2

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in






কত বছর জানি না, তবে অনেক দিন আগে এখানে একটা রাজবাড়ি ছিল। এখন শুধু তার দু-একটা পাঁচিল লতাপাতা গাছ-গাছালিতে জড়িয়ে অগোচরে পড়ে আছে। রাজবাড়ির বাগানে মাটি কোপানোর কাজ করত বিরজু আর রোজ ফুল তুলে গোছ করে রাজবাড়ির ঘরে ঘরে ফুলদানিতে রাখার জন্য ছিল বিনি। বিরজু আর বিনি। আঠারো আর ষোলো। কোদাল চালাবার সময় বিরজুর পেশীবহুল মেদহীন শরীরের ওঠানামা দেখে বিনির গা শিরশির করে উঠত। আর মাথা নিচু করে বিনির ফুলতোলা দেখে বিরজু উতলা হয়ে পড়ত। মানে পিরীত শুরু হয়ে গিয়েছিল আর কি। বিকেলের দিকে চুপিচুপি দুজনে বনের ভেতর একটা ফাঁকা জায়গায় বসে সোহাগ করত। বিরজু বলত—‘আমাকে বিয়ে করবি?’ বিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলত—‘কেন করব, তুই আমার জন্য কী করেছিস?’

বিনি একবার বলেছিল—‘বিরজু তুই এখানে আমার জন্য একটা পুকুর কেটে দিবি?’

বিরজু কোদাল নিয়ে লেগে পড়ল। মাসখানেকের ভেতর বেশ অনেকখানি মাটি খুঁড়ে ফেলল। তারপর এল বর্ষা। জলে ভরে গেল ডোবা। বিনির মনে হত এই বোধহয় সাগর। বিনি একদিন কোথা থেকে পলাশ গাছের চারা নিয়ে এলো। মাটিতে পুঁতে দিল। বিরজুর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বিনি বলেছিল—‘আমিও তোর জন্য একটা লালফুলের গাছ লাগিয়ে দিলাম।’

তারপর? সে আগেকার দিনে পিরীতের রাস্তা বড় পিছল আর ঘোরালো ছিল। কোথায় যে গেলো ওরা কেউ জানে না। তবে ফি-বছর বর্ষায় ডোবাটা বাড়তে বাড়তে পুকুরের মত হয়ে গেছে। পলাশ গাছটায় এখনও ফুল ফোটে অনেক।

আরও অনেকদিন কেটে গেল। ইংরেজরা কোথা থেকে এসে দেশ দখল করল। কত লড়াই হলো। লড়াইতে সুবিধে না করতে পেরে ওরা চলে গেল, তিন-রঙা পতাকা উড়ল। তারপর পাকা রাস্তা হলো। সে রাস্তায় হুসহুস করে মোটরগাড়ি আর ট্রাক চলে। ওদিকে পাঁচশো বিঘে জমির ওপর একটা কারখানা হয়েছে। কয়লা আর লাল পাথর দিয়ে লোহা বানায়। সেইখানেই ট্রাক থেকে বেলচা দিয়ে কয়লা নামানোর কাজ পেয়েছে ছেলেটা। আর মেয়েটা সেই কয়লার ঝুড়ি মাথায় নিয়ে মেশিন অবধি নিয়ে যায়। এরাও মোটামুটি আঠারো আর ষোলো। নাম জানি না, বিরজু আর বিনিই ধরে নেওয়া যাক। কাজের ফাঁকে এরা একে অন্যকে দেখে আর ভেতরে ভেতরে ছটফট করে। রাজা-রাজড়া, মন্ত্রী-আমলা বাড়িঘর রাস্তাঘাট সবকিছু পালটে গেলেও পিরীতির প্রথম ভাগ একই রকম আছে। এরাও লোকজনের থেকে দূরে জঙ্গলের ভেতর সেই পুকুর পাড়ে সেই গাছটার তলায় বসে এ ওর সঙ্গে ঢলাঢলি করে। সেদিন বিনি বলছিল—‘তুই আমাকে আজ অবধি কিচ্ছু দিস নি।’ বিরজু কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু চমকে উঠল। ওর কানে কানে কে যেন বলে উঠল—‘বল, এই পুকুরটাতো আমিই তোর জন্য কেটে রেখেছি। নিয়ে নে তুই…’ বিরজু হুবহু তাই বলে বসল।

শুনে বিনি খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। তবে হঠাৎ যেন চুপ করে গেল। ওর কানে কানেও একটা মেয়ে যেন বলে গেল—‘তুই বল, বিরজু তোকে আমি এই পলাশ গাছটা দিলাম। অনেক কষ্টে চারা খুঁজে এনে লাগিয়েছিলাম, দ্যাখ কত ফুল ধরেছে’ বিনিও তাই বলল, তবে ওর গা ছমছম করছিল। বিরজুর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল। দুজনেই তারপর চুপ করে রইল। আশেপাশে তো কেউ নেই, কথাটা তাদের মনের ভেতরে ঢুকে কে শুনিয়ে গেল? না কি তাদেরই মনের কথা কেউ হাওয়ায় ভেসে এসে মনে করিয়ে দিল?

কী হলো? গল্পটা বিশ্বাস হলো না তোমাদের? এক কাজ কর, ফাগুন-চত্তির মাসে হাইওয়ে থেকে নেমে কাঁচা রাস্তা ধরে খানিকটা চলে যেও। জায়গাটার নাম কী ডিহি যেন, ঠিক মনে পড়ছে না। ক্ষতি নেই, যে কোন জায়গায় গেলেই হবে। যেতে যেতে আসবে একটা পুকুর। কোন এক বিনি কিংবা বিরজুকে দেখবে কাছে পিঠে, সে আর একজনের অপেক্ষায় রয়েছে। হ্যাঁ, বিকেলের দিকে যেও। দেখবে চারিদিক শুনশান হয়ে আসছে, পুকুর পাড়ে একটা পলাশ গাছ বিস্তর ফুল ফুটিয়ে পুকুরের কালো জলে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। একটা দলছুট গরু হয়তো তোমার পাশ দিয়ে গাঁয়ের দিকে হেঁটে যাবে। ওকে যেতে দিও। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসবে। তুমি কিন্তু ওখানেই দাঁড়িয়ে থেকো। একদৃষ্টে চেয়ে থেকো পুকুর পাড়ের দিকে। তুমি টের পাবে সেই বহুকাল আগের বিরজু আর বিনি এখনো হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। এখনো তারা আজকের আঠারো আর ষোলো মানে এখনকার বিরজু-বিনিকে সেই চিরকালের কথাটুকু কানে কানে পৌঁছে দিয়ে যায়। জন্মজন্ম ধরে একই খেলা চলে আসছে। কত কী এলো গেলো, পিরীতির প্রথম ভাগ আজও মোটে পাল্টায়নি।

2 comments:

  1. পিরীত নিয়ে সুন্দর গল্প। ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. Khub misti ekta premer golpo,ekhon sei nirjan prantor harie gechhe ar birjurao nei khub nostalgic chalie jao

    ReplyDelete