0

গল্প - সৌমিত্র চৌধুরী

Posted in

‘উঃ...’

আবার সেই মিহি ডাক। কান দিয়ে ঢুকে নিমেষে মাথায়। তারপর বুকে। এ নিয়ে দ্বিতীয় বার। আগেরটাকে তেমন আমল দেয়নি ঋজু। এবারটাকে দিতে হল। শব্দটা খচ্‌ করে বুকের খাঁচার বাঁদিকটা ভেদ করে ভিতরের নরম পর্দায় গিয়ে বিঁধল।

ঘাড় ঘুরিয়ে এপাশ–ওপাশ দেখল ঋজু। চারদিক ফাঁকা। নির্জন। কেউ কোথাও নেই। একটু ঘাবড়ে গেল ঋজু।

সন্ধ্যাবেলা এদিকের রাস্তায় লোক হাঁটে না। আলো নেই। অন্ধকারের পেটে ডুবে থাকে গাছ, লতাপাতা, বাড়িঘর। চোখের আলোয় পথ চিনতে হয়। পথ সরু, তার উপর খানা খন্দে ভরা। মানুষ চলতে পারে না। কুকুর বিড়াল চলে অবশ্য। ওদের চোখ তো অন্যরকম। অন্ধকারেও দেখতে পায়।

অন্ধকারে এখন চোখ অনেকটা সোয়ে এসেছে। রাস্তার গর্ত টর্ত বুঝে সাবধানে পা ফেলছিল ঋজু। সামনে একটা ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ। ওর তলায় অন্ধকারটা জমাট বেঁধেছে। কালো পাথরের মত জমাট। ওদিকে চোখ রেখে ধীর পদক্ষেপে এগোচ্ছিল ঋজু। তখনই আবার।

‘উঃ আঃ...।’

থামল ঋজু। শব্দটা কোথা থেকে আসছে? কান খাড়া করে টানটান দাঁড়াল। ডাইনে-বাঁয়ে চোখ চালাল। অন্ধকার। নজরে এল না কিছু। কেন যে বাতি দেয় না এ পথে! খোঁজ নিলেই শুনতে পায়, এবার এসে যাবে। খুঁটি পোতা হয়ে গেছে। বিদ্যুতের তার লেগে যাবে শিগগির। ব্যাস!

‘ব্যাস’ আর হয় না। শিগগিরটাও আসে না। সপ্তাহ মাস বছর পেরিয়ে গেলেও অবস্থা যে-কে সেই। অন্ধকার। অন্ধকারে ঢাকা রাস্তাটা পার হলে অবশ্য একটু আলোর ছিঁটে চোখে এসে লাগে। জেলা পরিষদের সরু রাস্তার সাথে মিশেছে এই পথটা। ওখানে বিদ্যুতের খুঁটির উপর বাতি জ্বলে। কিন্তু টিমটিমে। আলোর ছটা উপরেই আটকে থাকে। মাটি ছুঁতে পারে না। তবু ভালো। ঘন অন্ধকার তো নয়। মিটমিটে আঁধার। চোখের আলোয় পথ চেনা যায়। সে কারণে জেলা পরিষদের ওই রাস্তায় রাত বিরোতে মানুষজনের চলাচল।

কিন্তু এ পথটা? নির্জন আর অন্ধকার তো! মানুষ ভয় খেয়ে এড়িয়ে যায়। ভয় পাবারই কথা। অন্ধকারে কত কিছু থাকে। তবে অল্প কিছু মানুষ আছে যারা অন্ধকারকে আমল দেয় না। তাদের বুকে ভয় ডর কম।

যেমন ঋজু। ওর মত দু’চারজন আরও আছে। তাজা যুবক ওরা। প্রয়োজনে এপথ ধরে হাঁটে বৈকি! যেমন আজ। ডিউটি থেকে বেরোতে দেরি হলো খানিক। অফিসে সিকিউরিটির কাজ। চাকরিটাও নতুন। রিলিভার না এলে বেরিয়ে আসা যায় না। সে এল হাঁপাতে হাঁপাতে পঁচিশ মিনিট দেরিতে। রাস্তায় বাস নাকি খারাপ হয়ে গেছিল। রিলিভারকে চার্জ বুঝিয়ে বেরিয়ে আসতে আরও আধ ঘণ্টা। পাঁচটা চব্বিশের ট্রেনটা ধরা গেল না। পরের ট্রেন চল্লিশে।

হাতে একটু সময় পেল ঋজু। ষ্টেশনের বাইরে খিদে মেটাতে একটু দাঁড়াল। রাস্তার ধারেই আরিফের দোকান, ‘ফ্রেশ বিরিয়ানি’। সস্তার এক প্লেট কিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গপ গপ করে গিলল ঋজু। খেতে ভালো না, তবে খিদের পেটে দিব্যি চলে যায়। বন্ধুরা বলে ‘সস্তার কাউয়া বিরিয়ানি। সস মাখিয়ে খেয়ে নে।’

কাকের মাংস দেয়, তাই নাকি এত সস্তায় বিক্রি করতে পারে আরিফ। সস্তা বিরিয়ানির মাংসে একটা বাজে গন্ধ পাচ্ছিল ঋজু। প্রথমে বুঝতে পারে নি। কিন্তু পেট ভরতেই গা-টা গুলিয়ে উঠল। তারপরই একটা বিচ্ছিরি ঢেকুর উঠল। মুখের বাজে স্বাদ চাপা দিতে একটা মিষ্টি পান কিনে মুখে পুরল। তারপর স্টেশনে ঢুকে প্লাটফর্মের দিকে হন হন করে পা চালাল। ঠিক তখন গড়িয়ে গড়িয়ে ট্রেনটা ঢুকল কুড়ি মিনিট লেটে।

তবে ছাড়তে দেরি করেনি অবশ্য। কিন্তু পরের ষ্টেশনে ঢুকবার আগেই সিগন্যালের গ্যাঁড়াকলে আঁটকে গেল। তারপর চলল বটে কিন্তু ধিকিয়ে ধিকিয়ে। মন্দিরতলা পেরানোর পর একটু গতি পেল। তবে অনেকগুলো দেরি যোগ হতে হতে শেষমেশ নিজের স্টেশনে ঢুকলো দেড় ঘণ্টা লেটে।

ট্রেন থেকে নেমেই ভিড় ঠেলে হনহনিয়ে হাঁটা লাগাল ঋজু। একটু দূরে পাকুড়তলা পেড়িয়ে বাঁ-দিকের সর্টকাট ধরল। মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই বুড়োদার চায়ের দোকান। ওখানেই আড্ডা মারে ঋজু।

ঠিক সময়ে ট্রেন থেকে নামলে সোজা বাড়ি চলে যায়। পোশাক পাল্টে দাদার মেয়েকে কোলে নিয়ে ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটে। তারপর সাইকেল নিয়ে আড্ডা মারতে চলে যায়। আর অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে বাড়ি যায় না। ঘেমো পোশাকেই আড্ডা মারতে বসে যায়।

ক্লাবের বহু ছেলে পাল পাড়ার মাঠে বিকেলে ঘাম ঝড়ায়। তারপর বুড়োদার দোকানে বসে আড্ডা মারে। ক্লাবের মাঠে সকালে প্র্যাকটিস করে ঋজু। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা যখন নামে, ডিউটি ফেরত আড্ডা মারতে বসে। আজকেও বাড়ি না গিয়ে আড্ডায় বসল ঋজু। কিন্তু মন দিতে পারল না। পেটে কেমন একটা ব্যথা ব্যথা ভাব। মাথাটাও ঝিম ঝিম করছে।

আড্ডা থেকে উঠে বাড়ির পথ ধরল। সর্টকাট রাস্তায় একটু হাঁটতেই কানে এল ডাকটা। ‘উঃ আঃ...’। যন্ত্রণার কাতরানি! অবাক হয়ে একটু দাঁড়াল ঋজু। এবার কানে এল ফিনফিনে গলায় ডাক। ‘মিউ মিউ’।

বিড়াল ডাক? কিন্তু ডাকটা যেন অন্য রকম! এবার বেশ একটু ঘাবড়ে গেল ঋজু। বুকটা ধক করে উঠল। পেটে কনকনে ব্যথা। মাথায় ঝিম ঝিম। কিন্তু সাহস হারায়নি ঋজু। বরাবরের ডানপিটে ছেলে। খেলা ধুলায় ওস্তাদ। ফুটবলটা দারুন খেলে। দু’পায়েই জোরে শট নিতে পারে। এবছর এলাকার বড় ক্লাব, স্পোর্টিং ইউনিয়নের সেন্টার ফরোয়ার্ড ঋজু রায়।

পাল পাড়া মাঠের পেছন দিকে আগাছা ভর্তি উঁচু নিচু রাস্তায় হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ঋজু। টানটান শরীর। কোমরে দু’হাত রেখে সামনের দিকে ঝুঁকল। কপাল কুঁচকে চারপাশটায় চোখ বুলাল। কোথাও কিছু নেই। হঠাৎ একটু দূরে কচু পাতার ঝোপে কিছু একটা নড়ল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ওদিকটায় তাকিয়ে রইল ঋজু।

এবার স্পষ্ট শুনল ডাকটা। ‘উফ উফ’। মানুষের মত ডাক! দু’পা এগিয়ে কান খাড়া করে সামনে ঝুঁকল ঋজু। অন্ধকারেও অল্প দেখত পাচ্ছে এখন। এবার নজরে এল জিনিসটা। একটা বেশ মোটা বেড়াল। সাদা কালো রঙ। স্পষ্ট শুনল ওর ডাক, ‘মিঁউ, মিঁউ’।

এতক্ষন মানুষের মত ‘উঃ আঃ’ করছিল কেন? ভাবতেই পা থেকে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। শিরশিরানি একটা ভয়! শুকনো জিভে কথা সরল না। জিভটা কিছুক্ষণ চেটে নিয়ে গলাটা ভারি করে ঋজু বলল, ‘কে ওখানে?’

‘আমি বেড়াল’, আওয়াজটা এবার স্পষ্ট।

‘বেড়াল? বেড়াল আবার কথা বলতে পারে নাকি?’ ভয় পেয়ে বিজবিজে গলায় বলল ঋজু।

‘পারে পারে। আজ কান মাথা ভোঁভোঁ করছে তো। তাই শুনতে পাচ্ছো।’

বলে কি বেড়ালটা? এবার বেশ একটু ভয় পেয়ে গেল ঋজু। হাঁটু দু’টো ঠক ঠক করে উঠল।

ওর দিকে তাকিয়ে একটু নড়তে চেষ্টা করল বেড়াল। তারপর শুকনো ঠোঁট চেটে নিয়ে মানুষের গলায় কুঁথিয়ে কুঁথিয়ে বলল, ‘আমি ভূত-টুত নই। সত্যিকারের বেড়াল। ভয় পেয়ো না।’

‘ওঃ তুমি তা’লে সত্যিকারের বেড়াল। আমি শুধুই ভয় পাচ্ছিলাম।’ কথাটা বলে ঝট করে মাটি থেকে একটা আধলা ইট কুরিয়ে নিল ঋজু।

‘আমাকে মারবে? মারো। আধমরা তো হয়েই আছি।’ বেড়ালটা মেয়ানো গলায় বলল।

কেমন একটু মায়া হলো ঋজুর। হাতের ইটটা পেছনে ফেলে দিয়ে বলল, ‘আধমরা কে করল তোমাকে?’

‘তিনতলা নতুন বাড়িটার ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেছিলাম।’

‘পড়ে গেলে কেন’?

‘হোটেলের পচা খাবার খেয়ে ছাদে উঠে বমি করছিলাম। তখন বাড়ির ধেরে ছেলেটা তাড়া করল। পালাতে গিয়ে বেকায়দায় রাস্তায় আছাড় খেলাম।’

‘তারপর?’

‘পাড়ার একটা বাচ্চা ছেলে আমার মুখে একটু জল ঢেলে দিল। তাতে একটু বল পেলাম’’

‘তারপর?’

‘তারপর মরে যাবো বুঝতে পেরে ঘেষ্টে ঘেষ্টে শরীরটাকে এখানে টেনে নিয়ে এলাম।’

একটু থামল বিড়ালটা। দম নিল কিছুক্ষণ। তারপত হাঁপ ধরা গলায় টেনে টেনে বলল, ‘মৃত্যু আসছে বুঝলে আমরা তো স্বজন পরিজন কাউকে ডাকি না। দূরে চলে যাই। একা একা শুয়ে অপেক্ষা করি কখন মরণ আসে।’

‘তাহলে মরণের অপেক্ষা কর। আমি চললাম।’ কেমন একটু নির্বিকার গলায় বলল ঋজু। বিড়ালের কান্না কষ্ট যন্ত্রণা এসব দেখতে ইচ্ছে করছিল না। পেটের ব্যাথাও চাগিয়ে উঠছিল। বিড়ালটার উদ্দশ্যে মনে মনে ঋজু বলল, আমি বাড়ি যাই। তুমি মর। মর।

বিড়ালটা বলে উঠল, ‘মরবো তো বটেই। ভয় পাইনা কোন। তবে... অন্য একটা ব্যাপার আছে...।’

‘কী ব্যাপার?’

‘তোমাদের বিপদ আছে।’

‘তুমি মরলে আমাদের আবার কী বিপদ?’

‘সেটা জানাতেই তো না মরে বসে আছি।’

‘আশ্চর্য ব্যাপার! কী জানাবে বল।

‘বলছি শোনো। বিড়ালের নাদুস নুদুস শরীর। কিন্তু ওর মাংসে অনেক দোষ। খেলে তোমাদের ঘোর বিপদ।’

‘বিড়ালের মাংস খেতে যাবো কেন আমরা? এমনিতেই কাউয়া বিরিয়ানি খেয়ে পেটে আইঢাই। চিনচিনে ব্যথা। তারপর তোমার ঘিনঘিনে কথা। গা গুলিয়ে উঠছে আমার।’

‘উঠবারই কথা। তবে যা বলছি খাঁটি কথা, বুঝলে! আমি না-চাইলেও তোমাদের পাতে উঠে যাবে মরা বেড়াল।’

‘কি সব আবোল তাবোল বকছো?’

‘বিশ্বাস হচ্ছে না তো?’

দু’পাশে মাথা নাড়াল ঋজু। ম্যাও ম্যাও করতে করতে বিড়ালটা বলল, ‘আমি মরলে পঞ্চু ডোম বডিটা ভাগাড়ে ফেলে দেবে। তারপর ওসমান আর বিল্লু চুপি চুপি আসবে। ছাল ছাড়িয়ে আমার মাংস বাজারে চালান করবে। তোমরা টাকা দিয়ে কিনে সেই জিনিস চেটে পুটে খাবে।’

‘পেট গুলিয়ে উঠল ঋজুর। বমি করতে ইচ্ছে হলো। ক’বার থুতু ফেলে বলল, ‘তাই আবার হয় নাকি?’

‘হয় হয়। মৃত্যুপথ যাত্রী মিছে কথা বলে না। অনিত্য সংসারে সব চাওয়া পাওয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে তো, তাই!’

‘বড় বড় কথা বলছ। তোমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।’

‘হবে। বিশ্বাস হবে যখন কাগজে পড়বে, টিভিতে দেখবে।’

‘ও সব কথা থাক।’

‘ঠিক আছে, থাক। আমার কথা তো বিশ্বাস করবে না। তবে নিজের চোখে দেখে এসো। ভাগাড়ে মরা গরু কুকুর হাওয়া। মাজারের পেছনে দু’টো কবরের মাটি খোঁড়া। কে করল এ সব?’

‘খুব বাজে কথা বলছ কিন্তু তুমি?’

‘ঠিক আছে। আমি বাজে বকছি। তবে একবার খোঁজ নিও।’

একটু থামল বিড়ালটা। শরীরের শক্তি কমে আসছে। ধুঁকতে ধুঁকতে বলল, ‘একটা কাজ করবে তুমি? বলতে পার আমার শেষ ইচ্ছে।’

মনটা খুব নরম হয়ে গেল ঋজুর। পেটের ব্যথা ভুলে গেল। গলায় দরদ ফুটিয়ে বলল, ‘কী কাজ করতে বলছ?’

‘সহজ কাজ। আমি মরে গেলে বডিটা মাটিতে পুঁতে দিও। পঞ্চু ডোম আর ওর শাকরেদগুলো... যেন দেখতে না পায়।’

‘যদি না করি?’

‘ভাগড়ের মাংস খাবে তোমরা। খাচ্ছোও চেটে পুটে। আর... কবরের...।’

কথা শেষ করতে পারল না বিড়াল। গলার আওয়াজ একদম কমে এল। বাকি কথা শুনবার জন্য মুখ নিচু করল ঋজু। বিড়ালটা মিউ মিউ করছে, ‘তোমরা মানুষ না, ভাগাড়ের মাংস খাওয়া রাক্ষস। ন ন নরখাদ...।’

মুখ উপরে তুলে একটু বাতাস টানল বিড়াল। গলার স্বর এক পর্দা উঠল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘শিশুদের দেখো। ওরা ভালো মানুষ। এখনও ভাগাড়ের মাংস মুখে দেয়নি...!’

কথা শেষ করতেই বুকের সব বাতাস বেরিয়ে গেল। বিড়ালের কথা বন্ধ হয়ে গেল। বুকের ওঠা নামাটাও। ফট করে ঘাড় গুঁজে চোখ খুলে মরে গেল বিড়ালটা। এর আগে চোখের সামনে মৃত্যু দেখেনি ঋজু। ওর বুকটা টনটন করে উঠল।

বড় একটা শ্বাস ফেলল ঋজু। তারপর কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়াল। ওর কান তখনও ভোঁভোঁ করছে। মাথায় ঘাই মারছে বিড়ালের শেষ কথা গুলো—‘শিশুদের দেখো... ওরা এখনও ভাগাড়ের মাংস মুখে দেয়নি।’

0 comments: