার নাগ। প্রকাশক : সনৎকুমার নাগ।১৯৪৩ : ‘ভারতের চিঠি-পার্ল এস বাককে' গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন নিজেদের চয়নিকা পাবলিশিং হাউস থেকে।

তিতাস পাড়ের মৎস্যজীবী জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে তুলে ধরে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামে কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেন। মর্মস্পর্শী এ উপন্যাস প্রথমে মোহাম্মদী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু কয়েকটি অধ্যায় প্রকাশের পর পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। পরে বন্ধু ও পাঠকদের অনুরোধে আবার কাহিনীটি লেখেন। মৃত্যুর আগে কাঁচড়াাপাড়াা যক্ষ্মা হাসপাতালে যাবার আগে পাণ্ডুলিপিটি বন্ধুদের দিয়ে যান। ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করার কয়েক বছর পর উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ মৎস্যজীবী ‘মালো’সম্প্রদায়েরই মানুষ হয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সুগভীর অন্তঃদৃষ্টির আলোকে ধীবর সমাজের নিষ্ঠুর জীবনসংগ্রামের সাধারণ কাহিনীকে অসাধারণ নৈপূন্য উপস্থাপন করেছেন, যা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে উচ্চাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছাড়াও তিনি ‘রাঙামাটি’ও ‘শাদা হাওয়া’ নামে আরো দুটি উপন্যাস রচনা করেন। ‘শাদা হাওয়া' রচনা শেষ করেন ১৯.১২.১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। ‘সোনারতরী' পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯৪৮ বা ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে।

অন্যদিকে,‘রাঙামাটি' উপন্যাসটি ১৯৪৩-৪৫ সময়ের লেখা। তা মাসিক ‘চতুষ্কোণ' পত্রিকায় ১৩৭১-এর বৈশাখ থেকে চৈত্র ১২ সংখ্যায় ১টি বাদ দিয়ে ১১ দফায় ছাপা হয়। 

বক্ষ্যমান নিবন্ধের বিষয়ে ফিরে গিয়ে চেষ্টা করবো প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অনুবাদক,কবি, লোক সাহিত্য বিষয়ক লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণকে উপস্থাপন করতে। পত্রিকায় চাকুরীর কারণে পেশাগত দ্বায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করার সুযোগ পান। স্বল্পকালীন জীবনে অদ্বৈত মল্লবর্মণ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। এছাড়াও তিনি বহু শিশুপাঠ্য কবিতাও রচনা করেছেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরোলেও চল্লিশের দশকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমূখের পাশাপাশি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'এক পয়সায় একটি' গ্রন্থ সিরিজ আকারে লিখে তিনি বিশেষভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রসঙ্গত বলতে হয়, অদ্বৈত মল্লবর্মণের মত একজন লেখককে নিয়ে যতটা গবেষণা হওয়া উচিত ততটা এ পর্যন্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে সম্প্রতি কলকাতার দে’জ পাবলিকেশন থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর অচিন্ত্য বিশ্বাসের সম্পাদনায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনা সমগ্র সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। অচিন্ত বিশ্বাসের লেখা থেকে জানা যায়, তিনি রচনা সমগ্র প্রকাশের পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্যমোদীদের আমন্ত্রণে একবার অদ্বৈতের জন্মস্থান গোকর্ণঘাট গিয়েছিলেন। তিনি কিছু দুষ্প্রাপ্য লেখা উদ্ধার করে অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনা সমগ্র প্রকাশ করেছেন।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ প্রবন্ধ,অনুবাদ, গল্প, কবিতা, লোক সাহিত্য সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন যাতে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অসাধারণ নৈপূণ্য পরিস্ফুট। আমরা এখানে ‘প্রাবন্ধিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ, ‘অনুবাদক অদ্বৈত মল্লবর্মণ,‘গল্পকার অদ্বৈত মল্লবর্মণ, ‘কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ,‘ লোক সাহিত্য সংগ্রহাক অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘ শিরোনামে তাঁর সৃজন কর্মের পরিচয় তুলে ধরবো।

প্রাবন্ধিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ: অদ্বৈতের লেখা প্রবন্ধগুলোর মধ্যে যেগুলোর হদিস পাওয়া যায় সেগুলো হলো:১. ভারতের চিঠি – পার্ল এস বাককে, ২. নাটকীয় কাহিনী, ৩.নাটকের গোড়া পত্তন, ৪.পাত্রপাত্রী নির্বাচন, ৫. প্রয়োজন, ৬.প্রথমপাঠ,৭. প্রথম মহড়া, ৮.আরো মহড়া, ৯. ফ্রেশ রির্হাসেল, ১০. নাটকে নাট্যকারের স্থান, ১১.সিরাজের কাল, ১২. কাব্য সমালোচনা (একটি চিঠি), ১৩.প্রথম রজনী, ১৪. প্রথম রজনীর পর, ১৫. প্রাচীন চীনাচিত্রকলার রূপ ও রীতি, ১৬.ছোটদের ছবি আঁকা, ১৭.এদেশের ভিখারী সম্প্রদায়, ১৮.আম্রতত্ত্ব, ১৯. বর্ষার কাব্য, ২০. মৈত্রী সম্মেলন, ২১. বেগম রোকেয়া জীবনী পুস্তক সমালোচনা, ২২. টি এস এলিয়ট, ২৩. সম্পাদকীয়-স্তম্ভ * সাহিত্য ও রাজনীতি, ২৪. জিজ্ঞাসা, ২৫.লোক গণনা, ২৬ ভারতীয় সংস্কৃতি ইত্যাদি।

আমরা অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা ‘সিরাজের কাল’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর রচনা শৈলীর কিছুটা পরিচয় নেবো। তাঁর লেখা এই প্রবন্ধটি মাসিক মহম্মদী ১৩৪৭ সাল আষাঢ় ১৩শ’ বর্ষ, নবম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। “সিরাজের কাল- অদ্বৈত মল্লবর্মণ --- ’ থেকে: ‘ ইতিহাস সাহিত্যের অঙ্গীভূত। ইতিহাসের মধ্য দিয়া কোন ব্যক্তি বা জাতির অবমাননা করিলে সেই অবমানার জন্য দায়ী সাহিত্যই। সাহিত্য ইতিহাসকে বুকে করিয়া রাখিয়াছে, কাজেই সে বুকে করিয়া রাখিয়াছে ইতিহাসের সত্য- মিথ্যা সকল দায়িত্বকে।’ -- এই প্রবন্ধে তিনি আরো লেখেন, ‘অদ্যবধি সিরাজের যুগ অন্ধকারে রহিয়াছে। বহুকালের এই পুঞ্জীভূত মিথ্যা সরাইয়া সিরাজকে তাঁহার স্বদীপ্তিতে প্রভাবিত করা দুই একজন ঐতিহাসিকের কাজ নহে। আজ ইংরাজ জাতি এরূপ অবস্থায় পতিত হইলে কেবল সাহিত্যের প্রাচুর্য্যে মধ্য দিয়াই তাহারা এতদিনে জাতির ভাগ্য করিয়া নির্ণয় লইত।’

অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর লেখা অনেক প্রবন্ধেই কবি সাহিত্যিকদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তা করতে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিতে পিছপা হননি। এ প্রসঙ্গে আবারো তাঁর লেখা ‘সিরাজের কাল’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি করা যেতে পারে। তিনি এই প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শুদ্ধ সাহিত্যে যাঁহারা সিরাজের প্রতি অবিচার করিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে সর্বাগ্রে স্বর্গীয় কবি নবীন সেনের উক্ত হইয়া থাকে। স্বর্গীয় অক্ষয়কুমার মৈত্রয় মহাশয় পর্যন্ত নবীন সেনকে ক্ষমা করেন নাই- পরবর্ত্তীগণকে যে ক্ষমা করিবেন না, উহা বলাই বাহুল্য। নবীন সেন ঐতিহাসিক উপকরণ লইয়াছেন ইংরেজদের নিকট হইতে ধার করিয়া, আর কাব্যিক উপকরণ লইয়াছেন কিছুটা স্বকপোল কল্পনা হইতে আর কিছুটা বিজাতীয় কবির কাব্য হইতে।’

অদ্বৈতের ‘নাটকীয় কাহিনী’, ‘নাটকের গোড়া পত্তন’, ‘পাত্রপাত্রী নির্বাচন’, ‘ফ্রেস রির্হাসেল’, ‘নাটকে নাট্যকারের স্থান’, ‘আম্রতত্ত্ব,’ ‘মৈত্রী সম্মেলন’, টি এস এলিয়ট, ইত্যাদি প্রবন্ধ প্রশংসার দাবী রাখে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘দেশ’ পত্রিকায় থাকাকালে টি.এস. এলিয়ট সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। সেটা ছিল ১৯৪৮ সাল। টি.এস. এলিয়টের উপর প্রবন্ধ লেখার দায়িত্ব ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে অদ্বৈতকে দেওয় হয়েছিল। ‘ভারতের চিঠি -পার্ল এস বাককে’ শীর্ষক প্রবন্ধে অদ্বৈত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের যন্ত্রণাকাতর মানুষের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা কালের গণ্ডী পেরিয়ে প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে। অদ্বৈত এই প্রবন্ধে লিখেছেন,‘আজকের দিনে ব্যক্তিত্বের বড়ো দুর্দশা; মহাস্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দাও, দেখবে সে স্রোত আবর্ত বুকেও তোমার ব্যক্তিকে করুণায় ঠিক রেখেছে; বেঁকে বসো, তাহলে দেখবে সে ব্যক্তিত্ব খণ্ড খণ্ড হয়ে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে।’ এ সময় নবশক্তিতে দুটো বারো মাসী গান, ‘এদেশ ভিক্ষারী সম্প্রদায়’পল্লী সঙ্গীতিতে পালা গান সহ বিভিন্ন প্রবন্ধ বের হয়।

অনুবাদক অদ্বৈত মল্লবর্মণ: অদ্বৈত মল্লবর্মণ অনুবাদক হিসাবে স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্যে পরিচয় দিয়েছেন ভিন্ন ভাষার উপন্যাস ও কবিতা অনুবাদ করে। শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগগের এর জীবন অবলম্বনে আরভিং স্টোনের লেখা ‘লাস্ট ফর লাইফ’ এর বঙ্গানুবাদ করেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘জীবনতৃষা’ নামে।

বিদেশী ভাষার কবিতা অনুবাদ করে অনুবাদ সাহিত্যে তিনি পারঙ্গমতার পরিচয় রেখেছেন। কবি পত্রিকা, বৈশাখ ১৪২১ সংখ্যায় ‘যোদ্ধার গান’ নামে অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হয়। উক্ত কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করলে অনুবাদ কর্মে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ঋদ্ধতার পরিচয় পাওয়া যায়। যোদ্ধার গান: কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ (ত্রয়োদশ শতাব্দীর একটি আরবি কবিতার তাঁর বঙ্গানুবাদ )। করুণায় আর গৌরবের সুমহান / আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে নুয়াইনি কভূ শির / উপলাকীণ্র্ বন্ধুর পথে ধরি কর – অঙুলি / চালায়েছ মোরে চিরবিজয়ের পথে-/ দিয়েছে আমার সম্পদ রাশি, দিয়েছে সিংহাসন,/ হস্তে দিয়েছে বিজয়ী তরবারি।/ অজানা দেশেতে আমারে জানার গৌরব দিয়াছেন, / মোর রাজ-ছায়া দিয়ে তিনি ধরারে টানিয়াছেন / অজ্ঞাত ছিনু , অখ্যাত ছিনু, তাহা কি মোহর বাণী / দিকে দিকে মোরে বিজয় দিয়েছে আনি। / তার শত্রুরা পালাইয়া গেল / মোর সম্মুখ হতে। / তিনি চাহিয়াছিলেন করুণা করিতে,/ নিলো না সে দান তারা/ জাহান্নামের চির তমসায় সব শয়তনী সহ/ বিরাম লভিল তারা। কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ : বাংলা সাহিত্যে তাঁর আর একটি পরিচয় কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তাঁর পিতা অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ বসতভিটে ছাড়া আর কিছু ছিল না।এমনকি তার মাছ ধরার জন্য নৌকা বা জাল ছিল না। অধরচন্দ্র নিরক্ষর হলেও কিন্তু গান বাঁধতে পারতেন। পিতার গান বাঁধার সূত্র ধরে পিতার মৃত্যুর আগে শৈশবকাল থেকেই অদ্বৈতের মধ্যে গান ও কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা জেগে উঠে। অদ্বৈতের লেখা ’তমালেরি ডালে বসি কোকিলায় কি বলে রে’ গানটি থেকে তার গানটি তারই দৃষ্টান্ত। এখানে এই গানটি উদ্ধৃত করা অপ্রসঙ্গিক হবে না।

‘তমালেরি ডালে বসি কোকিলায় কি বলে রে / কোকিলায় কি বলে শ্যাম বেইমানে কি বলে রে। / টিয়া পাললাম, শালিক পাললাম / আরো পাললাম ময়নারে / সোনামুখী দোয়েল পাললাম, / আমায় কথা কয় না রে।’

তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালে প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগে তিনি ‘তিতাস ‘নামে তিনটি কবিতা লেখেন। কলেজে পড়ার আগেই তাঁর লেখা কবিতা শিশুসাথী, খেলাঘর ও মাস পহেলা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। পিতার কাছ থেকে পাওয়া গান বাঁধার গুণে তিতাস নদী তীরবর্তী এলাকায় ‘গানদার’ বলে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে অদ্বৈতের। তাঁর লেখা কবিতাগুলোর মধ্যে ১.বিদেশী নায়িকা, ২.শুশুক, ৩. যোদ্ধার গান, ৪. আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবস, ৫. ধারা শ্রাবণ, ৬. মোদের রাজা মোদের রাণী, ৭. ত্রিপুরা লক্ষ্মী, ৮. শ্রীমতি শান্তি বর্মণকে, ৯. সন্ধ্যা- বিরহিনী, ১০. মোহনলালের খেদ, ১১. সিরাজ, ১২. পলাশী, ১৩. হলওয়েল স্তম্ভ, ১৪. হীরামতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। স্বল্প জীবনের অধিকারী অদ্বৈতের লেখা এখানে ওখানে অবশ্যই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার প্রমাণ মেলে পশ্চিম বঙ্গের অভিজিৎ ভট্ট এবং অধ্যাপক মিলনকান্তি বিশ্বাস সম্পাদিত 'অগ্রন্থিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ' গ্রন্থে 'বিস্ময়', 'জাল ফেলা জাল তোলা', 'তমোনাশের মন' এবং 'আশালতার মৃত্যু ' এই চারটি গল্পের সন্ধান পেয়ে। বলা বাহুল্য অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাসের সম্পাদিত গ্রন্থে উপরে উল্লিখিত ‘স্পর্শদোষ ', ' সন্তানিকা ', ' কান্না', এবং 'বন্দী বিহঙ্গ' এই চারটি গল্পের কথা পাঠক মাত্রই আগে থেকেই জানেন। আজ পর্যন্ত পাওয়া অদ্বৈতের লেখা গল্পে সংখ্যা : ৮টি

প্রেমেন্দ্র মিত্রের নবশক্তি ছেড়ে আসার পর অদ্বৈত সম্পাদনা করেন ‘দলবেঁধে’ গল্পগ্রন্থ।

তাঁর এই গল্পগুলোর রচনা শৈলী, ভাষা অসাধারণ। দুঃখ বেদনার অনুষঙ্গ তিনি তুলে ধরেছে বিশেষ আঙ্গিকে। তাঁর স্বল্পস্থায়ী জীবনে তাঁর মেধা মনন, চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর অন্যান্য রচনায় উপস্থাপন করেছেন।

লোক সাহিত্যের সংগ্রহক ও গবেষক অদ্বৈত মল্লবর্মণ: প্রসঙ্গক্রমে লোক সাহিত্যের উপর লেখাগুলোর দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে পারা যায় লোকজ সাহিত্যকে অনুসন্ধানী দৃষ্টির আলোকে উপস্থাপন তাঁর গবেষণার ফসল। তিনি লোকজ সাহিত্যকে সাহিত্যের ভাণ্ডারে সন্নিবেশিত করেছেন। লোকজ সাহিত্যের উপর অদ্বৈতর লেখাগুলো হচ্ছে: ১. অপ্রকাশিত পল্লীগীতি, ২. ত্রিপুরার বারমাসী গান, ৩. তিনটি বার মাসী গান, ৪. সীতার বারমাসী, ৫. পল্লী সঙ্গীতে পালা গান, ৬. বিনোদের পালা, ৭. কটু মিঞার পালা, ৮. শেওলার পালা, ৯. বরজের গান, ১০. জলসওয়া গীত, ১১. নাইওরের গান, ১৩. নাইওরের গান, ১৪. পাখির গান, ১৫. ভ্যমর দূত, ১৬. মেওয়া মিছরির গান, ১৭. উপাখ্যানমূলক সঙ্গীত, ১৮. বানিয়ার গান,১৯. ভাই ফোঁটার গান, ২০. মাতৃস্নেহসূচক কয়েকটি অপ্রকাশিত প্রাচীন গান, ২১. পরিহাস সঙ্গীত, ২২. মাঘ মণ্ডল, ২৩.অপ্রকাশিত পুতুল বিয়ের ছড়া, ২৪. অপ্রকাশিত বাউল সঙ্গীত ইত্যাদি। এই সমস্ত লোক সাহিত্য কালের করালগ্রসে হারিয়ে যেতে বসেছিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণ এইগুলোকে সংগ্রহ করে লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন, যা তাঁর একটি অসাধারণ কাজ নিঃসন্দেহে। অদ্বৈত মল্লবর্মণে প্রথম প্রকাশিত পুস্তক ভারতের চিঠিঃ পার্ল এস বাককে কেবল তাঁর জীবৎকালে প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৯৫৬ সালে কলকাতার পুথিঘর প্রাইভেট লিঃ থেকে প্রকাশিত হয় তিতাস একটি নদীর নাম। ১৯৬১ সনে ভারতের চিঠি পার্লবাককে পুনর্মুদ্রিত হয় কলকাতার বিশ্ববাণী থেকে। ১৯৯০ সনে দেবীপ্রসাদ ঘোষ সাপ্তাহিক নবশক্তি থেকে ১৮টি এবং দেশ ও আনন্দবাজার থেকে ৪টি মোট ২২টি নাতিদীর্ঘ রচনা সংগ্রহ করে বারমাসী গান ও অন্যান্য নামে প্রকাশ করেন। ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে যথাক্রমে প্রকাশিত হয় শাদা হাওয়া ও রাঙামাটি।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ যে নিজের সম্পর্কে অত্যন্ত নির্লিপ্ত ছিলেন তার প্রমাণ মেলে তাঁরই লেখা একটি চিঠি থেকে। কাঁচরাপাড়া টিবি হাসপাতালের বি-৩ ওয়ার্ডে থাকাকালে অদ্বৈত ১৩৫৭ সনের ২৮ বৈশাখ চন্দ্রকিশোর মল্লবর্মণের নামে তাঁর এক স্নেহভাজনকে পোস্টকার্ডে লিখেছিলেন ‘আমি এখনো হাসপাতালেই আছি। আর কতদিন থাকতে হইবে তাহার কোন নিশ্চয়তা নাই। যতদূর মনে হয় আমি আরও এক বৎসর এই হাসপাতালেই থাকিতে পারিব। আমার জন্য কোন চিন্তা করিও না। আমার যতদিন ভোগ কপালে লেখা আছে ততদিন অবশ্যই ভুগিতে হইবে।’

অদ্বৈতে’র জীবনকাল ছিল মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের। অপরপক্ষে তারাশঙ্কর বেঁচেছিলেন ৭৩ বছর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ৪৮ বছর, সমরেশ বসু ৬৪ বছর আর বিভূতিভূষণ বেঁচেছিলেন ৫৬ বছর। অদ্বৈত ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল কলকাতার নারকেলডাঙ্গার ষষ্ঠীতলায় তখনকার দুরারোগ্য টিবি রোগে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে ধুঁকে ধুঁকে মুত্যুবরণ করলেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হওয়া সত্ত্বেও জীবদ্দশায় তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে অকালে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন- এটা বড় দু:খের ও বেদনার। অন্ত্যজ শ্রেণী থেকে উঠে আসা মানুষটি তাঁর বিপন্ন জীবন থেকেই জ্ঞানের দীপ্তি ছড়িয়েছিলেন তাঁর বহুমাত্রিক অসাধারণ সব লেখায়। এই মানুষটি তাঁর জীবৎকালে অন্য পাঁচজন লেখকের মত লইমলাইটে না এলেও চিরায়ত বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন অত্যুজ্জ্বল ধ্রুবতারা।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


গীতারহস্যামৃতম
(তৃতীয় অধ্যায়)
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী

(৭) 

যাইহোক, কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যখন পৃথিবীর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মঞ্চ তৈরি তখন সর্বনাশের মাথায় বাড়ি মেরে অর্জুন যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেন। 

সপ্তম রিপু ডিপ্রেশনের চাপে পড়ে অর্জুন কি বলেছিলেন শোনা যাক (প্রথম অধ্যায় - অর্জুন বিষাদ – ২৯নং শ্লোক)- 

সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি। 
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।। 
(আমার গাত্র সকল অবসন্ন হচ্ছে এবং মুখ পরিশুষ্ক হচ্ছে। 
আমার শরীরে কম্প ও রোমহর্ষ হচ্ছে।।) 

সবশেষে, (প্রথম অধ্যায় - অর্জুন বিষাদ – ৪৬নং শ্লোক)- 

যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ। 
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ।। 
(যদি অস্ত্রহাতে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ প্রতিকারবিমুখ 
অশস্ত্র অবস্থায় আমাকে রণে হত্যা করে, তাও আমার মঙ্গলতর হবে।) 

এই বলে শোকগ্রস্ত অর্জুন গাণ্ডীব বিসর্জন দিয়ে রথের আসনে বসে পড়েন। 

এদিকে কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেন না বলে নিজের নোবেল শান্তি পুরস্কারটাও (সেই আমলে নোবেলের বদলে অন্য কিছু থাকতে পারে হয়ত) প্রায় বাগিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু অর্জুনের এই অবিমৃষ্যকারিতায় তখন তাঁর কূল আর রাধা দুটোই হাতছাড়া হবার যোগাড়! 

এদিকে পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজিয়ে ভদ্রলোক তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছেন। বিপক্ষ পার্টি নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরে তীর / বর্শা / ভল্ল ইত্যাদি না ছুঁড়ে অবাক হয়ে ওনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে ওনারা দুজনে মিলে কি কুবুদ্ধি আঁটছেন। কৃষ্ণের তো আবার এই বিষয়ে যথেষ্ট সুনাম ছিল, তাই নয় কি! 

প্রথমে ভীষণ অবাক হলেও পরে প্রচণ্ড রেগে গেলেন কৃষ্ণ এবং উপহাসসহ প্রচণ্ড ভর্ৎসনাও করলেন অর্জুনকে। 

দেখা যাক তিনি কি কি বাক্য প্রয়োগ করেছিলেন (সাংখ্যযোগ-২/৩নং শ্লোক)- 

কুতস্তা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম। 
অনার্যদুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন ।। 
ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতং ত্বয্যুপপদ্যতে। 
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তবোত্তিষ্ঠ।। 

( হে অর্জুন, এই বিষম কালে এপ্রকার অনার্য ব্যক্তির মত স্বর্গের প্রতিবন্ধক অকীর্তিকর মোহ তোমার কোথা থেকে উপস্থিত হল? / হে পার্থ, ক্লৈব্য পেও না, তোমার উপযুক্ত নয়; ক্ষুদ্র হৃদয় দৌর্বল্য ত্যাগ করে ওঠ।) 

এর পরেও যখন অর্জুন যুদ্ধ করব না বলে গোঁ ধরে থাকলেন তখন কৃষ্ণ জন্মের পর মৃত্যুই একমাত্র সত্য কিন্তু আত্মা অবধ্য, মৃত্যুর পর আত্মা নতুন দেহের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়; অতএব শোক করার কোন কারণই থাকা উচিৎ নয় ইত্যাদি অনেক জ্ঞানের কথা বললেন। তারপর এই ধর্মযুদ্ধে যোগদান করে স্বর্গলাভ সুনিশ্চিত করার কথা বলে প্রলোভনও দেখালেন। আর এই ধর্মযুদ্ধ না করলে পাপগ্রস্ত হবার ও লোকনিন্দায় আত্মসম্মান হারানোর ভয়ও দেখালেন। 


(৮) 

এরপরেও যখন অর্জুন কোন সাড়াশব্দ করলেন না, তখন কৃষ্ণ সাংখ্যযোগের ৩৯নং শ্লোক থেকে গীতার দার্শণিক বিবৃতি আরম্ভ করলেন। 

তারপর কর্মযোগে এসে ফলের আশা ত্যাগ করে কর্মবন্ধে না পড়ে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার উপদেশ দিলেন। 

এত কিছু করার পরও কিন্তু অর্জুনকে কিছুতেই যুদ্ধে নামানো যাচ্ছে না। অর্জুনও কৃষ্ণের দার্শণিক উপদেশের ব্যাখ্যা চাইতে শুরু করে দিয়েছেন। এ যেন অনেকটা কৃষ্ণের অগ্নিবাণের মোকাবিলায় অর্জুনের বরুণ বাণ ক্ষেপণ। 

অর্জুন প্রশ্ন করলেন (কর্মযোগ- ৩৬নং শ্লোক), 

অথ কেন প্রযুক্তয়ং পাপঞ্চরতি পুরুষঃ। 
অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ।। 

(হে কৃষ্ণ, তবু কিসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পুরুষ অনিচ্ছুক হয়েও জোর করে পাপ আচরণ করে।) 

অর্জুনের মুখ থেকে এইসব তাত্ত্বিক প্রশ্ন শুনে কৃষ্ণ অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন কিনা গীতায় সেটা বলা নেই তবে মাথা ঠান্ডা রেখে কৃষ্ণ অর্জুনের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। কৃষ্ণের তখন উভয়সঙ্কট। ভেতরে ভেতরে রেষ্টলেস ফিল করলেও মুখমিষ্টি বজায় রেখে অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্রে নামাতেই হবে। চলতে থাকল পাহাড় প্রমাণ জ্ঞানের তত্ত্বকথা। না হলে কৃষ্ণের সমস্ত লীলা খেলাই তো পুরে মিট্টি মে গির যা সকতা হ্যায়! 

এরপর জ্ঞানযোগের প্রথমেই কৃষ্ণের দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসলেন অর্জুন! কৃষ্ণ যখন বললেন যে তিনি এইসব তত্ত্বকথা সূর্যকে (বিবস্বান) বলেছিলেন, সূর্য তৎপুত্র মনুকে বলেছিলেন, মনু তৎপুত্র ইক্ষাকুকে বলেছিলেন; এইভাবে আর সব রাজর্ষিগনেরা পরম্পরার মাধ্যমে এই গুহ্যকথা জানতে পারতেন, তখন দুম করে অর্জুন প্রশ্ন করে বসলেন (জ্ঞানযোগ- ৪নং শ্লোক)- 

অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ। 
কথমেতদ্ বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি।। 

(তোমার জন্ম অদূরে, বিবস্বানের জন্ম দূরে; তুমি আদিতে বলেছিলে এ কি করে জানব?) 

অর্জুনের এই গুগলিতে বাধ্য হয়ে কৃষ্ণকে গীতার সেই সবচেয়ে বেশি টি.আর.পি যুক্ত শ্লোকটা আবৃত্তি করতে হয় (জ্ঞানযোগ- ৭ / ৮ নং শ্লোক)- 

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। 
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।। 
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিণাশায় চ দুস্কৃতাম। 
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভমামি যুগে যুগে।। 

অর্জুন মনেপ্রাণে কৃষ্ণের এই যুক্তি মেনে নিতে পেরেছিলেন কিনা জানা নেই তবে জ্ঞানযোগের শেষে যখন কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন তখনও পুরো প্রসেসটাকে ডিলে করাবার জন্য অর্জুন আবার কর্ম সন্ন্যাস আর কর্ম যোগের মধ্যে কি প্রভেদ তার ব্যাখ্যা চেয়ে বসলেন সন্ন্যাসযোগের প্রথমেই। তারপর আলোচনা চলল ধ্যানযোগ, জ্ঞান-বিজ্ঞানযোগ, অক্ষর-ব্রহ্মযোগ, রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগ পর্যন্ত। 

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল যে ধ্যানযোগ পর্যন্ত অর্জুন তবু কয়েকটা করে প্রশ্ন করছিলেন, তারপর বাকি পরের তিনটি অধ্যায়ের বিষয় এত গম্ভীর ছিল যে মনে হয় যেন অর্জুন একটু ব্যাকফুটে চলে গেছিলেন। 


(৯) 

এরপর বিভূতিযোগ অধ্যায়ে কৃষ্ণের “আমিই ব্রহ্ম, আমিই সব” টাইপের কথাবার্তা শুনে অর্জুন বোধহয় যুদ্ধের শুরুওয়াতটা আরও দেরি করাবার জন্য কৃষ্ণের ভক্ত হিসেবে কৃষ্ণকে ভগবান মেনে নিয়ে পর পর সাত-সাতটা শ্লোক আউরে ফেলেছিলেন (বিভুতি যোগ – ১২-১৮ নং শ্লোক)! 

কৃষ্ণও খুশি মনে নিজের মাহাত্য বোঝানোর জন্য “আমি আদিত্যগনের মধ্যে বিষ্ণু, জ্যোতিষ্কগনের মধ্যে অংশুমান রবি, আমি নক্ষত্রগনের মধ্যে চন্দ্র...।“ ইত্যাদি আরও কিছু সর্বশ্রেষ্ঠতার উদাহরণ দেবার সময় “আমি পান্ডবগনের মধ্যে ধনঞ্জয়” (বিভুতি যোগ – ৩৭ নং শ্লোকের মুখরা) বলে মনেহয় অর্জুনকে একটু অ্যাপেল পলিশিং করেছিলেন। 

এরপর ঘটল আসল ঘটনা। 

কৃষ্ণ এরই মধ্যে ৩৪১টা শ্লোক খরচ করে ফেলেছেন। কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। মনে মনে কৃষ্ণ যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন বলেই মনে হয়। এবার ওনারও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবার অবস্থা। কিন্তু অর্জুনকে ছাড়া তো তাঁর চলবেও না। তাই এবার তিনি অতি সুকৌশলে কার্য উদ্ধার করার কথা ভাবলেন। 

অর্জুনও তাঁর সাথে কথার পিঠে কথা চালাতে চালাতে ওনার বিভূতিযোগের সর্বশেষ ৪২নং শ্লোক- “বিস্টভ্যহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিত জগৎ” (আমি এই সমস্ত জগৎ একাংদ্বারা ধারণ করে আছি) শুনে কৃষ্ণের টোপটা গিলে নিয়ে ওনার বিশ্বরূপ দেখার জন্য বায়না ধরে বসলেন। 

ব্যস! এই সুযোগটার জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। 

তার্কিকেরা বলেন অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখানোটা আর কিছুই নয় আসলে খুবই উচ্চস্তরের সন্মোহন। বলা যেতে পারে আমজনতার চোখের সামনে থেকে আমাদের সরকার মশাইয়ের তাজমহল অদৃশ্য করে দেবার মতই রোমাঞ্চকর ঘটনা। সেই পদ্ধতিতেই অর্জুনকে সন্মোহিত করে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দানবাকৃতি এক রূপ দেখিয়ে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিলেন। 

ভয়ের চোটে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে করজোড়ে সামনে, পেছনে, সর্বদিকে (360°) নমস্কার করে কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললেন (বিশ্বরূপদর্শণযোগ-৪৬নং শ্লোক)- 

কিরীটিনং গদিনং চক্রহস্ত-মিচ্ছামি ত্বাং দ্রষ্টুমহনং তথৈব। 
তেনৈব রূপেণ চতুর্ভুজেন সহস্রবাহো ভব বিশ্বমূর্তে।। 

(আমি তোমাকে সেই রূপেই কিরীটধারী গদাধারী চক্রহস্তে দেখতে ইচ্ছা করি। 

হে সহস্রবাহো বিশ্বমূর্তে, সেই চতুর্ভূজ রূপেই আভির্ভুত হও।।) 

এরপর ভক্তিযোগ, ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ, গুনত্রয়বিভাগযোগ, পুরুষোত্তমযোগ, দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ, শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগের সোপান পার হয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এনে ফেললেন মোক্ষযোগ অধ্যায়ে। 

এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ মোটামুটি পেছনের সবকটা অধ্যায়ের সারাংশ করেছেন। 

আসক্তি ত্যাগ করে কর্ম করার কথা বলেছেন, কর্ম ফলের আশা ত্যাগ করে কর্ম করা বলেছেন, বলেছেন সত্ত্ব-রজো-তম গুনের কথা, বুদ্ধিযোগ আশ্রয় করে ব্রহ্মপরায়ণ হওয়া্র উপদেশ দিয়েছেন, সর্বত অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হলে উনিই রক্ষা করবেন ইত্যাদি এইসব কথাও বলেছেন।

0 comments:

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in

ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ১১
শিবাংশু দে



আমারে তুমি অশেষ করেছো....

পার্থ দাশগুপ্ত নামে একজন তন্নিষ্ঠ রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রেমী'র লেখায় একটা মন্তব্য পেয়েছিলুম। "....রবীন্দ্রনাথের গানের সর্বকালের সফলতম অনুবাদক হিসেবে আমি যাকে মনে করি, তাঁর নাম সুবিনয় রায়। বুজুর্গরাও বলেন, যদি রবীন্দ্রনাথের গানের শুদ্ধতা আর অন্তর্নিহিত ভাবের হরগৌরী মিলনের সঠিক সুলুকসন্ধান পেতে চাও, তাহলে সুবিনয় রায়ের গান শোনো।" পার্থ নিজেকে একযোগে রবীন্দ্রখ্যাপা, হেমন্তখ্যাপা ও সুবিনয়খ্যাপা হিসেবেও ঘোষণা করেছিলেন। উক্তিটা আমি ভুলিনি কখনও। কারণ তিনি সরাসরি আমার মনের কথাটিই বলেছিলেন। আমার মনে পড়ে গেলো শান্তিনিকেতনে এক নিবিড় আড্ডায় কয়েকজন রবীন্দ্রমগ্ন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা প্রসঙ্গে বলেছিলুম, "আজ যদি কবি নিজে থাকতেন, তবে তিনি সুবিনয়ের মতো করেই তাঁর গান শোনাতেন।" হয়তো আমার এই উক্তিটি একটু পক্ষপাতী মনে হতে পারে। সুবিনয়ের গানের প্রতি আমার ভালোবাসাটা প্রায় ভক্তি আপ্লুত হয়ে পড়ছে এভাবে। যে কোনও শিল্পবিচারকে যদি একটু দূরের পরিপ্রেক্ষিত থেকে না দেখা হয় তবে তার আলো অন্ধকার দুইই ধরা যায়না। একটা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার অলীক প্রয়াস বোধ হতে পারে। কিন্তু আমি নাচার। আমার এরকমই বোধ হয়। কেন হয়, সে কারণটা ব্যক্তি আমার কাছে নিশ্চয় গ্রাহ্য। কিন্তু হয়তো অনেকের কাছে অতিশয়োক্তি বোধ হতে পারে।

ছোটোবেলায় বাড়িতে তাঁর দু'টি গান রেকর্ডে বাজতে শুনতুম। আদ্যিকালে গাওয়া গান। "তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে" আর "ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়"। কিছু কিছু গান যেমন রক্তে এসে যায়, এই গানদুটি আমাদের জন্য সেমত নৈসর্গিক মাত্রা নিয়ে নিয়েছিলো। আমার মনে পড়ছে পাঁচ-ছ বছর বয়সে প্রথম ইশকুল যাত্রা। রামকৃষ্ণ মিশনের ইশকুল আর সেবছর স্বামীজীর জন্মশতবর্ষ। সব ক্লাস থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠান হবে। আমি নেহাৎ শিশুত্বের বেড়া পেরোইনি তখনও। কেন যে মনে হয়েছিলো, কিভাবে, জানিনা। গেয়েছিলুম, "ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়..."। তখন আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ একটা গৃহস্থালীর চেনা নামমাত্র। প্রায় বালকটির কানে তখন ছিলেন রেকর্ডের সুবিনয়। ব্যক্তিগত সম্পর্কটা অতি পুরাতন। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুনিয়ায় সুবিনয়ের স্থান নির্ণয়ের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক অবশ্যই নেই।

মাননীয় সুধীর চক্রবর্তী তাঁকে বলেছিলেন 'শুদ্ধান্তঃপুরের আচার্য'। 'শুদ্ধ' ও 'অন্তঃপুর' শব্দদুটি তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর ঘরানা বোঝাতে গেলে এই শব্দগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর শিল্পীসত্ত্বার দুটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। গায়নশিল্পী ও শিক্ষক। তাঁর সমসময়ে যেসব দিকপাল শিল্পী এই দুটি কাজে সিদ্ধ ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও তাঁর স্থানটি ছিলো অনন্য। শুধুমাত্র পারফরমার হিসেবে দুজন শিল্পী সেকালে শ্রোতাদের শ্রবণরুচির মধ্যে কিছু অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছিলেন। তাঁরা দেবব্রত বিশ্বাস এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁদের সর্বপ্রভাবী চাপের সমান্তরাল অন্যতর একটি গীতধারা প্রস্তাব করা এবং কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠা দেবার একটি দুরূহ কাজ সফলভাবে অর্জন করেছিলেন সুবিনয়। জর্জদা বা হেমন্তের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাঁদের নিজস্ব মাত্রা,মুদ্রা বা শক্তির ছাপ ছিলো শেষকথা। লোকপ্রিয়তা, নিয়মিত জনসংযোগ, লোকরুচির প্রতি আগ্রহ তাঁদের 'হিরো' করে তুলেছিলো।


সুবিনয়ের সম্পূর্ণ গীতব্যক্তিত্বটিই ছিলো 'হাটের ধূলার' বাইরে অন্তর্মুখী আরাধনার মতো। সামগ্রিক শ্রোতাসমাজের একটি সীমিত অংশই তাঁর যাত্রার অনুসারী হবার যোগ্যতা অর্জন করতেন। তাঁর সঙ্গীতশিক্ষার প্রধান গুরু শৈলজারঞ্জন। তাঁর কাছ থেকে সুবিনয় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ন বিষয়ে যে শিক্ষাটি পেয়েছিলেন, নিজের কথায়, "... আশ্রম-জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানকে যেভাবে পাওয়া যায়, এই পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে ঐ গান চর্চা করলে তাকে সেভাবে পাওয়া যায়না।" তাঁর নম্র, অনুচ্চ, অনুচ্ছাস, অন্তর্মুখী গীতশৈলীর উৎস পাওয়া যাবে শৈলজারঞ্জন ও শান্তিনিকেতন বিষয়ক তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যায়। তিনি পেশাগতভাবে সম্পূর্ণ সঙ্গীতজীবী ছিলেন না। কিন্তু যাপনের একটি বৃহৎ অংশ তিনি ব্যয় করতেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ন ও শিক্ষণে। পঞ্চাশের দশকে প্রথম রেকর্ড করা দুটি গান, "তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে" বা "এই করেছ ভালো নিঠুর হে" শুনলে তাঁকে সুনীল রায় বা সমরেশ রায়ের গীতধারার তৃতীয় কোণ হিসেবেই মনে হতে পারে।


কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাঁর পরিশীলিত রুচিবোধ, আত্মবিশ্বাস, গান নির্বাচন ও স্থিতধী আবেদন তাঁকে প্রজন্মের সবার থেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। বাল্যে তাঁকে যতোটুকু ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি তাতে মনে হয়েছিলো তিনি বেশ সাহেবি মানুষ। 'সাহেবি' অর্থে নিয়মনিষ্ঠ, অনুচ্য, অচঞ্চল ও দক্ষ। এসরাজ বাদন শিখেছিলেন খুব যত্ন করে। তাঁর গানে সুর লাগানোর ধরনে এসরাজের স্বরপ্রক্ষেপণের বিশুদ্ধতা কানে বাজবে একটু মনোযোগী হলেই। বহুধরনের রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেও তাঁর সতর্ক গান নির্বাচন তাঁর সাফল্যে অন্যতর মাত্রা যোজনা করেছিলো। শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, "মনে হয় যে-গান তার সম্পূর্ণ উদ্ঘাটনের জন্য দাবি করে একটা স্বচ্ছতার একটা স্পষ্টতার আর একটা সর্বসমর্পণের স্বর, সে গানের উপযুক্ত গলা আছে যেন শুধু সুবিনয় রায়ের মধ্যেই। কোনো মাত্রা ছাড়ানো মাধুর্য নয়, আবেগের কোনো বহুলতা নয়, কোনো উদাত্ততা নয়, শনাক্ত করার মতো বিশেষ কোনো ব্যক্তিভঙ্গিমা নয়, সুবিনয় রায়ের গানের মধ্যে আছে প্রকট ব্যক্তিত্বকে লুকিয়ে ফেলবার মতো এক-ধরণের সজল ব্যক্তিত্ব। জলতরঙ্গের মতো যেন সুরটাই খেলতে থাকে তাঁর গলায় আর তার মধ্যে দিয়ে পৌঁছতে থাকে কথা, যিনি গাইছেন তিনি যেন লুকিয়ে থাকেন দূরে। সুরের কাছে আত্মবিলোপময় সমর্পণের জন্যই হয়তো তাঁর গলায় স্মরণীয়ভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে পূজাস্পর্শী গানগুলি।"


রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের পর যখন এই ধারার সঙ্গীত চর্চার মধ্যে হঠাৎ ব্যাপ্ত জোয়ার এসেছিলো, প্রথিতযশা শিল্পীরা ক্রমশ নিজস্ব গীতভঙ্গি তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজস্ব ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার লক্ষণগুলি মনে রেখে। দেবব্রত যেমন বেছে নিয়েছিলেন তাঁর অভ্যস্ত 'মাঠেঘাটে' গাওয়া গণসঙ্গীতের উদাত্ত গীতশৈলীর লোকপ্রিয় পথটি। সেভাবেই হেমন্তের সাফল্য ছিলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে,বিশেষত চলচ্চিত্রে প্রযুক্ত গানের সঙ্গে ওতপ্রোত তাঁর মোহিনী কণ্ঠশিল্পের প্রতিভার শক্তিতে। সুবিনয় রায়ের শক্তির উৎস ছিলো তাঁর দীর্ঘকাল ধরে ক্রমাগতভাবে চালিয়ে যাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুশীলন, অনুধ্যান ও অনুরাগের মধ্যে। কণ্ঠশিল্পী ও শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর বিষয়কে শল্য চিকিৎসকের মতো নিপুণ নিষ্ঠায় অন্তহীন বিশ্লেষণ করে গেছেন। এই প্রক্রিয়াজাত অভিজ্ঞতা তাঁকে অসীম আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিলো। রবীন্দ্রসঙ্গীতের গভীর, নিহিত উদ্দেশ্য ও সন্ধান বিষয়ে তাঁর ধারণাটি প্রশ্নাতীত পারফেকশন পেয়ে গিয়েছিলো।

হেমন্তের গায়ন প্রসঙ্গে সুবিনয় যেমন বলেছিলেন, স্বর দু'ভাবে লাগানো যায়। Sophisticated এবং Unsophisticated। এই Sophisticated বিশেষণটি সম্ভবত তিনি শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন, যেখানে প্রত্যেকটি স্বরকে ভিন্ন মাত্রা দিয়ে বিচার করা হয়। সুরের বারোটি স্বরকে পৃথক অস্তিত্ব হিসেবে কল্পনা করে তাদের বিভিন্নভাবে সমন্বিত করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি অনুশীলন ও সাধনসাপেক্ষ। সেখানে এক ধরণের স্ট্রাকচার্ড সুরবিন্যাস গড়ে তোলা হয়, যা শুধু শ্রুতিমধুর হওয়ার ঊর্দ্ধে জটিল, অনুশাসিত সেরিব্রাল বন্ধনে বাঁধা থাকে। সুবিনয় কথিত Unsophisticated সম্ভবতঃ ন্যাচরল গায়ন শৈলি। যেখানে শ্রুতিমধুর স্বতঃস্ফূর্ততাই প্রধান শর্ত। আমাদের লোকপ্রিয়তার তুলনামূলক বিচারে ন্যাচরল সুরশিল্পীরাই অনেক এগিয়ে থাকেন। পঙ্কজকুমার থেকে কিশোরকুমার। কিন্তু সুবিনয় প্রথম থেকেই তাঁর সুরঋদ্ধ চিকণ কণ্ঠস্বরকে শাস্ত্রীয় স্বরক্ষেপণের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবহার করেছেন। তাঁর মূল শিক্ষাগুরু শৈলজারঞ্জন তাঁর স্টাইলটি এভাবেই তৈরি করে নিতে তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। যখন মাঠে ব্যাস, ব্যারিটোন, নিদেন টেনর কণ্ঠসম্পদ নিয়ে পঙ্কজকুমার, হেমন্ত বা দেবব্রত সৃষ্টিশীল রয়েছেন, তখন সুরেলা, মিহিন, নমনীয় স্বরক্ষেপনকে মঞ্চ করে সুবিনয় গান গেয়ে গেছেন। কণ্ঠ নয়, তাঁর প্রধান সম্পদ ছিলো নিখুঁত সুর লাগানো, নির্ভুল লয়জ্ঞান ও সামগ্রিক পরিবেশনায় গণিতের মতো ব্যবস্থিত বিন্যাসকে ধরে রাখার কৌশল। সুচিত্রা যেমন বলতেন, গাইবার সময় সমগ্র গানটি তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। সুবিনয়ের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে গানের শরীরটিকে তিনি জাদুকরের দক্ষতায় বেঁধে রেখেছেন এবং তাঁর শিল্পীমন যা করতে চায় সেভাবেই তাকে প্রসাধিত করে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের থেকে এই পর্যায়ের আদায় আমরা খুব কমই দেখেছি। অন্তত রবীন্দ্রসঙ্গীতে শাস্ত্রীয়ঘরানায় অনুরক্ত আর কারো থেকে এই স্তরের সিদ্ধি আমরা দেখিনি। আবহমান ব্রাহ্মসমাজের সম্পন্ন গীতশৈলির ঐতিহ্য তিনিই সার্থকভাবে ধরে রাখতে পেরেছিলেন।


তিনি যখন প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা শুরু করেন, বাংলার জনমনে কবির গানের আবেদন ছিলো নিতান্ত সীমিত। সাধারণ শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত যথেষ্ট পৌরুষময় বা জেল্লাদার গান হিসেবে গ্রাহ্য হতোনা। মূলত নজরুলের গান, কিছুটা অতুলপ্রসাদের গীতধারাই ছিলো বাংলাগানের প্রধান ধারা। রাজ্যেশ্বর মিত্র জানিয়েছিলেন একবার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে স্বয়ং দিনেন্দ্রনাথকে শ্রোতারা দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার পরে থামিয়ে দিয়ে নজরুলগীতি শুনতে চেয়েছিলেন। শেষে দিলীপকুমার রায় এসে নজরুলগীতি গেয়ে অবস্থা সামলান। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে কলকাতার মানুষ সুবিনয় যে শুধু 'প্রকৃত' রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতে শান্তিনিকেতনেই গেলেন না, উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করে কলকাতায় ফিরে প্রথমে 'গীতবিতানে' ও পরে 'দক্ষিণী'তে দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষকতাও করলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্তর্নিহিত শক্তি একসময় প্রকাশ পাবেই। তাঁর ধারণাজাত 'আশ্রম-জীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়া'র গীতশৈলীও যে একদিন সাধারণ শ্রোতার কাছে আদৃত হবে, এ দৃঢ়মূল বিশ্বাস তাঁর শেষ পর্যন্ত অটল ছিলো। তিনি অনুভব করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্তর্মুখী পরিবেশন আপাতভাবে প্রমোদপ্রাণ শ্রোতাসমূহের কাছে বিপুল স্বীকৃতি না পেলেও এই শৈলীটি নিমগ্ন শ্রোতাদের আনুকূল্য পাবে। কিন্তু পরবর্তীকালে আক্ষেপও বোধ করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদক জানতে চান ভবিষ্যতের কোন কোন শিল্পীর মধ্যে তিনি সম্ভাবনা লক্ষ করেছেন? উত্তরে তিনি নৈরাশ্য প্রকাশ করেন। "... সাধারণভাবে শেখবার আগেই এরা বেশি কমার্শিয়াল হয়ে পড়ছে। কিভাবে পরিচিতি এবং অর্থ দুটো'ই তাড়াতাড়ি লাভ করা যায় সেদিকেই এদের নজর বেশি। এবং আরো একটা খারাপ জিনিস হচ্ছে, ভালো করে না শিখেই এরা আবার অন্যদের শেখাতে শুরু করছে। জীবিকার উপায় আর কী।"


রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে নিজস্ব ধারণা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, "...আমি বরাবর বলি যে রবীন্দ্রনাথের গান শিখে জীবনে discipline আনা যায়। রবীন্দ্রসংগীতকে তাই আমি disciplined music বলি। আমি তো অন্যান্য গানও শিখেছি। আর কোনো গান এত disciplined নয়, এমনকে হিন্দুস্থানী ধ্রুপদ গানও নয়। যদিও রবীন্দ্রনাথ বলতেন ধ্রুপদ শেখা উচিত গানেdiscipline শেখবার জন্য, তিনি নিজের গানকে আরও অনেক বেশি discipline-এ বেঁধেছিলেন। এমন কতগুলো বাধ্যবাধকতা বা rigidity আছে তাঁর গানে, সেগুলো শিক্ষা করলে মানুষের জীবনের পরম উপকার হয়। আমার জীবনে যেটুকু discipline এসেছে, রবীন্দ্রনাথের গান শেখবার ফলেই এসেছে।"

পরবর্তীকালে অনুশীলনহীন, প্রস্তুতিহীন, মেধাহীন রবীন্দ্রগায়কেরা, যাঁরা শুধুমাত্র কণ্ঠস্বর সম্বল করে আসরে নেমেছিলেন বা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য সুবিনয় ছিলেন চূড়ান্ত সচেতক। 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' নামক শিল্পমাধ্যমটিকে পূর্ণতঃ অনুধাবন করতে গেলে গায়ক, চিন্তক, ভাবুক সুবিনয়কে ছাড়া আমাদের চলবে না। তাঁর কণ্ঠসম্পদ হয়তো 'ঈর্ষনীয়' ছিলোনা। আজকের বাজারের ভাষায় যাকে এক্স-ফ্যাক্টর বলা হয়, তা ছিলোনা ঐ স্বরে। কিন্তু স্বরসংযোগের স্থৈর্য, উচ্চারণের পবিত্রতা আর গানের ভিতর দিয়ে আত্ম-আবিষ্কারের ঐ পর্যায়ের মেধা তাঁকে এক অপরাজেয় শিল্পী করে তুলেছিলো। আজকের অস্থির, প্রস্তুতিহীন গায়ক ও শ্রোতাদের জন্য তিনি এক চির-আলোকিত বাতিঘর।

0 comments:

1

গল্প - দোলা সেন

Posted in

গল্প


আঁধার পেরিয়ে
দোলা সেন



সিম্বার মনটা আজ খুব ভালো আছে। গতকাল যে হরিণটা ও শিকার করেছিল, হায়নার দল তার খোঁজ পায়নি। তাই আজকের খাওয়াটাও জম্পেশ হল। এমনটা কালেভদ্রে হয়। কোত্থেকে যে গন্ধ পায় এই পরগাছাগুলো! ঠিক হাপিস করে দেয় সিম্বার এত কষ্টের শিকারদের। বিরক্তি প্রকাশ করতেই বোধহয় সে তার সোনালি কেশরওয়ালা মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিল।

কিন্তু এক বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে সে শেখেনি। তাই ঘাসজমি ছেড়ে মাঠের মধ্যে ছাতার মতো ডালপালা বিছিয়ে থাকা অ্যাকাশিয়া গাছটার ছায়ায় আয়েস করে পা ছড়িয়ে বসল। অন্যদিন এই সময় তার সঙ্গে তার পরিবারের বাকিরাও থাকে। কিন্তু আজ তার তৃপ্ত উদর, ঘননীল আকাশ আর সোনালি রোদ তাকে আলসে আর একান্তচারী করে তুলেছে। তাই সে বাকীদের খোঁজে না গিয়ে লম্বা একটা হাই তুলে চোখ বুজল।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছের ছায়া ছোট হতে থাকে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায় সিম্বা। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে কোনও বার্তা পাঠাচ্ছে। সূর্য এখন মধ্যগগনে। এই তীব্র আলোয় তার দৃষ্টি পূর্ণ শক্তিতে কাজ করে না। নাক টানল বার কয়েক। কোন গন্ধ পেল না। অথচ মাথার মধ্যে টিং টং করে বিপদের ঘন্টিটা বেজেই যাচ্ছে। তার শ্রবণেন্দ্রিয় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। কিসের একটা মৃদু, অতি মৃদু আওয়াজ না? আওয়াজ লক্ষ্য করে ঘুরে দাঁড়াল সিম্বা। হাওয়ার উল্টোদিকে আধখানা চাঁদের মতো একটা ঝোপের লাইন না? ওটা কি আগে ছিল? সে ঠিকঠাক মনে করতে পারল না। কিন্তু আওয়াজটা ওদিক থেকেই আসছে। আলোটা একটু কম হলে সে ঠিক দেখতে পেত ঝোপের মতন জিনিসটা এগোচ্ছে। গোলমুখটা আর একটু ছোট হতেই হাওয়ায় গন্ধটা ভেসে এল। আর তখনই তার শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে একটা ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল।

নিঃসন্দেহে গন্ধটা চিহ্নিত করতে পেরেছে সিম্বা। সে আজ আফ্রিকার জঙ্গলের সবচেয়ে বড় বিপদের মুখোমুখি। ওর চারপাশ ঘিরে ব্যুহ রচনা করেছে ক্ষুধার্ত বুনো কুকুরের দল। সিম্বা জানে এই কুকুরগুলোর দলবদ্ধতা এবং শিকার করার ধৈর্য প্রশ্নাতীত। তাই সে গোলের খোলামুখটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইল। মাথা নীচু করে গর্জন করে উঠল। কুকুরের দল ততক্ষণে নিরাপদ দূরত্বে তাকে ঘিরে একটা বলয় বানিয়ে ফেলেছে। সিম্বা এগোলে সেদিকের বেষ্টনী যেমন পিছিয়ে যায়, তেমনি পিছনের দলটি এগিয়ে আসে। ফলে সিম্বা সবসময়েই বৃত্তের কেন্দ্রেই থেকে যায়। এর মধ্যে একটা দুঃসাহসী কুকুর সামনে এসেছিল। তার ভবলীলা সাঙ্গ করেছে সিম্বা। কুকুরেরা যেন জানত এমনই হবে। তারা শুধু বৃত্তের পরিধিটা বাড়িয়ে কমিয়ে যেতে থাকে। এবার সামনে এগিয়ে আসে আরও একজন। সিম্বা তার ঘাড় কামড়ে ধরার আগেই পিছন থেকে আরও দুটো কুকুরের দাঁত বসে যায় ওর পেটে। যন্ত্রণায় গর্জন করে একপাক ঘুরতেই ওরা নিমেষে ফিরে যায় নিজের ব্যুহে।

আস্তে আস্তে সাহস বাড়ে কুকুরগুলোর। সামনে দুজন আসে তো পিছনে পাঁচজন। পিছন থেকে কামড়ে পালিয়ে যাওয়াটাই ওদের এখনকার রণকৌশল। ইতিমধ্যে সিম্বার হাতে মারাও পড়েছে দু-একটা। কিন্তু ওদের দলটা এত বড় যে এতে ওদের কিছু যায় আসে না। এদিকে অনেকটা সময় কেটে গেছে। সমানে চর্কিপাক খেতে খেতে আর কামড়ের বিষে সিম্বা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কুকুরগুলো এরই প্রতীক্ষায় ছিল। এবার তারা আরও বেশি সংখ্যায় আক্রমণে নামে। এখন ওদের ক্ষিপ্রতা সিম্বার চেয়ে অনেক বেশি। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে সিম্বা এবার ব্যুহ ভেদ করে দৌড়ে পালাতে গেল। কুকুরের দল তার সামনে থেকে সরে গেল কিন্তু পিছন থেকে কয়েকজন কামড়ে ঝুলে রইল। এ এক খাবলা মাংস নিয়ে নামে তো ও আরেকট খাবলা – আর দৌড়োতে পারেনা সিম্বা। পড়ে যায়। তার চারপাশে এখন অনেক কুকুর – আস্তে আস্তে বিকেলের আলোয় মাঝরাতের অন্ধকার নেমে আসে...



...আর এই অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে যেতে যেতে আতঙ্কে হাঁকপাক করে বিছানায় উঠে বসে জর্জ। জর্জ হেনড্রিক্স। ঘামে সারা গা ভিজে জবজবে। ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে জলের গেলসটা খালি করে হাঁপাতে থাকে। কি কুক্ষণেই যে কয়েক বছর আগে এই ডকুমেন্টারিটা দেখেছিল! সেই থেকে কেমন করে যেন সিম্বার সঙ্গে সে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছে। যেন তার জন্যও অপেক্ষা করে আছে এমন এক ভবিষ্যত। অজান্তেই তার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সে। প্রায়ই তার স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে এই ভিডিওটা। আর তার মনে হয় বৃত্তটা ক্রমশঃ ছোট হচ্ছে। 

অথচ বাস্তব হলো এই যে, ওর চারপাশে এক রৌদ্রোজ্জ্বল পৃথিবী। ঝকঝকে চাকরি, চকচকে বাড়ি আর ফুটফুটে বৌ আদেলাকে নিয়ে ভারি সুখের সংসার তার। ওহ্, আরেকজনও আছে ওদের এই ছোট্ট দুনিয়ায়। তার নাম জিম। আদেলার প্রাণভোমরা যেন। মাঝে মাঝে এই নিয়ে বৌয়ের সঙ্গে কপট লড়াইয়ে নামে জর্জ – ‘অ্যাই, সত্যি করে বলোতো, কাকে বেশি ভালোবাস তুমি? আমাকে না ওই জিমকে?’ খিলখিল করে হাসে আদেলা। সেই হাসি সুখের মুক্তো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ঘর ছাড়িয়ে, মন ছাপিয়ে বয়ে যায় নদীর মতো। জিম তাতে ভারি আপ্যায়িত হয়ে মৃদু ডাক ছাড়ে – ‘ভৌ’!

একটা লং উইকএন্ড পেলেই ওরা তিনজনে বেরিয়ে পড়ে ওদের বাসাগাড়িটা (RV) নিয়ে। হেলেনায় থাকার সুবাদে আসেপাশে দ্রষ্টব্যের অভাব নেই। মন্টানা চিরকালই তার অপরূপ সৌন্দর্যে অনন্যা। বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখা হয়ে গেল যখন, তখন জর্জ আর আদেলা চলে যেত গ্লেসিয়ার ন্যাশানাল ফরেস্টের নির্জন প্রান্তরে, কোনও এক নির্জন লেকের ধারে – যেখানে সব কোলাহল বারণ, শুধুই কথা প্রাণে প্রাণে! বাসাগাড়ি থেকে ডেকচেয়ার বের করে ওরা চুপটি করে বসে চাঁদের আলোয় জলের ঝিলিমিলি দেখত। পায়ের কাছে নিঃশব্দে শুয়ে থাকত জিম। কী করে যেন সেও বুঝে যেত এই সময় কথা বলতে নেই!

সেই বছর আগস্টে জর্জ আর আদেলার একটা লম্বা ছুটি মিলেছিল। লোকালয় থেকে বেশ অনেকটা দূরে জর্জ একটা কটেজের সন্ধান পেয়েছে। ছবিটবি দেখে আদেলারও ভারি পছন্দ হয়ে গেল জায়গাটা। তাই গাড়ির মাথায় নৌকোটা বেঁধে রওনা দিল ওরা তিনজনে। এবারে আর বাসাগাড়িটা নেয়নি। কটেজ আছে যখন, তখন এদিক ওদিক ঘুরতে ছোট গাড়িতেই সুবিধা।

জায়গাটায় নেমে মুগ্ধ হয়ে গেল ওরা। ছবিতে যা দেখেছিল বুক করার সময়, এ তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। ঘন নীল লেকের তিনদিক ঘিরে সবুজ বন। একদিকে ঘাসজমির ওপরে ছোট্ট কটেজটি। কটেজের বারান্দায় বসলে গাছেদের মাথার ওপর দিয়ে সাদা পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়।

জর্জ আর আদেলা মিলে হাতে হাতে গুছিয়ে ফেলল তাদের সাতদিনের ঘরকন্নার সংসার। তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে এসে বসল বারান্দায়। আজ অনেকটা গাড়ি চালিয়ে আসা হয়েছে। তাই এখন বিশ্রাম। আজ শুধু বসে বসে দেখা কেমন করে লেকের জল রাঙা করে, মেঘেদের গায়ে লাল কমলা রঙের হাত বুলিয়ে অতি অনিচ্ছায় সুয্যিঠাকুর ডুবে যায়। এরপরেও ভালো করে আঁধার হল না কিন্তু! দুদিন পরেই পুর্ণিমা – তাই চাঁদের রূপোলী আলোয় চারদিক ভেসে গেল, আর চাঁদটা টুকরো টুকরো হয়ে জলের ঢেউয়ের মাথায় চড়ে নাচতে লাগল।

পরদিন সকালে হাইক, বিকেলে বোটিং, আর সন্ধ্যেবেলায় ওয়াইনের গেলাস হাতে বারান্দায় বসে সামনের নির্জন সৌন্দর্য উপভোগ – বেড়াতে বেরিয়ে এত আনন্দ ওরা কখনো পায়নি। তার পরদিন পুর্ণিমা। রাত্রে আবারও নৌকো ভাসালো আদেলা আর জর্জ। বড্ড ক্লান্ত লাগছে এবার। এখন দরকার একটা তৃপ্তির ঘুম। কিন্তু জিম আজ কেমন যেন ছটফট করছে। কিছুতেই বারান্দায় থাকতে চাইছে না। অথচ কটেজের ভিতরে পোষ্যের প্রবেশের অনুমতি নেই। তাই কোনমতে জিমকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বারান্দায় রেখে ওরা ঘুমোতে গেল। জিমের প্রবল আপত্তিতে আজ আর ওকে বাঁধা গেল না।

আদেলা ঘুমিয়েও পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু এত ক্লান্তি সত্ত্বেও জর্জের আজ ঘুম আসতে চাইছে না। জিমের ছটফটানিতে আজ যেন ও সিম্বার উদ্বেগের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। দু একবার বাইরে বেরিয়েও দেখল। সব স্বাভাবিক। তবু বন্দুকটা লোড করে রাখল বিছানার পাশে। তারপর একসময় গভীর ঘুমের তলে ডুবে গেল।

ঘটনাটা ঘটল শেষরাতের দিকে। জিমের ঘনঘন ডাকে ঘুম ভেঙে গেল আদেলার। জর্জ পাশে শুয়ে অগাধে ঘুমাচ্ছে। ডাকতে মায়া হল। তাই চটিটা গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো একাই। কিন্তু জিম তো বারান্দায় নেই! মাঠের দিকে তাকাতেই বুকটা হিম হয়ে গেল ওর। আট ফুটের ওপর লম্বা চারশো কেজি ওজনের দৈত্যটার বাদামী রং চাঁদের আলোয় কালো দেখালেও, গ্রিজলিটাকে চিনতে একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। জিমকে ওর পাশে খরগোসের মতো দেখাচ্ছে। নৌকোটাকে খোলামকুচির মতো আছড়াচ্ছে প্রাণীটা। সব ছেড়ে গ্রিজলির মনোযোগ যে কেন নৌকোটার উপর পড়েছে, সেটা ভেবে অবাক হতে গিয়ে – হঠাৎ বিদ্দ্যুচ্চমকের মতো খেয়াল হল কাল রাতের ক্লান্তিতে ও এক অমার্জনীয় ভুল করে বসেছে। খাবারের প্যাকেটটা নৌকোতেই ফেলে এসেছিল। আর সেই গন্ধে গন্ধেই.....

কিন্তু জিম তার কর্ত্রীর সম্পত্তি বাঁচাতে মরিয়া। প্রবল চেঁচাচ্ছে গলা ফাটিয়ে। ওকে যদি পায় ভালুকটা – আতঙ্কে আদেলা দ্বিতীয় ভুলটা করে বসল। জিইইইইম বলে চিৎকার করে দৌড়ালো ওকে ফেরত আনতে। আর এই চিৎকারেই বোধহয় ঘুরে দাঁড়াল গ্রিজলিটা। জর্জ বন্দুক নিয়ে বেরোতে বেরোতেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু ঘটে গেল। আদেলাকে বাধা দেওয়ার অবকাশটুকুও সে পেল না।

দৌড়োচ্ছে আদেলা। একহাতে জিমকে টানতে টানতে দৌড়াচ্ছে ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। পারল না। শিকারীর গতি যে ঘন্টায় তিরিশ কিলোমিটার! একটানে আদেলাকে ধরে সে পিছন ফিরল। পাগলের মতো গুলি চালিয়ে যাচ্ছে জর্জ। অসম লড়াইটা শেষ হল একসময়। লুটিয়ে পড়ল গ্রীজলী। তার আগে সে নখের আঁচড়ে গাছের ছাল ছাড়াবার মতো আদেলার শরীর থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে মাংস আর চামড়া। গ্রীজলীর বুকের মধ্যেই চিরঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছে ও।

সেই স্বপ্নে দেখা অন্ধকারের হাঁমুখটার মধ্যে ক্রমশঃ ঢুকে যাচ্ছে জর্জ। চাপ চাপ অন্ধকার আর আর কালো রক্তে মেশা সুড়ঙ্গটা থেকে তার আর বেরোবার পথ নেই। কতোটা কষ্ট পেয়ে মরেছিল আদেলা? গা থেকে চামড়া খুলে গেলে ঠিক কতটা যন্ত্রণা হয় একটা মানুষের? শেষ চিৎকারটা তো আদেলা তার নাম ধরেই করেছিল! কিচ্ছু করতে পারল না! অথচ সে তো এখনো দিব্বি পুরো চামড়া গায়ে জড়িয়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে! পুলিস এসেছে। চলে গেছে। সে ফিরে এসেছে তাদের – তার বাড়িতে। এখানে এখন যন্ত্রের মতো দিন পেরিয়ে রাত হয়। রাত পেরিয়ে দিন। এভাবেই ছয় মাস পেরোল। পুলিসের ভারপ্রাপ্ত অফিসারটি তার উপর বড় সদয়। তিনি চেষ্টা করেন যাতে তদন্তের সময় জর্জকে বারবার সেই ঘটনার মুখোমুখি হতে না হয়। তারপর একদিন সব মিটে গেল। আজ অফিসারটি এসেছেন তাকে আদেলার পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা দিতে। জর্জ রিপোর্টটা নিয়ে হতাশ হাসি হাসে। ধন্যবাদ দেয় অফিসারকে। বিদায় জানায়। রিপোর্টটা ছুঁড়ে ফেলে ঘরের এক কোণায়। কী হবে দেখে? আদেলা কতো যন্ত্রণা পেয়েছিল তা কী বলা থাকবে ওতে? গেলাসটা আবারও ভরে নেয়। এক ঢোকে শেষ করে। আজকাল আর নেশা হতে চায় না। আরো কড়া কিছু চাই ওর। বেরোতে যাবে, পায়ের কাছে খামটা এসে পড়ল। আবারও ছুঁড়ে ফেলতেই যাচ্ছিল, কী মনে হল, চেয়ারে বসে খামটা খুলল। রিপোর্টটার সঙ্গে একটা ছোট চিঠি। এবার একটু কৌতূহল হল মাতালের। চিঠি খুলে পড়তে শুরু করল।



প্রিয় জর্জ,

ভেবেছিলাম এই রিপোর্টটা তুমি একটু সুস্থ হলে দেব। কিন্তু দিন দিন তুমি নিজেকে যে হারে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছ, তাতে কবে কি করে বসবে, সে ভয়টা রয়েই যাচ্ছে। তার আগে তোমাকে এই রিপোর্টটা দেওয়া আমার কর্তব্য। তোমার স্ত্রী কীভাবে মারা গেছে সেটা তোমার জানার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।

তোমার প্রথম গুলিটা গ্রিজলির গায়ের চামড়া ছিঁড়ে আদেলার হার্ট ফুটো করে দেয়। তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয় তার। তারপরে তোমার উপর্যুপরি গুলিতে ভালুকটাও ভবলীলা সাঙ্গ করে।...............



বুক চেপে বসে পড়ে বেচারি। এক্ষুণি একটা গরম সীসের গুলি ওর বুকের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে! হাতের মধ্যে মুচড়ে ধরে চিঠিটা। গ্রিজলি নয়, ও। ও নিজের হাতে হত্যা করেছে ওর প্রিয়তমাকে। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়। ড্রয়ার খুলে বের করে আনে .৩৮ ক্যালিবারের পিস্তলটা। পুলিস বন্দুকটা নিয়ে গেলেও এটা এখনো তার কাছেই আছে। কোথায় লাগাবে? মাথায়? না, না – আদেলা যেভাবে মরেছিল ঠিক সেভাবেই মরতে হবে। ঘোর লাগা চোখে চিঠির শেষাংশে মন দেয়। ডিটেলটা চাই ওর।



..........অবশ্য তোমার গুলি না লাগলেও আদেলা মরতই। ভালুকের নখের আঘাতে তার সারা শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। একদিক থেকে দেখতে গেলে তুমি তাকে সেই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছ।

আমি জানিনা এতে তুমি কোন সান্ত্বনা পাবে কিনা। পারো যদি জীবনের দিকে মুখ ফেরাও।

শ্রদ্ধাসহ

ড্যানিয়েল



এতদিন পরে, এই প্রথম হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল জর্জ। কোথা থেকে যেন একটা শীতল বাতাস আসছে। আদেলা স্নান করে এলে বাতাসে এই গন্ধটাই ভেসে আসত না? আদেলাকে ও মারেনি। এক নারকীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে মাত্র। যে যন্ত্রণার কল্পনা তাকে পাগল করেছে এতদিন ধরে, সেই কষ্ট আদেলা আদৌ পায় নি। কিছু বোঝার আগেই সে সব যন্ত্রণার ওপারে চলে গিয়েছিল। অন্ধকার ভেদ করে আসছে আলোর রেখা। সিম্বা পারেনি। কিন্তু সে পারবে। আঁধার পেরিয়ে সে যেতে পারবে আলোর দিকে। জর্জ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। পিস্তলটা পড়ে থাকে টেবিলের ওপর। বাইরে বেরিয়ে আসে জর্জ । এখন ওর সারা গায়ে মাথায় ঝলমলে রোদের আলো।

1 comments:

1

গল্প - মৌসুমী পুপুল

Posted in

গল্প


আবীরের রং ধূসর
মৌসুমী পুপুল



।প্রথম পাঠ।

সেবার দোল পূর্ণিমা আরো এক চুটকি রঙ যেন বেশি গুলে দিয়েছিলো বাঁড়ুজ্জেদের রাসমঞ্চে রাখা বিশাল পিতলের গামলাটায়। বাড়ির পাঁচিলে উঠোনে কুয়োতলায় লাল, সবুজ রঙের কলঙ্ক কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে সকালের রঙিন লীলার। সূর্য তখন তার ক্লান্ত গেরুয়া উত্তরীয় টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে, তার মাধুকরী সারা হলো সেদিনকার মতো। সারাদিন পথে পথে ফাগের ঘুর্ণী উড়িয়ে পাগলা হাওয়াটা গিয়ে শালের পাতায় পাতায় নাচন লাগিয়ে দিয়েছে। বুড়ো শালপাতারা এ পাগলামি সইতে পারে না মোটে, তারা ঝরঝর খরখর করে ক্রমাগত খসে পড়ে প্রতিবাদে। মরচে ধুলোর পথঘাটে পথিকের পায়ের নিচে মুড়মুড় করে ভেঙে যায় তাদের বেলাশেষের অভিমান। একটু পরে তামার টাটের মতো চাঁদ উঠবে, মহুয়ায় ঝিমঝিম করবে সাঁঝবেলার বাতাসটা। অনেক দূরে নদীর পাড়ের গৌরাঙ্গ মঠে প্রার্থনার ঘন্টা পড়বে থেমে থেমে... ঠং ঠং ঠং....

দ্রুতগতিতে সাইকেল চালিয়ে রাঙামণি বাড়ি ফিরছে। ওর ঢোলা পাজামা পত পত করে উড়ছে। কপালে গুলাবী আবীরের গুঁড়োর পাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তেষ্টায় ঠোঁট মুখ শুকিয়ে এসেছে ওর। সন্ধ্যের আগে বাড়ি পৌঁছতেই হবে। পনের বছরের রাঙামণির কাঁধে বিরাট একটা দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে তার বড় বো'ঠান্। বাঁড়ুজ্জেবাড়ির বড় বৌমা। রাঙাদের বৌদি নয় শুধু, বর্তমানে বাড়ির ক্যাপ্টেন। মেজ বো'ঠান তো মাত্র দু' বছর হলো এসেছে এবাড়িতে।

ঠাকুরঘরের দালানে ফুট কড়াই, গুলিকদমা, গোলাপী-হলুদ মঠ, নোনতা গজার হরির লুট শুরু হবে একটু পরেই। পাড়ার বাচ্চাকাচ্চার দল কাড়াকাড়ি করে কুড়োবে। তার আগে বাড়ি ঢুকে খবরটা দিতেই হবে।

এই তো একটু আগে হাসপাতালের লম্বা করিডোরে কাঠের বেঞ্চে বসেছিলো সে, চোখ ভেঙে ঘুম নামছিলো, ঘাড় বারবার এলিয়ে পড়ছিলো ফুলদা'র কাঁধে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিরক্তি দেখিয়ে ফুলদা বলেছিলো -- রাঙা, এখন ঘুমোবার সময় না। মেজ বো'ঠান কত কষ্ট পাচ্ছেন জানিস! বড় বৌদি,মেজদা, সেজদা সেই কখন থেকে ওই ঘরটার সামনে। নার্সেরা ছোটাছুটি করছে, বড় ডাক্তার এসে দু'বার ঘুরে দেখে গেলেন, দেখতে পাচ্ছিস তো! বিপদের সময়... তোর সাইকেলের চাকা ঠিক আছে তো?

রাঙামণি একটু লজ্জা পেল, সত্যি এখন কেউ ঘুমোয়! ও একটু নড়েচড়ে বসলো, আসলে বন্ধুদের চাপাচাপিতে একটুস্ সিদ্ধি খেয়েছে আজ। ফাগুয়ায় এটাই রেওয়াজ এখানে, আর খেয়েছে দু'চামচ রসমালাই। তাতেই একটু মৌতাত।

শ্যামকিষনের বাড়ির গলিতে সবাই মিলে হুটোপুটি করে সারা সকাল হোলি খেলেছে। বাড়ি ফিরে স্নান খাওয়া সেরে একটা লম্বা ঘুম দেবে মনে করেই সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিলো রাঙা, পোস্ট অফিসের মোড়ে দেখে ফুলদা উদভ্রান্তের মতো হেঁটে আসছে। ওকে দেখে যেন হাতে চাঁদ পেল।

-- রাঙা! শিগগির চল। হাসপাতাল। হাসপাতাল। মেজ বো'ঠানকে নিয়ে ওরা এগিয়ে গেছে মাথুর সাহেবের গাড়িতে। আমারও যাওয়ার দরকার। বিপদের সময়....

ক্যারিয়ারে ফুলদাকে বসিয়ে টিকিয়া উড়ান্ স্পীড তুললো রাঙা।

সেজদা গম্ভীর মানুষ, আজ আরও যেন গম্ভীর। করিডোরের অন্যদিকটায় দাঁড়িয়েছিলো ঠায়। ভুরুতে চিন্তার ভাঁজ। রাঙাকে দেখে বলেছিলো -- তুই আবার এখানে কেন? এঃ! রঙ টঙ মেখে... যা বাড়ি চলে যা।

সেজদাকে খুব ভয় রাঙার, ও তৎক্ষণাৎ ফিরে যাচ্ছিলো। বড় বো'ঠান ভিজিটার রুম থেকে বেরিয়ে এসে সেজদাকে ডেকে বললো -- না সেজ্ঠাকুরপো,ও একটু অপেক্ষা করে যাক, ঠাকুরঘরের ব্যবস্থাটা....ওর সাইকেল আছে, ওই খবরটা নিয়ে যাবে খ'ন।

রাঙা প্যাডেলে চাপ দিলো আরও জোর। সাদা তোয়ালে মোড়া এত্তটুকু একটা পুঁচকে! কিঁও কিঁও করে কাঁদছে.. বড় বো'ঠানের কোলে।

-- নাও মেজ ঠাকুরপো, তোমার কন্যে! দেখো দোলের দিনে বাঁড়ুজ্জেবাড়িতে লক্ষ্মী এলো গো!

সেজদার ভুরু সোজা হয়েছে এতক্ষণে, হাসি মুখ। মেজদা কেমন লাজুক মুখ করে তাকালো সবার দিকে, চোখের কোনায় চকচক্ করছে জল। ফুলদা একগাল হেসে বললো – হেঃ! বাঁড়ুজ্জেবাড়ির নতুন জেনারেশনও শুরু হয়ে গেল! বাঃ! আমরা তাহলে বুড়ো হতে চল্লাম! হে হে...

ফুলদা'টা এমনই কথা বলে। কে বলবে ওর বয়স এখন উনিশ বছর মোটে!

বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোট কাকুমণি, ঘন ঘন চুরুটে টান দিচ্ছে। উনি বাড়ির ছোট কর্তা। রাঙা দেখলো তার মা দাঁড়িয়ে ঠাকুর দালানে, হাতে বেতের মস্ত ধামা। রাজ্যের বাচ্চাকাচ্চা হল্লা লাগিয়েছে তাকে ঘিরে। কাকুমণি ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো,জিজ্ঞেস করলো -- কি সংবাদ হে দূত?

থতমতো খেয়ে রাঙা বলে -- ওই তো, চার পাউন্ড না কতো যেন! মাথায় অনেক চুল। খুব কাঁদছে।

রাঙার মা পাশে চলে এসেছে ততক্ষণে -- কি জ্বালা! ওরে ছেলে হয়েছে না মেয়ে সেটা জানিস না হতভাগা?

একগাল হেসে রাঙা বললো -- ওই তো, একটা মেয়ে হয়েছে। মা আর বেবি ভালো আছে নার্সটা বললো।

-- যাক্ বাবা। জয় রাধানাথ। রাঙার মা বলে। -- ও ঠাকুরমশাই... কাল থেকে মন্দিরে ভোগ দিতে পারবেন না তো, জল তুলসী দিতে হবে শুধু... শুভ অশোচ শুরু হোল...দুলু বাবার মেয়ে হয়েছে...

কাকুমণি ধমকে ওঠেন -- বাড়িতে রাধারাণী এলো আর তোমরা রাধানাথের ভোগ বন্ধ করে দিচ্ছো! আশ্চর্য!!

-- এ্যাই ঘোষাল ঠাকুর... আমাদের না'হয় বারণ আছে, তুমি এই ক'দিন নিজের গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে বৃন্দাবন পণ্ডিতের দোকান থেকে শুদ্ধ্ ঘীউ কা লাড্ডু, বালুসাই, কালাকান্দ আনিয়ে ভোগ চড়াবে, দুধ মালাই চড়াবে আমি বলে দিলাম।

বাড়ির বড় কর্তা সতীশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাঙার জেঠাবাবু চটি ফট ফটিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন এরই মধ্যে। ছোটকর্তা ভয় খেলেন এবার। সতীশ হলেন তাঁর বড়দা, জেলা আদালতে হাকিম ছিলেন।এখন অবসর নিয়েছেন। সতীশ হলেন ঋষি দুর্বাশার অবতার,সাংঘাতিক রাগ তাঁর। তেমন বাছ বিচার। তিন বেলা জপ আহ্নিক করেন। রামায়ণ, ভাগবত নিয়েই তাঁর দিন কাটে। শনির দশা, মঙ্গলের দৃষ্টি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান আজকাল বড্ড বেশী।

মেজো বউমার কন্যা সন্তান হয়েছে জানলে তিনি কি রিয়্যাকশন দেবেন, তা কাকুমণির অজানা। রাঙার মাও তাড়াতাড়ি সরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সতীশ জলদ গম্ভীর স্বরে ভাতৃবধূকে বললেন -- ছোটবাবু ঠিকই বলচেন, বৌমা। শুভ অশৌচে রাধানাথের পরমান্ন সেবা বন্ধ রাখা হলেও তাঁর জন্য নিত্য মিষ্টান্ন সেবার ব্যবস্থা করো। আর তোমার বড়দি গেলেন কোথায়? শাঁখ টাক বাজানোর কথা কি আমায় বলে দিতে হবে? শোন বৌমা... আজ হরির লুটে বাচ্চাগুনো কে প্রাণ ভরে মঠ, কড়াই, মেঠাই খাওয়াও। আমরা সব নতুন ঠাকুরদা ঠাকুরমা হলুম যে!

এরপর যা শুরু হলো বাড়ি জুড়ে! জোড়া শাঁখ বেজে উঠলো, উঠোনে বাচ্চারা হুটোপুটি করে লুটের মিষ্টি কুড়োতে লাগলো, মেজো কর্তা সন্তোষ আছেন বেঙ্গলী ক্লাবে,তাঁকে খবর দিতে লোক ছুটলো। বাড়ির আর বাকি সদস্যরা এঘর ওঘর ছোটাছুটি করে সবাই সবাইকে আনন্দ সংবাদ জানাতে লাগলো। ঠাকুরদালানে ঘোষাল ঠাকুর জোরে জোরে ঘন্টা দুলিয়ে দিলেন।

বাঁড়ুজ্জেবাড়ির সর্বময়ী কর্ত্রী বুড়ো কর্তাদের মা অতিবৃদ্ধা 'খাঁদি ঠাকরুণ' তাঁর সান্ধ্যকালীন আফিমের চটকা ভেঙে জেগে উঠে বল্লেন -- ও ছোটখোকা আ... আমার গুড়গুড়িটা ঝি বেটি কোথায় নুকিয়ে রেখেছে দ্যাখ্ না বাবা!

ওদিকে আমিষ রান্নাঘরে পলি, গোপারা তাদের সেজদার আনকোরা নতুন বৌকে নিয়ে লেগে পড়েছে ডিমের চপ বানাতে। আজকে বড় আহ্লাদের দিন যে!

মাইল তিনেক দূরে জেলা হাসপাতালের সাদা চূনকাম করা, সবুজ পর্দার আড়াল দেওয়া ছোট কেবিনে ঘুমিয়ে আছে নতুন মা, পাশের কটে তোয়ালে জড়ানো শিশুটিও। বাচ্চার বাবা অদূরে বসে ঘুমন্ত মুখ দু'টির দিকে তাকিয়ে থাকে। আশ্চর্য হয়ে ভাবে, মাত্র কয়েক ঘন্টায় কেমন করে যেন জীবনের ছন্দ বদলে গেলো! কোথা থেকে এত মায়া এসে ঘিরে ধরলো মন?

পকেটে রাখা ছোট্ট নোটবইটা বার করে সে, ডট্ পেনটাও। কয়েকটা ছোট ছোট শব্দ লেখা হয়, কাটা হয়,আবার লেখা হয়। জিজ্ঞাসা চিহ্ন পড়ে...

চৈতালি?

চৈতী?

রাধিকা?

নন্দিনী?

আবীরা!!!!

শেষতম নামটি অস্ফুটে উচ্চারণ করে নতুন বাবা ভারী খুশী হয়ে ওঠে। আবীরা!!

আনন্দের আতিশয্যে ঝুঁকে পড়ে মেয়ের মুখের ওপর। রেশম রেশম চুলে ভরা ছোট্ট মাথাটাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে -- আমার ছোট্ট আবীরা, আমার আবু তুই।

আবু তখন ঘুমের মধ্যেই টুক্ করে হেসে ফেলে তার বাবার কাণ্ড দেখে।



(সেই আবীরা আজ অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে এসেছে, সামনে আরও কিছু পথচলা বাকি আছে হয়তো... চলার পথে কত জনকে হারিয়েছে, পেয়েছে নতুন কত জনকে... এই সময়ে তার মাঝে মাঝেই পিছন ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে...আবুর জীবনের আরো কিছু কথা আগামী পর্বে শোনাবো, কথা দিলাম...)

1 comments:

1

গল্প - অরিন্দম আচার্য

Posted in

গল্প


পুনর্মিলন
অরিন্দম আচার্য



তেত্রিশ বছর! হ্যাঁ? ঠিক বললাম তো?

হুঁ, সেই সেভেন্টিথ্রিতে কলকাতা ছাড়লাম, তারপর এই এত বছর লেগে গেল। এর মাঝে কত ঝড়ঝাপটাই না গেল, সেই কলেজ - তারপর চাকরি। তবে কলকাতায় আসার তাগিদটা ছিল না কিছুতেই। কারণ, আমার চাকরি পাওয়ার পর মা তো আমার কাছে চলে গেছিল। বাবাও চলে গেলেন, মা আর কি বা করতেন একা একা!

সে তো বটেই। তবে ভালোই তো ছিলি, আবার এলি কেন এই মরা দেশে? সেই সময় যাও বা কিছু দেখেছিলি, এখন তো সব গেছে।

সেটাই অদ্ভুত লাগছে। কি সুন্দর পরিষ্কার নির্মল ছিল আমাদের কলকাতা, সবুজে সবুজ ছিল চারদিক। আর এখন? বাপরে, সারা রাস্তা হয় হকার, না হয় বাজার। কি ভয়ঙ্কর করে ফেলেছিস! ডবলডেকার বাস নেই, সিনেমা হলগুলোও সব উধাও - হয় মার্কেট না হয় অনুষ্ঠান বাড়ি হিসাবে ভাড়া দিচ্ছে। স্কুলের গেটে পার্টি পতাকা, রাস্তায় গর্ত। বাপ রে বাপ। তবে একটা জিনিস দেখলাম, এখানে লোডশেডিং হয় না।

নেহাত মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল, না হলে হয়তো কলকাতার এই রূপ দেখতেও পেতাম না কোনও দিন। মায়ের ইচ্ছা ছিল, বাবার মতন শেষ নিশ্বাস কলকাতায় ফেলার, কিন্তু সেটা কোনও ভাবেই হল না। মা হঠাৎ করেই চলে গেল। ম্যসিভ অ্যাটাক, কোনও সুযোগই দিল না। তাই কলকাতায় এসেছি, মায়ের আত্মার শান্তির জন্য। গয়ায় গেছিলাম পরশু, পুজোআচ্চা সেরে কাল রাতে এলাম শহরে। এখানে পা ফেলেই কত কথা মনে পড়ে গেল। সেই কালো হলুদ ট্যাক্সি এখন আর নেই? অবাক লাগল।

পুরোনো কে নতুন করে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল রে। তুই নিজেই তো আর সেই পুরোনো বিনয় নেই। মনে আছে, আমরা অভীক স্যারের ক্লাস থেকে শুরু করেছিলাম? সেটা কোন সাল হবে?

সেভেন্টি টু।

কারেক্ট। তুই পড়তে চলে গেলি, আর নতুন সরকার এল। রাজনৈতিক বন্দীদের আমাদের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ছেড়ে দেবার সুপারিস করেন আর অভীক স্যারও ছাড়া পেলেন। তুই তো আর দেশে ফিরলি না। জানতেও পারলি না, আমাদের কি হল।

কে বলল, আমি জানি না? আমি সব খবর রাখতাম, গীতশ্রী আমায় সব জানাত।

গীতশ্রী?! সে তোকে কি খবর দিত? আর কেন দিত? কোথায়, আমরা তো ব্যাপারটা জানতাম না? তোর সাথে অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু অনুমতি পাই নি। অভীক স্যারও অনেক খুঁজেছিলেন। তুই যেন পুরো ভ্যানিশ হয়ে গেছিলি। বিলে কোথা থেকে একদিন খবর এনেছিল, তুই পুলিসের গুলিতে মারা গেছিস। আমরা খবরটার সত্যতার জন্য তোর বাড়ির সামনে ফিল্ডিং দিয়েছিলাম এক হপ্তা। পরে বুঝলাম, খবরটা ভুল। আর তা ছাড়াও গীতশ্রী কত দিনই বা তোকে খবর জানাতে পেরেছিল? ও তো ধরা পড়েছিল তোর নিরুদ্দেশের বছর খানেক পর।

উপায় ছিল না, তুই তো জানিস আমি তখন অলরেডি ওয়ান্টেড হয়ে গেছিলাম।

সে তো আমিও ছিলাম বিনয়, আমি তো পালাবার চিন্তাই করি নি। তুই নিখোঁজ হওয়ার এক মাস পর আমি ধরা পড়লাম। জানিস, আমি কারুর নাম বলিনি। কিন্তু সে যন্ত্রণা সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছিল।

বাজে কথা, আমি কোথাও পালাই নি। কোইন্সিডেন্টালি আমি তখন ফিলাডেলফিয়া ইউনিভারসিটিতে মাস্টার্সের সুযোগ পেয়েছিলাম।

মাথায় রাখিস, দু’জনের একই অপরাধ ছিল এবং ধরা পড়লে আমরা রাজনৈতিক বন্দী ছিলাম না। ইনফ্যাক্ট, আমি ছাড়া পাই এইটটি সিক্সে। বাই দ্য ওয়ে, তুই তখন মোটেও আমেরিকা যাসনি, তুই তখন গেছিলি তোর দিদির বাড়ি লখনৌতে। সঞ্জয় আমাদের সে খবর যোগাড় করেছিল। ইনফ্যাক্ট, তোকে ধরে আনার একটা প্ল্যানও করা হয়েছিল। আমাদের ভয় ছিল, তুই হয়তো ধরা পড়ে গেলে সব বলে দিবি। কলকাতার ধারে কাছে থাকলে তুই নিশ্চিত খুন হতিস। আমরা এও জানতাম, তুই কতদিন লখনৌতে ছিলি আর কবে বাইরে যাস। ইনফ্যাক্ট, তোকে পালানোর জন্য তোর বাবার সহপাঠী বটতলার ওসি হেল্প করেছিল, সে খবরও আমরা জানতাম। কি, ভুল বললাম? আর আমেরিকায় নিয়ে গেছিল তোর দিদির ভাশুর। সে তো ওখানে একজন ডাক্তার। তাই না?

কেন? রাজনৈতিক নয় কেন? আমরা কোনও অপরাধ করিনি, অ্যাক্সিডেন্টালি লোকটা মারা গেছিল। আমরা মারিনি। শুধু টাকা আনতে গেছিলাম।

সেটা কেউ বিশ্বাস করেনি। আইনের চোখে আমরা ছিলাম খুনি। রাজনৈতিক খুন নয়, নির্ভেজাল নিরীহ মানুষ খুন। তবে একটা ব্যাপার ভালোই হয়েছিল। রাজনৈতিক অপরাধী হলে আজ আর তোর সাথে এভাবে চা খাওয়ার সুযোগ হত না।

হ্যাঁ সেটাও জানি। রাজ্য পুলিশ প্রায় সবাইকে ময়দানে ছেড়ে পেছন থেকে গুলি করত। বিলে, গোপাল ঐ ভাবেই মারা গেছিল।

জানিস আমাদের উপাধি কি? আমরা নকশাল। আজ এত বছর পরেও আমাদের উপাধি অটুট আছে।

আজ জীবন সায়াহ্নে এসে মনে হয়, আমরা কি কোনও ভুল করেছিলাম?

নিশ্চয় ভুল করেছিলাম। সে সময় আমরা পড়ুয়াদের কি ম্যাচিওরিটি ছিল, হঠাৎ মনে হল গনতন্ত্র ফনতন্ত্র সব বোগাস। অভীক স্যারের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে কেমন যেন স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। লাভ কি হল বল? তবে তুই এই কাটা গণ্ডী থেকে বেরতে পেরেছিলি বলে বেঁচে গেছিস। আমার মতন অসার নিম্নাঙ্গ নিয়ে জীবনধারণ করতে হল না।

তুই তো জানিস গীতশ্রী ধরা পড়েছিল, নাকি সেটাও জানতি না?

গীতশ্রীর খবর আমি পাইনি। আমি খোকনকে ফোনে চেষ্টা করেছিলাম। ওর বাবা আমার কথা শুনে ফোন নামিয়ে রাখে। ভেবেছিলাম, আমার ওপর বোধহয় সবার রাগ ছিল, তাই এমন ব্যবহার।

তারপর?

সত্যি বলছি, আমি কলকাতায় আমার সব আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে প্রায় রোজ ফোনে খবর নিতাম। যতদিন মা এখানে ছিল এখানকার পরিস্থিতি আমায় রোজ জানাত। কিন্তু সঠিক খবর কেউ বলে নি।

ভালোই করেছে। খোকনকে যেবার পাঁচজন পুলিশ ময়দানে ছেড়ে দিয়ে গুলি করে, সেবার আমাদের এক বিখ্যাত অভিনেতা ব্যাপারটা দেখে ফেলেছিল। তবে সংবাদ মাধ্যম ব্যাপারটা ধামা চাপা দিতে বেশীক্ষণ লাগায় নি। কাকিমাও এই সব জানত না। তোর বাবার পরিচিত বটতলা থানার ওসির জন্য তোর বাড়িতে খুব একটা উৎপাত হয় নি।

গীতশ্রীর ওপর অত্যাচারের কথাও ও কাউকে বলেনি। মাত্র সাতদিন আটকে রেখেছিল। অপরাধ ছিল, ওর কাছ থেকে নাকি রিভলভার পাওয়া গেছিল। সব বোগাস! তারপর কোন এক কাউন্সিলারকে ধরে ওর বাবা ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। রবিন গেছিল ওর সাথে দেখা করতে, ও বলেছিল, নিস্পলক চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিল আমাদের গীতা। কিন্তু কোনও কথা বলেনি।

মাত্র আরও সাতদিন ছিল, বাড়িতে বন্দী। নিজেই নিজেকে বন্দী করেছিল। ওর বাবা মা, অনেক চেষ্টা করেছিল, ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতে। সেবার সন্ধ্যেবেলা ওর বাবা দার্জিলিং-এর টিকিট কেটে ওর ঘরে গিয়ে দেখে ফ্যানে কামিজের ওড়না লাগিয়ে একমাত্র মেয়ে ঝুলছে। সবই শুনেছিলাম রবিনের কাছ থেকে। ঐ ব্যাটাই একমাত্র এ শহরে থেকেও বেঁচে গেল। কারণটা কেউ জানে না।

ভাবলে কষ্ট হয়। আমরা নিজে হাতে নিজেদের জীবন নষ্ট করেছি। কোনও দরকার ছিল না ঐ বিপ্লবের। এখন ভাবি, ওটা কিসের বিপ্লব! আমাদের আগের প্রজন্মই তো এই স্বাধীনতা এনেছিল। তবে কিসের রাগে আমরা সব কিছুকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছিলাম! আমাদের উদ্দেশ্য কি ছিল! গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, কিন্তু কেন? মাও-এর নাম করে আমরা যা করেছি, সেটা তো রাজনীতি নয়, সেটা ত ছেলেমানুষী!

তুই বল অনিল, আমরা কি পেলাম। বিলে, খোকন, গোপাল, পানু, কানাই, সুধীন, রাজেশ, সঞ্জয়, সবাই, কি পেল বলতে পারিস। আমায় না হয় তোরা বলছিস আমি পালিয়ে গেছি, বুর্জোয়া দেশে গিয়ে বুর্জোয়া হয়ে গেছি। বাড়ি গাড়ি সব আছে। তাতে কি?তোদের তো কেউ বাধা দেয়নি ও সব পেতে, ও সব অধিকার করতে?

এখানকার কোনও খবর আমেরিকায় পাওয়া যেত না। কিন্তু দমদম জেল থেকে পনেরো বন্দীর পালিয়ে যাওয়াটা ওখানেও একটা খবর ছিল। শুনেছি, সুধীন, রাজেশ, সঞ্জয়, ওরা ছিল। ওরা পালিয়েছিল?

কে বলল সে কথা?

আমাদের ওখানে একটা বাঙ্গালিদের আখরা ছিল। সেখানে এক বাংলাদেশি ছেলে বলেছিল। রাজেশ নাকি যশোরে পালিয়েছিল। বাকিদের খবর নেই। যশোরে ঐ ছেলেটির মামা বাড়ি। রাজেশ সেখানেই ছিল কিছুদিন। কথাটা সত্যি?

জানি না। তখন আমি জেলে। এমন কি আমি বাকিদের খবরও জানি না। কারণ আমি ছাড়া পাই এইট্টি সিক্সে। তখন কোথায় কে ছড়িয়ে পরেছে? শুনেছি, রাজেশ সিঙ্গাপুরে একটা এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে চলে গেছিল। ওখানেই সেট্‌ল্ড। তোর মনীষাকে মনে আছে?

কে মনীষা? সেই রোগা করে মেয়েটা? কলেজে যাকে দেখলেই তুই দূর থেকে ফু দিতিস? উড়ে যাবে কি না দেখার জন্য?

হাহাহাহাহা। কি বর্ণনা। তোর স্মৃতিশক্তির তারিফ না করে পারা যায় না। আজ থেকে ত্রিশ একত্রিশ বছরের পুরোনো ঘটনা হুবহু মনে রেখেছিস। হ্যাঁ, সেই মনীষা। অভীক স্যারের দুত হিসাবে আমার কাছে আসত প্রত্যেক সপ্তাহে, খোঁজ খবর নিত আর কিছু থাকলে জানাত। নতুন সরকারের আমলে ও একটা চাকরি পায়, স্কুলে। ভালই কাটে আমাদের। শুধু ওর বাবা মা আর আমার বাবা মা মেনে নেয়নি আমাদের সম্পর্ক। আমার বাবার তো আবার নিজস্ব আশ্রয় কিছু ছিল না। কালীঘাটে ভাড়া থাকতাম, তবে পুরোনো ভাড়াটে তো, গোটা বাড়িটাই আমরা ভোগ করতাম। শুনেছি, খুনির বাবা বলে আমার বাবা মাকেও বাড়িওলা বের করে দেয়। তারপর তারা কোথায় চলে যায় কোনও খবর নেই, মনে হয় মালদায় আমার মামার বাড়িতে আশ্রয় নিতে পারে। আমি আর কোনও খবর নেওয়ার চেষ্টা করিনি। মনীষাকেও বারণ করেছিলাম ঐ ব্যাপারে জড়াতে। ওর বাবা মায়ের সাথে সাথে ওর দাদারাও ওকে ঠাঁই দেয়নি ওদের বাড়িতে, আমাদের মেনে নেয়নি ওদের পরিবারের অংশ হিসাবে। খুনি মানুষকে কে আর পাত্তা দেয়, তায় আবার পঙ্গু।

আরিব্বাস, তোরা বিয়ে করেছিস? কোথায় থাকিস এখন?

ফুলবাগান। তুই বোধহয় জানিস না, আমাদের এক প্রতিবেশীকে কয়েক বছর আগে ফুলবাগান থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে পুলিশ ধর্ষণ করে। হইচই হল কিছু দিন। তারপর যে কে সেই। মনে আছে? আমরা পুলিশ মারার প্লান করেছিলাম। সেই পুলিশ!!! হাহাহাহাহা।

তুই বস্তিতে থাকিস?

হ্যাঁ, কেন, বস্তিতে মানুষ থাকে না? প্রথম প্রথম অকওয়ার্ড লাগত। এখনতো বস্তির ছাপ্পা লেগে গেছে। খারাপ কি? ছেলে মেয়ে তো নেই। বেশ আছি দুজনে। একখানা ঘর, ছোট জানলা, একটা তক্তাপোষ, আলনায় গোছানো কাপড় চোপর, পরিস্কার ছোট আয়না। ছোট জায়গায় বড় কাছাকাছি, ভীষণ ঘনিষ্ঠ ভাবে থাকা যায়। মনীষা ভীষণ গোছানো আর পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে।

সত্যি ,সময় কি বিচিত্র। কৃষকদের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা গরিব খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার বিচিত্র প্রচেষ্টা হল। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য এখনও অজানা। সমাজের সব শ্রেণীর মধ্যে সম্পদের সমবন্টন, সেটা আবার হয় নাকি! এটা তো ইউটোপিয়া। অথচ আমরা ছুটেছিলাম। কোন লাভ হল! সমাজের প্রকৃত দুটি শ্রেণী আজ আরও প্রকট হয়েছে।

সেটা তো তোকে দেখেই বুঝতে পারছি। এই সব জায়গায় আমার মতন কোনও মানুষ কোনওদিন ঢুকতে পেরেছে নাকি, খেতে পাওয়া তো দূরের কথা।

কি যা তা বলছিস! আমার কোনও পরিবর্তন হয় নি। আমি যেমন ছিলাম তেমন আছি। এটা ঠিক, সে সময় আমি তোদের সাথে সমানতালে থেকে যেতে পারিনি। কিন্তু আমিও তোদের সাথে শুরু করেছিলাম। যা যখন দরকার হয়েছে, যুগিয়ে গেছি। এটা তো তোকে মানতেই হবে, ঐ সব ধারাবাহিক ঘটনা আর যাই হোক, বিপ্লব নয়। যে কাজের কোনও উদ্দেশ্য নেই, সে কাজ করে লাভ কি বল?

সে তো অবশ্যই। একে একে সব নেতাই চলে গেলেন। শেষকালে কানু সান্যাল এই তো কিছুদিন আগে, সুইসাইড করলেন। তৎকালীন সব নেতারই অবসান হল।

আমাদের অভীক স্যার?

সে এক মস্ত ঘটনা। সবই শোনা, কারণ আমি তো তখন বন্দী। রাজনৈতিক বন্দীদের অপরাধ মুকুব করার পর সরকার একটা টোপ ফেলে। দলের লোক ভারি করার তাগিদ, আর কি! অভীক স্যারও যোগ দেয়। সে সময় কলকাতায় বাংলাদেশী রিফ্যুজিতে ভরে গেছে। সারা রাস্তায় গিজগিজ করছে মানুষ। নতুন নতুন কলোনি তৈরি হচ্ছে চারদিকে।

যে একদল রিফ্যুজিকে দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়েছিল, মনে পড়ে সে কথা? দেশ ভাগের পর যারা এসেছিল এখানে, তাদের থেকে কিছু লোক পাঠিয়েছিল না দণ্ডকারণ্যে? সেই তারা নতুন আশায় ফিরে এসেছিল, বাংলায়। হয়তো সরকার পরিবর্তনে ওদের ধারণা হয় যে ওরা আবার ওদের নিজের ভাষাভাষী মানুষের মাঝে এসে আশ্রয় পাবে। সুন্দরবনের কিছু জায়গা অধিকার করে নেয় তারা। ব্যস, আর যায় কোথায়? সরকার তাদের তাড়ানোর জন্য লোক পাঠায়, যত না পুলিশ তার চেয়ে বেশী পার্টিকর্মী।

হত্যালীলা চলে সেখানে। কিভাবে কি হল, জিজ্ঞাসা করিস না। আমি জানি না। শুনেছিলাম, প্রচুর গোলাগুলি চলেছিল। পৃথিবী শান্ত হয়ে যাওয়ার পর, মরিচঝাঁপির সেই খোলা প্রান্তরে অনেক নিরপরাধ মানুষের সাথে আমাদের অভীক স্যারের নিথর দেহটাও পাওয়া গেছিল। ওটাও নাকি একটা অ্যাক্সিডেন্ট, কেউ ওনাকে মারতে চায় নি, ভুল করে হয়ে গেছে। নিজের লোককে আর কে মারতে চায়!

মনীষা শেষ যাত্রায় পা মিলিয়েছিল সবার সাথে। রবিনের সাথে দেখা হয় সেখানে। ও নাকি তখন দক্ষিণ কলকাতার কোন একটা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ওর কাছ থেকেই শুনেছিল কানাই নাকি উন্মাদ হয়ে গেছে। কলকাতার কোন একটা পাগলা গারদে ছিল। তারপর কি হয়েছে কোনও খবর নেই। অভীক স্যারের জন্য পার্টি কোনও কসুর করেনি। লাল পতাকায় মুড়িয়ে লাল সেলাম জানিয়েছিল। সেটাই বা কম কি?

1 comments: