0

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in






মঙ্গল গ্রহে মানুষের উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনা ইলান মাস্ক এক দশক আগেই করে ফেলেছেন । তার জন্যেই তিনি ইতিহাসের সব চাইতে বড় রকেট স্টারশিপ বানিয়েছেন । তার উৎক্ষেপন দেখিয়ে তিনি বিশ্ববাসীকে তাকও লাগিয়েছেন ।

এবার মূল ভাবনায় এসেছে সেখানকার শাসন ব্যবস্থা ও নানান পরিকল্পনার ব্যাপার। তিনি ভাবছেন গ্রীসের মতন প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক আবহাওয়ার ব্যবস্থা করতে। ওনার ভাবনাতে এটা পরিস্কার যে সেখানকার শাসন ব্যবস্থা পৃথিবী গ্রহের গণতান্ত্রিক দেশ গুলোর মতন হবেনা । কারণ ব্যবস্থাটার গতিপ্রকৃতির নির্ধারক সেইখানকার অর্থনীতি , প্রযুক্তি , নিরাপত্তার উপর ।

তৈরি হবে এক নতুন সামাজিক শ্রেণী, সেটা কেমন হবে সেটাও এক বড় নির্ধারক।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু প্রশ্ন আসে । মনে পড়ে , ইলন মাস্ক কি চাইছেন এক ময়না দ্বীপের মতন জায়গা তৈরি করতে – মানিক বাবুর ‘পদ্মা নদির মাঝির’ আদলে । যেখানে মানিক বাবু যেমন চেয়েছিলেন – তার পছন্দের দ্বীপ , যেখানে থাকবেনা কোনো ধর্ম , শাসনব্যবস্থা আসবে সমাজ তন্ত্রের ছোঁয়ায় ।

ভিতরে ঢুকলে বা উপন্যাসের অন্তরে গেলে দেখা যায় বা বোঝা যায় তার সাধের ময়নাদ্বীপ কেমন হবে । কি তার সম্ভাবনা , কতটা বাস্তব , কতটা গ্রহনযোগ্য ।

এটাও দেখতে হবে, ইলন মাস্ক কি মঙ্গলগ্রহে আদতে ময়নাদ্বীপের মতো কোনো নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছেন বা দেখাতে চাইছেন? তার আগে একবার স্মরণ করা যাক, হোসেন মিয়ার সেই ময়নাদ্বীপ কেমন রাষ্ট্র বা সমাজের ইঙ্গিত দেয়।

মানিক নতুন করে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে এক নতুন সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করতে চান সেখানে—এমনই ইঙ্গিত মেলে। তিনি তখনো পুরোপুরি মার্ক্সবাদী কিনা সেটি নিয়ে হয়তো বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু নতুন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা চেতনায় ও চিত্তে ধারণ করেছিলেন সেটি পরিষ্কার। মূলত সেই স্বপ্নেরই প্রারম্ভিক একটি পরীক্ষা–নিরীক্ষার স্থল সম্ভবত ময়নাদ্বীপ।

আপাতদৃষ্টিতে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে সবকিছুর ঊর্ধ্বে এক নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ার প্রয়াস দেখা যায় ময়নাদ্বীপে। দ্বীপে মসজিদ, মন্দির কোনোটাই বানানো হবে না, সব লৌকিক ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ হবে ময়নাদ্বীপ।

কিন্তু হোসেন মিয়ার কাছে প্রথম অগ্রাধিকার সেখানে মানুষের প্রজনন। দ্রুত সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে দ্বীপকে জনবহুল করে তুলতে চান তিনি। এটা অনেক দিশা দেখায় , মনে হয় দ্বীপের লোক বাড়াতে হবে – স্বাভাবিক – কারণটা মানা যায় অন্যাটা ধর্মের তাড়নায় বংশবৃদ্ধির যে প্রথা তাকে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে কিনা সেটাকেও বুঝে দেখার জায়গাটাকে রাখতে হবে । তবে দুটোই কিন্তু হোসেন মিঞাকে সামনে রেখেই বলা হচ্ছে – কাজেই বিষয়টা খুব যে পরিস্কার বলা সে কথা বলা যায়না।

গণতন্ত্রের কথাও কি বলেছিলেন হোসেন মিয়া? না, কারণ সেখানে হোসেন মিয়া সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তিনিই ঠিক করে দেন সেখানে কার শাসন চলবে। আপাতত শ্রেণিহীন এক সমাজের খোদা হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায় তাঁর প্রতিটি কথায়, তৎপরতায়। কাজেই সেই ই হবে ধর্মের নিয়ন্ত্রক – নিজের ধর্মকে রাখার চেষ্টা থাকতেই পারে । ধর্মহীন সমাজের কথা বোধ হয় ভাবা যাচ্ছে না ।

মাস্ক খাঁটি গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতার অবতার হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। তথাকথিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের (লিবারেল ডেমোক্রেসি) বড় সমালোচক মাস্ক। এই গণতন্ত্র সমাজের একটি বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব তো করেই না, বরং এই ব্যবস্থার উপাদান ও হাতিয়ারগুলো ওই বৃহৎ অংশকে প্রান্তিক করে রাখার আয়োজন করে রেখেছে—এমনই মত ইলন মাস্কের।

এবার মঙ্গলে মানুষের শাসনব্যবস্থা নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার ধারণা দিয়েছেন। এক কথায় সেটিকে গ্রীসের ধাঁচে ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’ বলেই অভিহিত করেছেন।

বলা বাহুল্য সেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পৃথিবী গ্রহের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো হবে না। সেই ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে সেখানকার অর্থনীতি, প্রযুক্তি, নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি সামাজিক শ্রেণি।

মাস্ক যখন জনপ্রিয় মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার (পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখেন এক্স) ৪৪ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেন, তখন বলেছিলেন, তাঁর অধীনে টুইটার হয়ে উঠবে বাক্‌স্বাধীনতা চর্চার প্রধান ক্ষেত্র। মালিকানা নেওয়ার পর অনেক বিতর্কিত অ্যাকাউন্ট যেগুলো ভুল তথ্য, অপতথ্য, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, বর্ণবাদ ও উসকানিমূলক তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো ফেরত আনেন মাস্ক।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীলদের পাশে দাঁড়িয়েছেন ইলন মাস্ক। নব্যরক্ষণশীলদের অবতার ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম আমলে সরাসরি সমর্থন না জানালেও এবার সরাসরি তিনি তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে তহবিল জোগান দিয়েছেন। এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের জন্য মনোনীত হয়েছেন। তাঁর কাজ হবে আমলাতন্ত্র সংকুচিত করে সরকারের অনুন্নয়ন ব্যয় কমানো

এই নব্যরক্ষণশীলদের নিয়ে লিবারেলদের সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, এরা সেই অর্থে রক্ষণশীল নয়, যারা ঐতিহ্যগতভাবে বিদ্যমান ব্যবস্থার রক্ষক হিসেবে তৎপর থাকে। এই নব্যরক্ষণশীলেরা বিদ্যমান ব্যবস্থা ভেঙে ঢেলে সাজাতে চায়। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি ও করপোরেট আঁতাত ভেঙে দেওয়ার কথা বলে। আধুনিককালের দৃষ্টিভঙ্গিকে সামাজিক সংহতি ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর মনে করে। বঞ্চিতদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা কখনো স্পষ্ট হয়নি। তাদের প্রতিশ্রুত ব্যবস্থাটি শুধু তারাই ভালো জানে!

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবতার হোসেন মিয়া যেমন ময়নাদ্বীপে এমন এক ব্যবস্থার কথা বলে সেটিও অস্পষ্ট, শুধুই ইঙ্গিতময়। সেটি এক শ্রেণিহীন সমাজ, যেখানে সবকিছু চলে একক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর শর্তে।

ইলন মাস্ক ও ডোনাল্ড ট্রাম্প নেক্সাস কোন ধরনের ব্যবস্থা চান সেটিও পরিষ্কার নয়। প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প তাঁর অনেক প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এবারও পারবেন এমন সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকেরা।

মাস্ক বলছেন, মঙ্গলেও তিনি গণতন্ত্রই চাইবেন। তবে সেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেমন হবে সেটি তিনি সেখানকার বাসিন্দাদের হাতেই ছেড়ে দিতে চান। কথাটি আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ ও সরল মনে হলেও তিনি যে হোসেন মিয়ার চরিত্রে আবির্ভূত হবেন না সেটি বলা যায় না।

কিন্তু ময়না দ্বীপ তো মার্ক্সবাদী ধারণার সাথে মেলে না। এটা তো এক অর্থে উপনিবেশ। হোসেন মিয়া যার সর্বময় ক্ষমতার মালিক। ময়না দ্বীপকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সমাজব্যবস্থা মনে করতে গেলে তো হোসেন মিয়াকে মার্ক্সবাদী বলতে হয়! যা আদপেই অসম্ভব ও হাস্যকর। বুঝলাম, হোসেন মিয়া হয়ত অনন্ত তালুকদারের মত (এ উপন্যাসের ভূস্বামী) পুরোপুরি শোষক শ্রেণির নন। কিন্তু তিনি তো বুর্জোয়া সমাজেরই একজন প্রতিনিধিত্বকারী, খেটে খাওয়া মানুষদের সাথে যার শ্রেণিগত দূরত্ব অনেকখানি। তার হাতে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আসবে এটা মানিক নিজেও বিশ্বাস করতেন না।

হোসেন মিয়ার অনেক ধূর্তামি তো তিনি নিজ বয়ানে বা কুবেরের চোখ দিয়ে উন্মোচন করে দিয়েছেন।
আর ময়না দ্বীপে ধর্ম নেই এটাও তো ঠিক নয়। হোসেন মিয়া যতই বলুক তার দ্বীপে মসজিদ মন্দির কোনটাই হবে না, অর্থাৎ সব লৌকিক ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজ হবে তার দ্বীপ, কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি প্রচলিত ধর্ম না থাকলেও নতুন একটি ধর্ম তো থাকছেই, হোসেন মিয়ার তৈরি করা ধর্ম। হোসেন মিয়া যেখানে অঘোষিত খোদা। তারও আছে কিছু নিয়মকানুন।

সন্তান জন্মদানে অক্ষম নারী পুরুষের কোন মূল্য নেই তার দ্বীপে। তাই বৃদ্ধ বশিরের স্ত্রীর সাথে যুবক এনায়েতের সাথে অবৈধ প্রণয় স্বীকৃতি দিয়েছেন হোসেন মিয়া। মানলাম যুক্তি আছে , দ্বীপের জনসংখ্যা বাড়াতে হবে – বন্ধ্যা নারীর প্রয়োজন সেখানে থাকবার কথা নয়।

কেতুপুরে বরং তারা হোসেন মিয়াকে এতটা ভয় করে না, কিন্তু ময়না দ্বীপে গেলে তো তারা পুরোপুরি অসহায়। হোসেন মিয়ার মতের বাইরে যায় এমন সাহস সেখানে কোথায় তাদের! আর ময়না দ্বীপে তো তারা কেউ স্বেচ্ছায় যায় না। যায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে।
কাজেই প্রশ্ন থেকে যায় কেন উপন্যাসের পরিণতি হয়েছে একটি কল্পিত দ্বীপে নিক্ষিপ্ত হবার মধ্যদিয়ে।

মার্ক্সবাদী চিন্তাচেতনার সাথে আদতেই মেলানো যায় না এই রহস্যপূর্ণ আধো চেনা ময়না দ্বীপকে। ময়না দ্বীপে দেড় হাজার নারী পুরুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম অদ্ভুত ইচ্ছার বাইরে হোসেন মিয়ার আর কোন ইচ্ছা নেই এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। হোসেন মিয়ার চরিত্রের সাথে তার এ আকাঙ্ক্ষা মেলে না। বরং এর ভিতরে যে তার একজন সামন্তপ্রভু হয়ে উঠার আকুতি বিদ্যমান তা বুঝতে পাঠকের খুব বেগ পেতে হয় না। কুবেরের ময়না দ্বীপে আসা মানে ধীরে ধীরে একটা সময় পুরো জেলে পাড়াই এখানে উঠে আসবে। জেলে জীবন ত্যাগ করে পুরোপুরি শ্রমিক জীবন। তাতে কি তাদের মানসিক বা অর্থনৈতিক কোনক্ষেত্রেই বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হবে?

বুঝতে পারছি মানিক একটা পরিবর্তন চেয়েছেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষিত জেলেপাড়ার অচলাবস্থায় চেয়েছেন একটা ধাক্কা দিতে। মানিক তখন ধীরে ধীরে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিচ্ছেন। নতুন সমাজব্যবস্থার চিন্তা তার চেতনায় জন্ম নিতে থাকে। ময়না দ্বীপ সেই চিন্তারই ফসল বলে সমালোচকদের ধারণা। এ ধারণা হয়ত অমূলক না,

তবে নতুন এই সমাজ ব্যবস্থা এর ভিতর দিয়েই সমাজতান্ত্রিক ধারায় বিনির্মিত নিশ্চয়ই না। বরং তা সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থারই অন্য রূপ। শোষণের রূপ বদলেছে, মাত্রা কমেনি। ধর্মীয় শিকলও আছে, ভিন্ন পরিচয়ে। মানিকের সাম্যবাদী চেতনা এখানে হোসেন মিয়ার প্রভুত্বে হোঁচট খেয়েছে। তিনি জানতেন, বিদ্যমান অচলাবস্থা না ভাঙ্গলে শোষিত শ্রেণির মুক্তি নেই। কিন্তু সেই অচলাবস্থা ভাঙ্গার পথ কিরকম হবে, তা মানুষের প্রকৃত মুক্তি আনবে নাকি নতুন কোন শিকলে বন্দী করবে মানিক কি বিষয়টি সম্পর্কে তখনও পরিষ্কার নন?
মাস্কের ভাবনার সেই নতুন মঙ্গলগ্রহতে কি আমরা আবার ঐ বাধ্য হওয়া , অজানা ভাবনার সমুদ্রে ঝাঁপ দেব , যেমনটা ময়নাদ্বিপে যাওয়ার মানুষদের মধ্যে কাজ করছিলো । মানিক বাবু নিজেও বোধ হয় খুব একটা পরিস্কার ছিলেননা – ঐ সেখান কার ( ময়নাদ্বীপের ) গঠনতন্ত্র বা পরিচালন সম্বন্ধে , তাই ওনাকে ভরসা করতে হয়েছিলো হোসেন মিঞার উপর ।

এরকমটা হয়েই থাকে । আর সেটা যে খুব একটা কাম্য নয় সেটাও পরীক্ষিত ।

0 comments: