0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in





কে কোথায় কতবার গেছেন বা কত দিন থেকেছেন, তার ওপর পারিপার্শ্বিকতা ও সেই মানুষের জীবন যাত্রার যাপনের কথাবার্তা নির্ভর করে না।বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো দিন আফ্রিকাতে যান নি, কিন্তু তিনি চাঁদের পাহাড়ের মতো অসামান্য একটি লেখা লিখেছেন যা শুধু বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম সম্পদ।

থাক সেসব প্রসঙ্গ।রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন।ত্রিপুরার মহারাজাদের হৃদ্যতা, হৃদয়ের শব্দ, আন্তরিক আহ্বান কবিকে মুগ্ধ করেছিল এবং কবি কোথায় যেন ত্রিপুরার সঙ্গে এক অদৃশ্য ডোরে বাঁধা পড়েছিলেন, না হলে সেই সময় পরাধীন ভারতবর্ষে যখন অখণ্ড ভারতের ত্রিপুরার সঙ্গে অখণ্ড বঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই

ভালো নয়, তার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ বারেবারে ঘুরে ঘুরে এসেছেন ত্রিপুরায় এবং এখানকার রাজাদের আনুকূল্যে তিনি বসবাস করেছেন এখানে।এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, বইপত্র আছে। সেসব আমরা জানি। ফলে নতুন করে এই ব্যাপারটা নিয়ে বলার কিছু নেই।বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাতবার ত্রিপুরায় আসার কথা বলেছি।

কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন এই যে তিনি সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন তাতে ত্রিপুরার কী এল,কী গেল? তাতে ত্রিপুরার মানুষ, ত্রিপুরার ভূপ্রকৃতি, ত্রিপুরার যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, যা অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বর্ধিষ্ণু তার কী এল গেল?

এখন কথা হল যে একজন কবি যিনি আন্তর্জাতিক মাপের এবং একই জাতীয়ও। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক না হলে জাতীয় হওয়া যায় না।অনেক লেখকই আন্তর্জাতিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে আন্তর্জাতিক বোধ ও চিন্তা তা বারবার প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর লেখার মধ্যে,বিশেষ করে প্রবন্ধের মধ্যে তিনি নিজের আন্তরিক চেতনা ও চৈতন্য তুলে ধরেছেন।যেকথা বলছিলাম, রবীন্দ্রনাথের বার বার ত্রিপুরায় আসার কারণ ত্রিপুরার মানুষের অসম্ভব আতিথ্য এবং অতি যত্ন আত্তি তিনি পেয়েছেন।কিন্তু তাঁর কথা সাধারণ মানুষের কী কাজে লেগেছে? এখন আমাদের কথা হলো একজন বড় লেখক, কবি, সাহিত্যিক একেবারেই নির্দিষ্ট কারওর নন, আবার নিজেরও নন।তাঁর নিজস্ব গতি এবং চলন তাঁর জীবনের সূত্র ধরে তাঁকে অন্য পথে নিয়ে যায়।এবং তিনি সেই পথে চলতে থাকেন এবং চলতে চলতে দুপাশে কখনও পাহাড়ি গোলাপ, কখনওবা বন্য সৌন্দর্য, কখনও কেয়ারী করা মনোরম বাগান।কখনও বা অতি দীর্ঘ বাগিচা দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তার সুগন্ধে তিনি মুগ্ধ হন এবং তাঁর স্বভাব কৌতূহলে, স্বভাব সৌন্দর্য মুগ্ধতায় তিনি ঢুকে পড়েন সেই বাগানের মধ্যে,সেখানে থাকে অনেক আনন্দ,অনেক মায়া, কায়া, জীবন যাপনের গান।রবীন্দ্রনাথ সেই গানে অবগাহন করেছেন এবং নিজে নিজে সেই সঙ্গীতের যে সুর ও মূর্ছনা তাকে আত্মীকরণ করেছেন এবং তাকে ধরেই অনেকটা পথ অতিক্রম করেছেন।আবার নতুন বাঁকে তিনি ঘুরে গেছেন এবং ঘুরে গেছেন বলেই তাঁর সাহিত্য এবং সৃষ্টি, ছবি আঁকা এবং অন্যান্য কাজ শান্তিনিকেতন তৈরি করা, শ্রীনিকেতন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে কতখানি প্রাসঙ্গিক? এর উত্তর দিতে গেলে এক সমুদ্র জিজ্ঞাসা এবং এক হিমালয় উত্তর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। এর উত্তর খুব সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিঃশ্বাসেই জড়িয়ে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রশ্বাসে জড়িয়ে আছেন।যেমন একজন ভক্ত,আস্তিক মানুষ যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাঁর যে ইষ্ট মন্ত্র, তাঁর যে জপা এবং অজপা মন্ত্রযান,তা যেমন তাঁকে নিয়ে যেতে থাকে কোনো এক অপার্থিব সুরলোকে, তেমনি একইভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মী তিনি মার্কসবাদী বিশ্বাসী হতে পারেন,তিনি গান্ধীবাদী বিশ্বাসী হতে পারেন কিংবা অন্য যেকোনো দর্শনে বিশ্বাস রাখতে পারেন এবং সেই দর্শনের যে মূল কথা সেই দর্শনের যে মূল বাণী, সেই দর্শনের যে সমাজ বিপ্লব অথবা অহিংসার পথে এগিয়ে যাওয়ার যে কথাবার্তা, তাকে তিনি আত্মীকরণের মাধ্যমে নিজের মধ্যে নিয়ে আসেন এবং একজন প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মী এবং সংগঠক তাঁর কাজ করে যান সারাজীবন। কখনও বিপ্লবের স্বার্থে, কখনও অহিংসার স্বার্থে, কখনও গ্রাম পুনর্গঠনের স্বার্থে,কখনও আরও কোনো দার্শনিক স্বার্থে।রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে এমনই এক দর্শন কাব্য, তাঁর লেখা পড়লে পরে যে দার্শনিক অভিঘাত, যে দার্শনিক ব্যঞ্জনা, যে দার্শনিক জিজ্ঞাসা আমাদের সামনে ফুটে ওঠে বারবার তাঁর নাটকে,তাঁর প্রবন্ধে, তাঁর ছোট গল্পে, তাঁর উপন্যাসে,তাঁর গানে। তিনি সর্বত্রগামী। সব কিছু লিখেছেন ,এবং অসম্ভব পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। আমরা জানি বা পড়েছি বহু নবজাতক বা নবজাতিকার নামকরণ তিনি করেছেন। তিনি পরাধীন দেশে গ্রাম উন্নয়নের জন্যে শান্তিনিকেতন এবং শ্রীনিকেতন তৈরি করেছিলেন। শান্তিনিকেতনকে করেছেন আন্তর্জাতিক বিদ্যাচর্চা এবং সারস্বত চর্চার অন্যতম জায়গা।পাশাপাশি শ্রীনিকেতন হয়ে উঠেছে আমাদের গ্রামীণ শিল্পকলা এবং শিল্পকর্মের যে প্রতিভূ তাকে স্পষ্ট করার জন্য কোনো এক সংগঠন।সম্পূর্ণ স্বদেশী চিন্তায়, স্বদেশী ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ এই পথে এগিয়েছেন, আবার পাশাপাশি পাশ্চাত্যের আলো, পাশ্চাত্যের জ্ঞান ও বোধ,চীন, জাপানের যে দার্শনিক চিন্তা, ইরাণও পারস্যের যে বিবিধ শিল্প সৌকর্য, ইউরোপের কারিগরি প্রভাব ইত্যাদি প্রভৃতি তিনি ভারতে প্রয়োগ করেছেন।পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনি বাগিচা চর্চা বিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন বিদেশে।এমন নানা কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, যে কীকরে মানুষ ভোর চারটের সময় উঠে রাত্রি বারোটা একটা পর্যন্ত কাজ করতেন।বিনিদ্র চোখে তিনি জেগে থাকেন সাধারণ মানুষের জন্য,গ্রাম উন্নয়নের জন্য,গ্রাম পুনর্গঠনের জন্য,তিনি জেগে আছেন মানুষের কল্যাণের জন্য জন্য,মানুষের আত্মমর্যাদার জন্য।সেখানে কোনো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই,সেখানে কোনো রাজনৈতিক কাঠামো নেই,রাজনৈতিক বন্ধন নেই। রবীন্দ্রনাথ স্বভাবত স্বতন্ত্র মানুষ। তার বন্ধন যা আছে তা দেশের বন্ধন। সে মানব বন্ধন। রবীন্দ্রনাথ একজন মুক্ত স্বাধীন মানুষ হিসাবে বারবার বারবার দাঁড়িয়েছেন মানুষের পক্ষে।

তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের হিজলি জেলে গুলি চালনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা হিজলি জেলে বিপ্লবীদের হত্যা করেছিল।জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি পথে নেমেছেন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। তখন তিনি প্রচুর গান লিখেছেন ১৯০৫ সালে,গান গেয়েছেন,নিজে পথে নেমে সকল মানুষকে একসঙ্গে সংগঠিত করেছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন।ব্রিটিশদের অত্যাচারে, দেশবাসীর যন্ত্রণায়, দেশবাসীর যাতনায়, দেশবাসীর রক্তক্ষরণে, নিহত দেশবাসীর মৃত মুখ তাঁকে বারবার আঘাত করেছে।তিনি পরদিন নাইটহুড পরিত্যাগ করেন জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর।

আমরা জানি ছবি আঁকা একটা বিরাট পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে তা করে গেছেন ষাটোর্ধ বয়সে। মনে রাখতে হবে তাকে ইদানীং তথাকথিত 'অতি বিজ্ঞ' গবেষক প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে রবীন্দ্রনাথ আসলে 'রঙকানা' বা 'কালারব্লাইণ্ড।' কিন্তু একজন মানুষ যদি 'রঙ কানাই' হয় তাহলে তিনি কীভাবে এই সংস্থাপন আলো-ছায়ায়,কালো-সাদায়, রঙে নির্মাণ করলেন আমাদের সামনে। আমরা জানি তার সেই চুম্বন নামের বিখ্যাত ছবিটির কথা।যেখানে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে চুম্বনের আভাসে রয়েছেন এমন কথা ইতিহাস বলে। বিচিত্রগামী লেখক তিনি।তিনি দেবতার গ্রাসের মতো কবিতা লিখছেন।লিখছেন দুই বিঘা জমির মতো কবিতা,আবার লেখেন তোমার শঙখ ধুলায় পড়ে আছে নিয়ে তিনি লিখছেন এমন কোনো লাইন। তিনি লিখছেন 'জানি মোর কবিতা হয় নাই হয় নাই সর্বত্রগামী।'এই যে আফসোস, এই যে হাহাকার, তা একজন সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষেই সম্ভব। ঐকতান পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ এই কথা লিখেছিলেন।

আমরা কি মনে রেখেছি রবীন্দ্রনাথকে? প্রাত্যহিকতায় ত্রিপুরার মানুষ, পশ্চিম বাংলার মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ, যারা বাংলা ভাষায় অন্তত কথা বলেন,লেখেন, তারা কি মনে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথকে? না কী শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণের মলাট লিখন এক ধারাবাহিক পূজা পদ্ধতি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখে গেছেন 'তোমায় পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।'কিংবা 'তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলে যে যাই'।এই যে নিজেকে দেখতে পাওয়া, নিজেকে নিজের আয়নায় আবিষ্কার করা, তা একজন বড় মাপের দার্শনিকের পক্ষেই সম্ভব।

আমরাও তো তাঁকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়েছি কী? আজকে যখন সমস্ত পৃথিবী দীর্ণ হিংসায় জর্জরিত। 'যখন নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস' এই লাইন কী অমোঘ হয়ে আসে না? কিংবা যখন তিনি বলেন 'আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনিই লীলার তব- এই যে তুমি এবং আমি।এটা কী?

আমাদের অনুভূতিতে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়, পূজা পর্যায়,স্বদেশ পর্যায় বলে আলাদা কিছু হয় না।'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে' বনে এটা কী প্রেমের গান না প্রত্যাখ্যানের গান? কিংবা এইটা নি বিরহের গান না কী প্রাত্যহিক যন্ত্রণার গান, মিলনার্তির গান? যে যন্ত্রণা নিয়ে আমরা সকালবেলা উঠি মেঘার্ত আকাশ থাকলে আকাশকে মনে হয় মেঘ মলিন কোনো ছাদের কার্নিশ। সেই রকম এক মনন নিয়ে যখন আমরা রবীন্দ্রনাথের গানে প্রবেশ করতে থাকি, যখন আমরা তাঁর ছবিতে প্রবেশ করতে থাকি, যখন আমরা তার নাটকে প্রবেশ করতে থাকি, তখন মনে হয় জীবন কী আসলে এরকম? কিংবা জীবন কী আসলে এরকমই? জীবন কি আসলে এরকমই হওয়ার কথা ছিল? বা হওয়ার কথা ছিল না?

রক্তকরবী নাটকে রঞ্জন, নন্দিনী, বিশু পাগল, অধ্যপক, রক্তকরবীর মালা নন্দিনীর গলায়, তা কি কোনো স্বপ্নিল উচ্চারণ না কী কোনো প্রেমার্তি? না কী তা আসলে বিদ্রোহের সামগ্রিক শোষণ, সামগ্রিক সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের একক জেগে থাকা।রাজা অথবা রক্তকরবী অথবা মুক্তধারা আমাদের বারে বারে জীবন ও বিবিধ বিষয় নিয়ে সতর্ক করে দেয়, যা আজও আধুনিক প্রাসঙ্গিক।

ফলে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমরা কিছুই ভাবতে পারি না।আমরা বাতাস দেখতে পাই না,কিন্তু অনুভব করতে পারি, বাতাস আছে।যখন বুকে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, তখন আমরা বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করি।ঠিক তেমনি আমাদের জীবনে যখনই দুঃখ কষ্ট অনুভব করি, নানাভাবে পর্যুদস্ত হই,তখনই আমরা রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হই।রবীন্দ্রনাথ আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।

আমরা যখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে পড়ি তখন আমরা সাংস্কৃতিকভাবে সাংস্কৃতিক চেতনা ও চৈতন্যে রাজনৈতিক চেতনা ও ভাবনায় ভয়ানক যাতনায় পরি,তখন একেবারে অন্তিম দশা যেন উপস্থিত হয় আমাদের সামনে, তখন রবীন্দ্রনাথ প্রায় 'সর্বরোগহর' মালিশ এবং ওষুধ হিসাবে আমাদের সামনে আসেন।আমাদের বিশ্বাস সভ্যতা যতদিন থাকবে, যতদিন মানুষ কথা বলবে,যতদিন মানুষ প্রতিবাদ করবে,গান করবে,যতদিন মানুষ সজাগ থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন, জেগে থাকবেন,আমাদের হৃদস্পন্দন হয়ে। জীবন ও আধ্যাত্মিকতা, জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা, জীবন ও প্রকৃতি চেতনা সব মিলিয়ে এক অন্যন্য সাধারণ ব্যাক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথকে আমাদের প্রণাম।আমাদের জীবনের ভালোবাসা, বিরহ, বেদনা, বিচ্ছেদ,সুখ,আনন্দ,দুঃখ, সব কিছুইতেই রবীন্দ্রনাথ।

আমাদের স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই,রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছেন।তিনি এসেছেন বলে ত্রিপুরার মানুষ যেমন তাঁকে ভালোবেসে খুশি হয়েছেন তেমনি নিজেদের সমৃদ্ধও করেছেন।ত্রিপুরার মানুষ এমনিই অসম্ভব আথিত্য পরায়ণ তাঁরা। তাঁরা জানেন মানুষকে ভালোবাসতে,মানুষকে আপন করে নিতে।মানুষকে বুকের কাছে,বুকের মধ্যে টেনে নিতে। তাঁরা স্বার্থপর নন।তারা স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠে অনেক কথা,অনেক উচ্চারণ করতে পারেন,যা অনেকেই পারেন না।সে ত্রিপুরার রাজা বা প্রজা যেই হোন না কেন।আমরা কাউকে ছোট করছি না।কিন্তু ত্রিপুরার মানুষের এই আতিথ্য বোধটুকু অসামান্য, অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ তাতে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

চির ভালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ।তিনি ত্রিপুরার মানুষের এই ভালোবাসাটুকু টের পেয়েছেন।এবং পেয়েছিলেন বলেই ত্রিপুরার আকাশে,বাতাসে রবীন্দ্রনাথের কাছে ত্রিপুরার মানুষের কন্ঠস্বর রবীন্দ্রনাথের রচনায়,রবীন্দ্রনাথের লেখায়, রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনায়, রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে বার বার উঠে এসেছে।ফলে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় সাতবার এসেছিলেন বলে ত্রিপুরা ধন্য।আবার প্রকারান্তরে বলতে হয় রবীন্দ্রনাথও খানিকটা ধন্য হয়েছেন এই ত্রিপুরার মাটিকে স্পর্শ করে।ত্রিপুরার মানুষের প্রেম ও ভালোবাসা প্রীতি পেয়ে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন ত্রিপুরার মানুষ তাঁকে ভালোবাসে, এবং তিনিও ত্রিপুরার মানুষ, প্রকৃতি, আকাশ বাতাসের মতো রাজাদেরও ভালোবাসতেন।রবীন্দ্রনাথ এসে ত্রিপুরাকে ধন্য করেন নি।করা সম্ভব নয় কিন্তু আমাদের কারও কারও জীর্ণ পর্ণ কুটিরের সামনে দিয়ে যদি একদিন কোনো এক প্রবহমান স্বর্ণালী স্রোত বয়ে যায়, যে স্রোতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবন চর্যার আশ্চর্য মোহময়তা। তাকে দেখে কী আমরা মুগ্ধ হব না? অথবা আমরা যারা দেখতে পাই নি তাঁকে, তাঁরাও কি বালির মধ্যে খুঁজে বেড়াই না? তাঁর মুছে যাওয়া পায়ের ধ্বনি। সেই স্বর্ণময় স্রোতের অস্তিত্ব মুখে মুখে কি গল্প-কাহিনি ছড়ায় না? তিনি এসেছিলেন।তিনি এসেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- 'এসেছিলে তবু আসো নাই জানায়ে গেলে।'এই যে জানায়ে যাওয়ার কথা সেকথাই হয়তো ফুটে থাকে আমাদের মনের ঘরে। আমাদের চিন্তায়, চৈতন্যে, সাংস্কৃতিক ফসলে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সারাক্ষণ জড়িয়ে থাকেন।সকাল বেলা আমরা যারা সাহিত্য,সংস্কৃতি ও মনন চর্চা করি তাদের কথা বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের অনেক লাইন মানুষকে ভরসা দেয়। সকাল বেলা থেকেই মানুষকে মনুষ্যত্ব জাগরণের যে অভিশ্রুতি তা রবীন্দ্রনাথই দিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের যে গান, সে গানের লাইন সকাল থেকে গড়াতে গড়াতে দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা থেকে রাত্রির দিকে চলে যায় নক্ষত্র স্নান সারতে থাকে, আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক চেতনায় উপস্থিতির জন্য দুঃখে,সুখে আনন্দে, বিরহে,বেদনায় প্রেমার্তিতে, অসফলতায়, সাফল্যে রবীন্দ্রনাথ যেন বা কোনো মহীরুহ সম।তাঁর সেই লাইন- 'আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনই লীলা তব।' এই যে আমাকে অশেষ করছ মানে কী? আমার জীবনকে, আমার উচ্চারণকে তুমি অশেষ করেছ।চিরজীবী করছ, মানে এই নশ্বর পৃথিবীতে কিছুই চিরজীবী নয়। কিন্তু তবুও তাঁর এই গানের কথা,তাঁর এই ছোট গল্পের লাইন,তাঁর এই ছবির কথা,নাটকের কথা, আমরা যখন কোনও ভাবে না কোনও ভাবে মনে করি, তখন আমাদের মধ্যে একটা অন্য ধরনের উন্মেষ তৈরি হয়।'স্ত্রীর পত্র' পড়তে পড়তে আমরা মৃণালের যে যন্ত্রণা, তা সোচ্চার নারীবাদ না হলেও মৃণাল যেভাবে একজন স্বাধীন নারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং মাখন বড়ালের নাম চিহ্নিত গলিতে আর সে ফিরে যাবে না, এই কথা যখন সে উচ্চারণ করে, তখন আমরা বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠিক কোনখানে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের হৃদয় স্থবিরতায় অথবা 'ছুটি' গল্পে যখন ফটিক এক বাঁও মেলেনা, দুবাঁও মেলেনা তখন আমরা বুঝতে পারি মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করতে করতে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যান 'অতিথি' নামক আখ্যানে তারাপদকে তিনি যাত্রা করেন নতুন কোনও এক অভিযাত্রায়।।ফলে তাঁকে বাদ দিয়ে জীবন উচ্চারণ, নিঃশ্বাস গ্রহণ নিঃশ্বাস পতন সম্ভব নয়।

0 comments: