ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক[কোনও প্রতিষ্ঠানবিশেষ বা ব্যক্তিবিশেষকে আঘাত দেওয়া এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয়। এটি নেহাৎ কিছু ব্যতিক্রমী ভালোবাসার গল্প। তবু কারও মনে আঘাত লাগলে আগাম মাফ চেয়ে রাখছি।
যদিও ধারা ৩৭৭-এর কাঠামো ধরে ঝাঁকানো হচ্ছে, আরও কিছু অচলায়তনের জানলা খুলে একজটা দেবীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা চলছে, তবু জনমানসে পঞ্চকদের প্রতি বিরক্তি ও মহাপঞ্চকদের প্রতি আস্থা আজও অটুট। তাই গাল খাওয়ার ভয় রয়েই গেল।
আসল ভয় নিজের ভেতরে; পাছে লেখনীর অক্ষমতায় এই ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে লেখা গল্প ভালোবাসার অন্তর্লীন বিষাদকে ধরতে না পারে? যদি সব ছাপিয়ে যৌনতার গন্ধ প্রবল হয়ে উঠে এটাকে ফুটপাথে বিছিয়ে রাখা লেখক/প্রকাশকের নাম গোত্রহীন সাহিত্যের ক্লাবের সদস্য করে দেয়?]
১)
“গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ”
রাঢ়বাংলার সীমানা ছুঁয়ে রুক্ষ কাঁকুরে মাটি ছাড়িয়ে শুরু হয়েছে লালচে পাথুরে জমি। এই জমিতে রয়েছে লোহার আকর, তাই রাঙামাটির ঢেলা আর ঝুরঝুরে নয়, বরং গনগনে রোদ্দুরে পুড়ে কোথাও কোথাও কালচে পাথরের গুলির মত। এদের বলা হয় মোরাম। অথচ মাইলখানেক দূরে বয়ে চলেছে এক কুলু কুলু নদী। এদের দেখেই বোধহয় রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি, দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি’। আবার কোথাও কোথাও রয়েছে গ্রীষ্মের দাবদাহে শুকিয়ে যাওয়া ফুটিফাটা পুকুর। সেখানে আবার কালো এঁটেল মাটি বা ব্ল্যাক কটন সয়েল। এই রুক্ষ জমিতে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে কাঁটাওলা কালচে বাবুল গাছ। আর আছে কুল গাছ, শাল গাছ, শিমূল, পলাশ ও মহুয়ার সারি।
এইখানে নগর সভ্যতার সামান্য দূরে অনেকখানি জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি পাঁচিলে ঘেরা আবাসিক বিদ্যালয়। উদ্দেশ্য—বালক বয়স থেকেই সঠিক শিক্ষা ও সংস্কারের মাধ্যমে মানুষ গড়ে তোলা।
সময়টা ষাটের দশক। স্বাধীন ও নতুন ভারতের নাগরিক গড়তে চাই নতুন ভাবনা চিন্তা। সেই নিয়ে নানারকম চিন্তা, নানান মডেল, নতুন সব এক্সপেরিমেন্ট। না, এটা কোন মিশনারি স্কুল নয়। বরং ভারতের প্রাচীন আদর্শের কথা মাথায় রেখে শিক্ষা দেওয়া যাতে বাচ্চারা ইউরোপীয় ভাবধারার বদলে ভারতীয় হয়ে ওঠে। বিদেশি টেকনোলজি চাই, কিন্তু দর্শন চিন্তা ও মূল্যবোধ যেন ভারতীয় হয়।
এই উঁচু পাঁচিল ঘেরা আশ্রমে কাদের বাচ্চারা পড়তে আসে? সোজা কথায় কোন বাবা-মা তার বাচ্চাদের পড়তে পাঠায়?
আসে স্থানীয় বাচ্চারা, বিশেষ করে আদিবাসীরা। তবে শুধু স্কুলে ভর্তি হয়, হোস্টেলে নয়। তবু হোস্টেলের ছাত্রসংখ্যা ১৭০ থেকে ২০০-র মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এরা আসে স্থানীয় ছোট বড় শহরের মধ্যবিত্ত ও সম্পন্ন ঘর থেকে। এদের বাপ-মা’রা বিশ্বাস করেন এখানে থাকলে চরিত্র নির্মাণ হবে। পাড়ায় বড় বড় ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কম বয়েস থেকেই বিড়ি-সিগ্রেট খাওয়া, সিনেমা দেখা, চটুল হিন্দি গান গাওয়া এসব ইল্লুতেপনায় আসক্ত হবে না।
এই আশায় সুদূর কোলকাতা থেকেও অনেকে বাচ্চাদের পাঠান এখানে ভর্তি হতে। বলতে মানা নেই, এই স্কুল থেকে কয়েক বছর আগে একজন হায়ার সেকেন্ডারিতে রাজ্য বোর্ডে মেরিটে এসেছে। ফলে এই স্কুলের দিকে অনেক গার্জিয়ানের নজর পড়েছে এবং সরকার বাহাদূর অনুদান এবং গ্র্যন্ট দিয়েছেন।
আমি প্রদ্যুম্ন বসু এসেছি দক্ষিণ কোলকাতার মুসলমান-ফিরিংগি ও বাঙাল উদ্বাস্তু পরিবারের বসতে ঠাসা একটি জগাখিচুড়ি পাড়া থেকে। আমার বাবা অন্য রাজ্যে চাকরি করেন। টো টো কোম্পানি করে দিনদিন বাঁদর হয়ে যাচ্ছিলাম, ঘরে মন বসছিল না। এখানে মামাবাড়িতে সবার আমাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা, এই ছেলে বড় হয়ে কি হবে? পকেটমার নাকি ফেরিওয়ালা? এর বেশি এলেম আমার যে নেই সেটা তখনই ওঁরা টের পেয়েছিলেন। তাই ঠিক হলো, হোস্টেলে পাঠাতে হবে।
সবচেয়ে ভালো হলো কোন মিশনের স্কুল, ভারতীয় আদর্শের পড়াশুনো। আমার বাবা-মা রাঢ় বাংলার কোন মিশনের দীক্ষিত, ওঁরা বেলুড়ের থেকে আলাদা, স্বাধীন কোন গুরু মহারাজের শিষ্য। যেন ভ্যাটিক্যানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ক্যান্টারবেরি। তাই আমাকে ভর্তি করা হলো এখানে। কোলকাতা ছেড়ে ট্রেনে করে এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে আসতে মন চায়নি। কিন্তু মন তো অনেক কিছু চায়, তাতে কী?
এভাবে কেটে গেছে তিন-তিনটে বছর। আমি এখন সিনিয়র। ঠোঁটের উপর হালকা গোঁফের রেখা। কখনও কখনও মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে যায়। এখান থেকে আমার গল্প শুরু।
'সে কোন বনের হরিণ এল আমার মনে?'
যোগানন্দধামে সন্ধ্যে বেলা আমাদের টিউটোরিয়াল। আমরা মানে ক্লাস এইটের আবাসিকের দল। দুটো সেকশন মিলে জনা পনেরো হবে।
যোগানন্দধাম আসলে একটি লম্বাটে দোতলা হল ঘর। পুকুরপাড়ে। এই ঘরে আমরা থাকি। মাটিতে শতরঞ্চির উপরে তোষক পেতে বিছানা। আমরা বলি-বেডিং। দিনের বেলায় এই বেডিং গুটিয়ে দেয়াল ঘেঁষে রেখে দিতে হয়। টিউটোরিয়ালের সময় শুধু শতরঞ্চি পেতে বসে পড়াশুনো। আমাদের টিচার অনিমেষদা হোস্টেলেই থাকেন। উইক এন্ডে বাড়ি যান।
হলে পাখা নেই। তাই জানলা কখনই বন্ধ করা হয় না। এই জানুয়ারী মাসের শীতেও না। তবে বর্ষার দিনের কথা আলাদা। নইলে বিছানা ভিজে যাবার ভয়। সামনের পানাপুকুর থেকে একটা আঁশটে গন্ধ ভেসে আসছে, আর নীচের তলা থেকে সোঁদা গন্ধ।
আসলে মার্কিন সংস্থা CARE এর থেকে পাঠানো গুঁড়ো দুধ বড় গামলায় জলে মিশিয়ে সপ্তাহে তিন দিন কাছাকাছি গ্রামের বাচাকাচ্চাদের মধ্যে বিলি করা হয়। নীচের তলায় তার গুদাম ঘর। গন্ধ আসছে সেখান থেকে। আমরা এতে অভ্যস্ত। নাকে সয়ে গেছে। সয়ে গেছে জানলা দিয়ে ক্রমাগত ধেয়ে আসা মশার ঝাঁক। পানাপুকুরটায় ওর চাষ হয় নির্ঘাৎ। আমি ভূগোল বই খুলে ‘আফ্রিকাকে কেন অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলা হয়’ মুখস্থ করার ফাঁকে চটপট হাত চালিয়ে মশা মারতে থাকি। কোনও কোনও মশা মারলে ওর পেট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে পড়ে, তখন বড় আনন্দ হয়। শুকনো মরুটে মশা মেরে মজা নেই। তবু মশাদের শবদেহ গুনতি করে একটা টেক্কামার্কা দেশলাই বাক্সে পুরে ফেলি। বন্ধুরা আমাকে শতমশকমারীবীর টাইটেল দিয়েছে যে!
গৌতম ও সহদেবের অংকের খাতা দেখে বকুনি দেওয়ার ফাঁকে অনিমেষদার চোখ ফিরেছে আমার দিকে।
—অ্যাই প্রদ্যুম্ন, তোর হলো? নাকি স্ট্যানলি লিভিংস্টোনের মত জঙ্গলে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছিস? এদিকে উঠে আয়!
পাশে একটা বেত সবসময় রাখা থাকলেও উনি সেটার ব্যবহার কদাচিৎ করেন। দরকার পড়লে ওনার হাতই যথেষ্ট। ফোরহ্যান্ড ব্যাকহ্যান্ড ঝড়ের মত চলে, তবে মেজাজ বিগড়োলে।
আমি বই হাতে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াই। গুটি গুটি পায়ে ওঁর দিকে এগিয়ে যাই, আর বোঝার চেষ্টা করি যে ওঁর মুড এখন কী—ইম্পারেটিভ না সাবজাংকটিভ?
পোড়োদের গলার স্বর আচমকা থেমে গেছে। কোন ঘটনা ঘটবে। আমার কিন্তু ‘কানের কাছে নানান সুরে, নামতা শোনায় একশ’ উড়ে কেস।
হলের অন্য প্রান্তে দরজায় শব্দ। সবার চোখ সেদিকে ঘুরল। হস্টেলের কাজের ছোকরা পঞ্চা ঢুকেছে, ওর সঙ্গে একটি ছেলে। শ্যামলা লম্বাটে গড়ন, মুখে একটু অপ্রস্তুত লজ্জা লজ্জা হাসি। ওর চোখ গিয়ে থেমেছে স্যারের পাশে রাখা বেতগাছার দিকে, আর চেহারায় খেলছে একটু ভয়ের ছায়া। কিন্তু এইটের ছেলে ফুলপ্যান্ট পড়েছে? আর গায়ে ওটা কি? এই রকম সোয়েটার তো শুনেছি ‘বিশ সাল বাদ’ সিনেমার নায়ক বিশ্বজিৎ পরে। এ নিশ্চয় লুকিয়ে লুকিয়ে সিগ্রেট খায়।
ঠিক আছে। এ কে সময়মত ঠিক সাইজ করে নেওয়া যাবে। কোন সেকশনে ভর্তি হয়েছে? আর ওর বেডিং স্যুটকেস থালা বাটি? কোন হলে?
কৌতুহল খানিকটা মিটল। পঞ্চা স্যারকে জানিয়ে দিল যে নতুন ছেলে বিপ্লব আজই ভর্তি হয়েছে, সেকশন এ। সীট পেয়েছে বিবেকানদ হলে। মহারাজ ওকে অনিমেষদার টিউটোরিয়ালে বসতে বলেছেন। অনিমেষদার প্রশ্নে ছেলেটি নিজেই জানাল যে ও কোলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে এসেছে। ওর বাবা দূর্গাপুরে বদলি হয়ে গেছেন, তাই হস্টেলে।
আমাকে মশা কামড়ায়; টের পাই না। হাফপ্যান্টের ফাঁকে কোথাও চুলকোতে চুলকোতে ফুলে ওঠে। ও নিয়ে ভাবি না। স্যার ওঠার আগে কালকের জন্যে টাস্ক নোট করিয়ে দিলেন, লেখা হলো না।
শেষ হতেই সবাই হুড়োহুড়ি করে নীচে নামতে থাকে। নতুন ছেলেটা একটু হকবকিয়ে গেছে। আমি পা চালিয়ে ওর পাশে দাঁড়াই। বলি—এখনই খাওয়ার ঘন্টা পড়বে। আমার সঙ্গে চল। কলতলাটা পেছল। আমি দেখিয়ে দেব। হাত মুখ ধুয়ে নাও।
পাশ থেকে কেউ ফুট কাটল—ওর সঙ্গে যেও না খোকাবাবু। ও মহা ল্যাবা, অংক পারে না। নিজেই পা পিছলে পড়ে যায়!
—ছাড় না! কেন ওর পেছনে লেগেছিস?
—দ্যাখ না শালা! প্রথম দিন থেকেই নতুন ছেলেটাকে লাইন মারছে।
সমবেত হো হো হাসি! নতুন ছেলেটা অপ্রস্তুত। আমি ওর হাত ধরে ফেলি। নীচু গলায় বলি,
—ফালতু কথায় কান দিও না। নিজেরা তো গত বছর গাব্বু মেরেছে!
পরের দিন রোববার।
আজকে হোস্টেলের টপ দুটো দলে ক্রিকেট ম্যাচ। বেশিরভাগ নাইন আর টেনের ছেলে, জনা দুই এগারো ক্লাস (ওদের এবার বোর্ড আছে না!)। কিন্তু দুতিনটে ক্লাস এইটের ছেলেও আছে—রিজার্ভ বেঞ্চে, আমি তাদের একজন। অফব্রেক মন্দ করি না, কিন্তু ফিল্ডিং ভালো নয়, তাই রিজার্ভের দলে।
ক্লাস টেন-এর বিকাশদা বাড়ি গেছে, একটা বোলার কম পড়েছে, মনে মনে ঠাকুর ঠাকুর করছি—আজ বোধহয় ম্যাচে একটা চান্স পাবো। সাদা হাফ প্যান্ট, জামা ও সাদা রং করা কেড্স্ পরে লাইনের বাইরে বসে আছি।
কিন্তু এটা কী হলো?
ক্যাপ্টেন অমিতদা হঠাৎ নতুন ছেলেটাকে ডাকলেন।
—ক্রিকেট খেল? আগের স্কুলে খেলতে?
—হ্যাঁ, স্কুল টিমের হয়ে খেলেছি।
মিথ্যে কথা! এই মুখচোরা লাল্টুমত ছেলেটা কিছুতেই হেয়ার স্কুলের মত অভিজাত স্কুলের টিমে রেগুলার হতে পারে না। নিঘঘাৎ ইম্প্রেস করার জন্যে ঢপ দিচ্ছে।
—একবার ট্রায়াল ম্যাচে খেলালে হয় না? ওরা ডিউস বলে খেলে। আমদের তো টেনিস বল।
—অ্যাই! তোকে কে জিজ্ঞেস করছে? নিজের চরকায় তেল দে।
যাঃ, ক্যাপ্টেনকে রাগিয়ে দিয়েছি। আমার চান্স গেল। এই ছেলেকেই না আমি কাল হাত ধরে ডাইনিং হলে নিয়ে গেছলাম? এছাড়া কলঘর, মশারি টাঙানোর কায়দা, কিছু কিছু বিধিসম্মত সতর্কীকরণ!
ক্যাপ্টেন ভুল করেনি।
ছেলেটা ওপেনিং নেমে বেশ ব্যাট করল। দু'হাত আগে পড়ে লাফিয়ে ওঠা বলগুলোকে ব্যাকফুটে টো-এর ওপর ভর দিয়ে আস্তে করে নামিয়ে দিচ্ছিল। ফরওয়ার্ড শর্ট লেগ ও গালির ছেলেগুলো ক্যাচ নেওয়ার চেষ্টা করে মাটিতে গড়াল।
প্রথম দিনেই গোটা হোস্টেল ওর দিকে আলাদা ভাবে তাকাতে শুরু করল।
আরে! তিনদিন পরেই বাঁকুড়া শহরের মিশনে স্বামী বিবেকানন্দ জন্মোৎসবে ছাত্রদের দিন! কলেজের সঙ্গে অন্য স্কুল থেকেও কিছু কিছু চান্স দেওয়া হবে।
আমাদের ভাগ্যে জুটেছে স্বামীজির লেখা কবিতার আবৃত্তি।
বাংলা আবৃত্তিতে অবশ্যই আমি, প্রদ্যুম্ন। প্রতিবার হোস্টেলে এবং স্কুলে সমস্ত ব্যাচ মিলিয়ে আবৃত্তি চ্যাম্পিয়ন। হুঁ হুঁ বাবা! আমার পিসেমশাই বরানগরের কুঠিঘাট রোডের ভব রায় আমাকে ছোটবেলা থেকেই হাতে ধরে শিখিয়েছেন। উনি ইউনিভার্সিটির দিনে কয়েকবার ‘সারা বাংলা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা’র চ্যাম্পিয়ন।
ঠিক হলো, উৎসবে আমাদের আশ্রমকে রিপ্রেজেন্ট করব আমি। সেই ‘সখার প্রতি’, সেই ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার’। লম্বা কবিতা, প্রায় চার পাতা। কিন্তু এতবার করেছি যে মুখস্থ হয়ে গেছে।
আচ্ছা, ইংরেজিটা কেউ ট্রাই করবে? The Cup? কেউ এগোয় না।
—প্রদ্যুম্ন?
এই সুযোগ, ইংরেজি বাংলা দুটোই আমি? এ যে শালা জ্যাকপট!
কিন্তু আমি দুলাইন বই দেখে বলতেই স্যার হাত তুললেন।
—শোনো, তুমি কবিতাটা বুঝতে পারোনি। এই কাপ চায়ের কাপ নয়। এ বয়সে বোঝা সম্ভবও নয়। কিন্তু এই ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে কলেজের স্টেজে—! নাঃ, শুধু বাংলাটাই কর।
—আমি ট্র্রাই করব?
সেই নতুন ছেলেটা! মহা পাকা তো!
—This is your cup.
The cup assigned to you from the begining.
Nay my child
স্যার হাত তুললেন, তুমি ও কে! ছোট কবিতা, আজকে মুখস্থ করে ফেলবে। এই প্রথম আমাদের আশ্রম বাংলার সঙ্গে ইংরেজি রিসাইটেশনেও পার্টিসিপেট করবে।
লাজুক হেসে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়া ছেলেটার দিকে সবাই প্রশংসার চোখে তাকিয়ে। আমি স্যারের মাথার পেছনে সাদা দেওয়ালে একট টিকটিকি কেমন পোকা ধরছে সেটা মন দিয়ে দেখতে লাগলাম।
এই বিপ্লব ছেলেটাকে আর পাত্তা দেব না। ও কোনদিন আমার বন্ধু হবে না।
তিনদিন পরের সকাল। আমরা ক’জন সুনীলদা, মানে আমাদের ছোট মহারাজ, ও একজন ওয়ার্ডেনের সঙ্গে খেয়াঘাট থেকে নৌকোয় উঠেছি। নদীর বুকে একটু কুয়াশা কুয়াশা ভাব। আমি মাঝখানে একধারে বসেছি। দেখছি যে দাঁড়ের আঘাতে জলের বুকে কেমন ছোট ছোট ঘুর্ণি তৈরি হচ্ছে। কোথাও এক আধটা নিঃসঙ্গ কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে।
কোত্থেকে একটা বেয়াড়া লাইন মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
ওই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর।
দিবাকর? সূর্য? এখনও ভালো করে ওঠেনি। কেমন ফ্যাকাশে ম্যাদামারা রোদ্দূর। একটা হাফ সোয়েটার পরে আছি, শীত শীত করছে। তবে এই নদীটা তো ঠিক গঙ্গা নয়? এতো ধলেশ্বরী? না না, এখানে সবাই বলে দারুকেশ্বর। এটাই গিয়ে ঘাটালের কাছে কাঁসাইয়ের সঙ্গে মিশে নাম নিয়েছে রূপনারায়ণ, তারপর কোলাঘাটের গিয়ে গঙ্গায় মিশেছে। সব অগতির শেষ গতি হলো গঙ্গা; আর আমার মত বয়ে যাওয়া ভ্যাগাবন্ড ছোঁড়ার বোধহয় এই আশ্রম!
বিপ্লব হাসছে, আমাকে হাত নেড়ে কাছে আসতে বলছে। আমি এখানেই বেশ আছি।
নৌকো পাড়ে ভিড়ল। ভাটার সময়। ঘাটের কাছে থকত্থকে কাদা। একটা কাঠের পাটাতন দিয়ে নৌকো থেকে যাত্রীদের কাদা এড়িয়ে শুকনো ডাঙায় পা রাখার ব্যব্স্থা করা হয়েছে।
বিপ্লব কাঠের পাটায় পা রাখতে ইতঃস্তত করছিল। এঃ, ভয় পেয়েছে খোকাবাবু! এবার হেয়ার স্কুলের ফাট বেরিয়ে যাবে।
আমি ওর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ও করুণ চোখে আমাকে দেখল।
পা রাখল, পাটাতন দুলছে। অনিল মহারাজ বললেন—কী হলো? তাড়াতাড়ি কর।
ও আদ্দেক রাস্তা পেরিয়ে এসেছে। এই বার আর দুটো স্টেপ। কিন্তু পাটাতন বড্ড দুলছে যে! সবাই মন দিয়ে দেখছে।
আমি নিজের অজান্তেই কখন পাটাতনের কাছে পৌঁছে গেছি। শেষ পা রাখতেই পাটাতন বিচ্ছিরি ভাবে নড়ে সরে গেল আর বিপ্লব ব্যালান্স হারিয়ে হুড়মুড়িয়ে এক পা শুকনো মাটিতে আর এক পা কাদায় পড়ে গেল।
না, ঠিক পড়ে যায় নি। কেউ কিছু বোঝার আগেই আমি ওর এক হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছি, ও এসে হুড়মুড়িয়ে আমার গায়ে এসে পড়ল। আমিও হয়ত পড়ে যেতাম। কিন্তু তার আগেই অনিমেষদা আমাকে ধরে সামলে দিলেন। সবাই হেসে উঠল। ওর মুখটা লাল। কিন্তু আমাকে বলল—থ্যাংকস্!
আমি বাংলায় বললাম—ঠিক আছে।
ও কি কোন বিশেষ সেন্ট মাখে। নইলে কেমন একটা অন্যরকম গন্ধ কেন ওর গায়ে? অচেনা গন্ধটা ভালো লাগছে।
এটা কি ইংলিশ মিডিয়াম ছেলেদের গায়ের গন্ধ? নাকি শুধু হেয়ার স্কুল হিন্দু স্কুল ছেলেদের?
আমরা এগিয়ে যাচ্ছি স্টেজের কাছে। এখনও বেশি ভীড় হয় নি। আস্তে আস্তে লোক আসছে। শীতের সকাল। গান হচ্ছে—ক্ষাত্রবীর্য ব্রহ্মতেজ মূর্তি ধরিয়া এল এবার!
অনিমেষদার পেছন পেছন আমি আর বিপ্লব স্টেজের কাছে দাঁড়াই। উনি বল্লেন—তোমরা এখানেই অপেক্ষা কর। আমি ভেতরে গিয়ে জেনে নিচ্ছি আমাদের কখন চান্স দেবে।
বিপ্লব বলল—গানের সুরটা বেশ ভালো লাগছে।
আমি গম্ভীর মুখে বলি—রাগ মালকোষ, তাল তেওড়া।
ওর চোখ বড়বড়।—তুমি এসব জান? গান শিখছ?
—এখানে সবাইকে শিখতে হয়। তোমার ইচ্ছে থাকলে তুমিও শিখে যাবে। সবে তো এসেছ।
ওর চোখে বেশ সম্ভ্রম। আমার হাত ধরে। বলে আমি নাকি কাদায় পড়ার হাত থেকে ওকে বাঁচিয়েছি। জামাকাপড়ে একরাশ কাদা নিয়ে ও কী করে স্টেজে উঠত!
যাকগে, অনিমেষদা আসলেই আমরা ব্যাকস্টেজে বড় ঘরটায় এন্ট্রি পাব। তখন নিশ্চয়ই স্পেশাল জলখাবার দেবে। সাতসক্কালে বেরিয়েছি। খিদে পেয়েছে চড়চড় করে।
হঠাৎ কানখাড়া হয়। কখন গান শেষ হয়ে কবিতা আবৃত্তি শুরু হয়েছে, বাংলায়।
“—দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলে অনিবার,
পিতাপুত্রে নাহি দেয় স্থান।
স্বার্থ স্বার্থ সদা এই রব,
কেবা পারে ছাড়িতে সংসার?”
আরে! এটাই তো আমার করার কথা, স্বামী বিবেকানন্দের ‘সখার প্রতি’! একটি কলেজের ছেলে করছে, ভারী গলা। মন্দ নয়। কিন্তু আমি এর চেয়ে ভালো করি। তাহলে?
অনিমেষদা ফিরে এলেন। কেমন শুকনো মুখ।
—বাংলা কবিতাটা ওরাই করে দিল; দেখলে তো? ইংরেজিটার জন্যে বিপ্লবকে ভেতরে ডাকছে। তুমি বরং রাজা মহারাজের মন্দিরের কাছে চলে যাও। ওখানে ভলান্টিয়ারদের জলখাবার দিচ্ছে। ওখানেই ডিউটি কর। সেকেন্ড হাফে সম্ভবত তোমাকে একটা চান্স দেবে। আমি তখন তোমাকে ওখান থেকে ডেকে আনব।
অনিমেষদা বিপ্লবকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ও একবার আমার দিকে দেখল। আমি রাজা মহারাজের মন্দিরের দিকে হাঁটছি। বড্ড খিদে পেয়েছে যে! সামনে অন্য একটা মন্দির। সেখানেই দেখি ভলান্টিয়ারদের জন্যে লুচি আর আলুর ঘ্যাঁটমত দিচ্ছে। ওখানে আমাদের হোস্টেলের ক'জনকেও দেখতে পাচ্ছি। মহা উৎসাহে ওরা আমাকে জলখাবারের লাইনে ঢুকিয়ে নিল। খাবার পর জ্যোতিষ বলল, তুই এখানে আমাদের সঙ্গেই থাক। সহজ কাজ।
কাজটা হল পাবলিকের জুতো রাখা। একদিকে সারি সারি জুতো অর চটি। অন্যদিকে বড় বড় করে নম্বর লেখা একগাদা কাগজের স্লিপ আর একটা বালতিতে জ্বাল দেওয়া ময়দার লেই।
আমি মন দিয়ে লোকের কাছ থেকে জুতো নিই। ওদের একটা নম্বরের কাগজ ধরিয়ে দিই। বলি, সামলে রাখবেন, নইলে—!
তারপর যমজ স্লিপটির নীচে বেশ করে আঠা লাগিয়ে জুতোর তলায় হাত লাগিয়ে সেঁটে দিই। এভাবে খানিকক্ষণ পরে জুতোর তলার ধূলো ও আঠা মিলেমিশে আমার হাতের চেটোয় এক বিচিত্র নকশা তৈরি করে। বন্ধুরা বলে, যা, দুটো বিল্ডিং এর পরে একটা কল আছে। সেখান থেকে হাত ধুয়ে একটু ঘুরেটুরে আয়।
—মানে?
—আরে যত কাজ তার থেকে ভলান্টিয়র বেশি। তাই আমরা মাঝে মাঝে ডিউটি বদল করব। আমরা আগে ঘুরে এসেছি। এবার তুই যা। খালি ভলান্টিয়র ব্যাজটা খুলে পকেটে ঢোকা, কোন গেরুয়া যদি দেখে ফেলে তো চিত্তির!
আমি হাত ধুতে থাকি। ধুয়ে মুছে তারপর ব্যাজ পকেটে পুরবো। এমন সময় কাছে একটি বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা অ্যাম্প্লিফায়ার গর্জন করে ওঠে—This is your cup. The cup assigned to you from the begining. বিপ্লবের গলা।
আমি আর ভলান্টিয়র ক্যাম্পে ফিরে যাই না। ঘুরে বেড়াই। মন্দির এরিয়া থেকে যতটা সম্ভব দূরে। বিশাল নদীর পাড়। সবুজ ঘাস। কিছু কিছু জোড়া ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে। তাদের অলস কৌতূহলে দেখি। এগিয়ে চলি।
নানান দোকানপাট, কেনা কাটা। যেন হাট বসেছে। একজায়গায় পূপস বলে একটা কোম্পানি লাল সরবত বিক্রি করছে। না পয়সা নিচ্ছে না। অর্থাৎ বিলোচ্ছে। কাঁচের গেলাসে লাল শরবত। লোকের কাড়াকাড়ি। আমি ভীড়ের মধ্যে মাথা গলাই। লোকেদের কনুইগুলো একধাক্কায় সরিয়ে দিই। কেউ কড়া চোখে তাকালে আমার পকেটে পিন দিয়ে সাঁটা ব্যাজ দেখাই। জায়গা ছেড়ে দেয়। এভাবে দুগ্লাস মিঠে শরবত খেয়ে শরীর জুড়োয়। কিন্তু বরফে গলা খুসখুস করে।
এরপরে আর একটি ছোটখাট ভীড়ের দিকে গিয়ে দেখি লেক্স সিগ্রেট বিলোনো হচ্ছে। বিজ্ঞাপন। সেখানেও দুটো বাগাই—একই কায়দায়। পাটের দড়ি থেকে একটা ধরিয়ে দুটো টান মেরে কাশতে শুরু করেছি কি পেছন থেকে আওয়াজ—এ কী প্রদ্যুম্ন ! তুমি সিগ্রেট খাও?
বিপ্লব হাঁফাচ্ছে।
—কখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। শোন, অনিমেষদা তোমাকে খুঁজছেন। এই নাও খাওয়ার টিকেট। এটা নিয়ে দুপুরের প্রসাদ খেতে পারবে। কিন্তু এটা?
আমি কথা না বাড়িয়ে অন্য সিগ্রেটটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিই। খাবে?
ও চমকে যায়। তারপর হেসে ফেলে।
—ঠিক আছে। কিন্তু তার আগে পকেট থেকে ব্যাজটা খুলে ফেল, আমিও খুলছি।
সন্ধ্যের দিকে ফেরার পালা। নৌকোগুলোয় অসম্ভব ভীড়। শহরের বাজার ও মেলা থেকে ফেরা লোকজন, সাঁওতাল মেয়েপুরুষ, দুটো কালো ছাগল। আর আমরা আশ্রমের ক’জন।
অন্ধকারে টেমির আলোয় অনিমেষদা খেয়ার টিকেট কিনলেন। অন্ধকারে ভালো করে ঠাহর হয় না। একজন অচেনা লোক হাত ধরে আমাকে নৌকোয় তোলে। অনিমেষদা আর বিপ্লব যে কোন দিকে বসেছে টের পাইনে।
কালো আকাশ। কালো জল। শুধু দাঁড়ের ছপ ছপ শব্দ। বড্ড শীত করছে।
0 comments: