0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



টোটো-কোম্পানি
আমার ভারতবর্ষ-৬


ললিতগিরি


একশো বছরের উপর হয়ে গেলো। ১৯০৫ সাল। জাজপুরের এসডিও চক্রবর্তীসাহেব বেরিয়েছিলেন জঙ্গলমহাল সরজমিন ঘুরে দেখতে। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে গভীর বনের মধ্যে কিছু ভাঙাচোরা পাথরের ভাস্কর্য। সঙ্গীদের কাছে জানতে চান এই জায়গাটার নাম কী? তারা বলে নালতিগিরি। ঘন গাছ-বনস্পতির আলোছায়ার মধ্যে দেখা যাচ্ছে উঁচুনিচু টিলা আর লালমাটির রং। জাজপুরে ফিরে এসে তিনি ব্যাপারটা একেওকে জানান। কিন্তু তা নিয়ে কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেননি। শেষে ১৯২৮ সালে ভারতীয় জাদুঘরের পণ্ডিত রমাপ্রসাদ চন্দ মশাই এখানে এসে নিদর্শনগুলি পরীক্ষা করেন। তার ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের দলিলে নালতিগিরি জায়গা পেয়ে যায়। ক্রমাগত খোঁজাখুঁজির সুবাদে ১৯৩৭ সালে সরকার স্থির করেন এই পুরাবশেষটিকে সংরক্ষিত তকমা দেওয়া দরকার। কিন্তু তার পরেও কোনও ব্যবস্থা হলো না। কেটে গেলো আরো চল্লিশ বছর। ১৯৭৭ সালে উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় আর পুরাতত্ত্ব বিভাগের আয়োজনে খোঁড়াখুঁড়ির কাজে কিছুমাত্রায় গতি দেখা গেলো। তাও যথেষ্ট নয়। অবশেষে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ মধ্যে পাওয়া নানা
নিদর্শন দেখে পণ্ডিতেরা বুঝতে পারলেন এই নালতিগিরিই প্রাচীন ইতিহাসে উল্লেখিত ললিতগিরি'র গরিমাময় বৌদ্ধবিহার। ললিতগিরি ছিলো প্রবাদপ্রতিম পুষ্পগিরি বিহারের একটা অংশ। পৃথিবীতে প্রাচীনতম বৌদ্ধসংস্কৃতির নিদর্শনগুলির মধ্যে একটি প্রধান পীঠ। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টিয় দশম শতক পর্যন্ত এখানে ছেদহীনভাবে বৌদ্ধসভ্যতার বৈজয়ন্তী উড়েছিলো। অনেকে বলেন ললিতগিরি উত্তর মৌর্যযুগ থেকে তেরো শতক পর্যন্ত পূর্বভারতে বৌদ্ধধর্মের নিরন্তর তীর্থভূমি হয়ে থেকেছে।


খননকাজের পর এখানে ছোটো পাহাড়ের চূড়ায় একটি বিশাল স্তূপ আত্মপ্রকাশ করে। এই স্তূপটির গভীর থেকে একটি খোণ্ডালাইট পাথরের বাক্স পাওয়া যায়। প্রথম বাক্সটির ভিতরে আরেকটি স্টিয়াটাইট পাথরের কৌটো। তার ভিতর প্রথমে রুপোর ও তারও ভিতরে একটি সোনার কৌটো। এই সোনার কৌটোর ভিতরে ছিলো শাক্যমুনি বুদ্ধের দেহাস্থি।




এই স্তূপটি ছাড়া আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরানিদর্শন রয়েছে ললিতগিরিতে। পূর্বমুখী উপবৃত্তাকার চৈত্যগৃহ। ৩৩X১১ মিটারের ইঁটের নির্মাণ। যার দেওয়ালগুলি ১১ ফিট চওড়া। এর কেন্দ্রে আছে একটি বৃত্তাকার স্তূপ। তার উপর কুশান ব্রাহ্মী লিপিতে খোদিত শিলালেখ। এটি এবং আনুষঙ্গিক পুরা নিদর্শনগুলি দেখে মনে করা হয় এগুলি পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে, অর্থাৎ গুপ্তযুগের নির্মাণ।


ললিতগিরি গড়ে উঠেছিলো বিভিন্নপর্বে তৈরি হওয়া চারটি বৌদ্ধবিহারকে কেন্দ্রে রেখে। প্রথম বিহারটি বৃহত্তম ও দশম-একাদশ শতক নাগাদ নির্মিত হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিহারটি পরবর্তীকালে, যখন বৌদ্ধধর্মের দিন ফুরিয়ে আসছিলো এদেশে। তৃতীয় ও চতুর্থ বিহারগুলি আগে পরে তৈরি হওয়া। এখানেই একটি নবম-দশম শতকের পোড়ামাটির সিলমোহর পাওয়া যায়। তার উপর উৎকীর্ণ ছিলো "শ্রী চন্দ্রাদিত্যবিহার সমগ্র আর্য ভিক্ষু সঙ্ঘস্য।" এই উল্লেখটি থেকেই ললিতগিরির পরিচয়টি পণ্ডিতেরা জানতে পারেন।

ওড়িশার বৌদ্ধ ঐতিহ্যের বহুকথিত স্বর্ণিম'ত্রিভুজের প্রাচীনতম বিন্দুটি এই ললিতগিরি। কটক থেকে পারাদিপের পথে জগৎসিংপুর জেলায় রাজপথ থেকে একটু ভিতরদিকে এই পুরাবশেষটি দেখতে পাওয়া যাবে। মূলস্রোত থেকে একটু দূরবর্তী হওয়ার জন্য রত্নগিরি বা উদয়গিরির মতো জনসমাগম এখানে দেখতে পাওয়া যায়না। কিন্তু ললিতগিরির গুরুত্ব অবিসম্বাদী এর প্রাচীনত্বের কারণে। এখানে মহাযানী সংস্কৃতির নানা পুরা নিদর্শন পাওয়া গেছে। সোনারুপোর অলংকার, শিলাপট্ট, নানা শিলমোহর ছাড়াও অবলোকিতেশ্বর, তারা, হারীতি, অমিতাভ, মহিষমর্দিনী, গণেশ, বুদ্ধ, বোধিসত্ব, জম্ভলা ইত্যাদি মূর্তি প্রধান। এইসব ভাস্কর্যে গান্ধার ও মথুরা শৈলির স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। শেষ পর্যায়ে এখানে বজ্রযানী তন্ত্রসাধনার কেন্দ্রও গড়ে উঠেছিলো।

মহাস্তূপের উপর থেকে নিচে তাকালে আদিগন্ত সবুজের সমারোহে উজ্জ্বল উৎকলের সমভূমি। রোমাঞ্চ লাগে, যখন ভাবি হাজার হাজার বছর আগে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ মনীষারা নিজেদের কর্মভূমি, তপোভূমি হিসেবে এই জায়গাটা বেছে নিয়েছিলেন। তাঁদের স্মরণ করাই আমাদের তর্পণ। আলোয় ছায়ায় নিরন্তর আসা যাওয়া। আমার ভারতবর্ষ।

0 comments: