0

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






ভোর রাত্রের একটা দৃশ্য এরকম – একটা ঘরের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসছে রমণ ও শীৎকারের শব্দ। হরিদাস প্রভাতী নাম সংকীর্তন করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে – তার শব্দ। দূর থেকে এগিয়ে আসছে মৃতদেহ কাঁধে শ্মশানযাত্রীর দল। হরিনাম ধ্বনি ও তাদের খোলকরতালের শব্দ। এতো কিছু শব্দ মিলে সেই ভোর রাত্রের যে অনুনাদ বা রেসোনেন্স তৈরী হলো, তাতেই এই দুনিয়ায় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেলো। পৃথিবীর সময় উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করলো। যে মৃত যুবতীটি একটু আগেই কবরে শুয়ে ছিলো, সে জীবিত হয়ে উঠে এলো। ১৯৮০ সাল ১৯৮১র দিকে না গিয়ে এই দুনিয়ার সময় এগোতে লাগলো পেছনে, ১৯০০ সাল বা প্রাচীন পৃথিবীর দিনগুলোর দিকে। আমরা দেখলাম, এখন যে যুবতীটি মৃত, সে বেঁচে উঠেছে, ঘড়ির কাঁটা আরো পেছনে ঘুরতেই সে ধর্মযাজক দ্বারা ধর্ষিতা হচ্ছে! পৃথিবীর সময় আরো আরো পেছোচ্ছে, সোনার দাম কমছে। সেসব দিনগুলোয় আগের মতো দূষণ বা পল্যুশন নেই, সুন্দর একটা প্রাকৃতিক পরিবেশ। গল্পকারের দারুণ কল্পনাশক্তি, অসাধারণ পরাবাস্তবতা! এমনটাই লেখে সুবল দত্ত - তার ‘সময়-শোধন’ গল্পে। ঘড়ির কাঁটাকে এরকম পিছিয়ে নিয়ে গেলে আজকের মানুষ বুঝতে পারবে তাদেরই সমূহ ভুলভ্রান্তি। সত্যিই তো, নিজেদের সংশোধনের জন্যে আমাদের অতীতের থেকে শিক্ষা নেয়াটা বড় জরুরী। সময়কে পেছনে নিয়ে যেতে যেতে নানা ঘটনা পরম্পরাকে দেখিয়ে দিতে দিতে, এই গল্পের পরিসমাপ্তিতে লেখক ঘোষণা করলো- মানবতার বিরুদ্ধে সমস্ত জটিল কার্যকলাপ মুছে যাচ্ছে। এরপরে শুভবুদ্ধির প্রতিশ্রুতি। পৃথিবীর সময় আবার আগের মতোই সামনের দিকে এগোচ্ছে। দারুন এ গল্প – অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ভাবনা ! এখানেই গল্পকার সুবল দত্তের স্বকীয়তা!
সুবল দত্ত এসময়ের একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার। মিডিয়া প্রভাবিত দুনিয়ায় বহির্বঙ্গের এই গল্পকারের পরিচিতি অপেক্ষাকৃত সীমাবদ্ধ। যে ব্যপক পরিচিতি ও প্রচার তার প্রাপ্য , তা তিনি হয়তো এখনো পান নি। সুবল দত্তর সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৬ নাগাদ। থাকেন জামসেদপুরে। তার জন্ম পুরুলিয়ার মানবাজারে – ১৯৫৫ সালে। পেশায় স্টেট ব্যাঙ্ক-এর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। চাকুরী সূত্রে তাকে বিহার ঝাড়খন্ডের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়েছে। ওই অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের জীবনযাত্রা , ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি বেশ কিছুটা পরিচিত। লেখক জীবনে তার প্রাথমিক আত্মপ্রকাশ কবি হিসেবে। গল্পও লিখেছেন। প্রসঙ্গত এটাও উল্লেখ করা যায়, সুবল দত্ত একজন শিল্পী – তার করা প্রচ্ছদ রয়েছে আমার কাব্যগ্রন্থ ‘অনন্ত জলশব্দে আমি’ তে। এযাবৎ তার দুটো গল্পগ্রন্থ – ‘প্ল্যাগিয়ারিস্ট’ ও ‘প্রদাহবোধ ১১’, যা প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে। তার প্রৌঢ়ত্বে, রিটায়ার-সময়ের কাছাকাছি। সুবল দত্তের বইদুটো হাতে আসার পর তার গল্পের উপর আমার ভীষণ আগ্রহ জন্মায়। তাই আমি চেষ্টা করেছি তার গল্পকে বোঝবার, তাকে নিয়ে সামান্য লেখবার।
‘শৈলী’ পত্রিকার ৪৭তম / কার্তিক-১৪২৬ সংখ্যা এখন আমার সামনেই। এতে প্রকাশিত হয়েছে সুবল দত্তের একটা গল্প – ‘ইন্দে ইয়লো সামান গে তন্নো’। আমি এই গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ি। দেখি - একটা তামিলভাষী ভিখিরি গোছের মানুষ, তাকে বুঝিয়ে বাজিয়ে টাকার বিনিময়ে কিনে নেয়া হলো, কেনা হলো লোকটার একটা কিডনী, যেটা অপারেশন করে লাগিয়ে নেয়া হলো পয়সায়ালা মালিক মিহির সিং এর শরীরে। সুস্থ হয়ে কিছুদিন বাদে মিহির সিং এক রাত্রে সুপারভাইজেশনে গেলেন তার কারখানায়। তিনি দেখলেন, অবর্ণনীয় বিষাক্ত পরিবেশে রাত্রে লেবার মজদুরগুলো কাজ করে যাচ্ছে। মিহির সিং আরো দেখলেন, ওই মজদুরগুলোর মুখ কিডনী-বেচা তামিল মানুষটার মুখের মতোই! ওই মজদুরগুলোর ‘পেট থেকে উজ্জ্বল লাল রক্তের মত তরল গড়িয়ে পড়ছে’। এই বর্ণনায় পাঠক থমকে যায় – যে মানুষ একজায়গায় কারখানায় তার শ্রম বিক্রি করছে, সেই মানুষ অন্য জায়গায় তার কিডনীটা বিক্রি করছে! যে দেশ, যে ভাষাই হোক না কেন, তাদের চেহারা এক – তারা হলো নিঃস্ব উপায়হীন শ্রমজীবি মানুষ। তাদের সবার জাতও এক। গল্পটা পড়বার পর আমার চোখে ভাসছে সেই ট্রেনযাত্রী সেই ভিখারীগোছের তামিল মানুষটার মুখ, যে মুখ দিয়ে সে অঙ্গীকার করছে তার দাসত্বের, সে তামিল ভাষায় বলছে - ‘ইন্দে ইয়লো সামান গে তন্নো’ , যার অর্থ হলো ‘আমার যা আছে সব তোমার।’ এই গল্প লেখকের সমাজ ও দর্শণবোধকে আমি আবার সমীহ জানালাম।
এবার সুবল দত্তের প্রকাশিত গ্রন্থদুটো থেকে পড়া কিছু গল্পকে তুলে ধরা যাক। খুঁজে দেখার চেষ্টা করি তার লেখার চরিত্র বা বিশিষ্টতা।
‘বি পি এল’ – গল্পের মূল চরিত্র রজনী নামের লোকটাকে দেখি একটা সাপকে হাতে পিষে ধরেছে , ছোবল খাবার পরও সাপটার মুখ হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ওটার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। যেন সাপটা এই সমাজ ব্যাবস্থারই প্রতিরূপ । রজনী ভূমিহীন, ব্যাঙ্ক-ডিফল্টার, ঋণের দায়ে জেলখাটা, একটা সর্বস্বান্ত মানুষ । ওর কাছে গ্রামের মুখিয়া, বিপিএল কার্ড ইস্যু করা বাবু, ঋণদেয়া ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, অফিসের ক্লার্ক সবাই বিষাক্ত। তাই বিষাক্ত সাপটার সাথে লোকটার খালি হাতে এই লড়াইও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা লড়াই। যাদের পাবার কথা , তারা বিপিএল কার্ড পায় না। হাজার হাজার চালচুলোহীন মানুষ, পথের ভিখিরী, আরোগ্যহীন কুষ্ঠরোগীর দল এই গল্পে উঠে আসে। গল্পের শেষে দেখি ওই সব মানুষগুলো দলে দলে এগিয়ে আসছে, বাহাতের আঙ্গুলে কালি মাখিয়ে টিপছাপ দিচ্ছে। না কোন দলিলে নয়, কোন কাগজেও না। বর্জিত প্রান্তে পড়ে থাকা একটা বোবা পাথরের দেয়ালে ওরা ওদের আঙ্গুলের নিস্ফল টিপছাপ রেখে যাচ্ছে! সর্বস্বান্ত মানুষদের নিস্ফল টিপছাপ লাগানোর চিত্রকল্পটার মধ্যে গল্পকারের বক্তব্য একটা ধারালো মাত্রা পেয়েছে। লেখার ফাঁকে ফাঁকে এই গল্পেই তার লেখনীতে উঠে এসেছে কিছু অসাধারণ বর্ণনা। বিবেচকী লাইন – যেমন ‘গরিবের সংসার হোলো বহতা নিকাশির জল। ঝির ঝির বইতে থাকে তো বেশ। থেমে গেলেই পচা নর্দমা।’ কিংবা ‘দূরে পলাশ ডাবরের পলাশ জঙ্গল যেন দিগন্তে এক বিশাল সাঁঝা চুল্‌হা। যেন এই বিশাল উনুনে সন্ধেবেলার রুটি সেঁকা হবে।’
আদিবাসী উন্নয়নের নামে প্রত্যন্ত গ্রামে নেমে আসে সান্নাটা। খনির মালিক, পুঁজিপতিদের চক্রান্ত। এসবের জীবন্ত ছবি ‘একটি শেষ বিরলতম উপজাতির অন্তিম পার্বণ’ গল্পে। লিদরি লুগুন –এর মতো কমবয়সী সমাজকর্মী, সৎ অ্যাক্টিভিষ্টরা স্বার্থন্বেষী সমাজ ব্যবস্থার গোপন চক্রান্তে খুন হয়ে যায়। আসল কথা হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নয়ণ! আদিবাসীদের পার্বণে সবাই চুর হয়ে থাকে, হাড়িয়া বা ডিয়েং পানীয়ের নেশায়। সেই পানীয়তে মেশানো থাকে বিষ। একটা গ্রাম, একটা উপজাতি শেষ হয়ে যায় - সেখানে আর বাঁধা দেয়ার কেউ থাকে না। এদেরই জমি লুটে নিয়ে, বন-জংগল দখল করে তৈরী হয় পুঁজিবাদী উন্নয়ণের ইমারত। লেখক খুব মুন্সীয়ানার সঙ্গে এই উপজাতি সমাজ জীবনকে তার গল্পে একেছেন, তুলে এনেছেন দলিত ও পিছিয়ে থাকা সমাজের কথা, তাদের উপর অন্য একশ্রেনীর মানুষের নির্মম শোষনের ইতিকথা।
ছোটগল্পের বিষয় সূত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, জীবনের চলমান স্রোত থেকে গল্পকার সংগ্রহ করেন খন্ড খন্ড উপলব্ধি (perception) , সেটাই হয়ে ওঠে ছোটগল্পের প্রাণবীজ। এমনি ভাবেই ছোটগল্পের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে ওঠে চলমান জীবনের সত্য। সুবল দত্ত বিভিন্ন সূত্রে আদিবাসীদের কাছে গিয়েছেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সঙ্গে মিশেছেন। তাই তারই সমূহ উপলব্ধি সামুহিকভাবে মিশে থাকে তার লেখা গল্পগুলোয়।
কুষ্ঠরোগীদের জীবনকেন্দ্রিক গল্প ‘শাম্বর বংশবীজ, অর্জুনের দ্বন্দ্ব’ – এই গল্পে মানবজীবনের সাথে সাথে সমাজজীবনের কুষ্ঠদশার বিবরণই উঠে আসে। বিদেশবাসী ডঃ অর্জুন WHO-র তরফে কুষ্ঠরোগীদের সার্ভে করতে দীর্ঘদিন বাদে নিজের দেশে ফিরে আসে। তার নিখোঁজ বাবাকে সে খুঁজে পায় কুষ্ঠরোগীদের আশ্রমে। আমরা জানতে পারি কুষ্ঠজীবনের অসহায় নির্মমতার কথা, তাদের সমাজ-বিচ্যুত আবরুদ্ধ জীবনের কথা, রোগের চিকিৎসায় ওষুধ কোম্পানীগুলোর ধান্ধাবাজীর কথা। সুবল দত্তের গল্প শুধু কাহিনীমাত্রিকই নয়, গল্পের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে চাবুক মারা নানা উপলব্ধি। এখানে নায়ক অর্জুন উপলব্ধি করে, মানুষ যদি জরায়ু ভেদ করে তার মায়ের গর্ভে পুনর্বার ফিরে যেতে পারে – তাহলেই এ পৃথিবী পিচাশমুক্ত হবে। এই গল্পে লেখক শোনায় – ‘ অসমোসিস প্রক্রিয়াতে মিথ্যে সত্যের ভেতরে ঢুকে গেছে।’ গল্পের উপসংহারে দেখি আরো এক চরম উপলব্ধি! দেখি দাউ দাউ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কুষ্ঠ সমাজের মানুষজন, পুড়ে যাচ্ছে পচাগলা বিকৃত সময়ের কাহিনী। গল্পের পরিণতিতে বলা হয় – ‘চরম বিকৃতির পর ধ্বংস তারপর শুদ্ধসৃজন হতে বাধ্য।’ গল্পের পাতায় পাতায় এমনি নানা আশ্চর্য, অপ্রচলিত উপলব্ধি পাঠকে অনিবার্য এক দার্শনিকতার মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে দেয়।
সুবল দত্তের সামাজিক অভিজ্ঞতার ফসল - ‘পুনর্জন্ম’ গল্প। এটা আদিবাসীদের জীবন ও সমাজের গল্প। লেখক নিপাট বর্ণনা করছে এক অপ্রচলিত সমাজের জীবন যাপন, তাদের আচার সংস্কৃতি, পালা-পার্বণ, এমন কি কথাবার্তা। গল্পের পটভূমি পরিচিত গ্রাম-শহরের বাইরে , স্বতন্ত্র তার পরিবেশ। এমনই পরিবেশের একটা মেলা, লোকজনের জমায়েত। সেখানে আদিবাসী মেয়ে লিদরি-র উপর শারীরিক অত্যাচার ও তার প্রতিবাদ। এই বিষয় নিয়েই লেখা ‘পুনর্জন্ম’ গল্পটা!
গতানুগতিক কাহিনীর বাইরে বেরিয়ে এসে কি করে অভিনব কাহিনী লিখতে হয়, তার ট্যাকটিস সুবল দত্তের গল্পে হামেশাই খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, তার গল্প ‘নিস্তার’। এই গল্পের প্রধান চরিত্র মাতাল মাহাতো একটা অন্ধকার ঘরে দিনভর বাঁধা থাকে। রোগের কারণে তার চোখে দিনের আলো সহ্য হয় না, তার শরীরে ইয়া বড় বড় চুল গজায়। মাসে মাসে মাতাল মাহাতোর বউ সেই চুল কেটে ফেরিয়ালার কাছে বিক্রি করে। সেটা তার পরিবারের আয়। মাতালের বউ মোহিণীর দুসরা আয় নিজের শরীর বেচে, এই শরীর বেচাটাকে সে স্বাভাবিক ভাবেই উপভোগ করে, তাতে কোন রাখঢাক নেই। একটাই মাত্র ঘর, সেই ঘরের এক কোনে অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত মাতাল দেখে তার ভাই থুলকু ও তার বউ মোহিণী শারীরিক যৌন সম্পর্কে দিনের পর দিন জড়িয়ে থাকে। এই দৃশ্য মাতাল মাহাতোকেও যৌনকাতর করে তোলে। মানুষের আরোগ্যের জন্যে রক্ত খাওয়া কি জরুরী ? যৌন সম্পর্কে অপারগ মাতাল মাহাতো তার বউ মোহিণীর যোনিতে জিভ দিয়ে ঋতুশ্রাবের রক্ত চেটে চেটে খায়। মোহিণীও নিজেকে উলঙ্গ করে তার অসুস্থ স্বামীর কাছে নিজের রক্তাক্ত জরায়ু মেলে ধরে! এমনই একটা অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশ, নরকীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর যৌনতা, যা কিনা পবিত্র, অথচ অদ্ভুত। এই ‘নিস্তার’ আমাদেরকে অকল্পনীয় গল্পদৃশ্যের মুখোমুখি পৌছে দেয়। মনে পরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক প্রতিবন্ধী যুগল ভিখু-পাঁচির গল্পের পচাগলা অন্ধকারময় জীবনের কথা !
সুবল দত্ত নারীর হৃদয়কে গভীর ভাবে অনুসন্ধান করে তাকে উপস্থাপন করেছে ‘কনফেশন’ গল্পে । এই গল্পের মেয়েটি নার্সস্টাফ, সে পরপুরুষদের সঙ্গে কয়েকবার শুয়েছে, নিজের ঘরে অন্যের সংগে যৌনসম্পর্কের অভিজ্ঞতাও তার আছে। এই পদ্মাবতী তার ডিউটির হাসপাতালের প্রেমিক ডাক্তারটির সাথে অবাধে মেলা মেশা করে, তার সাথে একান্তে অনেক অন্তরঙ্গ সময় কাটায়। অথচ এই গল্পেরই অভিমুখ হঠাৎ পালটে যায়। একদিন পদ্মাবতীর শরীরকে ভোগ করার জন্য ডাক্তার তাড়িত-কামুকের মতো হাত বাডায়! তখনই উঠে আসে তীব্র অসম্মতি বা নারীর প্রতিরোধ। কারণ পদ্মাবতী ডাক্তারের মধ্যে এতোদিন একজন প্রকৃত প্রেমিককেই খুঁজেছে, তার ভালোবাসার মানুষটির মধ্যে সে কোন ধর্ষক কিংবা সহজলভ্য কামুক পুরুষকে দেখতে চায় নি। হৃদয়ের যে গভীর অনুসন্ধানটি পদ্মাবতীর মধ্য দিয়ে পাঠকদের কাছে পৌঁছায়, তা হলো শারীরিক যৌন সম্পর্কই সব সময়ে বড় কথা নয় , নারীর হৃদয়ও খুঁজে ফেরে কোন প্রকৃত প্রেম, নিটোল কোনো ভালোবাসা।
গল্পটার নাম ‘সেতু’। একটা নদী, একদিকে গরীব, অন্যদিকে বড়লোক। এই নদীর মাথার উপর দিয়ে বিশাল একটা সেতু। যখন গাড়ী যায়, থর থর করে কাঁপতে থাকে ব্রীজটা। নোংরা নদীপারের কাছেই একটা বস্তীতে থাকে কিসকু আর তার বউ। দারিদ্র, ডায়ারিয়া, এনকেফেলাইটিস এসব নিয়েই অপরিচ্ছন্ন জীবন। এই কাহিনী টানটান একমুখী কোন গল্প নয়। এ গল্প যেন পথ চলতে চলতে চোখ মেলে দেখা – এতে উঠে আসে অনেক ঘটনা, জীবনের অভিজ্ঞতা, ভাবনারা। বৃষ্টি, বৃষ্টি - এ গল্পের দ্রুতগামী ঘটনারা আসে এক অতি-বর্ষণের রাতে। চারদিকে জল থই থই। নদীতে জলের স্রোত। এমন অবস্থায় নদীর উপরের সেতুটা ভেঙ্গে পড়ে। এমনি দুর্যোগের সময় কিসকুর বউ জন্ম দেয় একটা বাচ্চার। বানভাসি জল, না ডাক্তার, না অ্যাম্বুলেন্স। কিসকু তার সদ্যোজাত প্রথম সন্তানটাকে জলের ছাট বাঁচাতে একটা ঝুড়িতে ঢাকাঢাকি দিয়ে রাখে। তারপর সদ্যপ্রসবা বউর হাতে হাত, সদ্যোজাত সন্তান ঝুড়িতে – মাথায় তোলা, কিসকু জলের উজান ঠেলে নির্ভয়ে হাটতে থাকে। সে চায় তার প্রজন্মকে বাঁচাতে, নিজেরা বাঁচতে।
গল্প সমাজ ও জীবনের দর্পণ। বর্তমান জটিল জীবনের বিভিন্ন দিক একই গল্পের মধ্যে মিলে মিশে থাকে। ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখকথা / নিতান্তই সহজ সরল’ – এটা ছোট গল্পের পরিচয়। অথচ উক্ত ছোট্ট পরিধিতে আজকের ছোটগল্প যে দাঁড়িয়ে থাকবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই। সুবল দত্তের গল্প চিরাচরিত ছোটগল্পের এই সংজ্ঞাকে অতিক্রম করে গেছে।

কানু ওরাঁওর বাঘের সঙ্গে মোকাবিলার গল্প ‘দৌড়’। গল্পের পটভূমি জঙ্গলঘেরা অঞ্চল - সরায়বিন্দা, বাঘবিন্দা, মহুলটাঁড়। কানু বাঘ মারতে বেরিয়েছে, বাঘেদের ওপর ওর খুব রাগ। জঙ্গলের মধ্যে বিপদজনক অবস্থা কানু যখন বাঘেদের মুখোমুখি হয়, তখন বোঝা যায় তার সামনে বাঘের মতোই উপস্থিত কিছু হিংস্র, উগ্রপন্থী মানুষ এবং নারীও! এই গল্পের বুনোট খুব আকর্ষনীয় – গল্পে বন জঙ্গল আর আদিবাসী পরিবেশের বর্ণনা পাঠকদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।
গল্পের রূপবৈচিত্র্য খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, কোন লেখা সাংকেতিক বা প্রতীকধর্মী, কোথাও রয়েছে প্রেম আখ্যান, কোথাও মনস্তাত্বিক টানাপোড়েন। আবার কোন লেখা প্রত্যন্ত আদিবাসী সমাজকে প্রধান্য দেয়। গল্প হতে পারে বস্তনিষ্ঠ, কিংবা কাল্পনিক, অথবা কাব্যিক। কোন গল্পে বিন্যাস ও আঙ্গিক প্রধান্য পায় । গল্পের বহুধাবিস্তৃত বহুমাত্রিকতার দুনিয়ায় সুবল দত্তের সফর অনেকটাই। তবে তার বেশীর ভাগ গল্পেই বিভিন্ন মাত্রা একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। কোন গল্পের বিশেষ মাত্রা কি , তা নির্ণয় করা একটু মুস্কিলের কাজ।
তবুও লেখালেখির বৈশিষ্ট্য ও গুনগত-প্রাধান্যের ভিত্তিতে সুবল দত্তের আরো কিছু গল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক।


গল্পের বিন্যাস

‘প্রদাহবোধ-১১’ গল্প সংকলনের প্রথম গল্প ‘ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি’। এ গল্পটা প্রভু মন্ডলের, যে কিনা মাস্টার অফ ফার্মেসী পাশ, তারই দশ কিলোমিটার পদযাত্রার গল্প। যাত্রাপথের দু’ কিলোমিটার বাদে বাদে গল্পটার এক একটা পরিচ্ছদের নাম দেয়া হয়েছে কাম, ক্রোধ, মোহ, লোভ, দম্ভ ও মোক্ষ। গল্পের এই বিন্যাস অভূতপূর্ব! এর পরিচ্ছদগুলোয় শুধু যাত্রাপথের বিবরণই থাকে না, আসে প্রভু মন্ডলের জীবন, যৌনতা, নকলি ওষুধ কোম্পানীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ, প্রতিবাদ। এমনকি ব্যক্তি নির্যাতন, সমাজকে মরনের দিকে ঠেলে দেয়ার মতো লোভ, মোক্ষর নামে ভন্ড অসাধু ও ধর্মীয় মানুষদের নিপাত কামনা ও বিদ্রোহ এ গল্পের পরিচ্ছদে ফিরে ফিরে আসে। নকলি ওষুধ বানিয়ে যারা লক্ষ লক্ষ টাকা কামায় তাদের বিরুদ্ধে এক ফার্মাসিস্টের লড়াই এ গল্পের মূল উপজীব্য হলেও, সুবল দত্তের লেখনী, কল্পনা , বর্ণনাতে এ লেখা একটা সামাজিক বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। আমার বিচারে, অতুলনীয় এ গল্পের বিন্যাস।

গল্পের প্লট

গল্পের নাম – ‘সীতাহার’। ঘুপসি অন্ধকার ঘর। সেখানে থাকে অন্ধ কানামতি। এই অন্ধকার কামরায় যুবতী কাজের মেয়ে, বিলাতিকে আমরা দেখি। সে কাপড় খুলে নগ্ন হয়ে লড়াই করছে কানা মতিকামারটার সঙ্গে। সে লড়াই কোন যৌন আক্রমণ বা প্রতিরোধের না। কাজের মেয়েটা সোনার সীতাহার চুরি করেছে, এরপর আরো কিছু হাত সাফাই করার জন্যে মেয়েটা আলমারির চাবির দখল নিতে চায়। কানামতি তা বুঝতে পারে। তাই ঘরের মধ্যে ডান্ডাডান্ডি। একদিকে শক্ত সমর্থ বয়স্ক একটা কানা লোক, অন্য দিকে অল্প বয়েসী একটা মেয়ে। অনেক সময় ধরে এই লড়াইএর পর আঘাতে বিলাতি মারা যায়। গল্পের পরিণতিতে জানা যায় ওই সোনার সীতাহারটা বিলাতির বিয়ের জন্যেই সংরক্ষিত ছিলো। গল্পের শেষে থাকে ছোটগল্পের চমক। একটা আবদ্ধ ঘরে নগ্ন যুবতীর সঙ্গে বয়স্ক কানা লোকটার এই লড়াইএর প্লট ও গল্পের আঙ্গিকটা আমাদের চমকে দেয়!

গল্পের কল্পবিজ্ঞান

কখনো কখনো কল্পবিজ্ঞানের জগতে ঢুকে পরে সুবল দত্তের গল্প। যেমন গল্পে এসেছে একটা বিশাল ক্রিস্টাল পাথর, যাতে বিশেষ কিছু ধাতব পদার্থ, যার গুণে খাড়া পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত ওই বিশালাকায় ক্রিস্টাল পাথরটা ব্রহ্মান্ডের অন্য গ্রহগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখার ক্ষমতা রাখে। ওই ক্রিস্টাল পাথরটা টেলিট্রান্সপোর্টেশনের মাধ্যম। কোন লোক তিহার জেলে আটকে আছে, কিন্তু এই টেলিট্রান্সপোর্টেশনের মাধ্যমে তার ত্রিমাত্রিক শরীর ওই পাথরটির উপর হাজির হয়ে আছে [ গল্প - মোতি লাকড়া]। বিজ্ঞানে এমন হয়েছে কিনা জানি না, গল্পকার এখানে অতি আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক কাহিনী ফেঁদেছে। তাতে আমাদেরই পরিচিত মানুষজন, সামাজিক আচার সংস্কৃতি। কেন্দ্রে কল্পবিজ্ঞানের একটা ক্রিস্টাল পাথর – এমনি ভাবেই টান টান সাসপেন্স রেখে আমরা গল্পটাকে উপভোগ করি।
ভূমিকায় উল্লিখিত ‘সময়-শোধন’ গল্পে নানা শব্দ মিলে যে অনুনাদ বা রেসোনেন্স তৈরী হয়, তাতে যে সব অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটে যায়, তাতেও কল্পবিজ্ঞানের ছায়া থাকে।
 
গল্পের প্রতীক ধর্ম –

সুবল দত্তের গল্পের প্রতীকের ব্যবহার আছে। মানব সংষ্কার, মানবিক আন্দোলন, বই লেখা সৃস্টিশীলতা – এগুলো কি ব্যর্থ সময়যাপন? একজন মানুষ কিংবা লেখকের মৃত্যু ? একটা কালভার্টের নীচে নালি, সেখানে থকথকে কালো পাঁকে পরে আছে একটা অর্ধপ্রোথিত লাশ – লোকটার হাতে ধরা একটা বই , কিংবা খাতা, ধরা যাক ওটা ডায়েরী। গল্পের মধ্যে দেখি লেখা মন্তব্যটা – ‘সংস্কৃতির দেহ নব্বই অংশ পাঁকে ডুবে আছে’ ! ওই ডায়েরীর মধ্যে ধরা আছে বর্তমানের কবিদের শ্রেষ্ঠ চিন্তা ভাবনা, ওরই মধ্যে আছে মৃতবৎ সংস্কৃতির পুনর্জীবনের দিশা। কেউ কি এগিয়ে আসবে এইসব শ্রেষ্ঠ চিন্তা ভাবনা ও সংস্কৃতিকে উদ্ধার করতে? পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মহীন নামে এক কবি ঝাপিয়ে পড়লো নালায়, পাকের মধ্যে। গল্পের শেষে মহীন সেই ডায়েরী উদ্ধার করতে সক্ষম হলো। এমনি ভাবেই প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে সংস্কৃতি সম্পর্কে হতাশ মানুষকে সজাগ ও উজ্জীবিত করার গল্প ‘একটি অপ্রকাশিত কাব্য-সংকলনের উদ্ধারের কাহিনী’ আমাদের চমকিত করে।
 
চরম বাস্তবতার গল্প

‘বিকলাঙ্গদের কথা’ প্রান্তিক জীবনের চরম বাস্তবতার কথা বলে। প্রথম সন্তান বিকলাঙ্গ, সেইই ওই পবিবারের একমাত্র পুঁজি। বিকলাঙ্গদের খাতায় অসুস্থ ছেলেটার নাম, তা দেখিয়ে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মাসে মাসে টাকা আসে। রোগগ্রস্থ ছেলেটা যখন অসময়ে মারা যায়, তখন ওর বাপ ফর্মে মৃত ছেলের টিপছাপ নিয়ে পৌছে যায় ব্যাঙ্কে। অন্তিম কিস্তির টাকাটা যাতে মার না যায়। শোকগ্রস্থ, শ্মশানযাত্রী ভুকলের ক্ষেত্রে এটাই আসল বাস্তব। সেইদিনই বিকলাঙ্গ ছেলেটির আসন্ন প্রসবা মা, ভুকলর বউ, শ্মশানের কাছে ঝোপের আড়ালে একটি সুন্দর ছেলের জন্ম দেয়। ভুকল সবার অজান্তেই, নিজের নবজাত শিশু পুত্রটির একটা পা দুমড়ে মুচড়ে দেয় – যাতে বড় হয়ে এই সন্তানটিও বিকলাঙ্গ হয়েই বেঁচে থাকে। যাতে ভবিষ্যতেও বিকলাঙ্গ খাতায় এই ছেলেটার নাম দেখিয়ে মাসে মাসে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা পাওয়া যায়। এই গল্পের অন্য একটা ডায়মেনশনও আছে। পেটের দায়ে ভুকলর বউ অন্য পুরুষের সঙ্গে শোয়, ভুকল জানে না সদ্যজাত সন্তানটি তার বীর্যের প্রকৃত উত্তরসুরী কিনা? – নাকি তারই বউএর গর্ভে জমিদার ছোট শর্মার সন্তান! এই টানা পোড়েন, এই বাস্তব পরিস্থিতির আলোকপাতে আলোচ্য গল্পটা এসময়ের একটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প হয়ে ওঠে।

গল্পে কাল্পনিকতা

সুবল দত্তের ‘বিস্ফোরক’ গল্পে দেখি একটা লোক পালঙ শাকের থলে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সেই ব্যাগের মধ্যে ভরা আছে দুটো জীবন্ত বোমা; যেগুলো যে কোন মুহূর্তেই ফেটে পড়তে পারে! সেই বোমা দুটো ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে! তাদের আলোচনার বিষয় সমাজ, ধর্ম, ইলেকশন, এমনকি মার্কসের তত্বও! ওই লোকটি নিমিত্তমাত্র, বোমাদুটোই সিদ্ধান্ত নেবে কখন তারা ফেটে পড়বে। ওই বোমাদুটোর মধ্যে রয়েছে যাবতীয় মানবিক গুনাগুন। গল্পের মধ্যে বোমাকে দিয়ে কথা বলানো, লেখকের এই কাল্পনিকতায় আমরা চমকে যাই!
আরেকটা গল্প ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’- এতে বাংলাভাষা প্রেমী এক লেখক হাসপাতালের নির্জন কক্ষে শুয়ে আছে। লোকটা নাম সুবল দত্ত, লেখক নিজেই। বাংলা ভাষা চর্চার ভবিষ্যত নিয়ে লোকটা চিন্তিত। অতি আধুনিক চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে সময় এগোতেই লোকটা তার কল্পনায় আবিস্কার করে তার বেডের চারপাশে আরো অনেক কবি লেখক সাহিত্যিকদের মুখ। কে নেই সেখানে। অশোক মিত্র, বারীন ঘোষাল, কাজল সেন, সমীর রায়চৌধুরী, অজিত রায় – এমন কি স্বয়ং মহাশ্বেতা দেবীও তার বিছানার চার পাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে। তাদের সবার মুখে এক একটা করে বেলুন ফুলে উঠতে থাকে – সেইসব বেলুনগুলো থেকে বেরিয়ে আসে অজস্র অক্ষর – উঠে আসে বাংলা ভাষার জয়গান। সুবল দত্ত গল্পে এমনই এক কাল্পনিক আবহ তৈরী হয়, কল্পনার কলমে সে লিখে ফেলে বাংলাভাষাকে উজ্জীবন করার আরোগ্যকথা।

গল্পের পরাবাস্তবতা ও যাদুবাস্তবতা

আধুনিক গল্পের বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরাবাস্তবতা ও ম্যাজিক রিয়েলিজম। পরাবাস্তব ও যাদুবাস্তব উভয়ক্ষেত্রেই যাদু ও বাস্তবতার মিশেল থাকে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোস-এর লেখায় এর প্রচুর উদাহরণ আছে। এবার আসা যাক সুবল দত্তের লেখায়।
তার ‘অন্তর্জলি’ গল্পের একটা দৃশ্য – ‘মনে হলো পুরো পুকুরটাই মস্তবড়ো আগুনের গোলা। …… ততক্ষণে জলে প্রচুর লোক নেমে গেছে। …… নাভিজলে দাঁড়িয়ে থাকা ওদের সবার প্রচন্ড প্রদাহ। নানা রকমের কষ্ট ও দৈন্যতাগুলি ভিন্ন ভিন্ন রঙের অগ্নিশিখা হয়ে তাদের সারা শরীর পোড়াচ্ছে …… ।’ এই বর্ণনাটা পুকুরের মধ্যে খাটে বসানো এক মৃতমুখী মহিলা ও তার ধর্ষক লোকটার অন্তর্জলি ক্রিয়াকর্মের দৃশ্য। এখানে হিংসা, ক্রোধ, ভয়, উৎকন্ঠা নিয়ে জড়ো হয়েছে জনতারা – সারা পুকুরটাই যেন মস্তবড়ো আগুনের গোলা হয়ে গেছে। আমরা দেখি পরাবাস্তবতার সফল প্রয়োগ।
‘অমূর্ত’ গল্পের দৃশ্যে দেখি যাদুবাস্তবতার ছোঁয়া! এখানে শিল্পীর ছবি আঁকার ব্রাশ স্থির, অথচ ক্যানভাস উঠছে, নামছে, সরছে। কোন এক অমূর্ত অদৃশ্য শক্তির চালনাতেই নির্মিত হচ্ছে শিল্প, আঁকা হয়ে যাচ্ছে ছবি, চিত্রমালা। দর্শক নিখিলেশ কিংবা ছবি আঁকে যে ছোট্ট ছেলেটা তারা অনড়, স্থির। গল্পকার এখানে যে বার্তা দিতে চান, তা হলো শিল্পের ক্ষেত্রে এই অদৃশ্য সত্ত্বাটাই মুখ্য – সে কখন যে কাকে দিয়ে কি আঁকিয়ে নেবে তা কেউ জানে না!
 
গল্পের মধ্যে কাব্যকথা

বিপত্নীক বাবা চোখের জল মুছতে মুছতে স্বামীর ঘরে গোলাপিকে পাঠিয়েছে। তার জীবন দুর্বিষহ! নির্জন জলাশয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপি। সে দেখছে, চারাপোনা ব্যাঙাচির ঝাঁক ভারি জলের ভিতর থেকে একটুকরো রুপালি আলো টেনে তুলছে। এই গল্পে একটাই চরিত্র, একজন যুবতীর জলের চোরাপাকে ডুবে আত্মহত্যা করার গল্প। চারপাতার এই গল্প ‘সলিল সমাধি’। এই আলোচ্য গল্পটির কাব্যরূপ আমাদের মনে চিরন্তন হয়ে থাকবে। গদ্যের মধ্যে এমন কাব্যিক আবহ সুবল দত্তের কলমে অনায়াসেই চলে আসে। এটাই তার লেখার গুন!

গল্পের অসাধারণ কিছু টুকরো দৃশ্য

অদ্ভুত অদ্ভুত সব দৃশ্য কল্পনা সুবল দত্তের গল্পে হামেশাই উঠে আসে। গল্পকারের ছোট ছোট এক একটা লাইন বা কয়েকটা লাইনের বর্ণনা আমাদের চমকে দেয়! কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক,মোতি লাকড়া লোকটা ‘ লিঙ্গতে দড়ি বেঁধে মাল বোঝাই টেম্পো টেনেছে’। [গল্প - মোতি লাকড়া]
‘মরার হাতের টিপছাপ নিয়ে ভুকল টাকা তুলতে এসেছে’। বিকলাঙ্গ মৃত ছেলের টিপছাপ নিয়ে সত্যি কেউ কখনো ব্যাঙ্কের থেকে টাকা তোলার কথা কল্পনা করেছে কি?[ গল্প – বিকলাঙ্গদের কথা]
সিঙ্কু নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণ করার শাস্তি দিচ্ছে, অকল্পনীয় পদ্ধতিতে দেয়া হচ্ছে ধর্ষককে শাস্তি, তার বর্ণনা ‘সিঙ্কু মনোযোগ সহকারে ছুড়ি দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলেছিল। লোকটা …… জেগে রয়েছে কি অজ্ঞান বোঝা যায় না। একটু দূরে উইঢিবি ভেঙে ফেলে সেই ঢিবি তার পেটে চাপিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে অজস্র উইপোকা বেরিয়ে তার উন্মুক্ত প্রস্রাবনালীর ভিতর দিয়ে ধুকতে লাগল।’ [গল্প – অন্তর্জলি ]
গুরুদেবের নির্দেশে নিজের মৃতপ্রায় স্ত্রী ও ধর্ষক লোকটার অন্তর্জলি ক্রিয়াকর্মের আয়োজন যেভাবে সিঙ্কু যে ভাবে করছে, তা আমার ভাষায় এরকম। - একটা খাট পুকুরের জলে পাতা হয়েছে। পায়াগুলো জলে কিছুটা ডুবে রয়েছে। সিঙ্কুর স্ত্রী ও ধর্ষক লোকটাকে সেই খাটে রাখা হলো। মৃতপ্রায় দুটো মানুষ , একজন অপরাধী , অন্যজন নিরপরাধ - তারা খাটে বসে আছে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে। ওরা তখন পারলৌকিক শান্তিকামী। এমন অন্তর্জলি যাত্রার বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে আরো আছে কিনা, আমি জানি না। [গল্প – অন্তর্জলি ]
গল্পের শুরুটা এমনি ‘ উঠোনের বাইরে পুটুসের বেড়া। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সেখানে পেচ্ছাপ করতে গিয়ে একটা হলদে তীর পেচ্ছাপের উল্টো স্রোত বেয়ে সমীরণের তল পেটে বিঁধল’। [ গল্প – শূন্যতাবোধ]
ইত্যাদি।
সুবল দত্তের গল্পে অনায়াসেই ঢুকে থাকে জীবনের গূঢ় তত্ব, অদ্ভুত দার্শনিকতা। দিগন্ত প্রসারী তার কল্পনাশক্তি। তার লেখার বিন্যাস ও আঙ্গিক অসাধারণ। তার গল্পের প্লটগুলোও অসামান্য। আমরা দেখেছি গল্পের মধ্য দিয়ে সে পাঠকদের নিয়ে যায় অপরিচিত কোনো কল্পবিজ্ঞানের জগতে। আবার কখনো কখনো তার গল্প হয়ে ওঠে কবিতা। গল্পের মধ্য দিয়ে সে পাঠককে আটকে রাখে অসীম কল্পনার দিগন্তহীন জগতে। আদিবাসী প্রত্যন্ত সমাজ সংস্কৃতি ও সাম্প্রতিক সভ্যসমাজ – এ দুটোই তার পরিচিত বিষয়, তাই তার লেখা বৈচিত্রময়। এই লেখকই কখনো চরম বাস্তবতাবাদী, - তারই কলমে বেরিয়ে আসে ‘বিকলাঙ্গদের কথা’, প্রান্তিক জীবনের চরম বাস্তবতার ইতিহাস। আমরা দেখেছি তার গল্পে পরাবাস্তবতা ও ম্যাজিক রিয়েলিজমের সফল প্রয়োগ।
সব কিছু মিলিয়েই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সুবল দত্ত তার গল্পে বহুমাত্রিকতার সফল স্বাক্ষর বহন করেছেন এবং এসময়ের তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার। তার লেখার স্টাইল এ সময়ের বাংলা সাহিত্যে বিরল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, সম্প্রতি মার্চ – ২০২০তে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মঞ্চে সুবল দত্তকে প্রদান করা হয় ‘একমাত্র সাহিত্য সম্মান-২০১৮’। আমি আশা করবো বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যে এই বিশিষ্ট গল্পকারের গল্প আরো বেশী বেশী পঠিত হোক এবং আলোচিত হোক। তিনি শারীরিক দিক থেকে সুস্থ থাকুন। আমি চাই তার গল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার। ভবিষ্যতেও তিনি সক্রিয় থাকুন। আমাদের দাবী, সুবল দত্ত এমনি আরো অনেক অনেক ভালো ভালো গল্প আমাদের উপহার দিন।



[প্রবন্ধটি ধানবাদের একটা কাগজে ২০২০ সালে প্রকাশিত]

0 comments: