0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


কি অমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখছ আমায়, এই সাত সকালে?

তোমায় গো তোমায়। আর কাকে দেখব? আশেপাশে কেউ কি আছে এমন অপরূপ সেজে?

ধুস্‌, এমন করছ যেন কখনো দেখনি আমায়!

দেখেছি গো দেখেছি। দেখেছি তো। এই সাতষট্টি বছর ধরে দেখে আসছি। থুড়ি, ভুল বললাম, তেষট্টি হবে। বেশ মনে আছে আমার আজও সেই দিনের কথা। তখন আমার চার বছর বয়স। প্রথম দেখে চমকে গেছিলাম। এত উজ্জ্বল নির্মল রূপ হতে পারে সেই ধারনা প্রথম পোষিত হল মনে, প্রাণে, হৃদয়ের অন্তরে। সেই থেকে তোমার এই প্রথম আগমনী দিনটার জন্য আমার প্রত্যাশী চোখ দুটো চাতকের মত চেয়ে থাকে। চক্রবাকীর মত ঘুরে ঘুরে আনাচে কানাচে খোঁজে তোমায়। আর যেদিন দেখা পাই, আঃ! কী আনন্দ যে হয় তা তুমি টেরটিও পাও না। সে তোমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। তোমার সৌন্দর্যই আছে কিন্তু বোঝার মন নেই। বুঝলে অপরূপা?

অপরূপা! বেশ বলেছ। আচ্ছা, আমায় একটু বলবে কী এমন দ্যাখ তুমি আমাতে। তাহলে আমিও সেটা জেনে একটু গর্ব করতে পারি।

কিচ্ছু নয়। একটা বিস্তীর্ণ ঝকঝকে নীল। বৃষ্টিধোয়া উজ্জ্বল নীল। তার ওপর ধুনুচির জ্যা থেকে ছিটকে বেরোনো অথবা শিমুল ফল ফেটে ইতিউতি ভেসে থাকা ততোধিক উজ্জ্বল সাদা পেঁজা তুলো।

ইস্‌! ব্যস, এইটুকুতেই এত আনন্দ! কিন্তু তুমি এমনভাবে দ্যাখো, বড় লজ্জা লাগে আমার।

ও, তাই বুঝি ওই সাদার ভেতর একটা হালকা কাজল ল্যাপা! হা হা। ভয় নেই, নজর দিই না।

তুমি না একটা যাচ্ছে তাই। তোমার তো দেখি যাই দ্যাখ তাতেই মন নেচে ওঠে ময়ূরের মত। এত বোঝো আর এটুকু বুঝলে না। ওটা আমার পুরনো স্মৃতি।

তার মানে?

এ বাবা, এটাও বুঝলে না! এতদিন ধরে যে বর্ষাকে নিয়ে তোমার এত আদিখ্যেতা, তার কৃষ্ণকলি রূপে তোমার মুগ্ধতা, তার নুপুরের রিনিঝিনি শিঞ্জন, এলোমেলো চুল ওড়ানো হাওয়া সবই তো তোমায় উৎফুল্ল করে। তার স্মৃতি একদিনে কী করে হারাই বল। আর সেই বা আমায় এত সহজে ছাড়বে কেন।

তুমি ভুল বলনি, বর্ষা আমায় বেশি বেশি মাতাল করে। আসলে এই একমাত্র একটা ঋতু যাকে স্পর্শ করা যায় সরাসরি। আর অন্য সবই তো অনুভূতি, জাগানো আবেগ। বৃষ্টিকে হাতে গায়ে পায়ে মাথায় মাখা যায়, এমন আর কিছুতে হয় না।

কেন, আমার শিশির? তাকেও তো স্পর্শ করা যায়।

তার জন্যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। কখন তেনার দয়া হয়ে ঝরে পড়বে। আর, সত্যি বল তো শরতে কি শিশির আর আসে? সে আসবে তুমি চলে গেলে, হেমন্তের হাত ধরে।

প্রতি বছর আমার আগমনে তোমার এই আদেখলাপনা আনন্দ আমি দেখে আসছি। কেন হয়? আসলে আমার নিজের কোন অনুভূতি নেই তো তাই জিজ্ঞেস করছি। তোমার মত প্রাণ নেই আমার। অবশ্য যাদের প্রাণ আছে সবাই কি মানুষের আবেগ পায়? তার জন্য একটা আস্ত ঘিলু-ওলা মস্তিষ্কের দরকার। সেটা একমাত্র মানুষেরই আছে। দ্যাখ, পাখিদের ফুলেদের সৌন্দর্য আছে কিন্তু ওদের তা বোঝার ক্ষমতা নেই যা তোমাদের আছে।

ঠিকই বলেছ, দুঃখের হলেও সত্যি। তবে এটাও সত্যি তোমার যদি আবেগ থাকত তাহলে আজকের এই সৌন্দর্যের গর্বে তোমার মাটিতে পা পড়ত না।

যাঃ, কি যে বল না। তেমন হব কেন? আর আমার সঙ্গে মাটির তো সম্পর্কই নেই। আকাশে ভেসে ভেসে থাকি।

দেখি তো, এই মানুষেরই একটু সাধারণের থেকে অন্যরকম, মানে ভালোর দিকে, হলে মাটিতে পা পড়ে না।

তবে তোমার এই নিবিড় চাহনি কিন্তু আমায় বেশ ঈর্ষা জাগায়। আচ্ছা, তুমি প্রেম করেছ? নাকি, শুধু আমাদের সাথেই তোমার ভালোবাসা। মানুষের ভালোবাসা শুনেছি অন্যরকম।

ওসব কথা থাক, শরৎ। একটা কথা তোমায় বলি, এই ঋতুদের মধ্যে বর্ষা আমায় স্পর্শ করলেও আমি কিন্তু আমার সপ্তম ইন্দ্রিয় দিয়ে আর পাঁচটা ঋতুরও স্পর্শ পাই। সত্যি বলছি। কী করে তা যদি জিজ্ঞেস কর বলতে পারব না কিন্তু পাই যেমন তৃতীয় নেত্র অনেক বেশি কিছু দেখতে পাই। এই যেমন আজকের সকালে তোমার স্পর্শ পেলাম। প্রচণ্ড গরমে কষ্ট পেলেও তার স্পর্শের আনন্দ পাই। তবে চুপিচুপি একটা কথা বলি, ঘাম আমি একদম সহ্য করতে পারি না। আগে কৈশোরকাল অবধি ঘাম হোত না তখন কোন সমস্যা ছিল না। পরে বাংলার বাইরে থেকে যখন আবার ফিরলাম তখন জলীয় বাষ্পে ভেজা ময়েশ্চারাইজড গরমে শুরু হল ঘাম। অসহ্য। সেই গরমকে ঠাণ্ডা করতে আসে বর্ষা। হাওয়া ঘুরে যায় দক্ষিণ থেকে পুবে। পুবের হাওয়া আনে মেঘ, জলভরা মেঘ। তার বর্ণনার শেষ নেই। তবে কি জান তো, বর্ষা খুব একলা করে দেয়। এমন করে ঘরের চারিদিকে গণ্ডি টেনে রাখে বেরতেই দেয় না। একা একলা ঘরে বসে বসে একাকীত্বের কবলে পড়ে যাই। বিষন্নতা ছেয়ে ফেলে ঘন কুয়াশার মত। সেটা যখন গভীর থেকে আরও গভীরে নিমজ্জিত হয় তখনই আমার দৃষ্টি চাতকের মত আকাশে তাকিয়ে থাকে রোজ সকালে, কবে দেখতে পাব তোমায়। এই যে দিনের পর দিন এই আকাঙ্খা আকুতি তীব্র পাওয়ার তিতিক্ষা মনটাকে আকুল করে তোলে। আর তাই যেদিন প্রথম তোমায় দেখি সেদিন আনন্দে বিহ্বল হয়ে যাই। হৃদয় পূর্ণ আনন্দে উথলে ওঠে। বুঝি আমি। তখনই তোমার প্রথম স্পর্শ পাই।

আর বোলো না, থাম। আমি আর নিতে পারছি না। তোমার এই এত আনন্দে আমিও যে ভেসে যাচ্ছি। দ্যাখ, আমি কেমন কাঁদছি। যদি পার তো আমার এখনকার এই চোখের দু ফোঁটা জল হাতে ধর। আমি সরাসরি তোমার অঙ্গে মিশে যাব। তুমি এতটা চাও আমায়!

আমি দুটো হাত বাড়িয়ে দিই ব্যালকনি থেকে। সত্যি, সত্যি বলছি, হাতে কয়েক ফোঁটা জল টপটপ করে পড়ল, আমি গায়ে মাথায় মেখে নিলাম। আমার শরতের স্পর্শ সারা শরীরে মেখে নিলাম। এরকমই হয় প্রতিবছর। বর্ষা বিদায়ের সরকারি ঘোষণার তোয়াক্কা করি না। আমার শরৎ কবে প্রথম আসে তা আমিই জানি। জানো তো শরৎ, জানি না আর কেউ এমন করে পেতেন কিনা তবে আর এক পাগল ছিলেন, আমার কবি, রবীন্দ্রনাথ। তিনিও শরতের আসার নীরব পদধ্বনি শুনতে পেতেন। কী অদ্ভূত তাঁর ক্ষমতা ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, পূর্ব ভারতে আমাদের এই বাংলায় যেমন করে ছটা ঋতুই তার নিজ নিজ বৈচিত্র্য মেলে ধরে এমনটি আর কোথাও দেখিনি। অনেক নিন্দুকে বলে এখন আর ঋতুদের ফিল করা যায় না। আমার সন্দেহ হয় কোনদিন তেমন করে অনুভব করেছে কি না। অনুভূতির জন্যে ধৈর্য্য দরকার, আবেগের জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি আবশ্যক। আবহাওয়া পরিবর্তনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো হয়তো তৈরিই হয়নি। বই পড়ে শিশুরা জানে ছটা ঋতু—ছ’য়ে ঋতু। সেটা কি, তার কোন আন্দাজ নেই। জানে শুধু মোটা দাগের উঃ আঃ গরম, ঝমঝম বৃষ্টি আর হুহু হিহি ঠাণ্ডা। তাও গরমে এয়ারকন্ডিশনে অভ্যেস আর ঠাণ্ডা পড়ল কি না পড়ল সারা শরীর ঢেকে ফেলল উলের জামাকাপড়ে। শরীরের চামড়ায় এগুলো না মাখলে এদের বুঝবে কী করে! এদের ফিল করতে হবে, চামড়ার রোমকূপ দিয়ে ভেতরে ঢুকে রক্তে, অন্তরে মাখামাখি না হলে বুঝবে কী করে! তখন বই পড়ে বা লোকমুখে জানতে হয় ঋতুদের অভিনবত্ব। এদের মাঝে আর তিনটে ঋতু যে কিছু দিনের জন্যে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়ে যায় সে উপলব্ধি করার মত শিক্ষা হয় না। আর এক দল আছে যাদের খিদের জ্বালাটাই এত প্রকট যে প্রকৃতি তো ছাড় অন্য কোন দিকে মন দেবার মত মনটাই তৈরি হয় না।

ছাড় ওসব। তুমি কি বলছিলে রবীন্দ্রনাথের কথা। সেটা বল।

রবীন্দ্রনাথের কথা তো বলতেই হবে। ওনাকে ছাড়া কোন কথাই শেষ হয় না। তবে তার আগে জানিয়ে দিই, তোমার এই আকাশ পেলে কি করে। জানো তো, আমাদের এই পৃথিবীর জন্ম সূর্যের থেকে। কিন্তু ক’জন জানি যে আমাদের এই সূর্য দ্বিতীয় প্রজন্মের। এই তো, চমকে গেলে। হ্যা, ঠিকই তাই। প্রথম প্রজন্মের সূর্য কবে মরে গেছে আর তার থেকে সৃষ্টি এই দ্বিতীয় প্রজন্মের সূর্যটার জন্ম পাঁচশো কোটি বছর আগে। এর শরীর থেকেই ছিটকে আসা নানা মাপের ও ভরের গলিত পাথরগুলো সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয় এবং মহাকর্ষীয় শক্তি সূর্যের চারিদিকে তাদের আবর্তনের গতিপথ ঠিক করে দেয়। এই গলিত পাথরগুলোই সূর্যের গ্রহ এবং গ্রহের উপগ্রহ। এ ছাড়াও আছে অনেক গ্রহাণু আর উল্কা যারা মাঝে মধ্যে পৃথিবীর মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঘটনাচক্রে তৃতীয় গ্রহের অর্থাৎ যাকে আমরা পৃথিবী নামে চিনি, তার অবস্থান এমন একটা জায়গায় হয়েছে যেখানে জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলের বাইরে না গিয়ে তার ভেতরেই রয়ে গেছে। আপন অক্ষের চারিদিকে নিজের আবর্তন অথবা সূর্যের চারিদিকে তার ঘুর্ণন কিছুই পৃথিবীর এই অবস্থাকে একচুলও বদলাতে পারেনি সাড়ে চারশো কোটি বছরেও। জমা জলীয় বাষ্প জল হতে পেরেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডলের চাপ এবং সার্বিক পরিবেশে বৃষ্টির জল বিশাল বিশাল গহ্বরে জমা হয়ে তৈরি হয়েছে সমুদ্র। সৃষ্টি হয়েছে প্রাণের তিনশো আশি কোটি বছর আগে। প্রাণের বিকাশ ও তার ক্রমাগত বিবর্তন এনেছে মানুষকে। সেই মানুষেরও বিবর্তন হয়েছে তার মস্তিষ্কে। সে ভাবতে, কল্পনা করতে শিখেছে। স্মৃতি হয়েছে প্রখর, দীর্ঘস্থায়ী। তৈরি হয়েছে আবেগ। সেই আবেগের জন্যেই আজ তোমায় দেখে আমার আনন্দ হচ্ছে।

বাব্বা! এত কিছু। এর থেকে মেঘের জন্মের একটা আভাসও পেলাম। আমি ছাই এসবের কি জানি। নিজের আনন্দে উড়ে উড়ে বেড়াই। কে আমাকে নিয়ে গবেষণা করে বা কবিতা লেখে আমি তা কেমন করে জানব বল। তবে জানতে পারলে ভালই লাগত। তাহলে ঋতু পাল্টায় কি করে?

সূর্যের চারিদিকে ঘোরার জন্যেই ঋতু পরিবর্তন। গরম, বর্ষা আর শীত এই তিনটে প্রধান ঋতুর গায়ে গায়ে আরও তিনটে ঋতুর আভাস পাই, যেমন তোমায়, শরৎ, আর তোমার গায়ে লেপ্টে থাকা হেমন্ত; শীত আর গরমের মাঝে আসে বসন্ত। এর জন্যেই প্রকৃতির রঙ বদলে যায়, আকাশের রঙ পাল্টায়, গাছে গাছে আসে নিত্য নতুন ফুল আর ফল। ঋতুর সাথে রঙের এই আত্মিক সম্পর্ক মানুষ দেখেছে। চিহ্ণিত করতে পেরেছে দার্শনিকেরা। বিজ্ঞানীরা নানাভাবে এই সম্পর্কের প্রামাণ্য দাখিল করেছে। আর ভাবুকেরা, কবিরা নানা রঙের স্বপ্নের ও কল্পনার জাল বুনে চলেছে।

আমাকে নিয়েও লিখেছে কবিরা কবিতা? কী মজা! খুব ভালো হবে যদি আমাকে একটা শোনাও। শোনাবে, আমার সোনা?

শোনো, আমার কবি লিখেছেন, “অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া/দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া”। এটা গান। খুব আলিস্যি ভরা এই গান। ঠিক তোমার মত। তোমার আলিস্যি তো জগৎ বিখ্যাত। ভরা নদীর ওপরে কাঁচা সোনার মতো অথবা চাঁপা ফুলের মতো রঙের রোদ। রোদের এমন রঙ আর দেখা যায় না। সেই রোদ পড়ে মাঠের ধারে কাশ ফুলের ওপর। কাশ সেই রোদ মেখে হালকা হাওয়ায় দোল খায়। সেই বাতাস লাগে মেঘেদের গায়। তাদের নড়াচড়ার কোন লক্ষণ প্রায় দেখাই যায় না। সারা প্রকৃতিই যেন আলসেমিতে ভুগছে। এমন মৃদুমন্দ বাতাসে ধীর গতিতে চলা তরণী আর কোন কালে দেখা যায় না। রাতভর শিউলি ফোটে আর যেই আলো ফুটলো অমনি তাদের মাটিতে ঝরে যাবার জন্যে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। একমাত্র তোমার মেঘের মত সাদা কাশ একেবারে এঁটে লেগে থাকে ডাঁটির সাথে। সেও যেন অতি কষ্টে দোলে কখনও সখনও। চুপটি করে মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতেই তার যত আনন্দ। আর তোমার এই আলসেমির ছোঁয়াচ মানুষের গায়ে লেগে তাকেও প্রভাবিত করে। কোন কাজ করতে চায় না। সবসময়ই মনে হয় ছুটি আর ছুটি। কাজের থেকে ছুটি। তাই জন্যেই বোধহয় এটাকে উৎসবের সময় করা হয়েছে।

সুযোগ পেয়ে আমাকে খুব কথা শোনালে। আমার কি দোষ বল? যদি হাওয়া না বয় তাহলে আমি চলি কেমন করে? আমার তো নিজের চলার শক্তি নেই। তা তোমার যদি আমাকে অলস বলে মনে হয় বলতে পার, আমি রাগ করব না।

শোনো, ভারতের কাব্য সাহিত্যে, বিশেষ করে বৈদিক যুগের পরে, প্রথম কালিদাস পরিচয় করান বর্ষার সাথে মানুষের প্রেম-বিরহের আবেগ। এরপর আসে বৈষ্ণব সাহিত্য। সেখানে বর্ষার সাথে সাথে বসন্তের রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হয় মানুষের প্রেমাবেগ। আর সবকটা ঋতুর বৈচিত্র্য উপলব্ধি করেন এবং গান ও কবিতার মাধ্যমে আলাপ করিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু তাই নয়, মানুষের আবেগ কীভাবে প্রভাবিত হয় এই প্রতিটা ঋতুতে সেটাকেও তাঁর রচনায় প্রকাশ করেন। তাঁর আশ্রমে শুরু করেন ঋতু উৎসব যা কেবলমাত্র এবং একমাত্র প্রকৃতিকেন্দ্রিক। তার সাথে কোথাও মিশে থাকতে পারে স্থানিক লোকাচার। তার থেকেই আমরা শিখেছি শুধু প্রকৃতিকে নিয়ে উৎসব করা। তবে রবীন্দ্রনাথ পড়ার অনেক আগে থেকেই আমার তোমায় নিয়ে আবেগ তৈরি হয়েছে সেটা প্রথমেই বলেছি। তাঁর আর একটা রচনা বলছি, শোনো, “আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা/নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।/এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/এসো নির্মল নীলপথে,/এসো ধৌত শ্যামল আলো-ঝলমল বনগিরিপর্বতে/এসো মুকুট পরিয়া শ্বেতশতদল শীতল-শিশির-ঢালা”।

অপূর্ব। খুব ভালো বুঝেছি। এ তো আমারই বন্দনা। জানো, আজ আমার এত কান্না পাচ্ছে, এত আনন্দ তুমি আমায় দিচ্ছ আজ এমন করে, তেমন করে কেউ তো কখনো দেয়নি। তোমাদের রবীন্দ্রনাথ তোমাদের জন্যে লিখেছেন, আমাকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু তুমি যেমন করে আমায় শোনালে আমি আগে শুনিনি। তোমায় আমি খুব ভালোবাসি। খুউউব। একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে। যেটুকু জানলাম তোমাদের রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি আর সুন্দরের পুজারি। পৃথিবীতে অসুন্দরও তো আছে। তারা কবিতায় স্থান পায় না? যেমন ধর, বর্ষার বৃষ্টি, শীতের ঠাণ্ডা ইত্যাদিতে অনেকের কষ্টও তো হয়, বন্যা হয়, লোক মারা যায়। এসব নিয়ে কবিতা হয়?

দিলে তো আমার আবেগে লঙ্কা ফোড়ন। শোন, সবকিছু নিয়েই কবিতা হয়। কাব্যের দুটো উদ্দেশ্য—বর্ণন ও শোধন। যা কিছু দেখতে, শুনতে, শুঁকতে, কোমলস্পর্শে সুন্দর বলে ভালো লাগে সেগুলো খুঁজতে হয় না, আপনিই তাদের পরিচয় মেলে। তা দিয়ে কাব্যি হয়। কিন্তু, ঠিকই বলেছ, অসুন্দরের অভাব নেই। কদাকার, কুবর্ণ, পুতিগন্ধ, কর্কশস্পর্শ ইত্যাদিতে সৌন্দর্যের অভাব। আবার নিরপেক্ষ, মানে সুন্দরও নয় আবার অসুন্দরও নয়, এমনও আছে আমাদের জগতে। এসবই কাব্যে পাওয়া যায় নানাভাবে বর্ণনায়। পুরুষ-নারীর মত সুন্দর-অসুন্দরও অবিচ্ছিন্ন। সম্পূর্ণতাপ্রাপ্ত বর্ণনাকাব্যের উদ্দেশ্য, স্বরূপ বর্ণনা। যেমনটি দেখছি, তেমনই বর্ণনা। তবে একদল কবি আছেন যারা অসুন্দরকে বেছে ফেলে শুধু সুন্দরটুকু বর্ণনা করেন। তাতেও তাদের স্বস্তি নেই। যা নেই, তা কল্পনায় এনে সুন্দরকে আরও সুন্দরময় করে তোলেন তাদের কাব্যে। এই ধরনের শোধন কাব্য বর্ণন কাব্যের থেকে আলাদা। রবীন্দ্রনাথ বর্ণন ও শোধন দু’ধরনের কাব্যেরই প্রণীতা।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে তোমরা এত ক্যালেন্ডার মেনে ঋতুকে প্রাধান্য দাও কেন? কই তুমি তো তা নও?

মানুষের ধর্মই হল সব কিছু তার গড়ে তোলা নিয়মের মধ্যে বেঁধে রাখা। তাতে তার নিজের কাজের হিসেবের সুবিধে হয়। সবই হিসেব করে চলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে মানুষ। সব রুটিন মানা জীবন। প্রকৃতির মত খামখেয়ালিপনা সহ্য করতে পারে না। অথচ প্রকৃতি তো সত্যি আর খামখেয়ালে চলে না, তারও একটা নিয়ম আছে শৃঙ্খলা আছে। সে অনেক বড়। এত বড় যে মানুষ তার নাগাল পায় না তাই নিজের মত করে একটা নিয়মশৃঙ্খলা করেছে। আর তার থেকে একটু এদিক ওদিক হলেই চেঁচিয়ে ওঠে, ‘গেল গেল’ রব তোলে। তার কারণ জান? প্রকৃতির কাছে হেরে যাওয়ার ভয়। এটাই সত্যি। প্রকৃতিতে আপাতভাবে কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন হলেই মানুষ ভয় পেয়ে যায়। চেঁচামিচি করে। প্রকৃতিকে যেন তার নিয়ম মানতে হবেই। যেমন ধর, ‘বৈদিক শরৎ’ একটা দিন/সময় আগে ঠিক ছিল। নিশ্চই বৈদিক কালে বর্ষার শেষে শরতের আকাশ দেখে একটা ঋতু-সূচী তৈরি হয়েছিল, এভাবে সব ঋতুরই সময় নির্ধারিত ছিল। কবি দার্শনিকদের মনেও এর প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরে বাংলা ক্যালেন্ডারে ভাদ্রের প্রথম দিনটাকে ধরা হয়েছে। আচ্ছা বল, এগুলো তো সবই ‘আপেক্ষিক’। কবে তুমি তোমার কাঁচা সোনা রোদ নিয়ে নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়না উড়িয়ে উজ্জ্বল করে তুলবে পৃথিবীর মাটি-জল, তা কেমন করে মানুষ জানবে! যতই প্রযুক্তি উন্নত হোক।

তোমার কথা শুনতে এত ভাল লাগছে, কিন্তু আমার সময় বড় কম। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আমায় নিয়ে উৎসবের কথা কি একটা বলছিলে, সেটা বলবে?

সংসারে নিত্যদিনের কাজকর্মের মধ্যে মানুষের স্বার্থ কাজ করে বেশি করে। সারাদিনে মানুষ কত লোকের সাথে মেশে, কথা বলে কিন্তু তার মধ্যে স্বার্থের ভাগই বেশি। মানুষ যখন নিঃস্বার্থভাবে অপরের সাথে মেশে, সেই মিলন হয়ে ওঠে উৎসব। এই যেমন ধর, তোমার এই উজ্জ্বলতা, চাঁপা রঙের কোমল সোনারোদ, এই নীল আকাশ, শ্বেতহংসের মত ভাসমান মেঘ, আর নিচে গাছে গাছে শিউলি ফুল, শিশির ভেজা ঘাসের আগা, বৃষ্টিধোয়া ঝকঝকে সবুজ পাতা ডালে ডালে ঘাসে ঘাসে, ভিজে মাটি, টইটুম্বুর জল নদী নালা খাল বিলে, এই সব মিলে সৌন্দর্যের একটা রূপ পূর্ণতা পায়। এরা একা বিচ্ছিন্ন, টুকরো সুন্দর, কিন্তু মিলেমিশে একটা উৎসব হয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে উদ্‌লোকের জন্যে একটা নতুন কিছু উপহার দিতে চায়। বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এই সত্যটা প্রকাশ পায় না, আনন্দ সম্পূর্ণ হয় না। এই যে তোমার যে রূপ দেখে আমি মুগ্ধ হই তা শুধু ওই নীল আকাশ আর সাদা মেঘ নয়, চোখ যা দেখে তা চোখের দৃষ্টির মধ্যে যা আসে সবটা নিয়েই দেখে আর তাতেই সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা প্রকাশ পায়। এখানেই তৃতীয় নয়ন আর সপ্তম ইন্দ্রিয়ের কাজ। এর মধ্যে আছে মৃদুমন্দ হাওয়া, আছে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ভৈরবীর সুরে বীণের মধুর ধ্বনি যা কানে শোনা যায় না কিন্তু অন্তরে রণিত হয়। এখানেই উৎসব হয়ে ওঠা, একলা নয়, অনেকে মিলে, সবাই মিলে একটা আনন্দ। তোমায় বলেছিলাম, মনে আছে নিশ্চয়ই, তোমার মধ্যে এক ধরনের আলসেমি দেখি। আসলে আলসেমি না থাকলে উৎসব হয়ে ওঠে না। আলসেমি মানে চুপ করে বিছানায় শুয়ে থাকা নয়, মনটাকে বিশ্রাম দেওয়া। যেমন দিনের বেলা আমরা কাজ করি আবার রাতের বেলা বিশ্রাম নিই। সেটাও একটা কাজ কিন্তু এই কাজে কারোর কাছে দায়বদ্ধতা নেই অথচ সম্পূর্ণতা আছে। কি সেই সম্পূর্ণতা? বিশ্রাম, মনের আরাম। এই মনের বিশ্রাম না থাকলে উৎসব হয়ে ওঠে না। প্রেম আসে না। আকাশে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী রোজ রাতে উৎসব হয়ে ওঠে। ছোটবেলায় তাদের এই উৎসব দেখতাম। এখন শহরে বাস করে দেখা যায় না তবে পাহাড়ে, জঙ্গলে গেলে, সমুদ্রে ভেসে থাকলে দেখা যায়। মস্তিষ্ক বিশ্রামে থাকে বলেই রাতের বেলায় সব উৎসব হয়। সেখানেও আমরা প্রকৃতির উৎসব পালন করতে গিয়ে প্রদীপ, মোমবাতি বা বিজলি বাতি আর যান্ত্রিক শব্দের মাঝে আসল উৎসবটাই হারিয়ে ফেলি। পুরো আকাশ জুড়ে যেখানে আনন্দের জ্যোতি সেখানে একটা প্রদীপ বা বিজলির আলোকমালা কি করবে? রাতের নীরব বাঁশির মধুর ধ্বনি হারিয়ে যায় যান্ত্রিক আওয়াজে। আসলে উৎসবের আয়োজন করা যত সহজসাধ্য, তার উপলব্ধি ততই দুরূহ। প্রকৃত উৎসবের নির্যাস কতজন গ্রহণ করে সে বিষয়ে সন্দেহ প্রবল। বিশেষ করে আজকের এই আন্তর্জাল দুনিয়ায় যেখানে আত্মপ্রচার এক বিশেষ মাত্রা অধিকার করে বসে আছে। যতই প্রাচূর্য, ঐশ্বর্য, সৌন্দর্য থাকুক তা প্রেমে রূপান্তর হতে পারে না কারণ প্রেম বিতরণ করার, সবাই মিলে উপভোগ করার। তুমি বলছিলে না, অসুন্দরকে নিয়ে কবিতা হয় কিনা, যে জায়গা বন্যার জলে ভেসে গেছে সেখানের মানুষের কাছে আজকের এই সকাল কতটা উৎসবের হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ আছে। আমি নিরাপদ গণ্ডির মধ্যে থেকে তোমার সৌন্দর্যের উপাসনা করতে পারছি, আমার আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু নিজের একলার আনন্দ তো আর উৎসব হয়ে ওঠে না। তাই মনে মনে উৎসবের আমেজ পেলেও আমি হেরে গেলাম। তবে তোমায় আমার প্রণাম জানিয়ে আমার কবির একটা নিবেদন দিয়ে শেষ করব,

“নিখিলে তব কী মহোৎসব। বন্দন করে বিশ্ব
শ্রীসম্পদভূমাস্পদ নির্ভয় শরণে।”

আমিও পালাই। হাওয়ায় হাওয়ায় মেঘেরা সরে গেছে দূরে। রোদও চড়ে গেছে। আবার দেখা হবে কখনও...

0 comments: