0

গল্প - রজত ভট্টাচার্য্য

Posted in






পর্ব ১
অয়ন সবই প্রায় ঠিক করে ফেলেছে। কখন আর কোথায় আগেই ভেবে রেখেছিল। কি ভাবে সেটা নিয়ে একটু সমস্যা ছিল। হপ্তা খানেক বেশ পড়াশোনা করতে হয়েছে। লাভ হলো না। ও সব বড্ড ঝামেলা। তার চেয়ে একটা ইংরেজি সিনেমায় দেখা পদ্ধতি বেশ কাজের। মোজার মধ্যে কিছু কয়েন ভরে নাও। সুযোগ বুঝে মাথার পিছনে একটা বারি, ব্যাস। কাজ হয়ে গেলে মোজাটা পরে ফেল আর কয়েনগুলো খরচা করে ফেললেই ঝামেলা শেষ। মোজাটা পরে রাস্তায় কোথাও খুলে ফেলে দিলেই হবে। মার্ডার ওয়েপন বলে আর কিছু রইল না। গোটা দশেক দশ টাকার কয়েন জোগাড় করা হয়ে গেছে। একটা দু-নম্বরি সিম জোগাড় করা ছিল। আর চোরবাজার থেকে একটা এন্ড্রয়েড ফোন কিনেছে। সেটাই ব্যবহার করেছে। এই সাইটগুলো কেউ না কেউ সর্বক্ষণ ওয়াচ করে। করলে করবে। খুব জোর আই.পি. নম্বর আর লোকেশন জানতে পারবে। তার বাইরে কিছু না। ও নিয়ে টেনশন নেই। অয়ন শ্যামার নামে ঘর বুক করেছে। তাই ওর নামটা কোথাও থাকছে না। আদিল বহুতবার ওখানে গেছে, মানে ওই হোটেলটায়। ওর কাছ থেকেই অয়ন খবর পেয়েছে। একটা রেড লেবেলের বোতল কোয়ার্টার শেষ করেই ভ্যাড়ভ্যাড় করে সব বলে দিল। আদিল সবসময় হিন্দু নাম ইউজ করে। এই হোটেলের লোক ওকে প্রদীপ বলে চেনে। প্রতিবার নতুন মেয়ে নিয়ে আসে। ভালো আছে মালটা। অয়ন হোটেলটা নিয়ে খোঁজ খবর করেছে। ঝামেলার কোন চান্স নেই। কোথাও কোনো ক্যামেরা-ফ্যামেরা নেই। আসো, নিজের কাজ করো, চলে যাও। টাইম ফ্রেম নিয়ে অয়নের একটা খুঁতখুঁতুনি ছিল, সেটার একটা সল্যুউশন বার করেছে। বাড়ি থেকে সকালে যখন বেরোবে তখন বেশি লাগেজ নেবে না। এই ক্যাসুয়াল একটা জিন্স আর টি-শার্ট, পিঠে রোজের কাজে যাওয়ার ব্যাকপ্যাক। অয়ন শনিবার দাড়ি কামায় না, তাই সে দিনও কামাবে না। প্রথমে নান্টুর দোকানে একটা চা খেয়ে ওর সাথে অল্প হ্যাজাবে। দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট খাবে। তারপর ঠান্ডা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে দু নম্বর ফোন থেকে ওলা বুক করে বেরিয়ে যাবে। নান্টুর সাথে কথা বলাটা জরুরি। বলা তো যায় না! ও সাক্ষী দিতে পারবে। কাজটা না করতে পারলে অয়ন শান্তি পাচ্ছিনা। সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি কাজ করছে। হাত-পা নিশপিশ করছে। প্রথমবার একটু নার্ভাস ছিল। কিন্তু সেবার কাজটা ভালোয় ভালোয় মিটেছে। নিজের রুমালটা রুমার মুখ থেকে বার করতে ভুলে গিয়েছিল অয়ন। যাক গে! সে আর ভেবে লাভ নেই। আঃ! কি শান্তি যে পেয়েছিল! পরে কাগজে লিখল পুলিশ রুমার প্রেমিককে খুঁজছে। খুঁজতে থাকুক, পাবে না। অয়ন সেরকম কোনো সূত্র রাখেনি। বকখালিতে ডিসেম্বরে এমনিতেই প্রচুর ভিড় হয়। তার মধ্যে কে, কার সাথে কোন হোটেলে একবেলা কাটিয়ে গেল, এ হিসেব কেউ রাখেনা। একটা পাঁচশোর নোট ঠেকাতেই অয়নকে আর রেজিস্টারে সই করতে হয়নি। অয়নের খুব ভালো লাগে ছটফটানি দেখতে। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, চিন্তা করার শক্তি নেই, দোমড়াচ্ছে, মোচড়াচ্ছে, শুধু একবার দম নেবে বলে! একটু ঢিলে দিতেই নাকের পাটা ফুলে উঠবে, প্রাণপণে হাওয়া টানবে, আর তারপরেই চিৎকার করার চেষ্টা করবে। ঠিক তখনই আবার ফাঁসটায় আরেকটা টান দিতে হবে। পুরো ছকে বাঁধা! আবার ছটফটানি। নিজেকে কিরকম ভগবান ভগবান মনে হয়। এই পুরো ব্যাপারটাতে আবার মাঝে মাঝে একটু বৈচিত্র্য আনতে হয়। না হলে একটু কি রকম একঘেয়ে লাগে। যেরকম ফাঁসটা অল্প আলগা করে কানের পাশটায় একটু কামড়ে দিল বেশ! কানের লতির নরম অংশটা খানিকটা খুবলে চলে এলো মুখের মধ্যে। একটু নোনতা, ঘাম ঘাম একটা স্বাদ। অয়নের খুব ভালো লাগে। এই টেস্টটা আগেরবারই প্রথম অয়ন পেল। বুক, কানের লতি, ঠোঁট, সব আলাদা আলাদা স্বাদ। প্রতিটা কামড়ের সাথে আরও ছটফটানি! আঃ, কি আনন্দ! দিব্যি চলছিল কিন্তু মেয়েটা আর পারল না। বিছানা, বালিশ সব ভিজিয়ে ফেলল। বিরক্তিকর! শালা, এক ধাক্কায় মুড অফ। তাই ফাঁসটা এবার একটু জোরে টানল অয়ন। একটা পাপ, একটা ময়লা, পরিষ্কার হয়ে গেল। বাড়িতে হাজব্যান্ড আছে, তিন বছরের একটা ছেলে আছে, তার পরেও এত রস! মর শালা, ...
এবার মেথড চেঞ্জ করতে হবে। কেউ যেন রিলেট করতে না পারে।

পর্ব ২
শ্যামা সাধারণত অফিসে পৌঁছে ইউনিফর্ম পরে। অফিসে লেডিস রুম আছে। তাই অসুবিধে হয় না। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় শাড়ি বা সালোয়ার পরেই বেরোয়। এই চাকরিটা বছর দুয়েকের পুরনো। তুতাই হবার পরে পরেই সমীরের চাকরিটা গেল। তাই তার এই চাকরিতে ঢোকা। কষ্ট করে সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল। সেটা এবার কাজে লেগে গেল। শ্যামা সুপার মার্কেটের লেডিস গার্মেন্টস সেকশনের সিকিউরিটি সুপারভাইসার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যত্ন করে চোখে আই লাইনার লাগাতে লাগাতে শ্যামা দেখল সমীর এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। শ্যামা চোখ ফিরিয়ে নিল। লোকটাকে দেখলে রাগে গা রি রি করে। কাজের জায়গায় মাতলামির জন্য চাকরিটা গেছে। বিয়ের দিনও মদ খেয়েছিল। এই নিয়ে চারটে চাকরি গেছে। শ্যামা এই নিয়ে বিস্তর কান্নাকাটি, হাতে পায়ে ধরা ইত্যাদি করেছে। ফল হয়নি। সমীর আজকাল আর চাকরি খোঁজার চেষ্টাও করে না। পুরো সংসারের দায়িত্ব এখন শ্যামার কাঁধে। মাস গেলে সব কেটে-কুটে শ্যামা এগারো হাজার তিনশো টাকা হাতে পায়। প্রথম প্ৰথম সমীর চক্ষুলজ্জার খাতিরে টাকা চাইত না। এখন কেড়ে নেবার চেষ্টা করে। কাল রাতে এই নিয়ে একপ্রস্থ হয়েছে। প্রথমে গালিগালাজ, তারপর গা-জোয়ারী। সমীর তার হাত মোচড়াবার চেষ্টা করতেই শ্যামা আরেকহাত দিয়ে পড়ে থাকা এঁটো চামচের পিছন দিকটা দিয়ে প্রাণপণে সমীরের চোখে খোঁচা দিতে চেষ্টা করেছিল। সে পুরোপুরি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। সমীরের নাকের পাশ থেকে চোখের নীচ অবধি কালসিটে। সমীর আর কিছু করতে পারেনি। শ্যামার এই নিয়ে কোন অনুশোচনা নেই। বেঁচে থাকতে হবে এবং তারজন্য যা করা দরকার তা করতে সে একবারেই পিছপা নয়। চিৎকার, ঝগড়া, কান্নাকাটি তাদের বস্তিতে লেগেই রয়েছে। কেউ ও নিয়ে মাথা ঘামায় না। কালকেও সমীরের আর্তনাদ শুনে কেউ আসেনি। প্রসাধন শেষ করে শ্যামা হ্যাঁচকা টানে ঘুমন্ত তুতাইকে কোলে তুলে নিয়ে পায়ে চপ্পল গলিয়ে খটাস খটাস শব্দ করতে করতে দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে একবারও পিছন দিকে না তাকিয়ে গোড়ালি দিয়ে দরজায় একটা ধাক্কা দিতেই দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। সুপারমার্কেটে একটা কমন ক্রেশ আছে। তুতাই সেখানেই সারাদিন থাকে।

পর্ব ৩
সমীর একদৃষ্টে শ্যামার চলে যাওয়া দেখছিল। দরজাটা বন্ধ হতেই তার মনে হল শ্যামা যেন যাওয়ার আগে তার মুখে একটা লাথি মেরে গেল। পকেটে একটা পয়সা নেই। কাল রাতে খাবার কিছুই পেটে পড়েনি। মাথার ভিতর দপদপ করছে। তার সাথে একটা গা গোলানো ভাব। সমীর খাট থেকে উঠে ঘরের কোনে রাখা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে এক গ্লাস জল খেল। একটাই ঘর। তারই একপাশে রান্নার বন্দোবস্ত। দু-চারটে কৌটো হাঁটকে একটাতে গোটা দুয়েক নেতানো বিস্কুট পেল সমীর। আপাতত এই দিয়েই চালাতে হবে। সমীরের বিস্কুট খেতে কষ্ট হচ্ছিল। মুখের সমস্ত মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা। নাকের পাশ থেকে চোখ অবধি রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। কাল রাতে একটু বেশিই নেশা হয়েছিল। সেই সুযোগে হারামজাদী তার এই অবস্থা করেছে। অনেক সহ্য করেছে সমীর, আর নয়। শিবরামপুরে দাসবাবুর ওয়েল্ডিং কারখানায় তার কাজের একটা কথা হয়েছে। আজ সেখানে গিয়ে কাজ করে কিছু টাকা অ্যাডভান্স নিতে হবে। টাকা হাতে এলে এখন কয়েকদিন চুপচাপ থাকা। তারপর, তারপর এই মাগীর দাঁতগুলো সে ভাঙবে প্রথমে, তারপর ওর ওই হাতটা, যেটা দিয়ে ও মেরেছিল, সেটাকে মুচড়ে শরীর থেকে আলাদা করে দেবে, তারপর ওর ঘাড়টা মুরগীর ঘাড়ের মতন...। হিংস্র, জ্বলজ্বলে চোখে সমীর একদৃষ্টে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর তার কড়া পরা রুক্ষ হাতে আস্তে আস্তে নিজের মুখের ক্ষতের ওপর হাত বুলোতে লাগল।

পর্ব ৪
আজ স্পেশাল ট্রেনিং আছে। যে সিকিউরিটি এজেন্সির হয়ে শ্যামা কাজ করে, তারা মাঝে মাঝেই নানা ধরণের ট্রেনিং দিয়ে থাকে। আজ রয়েছে ক্লোজ কমব্যাট এন্ড সারভাইভাল ট্রেনিং, যদি একা কখনও আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয় এবং চট করে সাহায্য পাওয়ার আশা না থাকে, তাহলে আত্মরক্ষা কিভাবে করা সম্ভব। একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক তাদের ট্রেনিং দিচ্ছিলেন। ‘মনে রাখবেন, আপনার প্রথম কাজ হল পালানোর চেষ্টা করা, যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে আক্রমণকারীর সাথে দূরত্ব তৈরী করা এবং প্রাণপণে চেষ্টা করা যাতে দ্রুত সাহায্য এসে পৌঁছতে পারে। কোন কোন নাম্বারে ফোন করে আপনি সাহায্য চাইতে পারেন, তা আমি আগেই আপনাদের বলেছি। কিন্তু যতক্ষন না সাহায্য আসছে, আপনাকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন ছোট ছোট সামান্য জিনিস, যে রকম একটা পেন্সিল, একটা চাবি, নেল কাটার, বডি স্প্রের শিশি আপনার প্রাণ বাঁচাতে পারে। কিভাবে? আমি দেখাব আপনাদের।’

ট্রেনিং শেষ হবার পর শ্যামা নিজের পোস্টে ফিরে গিয়ে কাজে মন দিল। ডিউটি রেজিস্টারে এন্ট্রি করা বাকি, দুজন আজ আসেনি। তাদের কাজ সমানভাবে বাকিদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। শ্যামা এক এক করে নামের পাশে দাগ দিচ্ছিল, এমন সময় তার মোবাইল ফোনের আলো জ্বলে উঠল। কাজের সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ। শ্যামা নম্বরটা দেখে কল কেটে দিল। তারপর ফোন পকেটে ভরে লেডিস টয়লেটের দিকে চলল।

‘তোমায় খুব ছুঁতে ইচ্ছে করছে।’ এই গলাটা শুনলেই শ্যামার গা শিরশির করে ওঠে, মাতাল মাতাল লাগে। শ্যামা বেসিনের কলটা শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘এখন? অসম্ভব! খুব ব্যস্ত। আজ হবে না।’ ওপাশ থেকে হালকা, তরল গলায় জবাব এল, ‘কেন? আমি লেডিস টয়লেটে ঢুকতে পারব না বলে, নাকি তুমি আজ আর ওখান থেকে বেরোবে না।’ শ্যামার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠেছে। সে কোনোরকমে বলল, ‘তুমি আবার এসেছ এখানে! কেউ যদি বুঝতে পারে আমার আর চাকরিটা থাকবেনা।’
‘না থাকলে না থাকবে। তুমি আমার সাথে থাকবে। এই লুকোচুরি আর ভালো লাগেনা। আমার আর তর সইছেনা। সামনের শনিবারের কথা মনে আছে তো?’
শ্যামা রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘আছে। তুমি এখন যাও, প্লিজ। আমায় আর বিপদে ফেলোনা। আমি ছাড়ছি।’ শ্যামা কল ডিসকানেক্ট করে দিয়ে শক্ত হয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মুখ তুলে তাকাল বেসিনের ওপরের আয়নাটার দিকে। তারপর খুব মন দিয়ে তাকিয়ে রইল নিজের প্রতিবিম্বের দিকে, তার কপালের বাঁদিকে ছোট্ট কাটা দাগটার দিকে, পাতলা ভুরুর দিকে, অল্প চাপা নাক আর কঠিন চিবুকের দিকে, তার দৃঢ়, উদ্ধত শরীরের দিকে। তারপর মনে মনে বলল, ‘আমি বেঁচে আছি। আমি বেঁচে থাকব।’

পর্ব ৫
কল ডিসকানেক্ট হবার সাথে সাথে অয়ন ২৫% ছাড় লেখা ব্যানারটার পিছনে সরে গেল। এই সব শপিং মল গুলো জুড়ে ক্যামেরা লাগানো থাকে। ক্যামেরার সামনে চোখাচুখি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। তাছাড়া বলা যায় না পরিচিত কারুর চোখে পড়ে যেতে পারে। শ্যামা টয়লেট থেকে বেরিয়ে, একবার ডানদিক-বাঁদিক আলগোছে তাকিয়ে মাথা উঁচু করে গটগট করে হেঁটে ফিরে গেল নিজের জায়গায়। বেশ দৃপ্ত একটা ভঙ্গি। ও জানে অয়ন দেখছে, কিন্তু একবারও ফিরে তাকাল না। অয়ন মনে মনে ভাবল মেয়েটা বেশ শক্ত, মনের জোর আছে। মজা হবে।
দাসবাবু বেশ খুশি সমীরের কাজ দেখে। আজকাল ভালো ওয়েল্ডার পাওয়া মুশকিল। সমীরের কাজ নিখুঁত। তাছাড়া বুদ্ধিমান, চট করে কাজ বুঝে নেয়। লেদ মেশিনের কাজও পারে। একটু কিন্তু কিন্তু করে দাসবাবু এক হপ্তার মাইনে অ্যাডভান্স দিয়ে দিলেন। সমীর পরেরদিন কাজে এল, তার পরেরদিনও। একটা ফেলে দেওয়া স্প্রিং পাত্তি সে আলাদা করে সরিয়ে রেখেছে। বাকি সকলে যখন টিফিন করতে ব্যস্ত থাকে, তখন সে ওই স্প্রিং পাত্তিটা নিয়ে পড়ে। জিনিসটা দেখতে দেখতে একটা ছোট্ট চপারের আকার ধারন করেছে। কাজ আরেকটু বাকি। লেদ মেশিনের ছেলেগুলো আজ একটু তাড়াতাড়ি ছুটি নেবে। বাকি কাজটুকু সে এই সুযোগে করে নেবে।
কারখানা থেকে বেরিয়ে সমীর সোজা চলে গেল শপিং মলের সামনে, যেখানে শ্যামা কাজ করে। শপিং মলের ঠিক উল্টো দিকের রাস্তায় একটা বন্ধ দোকানের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রইল। রাস্তার এদিকটা নির্জন, একটা মাত্র স্ট্রিট ল্যাম্প জ্বলছে। শ্যামার ছুটি হয় রাত আটটায়। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। সমীর একটা বিড়ি ধরাতে মুখ নিচু করেছিল। বিড়ি ধরিয়ে মুখ তুলে দেখল তার থেকে হাত দশেক দুরে আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছে। এই লোকটাও তাকিয়ে আছে শপিং মলের গেটের দিকে। লোকটা দাঁড়িয়ে আছে ল্যাম্প পোস্টের পিছনে। এও যেন সমীরের মত কারোর অপেক্ষায় রয়েছে এবং চায় না তাকে আর কেউ দেখুক। সমীর শেডের আরেকটু ভিতরে, প্রায় দোকানের শাটারের সাথে গা লাগিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটা লম্বা, পাতলা চেহারা, চশমা পরেছে, গালে দাড়ি আছে, পরনে পাঞ্জাবি আর জিন্স। একদৃষ্টে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লোকটা একটা সিগারেট ধরাল। আটটা বেজে দশ মিনিটে এক ঝাঁক মেয়ে বেরিয়ে এলো গেট দিয়ে। সমীর দেখল তাদের মধ্যে শ্যামাও রয়েছে। তুতাই পাশে লাফাতে লাফাতে আসছে। গেট থেকে বেরিয়ে শ্যামা রাস্তায় নামার আগেই তুতাইকে কোলে তুলে নিল। তারপর কোনো কারনে আবার কোল থেকে নামিয়ে তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ ঘাঁটতে লাগল। তারপর তার হাতে উঠে এল মোবাইল ফোন। এতদূর থেকেও ফোনের আলোটা চোখে পড়ছে। সমীরের দৃষ্টি ঘুরে গেল একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে। লোকটা কানে ফোন লাগিয়ে রেখেছে, কিন্তু কথা বলছেনা। ওপাশে শ্যামা কোনোরকমে তুতাইকে সামলে, কাঁধ থেকে খসে পড়া ব্যাগ ঠিক করে, কানের কাছে তার মোবাইলটা তুলতেই সমীর বুঝতে পারল তার পাশের লোকটিও এতক্ষনে কথা বলা আরম্ভ করল। লোকটা কি শ্যামার সাথে কথা বলছে! কিন্তু এভাবে কেন? সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কথা বলছে না কেন? একপা একপা করে সমীর লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। প্রতিটা পদক্ষেপে চপারটা কোমরের কাছে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। লোকটার হাততিনেক দূরে পৌঁছে সমীর শুনতে পেল লোকটা বলছে, ‘তুমি বাসে উঠে বসে পড়বে। আমি ঠিক তোমার পিছনেই থাকব। দেরী কোরো না প্লিজ।’ তারপর একটা হাল্কা হাসি আর চুমুর শব্দ। লোকটা ফোন কেটে দিল। সমীর দেখল রাস্তার উল্টোদিকে শ্যামাও ফোন ব্যাগে ঢোকাচ্ছে। লোকটা পিছন ফিরে সমীরকে দেখেই চমকে উঠল। লোকটার মুখে তখনও হাসি লেগে রয়েছে। দূরে একটা গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে। সমীর কোমরে গোঁজা চপারের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নরম স্বরে বলল, ‘দাদা, একটু আগুন হবে? বিড়িটা নিভে গেছে।’

পর্ব ৬
শ্যামা তুতাইকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল সকাল ছ’টায়। আজ শ্যামা তার ফেভারিট মেরুন সালোয়ার কামিজটা পড়েছে। কাঁধে একটা ছোট সাইড ব্যাগ, তাতে ফোন, চার্জার আর টুকিটাকি প্রসাধন সামগ্রী। তার সাথে গাঢ় হলুদ ওড়না। সমীরের সাথে তার কথা নেই বহুদিন। তাই কৈফিয়ত দেওয়ারও কোনো ব্যাপার নেই। শ্যামা বেরিয়ে যেতেই সমীর লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। সমীর কাল রাতে বাড়ি ফেরার আগে পল্টুর সাথে কথা বলে এসেছে। পল্টুর মোটরবাইক আর হেলমেট একদিনের জন্য ধার নিয়েছে। পল্টু এক গেলাসের বন্ধু। তাই না করতে পারে নি। মোটরবাইক আর হেলমেট বাড়ির সামনের চায়ের দোকানের ভিতর ঢুকিয়ে রাখা ছিল। তাই শ্যামার বেরিয়ে যাবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হেলমেটে মুখ ঢেকে সমীরও রওয়ানা দিয়ে দিল। তাদের বস্তি থেকে বড় রাস্তা হেঁটে মিনিট পাঁচ-ছয়। কাঁধে ব্যাগ আর তুতাইকে কোলে নিয়ে শ্যামা বেশ আস্তেই হাঁটছিল। তাই শ্যামাকে খুঁজে পেতে সমীরের বেশিক্ষন লাগল না। শ্যামা হাত দেখিয়ে অটো রিক্সা থামিয়ে তাতে উঠতেই সমীর স্পীড বাড়াল। শ্যামা নেমে পড়ল দুটো স্টপেজ পরেই। সমীর দেখল রাস্তার ধারেই একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। শ্যামা মিনিট খানেক তার সাথে কথা বলে তুতাইকে খানিক আদর করে আবার একটা বাসে উঠে পড়ল। তুতাই হাত নেড়ে মাকে টা টা করা অবধি সমীর বেশ কিছুটা দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভদ্রমহিলা তুতাইকে নিয়ে হাঁটা শুরু করতেই সমীর মোটরবাইক স্টার্ট দিল, এবার বাসের পিছু ধাওয়া।
ঠান্ডা হাওয়া শ্যামার মুখে চোখে ঝাপটা মারছিল। তুতাই এখনও কিছু বোঝে না। কিন্তু একদিন বুঝতে পারবে। তখন? কি জবাব দেবে তুতাইকে? আর তার নিজের ভালো লাগা, তার বুঝি কোনও দাম নেই? বাবা-মা ঘাড় ধরে তার বিয়ে দিয়েছিল। ছেলে নাকি ভালো কাজ জানে, রোজগারও ভালোই। একটা অপদার্থ, দায়িত্বজ্ঞানহীন, মাতালকে নিয়ে সে অ্যাদ্দিন ধরে ঘর করছে। শ্যামা টের পেল ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা সত্ত্বেও তার কান গরম হয়ে উঠেছে। সমীরের কথা ভাবতেই তার চোখের সামনে সমীরের কালশিটে পড়া মুখ ভেসে উঠল। শ্যামা দাঁতে দাঁত চেপে একটা অবরুদ্ধ গর্জন করে নিজের মনেই বলে উঠল ‘বেশ করেছি।’ তার চমক ভাঙল কন্ডাক্টরের ‘ধর্মতলা, ধর্মতলা...’ চিৎকারে।
বাস টিকিটের সফট কপি আগেই পৌঁছে গেছিল শ্যামার মোবাইলে। ডিপোর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ঝকঝকে এসি বাসটা চোখে পড়ল শ্যামার। নম্বর মিলিয়ে বাসে সিট খুঁজে নিয়ে শ্যামা বসতেই পিছনের সিট থেকে কে যেন আলতো করে তার কান আর গাল ছুঁয়ে দিল। চমকে পিছনে তাকিয়ে শ্যামা দেখল দুটো দুষ্টুমি মাখা চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্যামা নিজের সিটে বসে পড়ল। রোদ এখনও ওঠেনি। শ্যামা জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। শহরের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। চারিদিক গমগম করছে লোকজনের, গাড়ির যাতায়াতে। সে খেয়াল করলো না একটা মোটরবাইক এসে থামল তাদের বাস থেকে কিছু দূরে। আরোহী বাইক থেকে নামল না, মাথা থেকে হেলমেটও খুলল না, বসেই রইল বাইকের ওপর তাদের দিকে মুখ করে।
বাস প্রায় ফাঁকা। শ্যামার পাশের সিট ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। সিটের গভীরে তলিয়ে গিয়ে শ্যামা চোখ বন্ধ করল। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তীব্র টেনশন তাকে আজ যেন অবসন্ন করে তুলেছে। শ্যামার সাথে অয়নের আলাপ সুপার মার্কেটের লেডিস গার্মেন্টস সেকশনে। অজস্র পোশাকের ভিড়ে অয়ন অসহায় ভাবে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল। সে দিন সেলসগার্ল কয়েকজন না আসায় শ্যামাকে তাদের জায়গায় ম্যানেজ করতে হচ্ছিল। শ্যামা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘স্যার, বিশেষ কিছু খুঁজছেন?’ অয়ন যেন হাতের সামনে খড়কুটো পাওয়ার মত করে শ্যামাকে বলেছিল, ‘একটা সালোয়ার, আমার বোনের জন্য, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিনা...’
শ্যামা হেসে বলেছিল, ‘আপনার কোন বিশেষ পছন্দ, রং, প্যাটার্ন...’ থতমত খেয়ে অয়ন বলেছিল, ‘মানে, সেরকম স্পেসিফিক কিছু নেই, আপনি নিজের মনে করে একটা কিছু পছন্দ করুন না, লেটেস্ট কিছু, ... আপনার মতোই ফিগার...’। অয়ন সেদিন নিজের ক্রেডিট কার্ড ভুলে ফেলে গিয়েছিল। সেটা নিতে সে পরের দিন আবার এল। তার পরের দিন আবার। শ্যামা তার আঠাশ বছর বয়সে এসেও এত সুন্দর, ভদ্র, শান্ত পুরুষের সঙ্গ, তার প্রশংসা, ভালোবাসা কোনোদিন পায়নি। তাই ভেসে যেতে বেশি সময় লাগেনি। ছবির মত ঘটনাগুলো মনের মধ্যে সাজাতে সাজাতে শ্যামার মনে হল সে অয়নকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে তার বোনের পোশাকটা পছন্দ হয়েছিল কি না। আচ্ছা, ওর বোনের নাম কি? শ্যামা মনে করার চেষ্টা করল। নাঃ, অয়ন বোনের নাম ওকে বলেনি। শ্যামা ভাবার চেষ্টা করল অয়ন কোথায় থাকে। না, অয়ন সেটাও বলেনি। কি করে? ওই একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি, কি নাম কোম্পানির? অয়ন কি বলেছিল? বাড়িতে আর কে আছে? সে কি বিবাহিত? ছেলেমেয়ে আছে? আচ্ছা, প্রতিদিন দুপুর বেলায় কি করে শপিং মলে আসত? অফিস কি কাছে কোথাও? প্রতিদিন রাতে ডিউটির পরে গেট থেকে বেরোলেই কি করে সে ফোন পায়? দু-এক দিন তো তার দেরিও হয়েছিল, কিন্তু তখনও শ্যামা গেট থেকে বেরোবার সাথে সাথে ফোন পেয়েছে। কিন্তু কি করে? শ্যামা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল যার প্রেমে পাগল হয়ে সে বাঁধন ছেঁড়ার ঝুঁকি নিয়েছে, তার সম্বন্ধে সে কিছুই জানে না।

পর্ব ৭
বাসটা ডিপো ছেড়ে এগোলে সমীর খানিকটা দূরত্ব রেখে পিছন পিছন চলল। শ্যামার ঠিক পিছনের সিটে কালকের লোকটা বসে আছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যাচ্ছিল, তাই সমীরের পক্ষে যথেষ্ট। ও মুখ সে আর ভুলবে না। এই এসি বাসগুলো খুব জোরে চলে। পুরনো মোটরবাইক নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেও সমীর তাল রাখতে পারল না। অশ্রাব্য খিস্তি করে সে বাইক নিয়ে একটা পেট্রল পাম্পে ঢুকল। ইঞ্জিন একটু ঠান্ডা হোক। তেলও প্রায় শেষের দিকে। সমীর হাল ছাড়ল না। সে জানে ওরা কোথায় গেছে। খুঁজতে একটু সময় লাগবে এই যা। খুঁজে পাওয়ার পর... চোয়াল শক্ত করে সমীর পেট্রল পাম্পের কর্মচারীকে বলল ‘ফুল ট্যাংকি।’

দিঘা বাস টার্মিনাসে নেমে অয়ন ইশারায় শ্যামাকে পিছন পিছন আসতে বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোতে লাগল। কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগ। রিক্সা আর দালালের ভিড় টপকে বাঁদিকে ঘুরে অয়ন এগিয়ে চলেছে। আজ ছুটির দিন নয়। তাই বেশি ভিড় নেই। মিনিট দশেক হাঁটার পরে অয়ন গতি শ্লথ করল। এ জায়গাটা থেকে সমুদ্র দেখা যায় না। রাস্তায় লোক প্রায় নেই। মাঝে মাঝে এক আধটা রিক্সা, ভ্যান ছাড়া আর কোনো গাড়ি যাওয়া আসা করছে না। বড় রাস্তা ছেড়ে অয়ন এবার একটা ছোট ভাঙা-চোরা রাস্তা ধরল। সেই রাস্তা দিয়ে খানিকটা গিয়ে রাস্তা থেকে প্রায় আড়াল হয়ে থাকা নতুন দোতলা বাড়ির সামনে সে দাঁড়াল। বাড়ির দরজাটা কাঁচের। শ্যামা অয়নের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল ‘এখানে আমরা কি করব? আমি হোটেলে যাব না। এই জায়গাটা আমার ভালো লাগছে না। চল, আমরা সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসি।’ অয়ন কিছুক্ষন ঠান্ডা চোখে শ্যামার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে উঠল। ‘আরে দূর, সমুদ্রের ধারে কেউ চুপ করে বসে থাকে নাকি! চান করতে হবে না! এখানে ড্রেস চেঞ্জ করে সোজা সমুদ্র। চল, দেরি করলে রোদ আরও বাড়বে।’ ‘আমি বাড়তি পোশাক আনিনি। আমি চান করতে পারব না।’ শ্যামার কথা শুনে অয়ন যেন আহত হলো। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, আমি একাই জলে নামব। চট করে তৈরি হয়ে নিচ্ছি। তোমার যদি ওয়াশ রুম ইউজ করার থাকে তাহলে আর দেরি কোরো না। আমি ততক্ষন হোটেলের খাতায় এন্ট্রি করি।’ শ্যামার মুখে আর কথা জোগাল না। দীর্ঘ যাত্রার পর বাথরুমে যাওয়া সত্যিই জরুরি হয়ে পড়েছে। দরজা খুলে ঢুকতেই একটা বুড়ো মত লোকের সাথে অয়ন কথা বলতে আরম্ভ করে দিল। লোকটা বেশি কথা না বলে একটা চাবি বার করে অয়নের হাতে দিয়ে বলল, ‘দু’শ দুই, দোতলায় বাঁদিকে।’ অয়ন এক হাতে চাবিটা নিয়ে লোকটাকে বলল, ‘আমি ফিরে এসে রেজিস্টারে এন্ট্রি করছি। তারপর শ্যামার কব্জি ধরে সিঁড়ি ধরে উঠতে আরম্ভ করল। অয়নের স্পর্শ শ্যামার ভালো লাগছিল না। তাছাড়া অয়ন বেশ শক্ত করে হাত ধরে রয়েছে। শ্যামা একবার হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে দেখল অসম্ভব, তার সাধ্যের বাইরে। একহাতে শ্যামাকে ধরে রেখে আরেক হাতে চাবি খুলে অয়ন প্রায় ঠেলে শ্যামাকে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর আচমকা তার হাত থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে ঘরের কোনে রাখা চেয়ারের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। বিস্মিত শ্যামা অয়নের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাতে অয়ন দরজার ওপর পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল ‘আমার আর তর সইছে না।’

পর্ব ৮
সমীর প্রাণপণে বাইক চালিয়ে দিঘা পৌঁছে বাসটাকে দ্রুত খুঁজে বার করে ফেলল। বাসের খালাসি পাদানিতে বসে মুড়ি চিবোচ্ছিল, জিজ্ঞেস করতে বলল মাত্র আধঘন্টা আগে বাস পৌঁছেছে। বাস থামাতে হয়েছে মাঝে দুবার, তাতেই দেরি। সমীর কথা না বাড়িয়ে বাইক নিয়ে আস্তে আস্তে বড় রাস্তা ধরে এগোতে লাগল। দিঘা তার চেনা জায়গা। একাধিক বার বন্ধুদের সঙ্গে সে এখানে এসেছে। ওরা যদি হোটেলে ঢুকে গিয়ে থাকে, তাহলে আপাতত কিছু করার নেই। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ফেরার সময় হাতেনাতে ধরার জন্য। কিন্তু সেটা যথেষ্ট না। ওই নষ্ট মেয়েছেলেটা আর তার নাগরকে ধরতে হবে যখন ওরা ফূর্তি করছে, ঠিক তখন। তারপর কোপাতে হবে, বারবার। প্রথমে ছেলেটাকে, শ্যামার চোখের সামনে, তারপর শ্যামাকে। শুধু যদি জানা যেত ওরা কোন হোটেলে উঠেছে... সমীর মোটরবাইক নিয়ে ধীরে ধীরে দিঘার অলিতে গলিতে ঘুরতে লাগল।
শ্যামার একদম ভালো লাগছে না অয়নকে। যার প্রেমে সে পাগল হয়েছিল আজ সকাল অবধি, হঠাৎ তাকে ভীষন ভয় করছে। অয়ন মুখে হাসি নিয়ে একদৃষ্টে শ্যামার দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওয়াশরুমে যাবে বলছিলে না, ঘুরে এস। আমি ততক্ষন তৈরী হয়ে নিই।’ শ্যামা চারদিকে তাকিয়ে দেখল একটা মাত্র দরজা। সেই দরজাটা আগলে অয়ন দাঁড়িয়ে। শ্যামা অনুভব করল তার দম নিতে কষ্ট হচ্ছে, হাঁটুতে জোর নেই। খানিকটা যন্ত্রচালিতের মত শ্যামা বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
অয়ন খুব খুশি। মেয়েটা ভয় পেয়েছে। ভয় পাওয়াটা খুব জরুরি। ভয় না পেলে মজা নেই। এর পরের ধাপে প্রথমে অল্প কিছুক্ষন রাগের অভিনয়, তারপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য সাধাসাধি। তারপর গোঙানি ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। দু’নম্বর ধাপের পরে অয়ন কক্ষনো কাউকে কথা বলতে দেয় না। বলা যায় না, কে কোথা থেকে চিৎকার শুনতে পাবে। অয়ন জামা, প্যান্ট ছেড়ে ফেলল। তারপর ব্যাগ থেকে নাইলনের দড়ি, রুমাল আর মোজায় জড়ানো দশ টাকার কয়েন গুলো বার করে খাটের ওপর সাজিয়ে রাখতে লাগল। দড়ির এই বিশেষ ফাঁসটা অয়ন ওর মা’র কাছ থেকে শিখেছে। স্কুল থেকে মার হাত ধরে বাড়ি ফেরার সময় বাড়ির গলির মুখে সমরেশ কাকু রোজ দাঁড়িয়ে সিগারেট খেত। বাড়ি ঢুকে মা ওকে তাড়াতাড়ি করে খাইয়ে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিত। অয়ন ঘুমিয়ে পড়ত। একদিন ঘুম ভেঙে ঘরের বাইরে এসে শুনতে পেল মা কি রকম অদ্ভুত গলায় বলছে ‘তুমি বড্ড ব্যাথা দাও। দেখ কি করেছ! এবার একটু আদর করে দাও।’ অয়নের মা সমরেশের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়েছিল। তার মা’র দেওয়া সেদিনের শাস্তি অয়ন আজও ভোলেনি। দু পায়ের বুড়ো আঙুলের সাথে দু হাতের বুড়ো আঙুল এমন ভাবে বাঁধা যাতে নড়াচড়া অসম্ভব। দিনদুয়েক পরে অয়নের বাবা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। অয়নের মনে আছে বাবার চেহারাটা, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, জিভটা অস্বাভাবিক লাল আর পুরোটাই বাইরে বেরিয়ে আছে।
শ্যামা অনুভব করল তার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠেছে। হাত পা কাঁপছে। শুধুমাত্র যৌনতা অয়নের উদ্দেশ্য নয়, সেটা যেন শ্যামার কাছে আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। তাহলে এতদূরের হোটেলে আসত না, তার ব্যাগ কেড়ে নিত না। অয়ন জানে শ্যামা ব্যাগে মোবাইল রাখে, তাই ঠান্ডা মাথায় তাকে বাথরুমে যেতে দেবার আগে ব্যাগটা কেড়ে নিয়েছে। শ্যামা মাথা ঠান্ডা করে ভাবার চেষ্টা করল। আপাতত সে নিরাপদ। কারন অয়ন আর তার মাঝে একটা দরজা আছে। সে যদি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে অয়ন কিছু করতে পারবে না। দরজা ভাঙতে গেলে শব্দ হবে, হোটেলে নিশ্চই আরো লোক আছে। কিন্ত কতক্ষন? তাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। তুতাইকে অনুরাধাদির কাছে রেখে এসেছে। বেশি রাত হলে তুতাই কান্নাকাটি করবে, অনুরাধাদির সন্দেহ হবে। তাহলে কি চিৎকার করবে? যদি আসেপাশের কেউ শুনতে পায়। কিন্তু সে নিজে কি কৈফিয়ৎ দেবে, কেন এসেছে এখানে? তারপর যদি থানা-পুলিশ হয়! কেলেঙ্কারি যা হবার তা তো হবেই, সবার আগে চাকরিটা যাবে। আচ্ছা, তার ভুল হচ্ছে না তো? অয়ন হয়ত শুধুমাত্র তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কই গড়তে চায়, শ্যামা নিজেও তো খানিকটা তাইই চেয়েছিল। সে ছেলেমানুষ নয়। দিঘা পৌঁছে শুধু প্রেমালাপ করে তারা বাড়ি ফিরে আসবে, এটা শ্যামা একবারও ভাবেনি। কি একটা তীব্র অস্বস্তি, বারবার একটাই কথা, তার মনে ঘুরে ফিরে ধাক্কা মারছে। সে অয়ন সম্পর্কে কিছুই জানে না। খুব সূক্ষ্ম ভাবে অয়ন সবসময় নিজেকে আড়ালে রেখেছে। অয়ন প্রেমে পাগল তো নয়ই, সাধারণ সুযোগসন্ধানী লুচ্চাও নয়। তাহলে এ ক’দিনে শ্যামা টের পেত। অয়ন তার চেয়েও বেশি কিছু। অনেক বেশি ধূর্ত, হিংস্র। তার প্রতিটি পদক্ষেপ মাপা। এই হোটেলটা সম্বন্ধেও সে আগে থেকে খোঁজ নিয়েছে। না হলে এরকম নির্জন, শহর থেকে, সমুদ্র থেকে দূরে হোটেল সে চট করে বার করতে পারত না। শ্যামার নিজের হাতের দিকে চোখ পড়ল। কব্জির কাছে, যেখানে অয়ন তার হাত ধরে ছিল, সেখানে কালশিটে পড়ে গেছে। শ্যামা মরিয়ার মত চারিদিকে তাকাল। একটা স্কাইলাইট ছাড়া বাথরুমটাতে আর কোনো জানালা নেই। একটা শ্যাওলা পড়া বালতি আর মগ, দেওয়ালে ফিট করা একটা অপরিস্কার আয়না, আর তার সামনের প্লাস্টিকের তাকের ওপর হাবিজাবি ফেলে যাওয়া কতগুলো জিনিস ছাড়া আর কিছু নেই। গোটা দুয়েক আধখালি শ্যাম্পুর স্যাশে, গলে যাওয়া সাবানের টুকরো, বেশ কয়েকটা মেয়েদের কপালের টিপ আর তার পাশে একটা পুরনো, জং পড়া সেফটিপিন। শ্যামার কানের কাছে কে যেন ফিস ফিস করে বলে উঠল ‘ছোটখাট জিনিস, এমনি সময় চোখেই পড়বে না, আত্মরক্ষার কাজে লাগতে পারে। প্ল্যান করুন কিভাবে সেটাকে ব্যবহার করবেন। মনে রাখবেন আপনি আপনার প্রতিপক্ষকে, তা সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, একটা অতর্কিত আক্রমণে যদি চমকে দিতে পারেন, পালানোর একটা সুযোগ আসতে পারে।’ শ্যামা সেফটিপিনটা তুলে মুখের মধ্যে ঠোঁট আর মাড়ির মাঝখানে রেখে দিল। তারপর বুক ভরে একটা দম নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। অয়ন খালি গায়ে একটা হাফপ্যান্ট পরে খাটের উপর বসে একগাদা দশটাকার কয়েন গুনছিল। তাকে দেখে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘গুনে গেঁথে বারোটা। তোমার জন্য দুটো বেশি নিয়েছি।’ তারপর কয়েনগুলোকে পাশে রাখা মোজার ভিতর পুরে খুব শক্ত করে গিঁট দিয়ে দিল। শ্যামা দেখল খাটের উপর একটা পাতলা নাইলনের দড়ি রাখা। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘দড়ি দিয়ে কি হবে?’ অয়ন ভীষন মজা পেয়েছে এরকম একটা মুখ করে বলল, ‘তোমায় বাঁধব।’ শ্যামা আদুরে গলায় বলল, ‘আবার ব্যাথা দেবে? দেখো তো আমার হাতটার কি অবস্থা করেছ! কালশিটে পরে গেছে।’ শ্যামা দেখল অয়নের চোয়াল শক্ত, রগের কাছের শিরা ফুলে উঠেছে, চোখ বিস্ফারিত। শ্যামা আবারও আদুরে গলায় নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার আদর করে দাও।’ অয়ন চিতাবাঘের মত দ্রুতগতিতে উঠে দাঁড়াল। তারপর শ্যামা কিছু বোঝার আগেই তার বাড়িয়ে রাখা হাতটা ধরে টান মেরে তাকে বিছানার ওপর উপুড় করে ফেলল। তারপর হাতটা মুচড়ে প্রায় পিঠের কাছে এনে হাঁটু দিয়ে তার মাথাটা ঠেসে ধরল বিছানায়। শ্যামা একবার মাত্র আর্তনাদ করতে পেরেছিল, তারপর হাঁটুর চাপে তার আর দম নেবার ক্ষমতা রইল না। অতি তীব্র ব্যথা আর একটু হাওয়ার জন্য আকুলি বিকুলি করতে করতে শ্যামা বুঝতে পারল তার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হতে বেশি দেরি নেই। চিৎকার করতে গিয়ে সেফটিপিনটা ছিটকে পড়েছিল খাটের ওপর। চেতনার শেষ অবস্থায় সেটাকে খুলে সর্বশক্তি দিয়ে শ্যামা আরেক হাতে পিছন দিকে চালাল। এবার আরেকটা আর্তনাদ, কর্কশ, পুরুষ কণ্ঠের জান্তব চিৎকার। আর তার পরেই পিঠের উপর থেকে চাপটা সরে গেল। ফুসফুস ভর্তি হাওয়া ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামার চেতনা ফিরে এল। কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে সে এগিয়ে চলল দরজার দিকে। ওই দিকেই জীবন, ওই দিকেই মুক্তি। দরজার লকে হাত দিয়ে ঘোরালো শ্যামা, তারপরই মাথার পিছনে একটা বাড়ি। শ্যামা দরজার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
প্রায় ঘন্টাখানেক দিঘার আনাচে কানাচে ঘুরে সমীর হতাশ হয়ে মোটরবাইক ঘুরিয়ে নিল। ডান দিকের সব হোটেল তার দেখা হয়ে গেছে। বাঁদিকে ভালো হোটেল বিশেষ নেই। নিউ দিঘায় ফূর্তি করার মত জায়গা বহু আছে, তা ছেড়ে এত দূরে কেউ আসেনা। বাঁদিকে মোটরবাইক ঘোরাতেই চোখের সামনে কি যেন একটা চকমক করে উঠল। মোটরবাইক থামিয়ে সমীর ঠাহর করে দেখল গাছপালার ফাঁকে একটা কাঁচের দরজা দেখা যাচ্ছে। মানে এখানেও একটু ভিতর করে একটা হোটেল আছে। একটু দোনোমনো করে সমীর মোটরবাইক বড় রাস্তার পাশের গলিতে নামিয়ে দিল। সামনেই একটা দোতলা বাড়ি, সামনে কাঁচের দরজা। সমীর উঁকি দিয়ে দেখল কিন্তু ভিতরে কাউকে দেখতে পেলনা। সে মোটরবাইক ঘোরাতে যাবে, তখনই কে যেন আর্তনাদ করে উঠল, গলাটা সমীরের চেনা। তারপর আবার একটা আর্তনাদ। এবার ছেলেদের গলা। লাফ দিয়ে নেমে মোটরবাইক স্ট্যান্ড করে সমীর ভিতরে ঢুকে গেল। চিৎকারটা এসেছে দোতলা থেকে। কোমরে গোঁজা চপারটাকে একবার ছুঁয়ে নিয়ে সমীর কয়েক লাফে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। দোতলার ঘরের একটা দরজা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। একটা মেরুন পোশাকের আভাস, তারপর ফটাস করে একটা শব্দ। কে যেন পড়ে গেল। পা টিপে টিপে ঘরের দরজা অবধি পৌঁছে সমীর ভিতরে উঁকি দিল।
আধো জাগা, আধো ঘুমের মধ্যে যেন সে আছে। অয়নের হাতে কয়েন ভর্তি মোজাটা। অয়ন তার পা ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে খাটে নিয়ে ফেলল। অয়নের বাঁ চোখের নিচে সেফটিপিনটা বিঁধে রয়েছে। অয়ন তার হাত পা বেঁধে চিৎ করে ফেলে দিল বিছানার উপর। তার চোখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত আর মুখের লালা একসাথে শ্যামার গায়ে পড়ছে। দরজাটা আবার খুলে গেল। আরেকটা লোক ঢুকেছে। লোকটার হাতে কি যেন ঝকমক করছে। অয়ন মুখ তুলে তাকিয়ে কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। লোকটার হাতের জিনিসটা ঝিকিয়ে উঠল। এত রক্ত কেন তার সারা গায়ে! লোকটা তার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ে তাকে কিছু বলছে। দু হাত দিয়ে তাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সংজ্ঞা বিলুপ্ত হবার আগে শ্যামা দেখল মুখটা তার চেনা। সে অতি কষ্টে বলল, ‘বাড়ি যাব।’

পর্ব ৯
পল্টুর আজ উঠতে দেরি হয়েছে। অভ্যাসমত ব্রাশ মুখে করে সে পাড়ার মোড়ের কলতলায় এসে দাঁড়াল। কলতলায় বেশ ভিড়। তা হোক। পল্টুর কোনো তাড়া নেই। পিঁক পিঁক শব্দ শুনে পিছন ফিরে পল্টু দেখল সমীর তার মোটরবাইকটা চায়ের দোকানের পাশে দাঁড় করাল। তারপর চাবিটা বার করে নিয়ে তার দিকে হাসি মুখে এগিয়ে এলো। পল্টু মুখ থেকে বেশ খানিকটা ফেনা নর্দমায় ফেলে চাবিটা নিতে নিতে বলল, ‘কি রে, কাজ হয়েছে?’ সমীর মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ‘তা এখন কি কারখানায় চললি?’ সমীর আবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ‘তা থলিতে করে কি নিয়ে চললি?’ পল্টুর প্রশ্ন শুনে সমীর মাথা নিচু করে বলল, ‘এই টিপিন, বউ করে দিয়েছে, রুটি আলুভাজা। আর বলেছে এবার থেকে আমি যেন রোজ টিপিন নিয়ে যাই, ওই সকালে উঠে বানিয়ে দেবে আর বলেছে...’

0 comments: