প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধশীত যাচ্ছে, বাজারে শাকসব্জীর দাম ফের চড়তে শুরু করেছে। বাজেটের দিন এল এবং গেল। তাতে সরকারের আয়ব্যয়ের ফিরিস্তির সঙ্গে রয়েছে আগামী বছরের করব্যবস্থা। মানতেই হবে, বাজেটে একটা ঘোষণা চমকে দিয়েছে। যাদের বার্ষিক আয় ১২ লক্ষ টাকা তাদের নাকি এক পয়সা আয়কর দিতে হবেনা। ঠিক করে বললে—বার্ষিক আয় ১২.৭৫ লক্ষ পর্য্যন্ত জিরো আয়কর। পেনসনভোগীদের জন্য লক্ষণরেখাটি ১৩ লক্ষ। কারণ, স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন হল ৭৫ হাজার, এবং পেনসনভোগীদের জন্য এক লক্ষ। ফলে আমার মত পেনসনভোগী এবং আরও অনেকে প্রথমে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করে নিল।
তারপর একটু ভাবতেই কপালে ভাঁজ। পুরনো আয়কর নিয়মেও ৭ লক্ষ পর্যন্ত বার্ষিক আয়ে কর দিতে হত না। তাহলে তাঁরাই লাভবান হলেন যাঁদের বার্ষিক আয় ৭ থেকে ১৩ লক্ষের মধ্যে! ফলে আমার মত লোকের কোন লাভ হয়নি। লাভ হয়েছে নাকি মধ্যবিত্তের বা মিডল ক্লাস। এখন এই মিডল ক্লাস সংজ্ঞাটি বড় গোলমেলে। কাকে বলব মিডল ক্লাস?
বিগত ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে বাজেট পেশের (২০২৩-২৪) আগে বিত্তমন্ত্রী সীতারামন বলেছিলেন যে মিডল ক্লাসের কষ্ট উনি বোঝেন, কারণ উনিও তাই। কী কাণ্ড! ওঁর মাসিক বেতন তো ২ লক্ষ টাকা, মানে বার্ষিক ২৪ লক্ষ!
তাহলে আয়করে কী ধরণের ছুট দিলে এই মাগ্যি গণ্ডার বাজারে সাধারণ মানুষের একটু সাশ্রয় হত? এই আলোচনা গুছিয়ে করার আগে একটা কথা বলা দরকার।
আমাদের দেশের কাঠামো হল আধুনিক কল্যাণকারী রাষ্ট্রের। আমরা ধরে নিই সরকার আয়ের জন্য বিভিন্ন খাতে ট্যাক্স আদায় করবে এবং তার উল্লেখযোগ্য অংশ খরচ হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং অধিকাংশ মানুষের খাদ্য-বস্ত্র ইত্যাদির গ্যারান্টির খাতে। আমাদের আইনের চোখে সব নাগরিক সমান, প্রধানমন্ত্রী বলেন—সব কা সাথ, সবকা বিকাশ।
বেশ কথা। সরকারের আয়ের একটা বড় অংশ আসে আয়করের মত প্রত্যক্ষ কর এবং পণ্য ও বিক্রয় কর (জিএসটি) গোছের অপ্রত্যক্ষ কর থেকে।
সজাগ নাগরিক হিসেবে কর দিতে কোন আপত্তি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটা দেখা দরকার যে সেই করের বোঝা কাদের উপর বেশি চাপানো হচ্ছে আর সেই আয় সরকার কাদের উপর বেশি খরচ করছেন। এই নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা শুধু করের ভার নিয়ে আলোচনা হবে।
একটা ভুল ধারণা জনমানসে গেড়ে বসেছে—গরীব মানুষ ট্যাক্স দেয় না, শুধু উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত দেয়। গরীব মানুষ কেবল সরকারের থেকে খয়রাত পায়। কথাটা সর্বৈব ভুল। ট্যাক্সো সবাই দেয়। আমির-গরীব সবাই। কীভাবে?
উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত দেয় আয়কর, সম্পত্তি কর জাতীয় প্রত্যক্ষ কর যা প্রগ্রেসিভ। অর্থাৎ সবার জন্য সমান নয়, যার আয় বেশি তার করের অনুপাত বেশি। কিন্তু গরীব মানুষ দেয় বিক্রয় কর—জিএসটি। এই অপ্রত্যক্ষ কর সবার জন্যে সমান। ওষুধ কিনলে, আনাজপাতি কিনলে, দোকান থেকে জিনিস কিনলে প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য উচ্চবিত্ত বা বিত্তহীন সবাইকে সমান জিএসটি হয়—তাই এই ট্যাক্সটি বিষমানুপাতি বা রিগ্রেসিভ।
গত কয়েকটি ত্রৈমাসিকের আর্থিক তথ্যের বিশ্লেষণ বলছে তিনটে কথা—শিল্পোৎপাদনের নিম্নগতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি। তার সঙ্গে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে আর একটা কথা—মধ্যম বর্গ বা মিডল ক্লাস শেষ হয়ে যাচ্ছে।
কেন মধ্যমবর্গের কথিত বিলুপ্তি নিয়ে এত চিন্তা?
কারণ মহানগর ও শহরে অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের ক্রেতা এই মধ্যম বর্গ। দেশের সমস্ত মল এবং বিপণিতে থরে থরে যে পণ্যসম্ভার সাজানো থাকে তার লক্ষ্য প্রধানতঃ উচ্চবর্গ এবং মধ্যমবর্গ বা মিডলক্লাস। হিসেব সোজা; উচ্চবর্গের উপভোক্তার সংখ্যা কম। তারা কিনবে ইম্পোর্টেড ও প্রিমিয়ার আইটেম, মূলতঃ যেগুলো বিলাসদ্রব্যের আওতায় পরে।
মিডিয়ায় এবং সাইনবোর্ডে বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য এই বিশাল মিডলক্লাস, যার বিকাশ হয়েছে মূলতঃ এই শতাব্দীর প্রথম দশকে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের খোলা বাজার নীতির ফলে। মিডলক্লাসকে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন কনজিউমার লোন বা ভোগ্যবস্তু কেনার জন্যে সহজ ঋণ এবং ওভারড্রাফট দিতে ব্যাংকগুলিও মুখিয়ে আছে।
কিন্তু দুটো দশক পেরোতেই কী হয়েছে?
২০২৪ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের সবচেয়ে বড় এফ এম সি জি হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের প্রফিট ৩.৭% কমে গেছে। এফ এম সি জি মানে ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস; এতে অধিকাংশ মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন ব্যবহারের প্যাকেজ করা ভোগ্য পণ্য যেমন সব খাবার জিনিস, প্রসাধন, ঘর পরিষ্কারের কেমিক্যাল, হেলথ সাপ্লিমেন্ট, বাচ্চার ডায়পার সবই পড়ে।
হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের সিইও রোহিত জাভা, নেসলে ইণ্ডিয়ার চেয়ারম্যান সুরেশ নারায়নন, টাটা কনজিউমার প্রোডাক্টসের এবং আইটিসি লিমিটেডের মুখপাত্র সবার একই সুর -- শহরের মিডল ক্লাসের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, তাই বাজারে ডিমান্ড কমছে, ভোগ্যবস্তুর যোগান কমছে এবং দাম বাড়ছে।
কেন দেশের এই দুরবস্থা? বড় বড় করপোরেট ঘরানা বলছে দুটো কারণ।
এক, শহুরে মধ্যমবর্গের ক্রয়ক্ষমতা সমানে কমছে। মুদ্রাস্ফীতি ও করের বোঝার ভারে ওদের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমহ্রাসমান।
দুই, অধিকাংশ সাধারণ মানুষ পরিশ্রম বিমুখ, খাটতে চায় না।
আমরা দুটো বক্তব্যকেই খুঁটিয়ে দেখব।
মধ্যবর্গ বা মিডলক্লাস কারা?
আমরা বর্তমান নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরের কথা মনে রেখে একাডেমিক বিতর্ক এড়িয়ে একটি খুব সরল আর্থিক সংজ্ঞাকে বেছে নেব। ভারতের সমাজকে আয়ের ভিত্তিতে মোটাদাগের এই বর্গবিভাগটি করেছেন জনৈক ব্যবসায়ী কিশোর বিয়ানী।
উপভোক্তার বর্গভেদ লোকসংখ্যা গড় বার্ষিক আয়
উচ্চবর্গ ১২ কোটি ১২.৩ লক্ষ টাকা
মধ্যম বর্গ ৩০ কোটি ২.৫ লক্ষ টাকা
আবার ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্ল্যায়েড রিসার্চের মতে মিডল ক্লাস হল যাদের পারিবারিক আয় বার্ষিক ২ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ আয়ের লোকজন।
উচ্চবর্গের রয়েছে বিশাল চল-অচল সম্পত্তি এবং শেয়ারে বিনিয়োগ করার মতন বাড়তি আয়। বিদেশ ভ্রমণ এবং বিদেশি বিলাসিতার পণ্য কেনা এঁদের কাছে জলভাত। এঁদের চিকিৎসাও দরকারে বিদেশে হয়। রাজনীতি এবং ক্ষমতার অলিন্দে এঁদের অবাধ এবং মসৃণ যাতায়াত।
মধ্যমবর্গের অধিকাংশ চাকুরিজীবি; রয়েছে নিজস্ব বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট, ছোট গাড়ি, ব্র্যাণ্ডেড জামাকাপড়, উচ্চশিক্ষা, বীমার সাহায্য নিয়ে প্রাইভেট নামী হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে চিকিৎসার সুবিধে, ছেলেমেয়েদের দামী স্কুলে ভর্তি করা, ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া, ভাল রেস্তোরাঁয় মাঝেমধ্যে খাওয়াদাওয়া এবং সামান্য হলেও কিছু আর্থিক জমাপুঁজি যার জোরে সাময়িক আর্থিক এবং পারিবারিক সংকট সামলে নেয়া যায়।
জনসংখ্যার বাদবাকি অংশ, প্রায় ৯০ থেকে একশ কোটি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঘর চালাতে ব্যস্ত। কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ৮০ কোটি জনসংখ্যাকে নিয়মিত, এবং প্রায় বিনামূল্যে রেশন পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে এই বর্গভেদকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। একই কথা বঙ্গের দুয়ারে- রেশন জাতীয় যোজনার ব্যাপারেও প্রযোজ্য। শুরু হয়েছিল কোভিডের সময়, এখন বাজারের যা অবস্থা তাতে সরকার বাধ্য হয়েছে অমৃতকালে এই ধরণের অমৃত বিতরণের ব্যবস্থা করতে।
এদের কোন জমাপুঁজি নেই। অসুখ হলে যায় সরকারি হাসপাতাল-- যার অবস্থা সবাই জানেন। উত্তর প্রদেশ এবং কোলকাতায় গত কয়েক বছরে ব্যাপক শিশুমৃত্যুর খবর এখনও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।
গরীব মানুষ আলসে?
বড় বড় শিল্পপতি ঘরাণার কথা শুনুন, মনে হবে দারিদ্র্যের আসল কারণ ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব, ওরা অলস।
ইনফোসিসের নারায়ণ মূর্তির বক্তব্য ভারতের চাকরিজীবিদের সপ্তাহে ৭০ ঘন্টা কাজ করা উচিত। আর একজন বিজ্ঞের মতে সপ্তাহের শেষে শনি-রবি ছুটি নাকি পাশ্চাত্য সংস্কার, আরেকজনের নিদান—রবিবারে বৌয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে অফিসে চলে এস।
কিন্তু বাস্তব চিত্রটি কী?
সব বড় কর্পোরেট ঘরানার লাভ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, অথচ কর্মচারিদের বাস্তবিক মাইনে কমছে। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতির দরের চেয়ে কম দরে বৃদ্ধি হচ্ছে—এটাই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের আসল কারণ।
The FICCI-Quess Corp Income Report 2022-23 বলছে “ profit of Indian corporates across six major sectors increased 4 times. Real Salary growth negative”. এর অর্থ গড় মুদ্রাস্ফীতির দর 5.7% , বেতনবৃদ্ধির দর তারচেয়ে বেশ কম।
খোদ ভারত সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি নাগেশ্বরন বলছেন-- Corporate profitability has gone up from 5.3 trillion in FY 20 to 20.6 trillion in FY 23. Wage growth has not grown in the same pace.
এক দিকে তো কোম্পানিগুলো সুপার প্রফিট করছে, অথচ কর্মচারিদের মজুরি বেতন ইত্যাদি বাড়াতে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আবার কেন্দ্রীয় সরকার তাদেরই কর আদায়ে বিরাট ছাড় দিচ্ছে। ২০১৯ থেকেই মোদী সরকার কর্পোরেট ট্যাক্স কমাতে শুরু করে।
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিত্তমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন গোয়াতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে ভারত সরকারের বিত্ত মন্ত্রক Taxation Law (Amendment) Ordinance 2019 আয়কর আইন (সংশোধন) অর্ডিনান্স জারি করে income Tax Act 1961 Finance (nO.2) Act 2019।তাতে দেশি কোম্পানির জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে ২২% এবং নতুন কোম্পানির জন্য ১৫% করা হয়েছে। আরও অনেক সুবিধে দেয়া হয়েছে, উদ্দেশ্য তাতে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে , শিল্পের বিকাশ হবে এবং আম জনতার চাকরি ও রোজগার বৃদ্ধি হবে। এই ছাড় দেয়ায় সেবছরই ভারত সরকারের ১.৪৫ লাখ কোটি আয় কমে যায়। আর শিল্প , রোজগার এবং বিনিয়োগ যে কী বেড়েছে, কোথায় বেড়েছে সেটা এখন সবাই জানেন।
অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী
এটা খেয়াল করার মত যে ২০১৯ সালে সরকারের কর থেকে আয়ের ৫৮.৩% আদায় হত কর্পোরেট ট্যাক্স থেকে। এখন ২০২৩-২৪ সালে সেই প্রতিশত নেমে এসেছে ৪৬.৫% পর্য্যন্ত। অর্থাৎ আয়কর দাতা মধ্যম বর্গ থেকেই সরকারের কর আদায় বেশি হচ্ছে। এবার ১১.৫৬ লাখ কোটি টাকা বা ট্রিলিয়ন আসছে আয়কর থেকে, আর কর্পোরেট ট্যাক্স থেকে ১০.৪২ লাখ কোটি, (অনুমানিত) ২০২৪-২৫।
দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৩% আয়কর দেয়। কিন্তু ওই ৩% থেকে দেশের সমস্ত কর্পোরেট ঘরাণার থেকে বেশি কর দিচ্ছে।
মনমোহন সিং সরকারের সময় সরকারের সমস্ত আয়ের ৩৫% আদায় হত করপোরেট ট্যাক্স থেকে, বর্তমান সরকারের সময় সেটা নেমে ২৬% হয়েছে।
অনেক আন্তর্জাতিক স্তরের অর্থনীতিবিদের মতে ভারতের মত দেশের সরকারের আমদানি আয়করের উপর বেশি নির্ভরশীল হওয়া সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।
গল্পটা এখানেই শেষ নয়। মধ্যম বর্গ নিজের মাইনে এবং অন্য আয়ের উপর ট্যাক্স দেয়। কিন্তু করপোরেট ট্যাক্স দেবে নিজের আয় থেকে খরচা কেটে শুধু প্রফিটের উপর। দেশের সবচেয়ে বড় দশটি কর্পোরেট ঘরানা ১৯৮২ সাল পর্য্যন্ত লাভের উপর কোন ট্যাক্স দেয় নি। এদের বলা হয় জিরো ট্যাক্স কোম্পানি। এমনকি রিলায়েন্স ৩০ বছর জিরো ট্যাক্স কোম্পানি ছিল, ১৯৯৬-৯৭ সালে প্রথম ট্যাক্স দেয়। তারপর রয়েছে ট্যাক্স-মুক্ত কিছু দেশে শেল কোম্পানি (কাগুজে কোম্পানি) খুলে ট্যাক্স এড়িয়ে যাওয়া।
সাম্প্রতিক কালে পানামা পেপার্স ঘটনায় আদানি পরিবারের বিনোদ আদানির শেল কোম্পানি নিয়ে সুপ্রীম কোর্ট তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল।
এই পুঁজিবন্ধু নীতির ফলে দেশের বাকি জনতার কী অবস্থা।
অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার মাথাপিছু আয়ের তালিকায় নীচের দিকের ৫০%
জনতার রাষ্ট্রীয় আয়ে ভাগীদারি মাত্র ১৩% , আর রাষ্ট্রীয় সম্পদে অধিকার ৩% এর কম।
এবার দেখা যাক জিএসটি নামক রিগ্রেসিভ ট্যাক্সের বোঝা কার ঘাড়ে বেশি।
একই অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে নীচের ৫০% থেকে জিএসটির ৬০% এর বেশি আদায় হচ্ছে, আর জনসংখ্যার ৪০% যে মধ্যমবর্গ, তাদের থেকে জিএসটি আদায় হচ্ছে ৩৩%, অথচ শিখরে বসে থাকা উচ্চবিত্ত ১০% দিচ্ছে ৩-৪% জিএসটি।
সবার দরকারি জিনিস যেমন ওষুধের ৮০% আইটেমে, জিএসটি ৯% থেকে বেড়ে ১২%, হয়েছে।
এমনকি জীবন বীমা এবং মেডিক্লেমেও জিএসটি ১৫% থেকে ১৮% প্রতিশত!
তাহলে দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ সরকারের থেকে কী পরিষেবা পাচ্ছে? সরকারি স্কুল ও হাসপাতালের মান খারাপ হলেও সাধারণ মানুষ প্রাইভেট স্কুল ও হাসপাতালে যেতে পারে না। রাস্তাঘাট, পরিবেশ দূষণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। কিন্তু এইসব ইস্যুতে বাজেটের কত প্রতিশত খরচের জন্য নির্ধারণ করা হয়? এসব দেখেই যখন সংসদে দিল্লির এক সাংসদ রাঘব চাড্ডা সরকারের দিকে আঙুল তুলে বলেন যে তোমরা কর আদায় কর ইংল্যাণ্ডের মত, অথচ পরিষেবা দাও আফ্রিকার সোমালিয়ার মত, তখন আমরা সায় না দিয়েই পারি না।
বিশ্ব অসাম্য পরীক্ষাগার
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি (ফ্রান্স) তাঁদের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আয়ের কাটাছেঁড়া করে বলেছেন—আয় বৈষম্যের ব্যাপারে ভারত ইতিমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে আয়-অসাম্যের দেশের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। গত কয়েক দশকে জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে বটে, কিন্তু বেশিরভাগটাই গেছে জনসংখ্যার উপরতলার ১০% এর পকেটে; ঠিক করে বললে তাদের মধ্যেও উপরের ২% এর হাতে।
ফলটা ভালো হয়নি। সাধারণ মানুষের বাস্তবিক আয় কমেছে। বাজারে উপভোগ বস্তুর চাহিদা কমেছে এবং বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। এই কথাগুলো নানা ভাবে সরকারের বাজেট পূর্ব আর্থিক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনেও এসেছে। কিন্তু বিত্তমন্ত্রীর বাজেটে তার প্রতিফলন কোথায়? পরিকাঠামোতে বড় বিনিয়োগের কথা রয়েছে, তাতে বড় শিল্পপতি এবং সরকার যুক্তভাবে কাজ করবে এবং বার্ষিক ১২ লক্ষ আয়ে আয়করে ছুট—আর কিছু?
শিক্ষা, গবেষণা এবং স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের প্রতিশত প্রতিবছর কমছে।
সবচেয়ে বড় কথা গত একদশকের বাজেটে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল, যেসব বড় বড় যোজনার কথা বলা হয়েছিল (যেমন, কৃষিক্ষেত্রে আয় দ্বিগুণ করা, ‘নমামি গঙ্গে’ যোজনা) তার উপলব্ধি -- সে নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য দেখলাম না।
সরকারের বিত্তীয় ঘাটতি (ফিসক্যাল ডেফিসিট) কম করার দুটো উপায়— করের মাধ্যমে আয় বাড়ানো এবং খরচ কমানো। দেখা যাচ্ছে সরকার আয়করে কর্পোরেট ঘরাণাকে বড় ছাড় দিয়ে জিএসটি বাড়িয়ে জনতার থেকে নিজের আয়ের ভরপাই করছেন। অন্যদিকে শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে হাত টেনে রেখেছেন। চিন স্বাস্থ্যখাতে ৭.১৯% এবং গবেষণায় জিডিপি’র ২.৪৩% , ভারত ১.৮৪% এবং ০.৬৫%।
অন্য উপায়?
পিকেটির মতে উপরের সারির বিত্তবানদের বা কর্পোরেট ঘরাণার থেকে চড়া হারে সম্পত্তি/বিত্ত কর আদায়।
শোনামাত্র অনেকে আপত্তি করছেন।
তাঁদের বক্তব্যঃ ভারতের মত দেশে সম্পত্তি/বিত্ত কর (wealth tax) লাগিয়ে লাভ হবে না। এই কর আদায় করতে আয়ের চেয়ে প্রশাসনিক খরচ বেশি হবে।
কিন্তু যাঁরা সম্পত্তি কর চড়া হারে লাগানোর পক্ষে তাঁরা বলছেনঃ এটা অজুহাত। বর্তমান ভারতে আর্থিক এবং বিত্তীয় লেনদেনের রেকর্ড ডিজিটালাইজেশনের ফলে নির্দিষ্ট রেকর্ডের বা কেনাবেচার পাত্তা লাগানো খুব সোজা।
এরসঙ্গে দরকার সাধারণ মানুষকে রেহাই দিতে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং পরিষেবার উপর জিএসটি হার কমিয়ে দেয়া। কিন্তু বাস্তবচিত্রটি ঠিক কী?
উপসংহার
জিএসটি কাউন্সিলের সাম্প্রতিক বৈঠকের পর বিত্তমন্ত্রী সীতারমনের প্রেস কনফারেন্স থেকে জানা গেল পপকর্নের তিনরকম জিএসটি ধার্য হয়েছে। সাধারণ মান—৫%, ব্র্যান্ড –১২% ,ক্যারামেল যুক্ত—১৮%
হাসব না কাঁদব?
এদিকে রোজকার চাল-ডাল-আটা-চিনি-ময়দার উপর জিএসটি দিতে হবে, কিন্তু বস্তা যদি ২৫ কেজির বেশি হয় তাহলে কোন জিএসটি দিতে হবে না।
একসঙ্গে ২৫ ২৫ কেজির দ্রব্য কে কিনতে পারে? হাসিম শেখ, রামা কৈবর্ত? আপনি আমি?
তাই এই বাজেটের আগে আমার বিনীত প্রশ্নঃ শাহেনশাহ্ , তুমি কোন শিবিরে?
0 comments: