0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





















১৯.১

জানুয়ারী মাসের আদ্দেক পেরিয়ে গেছে। এরপর ফেব্রুয়ারি এলে গ্রামসভার নির্বাচন হবে। ফের মার্চ মাসে হাইস্কুল আর ইন্টারমিডিয়েট কলেজের পরীক্ষা শুরু হবে। এই নির্বাচন একদিকে শনিচর ও বদ্রী পালোয়ানের কুস্তির আখড়াকে এবং অন্যদিকে রামাধীন ভীখমখেড়ী ও তার জুয়াড়ি সেনাপতিদের প্রজাতন্ত্রের সেবা করতে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এখন পর্য্যন্ত এদের সেবা করার বিশেষ পদ্ধতি বলতে যা দেখা যাচ্ছে তা হল বিরোধী দলকে পর্দার পেছনে গালমন্দ করা।

সবার আশা ফেব্রুয়ারি এসে গেলে এসব মুখোমুখি শুরু হবে। মার্চের পরীক্ষার কথা? এখনও কেউ ফাঁসে নি। ছাত্রের দল, অধ্যাপককুল, বিশেষ করে প্রিন্সিপাল সাহেব –কারও কোন হেলদোল নেই।

কিন্তু প্রিন্সিপাল সাহেব অন্য এক মামলায় ফেঁসে গেছেন। কিছুদিন আগে, কলেজ কমিটির বার্ষিক সভায় বৈদ্যজীকে সর্বসম্মতিতে ফের ম্যানেজার নির্বাচিত করা হয়। এটা নিয়ে কিছু সদস্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছেন। ওদের বক্তব্য—প্রস্তাবের বিরোধী সদস্যদের সভায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি, বরং আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ধমকানো হয়েছিল।

এই কথাটা চিঠিতে এত ফেনিয়ে লেখা হয়েছে যে ওটা পড়াই এক কঠিন কাজ। আর পড়লেও বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ, চিঠির পুরো বিবরণ সত্যি হলে মেনে নিতে হয় যে শিবপালগঞ্জে কোন নিয়ম কানুন নেই, থানা-পুলিশ বলতে কিছুই নেই, ওখানে গোটা চারেক গুণ্ডা মিলে যা খুশি তাই করে চলেছে।

এটা স্পষ্ট-- এই নালিশ যে মিথ্যে সেটা বুঝতে কোন তদন্তের আবশ্যকতা নেই। তবু বিরোধী পক্ষের কিছু সদস্য শহরে গিয়ে ওই নালিশের কপি করে শিক্ষা বিভাগের বড় বড় অফিসারের টেবিলে জমা করে ফিরে এল। তারপর গাঁয়ে এসে রটিয়ে দিল যে নালিশের তদন্ত করতে ডিপ্টি ডায়রেক্টর অফ এজুকেশন পদের অফিসার করবেন।

উনি নাকি সাদাসিধে গরু। কিন্তু এবার বৈদ্যজীর বাপেরও সাধ্যি নেই যে ওনাকে দুইয়ে নেবে। কারণ উপর থেকে সঠিক তদন্তের হুকুম জারি হয়েছে।

প্রিন্সিপাল সাহেবকে ফাঁসাতে ওইটুকুই যথেষ্ট। উনি জানেন যে তদন্তের দিকটা বৈদ্যজী নিজে দেখবেন। কিন্তু তদন্ত শুরু হলে হাকিমদের আনাগোনা লেগে থাকবে। সেসব প্রিন্সিপালকেই সামলাতে হবে। হাকিম কলেজে এলে সবার আগে কী দেখবেন? প্রিন্সিপাল নিজেকে উত্তর দিলেন— কলেজ ভবন।

এবার উনি ভবনের সৌন্দর্য বাড়াতে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন।

শহরে গিয়ে দেখে এসেছেন-- একটা ছোট চারাগাছ পুঁতে তার চারদিকে ইঁট দিয়ে গোল ঘিরে লাল -সাদা রঙ লাগিয়ে দিলে অবহেলায় পড়ে থাকা মাঠ কেমন বাগান সেজে ঝলমলিয়ে ওঠে! ভাবলেন, কলেজের সামনে একসারি গুলমোহর আর অমলতাস গাছ লাগিয়ে দেয়া যাক। আর হাকিমের দলবল আসার আগেই নানারঙের ইঁট দিয়ে ঘিরে দেয়া যাক।

ওঁরা আসার সময় দেখবেন নানারঙে সেজেওঠা সাফ-সুতরো কলেজভবন এবং ফিরবেন একপেট ফার্স্ট ক্লাস চা এবং নাস্তা গিলে। তাহলে আর আমার বিরুদ্ধে কী রিপোর্ট দেবেন?

প্রিন্সিপাল সাহেব এসব ভেবে জানুয়ারির হাড়কাঁপানো শীতের অজুহাত ঝেড়ে ফেলে কাজে নেমে পড়লেন। গাছ লাগাতে বছরের যে কোন সময় উপযুক্ত বটেক—চুলোয় যাক বৈজ্ঞানিক লেকচারবাজি!

উনি কলেজের পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে গর্ত খোঁড়ার তদারক করছিলেন। ওনার হাতে দুটো বই—একটা মোটা আর একটা পাতলা—দেখামাত্র মনে হবে খুব দামি। । পরনে ওনার প্রিয় কেজো পোশাক, অর্থাৎ মোজাছাড়া জুতো আর হাফপ্যান্ট। লোকে দেখে যাই ভাবুক, উনি এই পোশাকে নিজেকে বেশ চটপটে এবং চালাক ভাবেন। বইদুটোকে উনি পোষা বেড়ালের মত আদর করে ধরে আছেন।

একজন মজুর কোদাল-গাঁইতি চালানো থামিয়ে ওনাকে বলল, ‘দেখে নিন মাস্টার সাহেব, গর্ত তো এতটাই হবে’?

প্রিন্সিপাল মাথা নেড়ে বললেন, ‘হুঁহ্‌ এটা কোন গর্ত হল? একটা পাখি মুতে দিলেই উপচে পড়বে। খুঁড়ে চল বেটা, এখনও অনেক বাকি’।

এসব বলে উনি পাশে দাঁড়ানো এক মাস্টারের দিকে দর্পভরে তাকালেন। মাস্টারমশায়টি ওঁর আগে থেকেই চেনা, কারণ সে এনার খুড়তুতো ভাই। তিনিও এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলেন শত্রুপক্ষের কোন মাস্টার কাছাকাছি আছে কিনা। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে আত্মীয় ঢঙে বললেন—ভাইয়া, এই কলেজে তুমি তো এখন উদ্যান-বিশারদ!

প্রিন্সিপাল বইদুটো বুকে ঠেকিয়ে বললেন, ‘সবকিছু এদের জন্যে সম্ভব হয়েছে। তবে ব্যাটারা বড্ড কঠিন সব ইংরেজি লিখেছে। বুঝতে গেলে সাধারণ-বুদ্ধির মাথা বোঁ- বোঁ করে ঘুরবে’।

খুড়তুতো ভাই উবাচ, ‘আপনি তো লৌহপুরুষ! কলেজের এত এত কাজ, পলিটিক্সে মাথা গরম হয়ে যায়। তারপর আপনি বইও পড়ে ফেলেন! আমার তো অবস্থা হল কেউ বই পড়তে না বলুক, বরং দশ ঘা জুতো মারুক। বই দেখলে গা গুলোয়’।

প্রিন্সিপাল ফিফটি পার্সেন্ট বড়দা এবং বাকি ফিফটি পার্সেন্ট প্রিন্সিপাল হয়ে বললেন- ‘চুপ কর। এসব বলতে নেই। সফরের সময়ও বই সঙ্গে রাখি। শুধু কোট-প্যান্ট পড়লে কী হবে? তাই দেখে কেউ তোমায় অধ্যাপক বলবে ভাবছ? কোট প্যান্ট তো কুঁজো বামনও পরতে পারে’।

ভাই বলল, ‘আপনিই ঠিক। মাঝখানে বাধা দেয়া আমার স্বভাব নয়। কিন্তু আমাদের আর কুঁজো-বামনের মধ্যে তফাৎ কোথায়? এই শালার টেক্সট বুক, বুঝে নিন, পচাগলা ফল ছাড়া কিছু নয়। আমরা ছোঁড়াদের পেটে এগুলো ঠুঁসতে থাকি। কারও হজম হয়, কেউ বমি করে ফেলে’।

প্রিন্সিপাল হেসে ফেললেন। ‘কথাটা অনেক দূর অব্দি নিয়ে গেলে। কিন্তু অতি বুদ্ধিমানের মরণ নিশ্চিত’।

কথাটা বলে উনি গর্ত কতটা গভীর হল উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। যেন কোন বুদ্ধিমানের মরণ হলে তাঁকে এই গর্তেই কবর দেবেন।

এমনসময় ওখানে আগমন হল খান্না মাস্টারের। উনি হড়বড় হড়বড় করে এসে প্রিন্সিপালের হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন—নিন, ধরুন।

প্রিন্সিপাল একবার সাহায্যের আশায় তুতো ভায়ের দিকে তাকালেন। তারপর গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে কঠোর মূর্তি ধরে অফিসারি মেজাজে বললেন—এটা কী?

--কী আবার! একটা কাগজ।

ওর দিকে বুক চিতিয়ে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন দেখে খান্না মাস্টার হিতৈষী স্বরে বলল—দিন, পড়ে শোনাচ্ছি।

--‘যান, নিজের কাজ করুন। আমাকে পড়ানোর কষ্ট নাই করলেন’। এসব উনি ঘেন্না মিশিয়ে বললেন।

খান্না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল—এই জন্মে পড়ানোর হাত থেকে রেহাই কোথায়!

তুতো ভাই খান্না মাস্টারকে একদৃষ্টিতে দেখছিল। মালিকের বাংলোর ভেতর থেকে পোষা অ্যালসেশিয়ান রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলোকে যে চোখে দেখে। প্রিন্সিপাল অনেকক্ষণ ধরে কাগজের টুকোরোটার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে রইলেন। প্রাচীনকালের ঋষিমুনি হলে কাগজটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেত। খানিকক্ষণ পরে উনি ওই কাগজটাকে খান্না মাস্টারকেই ফেরত করে দিলেন।

খান্না রেগে গেল। ‘এটা কী’?

--‘কী আবার, কাগজ’। এবার প্রিন্সিপাল মন দিয়ে গর্তের গভীরতা দেখতে লাগলেন।

খান্না মাস্টার ঠোঁট কামড়ে গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘যাই হোক, লিখে আবেদন দিয়েছি। আপনার আদেশ ওই আবেদনের উপর লিখে দিতে হবে’।

প্রিন্সিপাল একজন মজুরের সঙ্গে কথা বলছিলেন-‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার থাম। আবে, গর্ত খুঁড়ছিস, কুয়ো নয়। ঢের হয়েছে’।

খান্না খানিকক্ষণ চুপচাপ। ফের মুখ খুলল,’আমি চারদিনের জন্য বাইরে যাব। ছুটি চাই। আপনি লিখে হুকুম দিন’।

প্রিন্সিপাল পায়ের পাতায় ভর দিয়ে গর্তের পাশে জমা ভিজে মাটির উপর বসেছেন। যাদের চোখ আছে, তারা দেখুক—কলেজের স্বার্থে উনি কাদা হোক, নালা-নর্দমা হোক, কিছুরই পরোয়া করেন না। এবার উনিমাটিকাটা মজুরদের গর্তের চারপাশে উঁচু করে আল বাঁধার ব্যাপারে বিস্তারিত নির্দেশ দিতে লাগলেন।

খান্না মাস্টারের কথাবার্তা এবার পার্শ্বসংগীতের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তিনিও গর্তের উলটো পাড়ে পায়ের পাতায় ভর করে বসে বলে উঠলেন—‘ গর্তের ভেতর লাফিয়ে পড়ার আগে আমার কথার জবাব দিয়ে যান’।

প্রিন্সিপাল ওর দিকে খোলাচোখে তাকালেন। বললেন—‘ আগে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে গর্তে ফেলব, তারপর তোমার উপর লাফিয়ে পড়ব। বুঝলে হে খান্না মাস্টার’! ডায়লগ মেরে উনি তুতো ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ভাইটি একেবারে বিনয়ের অবতার হয়ে নম্রস্বরে বলল-‘যাই, চাপরাশিদের ডেকে আনি। মনে হচ্ছে ভালরকম ঝগড়া ঝঞ্ঝাট হবে। কিন্তু আমার দিব্যি, আমি ফিরে না আসা পর্য্যন্ত আপনি কিছু বলবেন না’।

--‘আমি আর কী বলব ভাই! সবকিছু মুখবুজে সহ্য করে যাচ্ছি। যেদিন ওর পাপের ঘড়া পূর্ণ হবে, সেদিন নিজে থেকেই ভক্‌ করে ফাটবে’।

প্রিন্সিপাল খান্না মাস্টারকে শাপ দিলেন নাকি? ও বেশ ঘাবড়ে গেল। ওর ভয় প্রিন্সিপাল হঠাৎ চেঁচাতে না শুরু করে—খান্না আমার গায়ে হাত তুলেছে। তারপর খান্না মামলা মোকদ্দমায় না ফেঁসে যায়!

ও চুপচাপ উঠে গর্তের থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মাস্টারের কাছে গেল। তারপর গোটা দুনিয়াকে শুনিয়ে চেঁচাতে লাগল—ভয় দেখাবেন না মাস্টার সাহেব, ধমকি দেবেন না। এটা নবাবী আমল নয়। এত সহজে খান্নার প্রাণ যাবেনা। বলে দিচ্ছি, আমার গায়ে হাত তুলেছেন তো রক্তগঙ্গা বইবে। এই বলে দিলাম, হাঁ!

খান্না ঠিক চেঁচাতে চায়নি। কিন্তু জোর গলায় বলতে গিয়ে ব্যাপারটা চেঁচানোর স্তরে পৌঁছে গেল। কয়েকজন মাস্টার এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। খান্না হঠাৎ বিকট চিৎকার করে উঠল—‘মারুন, মারুন না আমাকে! ডেকে আনুন যত চাপরাশির দল। ওদের হাতেই আমার অপমান হোক। থেমে গেলেন কেন’?

খাসা তামাশা জমেছে। এই সত্যি কথাটা বোঝার তাগিদে দুই দলের কিছু মাস্টার দুদিকে জড়ো হল। ছাত্রের দল এখনও আসেনি। যে দু একটা এসেছিল, তাদের চাপরাশিরা আগে থেকেই ভাগিয়ে দিল। ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখতে পাচ্ছিল। তবে এই তামাশা সেরেফ ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ হয়ে গেল।

প্রিন্সিপল সাহেব এই আচমকা আক্রমণে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেছলেন। তারপর ঠেলে ওঠা ক্রোধকে সংযত করে খান্নার কাছে গেলেন। ছুটির দরখাস্তটি ছিনিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন—‘চেঁচিও না খান্না মাস্টার! তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে। দাও, দরখাস্তের উপর আদেশ লিখে দিচ্ছি’।

ওঁর ইশারায় তুতোভাই মাস্টার একটা ফাউন্টেন পেন বাড়িয়ে দিল। উনি হাতের হর্টিকালচারের বইটার উপর ছুটির দরখাস্তটি রেখে তার উপর খসখস করে কলম চালাতে লাগলেন। লিখতে লিখতে বললেন—‘আমাদের লড়াই নীতির। এর মধ্যে মারপিটের কথা উঠছে কেন? ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে’।

খান্না মাস্টার নিজের খাড়া করা তামাশায় নিজেই ক্লান্ত হয়ে বলল,-‘আগে এই দরখাস্তের ওপরে হুকুম লিখুন। তারপর বাকি কথা’।

তিনি মুচকি হেসে জানালেন,-‘সেটাই করছি’।

কয়েকটা শব্দের উপর উনি ‘ক্রস’ চিহ্ন লাগালে। অন্য কয়েকটায় গোল করে ঘিরে দাগিয়ে দিলেন। শেষে বড় করে ইংরেজিতে একটা শব্দ লিখলেন—‘রিজেক্টেড’!

খান্না মাস্টারের মুখ থেকে কোন শব্দ বেরোনের আগেই তিনি দরখাস্ত ওকে ফেরত দিয়ে বললেন—স্পেলিংয়ে অনেকগুলো ভুল। ‘হলিডে’ শব্দে ‘এল’ অক্ষরের পরে ‘ওয়াই’ লেখা হয়েছে। ‘খান্না’ শব্দে ‘কে’ অক্ষরটা ক্যাপিটালে লেখা নাকি স্মল বোঝা দায়। এসব খেয়াল করা উচিত’।

খান্না বাকশক্তিরহিত। তারপর হঠাৎ গণ্ডারের মত মুখ খুলে গর্জন করে উঠল—‘ একবার কলেজের বাইরে আয়! তোর সমস্ত স্পেলিং ওখানেই শিখিয়ে দেব’।

ব্যস্‌ মহারণ শুরু।

0 comments: