1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - শ্রীশুভ্র

Posted in




















ইতিহাস অবশ্যই চর্চার বিষয়। ইতিহাস কি অতীত হয়ে যায়? যায় নিশ্চয়ই। ইতিহাসের চর্চা যখন স্তব্ধ হয়ে যায়। ব্যহত হয়ে যায়। তখন সত্যিই, ইতিহাসও অতীত হয়ে যায় বইকি। অতীত হয়ে যাওয়া মানে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া। চেতনার নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। সম্পূর্ণ অতীত হয়ে যাওয়া সেই ইতিহাস আর আমাদের কোন কাজে আসে না। কিন্তু নিজের ইতিহাস না জানলে নিজের বর্তমানকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করা যায় না। আর বর্তমানকে না চিনতে পারলে, সময় থাকতে ভবিষ্যতের দিশা ঠিক করাও সম্ভব নয়। দিশাহীন ভাবে ভবিষ্যতের দিকে এগোনোর অর্থ দিকভুল হওয়া। না, সেরকম ভাবে দিকভ্রান্তের মতো এগোতে চাই না নিশ্চয়ই আমরা কেউই। আর ঠিক এই কারণেই ইতিহাসের চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নিজের ইতিহাসটুকু জানা খুব জরুরী। নিজের ইতিহাস অর্থে নিজ দেশের ইতিহাস। সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনীতির ইতিহাস। স্বজাতির ইতিহাস। নিজ সংস্কৃতির ইতিহাস। আবার তাই বলে দেশের প্রতিটি মানুষ এক একজন ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবেন। সেটাও নিশ্চয় নয়। সেকথা কেউই বলে না। কিন্তু একজন শিক্ষিত মানুষ তাঁর স্বদেশ ও স্বজাতির, সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসের কিছুই জানবেন না। তেমনটাও নিশ্চয়ই কোনভাবেই অভিপ্রেত নয়। শুধুই যে শিক্ষিত মানুষ আপন ইতিহাস সম্বন্ধে সচেতন থাকবেন তাই নয়। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে পড়ে থাকা জনগণের বৃহত্তর অংশও কিন্তু সমাজিক ভাবেই আপন ইতিহাস সম্বন্ধে একটা প্রাথমিক ধারণা রাখে। সেটা কিভাবে সম্ভব হয়? সম্ভব হয়, আমরা যাকে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বলে থাকি। সেই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরার ভিতর দিয়েই সাধারণ ভাবে প্রথাগত শিক্ষার বাইরে থাকা মানুষও আপন ইতিহাসের খোঁজ রাখেন। এইভাবেই কালে কালে সমাজ এগিয়ে চলতে থাকে। এগিয়ে চলতে থাকে ইতিহাসের চর্চাও। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সেই চর্চা অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুসংহত ভাবে করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোর বাইরেও সামাজিক জীবনেও ইতিহাসের যে চর্চা চলতে থাকে। তার মূল্যও কম নয়। মূল্য কম নয় তার একটা বড়ো কারণই হলো, সাধারণ মানুষের চিন্তা ও চেতনা, জ্ঞান ও বুদ্ধির উপরে সেই চর্চার একটা স্থায়ী প্রভাব পড়তে থাকে। সমাজ তার নিজস্ব গতিতে ইতিহাসের যে চর্চাটুকু চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকে, সামগ্রিকভাবে সাধারণ জনমানসে তার প্রভাবই সমধিক। বস্তুত ইতিহাসের বইয়ের পাতায় কোন ইতিহাস কিভাবে লেখা থাকলো। তার থেকেও ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরায় যে ইতিহাস দাঁড়িয়ে যেতে থাকে তার প্রভাব অনেক বেশি। বেশি তার কারণ এইখানেই যে, সেই ইতিহাস প্রায় প্রতিটি মানুষকেই ছুঁয়ে থাকে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়জন ইতিহাসের পরীক্ষায় পাস করে কতো বড়ো সার্টিফিকেট পেল, তাই দিয়ে সমাজ চলে না। সমাজ যেভাবে তার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরাকে বহন করে নিয়ে চলে। সেইভাবেই জনমানসে ইতিহাসের চর্চা জারি থাকে। এইভাবে চলতে চলতেই আমরা ব্রিটিশ শাসন পর্বের তথাকথিত আধুনিক যুগে এসে পৌঁছিয়েছিলাম একদিন।

আবার একথাও ঠিক। শুধুমাত্র ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরার উপরেই নির্ভর করে থাকলে ইতিহাস চর্চা কখনোই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না। তার অন্যতম বড়ো কারণ হলো এই। ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরা কোন স্থায়ী রূপে আবর্তিতও হয় না। চলতে থাকে না একরকম ভাবেও। কালে কালে, নতুন কালের হাওয়া লেগে ঐতিহ্যও সময়ের সাথে বদলাতে থাকে। ফলে পরবর্তীতে উত্তরাধিকারের হাত ধরে ঐতিহ্যের বদলটাই সামনের কালের অভিমুখে টিকে থাকে বেশ কিছুকালের জন্য। কিন্তু ততক্ষণে ঐতিহ্যের বদলের পূর্বরূপটা পরবর্তী প্রজন্মগুলির কাছে হারিয়ে যেতে থাকে। হারিয়ে যায়। ফলে ইতিহাসের চর্চা যখন শুধুমাত্র ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে পরম্পরায় সংঘটিত হতে থাকে। তখন ইতিহাসের দৈর্ঘ্য কালে কালে ক্ষয়ে যেতে থাকে। ধরা যাক গৌতম বুদ্ধের জীবৎকালে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরায় যে ইতিহাসটুকু সজীব ছিল। গৌতম বুদ্ধের পরবর্তী এক হাজার বছর পরে নিশ্চয় সেই ইতিহাসের অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল। তার পরের হাজার বছরে আগের হাজার বছরের ইতিহাসেরও অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে। কারণ সময়ের সাথে ঐতিহ্য কখনোই এক জায়গায় এক ভঙ্গিমায় থেমে থাকে না তো। ফলে ঐতিহ্যের বদলের সাথে সাথে অতীত ইতিহাসের অনেকটাই হারিয়ে যেতে থাকে। যায়। অর্থাৎ শুধুমাত্র ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরার উপরে নির্ভর করে থাকলে বেশিদূর অতীতের ইতিহাস মুছে যেতে থাকে। যদি না ইতিহাসের চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ধারণ করে রাখা যায়। আর ঠিক এইখানেই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সুসংহত ভাবে ইতিহাসের চর্চাকে ধারণ করে রাখতেও হয়। ইতিহাসের চর্চাকে নিরন্তর সজীব ও সচল করে রাখতেও হয়। না, সেকাজ সাধারণ জনসাধারণের নয়। সেই কাজ বিশেষ ভাবে শিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের। সেই কাজ ঐতিহাসিকদের। তাদের কাজের ভিতর দিয়ে চর্চিত ইতিহাসের দীক্ষাকে জনসমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। শিক্ষা ব্যবস্থার। যে দেশ, যে জাতি সেই কাজে যত বেশি সফল। সেই দেশ সেই জাতি তার বর্তমানকে তত বেশি করে উন্নত করে তুলতে সক্ষম হয়। এটা ইতিহাসেরই বিধান। আজকে ইউরোপ, আমেরিকা তাদের দেশ ও সমাজ, অর্থনীতি ও শক্তিকে যতটা উন্নত করে তুলতে পেরেছে। সেটি সম্ভব হয়েছে তারা যতটা সফল ভাবে তাদের ইতিহাসকে সমগ্র জাতিসত্ত্বায় প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়েছে। তার ভিত্তিতেই। অনে‌কেই বলতে পারেন তা কেন। ইউরোপ, আমেরিকা উন্নতি করতে পেরেছে তার কারণ তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে বলেই। অনেকের আবার এমনও ধারণা, ইতিহাসের চর্চা করা মানে পিছিয়ে পড়ে থাকা। এই দুই ধারণাই অভ্রান্ত নয়। পথ চলার সময়ে আমার পিছনের পা ঠিক কোনখানে কোন অবস্থানে ছিল, সেই সম্বন্ধে আমার স্পষ্ট কোন ধারণা না থাকলে, প্রায় প্রতি পদেই সামনের পা অজায়গায় ফেলার সম্ভাবনা থাকে ষোলো আনা। এগিয়ে চলতে গেলে সামনের পা ঠিক কোথায় ফেললে নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলা সম্ভব সেটি জানতে গেলে পিছনের পায়ের অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভর করা ছাড়া কোন গতি নেই। থাকতেই পারে না। যেকোন দেশ ও জাতির সম্বন্ধেও ঠিক একই কথা। সেই পিছনের পায়ের অভিজ্ঞতার জ্ঞানই ইতিহাস। যেটি ঠিকমতো না জানতে পারলে সঠিক দিশায় দ্রুত সমানের দিকে এগোনা মুশকিল। পদে পদে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা। অবোধ শিশু যখন টলমল পায়ে চলতে শুরু করে। তখন তার এই পিছনের পায়ের কোন অভিজ্ঞতার বোধ জন্মায় না। ফলে সামনে গর্ত থাকলেও সে এড়িয়ে যাওয়ার বুদ্ধির কোন খোঁজ পায় না। ফলে হোঁচোট খেয়ে পড়ে। ইতিহাস বিমুখ জাতিও তাই উন্নত হয়ে উঠতে পারে না। শিশুর মতোই তাকে অন্যের হাতের উপরে নির্ভর করে পথে চলতে হয়। এইখানেই উন্নত দেশ ও সমাজগুলির উন্নতির পিছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যাবসা ও বাণিজ্যের অবদানের অনেক আগে সঠিক ইতিহাস চর্চার অবদান রয়ে গিয়েছে। ইতিহাসের নিরন্তর চর্চার ভিতর দিয়েই তারা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। সেই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই শিক্ষা ও দীক্ষা, জ্ঞান ও দর্শনের উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এইগুলির উন্নিত না হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যাবসা ও বাণিজ্যের উন্নতি ঘটানো অসম্ভব। অত্যন্ত পরিতাপের কথা, ভারতীয় উপমহাদেশের জাতিগুলির ভিতরে এবং বিশেষত বাঙালির চেতনায় এই সোজা কথাটি আজও ঢোকে নি। যার মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের প্রতিদিন।

ফলে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশের সূর্য উদয় হওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের ইতিহাসের চর্চা মূলত সেই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল। এখন ইতিহাসের চর্চা যখন ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরায় চলতে থাকে, তখন ইতিহাসের ভুলগুলি থেকে সঠিক শিক্ষা নেওয়ার কোন অভিজ্ঞতাও গড়ে ওঠে না। অন্ধবিশ্বাসের মতো যখন ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরাকে আমরা সতঃসিদ্ধ বলে মেনে নিতে থাকি, তখনই সতীদাহের মতো মর্মান্তিক প্রথাও চলতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী। আর এইখানেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রণালীর ভিতর দিয়ে ইতিহাসের গবেষণা ও চর্চার প্রয়োজন সীমাহীন। ব্রিটিশ শাসনের আগে অব্দি আমরা সেই প্রয়োজনের গুরুত্ব সম্বন্ধেই সচেতন ছিলাম না কোনদিন। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের কোন জাতিই নিজের ইতিহাসের সন্ধান করেনি তেমনভাবে। ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরায় সমাজিকভাবে যতটুকু ইতিহাসকে ধারণ করা যায়, তার বেশি ইতিহাসের সন্ধান ছিল না আমাদের চেতনায়। ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় জাতি ভারতীয় উপমহাদেশকে সঠিক ভাবে চেনার ও জানার লক্ষ্যেই ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের সন্ধান শুরু করলো। যে কোন জাতিকে তার সমাজ ও সংস্কৃতিকে জানতে গেলে সেই জাতির ইতিহাস জানা সবচেয়ে বেশি জরুরী। ইউরোপের জাতিগুলি সেই সত্য সম্বন্ধে পূর্ণ সচেতন ছিল বলেই, ব্রিটিশ শাসন পর্বে তারা ভারতীয় উপমহাদেশের জাতিগুলির ইতিহাসের সন্ধানে তৎপর হয়ে উঠলো। আর ভারতীয় উপমহাদেশকে শাসন করার কাজে ব্রিটিশের পক্ষে এই ভূখণ্ডের ইতিহাস জানা তো অনিবার্য্য ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুধুমাত্র ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরার উপরেই তারা নির্ভর করলো না। কারণ পূর্বেই বলেছি। এই পথে কেবলমাত্র সাম্প্রতিক ইতিহাসটুকুই সজীব থাকে। বহু পূর্বের ইতিহাস জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায় কালের বিবর্তনে। ফলে ইউরোপের গবেষকরা একেবারে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় শুরু করে দিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের সন্ধান ও গবেষণা। আর সেই কাজে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে এলো ব্রিটিশ। তাদের দায় ছিল এই ভূখণ্ডকে শতকের পর শতক পরাধীন করে রাখার। কোন ভূখণ্ডের মানুষকে শতকের পর শতক পরাধীন করে রাখতে গেলে, সেই ভূখণ্ডের ইতিহাসের নাড়িনক্ষত্র জানা জরুরী। এই কথাটুকু ব্রিটিশ শাসকরা সকলের প্রথমেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। আবার একথাও ঠিক। ভারতীয় উপমহাদেশের সমৃদ্ধ প্রাচীন ইতিহাসের অনুসন্ধানের ভিতর দিয়েই ইউরোপের জাতিগুলি সামনের দিকে এগিয়ে চলার সঠিক পথনির্দেশও অর্জন করেছিল। ভারতীয় ভূখণ্ডের জাতিগুলি দীর্ঘ কাল সীমায় যে যে ভুল করেছিল। তার থেকে সকলের আগে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলার পথনির্দেশ লাভ করে নিল ইউরোপ ও আমেরিকা। আমরা পড়ে রইলাম আমাদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরা নিয়েই। আর সেই সুযোগে ব্রিটিশ আমাদের উপরে প্রবল পরাক্রমে জাঁকিয়ে বসে পড়লো।

ফলে সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থা দিনে দিনে বিলুপ্ত হতে থাকলো। আমরা ব্রিটিশের পত্তন করা শিক্ষা ব্যবস্থায় অভ্যস্থ হয়ে উঠতে থাকলাম। এখন ব্রিটিশের পত্তন করা শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে ব্রিটিশের অনুগামী একশ্রেণীর অর্ধশিক্ষিত মোসাহেব গোত্রের ভৃত্য তৈরীর। যারা ব্রিটিশের শাসন শোষণ অত্যাচার ও লুন্ঠনের কাজে ব্রিটিশকে কায়মনবাক্যে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এবং ব্রিটিশ, ইংরেজি ভাষায় দক্ষ এই শ্রেণীর সাহায্যেই ভারত শাসন চালিয়ে যাবে শতকের পর শতক। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের গোটা কালপর্ব এইভাবেই চলেছিল, সেকথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এতে একটা সর্বনাশ যেটা ঘটেছিল সেটি হলো এই। ব্রিটিশের স্কুলে ঢুকে ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাস মুখস্থ করে যে নব্য শিক্ষিত ইংরেজি জানা শ্রেণীটি তৈরী হলো। তারা ভারতীয় উপমহাদেশের সেই ইতিহাসই জানতে পারলো ব্রিটিশ যে ইতিহাস ঠিক যেরকম ভাবে জানাতে চেয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের যে মূল্যায়ণ ব্রিটিশ করেছিল, সেটি যেমনই হোক না কেন। আমাদেরকে তারা যে সিলেবাসের খোঁড়ারে বেঁধে রেখে তৈরী করেছিল। সেই সিলেবাস তাদের হাতে তৈরী। তারা ঠিক যেভাবে আমাদের ইতিহাস আমাদেরকে জানাতে চেয়েছিল। আমরা ঠিক সেইভাবেই আমাদের ইতিহাস জানতে শিখেছিলাম। ব্রিটিশ শুধুই যে রাজনৈতিক ভাবে প্রশাসনিক ভাবে আমাদের পরাধীন করে রেখেছিল তা নয়। তারা আমাদের চেতনাকেও পরাধীন করে রেখে দিয়েছিল। ইতিহাসকে মানুষ জানবে শাসকের চোখ দিয়ে। শাসক যেভাবে ইতিহাস জানাতে থাকবে। মানুষকে সেই ভাবেই যখন ইতিহাস জানতে হয়। তখনই মানুষ শাসকের হাতে পরাধীন হয়ে যায়। সেই শাসক দেশীয়ই হোক আর বিদেশী হোক। তফাৎ বিশেষ কিছু থাকে না। ফলে সুচতুর ব্রিটিশ শতকের পর শতক ভারতীয় উপমহাদেশকে পরাধীন করে রাখার উপায় স্বরূপ এই ভূখণ্ডের ইতিহাসের এক ধরণের মূল্যায়ণ চাপিয়ে দিয়েছিল আমাদের উপরে। আমরাও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠার সাথে সাথেই ইতিহাসের সেই মূল্যায়ণকেই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রকৃত মূল্যায়ণ বলে গ্রহণ করে নিলাম। যার ফলে আমাদের ভিতরে ব্রিটিশের প্রতি ভক্তি বংশ পরম্পরায় অটুট থাকতে শুরু করে দিল। হ্যাঁ আমরা দেশের স্বাধীনতা চেয়েছি। নিজের দেশের শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে চেয়েছি বইকি। যাকে আমরা স্বাধীনতা আন্দোলন বলে অভিষিক্ত করে রেখে দিয়েছি। কিন্তু তাই বলে আমাদের ভিতরে ব্রিটিশের প্রতি ভক্তি ভালোবাসার ঐতিহ্য উত্তরাধিকারের পরম্পরায় আজও ছেদ পড়েনি। আজও দেশশুদ্ধ লোক বিশ্বাস করে, ভাগ্যে ব্রিটিশ এসেছিল। আমাদের পরাধীন করে দেশটাকে দখল করে নিয়েছিল। না হলে আজও আমরা আধুনিক হয়ে উঠতে পারতাম না। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা। ইংরেজি না জানতে পারলে বিশ্বের সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ ঘটানোই নাকি সম্ভব হতো না। ভারতীয় উপমহাদেশের যাবতীয় উন্নতির কারিগর তো সেই ব্রিটিশই। এই যে বদ্ধমূল বিশ্বাস। এবং সেই বিশ্বাসজনিত ভক্তি। সেই ভক্তি সময়ের সাথে আরও বেশি করে সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে, তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের সাড়ে সাত দশকের সময় সীমাতেও।

এখন প্রধান যে বিষয়টির উপরে আলোকপাত করা দরকার। সেটি হলো, ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাস থেকেই আমাদের চেতনায় এক বদ্ধমূল ধারণা জন্মিয়ে গেল যে ভারতবর্ষ একটি দেশ। সেটি সম্ভব হলো কারণ ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে আমাদের সামনে এমন ভাবেই উপস্থাপন করলো যে আমরাও ধরে নিলাম জার্মানী, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো ভারতবর্ষও একটি দেশ। অথচ ইতিহাসের যে ধারায় ইউরোপ একটি দেশ নয়। মহাদেশ। অর্থাৎ বিভিন্ন জাতি ও ভাষা ভিত্তিক এক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সমষ্টি, ঠিক সেই একই ধারাতেই ভারতবর্ষ নামে কখনো কোনদিন বিশ্বের কোথাও কোন দেশ ছিল না। কিন্তু আমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হলো ঠিক উল্টোটাই। ব্রিটিশের হাতে পরাধীন হওয়ার আগে অব্দি ইতিহাসের কোন পর্বেই ভারতবর্ষ বলে কোন দেশের অস্তিত্বই ছিল না। এটা কারুর ব্যক্তিগত মত বা তত্ত্ব নয়। এটা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস। অথচ ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাস মুখস্থ করে আমরা ঠিক উল্টোটাই জানলাম। না, শুধু আমরাই নয়। বাংলা ও বাঙালির সবচেয়ে বড়ো আত্মশ্লাঘার যে পর্ব। বাংলার সেই নবজাগরণের পর্বের রামমোহন থেকে নেতাজী পর্যন্ত এই ভুল ইতিহাসের সিলেবাসের প্রোডাক্ট। যার মূল্য আজও বাংলা ও বাঙালিকে দিয়ে যেতে হচ্ছে। সে অন্য প্রসঙ্গ। শাসকের স্বার্থে তৈরী করে দেওয়া ইতিহাসের সিলেবাস কি নির্মমভাবে এক একটি জাতিগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ ঝাঁঝরা করে দিতে পারে। এই ঘটনা তার অন্যতম বড়ো প্রমাণ। না, ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে বলেই যে এই অভিশাপের সমাপ্তি ঘটে গিয়েছে তেমনটাও নয় আদৌ। আলোচনার পরবর্তীতে আমরা সেই বিষয়ে আলোকপাত করবো যথাসময়ে। এখন অনেকের মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিতেই পারে। প্রায় একটি মহাদেশসম উপমহাদেশের ইতিহাসকে ব্রিটিশ কেন একটি দেশের ইতিহাস বলে চালিয়ে দিল। এবং শুধু দিলই না। একেবারে পাখি-পড়া করে আমাদের বিশ্বাস ভরসা চেতনার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। যার থেকে একজন মানুষও আজও মুক্ত হতে পারলো না। তার সবচেয়ে বড়ো কারণ, যে কোন ভূখণ্ডের মানুষকে যদি তার জাতিসত্ত্বার চেতনা থেকে উপড়িয়ে তুলে আনা সম্ভব হয়। তবে তাকে অনন্তকালের জন্য বশংবদ করে রাখা সহজ হয়ে যায়। ঠিক এই কারণেই ব্রিটিশ শাসন পর্বে আমরা আমাদের বাঙালি জাতিসত্ত্বার চেতনা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। উল্টে ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাস মুখস্থ করে সম্পূর্ণ এক কাল্পনিক মনগড়া ভারতীয় জাতিসত্ত্বায় বিভোর হয়ে পড়েছিলাম। ঠিক যে কারণে আমরা বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতা চাইনি কোনদিন। আমরা ভারত ও ভারতীয়দের স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। ব্রিটিশ জানতো, এর ফলে ব্রিটিশ যেদিন ভারতবর্ষ ছেড়ে চলেও যাবে। সেদিনও ব্রিটিশের বদলে যারা শাসকশ্রেণী হয়ে উঠবে। তারাও ব্রিটিশের মতোই শাসন ও শোষণ অত্যাচার ও লুন্ঠনের কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে সহজেই। একটি দেশ গড়ে ওঠে এক ভাষা ও এক জাতিগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে। এটাই ইতিহাসের বিধান। তখন সেই দেশের জনসাধারণের ভিতরে যে স্বদেশ প্রেম যে জাতীয়তার বোধ গড়ে ওঠে, তাতে এক দেশ এক প্রাণ এবং একটিই জাতীয় স্বার্থের বোধ জন্ম নিতে থাকে। ফলে সেই দেশ তখন সমাগ্রিকভাবে সমগ্র দেশ ও সকল দেশবাসীর উন্নতির জন্য স্বচেষ্ট হয়। উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশের দিকে তাকালেই আমরা ইতিহাসের এই বিধান প্রত্যক্ষ করতে পারি। কিন্তু পঁয়ত্রিশটি জাতি, ভাষা ও আলাদা আলাদা দেশকে একটিমাত্র মানচিত্রে গেঁথে দিলে যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে ওঠে। তাতে কখনোই এক দেশ এক প্রাণ এক জাতিসত্ত্বার উদ্বোধন হয় না। সেই জগাখিচুড়ি অবস্থাকে বৈচিত্রের ভিতরে ঐক্যের সমন্বয় বলে চালানো সহজ হলেও তাতে লাভ হয় শুধুমাত্র শাসন ও শোষণের। অত্যাচার ও লুন্ঠনের। ভারতীয় উপমাদেশকে ভারতবর্ষ বলে চালিয়ে ব্রিটিশ সেই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করেছিল। আজকে ব্রিটিশের বদলে যারা শাসকশ্রেণী। তারাও সেই একই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে চলছে। এটাই এই ভূখণ্ডের অন্যতম প্রধান অভিশাপ।

শাসক তার স্বার্থে যে ইতিহাস রচনা করে। সেই ইতিহাস মানুষের বিশেষ উপকারে আসে না। উল্টে অপকার নিশ্চিত করে। ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডের ভিতর ভাষা সংস্কৃতি ও ইতিহাসের যতটুকু মিল। বাংলা ও মহারাষ্ট্রের ভিতরেও ভাষা সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ততটুকুই মিল। ফ্রান্স যেমন এককালে ইংল্যাণ্ড অধিকার করে শাসন করেছিল। মারাঠী বর্গীরা বাংলা দখল করে তেমন ভাবে শাসন না করলেও বাংলার সমৃদ্ধ অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল। এখন একজন ফরাসী কিন্তু কখনোই একজন ব্রিটিশকে আপন স্বজাতি বলে মনে করবে না। কিন্তু ভারতীয় বাঙালি মাত্রেই মারাঠীদের আপন স্বজাতি বলে মনে করে থাকে। তার কারণ বাঙালিরা ব্রিটিশের সিলেবাস মুখস্থ করে মারাঠীদের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ভারতীয়। যদিও কোন মারাঠীই বাঙালিকে আপন স্বজাতি বলে মনে করে না। করার কথাও নয়, করা উচিতও নয়। কজন তামিল পাঞ্জাবীদের আপন স্বজাতি বলে মানে? এই দুই জাতির ভাষা সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভিতর এমন কি জলবায়ুর ভিতরেও কতটুকু মিল রয়েছে? একটু স্বাধীন ভাবে ভাবলেই সঠিক উত্তরটি জানা সম্ভব বইকি। ঠিক তেমনই গুজরাটীদের সাথে তেলেঙ্গানার অধিবাসীদেরই বা মিল কোথায়? কিংবা রাজস্থানীদের সাথে আসামীদের? এই যে প্রত্যক্ষ অমিলের বিষয়গুলি। এই ধরণের অমিলগুলি ইটালী, জার্মান, পোলিশ, সুইডিশ, গ্রীক, রাশিয়ানদের ভিতরেও একই রকমভাবে প্রত্যক্ষ। কিন্তু তাই বলে কেউ দাবি করে না তারা একই জাতি। কিন্তু ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাসে আমাদের মনে করতে হচ্ছে তামিল, নাগা, পাঞ্জাবী, বাঙালী, মারাঠী, আসামী, গুজরাটি, কাশ্মীরী সব এক জাতি। না, এই সর্বনাশা ইতিহাস কোনদিন কোন মানুষের উপকারে আসতেই পারে না। আসার কথাও নয়। তাহলে এই ইতিহাসে উপকার কাদের হয়? কাদের কোন কোন স্বার্থ রক্ষিত হয়? উপকার হয় শাসকশ্রেণীর। উপকার হয় শিল্পপতিদের। তাদের শাসন ও শোষণের চুরি ও লুন্ঠনের স্বার্থ রক্ষা হয়। ১৯৪৭ এর আগে সেই স্বার্থ পূরণ হতো ব্রিটিশের। লিভার ব্রাদার্সসহ অন্যান্য ইউরোপীয় কর্পোরেট সংস্থাগুলির। ১৯৪৭ এর পর সেই স্বার্থ পূরণ হয়েছে কংগ্রেসের। টাটা বিড়ালাদের। আজকে পূরণ হচ্ছে বিজেপির। আদানী আম্বানীদের। রাষ্ট্র যখন বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত থাকে তখন মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধ ও উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। নয় বলেই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙে গিয়েছিল। বাঙালির যত স্বার্থহানিই হোক না কেন। তাতে অবাঙালিদের কিছুই এসে যাবে না। মারাঠীদের ক্ষতিতে তামিলরা কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত বোধ করবে না। আজ অবরুদ্ধ কাশ্মীরবাসীদের যন্ত্রণায় ভারতের বাকি কোন জাতগোষ্ঠীরই কিছু এসে যাচ্ছে না। এইভাবে কোন দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। দেশের উন্নতি মানে দেশের আপামর মানুষের উন্নতি। কয়েকজন শিল্পপতির উন্নতিতে দেশ উন্নত হয় না। এই বোধ আমাদের ভিতরে আজও গড়ে ওঠেনি। তার মূল কারণ। আমরা ইতিহাসের পাঠ নিয়েছি শাসকের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাস মুখস্থ করেই। যে ইতিহাস শাসকের স্বার্থ রক্ষায় তৈরী করা হয়। এটাই ইতিহাসের রাজনীতি।

ব্রিটিশ চলে গিয়েছে সাড়ে সাত দশক আগে। কিন্তু ইতিহাসের এই রাজনীতি বহাল তবিয়তে আরও নানান শাখা প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশের পরে শাসকশ্রেণী হিসাবে কংগ্রেস তার নিজ স্বার্থে ইতিহাসের একটা পাঠ তৈরী করে তুলেছিল কয়েক দশকের সাধনায়। যে পাঠে, ভারতবর্ষের সাধীনতার কাণ্ডারী একমাত্র কংগ্রেস এবং গান্ধী পরিবার। দেশের রূপকার মহাত্মা গান্ধী। ব্রিটিশের হাতে পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিস্তৃত ইতিহাসকে দশকের পর দশক ধরে ভুলিয়ে দেওয়ার সিলেবাস চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। শুধুমাত্র গান্ধী, নেহেরু ও প্যাটেলের হাতেই ব্রিটিশের পরাজয় ঘটছে। এমনই সম্পূর্ণ অসত্য এক ইতিহাসের সুচতুর নির্মাণ হয়েছে কংগ্রেস শাসনে। গোটা ভারতবর্ষের জনমানস থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজী ও তার আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদানকে প্রায় সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া হয়েছে দক্ষ হাতে। বাংলার বিপ্লবীদের স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসকে ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের ইতিহাসের সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলা মাধ্যমে সুশিক্ষিত বাঙালি ছাড়া ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর মানুষ ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, রাসবিহারী, বিনয়-বাদল-দীনেশ, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রতিলতা ওয়াদ্দেদার সহ শতশত বাঙালি শহীদদের নামই জানে না। তাদেরকে সচেতন ভাবে পরিকল্পনা করেই জানতে দেওয়া হয়নি। জানতে দেওয়া হয় না। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাঙালির অবদান সম্বন্ধে অবাঙালিদের ভিতর প্রকৃত কোন ধারণাই গড়ে ওঠেনি। উঠতে দেওয়াই হয়নি। হয়নি কারণ। কংগ্রেসের স্বার্থ রক্ষার কারণে। গান্ধী ও নেহেরু পরিবারের স্বার্থে। যে নেহেরু পরিস্কার ঘোষণা দিয়েছিলেন, নেতাজী ফিরে আসলে সকলের আগে তিনিই তরবারি নিয়ে রুখে দাঁড়াবেন। সরকারী দপ্তরে নেতাজীর ছবি টাঙানো ও প্রতিকৃতি রাখার বিষয়ে অলিখিত নিষেধ ছিল। ফলে কংগ্রেসী শাসনামলে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বাঙালির প্রকৃত অবদান প্রায় নস্যাৎ করে অকিঞ্চিৎকর করে দেখাতে হয়েছিল। যাতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রধান রূপকার হিসাবে কংগ্রেস ও গান্ধী এবং নেহেরুই প্রধান হয়ে ওঠে জনমানসে। এই সেই ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি। শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় ইতিহাসের সিলেবাস নির্মাণ। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভূমিকাকেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। হয়েছে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির স্বার্থেই। শাসকশ্রেণী ও শিল্পমহল তাদের শাসন ও শোষণের স্বার্থেই ইতিহাসের সিলেবাসকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে। সেই ইতিহাস মানুষকে অন্ধকারে রাখতে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। সেই ইতিহাস মানুষকে শাসকের স্বার্থে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। সেই ইতিহাস দেশের সম্পদ লুঠ করতে সাহায্য করে। ব্রিটিশের তৈরী করে দিয়ে যাওয়া এই রাজনীতিই স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের অন্যতম ইতিহাস। যে ইতিহাস মানুষের ইতিহাস নয়। শাসকের ইতিহাস।

ভারতবর্ষ যে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। ক্ষমতা হস্তান্তর আর স্বাধীনতা অর্জন যে এক বিষয় নয় সেই ধারণাও আমদের ভিতরে গড়ে ওঠেনি। যদি এই স্বাধীনতা অর্জিত স্বাধীনতা হতো। তাহলে ব্রিটিশ শাসনামলের পর্বের ইতিহাসের বয়ান অন্য রকমের হতো। আজও ভারতবর্ষের মানুষের ভিতরে এমন অহেতুক ব্রিটিশভক্তি দেখা যেত না। আজও ভারতবাসী ব্রিটেন আমেরিকার মোহান্ধ হয়ে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, ব্রিটিশের হাত ধরেই ভারতবাসী সভ্য শিক্ষিত আধুনিক হয়ে উঠেছে। এটা সম্ভব হয়েছে তার কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের শাসনামলে ইতিহাসের যে সিলেবাস রচনা করা হয়েছিল, তাতে ব্রিটিশকে ভারতবন্ধু হিসাবেই তুলে ধরা হয়েছে বেশি করে। এই হলো ইতিহাসের বয়ান নির্মাণ। এই হলো ইতিহাস নিয়ে রাজনীতির কূটকৌশল। অনুমান করা কষ্টকর নয়, ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তির ভিতরেই হয়তো এই নির্দেশ রয়ে গিয়েছিল। যে চুক্তি আজও সম্পূর্ণ গোপন করে রাখা হয়েছে। ইতিহাসের এই বয়ানের দুইটি প্রধান দিক। এক দিকে দেশের স্বাধীনতা এনেছে কংগ্রেস। দেশ ভাগের দায় মুসলীম লীগসহ জিন্নাহর। আর এক দিকে ব্রিটিশের হাত ধরেই ভারত আধুনিক ও সভ্য হয়ে উঠেছে। ফলে ভারতবর্ষ ও ব্রিটেন আর পরস্পরের শত্রু নয়। বরং মিত্র। এই মিত্রতার নির্মাণ ইতিহাসের সিলেবাস তৈরীর ভিতর দিয়েই সম্ভব হয়েছে। শাসকশ্রেণী হিসাবে কংগ্রেস তার গোষ্ঠী স্বার্থকে রক্ষা করতেই ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ একপেশে করে পরিবেশিত করেছে। কংগ্রেসের গোষ্ঠী স্বার্থের সাথে যোগ দিয়েছে টাটা বিড়লা সহ গুজরাটি, মারোয়ারী শিল্পমহল। যাদের স্বার্থে স্বাধীনতার আন্দোলনে কমিউনিস্ট ধারার কোন ভূমিকাই দেখানো হয় না। উল্টে কমিউনিস্টদের বিদেশের দালাল হিসাবে চীন, রাশিয়ার দালাল বলে দেখানো হয়ে থাকে। যাতে দেশের ভিতর শিল্পমহলের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত জনগণের ক্ষোভ বিক্ষোভ কমিউনিস্ট ভাবধারায় সংহত হয়ে উঠতে না পারে। কারণ তাহলেই ধনতন্ত্রের বিপদ। ধনতন্ত্রের বিপদ মানেই দেশের শিল্পমহলের বিপদ। এবং সেই শিল্পমহলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসাবে শাসকশ্রেণী কংগ্রেসেরও বিপদ। ফলে জনমানসে কমিউনিস্ট আন্দোলনের কোন প্রভাব যাতে না পড়ে, কংগ্রেসের শাসনামলের ইতিহাসের বয়ান সেই দিকে লক্ষ্য রেখেও নির্মিত হয়েছিল। এর ফলে দেশের প্রকৃত ইতিহাস থেকে দেশবাসীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কাজটি সুচারুরূপে সার্থক করে তোলা সহজ হয়ে যায় অনেকটাই। দেশব্যাপী জনমানস যখন প্রকৃত ইতিহাস থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন সেই জনগোষ্ঠীকে ইচ্ছে মতোন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা মাখনের ভিতর দিয়ে ছুরি চালানোর মতো আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে শাসক শ্রেণীর কাছে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় সাত দশক কংগ্রেস সেই আনন্দকে ধরে রাখতে পেরেছিল অক্লেশে। এইখানেই স্বাধীনতা পরবর্তী কালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসের নির্মিত বয়ানের সাফল্য।

শাসন ক্ষমতায় সেই কংগ্রেসও আর নেই। শিল্পমহলও শিবির বদল করে ফেলেছে। নতুন শতকে নতুন শাসক। শাসকের শ্রেণী একই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেসের জায়গায় ক্ষমতার দখল এখন বিজেপির হাতে। এদিকে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের তৈরী করা ইতিহাসের বয়ানে বিজেপি বা তার পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক আরএসএস-এর কোন ছবি তো নেই। এমনকি প্রকৃত ইতিহাসেও তাদের কোন ভূমিকা নেই। ভূমিকা যেটুকু রয়েছে সেটা ব্রিটিশের পক্ষেই রয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে কোন ভূমিকাই নেই। এটাই বিজেপি তথা আরএসএস-এর সবচেয়ে নড়বড়ে আর দুর্বলতার জায়গা। তাই এই দুর্বলতাকে যেভাবেই হোক ঢাকা না দিলে তো কংগ্রেস মুক্ত ভারত গড়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। ফলে গত সাত বছরে শাসক শ্রেণীকে ইতিহাসের নবতর এক বয়ানের নির্মান কার্য শুরু করতে হয়েছে। একাজ যদিও এক আধ দিনের কাজও নয়। আগামী কয়েক দশক এই কাজ চালিয়ে নিয়ে না গেলে কংগ্রেস নির্মিত ও চর্চিত বয়ানের প্রভাব থেকে দেশের মানুষককে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। আর সেটি না করতে পারলে দশকের পর দশক জুড়ে শাসন ক্ষমতা দখলে রাখাও সম্ভব হবে না। ঠিক এই কারণেই বর্তমান শাসকশ্রেণীকে সাভারকারকে নিয়ে উঠে পড়ে লাগতে হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর জায়গায় সাভারকারকে যেভাবে হোক বসানোর একটা প্রতিজ্ঞা হয়তো তাদের মধ্যে দৃঢ় হয়ে উঠেছে। তারই নানা রকম লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে বিজেপি ও আরএসএস-এর কর্মকাণ্ডে। একদিকে সাভারকারকে হিন্দুত্বের জাগরণের সাথে জুড়ে রেখে নাথুরাম গডসেকে শহীদ বানানোর প্রয়াসের ভিতর দিয়েই হয়তো তাদের লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনার পথ বিস্তৃত হচ্ছে দিনে দিনে। কিন্তু এতো করেও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে আরএসএস-এর অবদানের ইতিহাস নির্মাণ যে সম্ভব নয়। সেকথা তারাও বিলক্ষণ জানে। ফলে তাদেরকে ইতিহাসের নবতর বয়ান নির্মানে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে কয়েক হাজার বছর। শুরু করতে হচ্ছে রামায়ণ মহাভারতের সিরিয়াল দিয়ে। মহাকাব্যকেই ইতিহাসের সিলেবাসে নিয়ে আসতে হচ্ছে একেবারে ঢাক ঢোল পিটিয়ে। ফলে রাম ও রামমন্দির দিয়ে শুরু করতে হচ্ছে। আর অযোধ্যাই সে শুরুর পবিত্রভূমি। বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও সেখানে রামমন্দির নির্মাণই ইতিহাসের বিজেপিকরণের সূত্রপাত হিসাবে ধরা হচ্ছে। এখন বিজেপি তথা আরএসএস-এর কাছে অযোধ্যা আর রামমন্দির সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার একটা কারণ রয়েছে। যেহেতু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে তাদের কেন ভুমিকা নাই। সেই অক্ষমতা ঢাকা দেওয়ার জন্য তাদের নির্মিত ইতিহাসের বয়ানে হিন্দুত্বের পুনরজাগরণের গল্পকে গেঁথে তোলা ছাড়া হাতে অন্য কোন বিকল্প কোন পথও নেই। আর এই পুর্নজাগরণের লড়াই কাদের বিরুদ্ধে? না ইসলামের বিরুদ্ধে। সেটি না হলে ব্রিটিশের উদ্ভাবিত ডিভাইড এণ্ড রুল সংঘটিত করাই বা যাবে কি করে? ফলে অযোধ্যা থেকেই ইতিহাসের নবনির্মাণ শুরু করতে হচ্ছে আরএসএস ও বিজেপিকে। এবং রামমন্দির প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়েই ইতিহাসের নতুন বয়ানের পাতাগুলি দিনে দিনে খুলতে শুরু করবে। যার মূল গতি থাকবে ইসলামের বিরুদ্ধে, হিন্দুত্বের নবজাগরণের অভিমুখে। ঠিক এই কারণেই ইতিহাসের এই নবনির্মাণে ভারতবর্ষে ইসলামী আক্রমণ ও সাম্রাজ্যবিস্তারকে দেশের পরাধীনতা হিসাবে দেখানোর প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যাতে অনেকই সহমত হবেন। ঠিকই তো শক হুন দল মোগল পাঠান, আসলেই তো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবেই এখানে ঢুকে ভারতবর্ষ দখল করেছিল। কোন ভারতবর্ষ? না, ব্রিটিশের তৈরী করা ভারতবর্ষ। তাদেরকে আদৌ বোঝানো যাবেই না। ব্রিটিশের তৈরী করা মানচিত্রের ভারতবর্ষের অস্তিত্ব ব্রিটিশ আসার আগে ছিলই না কোনদিন। ভারতীয় উপমহাদেশের নানা জাতির নানান সাম্রাজ্য ছিল এখানে। নানা ভাষা নানা মত। নানা পরিধান। হ্যাঁ, একের পর এক বিদেশী শক্তি বারংবার হানা দিয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের নানান সময়ে। এক এক সময়ে এক এক বিদেশী শক্তি এক একটি সাম্রাজ্য দখল করে নিয়ে সেই সাম্রাজ্যের শাসক হয়ে বসলেও। কালক্রমে সেই সাম্রাজ্যেরই একজন হয়ে উঠেছিল। নাদির শাহের মতো সম্পদ লুন্ঠন করে নিয়ে ফিরেও যায়নি। কিংবা ব্রিটিশের মতো এই ভূখণ্ডকে পরাধীনতার নাগপাশে বেঁধে রেখে শোষন করতে থাকেনি শতকের পর শতক ধরে। উল্টে এই ভারতীয় ভূখণ্ডেরই নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এক এক জাতির অংশ হয়ে উঠেছিল। এই যে প্রকৃত ইতিহাস। সেই ইতিহাসই নতুন করে ঘুলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে যে, সেটি কিন্তু পরিষ্কার। ইতিহাসের এই নব নির্মাণের একদিকে হিন্দু রাজাদের জাতীয় বীর বলে তুলে ধরা হচ্ছে, হবে। আর এক দিকে মুসলিম শাসকদের বিদেশী শত্রু বলে তুলে ধরে তাদের বংশধরদেরকেও ভিলেন বানিয়ে তোলা হবে। আর সেটি করতে গেলে, তো মোগল পাঠানদের হাতে মন্দির ধ্বংস, হিন্দু নারীদের সম্মানহানি, লুঠপাট অগ্নিসংযোগের পুরনো ইতিহাসগুলি আরও বেশি করে ফাঁপিয়ে এবং বাড়িয়ে পরিবেশন করতেই হবে। প্রথমে সিনেমা সিরিয়াল দিয়ে এবং পড়ে ইতিহাসের নতুন সিলেবাস তৈরী করে ভারতবর্ষকে শুধুমাত্র হিন্দুর দেশ আর মুসলিমদের বিদেশী শত্রু হিসাবেই চিহ্নিত করার কাজ পাকাপাকি বন্দোবস্তে সম্পন্ন করা হবে। আর সেটি করতে পারলেই হিন্দুত্বের নবজাগরণ ঘটানোর নেপথ্যে বিজেপি তথা আরএসএস-এর অবদান ও ভূমিকাকে আগামী ইতিহাসে স্থায়ী করে দিয়ে যাওয়ার পথ খুলে যাবে বইকি।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই প্রয়াস নতুন বা প্রথম নয় আদৌ। এই প্রয়াসের শুরু সম্ভবত বৈদিক যুগ থেকেই। যখন আর্যরা অনার্যদের হাত থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। পরাজিত নির্যাতিত অনার্যরা ক্রমশ পিছু হটতে হটতে সমাজের মূল স্রোত থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে মূলত বন জঙ্গলেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। যাদের রামায়ণ মহাভারতের মতো মহাকাব্যে রাক্ষসকূল বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর্যরাই হিরো। আর অনার্যরা ভিলেন তথা রাক্ষস। আজকে যাদেরকে আমরা দলিত বলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বলে অভিহিত করে থাকি। ফলে বৈদিক যুগের ইতিহাসের বয়ানে অনার্যরা যেভাবে রাক্ষস হয়ে উঠেছিল। ঠিক সেই ভাবেই হিন্দুত্বের নবজাগরণের ইতিহাসের যে বয়ান তৈরী হতে চলেছে। তাতে ভারতীয় মুসলিমদেরকেই ভিলেন তথা বিদেশী শত্রু আর হিন্দু নেতাদের হিরো তথা দেশপ্রেমিক ইত্যাদি হিসাবে প্রচার করা হতেই থাকবে। এর ভিতর দিয়েই দেশের অধিকাংশ হিন্দুদেরকে বিজেপি তথা আরএসএস-এর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারলেই কেল্লাফতে। সমস্ত দেশীয় সম্পদের মালিকানা তখন দুই একজন শিল্পপতির হাতে তুলে দিলেও ক্ষমতার গদি টলে যাবে না। ফলে কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়তে ইতিহাসের এই নবনির্মাণ জরুরী। হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে গেলে ইতিহাসের এই নবনির্মাণ জরুরী। দেশের সব সম্পদ শিল্পমহলের মালিকানায় তুলে দিতে গেলে ইতিহাসের এই নবনির্মান জরুরী। লক্ষ্য করে দেখতে হবে। মুসলিম ও খ্রিষ্টান এই দুই সম্প্রদায়ই ভারতীয় উপমহাদেশের নানান সাম্রাজ্যের দখল নিয়ে নিয়েছিল। মুসলিমরা এসেছিল আগে। ইউরোপীয়ানরা এসেছিল পরে। কিন্তু হিন্দুত্বের নবজাগরণের ইতিহাসের নবনির্মাণে ভিলেনের জায়গাটি দেওয়া হচ্ছে কিন্তু শুধুমাত্র মুসলিমদেরকেই। আওরঙ্গজেব অত্যাচারী শাসক ছিল। কিন্তু ইতিহাসের এই নব নির্মাণে ব্রিটিশ কিন্তু অত্যাচারী শাসক নয় আদৌ। মোগল পাঠানরা হিন্দুদের উপরে অত্যাচার করলেও। ব্রিটিশের অত্যাচার নিয়ে ইতিহাসের এই নবনির্মিত বয়ান একেবারেই কিন্তু নিশ্চুপ। লক্ষ্মনীয় আরও একটি বিষয়। ব্রিটিশকে ইতিহাসের গুডবুকে রাখার বিষয়ে কংগ্রেস ও বিজেপির ভূমিকা কিন্তু একই রকম। এই একটি বিষয়ে কি অত্যাশ্চার্য মিল এই দুই শিবিরের।

অর্থাৎ ব্রিটিশ তার স্বার্থে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে একভাবে উপস্থাপিত করে গিয়েছে। কংগ্রেস তার স্বার্থে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে তাদের মতো করে উপস্থাপিত করে দশকের পর দশক শাসন করে গিয়েছে। আর বর্তমানে ইতিহাসের আরও এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করা শুরু হয়ে গিয়েছে বর্তমান শাসক ও তার মহা পরিচালক আরএসএস-এর স্বার্থরক্ষায়। কিন্তু এইসব একাধিক বয়ানের ভিতরে একটি জায়গায় খুব মিল রয়েছে। সেটি হলো এই ভূখণ্ডের সম্পদের মালিকানার দখল নেওয়া। একদিন সেই মালিকা ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাতে গিয়ে পড়েছিল। সেই সূত্রে ব্রিটেনের শিল্পমহলের হাতে গিয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের হাত ধরে সেই মালিকানার একটা বড়ো অংশ টাটা বিড়লাদের হাতে গিয়ে পৌঁছায়। আর বর্তমান সরকার তো সরাসরি দেশের সব সম্পত্তিই জলের দরে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। আর এই গোটা প্রক্রিয়ায় জনতার প্রতিক্রিয়া শূন্য করে রাখতেই ইতিহাসের এক একটি বয়ানের নির্মান ও প্রচারের ব্যবস্থা। ফলে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ এই ভূখণ্ডের মানুষের অধরাই রয়ে গিয়েছে। শাসকের মুখের বদল ঘটেছে শুধু। শোষণের ধারার বদল হয়নি কোন। ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন বয়ান নির্মাণ ছাড়া শোষণের ধারা বজায় রাখাও মুশকিল। তাই দেশের প্রকৃত ইতিহাস থেকে জনসাধারণ যত বেশিদিন বিচ্ছিন্ন থাকবে। ততদিনই শোষণের এই ধারা চলতে থাকবে অব্যাহত গতিতে। নিরন্তর সঠিক ইতিহাসের চর্চা ও তার আলোচনা ছাড়া জনমানসে কোনটি ঠিক আর কোনটি নয়, সেই বোধ গড়ে ওঠে না। সেটি গড়ে না উঠলে সেই জনতার পক্ষে তার দেশ ও স্বজাতি সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানোও সম্ভব নয়। ইউরোপের অধিবাসীরা এই সত্য বেশ কয়েক শতক আগেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল। হয়েছিল বলেই তারা দ্রুত নিজেদের উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে আর গোটা বিশ্বকেই তারা আজ ভাগ করে নিয়ে অধিকার করে বসে রয়েছে। এই শক্তি তারা অর্জন করেছে নিরন্তর ইতিহাসের চর্চা ও গবেষণা থেকে। কিন্তু আমাদের মতো উপনিবেশিক ভূখণ্ডের জনসাধারণের ভিতরে সেই বোধ আজও অর্জিত হয়নি বলেই, আজও আমরা একটির পর একটি শাসকের অধীনে শোষিত ও নিপীড়িত হয়ে চলেছি। স্বাধীনতা তাই আমাদের কাছে একটি দিন মাত্র। জীবনের মূল সত্য নয়। আর বিশেষ করে ইতিহাস বিমুখ ও ইতিহাস বিস্মৃত জাতির পক্ষে নিরন্তর অপরের গোলামী করে যাওয়া ছাড়া করারও কিছু থাকে না। সে বিদেশী কি দেশীয় শক্তিই হোক না কেন। আর ঠিক এই কারণেই বিশ্বের যাবতীয় সূচকে তারাই সবচেয়ে পিছনের সারিতে পড়ে থাকে। পড়ে থাকবেও।

আমরা যদি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রকৃত ইতিহাসের অনুসন্ধান ও চর্চা করতাম, তাহলে খুব স্পষ্টভাবেই কয়েকটি বিষয় আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতো। প্রথমত, পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতবর্ষ কোন দেশ ছিল না কোনদিই। ইউরোপের মতো আফ্রিকার মত এশিয়ার মতোই নানান সাম্রাজ্য ও জাতির অবস্থান নিয়েই গড়ে উঠেছিল ভারতীয় উপমহাদেশ। যেখানে প্রতিটি জাতি ইউরোপীয় জাতিগুলির মতোই পরস্পরের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থেকে আপন সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে অধিকতর ব্যস্ত থাকতো। এবং তাদের ভিতর পারস্পরিক শত্রুতা এতটাই তীব্র ছিল যে, ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি যখনই ভারতীয় উপমহাদেশের কোন একটি সাম্রাজ্য আক্রমণ করতো, এই ভূখণ্ডের অন্যান্য সাম্রাজ্যগুলি বসে বসে মজা দেখতো। এবং তদের পড়শীর পতনে উল্লসিত হতো। আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের সময় থেকে এই ধারাই চলে আসছিল। নিশ্চয়ই ভারতবর্ষ যদি একটি মাত্র দেশ হতো, এমন ঘটনা সম্ভব হতো না। না, ইতিহাসের এই সহজ কথাটা আমাদের চেতনায় ধরা দেয় না আজও। দ্বিতীয়ত, আলেকজাণ্ডার চেঙ্গিস খাঁ তৈমুর লঙ্গ নাদির শাহের মতো স্বল্প সংখ্যক ব্যাতিক্রম বাদ দিলে, বাকি সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণকারীরা কিন্তু এই ভূখণ্ডেই রয়ে গিয়েছিল। নিজ মাতৃভুমিতে আর ফিরে যায়নি কোনদিন। এই ভূখণ্ডেই তারা তাদের সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশেরই অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল কালে কালে। তৃতীয়ত, একমাত্র ব্রিটিশ বাদে অন্য কোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই ভারতবর্ষকে পরাধীন করে রাখেনি কোনদিন। সাম্রাজ্য বিস্তার ও দখল করা এক বিষয়। আর একটি ভূখণ্ডকে পরাধীন করে রাখা অন্য বিষয়। ফলে শক হুন মোগল পাঠানের সাথে ব্রিটিশ জাতির পার্থক্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। শক হুন মোগল পাঠানের মতো ব্রিটিশ জাতি ভারতীয় ভূখণ্ডের অপরাপর জাতির সাথে মিশে যায়নি আদৌ। এইখানেই তাদের সাথে শক, হুন, মোগল, পাঠানদের প্রভেদ। তারাও আর্যদের মতোই এই ভারতীয় উপমহাদেশই রয়ে গিয়েছে। আজকে তাই আর্য থেকে শুরু করে শক হুন মোগল পাঠান কাউকেই আর বিদেশী বলে চিহ্নিত করার উপায় নাই। কালের বিবর্তনে আজকে এসে একমাত্র মাতৃভাষা দিয়েই এই ভূখণ্ডে জাতিগত পরিচয় নির্ধারিত হতে পারে। অন্য কোন উপায়ে নয়। এবং ধর্ম দিয়ে তো নয়ই। বিশ্বের কোন প্রান্তেই ধর্ম জাতিগত পরিচয় নির্ধারণ করে না। ভাষা খাদ্যাভ্যাস কিছুটা পরিমাণে পোশাক পরিচ্ছদের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিই জতিগত পরিচয়ের নির্ধারক। এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিগুলি ব্রিটিশের কাছে পরাধীন হওয়ার আগে অব্দি কখনো কোনদিন ভারতীয় পরিচয়ে আপন জাতিসত্ত্বা বিসর্জন দেয়নি। এবং তারা সকলে মিলে পারস্পরিক স্বাতন্ত্রের উর্দ্ধে উঠে কাল্পনিক ভারতীয় পরিচয়কেও কোনদিন বরণ করে নেয়নি। ব্রিটিশ এসে সর্বপ্রথম এই ভূখণ্ডের সকল জাতিকে পরাধীন করে এই এক ভারতীয় জাতীয়তার শিকলে বেঁধে ফেলে। পরে ডিভাইড এণ্ড রুল তত্ত্বেই জন্ম হয় পাকিস্তানের। ভারতবর্ষের ইতিহাসের আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট হল, বর্ণভেদ প্রথা। ইউরোপের ইতিহাস যে অভিশাপ থেকে মুক্ত ছিল। ইউরোপের জাতিগোষ্ঠিগুলি ধনী ও দরিদ্র, শোষক ও শোষিত এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। কিন্তু এই ভূখণ্ডের জাতিগুলির ভিতরে অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যের সাথে এই বর্ণভেদ জুড়ে থাকায় কোন জাতির ভিতরেই স্বতন্ত্র জাতীয়তার বোধ সেভাবে জমাট বাঁধেনি ইউরোপের জাতিগুলির মতোন। বার বার বৈদেশিক শক্তিগুলির কাছে পরাজিত হওয়া এবং শেষমেশ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বশ্যতা স্বীকার করে পরাধীনতা বরণের পিছনে এটি অন্যতম বড়ো কারণ। এবং এই বর্ণভেদ প্রথার কারণেই এই ভুখণ্ডে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিত সমাজ কোনদিনের জন্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় না। আবার ভারতীয় উপমহাদেশ এই কারণেই ধনতন্ত্র চর্চার পক্ষ সবচেয়ে আদর্শ স্থান। ফলে ব্রিটিশ থেকে শুরু করে কংগ্রেস ও বর্তমানে বিজেপি ও তার নিয়ন্ত্রক আরএসএস-এর স্বার্থ যে একই সূত্রে ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি চালিয়ে যাবে, সে আর বিচিত্র কি? ইতিহাস নিয়ে এই রাজনীতি চালিয়ে যাওয়ার ভিতরেই ব্রিটিশের হাতে গড়া ভারতবর্ষে ধনতন্ত্রের প্রাণভোমরা।

1 comment:

  1. Diparun Bhattacharyya21 October 2021 at 07:44

    ভালো লাগলো পড়ে

    ReplyDelete