Next
Previous
0

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






ভোর রাত্রের একটা দৃশ্য এরকম – একটা ঘরের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসছে রমণ ও শীৎকারের শব্দ। হরিদাস প্রভাতী নাম সংকীর্তন করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে – তার শব্দ। দূর থেকে এগিয়ে আসছে মৃতদেহ কাঁধে শ্মশানযাত্রীর দল। হরিনাম ধ্বনি ও তাদের খোলকরতালের শব্দ। এতো কিছু শব্দ মিলে সেই ভোর রাত্রের যে অনুনাদ বা রেসোনেন্স তৈরী হলো, তাতেই এই দুনিয়ায় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেলো। পৃথিবীর সময় উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করলো। যে মৃত যুবতীটি একটু আগেই কবরে শুয়ে ছিলো, সে জীবিত হয়ে উঠে এলো। ১৯৮০ সাল ১৯৮১র দিকে না গিয়ে এই দুনিয়ার সময় এগোতে লাগলো পেছনে, ১৯০০ সাল বা প্রাচীন পৃথিবীর দিনগুলোর দিকে। আমরা দেখলাম, এখন যে যুবতীটি মৃত, সে বেঁচে উঠেছে, ঘড়ির কাঁটা আরো পেছনে ঘুরতেই সে ধর্মযাজক দ্বারা ধর্ষিতা হচ্ছে! পৃথিবীর সময় আরো আরো পেছোচ্ছে, সোনার দাম কমছে। সেসব দিনগুলোয় আগের মতো দূষণ বা পল্যুশন নেই, সুন্দর একটা প্রাকৃতিক পরিবেশ। গল্পকারের দারুণ কল্পনাশক্তি, অসাধারণ পরাবাস্তবতা! এমনটাই লেখে সুবল দত্ত - তার ‘সময়-শোধন’ গল্পে। ঘড়ির কাঁটাকে এরকম পিছিয়ে নিয়ে গেলে আজকের মানুষ বুঝতে পারবে তাদেরই সমূহ ভুলভ্রান্তি। সত্যিই তো, নিজেদের সংশোধনের জন্যে আমাদের অতীতের থেকে শিক্ষা নেয়াটা বড় জরুরী। সময়কে পেছনে নিয়ে যেতে যেতে নানা ঘটনা পরম্পরাকে দেখিয়ে দিতে দিতে, এই গল্পের পরিসমাপ্তিতে লেখক ঘোষণা করলো- মানবতার বিরুদ্ধে সমস্ত জটিল কার্যকলাপ মুছে যাচ্ছে। এরপরে শুভবুদ্ধির প্রতিশ্রুতি। পৃথিবীর সময় আবার আগের মতোই সামনের দিকে এগোচ্ছে। দারুন এ গল্প – অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ভাবনা ! এখানেই গল্পকার সুবল দত্তের স্বকীয়তা!
সুবল দত্ত এসময়ের একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার। মিডিয়া প্রভাবিত দুনিয়ায় বহির্বঙ্গের এই গল্পকারের পরিচিতি অপেক্ষাকৃত সীমাবদ্ধ। যে ব্যপক পরিচিতি ও প্রচার তার প্রাপ্য , তা তিনি হয়তো এখনো পান নি। সুবল দত্তর সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৬ নাগাদ। থাকেন জামসেদপুরে। তার জন্ম পুরুলিয়ার মানবাজারে – ১৯৫৫ সালে। পেশায় স্টেট ব্যাঙ্ক-এর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। চাকুরী সূত্রে তাকে বিহার ঝাড়খন্ডের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়েছে। ওই অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের জীবনযাত্রা , ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি বেশ কিছুটা পরিচিত। লেখক জীবনে তার প্রাথমিক আত্মপ্রকাশ কবি হিসেবে। গল্পও লিখেছেন। প্রসঙ্গত এটাও উল্লেখ করা যায়, সুবল দত্ত একজন শিল্পী – তার করা প্রচ্ছদ রয়েছে আমার কাব্যগ্রন্থ ‘অনন্ত জলশব্দে আমি’ তে। এযাবৎ তার দুটো গল্পগ্রন্থ – ‘প্ল্যাগিয়ারিস্ট’ ও ‘প্রদাহবোধ ১১’, যা প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে। তার প্রৌঢ়ত্বে, রিটায়ার-সময়ের কাছাকাছি। সুবল দত্তের বইদুটো হাতে আসার পর তার গল্পের উপর আমার ভীষণ আগ্রহ জন্মায়। তাই আমি চেষ্টা করেছি তার গল্পকে বোঝবার, তাকে নিয়ে সামান্য লেখবার।
‘শৈলী’ পত্রিকার ৪৭তম / কার্তিক-১৪২৬ সংখ্যা এখন আমার সামনেই। এতে প্রকাশিত হয়েছে সুবল দত্তের একটা গল্প – ‘ইন্দে ইয়লো সামান গে তন্নো’। আমি এই গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ি। দেখি - একটা তামিলভাষী ভিখিরি গোছের মানুষ, তাকে বুঝিয়ে বাজিয়ে টাকার বিনিময়ে কিনে নেয়া হলো, কেনা হলো লোকটার একটা কিডনী, যেটা অপারেশন করে লাগিয়ে নেয়া হলো পয়সায়ালা মালিক মিহির সিং এর শরীরে। সুস্থ হয়ে কিছুদিন বাদে মিহির সিং এক রাত্রে সুপারভাইজেশনে গেলেন তার কারখানায়। তিনি দেখলেন, অবর্ণনীয় বিষাক্ত পরিবেশে রাত্রে লেবার মজদুরগুলো কাজ করে যাচ্ছে। মিহির সিং আরো দেখলেন, ওই মজদুরগুলোর মুখ কিডনী-বেচা তামিল মানুষটার মুখের মতোই! ওই মজদুরগুলোর ‘পেট থেকে উজ্জ্বল লাল রক্তের মত তরল গড়িয়ে পড়ছে’। এই বর্ণনায় পাঠক থমকে যায় – যে মানুষ একজায়গায় কারখানায় তার শ্রম বিক্রি করছে, সেই মানুষ অন্য জায়গায় তার কিডনীটা বিক্রি করছে! যে দেশ, যে ভাষাই হোক না কেন, তাদের চেহারা এক – তারা হলো নিঃস্ব উপায়হীন শ্রমজীবি মানুষ। তাদের সবার জাতও এক। গল্পটা পড়বার পর আমার চোখে ভাসছে সেই ট্রেনযাত্রী সেই ভিখারীগোছের তামিল মানুষটার মুখ, যে মুখ দিয়ে সে অঙ্গীকার করছে তার দাসত্বের, সে তামিল ভাষায় বলছে - ‘ইন্দে ইয়লো সামান গে তন্নো’ , যার অর্থ হলো ‘আমার যা আছে সব তোমার।’ এই গল্প লেখকের সমাজ ও দর্শণবোধকে আমি আবার সমীহ জানালাম।
এবার সুবল দত্তের প্রকাশিত গ্রন্থদুটো থেকে পড়া কিছু গল্পকে তুলে ধরা যাক। খুঁজে দেখার চেষ্টা করি তার লেখার চরিত্র বা বিশিষ্টতা।
‘বি পি এল’ – গল্পের মূল চরিত্র রজনী নামের লোকটাকে দেখি একটা সাপকে হাতে পিষে ধরেছে , ছোবল খাবার পরও সাপটার মুখ হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ওটার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। যেন সাপটা এই সমাজ ব্যাবস্থারই প্রতিরূপ । রজনী ভূমিহীন, ব্যাঙ্ক-ডিফল্টার, ঋণের দায়ে জেলখাটা, একটা সর্বস্বান্ত মানুষ । ওর কাছে গ্রামের মুখিয়া, বিপিএল কার্ড ইস্যু করা বাবু, ঋণদেয়া ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, অফিসের ক্লার্ক সবাই বিষাক্ত। তাই বিষাক্ত সাপটার সাথে লোকটার খালি হাতে এই লড়াইও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা লড়াই। যাদের পাবার কথা , তারা বিপিএল কার্ড পায় না। হাজার হাজার চালচুলোহীন মানুষ, পথের ভিখিরী, আরোগ্যহীন কুষ্ঠরোগীর দল এই গল্পে উঠে আসে। গল্পের শেষে দেখি ওই সব মানুষগুলো দলে দলে এগিয়ে আসছে, বাহাতের আঙ্গুলে কালি মাখিয়ে টিপছাপ দিচ্ছে। না কোন দলিলে নয়, কোন কাগজেও না। বর্জিত প্রান্তে পড়ে থাকা একটা বোবা পাথরের দেয়ালে ওরা ওদের আঙ্গুলের নিস্ফল টিপছাপ রেখে যাচ্ছে! সর্বস্বান্ত মানুষদের নিস্ফল টিপছাপ লাগানোর চিত্রকল্পটার মধ্যে গল্পকারের বক্তব্য একটা ধারালো মাত্রা পেয়েছে। লেখার ফাঁকে ফাঁকে এই গল্পেই তার লেখনীতে উঠে এসেছে কিছু অসাধারণ বর্ণনা। বিবেচকী লাইন – যেমন ‘গরিবের সংসার হোলো বহতা নিকাশির জল। ঝির ঝির বইতে থাকে তো বেশ। থেমে গেলেই পচা নর্দমা।’ কিংবা ‘দূরে পলাশ ডাবরের পলাশ জঙ্গল যেন দিগন্তে এক বিশাল সাঁঝা চুল্‌হা। যেন এই বিশাল উনুনে সন্ধেবেলার রুটি সেঁকা হবে।’
আদিবাসী উন্নয়নের নামে প্রত্যন্ত গ্রামে নেমে আসে সান্নাটা। খনির মালিক, পুঁজিপতিদের চক্রান্ত। এসবের জীবন্ত ছবি ‘একটি শেষ বিরলতম উপজাতির অন্তিম পার্বণ’ গল্পে। লিদরি লুগুন –এর মতো কমবয়সী সমাজকর্মী, সৎ অ্যাক্টিভিষ্টরা স্বার্থন্বেষী সমাজ ব্যবস্থার গোপন চক্রান্তে খুন হয়ে যায়। আসল কথা হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নয়ণ! আদিবাসীদের পার্বণে সবাই চুর হয়ে থাকে, হাড়িয়া বা ডিয়েং পানীয়ের নেশায়। সেই পানীয়তে মেশানো থাকে বিষ। একটা গ্রাম, একটা উপজাতি শেষ হয়ে যায় - সেখানে আর বাঁধা দেয়ার কেউ থাকে না। এদেরই জমি লুটে নিয়ে, বন-জংগল দখল করে তৈরী হয় পুঁজিবাদী উন্নয়ণের ইমারত। লেখক খুব মুন্সীয়ানার সঙ্গে এই উপজাতি সমাজ জীবনকে তার গল্পে একেছেন, তুলে এনেছেন দলিত ও পিছিয়ে থাকা সমাজের কথা, তাদের উপর অন্য একশ্রেনীর মানুষের নির্মম শোষনের ইতিকথা।
ছোটগল্পের বিষয় সূত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, জীবনের চলমান স্রোত থেকে গল্পকার সংগ্রহ করেন খন্ড খন্ড উপলব্ধি (perception) , সেটাই হয়ে ওঠে ছোটগল্পের প্রাণবীজ। এমনি ভাবেই ছোটগল্পের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে ওঠে চলমান জীবনের সত্য। সুবল দত্ত বিভিন্ন সূত্রে আদিবাসীদের কাছে গিয়েছেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সঙ্গে মিশেছেন। তাই তারই সমূহ উপলব্ধি সামুহিকভাবে মিশে থাকে তার লেখা গল্পগুলোয়।
কুষ্ঠরোগীদের জীবনকেন্দ্রিক গল্প ‘শাম্বর বংশবীজ, অর্জুনের দ্বন্দ্ব’ – এই গল্পে মানবজীবনের সাথে সাথে সমাজজীবনের কুষ্ঠদশার বিবরণই উঠে আসে। বিদেশবাসী ডঃ অর্জুন WHO-র তরফে কুষ্ঠরোগীদের সার্ভে করতে দীর্ঘদিন বাদে নিজের দেশে ফিরে আসে। তার নিখোঁজ বাবাকে সে খুঁজে পায় কুষ্ঠরোগীদের আশ্রমে। আমরা জানতে পারি কুষ্ঠজীবনের অসহায় নির্মমতার কথা, তাদের সমাজ-বিচ্যুত আবরুদ্ধ জীবনের কথা, রোগের চিকিৎসায় ওষুধ কোম্পানীগুলোর ধান্ধাবাজীর কথা। সুবল দত্তের গল্প শুধু কাহিনীমাত্রিকই নয়, গল্পের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে চাবুক মারা নানা উপলব্ধি। এখানে নায়ক অর্জুন উপলব্ধি করে, মানুষ যদি জরায়ু ভেদ করে তার মায়ের গর্ভে পুনর্বার ফিরে যেতে পারে – তাহলেই এ পৃথিবী পিচাশমুক্ত হবে। এই গল্পে লেখক শোনায় – ‘ অসমোসিস প্রক্রিয়াতে মিথ্যে সত্যের ভেতরে ঢুকে গেছে।’ গল্পের উপসংহারে দেখি আরো এক চরম উপলব্ধি! দেখি দাউ দাউ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কুষ্ঠ সমাজের মানুষজন, পুড়ে যাচ্ছে পচাগলা বিকৃত সময়ের কাহিনী। গল্পের পরিণতিতে বলা হয় – ‘চরম বিকৃতির পর ধ্বংস তারপর শুদ্ধসৃজন হতে বাধ্য।’ গল্পের পাতায় পাতায় এমনি নানা আশ্চর্য, অপ্রচলিত উপলব্ধি পাঠকে অনিবার্য এক দার্শনিকতার মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে দেয়।
সুবল দত্তের সামাজিক অভিজ্ঞতার ফসল - ‘পুনর্জন্ম’ গল্প। এটা আদিবাসীদের জীবন ও সমাজের গল্প। লেখক নিপাট বর্ণনা করছে এক অপ্রচলিত সমাজের জীবন যাপন, তাদের আচার সংস্কৃতি, পালা-পার্বণ, এমন কি কথাবার্তা। গল্পের পটভূমি পরিচিত গ্রাম-শহরের বাইরে , স্বতন্ত্র তার পরিবেশ। এমনই পরিবেশের একটা মেলা, লোকজনের জমায়েত। সেখানে আদিবাসী মেয়ে লিদরি-র উপর শারীরিক অত্যাচার ও তার প্রতিবাদ। এই বিষয় নিয়েই লেখা ‘পুনর্জন্ম’ গল্পটা!
গতানুগতিক কাহিনীর বাইরে বেরিয়ে এসে কি করে অভিনব কাহিনী লিখতে হয়, তার ট্যাকটিস সুবল দত্তের গল্পে হামেশাই খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, তার গল্প ‘নিস্তার’। এই গল্পের প্রধান চরিত্র মাতাল মাহাতো একটা অন্ধকার ঘরে দিনভর বাঁধা থাকে। রোগের কারণে তার চোখে দিনের আলো সহ্য হয় না, তার শরীরে ইয়া বড় বড় চুল গজায়। মাসে মাসে মাতাল মাহাতোর বউ সেই চুল কেটে ফেরিয়ালার কাছে বিক্রি করে। সেটা তার পরিবারের আয়। মাতালের বউ মোহিণীর দুসরা আয় নিজের শরীর বেচে, এই শরীর বেচাটাকে সে স্বাভাবিক ভাবেই উপভোগ করে, তাতে কোন রাখঢাক নেই। একটাই মাত্র ঘর, সেই ঘরের এক কোনে অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত মাতাল দেখে তার ভাই থুলকু ও তার বউ মোহিণী শারীরিক যৌন সম্পর্কে দিনের পর দিন জড়িয়ে থাকে। এই দৃশ্য মাতাল মাহাতোকেও যৌনকাতর করে তোলে। মানুষের আরোগ্যের জন্যে রক্ত খাওয়া কি জরুরী ? যৌন সম্পর্কে অপারগ মাতাল মাহাতো তার বউ মোহিণীর যোনিতে জিভ দিয়ে ঋতুশ্রাবের রক্ত চেটে চেটে খায়। মোহিণীও নিজেকে উলঙ্গ করে তার অসুস্থ স্বামীর কাছে নিজের রক্তাক্ত জরায়ু মেলে ধরে! এমনই একটা অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশ, নরকীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর যৌনতা, যা কিনা পবিত্র, অথচ অদ্ভুত। এই ‘নিস্তার’ আমাদেরকে অকল্পনীয় গল্পদৃশ্যের মুখোমুখি পৌছে দেয়। মনে পরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক প্রতিবন্ধী যুগল ভিখু-পাঁচির গল্পের পচাগলা অন্ধকারময় জীবনের কথা !
সুবল দত্ত নারীর হৃদয়কে গভীর ভাবে অনুসন্ধান করে তাকে উপস্থাপন করেছে ‘কনফেশন’ গল্পে । এই গল্পের মেয়েটি নার্সস্টাফ, সে পরপুরুষদের সঙ্গে কয়েকবার শুয়েছে, নিজের ঘরে অন্যের সংগে যৌনসম্পর্কের অভিজ্ঞতাও তার আছে। এই পদ্মাবতী তার ডিউটির হাসপাতালের প্রেমিক ডাক্তারটির সাথে অবাধে মেলা মেশা করে, তার সাথে একান্তে অনেক অন্তরঙ্গ সময় কাটায়। অথচ এই গল্পেরই অভিমুখ হঠাৎ পালটে যায়। একদিন পদ্মাবতীর শরীরকে ভোগ করার জন্য ডাক্তার তাড়িত-কামুকের মতো হাত বাডায়! তখনই উঠে আসে তীব্র অসম্মতি বা নারীর প্রতিরোধ। কারণ পদ্মাবতী ডাক্তারের মধ্যে এতোদিন একজন প্রকৃত প্রেমিককেই খুঁজেছে, তার ভালোবাসার মানুষটির মধ্যে সে কোন ধর্ষক কিংবা সহজলভ্য কামুক পুরুষকে দেখতে চায় নি। হৃদয়ের যে গভীর অনুসন্ধানটি পদ্মাবতীর মধ্য দিয়ে পাঠকদের কাছে পৌঁছায়, তা হলো শারীরিক যৌন সম্পর্কই সব সময়ে বড় কথা নয় , নারীর হৃদয়ও খুঁজে ফেরে কোন প্রকৃত প্রেম, নিটোল কোনো ভালোবাসা।
গল্পটার নাম ‘সেতু’। একটা নদী, একদিকে গরীব, অন্যদিকে বড়লোক। এই নদীর মাথার উপর দিয়ে বিশাল একটা সেতু। যখন গাড়ী যায়, থর থর করে কাঁপতে থাকে ব্রীজটা। নোংরা নদীপারের কাছেই একটা বস্তীতে থাকে কিসকু আর তার বউ। দারিদ্র, ডায়ারিয়া, এনকেফেলাইটিস এসব নিয়েই অপরিচ্ছন্ন জীবন। এই কাহিনী টানটান একমুখী কোন গল্প নয়। এ গল্প যেন পথ চলতে চলতে চোখ মেলে দেখা – এতে উঠে আসে অনেক ঘটনা, জীবনের অভিজ্ঞতা, ভাবনারা। বৃষ্টি, বৃষ্টি - এ গল্পের দ্রুতগামী ঘটনারা আসে এক অতি-বর্ষণের রাতে। চারদিকে জল থই থই। নদীতে জলের স্রোত। এমন অবস্থায় নদীর উপরের সেতুটা ভেঙ্গে পড়ে। এমনি দুর্যোগের সময় কিসকুর বউ জন্ম দেয় একটা বাচ্চার। বানভাসি জল, না ডাক্তার, না অ্যাম্বুলেন্স। কিসকু তার সদ্যোজাত প্রথম সন্তানটাকে জলের ছাট বাঁচাতে একটা ঝুড়িতে ঢাকাঢাকি দিয়ে রাখে। তারপর সদ্যপ্রসবা বউর হাতে হাত, সদ্যোজাত সন্তান ঝুড়িতে – মাথায় তোলা, কিসকু জলের উজান ঠেলে নির্ভয়ে হাটতে থাকে। সে চায় তার প্রজন্মকে বাঁচাতে, নিজেরা বাঁচতে।
গল্প সমাজ ও জীবনের দর্পণ। বর্তমান জটিল জীবনের বিভিন্ন দিক একই গল্পের মধ্যে মিলে মিশে থাকে। ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখকথা / নিতান্তই সহজ সরল’ – এটা ছোট গল্পের পরিচয়। অথচ উক্ত ছোট্ট পরিধিতে আজকের ছোটগল্প যে দাঁড়িয়ে থাকবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই। সুবল দত্তের গল্প চিরাচরিত ছোটগল্পের এই সংজ্ঞাকে অতিক্রম করে গেছে।

কানু ওরাঁওর বাঘের সঙ্গে মোকাবিলার গল্প ‘দৌড়’। গল্পের পটভূমি জঙ্গলঘেরা অঞ্চল - সরায়বিন্দা, বাঘবিন্দা, মহুলটাঁড়। কানু বাঘ মারতে বেরিয়েছে, বাঘেদের ওপর ওর খুব রাগ। জঙ্গলের মধ্যে বিপদজনক অবস্থা কানু যখন বাঘেদের মুখোমুখি হয়, তখন বোঝা যায় তার সামনে বাঘের মতোই উপস্থিত কিছু হিংস্র, উগ্রপন্থী মানুষ এবং নারীও! এই গল্পের বুনোট খুব আকর্ষনীয় – গল্পে বন জঙ্গল আর আদিবাসী পরিবেশের বর্ণনা পাঠকদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।
গল্পের রূপবৈচিত্র্য খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, কোন লেখা সাংকেতিক বা প্রতীকধর্মী, কোথাও রয়েছে প্রেম আখ্যান, কোথাও মনস্তাত্বিক টানাপোড়েন। আবার কোন লেখা প্রত্যন্ত আদিবাসী সমাজকে প্রধান্য দেয়। গল্প হতে পারে বস্তনিষ্ঠ, কিংবা কাল্পনিক, অথবা কাব্যিক। কোন গল্পে বিন্যাস ও আঙ্গিক প্রধান্য পায় । গল্পের বহুধাবিস্তৃত বহুমাত্রিকতার দুনিয়ায় সুবল দত্তের সফর অনেকটাই। তবে তার বেশীর ভাগ গল্পেই বিভিন্ন মাত্রা একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। কোন গল্পের বিশেষ মাত্রা কি , তা নির্ণয় করা একটু মুস্কিলের কাজ।
তবুও লেখালেখির বৈশিষ্ট্য ও গুনগত-প্রাধান্যের ভিত্তিতে সুবল দত্তের আরো কিছু গল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক।


গল্পের বিন্যাস

‘প্রদাহবোধ-১১’ গল্প সংকলনের প্রথম গল্প ‘ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি’। এ গল্পটা প্রভু মন্ডলের, যে কিনা মাস্টার অফ ফার্মেসী পাশ, তারই দশ কিলোমিটার পদযাত্রার গল্প। যাত্রাপথের দু’ কিলোমিটার বাদে বাদে গল্পটার এক একটা পরিচ্ছদের নাম দেয়া হয়েছে কাম, ক্রোধ, মোহ, লোভ, দম্ভ ও মোক্ষ। গল্পের এই বিন্যাস অভূতপূর্ব! এর পরিচ্ছদগুলোয় শুধু যাত্রাপথের বিবরণই থাকে না, আসে প্রভু মন্ডলের জীবন, যৌনতা, নকলি ওষুধ কোম্পানীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ, প্রতিবাদ। এমনকি ব্যক্তি নির্যাতন, সমাজকে মরনের দিকে ঠেলে দেয়ার মতো লোভ, মোক্ষর নামে ভন্ড অসাধু ও ধর্মীয় মানুষদের নিপাত কামনা ও বিদ্রোহ এ গল্পের পরিচ্ছদে ফিরে ফিরে আসে। নকলি ওষুধ বানিয়ে যারা লক্ষ লক্ষ টাকা কামায় তাদের বিরুদ্ধে এক ফার্মাসিস্টের লড়াই এ গল্পের মূল উপজীব্য হলেও, সুবল দত্তের লেখনী, কল্পনা , বর্ণনাতে এ লেখা একটা সামাজিক বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। আমার বিচারে, অতুলনীয় এ গল্পের বিন্যাস।

গল্পের প্লট

গল্পের নাম – ‘সীতাহার’। ঘুপসি অন্ধকার ঘর। সেখানে থাকে অন্ধ কানামতি। এই অন্ধকার কামরায় যুবতী কাজের মেয়ে, বিলাতিকে আমরা দেখি। সে কাপড় খুলে নগ্ন হয়ে লড়াই করছে কানা মতিকামারটার সঙ্গে। সে লড়াই কোন যৌন আক্রমণ বা প্রতিরোধের না। কাজের মেয়েটা সোনার সীতাহার চুরি করেছে, এরপর আরো কিছু হাত সাফাই করার জন্যে মেয়েটা আলমারির চাবির দখল নিতে চায়। কানামতি তা বুঝতে পারে। তাই ঘরের মধ্যে ডান্ডাডান্ডি। একদিকে শক্ত সমর্থ বয়স্ক একটা কানা লোক, অন্য দিকে অল্প বয়েসী একটা মেয়ে। অনেক সময় ধরে এই লড়াইএর পর আঘাতে বিলাতি মারা যায়। গল্পের পরিণতিতে জানা যায় ওই সোনার সীতাহারটা বিলাতির বিয়ের জন্যেই সংরক্ষিত ছিলো। গল্পের শেষে থাকে ছোটগল্পের চমক। একটা আবদ্ধ ঘরে নগ্ন যুবতীর সঙ্গে বয়স্ক কানা লোকটার এই লড়াইএর প্লট ও গল্পের আঙ্গিকটা আমাদের চমকে দেয়!

গল্পের কল্পবিজ্ঞান

কখনো কখনো কল্পবিজ্ঞানের জগতে ঢুকে পরে সুবল দত্তের গল্প। যেমন গল্পে এসেছে একটা বিশাল ক্রিস্টাল পাথর, যাতে বিশেষ কিছু ধাতব পদার্থ, যার গুণে খাড়া পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত ওই বিশালাকায় ক্রিস্টাল পাথরটা ব্রহ্মান্ডের অন্য গ্রহগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখার ক্ষমতা রাখে। ওই ক্রিস্টাল পাথরটা টেলিট্রান্সপোর্টেশনের মাধ্যম। কোন লোক তিহার জেলে আটকে আছে, কিন্তু এই টেলিট্রান্সপোর্টেশনের মাধ্যমে তার ত্রিমাত্রিক শরীর ওই পাথরটির উপর হাজির হয়ে আছে [ গল্প - মোতি লাকড়া]। বিজ্ঞানে এমন হয়েছে কিনা জানি না, গল্পকার এখানে অতি আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক কাহিনী ফেঁদেছে। তাতে আমাদেরই পরিচিত মানুষজন, সামাজিক আচার সংস্কৃতি। কেন্দ্রে কল্পবিজ্ঞানের একটা ক্রিস্টাল পাথর – এমনি ভাবেই টান টান সাসপেন্স রেখে আমরা গল্পটাকে উপভোগ করি।
ভূমিকায় উল্লিখিত ‘সময়-শোধন’ গল্পে নানা শব্দ মিলে যে অনুনাদ বা রেসোনেন্স তৈরী হয়, তাতে যে সব অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটে যায়, তাতেও কল্পবিজ্ঞানের ছায়া থাকে।
 
গল্পের প্রতীক ধর্ম –

সুবল দত্তের গল্পের প্রতীকের ব্যবহার আছে। মানব সংষ্কার, মানবিক আন্দোলন, বই লেখা সৃস্টিশীলতা – এগুলো কি ব্যর্থ সময়যাপন? একজন মানুষ কিংবা লেখকের মৃত্যু ? একটা কালভার্টের নীচে নালি, সেখানে থকথকে কালো পাঁকে পরে আছে একটা অর্ধপ্রোথিত লাশ – লোকটার হাতে ধরা একটা বই , কিংবা খাতা, ধরা যাক ওটা ডায়েরী। গল্পের মধ্যে দেখি লেখা মন্তব্যটা – ‘সংস্কৃতির দেহ নব্বই অংশ পাঁকে ডুবে আছে’ ! ওই ডায়েরীর মধ্যে ধরা আছে বর্তমানের কবিদের শ্রেষ্ঠ চিন্তা ভাবনা, ওরই মধ্যে আছে মৃতবৎ সংস্কৃতির পুনর্জীবনের দিশা। কেউ কি এগিয়ে আসবে এইসব শ্রেষ্ঠ চিন্তা ভাবনা ও সংস্কৃতিকে উদ্ধার করতে? পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মহীন নামে এক কবি ঝাপিয়ে পড়লো নালায়, পাকের মধ্যে। গল্পের শেষে মহীন সেই ডায়েরী উদ্ধার করতে সক্ষম হলো। এমনি ভাবেই প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে সংস্কৃতি সম্পর্কে হতাশ মানুষকে সজাগ ও উজ্জীবিত করার গল্প ‘একটি অপ্রকাশিত কাব্য-সংকলনের উদ্ধারের কাহিনী’ আমাদের চমকিত করে।
 
চরম বাস্তবতার গল্প

‘বিকলাঙ্গদের কথা’ প্রান্তিক জীবনের চরম বাস্তবতার কথা বলে। প্রথম সন্তান বিকলাঙ্গ, সেইই ওই পবিবারের একমাত্র পুঁজি। বিকলাঙ্গদের খাতায় অসুস্থ ছেলেটার নাম, তা দেখিয়ে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মাসে মাসে টাকা আসে। রোগগ্রস্থ ছেলেটা যখন অসময়ে মারা যায়, তখন ওর বাপ ফর্মে মৃত ছেলের টিপছাপ নিয়ে পৌছে যায় ব্যাঙ্কে। অন্তিম কিস্তির টাকাটা যাতে মার না যায়। শোকগ্রস্থ, শ্মশানযাত্রী ভুকলের ক্ষেত্রে এটাই আসল বাস্তব। সেইদিনই বিকলাঙ্গ ছেলেটির আসন্ন প্রসবা মা, ভুকলর বউ, শ্মশানের কাছে ঝোপের আড়ালে একটি সুন্দর ছেলের জন্ম দেয়। ভুকল সবার অজান্তেই, নিজের নবজাত শিশু পুত্রটির একটা পা দুমড়ে মুচড়ে দেয় – যাতে বড় হয়ে এই সন্তানটিও বিকলাঙ্গ হয়েই বেঁচে থাকে। যাতে ভবিষ্যতেও বিকলাঙ্গ খাতায় এই ছেলেটার নাম দেখিয়ে মাসে মাসে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা পাওয়া যায়। এই গল্পের অন্য একটা ডায়মেনশনও আছে। পেটের দায়ে ভুকলর বউ অন্য পুরুষের সঙ্গে শোয়, ভুকল জানে না সদ্যজাত সন্তানটি তার বীর্যের প্রকৃত উত্তরসুরী কিনা? – নাকি তারই বউএর গর্ভে জমিদার ছোট শর্মার সন্তান! এই টানা পোড়েন, এই বাস্তব পরিস্থিতির আলোকপাতে আলোচ্য গল্পটা এসময়ের একটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প হয়ে ওঠে।

গল্পে কাল্পনিকতা

সুবল দত্তের ‘বিস্ফোরক’ গল্পে দেখি একটা লোক পালঙ শাকের থলে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সেই ব্যাগের মধ্যে ভরা আছে দুটো জীবন্ত বোমা; যেগুলো যে কোন মুহূর্তেই ফেটে পড়তে পারে! সেই বোমা দুটো ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে! তাদের আলোচনার বিষয় সমাজ, ধর্ম, ইলেকশন, এমনকি মার্কসের তত্বও! ওই লোকটি নিমিত্তমাত্র, বোমাদুটোই সিদ্ধান্ত নেবে কখন তারা ফেটে পড়বে। ওই বোমাদুটোর মধ্যে রয়েছে যাবতীয় মানবিক গুনাগুন। গল্পের মধ্যে বোমাকে দিয়ে কথা বলানো, লেখকের এই কাল্পনিকতায় আমরা চমকে যাই!
আরেকটা গল্প ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’- এতে বাংলাভাষা প্রেমী এক লেখক হাসপাতালের নির্জন কক্ষে শুয়ে আছে। লোকটা নাম সুবল দত্ত, লেখক নিজেই। বাংলা ভাষা চর্চার ভবিষ্যত নিয়ে লোকটা চিন্তিত। অতি আধুনিক চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে সময় এগোতেই লোকটা তার কল্পনায় আবিস্কার করে তার বেডের চারপাশে আরো অনেক কবি লেখক সাহিত্যিকদের মুখ। কে নেই সেখানে। অশোক মিত্র, বারীন ঘোষাল, কাজল সেন, সমীর রায়চৌধুরী, অজিত রায় – এমন কি স্বয়ং মহাশ্বেতা দেবীও তার বিছানার চার পাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে। তাদের সবার মুখে এক একটা করে বেলুন ফুলে উঠতে থাকে – সেইসব বেলুনগুলো থেকে বেরিয়ে আসে অজস্র অক্ষর – উঠে আসে বাংলা ভাষার জয়গান। সুবল দত্ত গল্পে এমনই এক কাল্পনিক আবহ তৈরী হয়, কল্পনার কলমে সে লিখে ফেলে বাংলাভাষাকে উজ্জীবন করার আরোগ্যকথা।

গল্পের পরাবাস্তবতা ও যাদুবাস্তবতা

আধুনিক গল্পের বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরাবাস্তবতা ও ম্যাজিক রিয়েলিজম। পরাবাস্তব ও যাদুবাস্তব উভয়ক্ষেত্রেই যাদু ও বাস্তবতার মিশেল থাকে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোস-এর লেখায় এর প্রচুর উদাহরণ আছে। এবার আসা যাক সুবল দত্তের লেখায়।
তার ‘অন্তর্জলি’ গল্পের একটা দৃশ্য – ‘মনে হলো পুরো পুকুরটাই মস্তবড়ো আগুনের গোলা। …… ততক্ষণে জলে প্রচুর লোক নেমে গেছে। …… নাভিজলে দাঁড়িয়ে থাকা ওদের সবার প্রচন্ড প্রদাহ। নানা রকমের কষ্ট ও দৈন্যতাগুলি ভিন্ন ভিন্ন রঙের অগ্নিশিখা হয়ে তাদের সারা শরীর পোড়াচ্ছে …… ।’ এই বর্ণনাটা পুকুরের মধ্যে খাটে বসানো এক মৃতমুখী মহিলা ও তার ধর্ষক লোকটার অন্তর্জলি ক্রিয়াকর্মের দৃশ্য। এখানে হিংসা, ক্রোধ, ভয়, উৎকন্ঠা নিয়ে জড়ো হয়েছে জনতারা – সারা পুকুরটাই যেন মস্তবড়ো আগুনের গোলা হয়ে গেছে। আমরা দেখি পরাবাস্তবতার সফল প্রয়োগ।
‘অমূর্ত’ গল্পের দৃশ্যে দেখি যাদুবাস্তবতার ছোঁয়া! এখানে শিল্পীর ছবি আঁকার ব্রাশ স্থির, অথচ ক্যানভাস উঠছে, নামছে, সরছে। কোন এক অমূর্ত অদৃশ্য শক্তির চালনাতেই নির্মিত হচ্ছে শিল্প, আঁকা হয়ে যাচ্ছে ছবি, চিত্রমালা। দর্শক নিখিলেশ কিংবা ছবি আঁকে যে ছোট্ট ছেলেটা তারা অনড়, স্থির। গল্পকার এখানে যে বার্তা দিতে চান, তা হলো শিল্পের ক্ষেত্রে এই অদৃশ্য সত্ত্বাটাই মুখ্য – সে কখন যে কাকে দিয়ে কি আঁকিয়ে নেবে তা কেউ জানে না!
 
গল্পের মধ্যে কাব্যকথা

বিপত্নীক বাবা চোখের জল মুছতে মুছতে স্বামীর ঘরে গোলাপিকে পাঠিয়েছে। তার জীবন দুর্বিষহ! নির্জন জলাশয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপি। সে দেখছে, চারাপোনা ব্যাঙাচির ঝাঁক ভারি জলের ভিতর থেকে একটুকরো রুপালি আলো টেনে তুলছে। এই গল্পে একটাই চরিত্র, একজন যুবতীর জলের চোরাপাকে ডুবে আত্মহত্যা করার গল্প। চারপাতার এই গল্প ‘সলিল সমাধি’। এই আলোচ্য গল্পটির কাব্যরূপ আমাদের মনে চিরন্তন হয়ে থাকবে। গদ্যের মধ্যে এমন কাব্যিক আবহ সুবল দত্তের কলমে অনায়াসেই চলে আসে। এটাই তার লেখার গুন!

গল্পের অসাধারণ কিছু টুকরো দৃশ্য

অদ্ভুত অদ্ভুত সব দৃশ্য কল্পনা সুবল দত্তের গল্পে হামেশাই উঠে আসে। গল্পকারের ছোট ছোট এক একটা লাইন বা কয়েকটা লাইনের বর্ণনা আমাদের চমকে দেয়! কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক,মোতি লাকড়া লোকটা ‘ লিঙ্গতে দড়ি বেঁধে মাল বোঝাই টেম্পো টেনেছে’। [গল্প - মোতি লাকড়া]
‘মরার হাতের টিপছাপ নিয়ে ভুকল টাকা তুলতে এসেছে’। বিকলাঙ্গ মৃত ছেলের টিপছাপ নিয়ে সত্যি কেউ কখনো ব্যাঙ্কের থেকে টাকা তোলার কথা কল্পনা করেছে কি?[ গল্প – বিকলাঙ্গদের কথা]
সিঙ্কু নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণ করার শাস্তি দিচ্ছে, অকল্পনীয় পদ্ধতিতে দেয়া হচ্ছে ধর্ষককে শাস্তি, তার বর্ণনা ‘সিঙ্কু মনোযোগ সহকারে ছুড়ি দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলেছিল। লোকটা …… জেগে রয়েছে কি অজ্ঞান বোঝা যায় না। একটু দূরে উইঢিবি ভেঙে ফেলে সেই ঢিবি তার পেটে চাপিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে অজস্র উইপোকা বেরিয়ে তার উন্মুক্ত প্রস্রাবনালীর ভিতর দিয়ে ধুকতে লাগল।’ [গল্প – অন্তর্জলি ]
গুরুদেবের নির্দেশে নিজের মৃতপ্রায় স্ত্রী ও ধর্ষক লোকটার অন্তর্জলি ক্রিয়াকর্মের আয়োজন যেভাবে সিঙ্কু যে ভাবে করছে, তা আমার ভাষায় এরকম। - একটা খাট পুকুরের জলে পাতা হয়েছে। পায়াগুলো জলে কিছুটা ডুবে রয়েছে। সিঙ্কুর স্ত্রী ও ধর্ষক লোকটাকে সেই খাটে রাখা হলো। মৃতপ্রায় দুটো মানুষ , একজন অপরাধী , অন্যজন নিরপরাধ - তারা খাটে বসে আছে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে। ওরা তখন পারলৌকিক শান্তিকামী। এমন অন্তর্জলি যাত্রার বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে আরো আছে কিনা, আমি জানি না। [গল্প – অন্তর্জলি ]
গল্পের শুরুটা এমনি ‘ উঠোনের বাইরে পুটুসের বেড়া। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সেখানে পেচ্ছাপ করতে গিয়ে একটা হলদে তীর পেচ্ছাপের উল্টো স্রোত বেয়ে সমীরণের তল পেটে বিঁধল’। [ গল্প – শূন্যতাবোধ]
ইত্যাদি।
সুবল দত্তের গল্পে অনায়াসেই ঢুকে থাকে জীবনের গূঢ় তত্ব, অদ্ভুত দার্শনিকতা। দিগন্ত প্রসারী তার কল্পনাশক্তি। তার লেখার বিন্যাস ও আঙ্গিক অসাধারণ। তার গল্পের প্লটগুলোও অসামান্য। আমরা দেখেছি গল্পের মধ্য দিয়ে সে পাঠকদের নিয়ে যায় অপরিচিত কোনো কল্পবিজ্ঞানের জগতে। আবার কখনো কখনো তার গল্প হয়ে ওঠে কবিতা। গল্পের মধ্য দিয়ে সে পাঠককে আটকে রাখে অসীম কল্পনার দিগন্তহীন জগতে। আদিবাসী প্রত্যন্ত সমাজ সংস্কৃতি ও সাম্প্রতিক সভ্যসমাজ – এ দুটোই তার পরিচিত বিষয়, তাই তার লেখা বৈচিত্রময়। এই লেখকই কখনো চরম বাস্তবতাবাদী, - তারই কলমে বেরিয়ে আসে ‘বিকলাঙ্গদের কথা’, প্রান্তিক জীবনের চরম বাস্তবতার ইতিহাস। আমরা দেখেছি তার গল্পে পরাবাস্তবতা ও ম্যাজিক রিয়েলিজমের সফল প্রয়োগ।
সব কিছু মিলিয়েই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সুবল দত্ত তার গল্পে বহুমাত্রিকতার সফল স্বাক্ষর বহন করেছেন এবং এসময়ের তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার। তার লেখার স্টাইল এ সময়ের বাংলা সাহিত্যে বিরল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, সম্প্রতি মার্চ – ২০২০তে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মঞ্চে সুবল দত্তকে প্রদান করা হয় ‘একমাত্র সাহিত্য সম্মান-২০১৮’। আমি আশা করবো বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যে এই বিশিষ্ট গল্পকারের গল্প আরো বেশী বেশী পঠিত হোক এবং আলোচিত হোক। তিনি শারীরিক দিক থেকে সুস্থ থাকুন। আমি চাই তার গল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার। ভবিষ্যতেও তিনি সক্রিয় থাকুন। আমাদের দাবী, সুবল দত্ত এমনি আরো অনেক অনেক ভালো ভালো গল্প আমাদের উপহার দিন।



[প্রবন্ধটি ধানবাদের একটা কাগজে ২০২০ সালে প্রকাশিত]
0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in





কে কোথায় কতবার গেছেন বা কত দিন থেকেছেন, তার ওপর পারিপার্শ্বিকতা ও সেই মানুষের জীবন যাত্রার যাপনের কথাবার্তা নির্ভর করে না।বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো দিন আফ্রিকাতে যান নি, কিন্তু তিনি চাঁদের পাহাড়ের মতো অসামান্য একটি লেখা লিখেছেন যা শুধু বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম সম্পদ।

থাক সেসব প্রসঙ্গ।রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন।ত্রিপুরার মহারাজাদের হৃদ্যতা, হৃদয়ের শব্দ, আন্তরিক আহ্বান কবিকে মুগ্ধ করেছিল এবং কবি কোথায় যেন ত্রিপুরার সঙ্গে এক অদৃশ্য ডোরে বাঁধা পড়েছিলেন, না হলে সেই সময় পরাধীন ভারতবর্ষে যখন অখণ্ড ভারতের ত্রিপুরার সঙ্গে অখণ্ড বঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই

ভালো নয়, তার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ বারেবারে ঘুরে ঘুরে এসেছেন ত্রিপুরায় এবং এখানকার রাজাদের আনুকূল্যে তিনি বসবাস করেছেন এখানে।এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, বইপত্র আছে। সেসব আমরা জানি। ফলে নতুন করে এই ব্যাপারটা নিয়ে বলার কিছু নেই।বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাতবার ত্রিপুরায় আসার কথা বলেছি।

কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন এই যে তিনি সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন তাতে ত্রিপুরার কী এল,কী গেল? তাতে ত্রিপুরার মানুষ, ত্রিপুরার ভূপ্রকৃতি, ত্রিপুরার যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, যা অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বর্ধিষ্ণু তার কী এল গেল?

এখন কথা হল যে একজন কবি যিনি আন্তর্জাতিক মাপের এবং একই জাতীয়ও। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক না হলে জাতীয় হওয়া যায় না।অনেক লেখকই আন্তর্জাতিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে আন্তর্জাতিক বোধ ও চিন্তা তা বারবার প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর লেখার মধ্যে,বিশেষ করে প্রবন্ধের মধ্যে তিনি নিজের আন্তরিক চেতনা ও চৈতন্য তুলে ধরেছেন।যেকথা বলছিলাম, রবীন্দ্রনাথের বার বার ত্রিপুরায় আসার কারণ ত্রিপুরার মানুষের অসম্ভব আতিথ্য এবং অতি যত্ন আত্তি তিনি পেয়েছেন।কিন্তু তাঁর কথা সাধারণ মানুষের কী কাজে লেগেছে? এখন আমাদের কথা হলো একজন বড় লেখক, কবি, সাহিত্যিক একেবারেই নির্দিষ্ট কারওর নন, আবার নিজেরও নন।তাঁর নিজস্ব গতি এবং চলন তাঁর জীবনের সূত্র ধরে তাঁকে অন্য পথে নিয়ে যায়।এবং তিনি সেই পথে চলতে থাকেন এবং চলতে চলতে দুপাশে কখনও পাহাড়ি গোলাপ, কখনওবা বন্য সৌন্দর্য, কখনও কেয়ারী করা মনোরম বাগান।কখনও বা অতি দীর্ঘ বাগিচা দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তার সুগন্ধে তিনি মুগ্ধ হন এবং তাঁর স্বভাব কৌতূহলে, স্বভাব সৌন্দর্য মুগ্ধতায় তিনি ঢুকে পড়েন সেই বাগানের মধ্যে,সেখানে থাকে অনেক আনন্দ,অনেক মায়া, কায়া, জীবন যাপনের গান।রবীন্দ্রনাথ সেই গানে অবগাহন করেছেন এবং নিজে নিজে সেই সঙ্গীতের যে সুর ও মূর্ছনা তাকে আত্মীকরণ করেছেন এবং তাকে ধরেই অনেকটা পথ অতিক্রম করেছেন।আবার নতুন বাঁকে তিনি ঘুরে গেছেন এবং ঘুরে গেছেন বলেই তাঁর সাহিত্য এবং সৃষ্টি, ছবি আঁকা এবং অন্যান্য কাজ শান্তিনিকেতন তৈরি করা, শ্রীনিকেতন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে কতখানি প্রাসঙ্গিক? এর উত্তর দিতে গেলে এক সমুদ্র জিজ্ঞাসা এবং এক হিমালয় উত্তর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। এর উত্তর খুব সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিঃশ্বাসেই জড়িয়ে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রশ্বাসে জড়িয়ে আছেন।যেমন একজন ভক্ত,আস্তিক মানুষ যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাঁর যে ইষ্ট মন্ত্র, তাঁর যে জপা এবং অজপা মন্ত্রযান,তা যেমন তাঁকে নিয়ে যেতে থাকে কোনো এক অপার্থিব সুরলোকে, তেমনি একইভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মী তিনি মার্কসবাদী বিশ্বাসী হতে পারেন,তিনি গান্ধীবাদী বিশ্বাসী হতে পারেন কিংবা অন্য যেকোনো দর্শনে বিশ্বাস রাখতে পারেন এবং সেই দর্শনের যে মূল কথা সেই দর্শনের যে মূল বাণী, সেই দর্শনের যে সমাজ বিপ্লব অথবা অহিংসার পথে এগিয়ে যাওয়ার যে কথাবার্তা, তাকে তিনি আত্মীকরণের মাধ্যমে নিজের মধ্যে নিয়ে আসেন এবং একজন প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মী এবং সংগঠক তাঁর কাজ করে যান সারাজীবন। কখনও বিপ্লবের স্বার্থে, কখনও অহিংসার স্বার্থে, কখনও গ্রাম পুনর্গঠনের স্বার্থে,কখনও আরও কোনো দার্শনিক স্বার্থে।রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে এমনই এক দর্শন কাব্য, তাঁর লেখা পড়লে পরে যে দার্শনিক অভিঘাত, যে দার্শনিক ব্যঞ্জনা, যে দার্শনিক জিজ্ঞাসা আমাদের সামনে ফুটে ওঠে বারবার তাঁর নাটকে,তাঁর প্রবন্ধে, তাঁর ছোট গল্পে, তাঁর উপন্যাসে,তাঁর গানে। তিনি সর্বত্রগামী। সব কিছু লিখেছেন ,এবং অসম্ভব পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। আমরা জানি বা পড়েছি বহু নবজাতক বা নবজাতিকার নামকরণ তিনি করেছেন। তিনি পরাধীন দেশে গ্রাম উন্নয়নের জন্যে শান্তিনিকেতন এবং শ্রীনিকেতন তৈরি করেছিলেন। শান্তিনিকেতনকে করেছেন আন্তর্জাতিক বিদ্যাচর্চা এবং সারস্বত চর্চার অন্যতম জায়গা।পাশাপাশি শ্রীনিকেতন হয়ে উঠেছে আমাদের গ্রামীণ শিল্পকলা এবং শিল্পকর্মের যে প্রতিভূ তাকে স্পষ্ট করার জন্য কোনো এক সংগঠন।সম্পূর্ণ স্বদেশী চিন্তায়, স্বদেশী ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ এই পথে এগিয়েছেন, আবার পাশাপাশি পাশ্চাত্যের আলো, পাশ্চাত্যের জ্ঞান ও বোধ,চীন, জাপানের যে দার্শনিক চিন্তা, ইরাণও পারস্যের যে বিবিধ শিল্প সৌকর্য, ইউরোপের কারিগরি প্রভাব ইত্যাদি প্রভৃতি তিনি ভারতে প্রয়োগ করেছেন।পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনি বাগিচা চর্চা বিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন বিদেশে।এমন নানা কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, যে কীকরে মানুষ ভোর চারটের সময় উঠে রাত্রি বারোটা একটা পর্যন্ত কাজ করতেন।বিনিদ্র চোখে তিনি জেগে থাকেন সাধারণ মানুষের জন্য,গ্রাম উন্নয়নের জন্য,গ্রাম পুনর্গঠনের জন্য,তিনি জেগে আছেন মানুষের কল্যাণের জন্য জন্য,মানুষের আত্মমর্যাদার জন্য।সেখানে কোনো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই,সেখানে কোনো রাজনৈতিক কাঠামো নেই,রাজনৈতিক বন্ধন নেই। রবীন্দ্রনাথ স্বভাবত স্বতন্ত্র মানুষ। তার বন্ধন যা আছে তা দেশের বন্ধন। সে মানব বন্ধন। রবীন্দ্রনাথ একজন মুক্ত স্বাধীন মানুষ হিসাবে বারবার বারবার দাঁড়িয়েছেন মানুষের পক্ষে।

তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের হিজলি জেলে গুলি চালনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা হিজলি জেলে বিপ্লবীদের হত্যা করেছিল।জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি পথে নেমেছেন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। তখন তিনি প্রচুর গান লিখেছেন ১৯০৫ সালে,গান গেয়েছেন,নিজে পথে নেমে সকল মানুষকে একসঙ্গে সংগঠিত করেছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন।ব্রিটিশদের অত্যাচারে, দেশবাসীর যন্ত্রণায়, দেশবাসীর যাতনায়, দেশবাসীর রক্তক্ষরণে, নিহত দেশবাসীর মৃত মুখ তাঁকে বারবার আঘাত করেছে।তিনি পরদিন নাইটহুড পরিত্যাগ করেন জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর।

আমরা জানি ছবি আঁকা একটা বিরাট পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে তা করে গেছেন ষাটোর্ধ বয়সে। মনে রাখতে হবে তাকে ইদানীং তথাকথিত 'অতি বিজ্ঞ' গবেষক প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে রবীন্দ্রনাথ আসলে 'রঙকানা' বা 'কালারব্লাইণ্ড।' কিন্তু একজন মানুষ যদি 'রঙ কানাই' হয় তাহলে তিনি কীভাবে এই সংস্থাপন আলো-ছায়ায়,কালো-সাদায়, রঙে নির্মাণ করলেন আমাদের সামনে। আমরা জানি তার সেই চুম্বন নামের বিখ্যাত ছবিটির কথা।যেখানে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে চুম্বনের আভাসে রয়েছেন এমন কথা ইতিহাস বলে। বিচিত্রগামী লেখক তিনি।তিনি দেবতার গ্রাসের মতো কবিতা লিখছেন।লিখছেন দুই বিঘা জমির মতো কবিতা,আবার লেখেন তোমার শঙখ ধুলায় পড়ে আছে নিয়ে তিনি লিখছেন এমন কোনো লাইন। তিনি লিখছেন 'জানি মোর কবিতা হয় নাই হয় নাই সর্বত্রগামী।'এই যে আফসোস, এই যে হাহাকার, তা একজন সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষেই সম্ভব। ঐকতান পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ এই কথা লিখেছিলেন।

আমরা কি মনে রেখেছি রবীন্দ্রনাথকে? প্রাত্যহিকতায় ত্রিপুরার মানুষ, পশ্চিম বাংলার মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ, যারা বাংলা ভাষায় অন্তত কথা বলেন,লেখেন, তারা কি মনে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথকে? না কী শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণের মলাট লিখন এক ধারাবাহিক পূজা পদ্ধতি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখে গেছেন 'তোমায় পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।'কিংবা 'তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলে যে যাই'।এই যে নিজেকে দেখতে পাওয়া, নিজেকে নিজের আয়নায় আবিষ্কার করা, তা একজন বড় মাপের দার্শনিকের পক্ষেই সম্ভব।

আমরাও তো তাঁকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়েছি কী? আজকে যখন সমস্ত পৃথিবী দীর্ণ হিংসায় জর্জরিত। 'যখন নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস' এই লাইন কী অমোঘ হয়ে আসে না? কিংবা যখন তিনি বলেন 'আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনিই লীলার তব- এই যে তুমি এবং আমি।এটা কী?

আমাদের অনুভূতিতে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়, পূজা পর্যায়,স্বদেশ পর্যায় বলে আলাদা কিছু হয় না।'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে' বনে এটা কী প্রেমের গান না প্রত্যাখ্যানের গান? কিংবা এইটা নি বিরহের গান না কী প্রাত্যহিক যন্ত্রণার গান, মিলনার্তির গান? যে যন্ত্রণা নিয়ে আমরা সকালবেলা উঠি মেঘার্ত আকাশ থাকলে আকাশকে মনে হয় মেঘ মলিন কোনো ছাদের কার্নিশ। সেই রকম এক মনন নিয়ে যখন আমরা রবীন্দ্রনাথের গানে প্রবেশ করতে থাকি, যখন আমরা তাঁর ছবিতে প্রবেশ করতে থাকি, যখন আমরা তার নাটকে প্রবেশ করতে থাকি, তখন মনে হয় জীবন কী আসলে এরকম? কিংবা জীবন কী আসলে এরকমই? জীবন কি আসলে এরকমই হওয়ার কথা ছিল? বা হওয়ার কথা ছিল না?

রক্তকরবী নাটকে রঞ্জন, নন্দিনী, বিশু পাগল, অধ্যপক, রক্তকরবীর মালা নন্দিনীর গলায়, তা কি কোনো স্বপ্নিল উচ্চারণ না কী কোনো প্রেমার্তি? না কী তা আসলে বিদ্রোহের সামগ্রিক শোষণ, সামগ্রিক সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের একক জেগে থাকা।রাজা অথবা রক্তকরবী অথবা মুক্তধারা আমাদের বারে বারে জীবন ও বিবিধ বিষয় নিয়ে সতর্ক করে দেয়, যা আজও আধুনিক প্রাসঙ্গিক।

ফলে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমরা কিছুই ভাবতে পারি না।আমরা বাতাস দেখতে পাই না,কিন্তু অনুভব করতে পারি, বাতাস আছে।যখন বুকে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, তখন আমরা বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করি।ঠিক তেমনি আমাদের জীবনে যখনই দুঃখ কষ্ট অনুভব করি, নানাভাবে পর্যুদস্ত হই,তখনই আমরা রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হই।রবীন্দ্রনাথ আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।

আমরা যখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে পড়ি তখন আমরা সাংস্কৃতিকভাবে সাংস্কৃতিক চেতনা ও চৈতন্যে রাজনৈতিক চেতনা ও ভাবনায় ভয়ানক যাতনায় পরি,তখন একেবারে অন্তিম দশা যেন উপস্থিত হয় আমাদের সামনে, তখন রবীন্দ্রনাথ প্রায় 'সর্বরোগহর' মালিশ এবং ওষুধ হিসাবে আমাদের সামনে আসেন।আমাদের বিশ্বাস সভ্যতা যতদিন থাকবে, যতদিন মানুষ কথা বলবে,যতদিন মানুষ প্রতিবাদ করবে,গান করবে,যতদিন মানুষ সজাগ থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন, জেগে থাকবেন,আমাদের হৃদস্পন্দন হয়ে। জীবন ও আধ্যাত্মিকতা, জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা, জীবন ও প্রকৃতি চেতনা সব মিলিয়ে এক অন্যন্য সাধারণ ব্যাক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথকে আমাদের প্রণাম।আমাদের জীবনের ভালোবাসা, বিরহ, বেদনা, বিচ্ছেদ,সুখ,আনন্দ,দুঃখ, সব কিছুইতেই রবীন্দ্রনাথ।

আমাদের স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই,রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছেন।তিনি এসেছেন বলে ত্রিপুরার মানুষ যেমন তাঁকে ভালোবেসে খুশি হয়েছেন তেমনি নিজেদের সমৃদ্ধও করেছেন।ত্রিপুরার মানুষ এমনিই অসম্ভব আথিত্য পরায়ণ তাঁরা। তাঁরা জানেন মানুষকে ভালোবাসতে,মানুষকে আপন করে নিতে।মানুষকে বুকের কাছে,বুকের মধ্যে টেনে নিতে। তাঁরা স্বার্থপর নন।তারা স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠে অনেক কথা,অনেক উচ্চারণ করতে পারেন,যা অনেকেই পারেন না।সে ত্রিপুরার রাজা বা প্রজা যেই হোন না কেন।আমরা কাউকে ছোট করছি না।কিন্তু ত্রিপুরার মানুষের এই আতিথ্য বোধটুকু অসামান্য, অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ তাতে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

চির ভালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ।তিনি ত্রিপুরার মানুষের এই ভালোবাসাটুকু টের পেয়েছেন।এবং পেয়েছিলেন বলেই ত্রিপুরার আকাশে,বাতাসে রবীন্দ্রনাথের কাছে ত্রিপুরার মানুষের কন্ঠস্বর রবীন্দ্রনাথের রচনায়,রবীন্দ্রনাথের লেখায়, রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনায়, রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে বার বার উঠে এসেছে।ফলে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় সাতবার এসেছিলেন বলে ত্রিপুরা ধন্য।আবার প্রকারান্তরে বলতে হয় রবীন্দ্রনাথও খানিকটা ধন্য হয়েছেন এই ত্রিপুরার মাটিকে স্পর্শ করে।ত্রিপুরার মানুষের প্রেম ও ভালোবাসা প্রীতি পেয়ে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন ত্রিপুরার মানুষ তাঁকে ভালোবাসে, এবং তিনিও ত্রিপুরার মানুষ, প্রকৃতি, আকাশ বাতাসের মতো রাজাদেরও ভালোবাসতেন।রবীন্দ্রনাথ এসে ত্রিপুরাকে ধন্য করেন নি।করা সম্ভব নয় কিন্তু আমাদের কারও কারও জীর্ণ পর্ণ কুটিরের সামনে দিয়ে যদি একদিন কোনো এক প্রবহমান স্বর্ণালী স্রোত বয়ে যায়, যে স্রোতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবন চর্যার আশ্চর্য মোহময়তা। তাকে দেখে কী আমরা মুগ্ধ হব না? অথবা আমরা যারা দেখতে পাই নি তাঁকে, তাঁরাও কি বালির মধ্যে খুঁজে বেড়াই না? তাঁর মুছে যাওয়া পায়ের ধ্বনি। সেই স্বর্ণময় স্রোতের অস্তিত্ব মুখে মুখে কি গল্প-কাহিনি ছড়ায় না? তিনি এসেছিলেন।তিনি এসেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- 'এসেছিলে তবু আসো নাই জানায়ে গেলে।'এই যে জানায়ে যাওয়ার কথা সেকথাই হয়তো ফুটে থাকে আমাদের মনের ঘরে। আমাদের চিন্তায়, চৈতন্যে, সাংস্কৃতিক ফসলে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সারাক্ষণ জড়িয়ে থাকেন।সকাল বেলা আমরা যারা সাহিত্য,সংস্কৃতি ও মনন চর্চা করি তাদের কথা বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের অনেক লাইন মানুষকে ভরসা দেয়। সকাল বেলা থেকেই মানুষকে মনুষ্যত্ব জাগরণের যে অভিশ্রুতি তা রবীন্দ্রনাথই দিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের যে গান, সে গানের লাইন সকাল থেকে গড়াতে গড়াতে দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা থেকে রাত্রির দিকে চলে যায় নক্ষত্র স্নান সারতে থাকে, আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক চেতনায় উপস্থিতির জন্য দুঃখে,সুখে আনন্দে, বিরহে,বেদনায় প্রেমার্তিতে, অসফলতায়, সাফল্যে রবীন্দ্রনাথ যেন বা কোনো মহীরুহ সম।তাঁর সেই লাইন- 'আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনই লীলা তব।' এই যে আমাকে অশেষ করছ মানে কী? আমার জীবনকে, আমার উচ্চারণকে তুমি অশেষ করেছ।চিরজীবী করছ, মানে এই নশ্বর পৃথিবীতে কিছুই চিরজীবী নয়। কিন্তু তবুও তাঁর এই গানের কথা,তাঁর এই ছোট গল্পের লাইন,তাঁর এই ছবির কথা,নাটকের কথা, আমরা যখন কোনও ভাবে না কোনও ভাবে মনে করি, তখন আমাদের মধ্যে একটা অন্য ধরনের উন্মেষ তৈরি হয়।'স্ত্রীর পত্র' পড়তে পড়তে আমরা মৃণালের যে যন্ত্রণা, তা সোচ্চার নারীবাদ না হলেও মৃণাল যেভাবে একজন স্বাধীন নারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং মাখন বড়ালের নাম চিহ্নিত গলিতে আর সে ফিরে যাবে না, এই কথা যখন সে উচ্চারণ করে, তখন আমরা বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠিক কোনখানে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের হৃদয় স্থবিরতায় অথবা 'ছুটি' গল্পে যখন ফটিক এক বাঁও মেলেনা, দুবাঁও মেলেনা তখন আমরা বুঝতে পারি মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করতে করতে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যান 'অতিথি' নামক আখ্যানে তারাপদকে তিনি যাত্রা করেন নতুন কোনও এক অভিযাত্রায়।।ফলে তাঁকে বাদ দিয়ে জীবন উচ্চারণ, নিঃশ্বাস গ্রহণ নিঃশ্বাস পতন সম্ভব নয়।
0

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in






মঙ্গল গ্রহে মানুষের উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনা ইলান মাস্ক এক দশক আগেই করে ফেলেছেন । তার জন্যেই তিনি ইতিহাসের সব চাইতে বড় রকেট স্টারশিপ বানিয়েছেন । তার উৎক্ষেপন দেখিয়ে তিনি বিশ্ববাসীকে তাকও লাগিয়েছেন ।

এবার মূল ভাবনায় এসেছে সেখানকার শাসন ব্যবস্থা ও নানান পরিকল্পনার ব্যাপার। তিনি ভাবছেন গ্রীসের মতন প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক আবহাওয়ার ব্যবস্থা করতে। ওনার ভাবনাতে এটা পরিস্কার যে সেখানকার শাসন ব্যবস্থা পৃথিবী গ্রহের গণতান্ত্রিক দেশ গুলোর মতন হবেনা । কারণ ব্যবস্থাটার গতিপ্রকৃতির নির্ধারক সেইখানকার অর্থনীতি , প্রযুক্তি , নিরাপত্তার উপর ।

তৈরি হবে এক নতুন সামাজিক শ্রেণী, সেটা কেমন হবে সেটাও এক বড় নির্ধারক।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু প্রশ্ন আসে । মনে পড়ে , ইলন মাস্ক কি চাইছেন এক ময়না দ্বীপের মতন জায়গা তৈরি করতে – মানিক বাবুর ‘পদ্মা নদির মাঝির’ আদলে । যেখানে মানিক বাবু যেমন চেয়েছিলেন – তার পছন্দের দ্বীপ , যেখানে থাকবেনা কোনো ধর্ম , শাসনব্যবস্থা আসবে সমাজ তন্ত্রের ছোঁয়ায় ।

ভিতরে ঢুকলে বা উপন্যাসের অন্তরে গেলে দেখা যায় বা বোঝা যায় তার সাধের ময়নাদ্বীপ কেমন হবে । কি তার সম্ভাবনা , কতটা বাস্তব , কতটা গ্রহনযোগ্য ।

এটাও দেখতে হবে, ইলন মাস্ক কি মঙ্গলগ্রহে আদতে ময়নাদ্বীপের মতো কোনো নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছেন বা দেখাতে চাইছেন? তার আগে একবার স্মরণ করা যাক, হোসেন মিয়ার সেই ময়নাদ্বীপ কেমন রাষ্ট্র বা সমাজের ইঙ্গিত দেয়।

মানিক নতুন করে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে এক নতুন সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করতে চান সেখানে—এমনই ইঙ্গিত মেলে। তিনি তখনো পুরোপুরি মার্ক্সবাদী কিনা সেটি নিয়ে হয়তো বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু নতুন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা চেতনায় ও চিত্তে ধারণ করেছিলেন সেটি পরিষ্কার। মূলত সেই স্বপ্নেরই প্রারম্ভিক একটি পরীক্ষা–নিরীক্ষার স্থল সম্ভবত ময়নাদ্বীপ।

আপাতদৃষ্টিতে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে সবকিছুর ঊর্ধ্বে এক নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ার প্রয়াস দেখা যায় ময়নাদ্বীপে। দ্বীপে মসজিদ, মন্দির কোনোটাই বানানো হবে না, সব লৌকিক ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ হবে ময়নাদ্বীপ।

কিন্তু হোসেন মিয়ার কাছে প্রথম অগ্রাধিকার সেখানে মানুষের প্রজনন। দ্রুত সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে দ্বীপকে জনবহুল করে তুলতে চান তিনি। এটা অনেক দিশা দেখায় , মনে হয় দ্বীপের লোক বাড়াতে হবে – স্বাভাবিক – কারণটা মানা যায় অন্যাটা ধর্মের তাড়নায় বংশবৃদ্ধির যে প্রথা তাকে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে কিনা সেটাকেও বুঝে দেখার জায়গাটাকে রাখতে হবে । তবে দুটোই কিন্তু হোসেন মিঞাকে সামনে রেখেই বলা হচ্ছে – কাজেই বিষয়টা খুব যে পরিস্কার বলা সে কথা বলা যায়না।

গণতন্ত্রের কথাও কি বলেছিলেন হোসেন মিয়া? না, কারণ সেখানে হোসেন মিয়া সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তিনিই ঠিক করে দেন সেখানে কার শাসন চলবে। আপাতত শ্রেণিহীন এক সমাজের খোদা হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায় তাঁর প্রতিটি কথায়, তৎপরতায়। কাজেই সেই ই হবে ধর্মের নিয়ন্ত্রক – নিজের ধর্মকে রাখার চেষ্টা থাকতেই পারে । ধর্মহীন সমাজের কথা বোধ হয় ভাবা যাচ্ছে না ।

মাস্ক খাঁটি গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতার অবতার হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। তথাকথিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের (লিবারেল ডেমোক্রেসি) বড় সমালোচক মাস্ক। এই গণতন্ত্র সমাজের একটি বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব তো করেই না, বরং এই ব্যবস্থার উপাদান ও হাতিয়ারগুলো ওই বৃহৎ অংশকে প্রান্তিক করে রাখার আয়োজন করে রেখেছে—এমনই মত ইলন মাস্কের।

এবার মঙ্গলে মানুষের শাসনব্যবস্থা নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার ধারণা দিয়েছেন। এক কথায় সেটিকে গ্রীসের ধাঁচে ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’ বলেই অভিহিত করেছেন।

বলা বাহুল্য সেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পৃথিবী গ্রহের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো হবে না। সেই ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে সেখানকার অর্থনীতি, প্রযুক্তি, নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি সামাজিক শ্রেণি।

মাস্ক যখন জনপ্রিয় মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার (পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখেন এক্স) ৪৪ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেন, তখন বলেছিলেন, তাঁর অধীনে টুইটার হয়ে উঠবে বাক্‌স্বাধীনতা চর্চার প্রধান ক্ষেত্র। মালিকানা নেওয়ার পর অনেক বিতর্কিত অ্যাকাউন্ট যেগুলো ভুল তথ্য, অপতথ্য, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, বর্ণবাদ ও উসকানিমূলক তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো ফেরত আনেন মাস্ক।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীলদের পাশে দাঁড়িয়েছেন ইলন মাস্ক। নব্যরক্ষণশীলদের অবতার ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম আমলে সরাসরি সমর্থন না জানালেও এবার সরাসরি তিনি তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে তহবিল জোগান দিয়েছেন। এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের জন্য মনোনীত হয়েছেন। তাঁর কাজ হবে আমলাতন্ত্র সংকুচিত করে সরকারের অনুন্নয়ন ব্যয় কমানো

এই নব্যরক্ষণশীলদের নিয়ে লিবারেলদের সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, এরা সেই অর্থে রক্ষণশীল নয়, যারা ঐতিহ্যগতভাবে বিদ্যমান ব্যবস্থার রক্ষক হিসেবে তৎপর থাকে। এই নব্যরক্ষণশীলেরা বিদ্যমান ব্যবস্থা ভেঙে ঢেলে সাজাতে চায়। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি ও করপোরেট আঁতাত ভেঙে দেওয়ার কথা বলে। আধুনিককালের দৃষ্টিভঙ্গিকে সামাজিক সংহতি ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর মনে করে। বঞ্চিতদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা কখনো স্পষ্ট হয়নি। তাদের প্রতিশ্রুত ব্যবস্থাটি শুধু তারাই ভালো জানে!

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবতার হোসেন মিয়া যেমন ময়নাদ্বীপে এমন এক ব্যবস্থার কথা বলে সেটিও অস্পষ্ট, শুধুই ইঙ্গিতময়। সেটি এক শ্রেণিহীন সমাজ, যেখানে সবকিছু চলে একক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর শর্তে।

ইলন মাস্ক ও ডোনাল্ড ট্রাম্প নেক্সাস কোন ধরনের ব্যবস্থা চান সেটিও পরিষ্কার নয়। প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প তাঁর অনেক প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এবারও পারবেন এমন সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকেরা।

মাস্ক বলছেন, মঙ্গলেও তিনি গণতন্ত্রই চাইবেন। তবে সেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেমন হবে সেটি তিনি সেখানকার বাসিন্দাদের হাতেই ছেড়ে দিতে চান। কথাটি আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ ও সরল মনে হলেও তিনি যে হোসেন মিয়ার চরিত্রে আবির্ভূত হবেন না সেটি বলা যায় না।

কিন্তু ময়না দ্বীপ তো মার্ক্সবাদী ধারণার সাথে মেলে না। এটা তো এক অর্থে উপনিবেশ। হোসেন মিয়া যার সর্বময় ক্ষমতার মালিক। ময়না দ্বীপকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সমাজব্যবস্থা মনে করতে গেলে তো হোসেন মিয়াকে মার্ক্সবাদী বলতে হয়! যা আদপেই অসম্ভব ও হাস্যকর। বুঝলাম, হোসেন মিয়া হয়ত অনন্ত তালুকদারের মত (এ উপন্যাসের ভূস্বামী) পুরোপুরি শোষক শ্রেণির নন। কিন্তু তিনি তো বুর্জোয়া সমাজেরই একজন প্রতিনিধিত্বকারী, খেটে খাওয়া মানুষদের সাথে যার শ্রেণিগত দূরত্ব অনেকখানি। তার হাতে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আসবে এটা মানিক নিজেও বিশ্বাস করতেন না।

হোসেন মিয়ার অনেক ধূর্তামি তো তিনি নিজ বয়ানে বা কুবেরের চোখ দিয়ে উন্মোচন করে দিয়েছেন।
আর ময়না দ্বীপে ধর্ম নেই এটাও তো ঠিক নয়। হোসেন মিয়া যতই বলুক তার দ্বীপে মসজিদ মন্দির কোনটাই হবে না, অর্থাৎ সব লৌকিক ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজ হবে তার দ্বীপ, কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি প্রচলিত ধর্ম না থাকলেও নতুন একটি ধর্ম তো থাকছেই, হোসেন মিয়ার তৈরি করা ধর্ম। হোসেন মিয়া যেখানে অঘোষিত খোদা। তারও আছে কিছু নিয়মকানুন।

সন্তান জন্মদানে অক্ষম নারী পুরুষের কোন মূল্য নেই তার দ্বীপে। তাই বৃদ্ধ বশিরের স্ত্রীর সাথে যুবক এনায়েতের সাথে অবৈধ প্রণয় স্বীকৃতি দিয়েছেন হোসেন মিয়া। মানলাম যুক্তি আছে , দ্বীপের জনসংখ্যা বাড়াতে হবে – বন্ধ্যা নারীর প্রয়োজন সেখানে থাকবার কথা নয়।

কেতুপুরে বরং তারা হোসেন মিয়াকে এতটা ভয় করে না, কিন্তু ময়না দ্বীপে গেলে তো তারা পুরোপুরি অসহায়। হোসেন মিয়ার মতের বাইরে যায় এমন সাহস সেখানে কোথায় তাদের! আর ময়না দ্বীপে তো তারা কেউ স্বেচ্ছায় যায় না। যায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে।
কাজেই প্রশ্ন থেকে যায় কেন উপন্যাসের পরিণতি হয়েছে একটি কল্পিত দ্বীপে নিক্ষিপ্ত হবার মধ্যদিয়ে।

মার্ক্সবাদী চিন্তাচেতনার সাথে আদতেই মেলানো যায় না এই রহস্যপূর্ণ আধো চেনা ময়না দ্বীপকে। ময়না দ্বীপে দেড় হাজার নারী পুরুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম অদ্ভুত ইচ্ছার বাইরে হোসেন মিয়ার আর কোন ইচ্ছা নেই এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। হোসেন মিয়ার চরিত্রের সাথে তার এ আকাঙ্ক্ষা মেলে না। বরং এর ভিতরে যে তার একজন সামন্তপ্রভু হয়ে উঠার আকুতি বিদ্যমান তা বুঝতে পাঠকের খুব বেগ পেতে হয় না। কুবেরের ময়না দ্বীপে আসা মানে ধীরে ধীরে একটা সময় পুরো জেলে পাড়াই এখানে উঠে আসবে। জেলে জীবন ত্যাগ করে পুরোপুরি শ্রমিক জীবন। তাতে কি তাদের মানসিক বা অর্থনৈতিক কোনক্ষেত্রেই বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হবে?

বুঝতে পারছি মানিক একটা পরিবর্তন চেয়েছেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষিত জেলেপাড়ার অচলাবস্থায় চেয়েছেন একটা ধাক্কা দিতে। মানিক তখন ধীরে ধীরে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিচ্ছেন। নতুন সমাজব্যবস্থার চিন্তা তার চেতনায় জন্ম নিতে থাকে। ময়না দ্বীপ সেই চিন্তারই ফসল বলে সমালোচকদের ধারণা। এ ধারণা হয়ত অমূলক না,

তবে নতুন এই সমাজ ব্যবস্থা এর ভিতর দিয়েই সমাজতান্ত্রিক ধারায় বিনির্মিত নিশ্চয়ই না। বরং তা সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থারই অন্য রূপ। শোষণের রূপ বদলেছে, মাত্রা কমেনি। ধর্মীয় শিকলও আছে, ভিন্ন পরিচয়ে। মানিকের সাম্যবাদী চেতনা এখানে হোসেন মিয়ার প্রভুত্বে হোঁচট খেয়েছে। তিনি জানতেন, বিদ্যমান অচলাবস্থা না ভাঙ্গলে শোষিত শ্রেণির মুক্তি নেই। কিন্তু সেই অচলাবস্থা ভাঙ্গার পথ কিরকম হবে, তা মানুষের প্রকৃত মুক্তি আনবে নাকি নতুন কোন শিকলে বন্দী করবে মানিক কি বিষয়টি সম্পর্কে তখনও পরিষ্কার নন?
মাস্কের ভাবনার সেই নতুন মঙ্গলগ্রহতে কি আমরা আবার ঐ বাধ্য হওয়া , অজানা ভাবনার সমুদ্রে ঝাঁপ দেব , যেমনটা ময়নাদ্বিপে যাওয়ার মানুষদের মধ্যে কাজ করছিলো । মানিক বাবু নিজেও বোধ হয় খুব একটা পরিস্কার ছিলেননা – ঐ সেখান কার ( ময়নাদ্বীপের ) গঠনতন্ত্র বা পরিচালন সম্বন্ধে , তাই ওনাকে ভরসা করতে হয়েছিলো হোসেন মিঞার উপর ।

এরকমটা হয়েই থাকে । আর সেটা যে খুব একটা কাম্য নয় সেটাও পরীক্ষিত ।
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





















১৯.১

জানুয়ারী মাসের আদ্দেক পেরিয়ে গেছে। এরপর ফেব্রুয়ারি এলে গ্রামসভার নির্বাচন হবে। ফের মার্চ মাসে হাইস্কুল আর ইন্টারমিডিয়েট কলেজের পরীক্ষা শুরু হবে। এই নির্বাচন একদিকে শনিচর ও বদ্রী পালোয়ানের কুস্তির আখড়াকে এবং অন্যদিকে রামাধীন ভীখমখেড়ী ও তার জুয়াড়ি সেনাপতিদের প্রজাতন্ত্রের সেবা করতে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এখন পর্য্যন্ত এদের সেবা করার বিশেষ পদ্ধতি বলতে যা দেখা যাচ্ছে তা হল বিরোধী দলকে পর্দার পেছনে গালমন্দ করা।

সবার আশা ফেব্রুয়ারি এসে গেলে এসব মুখোমুখি শুরু হবে। মার্চের পরীক্ষার কথা? এখনও কেউ ফাঁসে নি। ছাত্রের দল, অধ্যাপককুল, বিশেষ করে প্রিন্সিপাল সাহেব –কারও কোন হেলদোল নেই।

কিন্তু প্রিন্সিপাল সাহেব অন্য এক মামলায় ফেঁসে গেছেন। কিছুদিন আগে, কলেজ কমিটির বার্ষিক সভায় বৈদ্যজীকে সর্বসম্মতিতে ফের ম্যানেজার নির্বাচিত করা হয়। এটা নিয়ে কিছু সদস্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছেন। ওদের বক্তব্য—প্রস্তাবের বিরোধী সদস্যদের সভায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি, বরং আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ধমকানো হয়েছিল।

এই কথাটা চিঠিতে এত ফেনিয়ে লেখা হয়েছে যে ওটা পড়াই এক কঠিন কাজ। আর পড়লেও বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ, চিঠির পুরো বিবরণ সত্যি হলে মেনে নিতে হয় যে শিবপালগঞ্জে কোন নিয়ম কানুন নেই, থানা-পুলিশ বলতে কিছুই নেই, ওখানে গোটা চারেক গুণ্ডা মিলে যা খুশি তাই করে চলেছে।

এটা স্পষ্ট-- এই নালিশ যে মিথ্যে সেটা বুঝতে কোন তদন্তের আবশ্যকতা নেই। তবু বিরোধী পক্ষের কিছু সদস্য শহরে গিয়ে ওই নালিশের কপি করে শিক্ষা বিভাগের বড় বড় অফিসারের টেবিলে জমা করে ফিরে এল। তারপর গাঁয়ে এসে রটিয়ে দিল যে নালিশের তদন্ত করতে ডিপ্টি ডায়রেক্টর অফ এজুকেশন পদের অফিসার করবেন।

উনি নাকি সাদাসিধে গরু। কিন্তু এবার বৈদ্যজীর বাপেরও সাধ্যি নেই যে ওনাকে দুইয়ে নেবে। কারণ উপর থেকে সঠিক তদন্তের হুকুম জারি হয়েছে।

প্রিন্সিপাল সাহেবকে ফাঁসাতে ওইটুকুই যথেষ্ট। উনি জানেন যে তদন্তের দিকটা বৈদ্যজী নিজে দেখবেন। কিন্তু তদন্ত শুরু হলে হাকিমদের আনাগোনা লেগে থাকবে। সেসব প্রিন্সিপালকেই সামলাতে হবে। হাকিম কলেজে এলে সবার আগে কী দেখবেন? প্রিন্সিপাল নিজেকে উত্তর দিলেন— কলেজ ভবন।

এবার উনি ভবনের সৌন্দর্য বাড়াতে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন।

শহরে গিয়ে দেখে এসেছেন-- একটা ছোট চারাগাছ পুঁতে তার চারদিকে ইঁট দিয়ে গোল ঘিরে লাল -সাদা রঙ লাগিয়ে দিলে অবহেলায় পড়ে থাকা মাঠ কেমন বাগান সেজে ঝলমলিয়ে ওঠে! ভাবলেন, কলেজের সামনে একসারি গুলমোহর আর অমলতাস গাছ লাগিয়ে দেয়া যাক। আর হাকিমের দলবল আসার আগেই নানারঙের ইঁট দিয়ে ঘিরে দেয়া যাক।

ওঁরা আসার সময় দেখবেন নানারঙে সেজেওঠা সাফ-সুতরো কলেজভবন এবং ফিরবেন একপেট ফার্স্ট ক্লাস চা এবং নাস্তা গিলে। তাহলে আর আমার বিরুদ্ধে কী রিপোর্ট দেবেন?

প্রিন্সিপাল সাহেব এসব ভেবে জানুয়ারির হাড়কাঁপানো শীতের অজুহাত ঝেড়ে ফেলে কাজে নেমে পড়লেন। গাছ লাগাতে বছরের যে কোন সময় উপযুক্ত বটেক—চুলোয় যাক বৈজ্ঞানিক লেকচারবাজি!

উনি কলেজের পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে গর্ত খোঁড়ার তদারক করছিলেন। ওনার হাতে দুটো বই—একটা মোটা আর একটা পাতলা—দেখামাত্র মনে হবে খুব দামি। । পরনে ওনার প্রিয় কেজো পোশাক, অর্থাৎ মোজাছাড়া জুতো আর হাফপ্যান্ট। লোকে দেখে যাই ভাবুক, উনি এই পোশাকে নিজেকে বেশ চটপটে এবং চালাক ভাবেন। বইদুটোকে উনি পোষা বেড়ালের মত আদর করে ধরে আছেন।

একজন মজুর কোদাল-গাঁইতি চালানো থামিয়ে ওনাকে বলল, ‘দেখে নিন মাস্টার সাহেব, গর্ত তো এতটাই হবে’?

প্রিন্সিপাল মাথা নেড়ে বললেন, ‘হুঁহ্‌ এটা কোন গর্ত হল? একটা পাখি মুতে দিলেই উপচে পড়বে। খুঁড়ে চল বেটা, এখনও অনেক বাকি’।

এসব বলে উনি পাশে দাঁড়ানো এক মাস্টারের দিকে দর্পভরে তাকালেন। মাস্টারমশায়টি ওঁর আগে থেকেই চেনা, কারণ সে এনার খুড়তুতো ভাই। তিনিও এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলেন শত্রুপক্ষের কোন মাস্টার কাছাকাছি আছে কিনা। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে আত্মীয় ঢঙে বললেন—ভাইয়া, এই কলেজে তুমি তো এখন উদ্যান-বিশারদ!

প্রিন্সিপাল বইদুটো বুকে ঠেকিয়ে বললেন, ‘সবকিছু এদের জন্যে সম্ভব হয়েছে। তবে ব্যাটারা বড্ড কঠিন সব ইংরেজি লিখেছে। বুঝতে গেলে সাধারণ-বুদ্ধির মাথা বোঁ- বোঁ করে ঘুরবে’।

খুড়তুতো ভাই উবাচ, ‘আপনি তো লৌহপুরুষ! কলেজের এত এত কাজ, পলিটিক্সে মাথা গরম হয়ে যায়। তারপর আপনি বইও পড়ে ফেলেন! আমার তো অবস্থা হল কেউ বই পড়তে না বলুক, বরং দশ ঘা জুতো মারুক। বই দেখলে গা গুলোয়’।

প্রিন্সিপাল ফিফটি পার্সেন্ট বড়দা এবং বাকি ফিফটি পার্সেন্ট প্রিন্সিপাল হয়ে বললেন- ‘চুপ কর। এসব বলতে নেই। সফরের সময়ও বই সঙ্গে রাখি। শুধু কোট-প্যান্ট পড়লে কী হবে? তাই দেখে কেউ তোমায় অধ্যাপক বলবে ভাবছ? কোট প্যান্ট তো কুঁজো বামনও পরতে পারে’।

ভাই বলল, ‘আপনিই ঠিক। মাঝখানে বাধা দেয়া আমার স্বভাব নয়। কিন্তু আমাদের আর কুঁজো-বামনের মধ্যে তফাৎ কোথায়? এই শালার টেক্সট বুক, বুঝে নিন, পচাগলা ফল ছাড়া কিছু নয়। আমরা ছোঁড়াদের পেটে এগুলো ঠুঁসতে থাকি। কারও হজম হয়, কেউ বমি করে ফেলে’।

প্রিন্সিপাল হেসে ফেললেন। ‘কথাটা অনেক দূর অব্দি নিয়ে গেলে। কিন্তু অতি বুদ্ধিমানের মরণ নিশ্চিত’।

কথাটা বলে উনি গর্ত কতটা গভীর হল উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। যেন কোন বুদ্ধিমানের মরণ হলে তাঁকে এই গর্তেই কবর দেবেন।

এমনসময় ওখানে আগমন হল খান্না মাস্টারের। উনি হড়বড় হড়বড় করে এসে প্রিন্সিপালের হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন—নিন, ধরুন।

প্রিন্সিপাল একবার সাহায্যের আশায় তুতো ভায়ের দিকে তাকালেন। তারপর গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে কঠোর মূর্তি ধরে অফিসারি মেজাজে বললেন—এটা কী?

--কী আবার! একটা কাগজ।

ওর দিকে বুক চিতিয়ে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন দেখে খান্না মাস্টার হিতৈষী স্বরে বলল—দিন, পড়ে শোনাচ্ছি।

--‘যান, নিজের কাজ করুন। আমাকে পড়ানোর কষ্ট নাই করলেন’। এসব উনি ঘেন্না মিশিয়ে বললেন।

খান্না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল—এই জন্মে পড়ানোর হাত থেকে রেহাই কোথায়!

তুতো ভাই খান্না মাস্টারকে একদৃষ্টিতে দেখছিল। মালিকের বাংলোর ভেতর থেকে পোষা অ্যালসেশিয়ান রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলোকে যে চোখে দেখে। প্রিন্সিপাল অনেকক্ষণ ধরে কাগজের টুকোরোটার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে রইলেন। প্রাচীনকালের ঋষিমুনি হলে কাগজটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেত। খানিকক্ষণ পরে উনি ওই কাগজটাকে খান্না মাস্টারকেই ফেরত করে দিলেন।

খান্না রেগে গেল। ‘এটা কী’?

--‘কী আবার, কাগজ’। এবার প্রিন্সিপাল মন দিয়ে গর্তের গভীরতা দেখতে লাগলেন।

খান্না মাস্টার ঠোঁট কামড়ে গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘যাই হোক, লিখে আবেদন দিয়েছি। আপনার আদেশ ওই আবেদনের উপর লিখে দিতে হবে’।

প্রিন্সিপাল একজন মজুরের সঙ্গে কথা বলছিলেন-‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার থাম। আবে, গর্ত খুঁড়ছিস, কুয়ো নয়। ঢের হয়েছে’।

খান্না খানিকক্ষণ চুপচাপ। ফের মুখ খুলল,’আমি চারদিনের জন্য বাইরে যাব। ছুটি চাই। আপনি লিখে হুকুম দিন’।

প্রিন্সিপাল পায়ের পাতায় ভর দিয়ে গর্তের পাশে জমা ভিজে মাটির উপর বসেছেন। যাদের চোখ আছে, তারা দেখুক—কলেজের স্বার্থে উনি কাদা হোক, নালা-নর্দমা হোক, কিছুরই পরোয়া করেন না। এবার উনিমাটিকাটা মজুরদের গর্তের চারপাশে উঁচু করে আল বাঁধার ব্যাপারে বিস্তারিত নির্দেশ দিতে লাগলেন।

খান্না মাস্টারের কথাবার্তা এবার পার্শ্বসংগীতের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তিনিও গর্তের উলটো পাড়ে পায়ের পাতায় ভর করে বসে বলে উঠলেন—‘ গর্তের ভেতর লাফিয়ে পড়ার আগে আমার কথার জবাব দিয়ে যান’।

প্রিন্সিপাল ওর দিকে খোলাচোখে তাকালেন। বললেন—‘ আগে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে গর্তে ফেলব, তারপর তোমার উপর লাফিয়ে পড়ব। বুঝলে হে খান্না মাস্টার’! ডায়লগ মেরে উনি তুতো ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ভাইটি একেবারে বিনয়ের অবতার হয়ে নম্রস্বরে বলল-‘যাই, চাপরাশিদের ডেকে আনি। মনে হচ্ছে ভালরকম ঝগড়া ঝঞ্ঝাট হবে। কিন্তু আমার দিব্যি, আমি ফিরে না আসা পর্য্যন্ত আপনি কিছু বলবেন না’।

--‘আমি আর কী বলব ভাই! সবকিছু মুখবুজে সহ্য করে যাচ্ছি। যেদিন ওর পাপের ঘড়া পূর্ণ হবে, সেদিন নিজে থেকেই ভক্‌ করে ফাটবে’।

প্রিন্সিপাল খান্না মাস্টারকে শাপ দিলেন নাকি? ও বেশ ঘাবড়ে গেল। ওর ভয় প্রিন্সিপাল হঠাৎ চেঁচাতে না শুরু করে—খান্না আমার গায়ে হাত তুলেছে। তারপর খান্না মামলা মোকদ্দমায় না ফেঁসে যায়!

ও চুপচাপ উঠে গর্তের থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মাস্টারের কাছে গেল। তারপর গোটা দুনিয়াকে শুনিয়ে চেঁচাতে লাগল—ভয় দেখাবেন না মাস্টার সাহেব, ধমকি দেবেন না। এটা নবাবী আমল নয়। এত সহজে খান্নার প্রাণ যাবেনা। বলে দিচ্ছি, আমার গায়ে হাত তুলেছেন তো রক্তগঙ্গা বইবে। এই বলে দিলাম, হাঁ!

খান্না ঠিক চেঁচাতে চায়নি। কিন্তু জোর গলায় বলতে গিয়ে ব্যাপারটা চেঁচানোর স্তরে পৌঁছে গেল। কয়েকজন মাস্টার এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। খান্না হঠাৎ বিকট চিৎকার করে উঠল—‘মারুন, মারুন না আমাকে! ডেকে আনুন যত চাপরাশির দল। ওদের হাতেই আমার অপমান হোক। থেমে গেলেন কেন’?

খাসা তামাশা জমেছে। এই সত্যি কথাটা বোঝার তাগিদে দুই দলের কিছু মাস্টার দুদিকে জড়ো হল। ছাত্রের দল এখনও আসেনি। যে দু একটা এসেছিল, তাদের চাপরাশিরা আগে থেকেই ভাগিয়ে দিল। ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখতে পাচ্ছিল। তবে এই তামাশা সেরেফ ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ হয়ে গেল।

প্রিন্সিপল সাহেব এই আচমকা আক্রমণে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেছলেন। তারপর ঠেলে ওঠা ক্রোধকে সংযত করে খান্নার কাছে গেলেন। ছুটির দরখাস্তটি ছিনিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন—‘চেঁচিও না খান্না মাস্টার! তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে। দাও, দরখাস্তের উপর আদেশ লিখে দিচ্ছি’।

ওঁর ইশারায় তুতোভাই মাস্টার একটা ফাউন্টেন পেন বাড়িয়ে দিল। উনি হাতের হর্টিকালচারের বইটার উপর ছুটির দরখাস্তটি রেখে তার উপর খসখস করে কলম চালাতে লাগলেন। লিখতে লিখতে বললেন—‘আমাদের লড়াই নীতির। এর মধ্যে মারপিটের কথা উঠছে কেন? ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে’।

খান্না মাস্টার নিজের খাড়া করা তামাশায় নিজেই ক্লান্ত হয়ে বলল,-‘আগে এই দরখাস্তের ওপরে হুকুম লিখুন। তারপর বাকি কথা’।

তিনি মুচকি হেসে জানালেন,-‘সেটাই করছি’।

কয়েকটা শব্দের উপর উনি ‘ক্রস’ চিহ্ন লাগালে। অন্য কয়েকটায় গোল করে ঘিরে দাগিয়ে দিলেন। শেষে বড় করে ইংরেজিতে একটা শব্দ লিখলেন—‘রিজেক্টেড’!

খান্না মাস্টারের মুখ থেকে কোন শব্দ বেরোনের আগেই তিনি দরখাস্ত ওকে ফেরত দিয়ে বললেন—স্পেলিংয়ে অনেকগুলো ভুল। ‘হলিডে’ শব্দে ‘এল’ অক্ষরের পরে ‘ওয়াই’ লেখা হয়েছে। ‘খান্না’ শব্দে ‘কে’ অক্ষরটা ক্যাপিটালে লেখা নাকি স্মল বোঝা দায়। এসব খেয়াল করা উচিত’।

খান্না বাকশক্তিরহিত। তারপর হঠাৎ গণ্ডারের মত মুখ খুলে গর্জন করে উঠল—‘ একবার কলেজের বাইরে আয়! তোর সমস্ত স্পেলিং ওখানেই শিখিয়ে দেব’।

ব্যস্‌ মহারণ শুরু।
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in







সুপ্রিয়বরেষু বাসু,

অফিসের কাজে শহরের বাইরে ছিলাম প্রায় একমাস। তাই তোমার চিঠির উত্তর দিতে দেরী হলো। তুমি নিশ্চয়ই পাহাড় থেকে ফিরে এসেছো। কদিন আগেই যাকে বিগত যৌবনা বলে উপহাস করলে তাকেই লিখছো চিরনতুন বৃদ্ধা এ কেমন কথা? ভীমরতি ধরেছে নাকি মশাই! অবশ্য তোমারও তো বয়স হয়েছে এই বয়সে শুনেছি প্রায় পুরুষের কিছু চারিত্রিক ভীমরতি ঘটে, তোমারও কি তাই হলো নাকি বিগত যৌবনা বলে অনুশোচনায় ভুগছো? বছরের প্রথমেই শহরের বাইরে যাবার তাড়া ছিলো তাই নতুন বই কেনা হয়নি। বহুবছর পরে এয়ারপোর্টে কার সাথে দেখা হয়েছে শুনলে তোমার মনে দোলা লাগবে। কলেজের দিনগুলিতে যাকে একপলক দেখবে বলে তুমি ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যান্টিনে বসে থাকতে তোমার সেই চির যৌবনার সাথে দেখা হলো। স্বামী পুত্র নিয়ে দারুন সংসারী সে। তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেছে খুটেখুটে আজও সংসারী হওনি শুনে মনে হলো কষ্ট পেয়েছে খুব। ওর সাথে ঘন্টাখানেকের সাক্ষাতের পরে আমার মনে হয়েছে নারীর জীবন ব্যক্তিগত নয়, পুরোপুরি রাজনৈতিক। দেশকেও তো আমরা মায়ের রূপে দেখি অর্থাৎ সেই নারী আর তাই হয়ত তারও ব্যক্তিগত কিছু নেই যা আছে তা পুরোপুরি রাজনৈতিক তা হোক ভারতবর্ষ,বাংলাদেশ, সিরিয়া কিংবা অন্য যেকোন দেশ। শহীদুল জহিরকে তোমার মতন করে গভীরভাবে আমার পড়া হয়নি তবে তোমার চোখে তাকে দেখে আরো গভীরভাবে তাকে পড়ার ইচ্ছে জেগেছে প্রবলভাবে তা স্বীকার করি। বাংলাদেশকে দেখার কথা যদি বলো তাহলে সবচেয়ে বেশি আমি দেখেছি সেলিনা হোসেনের লেখায়। ফ্রানৎস ফানো বলেছেন অতীত নয়, যে-অগ্নিগর্ভ বর্তমানের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, যা এ-মুহূর্তে আকার পাচ্ছে, সে-সময়কেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখার কথা একজন সংবেদনশীল লেখকের সেটাই তো আত্মনির্ধারিত অন্বিষ্ট। শহীদুল জহির তেমনই একজন লেখক অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবু কেন জানি আমাকে বেশি টানে সেলিনা হোসেন। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা গভীরভাবে যেসব লেখকের রচনায় মূর্ত হয়ে উঠতে শুরু করে, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁদেরই একজন। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু বাবা মা ও আত্মীয় স্বজনের মুখে এত গল্প শুনেছি আমার এখনো মনে পড়ে স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের ভাতঘুমের আগে ঠাকুরমার কাছে রোজ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার দিনগুলি। মুক্তিযুদ্ধ প্রীতির জন্যই কিনা জানিনা বাবা সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬) বইটি কিনে দিয়েছিল বইমেলা থেকে। সেই জন্যও সেলিনা হোসেন আমার প্রিয় হতে পারেন। তুমি নিশ্চয়ই সেলিনা হোসেনের বহু লেখা পড়েছো। হাঙর নদী গ্রেনেড পড়ার পরে আমি সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা বেশকিছু উপন্যাস পড়েছিলাম।

বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ বেশি হয়ত পূর্বপুরুষের নাড়িপোতা আছে সেইজন্য কিংবা নিকটতম প্রতিবেশি দেশ বলে, কিন্তু পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখো সর্বত্র জনসাধারণ সমর্থিত ও অংশগ্রহণকৃত যুদ্ধ। ইতিহাস জানায়, এই সভ্য পৃথিবীতে একটি দিনের জন্যেও কখনো যুদ্ধ বন্ধ হয় নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজায় রাজায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রশাসকবৃন্দ নিজেদের প্রতিহিংসা, লোভ মেটাতে জনগণকে ছুড়ে ফেলেছে ক্ষুধার্ত

বাঘের খাঁচায়। এরিক মারিয়া রেমার্কের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এ দেখা যায়, দেশের যুবকরা বাধ্য হচ্ছে যুদ্ধে যেতে। সেই যুদ্ধ গৌরবের অনুভূতির পরিবর্তে তাদের দিয়েছে ক্লান্তি আর ঘৃণাবোধ। যুদ্ধ থেকে তারা ফিরেছে একরাশ হতাশা আর অর্থহীনতার বোধ সঙ্গে নিয়ে। ছাত্র রাজনীতি করলেও আমি যে তুখোড় রাজনীতিবিদ তেমনটা একদমই না। তবে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কিছু গলদ অবশ্যই আছে। যা বাংলাদেশে ঘৃণাকে বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির কাল থেকেই ভারত এককভাবে আওয়ামী লীগকে অন্ধভাবে সমর্থন করেছে যা এতবড় গণতান্ত্রিক দেশের কুশলী পরারাষ্ট্রনীতি হতে পারেনা কোন ভাবেই।

বাংলাদেশের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানকে ছাত্ররা বলছে নতুন স্বাধীনতা। এটা একটা রাজনৈতিক পন্থা হলেও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম গণঅভ্যুত্থানের পরে অস্বীকার করতে চাইছে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। তাঁর ভাষণ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে উঠে। কালজয়ী এ ভাষণ বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে সবসময় প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে সেলিনা হোসেনের একটি উপন্যাস আছে 'সাতই মার্চের বিকেল'। এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা দুজনেই একাত্তরে রমনার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছে। ইতিহাসের সেই অগ্নিঝরা বিকেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। লেখিকা উপন্যাসে দেখিয়েছে, নায়ক-নায়িকা যুদ্ধের পরে আবারও রমনার রেসকোর্স ময়দানে চলে আসে। মেয়েটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে গর্ভবতী হয়েছে। ছেলেটি মেয়েটিকে দেখে বলল, যুদ্ধের আগে আমাদের প্রেম ছিল। আমিতো তোমাকে এখনো একইভাবে চাই। তখন মেয়েটি বলে, আমার এই অবস্থাতেও তুমি আমাকে গ্রহণ করতে সম্মত আছো? ছেলেটি জানায়, গর্ভের সন্তানের দায়িত্ব নিতেও সে রাজি। গর্ভের সন্তানটি যেহেতু কোনো কিছুর জন্য দায়ী নয়, তাই তাকে গ্রহণ করতে তার আপত্তি নেই। তখন তারা দুজনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যায়। বঙ্গবন্ধু সে সময় বাড়িতে ছিলেন না। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা তখন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতাকে জানায়, তারা দুজনে বিয়ে করতে আগ্রহী। যুদ্ধের আগেও তারা ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেত, তাই বঙ্গমাতা তাদের সম্পর্কের কথা জানতেন। তিনি এই নতুন পরিবর্তিত অবস্থায় দুজনের বিয়ে করার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবর জেনে কাজী ডেকে বিয়ে দিয়ে দেন। বঙ্গমাতা তার গলার সোনার চেইন খুলে মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিয়ে তাদের আশীর্বাদ করেন। উপন্যাসটি পড়ে আমার মনে হয়েছে সেলিনা হোসেন এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে, এসবই বাংলাদেশের সাতই মার্চের অর্জন।

৫ই আগষ্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরে ৩২ নম্বরের সেই ঐতিহাসিক বাড়িটিতে আগুন দেয়া হয়েছে তারপর ৫ ই ফেব্রুয়ারি সেই বাড়ি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর সব প্রতিকৃতি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে আমার তখন আফগানিস্তানের কথা মনে পড়ছিল। সারাদেশ জুড়ে যে সব তান্ডব চলেছে তা শোনার পর অজানা কষ্ট ঘিরে ধরলেও আমাকে সাহস জুগিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেলিনা হোসেনের ১৯৭৬ সালে লেখা প্রথম উপন্যাস হাঙর নদী গ্রেনেড। এই লেখায় জনযুদ্ধ চিত্রায়নের সার্থক রূপায়ণ পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে নেই কোনো রাজনৈতিক চরিত্র, সেনা কর্মকর্তা, কিংবা অসাধারণ কোনো ব্যক্তিত্ব। হলদীগাঁ নামে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম হওয়া বুড়ি নামের মেয়েটির শৈশব থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত বেড়ে ওঠা আর জীবনযাপনের অতিসাধারণ বর্ণনা আছে এতে। বুড়ির বিয়ে হয় বিপত্নীক দুই পুত্রের বাবার সাথে। উপন্যাসের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত হলদীগাঁয়ের নিস্তরঙ্গ কৃষিভিত্তিক গ্রামসমাজের আবহমান ছবি তুলে ধরা হয়েছে। রাজনীতি, মিটিং-মিছিল, দাবি-দাওয়া এসব যেন শহুরে বিষয়, গ্রামজীবনের নিভৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন বহুদূরের প্রসঙ্গ। উপন্যাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে শহর থেকে যুদ্ধ ক্রমশ গ্রামীণ জীবনকে আক্রান্ত করে। হতচকিত গ্রামবাসী বিষয়টা বুঝে উঠতে উঠতেই অনেকখানি ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। গ্রামের সব যুবকের সাথে বুড়ির সৎ ছেলে সলিম-কলিম যুদ্ধে চলে যায়। বিশেষ পরিস্থিতিতে গ্রামের প্রতিবেশী দুই মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের বহু সাধনার কাঙ্খিত প্রতিবন্ধী পুত্রকে হায়েনার মুখে তুলে দেয় বুড়ি। সলিম-কলিম, বুড়ি কিংবা উপন্যাসে উল্লিখিত অন্য মুক্তিযোদ্ধারা কেউ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত কিংবা রাজনীতি সচেতন চরিত্র নয়। কিন্তু এরাই একাত্তরের সিংহভাগ জনতা, যারা মাতৃভূমি বাঁচাতে নিত্যকার ঘর-গৃহস্থালি ফেলে কাস্তে-লাঙলের বদলে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। এই গল্পের আরেক ধরনের যোদ্ধার উপস্থিতি সম্পর্কে না বললেই নয়। বুড়ির বাল্যসখী নীরা ছিল বাউল দলের সদস্য। সারাদেশ ঘুরে দোতারা হাতে গান গাইত সে। গ্রামের রাজাকাররা তাকে প্রাণের হুমকি দিয়ে দোতারা কেড়ে নেয়, কারণ গানের ভেতর দিয়ে সে দেশমাতৃকার কথা বলছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত বায়ান্নের ভাষা সংস্কৃতি বাঁচানোর লড়াইয়ের ধারাবাহিক ফলাফল। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাওয়া, ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা, সবশেষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড প্রমাণ করে দেয় যুদ্ধটা কেবলই ভূমি দখলের নিমিত্তে ঘটে নি। একটি জাতির মস্তিষ্ককে ধৌতকরণের মাধ্যমে দাসে পরিণত করাটাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবল সশস্ত্র যুদ্ধ হলে এত দ্রুত স্বাধীনতা লাভ করা যেত না সম্ভবত, যদি না আব্দুল মান্নান আর আরজাতুন্নেসার মতো স্বেচ্ছাসেবকেরা কোনো প্রাপ্তির আশা না রেখে জনতার কাতার থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। কসবার কুল্লা পাথর এলাকার এই দুজন বাসিন্দা ইতিহাসস্বীকৃত চরিত্র। যুদ্ধের নয় মাস এই দুজন শহিদদের লাশ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে উপযুক্ত মর্যাদায় দাফন করেন। আব্দুল মান্নান এবং আরজাতুন্নেসার জন্য বহু শহিদের লাশ বেওয়ারিশ হয়ে যায় নি। লাশ ধোয়ানোর সেই চৌকি আজও ইতিহাসের স্বাক্ষ্য দেয়। আর তাতেই বলতে সাহস পাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আদতে অসাম্প্রদায়িক, হয়ত এখনও।

তেমনি ‘ঘুমকাতুরে ঈশ্বর’উপন্যাসে নদীভাঙা মানুষের জীবনের দুঃখগাথা দিয়ে যে কাহিনির শুরু, সেইসব উপকাহিনির যোগসূত্র ঘটে একটি গণকবরের কাছে এসে। লেখক দেখাতে চান যে দেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় হয়ত যে কোনো উপায়ে আরো অধিক পুঁজি গড়তে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার জীবন বেছে নিয়েছে, যার ফলে দেশাত্মবোধ তাদের কাছে এখন লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতার নামান্তর। কিন্তু এই দেশেরই যেসব অতি সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষের অবদানের কারণে একাত্তরে বিজয় এসেছিল, তাদের জন্য আজও স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের বোধে একাত্ম হওয়ার বিকল্প নেই। একতার শক্তিই পারবে মানবেতর জীবনযাপন করা এইসব মানুষের জীবনে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বয়ে এনে দিতে। আর নওরতন বেওয়া সেই মানুষ, যিনি পেরেছেন স্বদেশ ও স্বাধীনতার প্রতিকৃতিরূপে নিজেকে দশগ্রামের মানুষের কাছে দাঁড় করাতে। তাই তার বাড়িতে যারা আসে, তারা বলে, ‘শহীদের লাগি মোরাই তো কাঁদুম। শহীদের লাগি কাঁদলে মাটি, আকাশ, বাতাস খুশি থাকবে। নইলে মোগ উপর গজব নামবে। মাটি ফুঁইসা উঠবে। নদীগর্ভে তলায়ে যাইবে। জলোচ্ছ্বাস মোগরে দুইয়া সাফ কইরা দিবে। আবার ফুঁইসা উঠবে। বজ্রপাত অইবে। মোগরে বেইমান বইলে গালি দিবে। মোরা ধ্বংস অইয়া যামু।’ একটি গণকবর, একটি গণহত্যা দিবস এবং স্মৃতিসৌধরূপী নওরতন বেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রতীকায়িত করা হয়েছে, যে দেশের শেকড় ‘একাত্তর’ নামক একটি সময়ে প্রোথিত রয়েছে। শেকড়ে ফিরতে পারলে, নওরতন বেওয়ার মতো স্বাজাত্যবোধ আর স্বদেশপ্রেম ধারণ করতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব কিছু নয়। অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব হলে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমবে, অনেক মূল্যের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে।

তোমার নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে বাংলাদেশের সমসাময়িক গণঅভ্যুত্থানকে কেন আমি সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস দিয়ে দেখছি। আসলে আমি তোমার মন জগতে যে ঢেউ উঠেছে তার হাহাকারের সাথে একাত্ম বোধ করছি কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ও সরলমনা সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের প্রতি বিশ্বাস রাখছি সেলিনা হোসেনের লেখা থেকে কেননা গল্প-উপন্যাসের বিষয় ও চরিত্রের অনুসন্ধানে সশরীরে মাঠে-প্রান্তরে ঘুরে ফেরেন তিনি। উদ্দেশ্য একটিই, যে জীবনের গল্প তিনি নির্মাণ করছেন বা যে চরিত্র তিনি সৃষ্টি করছেন, তা যেন সঙ্গতিপূর্ণ হয়। বাস্তববাদী লেখক হওয়ার ইচ্ছে থেকে তিনি এ কাজ করেন না। এ কাজ তিনি করেন একজন শিল্পীর লড়াই হিসেবে। এই লড়াই তিনি সকল ক্ষেত্রেই করেন। এছাড়া উপন্যাসের বিষয়বৈচিত্র্য খোঁজা তার শিল্পীসত্তার মৌলিক স্বভাব। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি তাঁর লেখায় খুব বেশি নেই। গল্প-উপন্যাসের বিষয় ও আঙ্গিকের অন্বেষণে রীতিমতো গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি সেলিনা হোসেনকে। সৃজনসত্তার এই বিশেষ প্রবণতা বা আকুতি তার লেখালেখির শুরু থেকেই শুরু। 'পোকামাকড়ের ঘরবমতি' লেখার পূর্বে তিনি সশরীরের জেলেদের ট্রলারে চড়ে গভীর সমুদ্রের গিয়েছিলেন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন-

যে ট্রলারে চড়েছিলাম তার প্রধান জেলে ছিলেন একজন বয়সী মানুষ। চুল-দাড়ি ধবধবে সাদা। মাথায় চুপি। ভেবেছিলাম তিনি আমাকে ট্রলারে উঠতে দিতেই চাইবেন না। দেখলাম তিনি অন্য মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আসেন আসেন। আমি আর আনোয়ার উঠলাম ট্রলারে। ট্রলার যখন গভীর সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে, তিনি গুড়-মুড়ির পোটলা খুলে বললেন, খাবেন মাগো? এই হলো আমাদের সাধারণ মানুষের চিত্র। বিপরীতধর্মী মানুষ নেই তা নয়। তবে এরাই সংখ্যায় বেশি। সেখানে গিয়ে কাহিনী মাথায় দানা বাঁধে। ঠিক করি যে উপন্যাসের নায়ক হবে একজন সাহসী মানুষ, যে হাঙর ধরার স্বপ্ন দেখে। জেলে মালেকের এই স্বপ্নের সঙ্গে ছিল তার প্রেম, দুঃখ-বেদনার গল্প। (গল্পকথা, সেলিনা হোসেন সংখ্যা, রাজশাহী, ২০১৫)

তাঁর এই আত্মকথন প্রমাণ করে তিনি কল্পনাপ্রসূত চরিত্র বিনির্মাণ করেননি, তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা তাঁর নিজ চোখে দেখা ও গবেষণা সৃষ্ট। যা সাধারণের বাস্তব মনজগৎকে তুলে এনেছেন পরম মমতায় বাস্তবসম্মতভাবে। তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দেখেছেন নিবিড়ভাবে। তাঁর গল্পে শ্রমিক, চাষি, কাঠুরে, রিকশাচালকসহ বিচিত্র পেশার মানুষ উঠে এসেছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে রঙচঙ লাগিয়ে বিস্তর হৈচৈ হচ্ছে দেশের মিডিয়াগুলোয় কিন্তু বিশ্বের কোথায় সংখ্যালঘুরা ভালো আছে বলো তো? আমাদের দেশেও কি বিষ ছড়ানো হচ্ছে না? মানুষকে যতদিন মানুষ পরিচয়ে বিবেচনা না করে ধর্ম বা জাতি দিয়ে বিবেচনা করা হবে ততদিন মুক্তি আসবেনা। বিশেষ করে সংখ্যালঘু শব্দটা যতদিন আছে। সংখ্যালঘুদের জীবন নিয়েও সেলিনা হোসেনের একটি মুক্তিযুদ্ধকালীন উপন্যাস আছে। ‘মাটি ও শস্যের বুনন’ উপন্যাসে দেখা যায়, শ্যামল সবুজ ধমশর গ্রামে ভোর হয় গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি শুনে। খ্রিষ্টধর্ম অধ্যুষিত গ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষদের জীবন নারকীয় হয়ে ওঠে পাক বাহিনীর আক্রমণে। ক্ষিতীশ ও মেরিনার কন্যাসন্তান র্ম্চ্ছূনার জন্ম হয় বিকট বোমা বিস্ফোরণের শব্দকে সঙ্গে নিয়ে। পরিবারের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবোধসম্পন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত দেশচেতনা ধারণ করেই বেড়ে ওঠে সে। গির্জার ফাদার যোসেফ এবং স্থানীয় মিশনারি হাসপাতালটি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও আশ্রয়ের জন্য নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। হাসপাতালে নির্যাতিত নারী পারুলিয়া যুদ্ধশিশুর জন্ম দিয়ে হত্যা করতে উদ্যত হয়। ক্ষিতিশ ও মেরিনার উদ্যোগে শিশুটিকে গ্রামের নিঃসন্তান দম্পতি দত্তক গ্রহণ করে। যুদ্ধশিশুর প্রতি এই অসাধারণ দায়িত্বশীল উপলব্ধি সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়লে পরবর্তীকালে বীরাঙ্গনা এবং যুদ্ধশিশুদের নানাবিধ করুণ পরিণতি বরণ করতে হতো না। হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী চন্দ্রমুখী আহত মুক্তিযোদ্ধার কেটে ফেলা পা সশ্রদ্ধচিত্তে বাগানের মাটিতে পুঁতে রাখে, যেন সেই পা থেকে জন্ম নেবে স্বাধীনতা নামের বৃক্ষ। সেখানে ফুল ফুটবে প্রতিদিন বাংলাদেশ নামে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধে যে বৈষম্যহীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিল তার প্রতিফল ঘটেনি বলে স্বপ্নগুলো যেমন মিথ্যে হয়ে যায়না তেমনি হাজার বছরের সংস্কৃতিকে চাইলেই বদলে ফেলা সম্ভব না। মনে রাখা জরুরি আমাদের সংস্কৃতিতে লোকাচারে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল মন্ত্র ছিল, বাংলার প্রত্যেক মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জনগণকে মুক্তি দেয়া। বাঙালি হবে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি। ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশ্র আদর্শে এই ভূখণ্ড পরিচালিত হবে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অনন্য বৈশিষ্ট এবং বিবিধ নৃতাত্ত্বিক সংমিশ্রণের ফলে এ সংস্কৃতি নিজস্বতা লাভ করেছে। বাঙালির স্বীকরণের ক্ষমতা এত বেশি ছিল যে শাসনতন্ত্র দিল্লি থেকে শত শত মেইল অবস্থানের পরেও শাসকদের অনুশাসন, ধার্মিকদের ধর্মাচার, দার্শনিকদের দর্শন ভাবনা ইত্যাদি যা কিছু বাংলা নামক এ প্রান্তিকে এসে পৌঁছেছে তাই বঙ্গীয় চরিত্র দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। পাশাপাশি শতশত নদী শাখা নদী এবং বনভূমিতে পরিপূর্ণ বাংলাদশ আবার বহুভাগে বিভক্ত হয়েছে। এ কারণে এ অঞ্চলের সংস্কৃতিও খানিকটা স্বাতন্ত্র্র্য লাভ করেছে। এসব উপসংস্কৃতিও জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং বহু উপ-ভাষার কারণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। বৈদিক, বৌদ্ধ এবং জৈন ইসলাম ধর্মের মতো প্রধান প্রধান ধর্মের উৎপত্তি এবং স্থান বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থিত। সে কারণে এসব ধর্মের আদি অকৃত্রিম রূপ এ অঞ্চলে পৌঁছায়নি; বরং এসব বহিরাগত ধর্মের সঙ্গে স্থানীয় ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচারের এক অদ্ভুদ সমন্বয় ঘটেছে। তাই সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা কথা বলা যায় যে, সংস্কৃতি একটা দেশ তথা অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর শেকড়ের মতো।

‘কাঠকয়লার ছবি’ সেলিনা হোসেনের আরো একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দেখা যায় চৈতীরাণী নামে এক নির্যাতিত নারীকে, চৈতীরাণী আদিবাসী বাঙালি এবং চাবাগানের শ্রমিক। একাত্তর সালে এইসব প্রান্তিক, অন্ত্যজ শ্রেণি যারা আজন্মকাল বহুবিধ শোষণের শিকার তারাও যুদ্ধে অবদান রেখেছিল নানাভাবে, ইতিহাসে যাদের কথা কোথাও লেখা নেই। যাদের আমরা অনেক সময় অকৃতজ্ঞের মতো বাঙালি বলে পরিচয় দিতেও লজ্জিত হই। চৈতীরাণী তেমন একটি চরিত্রের যে কিনা পাক বাহিনী এবং চা বাগানের বাঙালি ম্যানেজার কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয় এবং দুটো পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। যুদ্ধশিশু দুলালকে অবশ্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে বিদেশি দম্পতির কাছে দত্তক দিয়ে দেওয়া হয়। ‘মাটি ও শস্যের বুনন’ উপন্যাসের পারুলিয়াকে আমরা দেখেছি যুদ্ধশিশুকে ঘৃণার বশে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু এখানে দেখা যায় চৈতীরাণী নবজাতক শিশু হারানোর শোক আজীবন বহন করে চলে। এই উপন্যাসে একাধিক কাহিনির বিস্তারকে ছাপিয়ে যুদ্ধশিশু দুলালের উৎস সন্ধানের নিরন্তর প্রচেষ্টা উপন্যাসের মূল পটভূমি হয়ে পাঠক হৃদয়ে জেগে থাকে। দুলাল তার পালক পিতামাতার কাছে সব জানতে পেরে প্রথমে ভেঙে পড়লেও পরে জন্মদাত্রী মা এবং জন্মস্থান অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। এই খুঁজে ফেরা প্রতিটি যুদ্ধশিশুর জীবনের বেদনাদীর্ণ প্রতিচ্ছবি। বীরাঙ্গনা ও তার যুদ্ধশিশু যুদ্ধের আগে পরে বহুমুখী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। শোকের প্রেক্ষাপটে জেগে থাকে ক্ষত নিরাময়ের অযোগ্য আঘাত ও অপমানের স্মৃতি। পুরো উপন্যাসে দুলালের শেকড় খুঁজে বেড়ানোর আর্তি ও হাহাকার মিলেমিশে যুদ্ধশিশুর বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবায়। নাড়ির টানেই যেন দুলাল খুঁজে পায় মাকে। চারপাশে ঢোলের আওয়াজে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। মৃত্যু সন্নিকট হলেও মাতা-পুত্র দুজনেরই বিসর্জনের বাদ্য যেন হয়ে ওঠে হোলি খেলার উৎসব। এভাবেই লেখক যেন বাংলাদেশের মানুষকে সচেতনভাবে যুদ্ধশিশু আর বীরাঙ্গনা মায়েদের বরণ করে নেওয়ার জন্য উৎসবের আহ্বান করেছেন। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য নারী নির্যাতন আর যুদ্ধশিশু একটি আদিম মারণাস্ত্র। সেই মারণাস্ত্রকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে দেশবাসীকেই, মন-মানসিকতার পরিবর্তন ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের নাম সহিংস ধর্ম সন্ত্রাস বা লুকানো রিলিজিয়াস রেসিজম। এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় আজ বাংলার আকাশও আচ্ছাদিত। শান্তিই নাকি পৃথিবীর সকল সম্প্রদায়গত ধর্মের গন্তব্য। তাহলে এই শতাব্দীর দ্বার প্রান্তে এসে এইসব আমরা কি দেখছি? মানুষের কল্যাণের জন্য যে ধর্ম তা নিয়েই কত রাজনীতি,মত বিভেদ, রক্তপাত, অত্যাচার, লাঞ্ছনা আর অশান্তি। ঔপনিবেশিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের কারণে এই ধর্ম সন্ত্রাসের বীজ অনেক আগেই বাংলার মাটিতে বপন করা ছিল যা এখন বড় মহীরুহে পরিণত হয়েছে।

ইতি-

সুস্মি
১৪ ফেব্রুয়ারি,২০২৫



পুনশ্চ: "আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।"
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















বের্নহার্ড বেশ ঘাবড়ে গেল। প্রায় কেঁদে ফেলবে সে। এই প্রথমবার সে শুনল যে গের্ট এবং ইনেস একেবারে বয়ে যাওয়া ছেলেমেয়ে এবং এই বন্ধুমহলে মেলামেশা না করাই তার পক্ষে মঙ্গল। এদের সঙ্গে মিশলে বের্নহার্ডের ধ্বংস অনিবার্য। ‘বয়ে যাওয়া’ আর ‘ধ্বংস’ শব্দদুটো শুনে সে বেশ বিরক্ত হল, যদিও উল্টে কিছু বলবার সাহস তার ছিল না। তাছাড়া এই কথাটা তো অগ্রাহ্য করা চলে না যে গের্ট একেবারেই পরিশ্রমী ছাত্র নয়। কিন্তু ইনেসকে এই দলে ফেলা যায় না। সে এইসব নিন্দার উর্ধে। তাছাড়া বাবা তো জানেনও না যে ইনেস তাদের বন্ধুবৃত্তে বেশ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। তবে বন্ধুদের দলের সবাই খারাপ, এটাও সঠিক কথা নয়। কারণ অনেকেই যথেষ্ট পরিশ্রমী, ভাল স্বভাবের এবং নিয়মানুবর্তী…

এই ঘটনার কিছুদিন পরে বের্নহার্ডকে বাড়িতে যাবার কথা বলা হয়েছিল, কারণ তিন সপ্তাহের ছুটি ছিল তার স্কুলে। বাবা বলেছিলেন যে সবকিছু বদলে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। বের্নহার্ড ভেবে উঠতে পারছিল না যে ঠিক কেমন বদল ঘটবে। তার একটু ভয় ভয় করছিল। তাকে গের্ট এবং ইনেসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে গের্টকে একবার ফোন করেছিল এবং জিজ্ঞাসা করেছিল যে তাদের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব কি না।

এই দেখা করবার ব্যাপারটা শেষ অবধি বেশ অদ্ভুত হয়ে দাঁড়ালো। বের্নহার্ড গের্টের বাড়িতে গিয়ে বেল বাজানোর পরে গের্ট নিজে এসে দরজা খুললো। তারপর তার নিজের ঘরে নিয়ে গেল। গের্টের ঘর এমনিতেও বেশ অগোছালো থাকে, আজও তাই। ঘরের কার্পেটে ফ্লক শুয়ে আছে। সে বের্শেনকে দেখে লেজ নেড়ে আহ্লাদ প্রকাশ করল। গের্ট বলল যে ইনেস চলে গেছে কুকুরটাকে রেখে দিয়ে। ‘কুকুর’ বলে উল্লেখ করাটা বের্নহার্ডের ভাল লাগল না। কারণ ফ্লককেও সে বন্ধু বলেই মনে করে। কিন্তু ইনেস চলে গেছে, এটা শুনে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তার হতবাক দশা দেখে গের্ট মজা পেলেও, বের্শেনের মতে ইনেসের চলে যাওয়াটা সত্যি সত্যি একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ফার্দিনান্দের চলে যাওয়া, লাতিন পেপারের পরীক্ষার খারাপ ফল, বাবার সঙ্গে তর্কাতর্কি, সব বিচ্ছিরি ঘটনা ছাপিয়ে গেছে ইনেসের চলে যাওয়া।

-‘ইনেস কোথায় গেছে?’ অবশেষে একেবারে বিধ্বস্ত স্বরে বের্শেন প্রশ্ন করে।

-‘ইংল্যান্ডে গেছে, ওর দিদির কাছে। দিদির বাচ্চা হয়েছে। তিন-চার সপ্তাহের জন্য গেছে।’

-‘হঠাৎ করে যেতে হল?’

‘হ্যাঁ। যাই হোক, তোমাকে বারতিনেক ফোন করেছিল ইনেস। কিন্তু তুমি ছিলে না।’

রাগে, দুঃখে, অসহায়তায় বের্নহার্ড একদম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। ইনেস তার নামে একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে গের্টের কাছে।

‘প্রিয় বের্শেন,

আমি তোমাকে বিদায় জানিয়ে যেতে পারিনি বলে মন খারাপ করবে না। তোমায় তিন বার ফোন করেও কথা বলতে পারলাম না। আমি জানি না বিষয়টা আসলে ঠিক কী। কিন্তু আমার মনে হল ইচ্ছাকৃত তোমাকে ফোনে ডাকা হয়নি। তুমি যদি এমন কিছু করে থাকো, যেটা তোমার ঠাকুমা কিম্বা বাবা-মায়ের অপছন্দ, তাহলে সেই বিষয়ে তাড়াতাড়ি মিটিয়ে নাও পরিবারের মধ্যে কথা বলে। যদি আমাদের কোনও কাজকর্ম ওঁরা বুঝতে না পেরে থাকেন, সেক্ষেত্রে সেটা বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের উপরেই বর্তায়। কারণ, আমাদের সামনে এখন গোটা জীবনটা পড়ে আছে। ভাল থেকো, খুশি থেকো আর আমার চিঠির উত্তর দিও।

ইতি,

তোমার প্রিয় বন্ধু ইনেস’



গের্ট তার কাঁধের উপর উঁকি দিয়ে চিঠিটা পড়ে ফেলেছিল। সে ক্রমাগত জিজ্ঞেস করে যেতে লাগল যে বের্শেন কী এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।

চিঠিটার দিকে তাকিয়ে বের্শেন বলে… ‘কিচ্ছু না।’

গের্ট চিন্তান্বিত মুখে বের্নহার্ডের চুলে টোকা মারে।

‘কিন্তু কিছু একটা কাণ্ড তো নিশ্চয়ই তুমি ঘটিয়েছ বের্শেন। যদি ইনেস এখানে উপস্থিত থাকতো, তাহলে কি তুমি তাকে সেই কাণ্ডটা বলতে? এখন সে এখানে নেই, ফলে আমি হয়তো বুঝতে পারব না, সেইজন্য বলছ না আমায়?’

বের্নহার্ডকে নিরুত্তর বসে থাকতে দেখে অবশেষে সেও চুপ করে। ধীরে ধীরে তার মাথার চুলে টোকা মারে।

বের্নহার্ড হঠাৎ নিজের হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে হাহাকার করতে থাকে, ফেটে পড়ে দুঃখে… ‘আমায় ওঁরা আর তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে দেবেন না।’

গের্ট সাঙ্ঘাতিক অবাক হয়। বের্শেনকে টেনে নেয় তার কাছে। হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে… ‘এর চেয়ে যদি বেশি কিছু না ঘটে থাকে… তো… কিন্তু ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর!’

‘আগামীকাল আমায় বাড়ি চলে যেতে হবে… ছুটি পড়বে।’

‘খুশি থাকো, বের্শেন, তোমার একটু ছুটি খুব প্রয়োজন!’

‘এবং হয়তো তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমি আর নাও ফিরতে পারি!’

গের্ট চুপ করে বসে থাকে এক মুহূর্ত।

-‘কিন্তু বের্শেন!’ বলে ওঠে গের্ট… ‘আমিও যে এখানে একা থাকতে পারব না। ইনেস চলে গেছে… আবার তুমিও… আমি কী ভাবে থাকব যদি তুমিও এখানে না থাকো?’ গের্ট দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে একদম চুপ করে বসে থাকে। অবাক হয়ে বের্শেন লক্ষ্য করে যে গের্ট অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে আছে। বের্শেন চলে যাচ্ছে বলে গের্টের চোখে জল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বের্শেনের গলা জড়িয়ে ধরে।

শিক্ষকের কাছে চিঠি লেখে বের্নহার্ড ফরাসি ভাষায়,


মঁসিয়ে,

আপনাকে আমার পরিস্থিতি বিষয়ে অবগত করাবার জন্য নিঃসঙ্কোচে এই পত্র লিখছি। আপনি যখন পারী নগরে গিয়েছিলেন, তখন আমি জানতাম না যে এত শীঘ্র নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি স্থির করবার জন্য কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। বর্তমান সময়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত যে আমি যে কোনো চাকরিতে যোগ দেব নাকি আপনার নির্দেশিত পথে আপনার সঙ্গে পারী শহরে গিয়ে নিজের সঙ্গীতপ্রতিভা প্রমাণ করবার জন্য আরও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াব। আমার পিতা অর্থনৈতিক সমস্যায় আছেন এবং তিনি চান যেন আমি এখনই স্কুল ত্যাগ করি। পিতা আমাকে খুব বেশি অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে সক্ষম হবেন না। ফলে আমি যদি পারী নগরে যাই, সেখানে আমাকেই উপার্জন করতে হবে। যদি আপনি আমাকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে অবশ্য আমি সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব এবং সবক্ষেত্রে সফলতা লাভ করব, এমন আশা রাখি।

আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আপনার একান্ত অনুগত ছাত্র,

বের্নহার্ড


বাড়ির পরিবেশ যে সাঙ্ঘাতিকভাবে বদলে গেছে, ব্যাপারটা এমন নয়। বাবা মা যেভাবে থাকতেন বোন মনিকে নিয়ে, তেমনটিই আছেন। তবে বাড়ির ঘোড়াগুলো এবং গাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির চারপাশে যে জমিগুলো ছিল, সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে। চাকরবাকর যারা ছিল, সব একে একে বিদায় নিচ্ছে। শুধু যে পুরনো বৃদ্ধ গাড়োয়ান ছিলেন, তিনি এখন থেকে গৃহভৃত্য হিসেবে থাকবেন। মনির আয়া, যিনি শিশুকালে বের্নহার্ডকেও দেখাশোনা করতেন, তিনিও থাকছেন।

যেহেতু আগে থেকেই ঠিক ছিল যে বের্নহার্ড সঙগীত নিয়ে পড়াশুনা করবে এবং পারী শহরে যাবে, সেহেতু তার অবস্থান কিছুটা বদলে গেছে বাড়িতে। ফলে সারাদিন সে যাইই করুক না কেন, তাকে কেউ কিছু বলে না এবং তার উপরে সাঙ্ঘাতিক কঠোর বিধিনিষেধ কিছু আরোপ করা হয়নি। সে যখন পিয়ানো অভ্যাস করে, তখন কেউ তাকে বিরক্ত করে না। অর্থাৎ তার ক্রিয়াকলাপ আগের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এখন।

বের্নহার্ড মনির সঙ্গে অনেকটা সময় ধরে কথোপকথন চালিয়ে যায়। জঙ্গলে হাঁটতে যায় তারা। মনির ছোট হাত ধরে থাকে সে এবং তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেয়। মনি খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং ধৈর্য ধরে সে তার সব কথা শোনে। হাঁটতে হাঁটতে মাথাটা একদিকে একটু হেলিয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনে যায় মনি।

-‘বের্শেন’… মনিই সাধারণত প্রথমে বাক্যালাপ শুরু করে এবং তার মিষ্টি গলায় নিজের নামটা শুনতে বের্নহার্ডের খুব ভাল লাগে … ‘বের্শেন, তুমি তো চলে যাবে শুনলাম… তা তুমি ফিরবে কবে?’

-‘সে তো জানি না, মনি!’

-‘জায়গাটা কি অনেক দূর?’

-‘নাহ, খুব বেশি দূর নয়। তুমি যদি আমায় চিঠি লেখ, আমি পরদিন সন্ধেবেলার মধ্যেই সে চিঠি পেয়ে যাব।’

-‘কিন্তু আমি তো লিখতে শিখিনি এখনও।’

-‘তুমি মা’কে বলে দেবে তোমার যা বলার। মা লিখে দেবেন তোমার হয়ে।’

-‘তুমিও আমায় চিঠি লিখবে তো?’

-‘অবশ্যই লিখব… আর তুমি যদি চাও তোমার জন্য খেলনাও পাঠাতে পারি।’

-‘ওঃ, অবশ্যই বের্শেন। অবশ্যই চাই।’

-‘সেইজন্য কি তুমি আমাকে একটা চুমু দেবে এখন?’

-‘অনেকগুলো দেব। কিন্তু তার জন্য তোমাকে নিচু হয়ে বসতে হবে। কারণ তোমার মুখ অবধি আমি উঠতে পারব না। আমার মনে হয় যে তোমার মুখটা খুব সুন্দর!’

বের্শেন একটা গাছের গোড়ার কাছে উঁচু শিকড়ের উপরে বসে মনির হাতটা ছেড়ে দিয়ে। শিশুটি তার সামনে চুপ করে গম্ভীরমুখে দাঁড়ায়… ‘বের্শেন, তোমার কি মনে হয় আমার মুখটাও সুন্দর?’

‘খুব’ বলে ওঠে বের্নহার্ড… ‘খুব সুন্দর, বিশেষভাবে সুন্দর!’

এবং এই কথাটা যে শুধুই তার মনে হয় এমন নয়। সে অন্তর থেকে অনুভব করে। মনির ছোট্ট মুখটা ভারি সুন্দর। তার কমনীয় ত্বক সূর্যের রশ্মিতে একটু লাল হয়ে গিয়েছে, তার বড় বড় চোখ যেন আলোর শিখার মত, নাকি তারার মত উজ্জ্বল। অসম্ভব মনে হয় বের্নহার্ডের কাছে মনির চোখের সঠিক কোনো উপমা খুঁজে বের করা… একটু ঢেউ খেলানো সোনালি চুল খুব ভারি নয়, রেশমের মত মসৃণ, মোলায়েম, ফুরফুরে। সবচেয়ে সুন্দর মনির হাতদু’খানি। সাধারণ শিশুদের মত নরমসরম গোলগাল নয় তার হাত। রোদ্দুরে লালচে হয়ে ওঠা সুঠাম হাতে সুগঠিত আঙুলগুলো, হাতের পাতার উপরিভাগে শিরা জেগে আছে। ক্ষুদ্র হাতের এই নীলচে চকচকে শিরাগুলি দেখতে অপূর্ব বলে মনে হল বের্নহার্ডের।

‘মনি’ বলে বের্নহার্ড… ‘চুমু কই?’


(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in





বাইশ

রাজবাড়ি তার জৌলুস হারালেও পুজোর রীতি নীতি, জৌলুস কোনওটাই কমেনি আজও। অতীতের নিয়ম মেনেই পূজিত হন দেবী পটেশ্বরী। প্রতিপদ থেকে এই পুজো শুরু হয়ে যায়। এই পুজো নাকি বর্ধমানের রাজা মহাতাব চাঁদ শুরু করেছিলেন। কাঠের পটের উপর নানান রঙ দিয়ে আঁকা হতো দশভূজাকে। এখানে কেবল গণেশের দুটি চোখ দেখা যায়। বাকি সকলেরই দেখা যায় একটি করে চোখ। এমন ভাবেই আঁকা হয় এই পট। এই বাড়িতে আজও আছে বলি প্রথা। তবে পাঁঠা নয়, বলি হয় মিষ্টির। আগে অবশ্য কুমড়ো বলি হতো। নবকুমারীর পুজোও হয় এই বাড়িতে অষ্টমীর দিন। সমীরণ বলে,বীরভূমের পট নিয়ে প্রচুর কিছু লেখা না হলেও কিছু মূল্যবান আলোচনা রয়েছে। যাদু পটুয়াদের কথা লিখেছেন ও’ম্যালি, গৌরীহর মিত্র প্রমুখ। এই পটুয়াদের সঙ্গে হাট সেরান্দির পটশিল্পীদের পার্থক্য রয়েছে।এখানকার পটশিল্পীরা সূত্রধর সম্প্রদায়ের। পটের সঙ্গে গান এঁরা করেন না। কেবলমাত্র দুর্গার পট আঁকা/লেখা ছাড়া অন্য পটও করেন না। সে দিক থেকে অন্যান্য পটুয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই পটশিল্পীদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে, এমনটা বলা যায় না। কিন্তু শোনা যায়, হাট সেরান্দির সূত্রধর শিল্পীদের পূর্বপুরুষ রাজারাম এসেছিলেন অজয়পাড়ের ভেদিয়া থেকে। তিনিও পটের শিল্পী ছিলেন। ভেদিয়া নামটির উৎস কেউ কেউ‘বেদিয়া’ বলে গণ্য করা হয়। বেদিয়াদের মধ্যে পটশিল্পীদের গোষ্ঠী রয়েছে। আসলে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি একটি অন্যটির সঙ্গে কোথাও না কোথাও জুড়ে রয়েছে। এই যোগসূত্রগুলি খুঁজে দেখা দরকার। যাই হোক, বর্তমানে আমরা সূত্রধর শিল্পীদের মধ্যে পট আঁকার প্রায় দুশো বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস পাচ্ছি। রামকৃষ্ণ সূত্রধরের পিতা আদরগোপাল, তাঁর পিতা কালীপদ, কালীপদের পিতা শিবরাম, শিবরামের পূর্বে দ্বারিকানাথ, তদূর্ধ্ব রাজারাম। এ ভাবেই পারিবারিক ইতিহাস বাহিত হয়েছে। সূত্রধরদের মধ্যে প্রবীণ মানিকচাঁদ গুণী শিল্পী। এই সম্প্রদায়ের বাইরে রয়েছেন রত্নাকর মেটে। পটশিল্পের ইতিহাস নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। আমার উদ্দেশ্য বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে কিছু কথা বলা।

সমীরণ নিজের আশ্রমে বেশিদিন তাকে না।এবার রিমি ও বিপিনকে নিয়ে চলে এলো কালনা ঘুরতে।সমীরণ বলে,পূর্ব বর্ধমান জেলার উল্লেখযোগ্য শহর অম্বিকা কালনা।ছোটথেকেই শুনে আসছি কালনা শহরের ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের কথা।দেখার সৌভাগ্য হল ডি এল এড পড়ার সুবাদে।কালনা নবকৈলাস মন্দিরের ১০৯টি মন্দিরের মধ্যে ১০৮টি মন্দির জ্যামিতিক বৃত্তে বিন্যস্ত। দুটি বৃত্তে বিন্যস্ত এই মন্দিরগুলির বাইরের বৃত্তে ৭৮টি এবং ভেতরের বৃত্তে মোট ৩৪টি অবস্থিত। বৃত্তের বহির্দেশে, পশ্চিমদিকে ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি অবস্থিত। বৃত্তের মধ্যে অবস্থিত ১০৮টি মন্দির আটচালার আকৃতিতে নির্মিত। ভিতরের বৃত্তের পরিধি প্রায় ৩৩৬ ফুট এবং বাইরের বৃত্তের পরিধি ৭১০ ফুট। এই মন্দিরগুলি স্বল্প উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত এবং মন্দিরগুলি পরস্পর সংলগ্ন। মন্দিরগুলির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট এবং প্রস্থ ৯.৫ ফুট। এই মন্দিরের দেয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের পর্ব এবং শিকারের বহু দৃশ্যও চিত্রিত রয়েছে। ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি আটটি সিঁড়িবিশিস্ট বারান্দার উপর অবস্থিত । এর মন্দিরটি ৬ ফুট উচ্চ ভিত্তিবেদীর উপর অবস্থিত, যার আয়তন ১৩ ফুট X ১৩ ফুট এবং উচ্চতা ৩৫ ফুট। এই মন্দিরটির বর্তমান নাম জলেশ্বর।বৃত্তদুটির কেন্দ্রে একটি বাধানো ইঁদারা আছে যা মন্দিরের পূজার কাজে ব্যবহৃত জলের চাহিদা মেটায়। তবে অনেকে মনে করেন এটি শূণ্য অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মস্বরূপ শিবের প্রতীক।

বর্ধমান রাজপরিবারে বৈষ্ণব ভাবধারা প্রচলিত ছিল। গঙ্গার অবস্থিতি এবং বৈষ্ণব পাট হিসেবে পরিচিত হওয়ায় বর্ধমান রাজপরিবার কালনাতেও আবাসস্থল এবং বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মন্দির স্থাপন করে। রাজপরিবারের সদস্যরা কালনায় গঙ্গাস্নানে যেতেন। এই উদ্দেশ্যে বর্ধমান এবং কালনার মধ্যে ১৮৩১ সাধারণাব্দে রাজপথ নির্মাণ করান তেজচন্দ্‌। এই সঙ্গে নির্মিত হয় প্রতি আট মাইল অন্তর জলাশয়, বাংলো, আস্তাবল ইত্যাদি। ভোলানাথ চন্দ্র প্রণীত 'ট্রাভেলস অব আ হিন্দু' (লন্ডন, ১৮৬৯) এবং ডব্লু ডব্লু হান্টারের 'আ স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল' (১৮৭৬) উদ্ধৃত করে বলা যায় যে, গঙ্গার ধারে ছিমছাম সুন্দর শহরের রূপকার বর্ধমান রাজপরিবার। কালনা ছিল বর্ধমান জেলার একমাত্র বন্দর এবং মূল বাণিজ্যকেন্দ্র। জেলার বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানি হত কালনা বন্দরের মাধ্যমে। কালনা পুরসভার অস্তিত্ব পাওয়া যায় ১৮৭১ সাধারণাব্দে। ১৮৭২-য় কালনার জনসংখ্যা ছিল ২৭,৩৩৬। 'ক্যালকাটা রিভিউ' পত্রিকায় রেভারেন্ড জেমস্‌ লং-এর রচনা থেকে জানা যায় যে, কালনা বাজারে ইটের তৈরি এক হাজার দোকান ছিল। রংপুর, দেওয়ানগঞ্জ এবং জাফরগঞ্জ থেকে প্রচুর পরিমাণে চাল কিনে মজুত করা হত কালনায়। খাদ্যশস্য, সিল্ক, তুলো ইত্যাদি ছিল প্রধান পণ্যদ্রব্য।

এ হেন কালনা রাজবাড়ি চত্বরের সবচেয়ে পুরোনো পঁচিশচূড়া মন্দিরটি হল লালজি মন্দির। ১৭৩৯ সাধারণাব্দে মন্দিরটি নির্মাণ করান বর্ধমানের জমিদার কীর্তিচন্দ্‌-জননী ব্রজকিশোরী দেবী। মন্দিরের প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তি। 'লালজি'-র নামকরণের পিছনে তেমনই একটি কিংবদন্তি আছে।

কালনা ভ্রমণ শুরু করলাম চকবাজার এলাকায় অবস্থিত বিখ্যাত নবকৈলাস দর্শনের মধ্যে দিয়ে যা ১০৮ শিবমন্দির বলে পরিচিত। অম্বিকা কালনা ষ্টেশন থেকে টোটো করে চলে এলাম শহরের প্রানকেন্দ্রে ১৮০৯ সালে বর্ধমানের রাজা তেজ বাহাদুর কতৃক প্রতিষ্ঠিত অপরূপ শিল্পের এই একচালা মন্দির প্রাঙ্গণে। দুটি বৃত্তের মধ্যে ৪টি প্রবেশদ্বার নিয়ে ৭৪টি মন্দির বাইরে ও ভিতরে ৩৪টি মন্দির রয়েছে। বাইরের ৭৪টি মন্দিরে একটি সাদা শিবলিঙ্গ ও পাশেরটি কালো শিবলিঙ্গ এবং ভিতরের ৩৪টি মন্দিরে সাদা পাথরের শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দিরের প্রত‍্যেকটি শিবলিঙ্গ উওরমুখী এবং শিবলিঙ্গগুলোর অবস্থান ও কিছুটা ভিন্ন। মন্দির প্রাঙ্গণের কেন্দ্রস্থলে লোহার জাল দ্বারা পরিবেষ্টিত এক জলাধার রয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে ৩৪টি শিবলিঙ্গ একসাথে দেখা যায়। অদ্ভূত এক চিন্তা চেতনা ও ভাবনার নিদর্শন হচ্ছে এই নবকৈলাস বা ১০৮ শিবমন্দির।প্রখর বুদ্ধিমতী ব্রজকিশোরী তাঁর রাধিকা মূর্তির সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন এক সন্ন্যাসীর কাছে থাকা শ্যামরায়-এর এবং রাজ-জামাতা 'লালজি'-র আবাসস্থল হিসেবে অনন্য শৈলীর দেবালয়টি নির্মাণ করিয়ে ছিলেন।