0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়

শুভ বিজয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রকাশিত হলো ঋতবাক ষষ্ঠ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা।

আজ আশ্বিন মাসের শুক্লা একাদশী তিথি। বাঙ্গালীর সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর রেশ এখনও কাটেনি। এই লেখা যখন লিখছি, বাইরে ঢাকের আওয়াজ, প্রতিমা নিরঞ্জনের মিছিল। 

মনটা ভারী হয়ে ওঠে। না, মা চলে যাচ্ছেন, সেই আবেগে নয়। কেননা জানি, যাওয়া তো নয় যাওয়া! এ তো ফেরার আয়োজন! মন ভারী হয়ে ওঠে অন্য কারণে। বিষদেই বলি।

"দুর্গা পুজোয় জগজ্জননী বসুন্ধরা হয়ে ওঠেন বিশ্বরূপা, ভয়ঙ্করী আদ্যাশক্তি রূপান্তরিতা হন শুভঙ্করীতে। এই জীবন প্রতিমতা থেকে জন্ম নেয় তার প্রতিমা। মাতৃপূজা হয়ে ওঠে মুক্তির পূজা, মানুষের পূজা। গার্হস্থ্য গরিমায় তিনি দেখা দেন মানবীমূর্তিতে।" - শাস্ত্র ও সাহিত্যের কচকচানি।

কিন্তু বাঙ্গালীর আগমনী এবং বিজয়া তো মূলতঃ বাংলার মাতৃহূদয়ের গান। এক অর্থে, বাঙ্গালীর কন্যা-পূজা। কিন্তু বছরের বাকি দিনগুলোয়? 

মানি, বাঙ্গালী সচেতন হয়েছেন। কিন্তু যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন কি? এখনও মেয়ে জন্মালেই ইনভেষ্টমেন্ট স্কীম অ্যানালিসিসে বসে যান বিচক্ষণ অভিভাবক। "অঞ্জলীর মান্থলি স্কীমে ১২ মাস জমালে এক মাস ফ্রী"! ...সত্যিই কিন্তু এখনও অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙ্গালী পরিবারের এটাই অত্যন্ত পরিচিত একটা চিত্রপট। 

তবুও আশার কথা, দিন একটু একটু করে বদলাচ্ছে। সেদিন শুনলাম, এক মধ্যবিত্ত পিতা তাঁর একমাত্র কন্যাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার যা টাকা আছে, তাতে করে হয় তোমায় ম্যানেজমেন্ট পড়াতে পারি, নয়তো বিয়ে দিতে পারি; তুমি কি চাও? মেয়ে এখন বড়ো কম্পানীতে উচ্চপদে চাকরীরতা। 

কিন্তু মানতেই হবে, এখনও এই চিত্র বিক্ষিপ্ত, অপ্রতুল, দুর্লভ। আসলে আমাদের কন্যা-পূজা সেই দিনই সার্থক হবে, কোনও পিতার জিজ্ঞাসার অপেক্ষা না রেখে যেদিন বিয়ে দেওয়া নয়, কন্যাকে স্বাবলম্বী করে তোলাটাই সমাজের নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে আর 'কন্যাদায়গ্রস্ত' শব্দবন্ধটি অভিধান থেকে অপ্রতুল ব্যবহারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন, সৃষ্টিতে থাকুন...

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


“তুমি এলে শুভঙ্করি! বাড়ে আরও দায়...” 
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী 

একশো দেড় শো বছর আগে এই বাংলাদেশে একটি চল ছিল, শারদীয় দুর্গাপূজাকে বিষয়বস্তু করে গদ্যে-পদ্যে নানাবিধ রচনা প্রকাশিত হত। কখনও এগুলোতে থাকত ব্যঙ্গ, কখনো বা নির্মল হাস্যরস। কখনও এ সব রচনা দুর্গোৎসবের সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হত, কখনও বা লেখকেরা এ গুলি স্বতন্ত্র পুস্তিকা হিসেবে ছাপিয়ে বিলি করতেন। পূজাবিষয়ক সাহিত্যের এই ধারা এখন লুপ্তপ্রায়।

হুতোম পেঁচা, শ্রী দশ অবতার,বা টেকচাঁদ ঠাকুর প্রমুখের রচিত নকশাগুলির কথা বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত, এ গুলিতে আঁকা সমকালের দুর্গাপূজার ছবির কথাও আমরা কম বেশি জানি। দুর্গাপূজার সামাজিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও প্রভাব, এই পূজার সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা এ সব নকশায় অত্যন্ত জীবন্তভাবে চিত্রিত হয়েছে, বারোয়ারি পূজার উদ্যোক্তা, পুরোহিত, এমন কি, গাঁটকাটা চোর পর্যন্ত হুতোমের মনোযোগ থেকে বঞ্চিত হয়নি! বহুস্তরীয় সমাজব্যবস্থার এমন মিনিয়েচার-রূপায়ন বাংলা সাহিত্যে খুব কমই দেখা যায়।

পূজাবিষয়ক সাহিত্যে সমাজচিত্র প্রসঙ্গে এই নকশাগুলির পরেই উল্লেখযোগ্য ঈশ্বর গুপ্তের কিছু কবিতা যাতে পূজোর নানা টুকরো ছবি পাওয়া যায়। রসরাজ অমৃতলাল বসুও অনেক পূজাবিষয়ক কবিতা লিখেছেনঃ- ‘বৈজ্ঞানিক দুর্গোৎসব’, ‘বিলাতে দুর্গাপূজা’, ‘কেরানীর আগমনীগীতি‘ , ‘বিজয়া দশমী’, ‘পূজার আবদার’ ইত্যাদি। ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘দুর্গোৎসব উদ্ভট কাব্য’ (১২৯০), আর ‘শারদীয় সাহিত্য’ (১৩০৩) পুস্তিকা দু’টিও জনপ্রিয় হয়। এ ছাড়াও নানা অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রাম্য কবিও পূজার সময় কবিতা ও ছড়ার সংকলন বের করতেন।

‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকাটি ১৮৭৩ সালে ‘ছুটির সুলভ’ নামে শারদ সংখ্যা প্রকাশ করে [১২৮০ বঙ্গাব্দ]। দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা ‘উনবিংশ শতাব্দীর দুর্গোৎসব’ শিরোনামে কিছু কবিতা ও কাহিনী আর ‘উন্মাদিনী আগমনী’ নামে একটি রম্যরচনা প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রিকায় কার্টুন ছাড়াও প্রতিবার দুর্গাপূজার সময় পূজাকেন্দ্রিক রঙ্গব্যঙ্গ,গান, নকশা ইত্যাদিও প্রকাশিত হত। মনোমোহন বসু সম্পাদিত ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকায় ‘কোঁড়ল’-কৃত পাঁচালিও এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য। মাসিকপত্র ‘মালঞ্চে’র আশ্বিন,১৩২১ সংখ্যায় বেরিয়েছিল সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের নকশা ‘পূজার ফলাফল’। ব্যঙ্গচিত্রভিত্তিক সুপরিচিত পত্রিকা ‘বসন্তক’ এর পূজাবিষয়ক রচনা ও ছবিগুলিতেও পাওয়া যেত সামাজিক সমস্যার নানা উপাদান। সম্ভবত এই পত্রিকাতে ১৮৭৩-৭৪ সাল নাগাদ প্রকাশিত ‘স্পেশাল রিপোর্টারের হিমালয় হইতে প্রেরিত চিত্র’ নামক বিশাল ব্যঙ্গচিত্রটিই বাঙলা পত্রিকায় দুর্গা বিষয়ক প্রথম কার্টুন। এ জাতীয় নকশা বা হরপার্বতী সংবাদই বোধ হয় পূজা-সাহিত্যের একমাত্র ধারা, যা ক্ষীণভাবে হলেও এখনকার বাংলা সাহিত্যে কিছু পরিমাণে টিঁকে আছে।

‘পূজার গল্প’ লেখারও চল ছিল এক সময়। ১৩৭০ সনে অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী বের করেন ‘পূজার গল্প’।এই সংকলনে ছিল চারটি গল্পঃ- ‘সদানন্দের সন্ধিপূজা’, ‘মনে মনে মায়ের পূজা’, ‘মুখুজ্জেমশাই’ আর ‘তারাসুন্দরী’। বলা বাহুল্য, এই তালিকা সম্পূর্ণ নয়, আমরা কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করেছি। ক্ষেত্রনাথ ঘোষ নামে এক ছাত্র ‘সুখের শরৎ/ দুর্গোৎসব’ নাম দিয়ে একটি চটি বই প্রকাশ করেন, যাতে হরপার্বতীর কথোপকথন নাটকের ধাঁচে লেখা হয়, এর একটি দ্বিতীয় পর্বও বের হয়েছিল, যার নাম ‘হিমাচলে মা’র আগমন’।

বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে পূজা সাহিত্যের এই বিশেষ ধারাটিতে ভাঁটা পড়ে যায়। ষাটের দশকেও অবশ্য প্রবুদ্ধ রচিত ‘হরপার্বতী সংবাদ’, কমলাকান্ত শর্মা ছদ্মনামে প্রমথনাথ বিশীর কবিতা ইত্যাদি চোখে পড়ত। আরো পরে ক্ষীয়মান এই ধারাটিতে গৌড়ানন্দ কবি [গৌরকিশোর ঘোষ], সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ মাঝে মাঝে কলম ধরেছেন। চিরকালের সেই শিব-পার্বতীর ঘরকন্না ও কথাবার্তা নিয়েই তাঁরা নাটক-নকশা রচনা করেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমকালীন চেহারা আর মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক ভাবনার সেই চিরন্তন ছবিই এসব আধুনিক পূজা-সাহিত্যে ফুটে উঠেছে। 

মধ্যবিত্ত বাঙালির পূজোর সময়কার নানা অনুভূতির অন্যতম অবশ্যই ছুটির আনন্দ। অখিলচন্দ্র লহিড়ির ‘পূজার পাগল’ সংকলনটির ‘মা’ শীর্ষক কবিতাটিতে দেখা যাচ্ছে, প্রবাসী ছেলের পূজোর ছুটিতে বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করছেন বিরহকাতরা মাঃ- “ শরতের বিধু আধ-হাসি ছড়ায় গগনে/ জাগাইছে মনে পুত্রে মোর প্রবাস-ভবনে/ কবে আসিবে সেদিন, মিলিবে যেদিন, / কোলের মাণিক কোলে পুনরায়।/ দেখিনি আজ ক’টি মাস হায়। ...“ শুধু ছাত্রেরাই নয়, চাকুরেরাও দিন গোনেন পূজোর ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য। ‘বসন্তক’ পত্রিকার এক নকশায় কেরানীদের অধীরতার সে ছবির কিছুটাঃ- “ক্রমে পূজা নিকট, জলের মত সময় কেটে যাচ্ছে ,চতুর্থী এসে পড়লো। চাকরে বিদেশী কেরানীরা আজ ছূটি পাবেন, কিন্তু ছুটি আর হয় না, বাতি জ্বেলেও কাজ হচ্ছে, করেন কি/ বিকারী রোগীরা শয্যাকন্টকীতে যেরূপ ছটফট করে সেইরূপ ছটফট কচ্চেন! কি সর্বনাশ, আজ হলো চতুর্থী, এখন শাটী, মিশি, মাথাঘষা,চুলবাঁধা, জরি খরিদ, হয়নি; করেন কি, চারা নাই।….” বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, বাঙালির পূজা-সংশ্লিষ্ট সব ভাবনার সঙ্গেই চিরকাল অনিবার্যভাবে জড়িয়ে থাকে এর আর্থিক অনুষঙ্গটি। তাই কেরানীবাবুরা “আপিস থেকে বেরিয়ে আগুন খাকির মত গে বাজারে পড়লেন। ঠাকরুনের তস্মিসাটি হ’ক না হ’ক, গিন্নির ঢাকাই গুলবাহার, চিনের সিঁদুর, বেলেওয়ারী চুড়ি, ম্যাকেসার অয়েল, কিনতেই ব্যতিব্যস্ত হলে, ক্রমে রাত দুই প্রহর পর্যন্ত লাঠিমের মত ঘুরে ঘুরে বাজার কোরে বাসায় গে বুচকী বাচকা বাঁধতে লাগলেন। আজ আর চক্ষে ঘুম নাই।……”[বসন্তক, ১ম খণ্ড, ১২৮০-৮১]

দুর্গোৎসবের আগে বাঙালির এই কেনাকাটার হুজুগের পেছনে সব সময়ই যে কোন একটা নিরুপায় দায় থাকে তা কিন্তু নয়, পূজো উপলক্ষে প্রিয়জনকে সাজাবার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষাও সমান সত্যি। ‘বসন্তক-এর দুর্গোৎসব’ শীর্ষক এক কবিতায় এক গরিব ব্রাহ্মণের অক্ষম অভিলাষের ছবির কিছুটাঃ- “প্রাণের প্রিয়ারে আর নানা আভরণে/ সাজাতে বড়ই সাধ হয় মোর মনে। / বারণসী সাঁচ্চা শাড়ী পরাইয়ে আর/ দেখি রূপ অপরূপ আঁখি ভরি তার।।/ এইরূপ মনোহর বেশভুষা করি/ বরণ করিবে দুর্গা আমার সুন্দরী।“ হতভাগ্যের এই রকম আরও কত সাধ ছিল, বাড়িতে দুর্গোৎসবের আয়োজন করে রাজারাজড়ার মতো গড়ের বাদ্যি আনার ও গ্যাসের ঝাড় লন্ঠন জ্বালাবার , কিন্তু – “পিতলের বালা যার ঘটেনা কপালে/ তার কি এমন সাজ ঘটে কোন কালে!/ কেন রে এমন অসম্ভব সাধ তার।/ গরিব ব্রাহ্মণ ভিক্ষা উপজীব্য যার।“[বসন্তক, ২য় খণ্ড, ১২৮১-৮২]

পূজোর কেনাকাটার হুজুগে মধ্যবিত্ত বাঙালির অর্থকৃচ্ছতাকে কেন্দ্র করেই তার যত সমস্যা। বঙ্গবাসীর অসীম ক্ষুধা, তার দারিদ্র্যের জ্বালা ইত্যাদি মনে রেখে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দুর্গোৎসব’ নামে এক কবিতায় লেখেন, “এনেছ মা বিঘ্নহরে কিসের কারণে?/ বিঘ্নময় এ বাঙ্গালা আছে কি তা মনে?/ এনেছ মা শক্তিধরে, দেখি কত শক্তি ধরে/ মেরেছ মা বারে বারে দুষ্টাসুরগণে,/ মেরেছ মা তারকাসুর/ আজ বঙ্গ ক্ষুধাতুর/ মার দেখি ক্ষুধাসুর সমাজের রণে?...।“ এর পরে বঙ্কিম যা লিখেছিলেন, তা থেকে বোঝা যায়, তিনি বাঙালির সমস্যার সারকথাটি ঠিকই বুঝেছিলেনঃ- “ হাহাকার বঙ্গদেশে টাকার জ্বালায়।/ তুমি এলে শুভঙ্করি! বাড়ে আরও দায়।/ কেন এসো, কেন যাও/ কেন চালকলা খাও/ তোমার প্রসাদে যদি টাকা না কুলায়।/ তুমি ধর্ম, তুমি অর্থ , তার বুঝি এই অর্থ,/ তুমি মা টাকারূপিনী ধরম টাকায়।/ টাকা কাম টাকা মোক্ষ,/ রক্ষ মাতঃ রক্ষ রক্ষ/ টাকা দাও লক্ষ লক্ষ নৈলে প্রাণ যায়। ......” [ গদ্য পদ্য বা কবিতা পুস্তক, ১৮৭৮]

চাকুরিজীবী বাঙালির দৈনন্দিন যন্ত্রণার ছবি পাওয়া যায় ‘পূজার পাগল’-এর ‘চাকরে’ নামের এক কবিতায়। এতে পূজোয় সংসারের নানা রকমের খরচের এক বিশাল ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে। রজক, পাচক, পরামাণিক, গোয়ালিনী, পিওন, খানসামা – সবার দাবি তো আছেই, তার পরেঃ- “ছেলেপিলেদের পোষাক, ধূতি, জামা,/ উলকাঁটা, বডি, জ্যাকেট, বিনামা”, যা কিনা “পরে হবে বলে রেখে দিলে পরে,/ বাজার উঠে যাবে চড়ে।“ এ ছাড়া – “দিদিমা পিসিমা জেঠাইমা, মাসীমা;/ কার যে কত চাই নাইক তার সীমা,/ বার তের খানা নামাবলী, আর/ ডজন দুই তিন মালাই।“ কিন্তু এসবেরও ওপরে – “গত সপ্তাহে গিন্নির এক পত্রে/ লেখা ছিল প্রায় পঞ্চাশটি ছত্রে/ সাজ সরঞ্জাম এটা ওটা সেটার মস্ত একখান লিস্টি…।“ সবশেষে গৃহস্থের হাহাকারটুকুও লক্ষ করার মতোঃ- “হায়রে প্রবাস, হায়রে গোলামী,/আনন্দময়ি মা! আর নিরানন্দে/ রেখনা প্রাণ যে যায়।“ 

শুধু নিজের স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের জন্য পূজোয় কেনাকাটা করলেই বাঙালি গৃহস্থের সমস্যা শেষ হয়না, কারণ তার অন্যান্য সামাজিকতা –লৌকিকতাগুলোও পূজো-কেন্দ্রিক। সারা বছরের জমানো সমস্যাগুলোও যে পূজোর মরশুমের বোঝার ওপরেই চেপে বসে, তা বোঝা যায় ‘পূজার পাগল’ সংকলনটিতে ‘কর্তা ও গিন্নি’ কবিতাটিতে নানারকম সাংসারিক দাবির দীর্ঘ তালিকা থেকে। এখানে দেখা যায় কর্তা গিন্নিকে বলছেন, “ ওগো যতই করনা ভর্ৎসনা,/ এবার বুঝি হয়না মায়ের অর্চনা!/ আদায়পত্র শূন্যি আমার,/ পুণ্যি থাকুক মাথায়,/ কন্যাটি হলেন চতুর্দশ পার/ কুল মান রাখা দায়।...“ ইত্যাদি। গৃহস্থের নানা আর্থিক দায়িত্বের এই তালিকায় আছে ছেলের কলেজের ও পরীক্ষার ‘ফিস্‌’, কাশীবাসী শাশুড়ির মাসোহারা, গৃহিনীর গহনার ও বাড়ির দুর্গাপ্রতিমার ডাকের সাজ,, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লৌকিকতা ইত্যাদি। এ-প্রসঙ্গে গিন্নির মন্তব্যঃ- “হয়েছই যখন সংসারী/ তখন দিলে ত চলে না ফাঁকি।“

পূজোর সময় মধ্যবিত্তের বাড়তি খরচ সামলাতে বোনাসের ব্যবস্থা যে হাল আমলের জিনিস, এমনটা মনে করার কারণ নেই। এর আগে উল্লিখিত উনিশ শতকের ‘বসন্তক’ পত্রিকার সেই ‘দুর্গোৎসব’ নকশাটিতেও আমরা কেরানীবাবুদের পরিচিত বোনাসকে পাই অন্য চেহারায়ঃ- “...অনেক কষ্টের পর রাত ৭।।০ র সময় আপিসের বড় সাহেব মাহিনা বাঁটতে লাগলেন ও সঙ্গে প্রণাম দিতে লাগলেন।আহা এখন আর কেরানী ভায়াদেরে মুখে হাসি ধরেনা, সম্বৎসরের ইস্টুপিড, ড্যাম, রাস্কেল, এন্ড মি এন্ড সি, ঘুষো লাথি সব ভুলে গেলেন; দুহাত তুলে হুজুরের জয় বলে বগল বাজায়ে আপিস থেকে বেরিয়ে আগুনখাকির মত গে বাজারে পড়লেন।“ এর পাশাপাশি রাখা যায় অপেক্ষাকৃত হাল আমলের একটি নকশায় দেবী দুর্গার স্বীকারোক্তিঃ- “নন্দীভৃঙ্গী বোনাসের লাগি লাগি করে সদা উস্খুস।“[‘হরপার্বতী সংবাদ’ / প্রবুদ্ধ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭-১০-১৯৬৩]

পুজোর মরশুমে এমনিতেই মধ্যবিত্তের ওপর আর্থিক ধাক্কাটা একটু বেশিই হয়, তার ওপর বিশেষ কোনও সমকালীন ঘটনার ফলে যদি অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তা হলে তো কথাই নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ও বাংলাব্যাপী খাদ্যাভাব ও অনটনের আঁচ পাওয়া যায় শশীভূষণ দাসের ‘এস মা জননী (আগমনী)’ নামক এক কবিতা-সংকলনেঃ - “এস মা জননী দুর্গতিনাশিনী নেহার দুর্গতি আজ/ ধ্বংসের বাজনা বাজিছে ভারতে মাথায় পড়িছে বাজ।/ খাদ্যশস্যের অভাব হয়েছে, পরনে বসন নাই,/ রোগের ওষুধ মেলেনা কাহারো পথ্য খুঁজে না পাই,/…সংবাদ আসিল এবার পূজায় লুচির ফলার নাই,/ পুঁই চচ্চড়ি, মানকচু পোড়া ভাতে খেতে হবে ভাই!” এই কবিতা মনে পড়িয়ে দেয় পঞ্চাশ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় মোহিতলাল মজুমদারও লিখেছিলেন -- “মাতৃশক্তিপূজা নয়,মাতৃশ্রাদ্ধ দিন / বাৎসরিক – দায়গ্রস্ত পুত্র দীনহীন / করিয়াছে কোনোমতে তার উদ্‌যাপন / আজি তার বর্ষকৃত্য প্রেতের তর্পণ!’’ আবার‘বিজয়চন্ডী’ কবিতায় যতীন্দ্রমোহন বাগচি লিখেছিলেন, অন্নবস্ত্রহীন দেশে ভীরু ও শঙ্কিত প্রাণের পূজা দেবী গ্রহণ করেন না -- “দুর্বল দেহ, দুর্বল প্রাণ – আনন্দহীন ভীরুর দলে -/ মৃন্ময়ী মাতা চিন্ময়ী হন কোন্‌ কল্পনাশক্তিবলে?/ বিরাট বিশ্বমাতারে বরিয়া কেমনে সে মূঢ় বাঁধিবে কাছে, / বক্ষের নীচে শূন্য জঠর হাঁ করিয়া যার পড়িয়া আছে।” স্বদেশ-সমকালের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ উৎসবের সময় ভুলে থাকা স্বাভাবিকভাবেই এই কবিদের কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এই দারিদ্র্যের কারণেই আগমনীর সানাই শুনে কাজী নজরুলের মনে হয়েছে -- “ও যেন কাঁদিছে শুধু, নাই, কিছু নাই!”

“তুমি এলে শুভঙ্করি! বাড়ে যত দায়’- এই কথা বলে দুর্গার বাৎসরিক আরাধনাকে কেন্দ্র করে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে ঘনিয়ে আসা যেসব দায় বা দায়িত্বের কথা বঙ্কিম বোঝাতে চেয়েছিলেন, তার মধ্যে পরিবার-পরিজনের জন্য নতুন জামাকাপড় ইত্যাদি কেনার দায়ের পড়েই আসে বারোয়ারি পূজোগুলোর চাঁদার উৎপাতের সম্মুখীন হবার দায়। এই চাঁদার দাবি নিয়ে যারা প্রতি বছর গৃহস্থের দ্বারে হাজির হয়, তাদের বক্তব্য দেখা যাচ্ছে গত শতকের ষাটের দশকে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘কমলাকান্তের আসর’ কলমে “পূজার চাঁদার হিসাব’ নামে একটি কবিতায়ঃ- “ এবার টাকার টানাটানি/ মাছ তেলে সব ফুরোয়,/ বাঁধা দামের মধুর মিথ্যা,/ তবুও কান জুড়োয়!....” এই রচনাটিতে একটি সার্বজনীন দুর্গাপূজার আর্থিক দায়দায়িত্বের যে-ফিরিস্তি রয়েছে সেটি দেখা যেতে পারেঃ- “......দাদা,/ এবার পূজোয় নমো নমো/ সবই আধামাধা।/ পুরুত ধরুন আড়াই টাকা/ চালকলা দশ আনা,/ হাফ রেশনে খাবেন মাতা,/ বুঝুন মজাখানা!/ আলোকসজ্জা আড়াই হাজার ,/ মন্ডপে পাঁচ হাজার,/ বাদ্যভান্ডে হাজার খানেক,/ বেজায় মাগ্‌গী বাজার।/ নৃত্যগীতের অনুষ্ঠানে/বাজেট এবার কম,/হাজার দশেক, তার বেশি নয়,/ ফুরিয়ে গেল দম।....” তাই চাঁদাপ্রার্থীর আবেদনঃ- “কাজেই পূজো নমো নমো,/ দেখতে পাচ্ছেন শাদা/ গতবারের চেয়ে বেশি/ দেবেন এবার চাঁদা।“ সবশেষে তার দার্শনিক উপলব্ধিঃ-- “দাদা;/ চাঁদার হিসাব কেউ দিয়েছে? যে দেয় নেহাত গাধা।/ মায়ের টাকা ছেলেয় খাবে, আর খাবে ভক্তগণ/ প্রাচ্য দেশের এই তো রীতি নিয়ম চিরন্তন।“ 

প্রবুদ্ধ রচিত ‘হর-পার্বতী সংবাদে’রও শুরুতেই দেখা যায় ‘১৮৮৫ শকে’র [অর্থাৎ ১৩৭০ বঙ্গাব্দ] বঙ্গভূমির এই বর্ণনাঃ- “সমাগত শারদীয়া; আকাশে-বাতাসে/ বাজারে-অফিসে, আর গৃহস্থের ঘরে/ লবণ আনিতে পান্তা ফুরোবার ধূম।/ চাল মহামূল্য।– তবু চাল মারিবার/ বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই; দোকানেতে ভীড়।/ সাজের বহর, আর পকেটে ও পেটে/ লক্ষ্মীপূজা পর হতে ডন মারিবারে/ ছুছুন্দরীকুল তৈরী। যুগের হুজুগে/ মত্ত সবে, কেবা আজ কার কথা শোনে!...“ এতে দেখা যায় শিব পার্বতীকে বলছেন, “ কিন্তু দেবি! বঙ্গবাসী দুর্দশায় ভোগে।/ ঘরে চাল-চুলো নাই, দেখেও এসেছ/ এই তো সেদিন। কিবা আশীর্বাদ দেবে/ পূজা শেষে সন্তানেরে, বিরস বদন?/ ....কোন্‌ সে উপায়ে/ অগণিত ভক্তের দুঃখ হবে দূর?” এর উত্তরে দেবী দুর্গা বলেন, “দুর্গা মোর নাম, দুর্গতিমোচন চেষ্টা অবশ্য-কর্তব্য মোর। চাল দিতে নাহি পারি,/ আশ্বাস তো আছে। ....তাই নাথ,চল যাই/ আশার ললিত বাণী শুনাইয়া আসি,/ অতঃপর ভবিষ্যৎ জানা সবাকার,/ খন্ডাইতে পারে কেবা ললাট লিখন।“ [আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭-১০-১৯৬৩] 

এই পত্রিকাতেই পরের বছর একই লেখকের ‘হর-পার্বতী সংবাদ ১৩৭১’ রম্যরচনাটিতে দেখা যাচ্ছে দুর্গোৎসবে দেবী দুর্গার সন্তানদের বঙ্গদেশে যেতে ঘোর অনীহা! এই সূত্রে গণেশ মা দুর্গাকে যা বলেন, তাতে ফুটে উঠেছে সমকালের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও কালোবাজারীর সমস্যার ছবিঃ- “...মন্ডপেতে দর্শকের মন্তব্য কি পাওনা শুনিতে?/ কেউ বলে,’পেট মোটা ঐ ব্যাটা গণেশের তরে/ আমরা অভুক্ত আছি।‘ আমি নাকি ‘বেলাকের’ চাঁই/ মাছ ও সরিষা নিয়ে ম্যাজিক দেখাই।....“ এরই সমসাময়িক কালে আনন্দবাজার পত্রিকায় কলকাতার এক বস্ত্রবিপণির কবিতায় লেখা এক সচিত্র বিজ্ঞাপনে পূজো উপলক্ষে গৃহিনীর কেনাকাটার ঠেলায় পতিদেবতার চিন্তা ভাবনার কিছু নমুনাঃ- “কোন্‌ দোকানের ছোট জামা কিনে,/ গিন্নি বলেন, এটাই লেটেস্ট ফ্যাশন্‌/ কর্তা ভাবেন চোখ কপালে তুলে,/ এই টাকাতে দু’দিন হ’ত র‍্যাশন্‌!/ যেমনি মা তার তেমনি ছেলে মেয়ে,/ হাল ফ্যাশনের কিন্‌ছে পোষাক কত।/ সে সব দেখে হাত পা সেঁধোয় পেটে, / গৃহস্বামীর নাড়ী ছাড়ার মত।।“ [‘শারদীয় ফ্যাশন্‌ রঙ্গ’] 

সমাজে সমস্যা থাকলে তার সমাধানের বা মোকাবিলা করার দায়ও থেকে যায় ও দুর্গোৎসবের মতো বিরাট সামাজিক উৎসবকে কেন্দ্র করে তা যেন আরও প্রকট মূর্তি নিয়ে দেখা দেয়। বাঙালির সব যুগের পূজা-কেন্দ্রিক সাহিত্যে তাই সমকালের পরিস্থিতির ও সমাজ-সমস্যার নির্ভুল প্রতিফলন দেখা যায়। ‘বসন্তক-এর দুর্গোৎসব’ নামে যে কবিতাটির [১৮৮৮-৮৯] কথা আমরা উল্লেখ করেছি, তাতে গরিব ব্রাহ্মণটি যেসব অভিলাষ ব্যক্ত করেছে, তার সবই নিছক অক্ষমের ইচ্ছাপূরণ নয়, তার মধ্যে সে-সময়ের নানা সামাজিক অভ্যাস, প্রথা ও প্রবণতার প্রতি শ্লেষও আছে। এর কয়েকটিঃ- বিলিতি সাজে দেবীপ্রতিমার অলঙ্করণ, বন্ধুদের নিয়ে মজলিশ, বাই-নাচ, খেমটা নাচ, ‘মদের সদাব্রত’, হোটেল থেকে বাড়িতে খানা এনে খাওয়া, বৈঠকখানায় ‘বেশ্যা আনা’, বাড়ির দুর্গাপূজায় ‘লালমুখো সাহেব বিবি’দের আমন্ত্রণ করে আনা,ইংরেজের পদলেহন, বাঙালির নিন্দা ও খেতাবের জন্য মোসাহেবি ইত্যাদি ইত্যাদি। এরই পাশে রেখে দেখা যায় ১৯৮৪ সালের সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘হর-পার্বতী সংবাদ ১৩৯১’ নকশাটি থেকে শিবের এই সংলাপঃ- “ভুলে যেওনা গিন্নি, দেশের নাম পশ্চিমবাংলা।...এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ/ তবু রঙ্গে ভরা। সব হবে। সব এক মঞ্চে পাশাপাশি হবে। পাতাল রেল, চক্র রেল, বাহাত্তর ইঞ্চি পাইপ, দাবি-মিছিল, ধর্ম-মিছিল, বিয়ের মিছিল, ফুটবল, বাস্কেটবল, হকি, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, যাত্রা উৎসব, বাঙলাবন্ধ, বোম ছোরাছুরি, ভোট, ব্যালে নাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, বন্যা, খরা, বনমহোৎসব, বননিধন, সব পাশাপাশি চলবে। ...তুমি কিস্যু ভেব না। [আনন্দবাজার পূজা ক্রোড়পত্রিকা, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪] 

আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘গৌড়ানন্দ কবি’ রচিত একটি কৌতুক নকশায় গত শতকের ষাট-সত্তর দশকের কিছু পরিচিত শব্দ ও নাগরিক সমস্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন – উগ্রপন্থী, হিপি, ও সর্বদলীয় সমন্বয় সমিতি ইত্যাদি। এটিতে দেখা যাচ্ছে, পুত্রকন্যাসহ দুর্গা পশ্চিমবঙ্গে আসার পরে হাওড়া ব্রিজে ট্রাফিক জ্যামে আটকে যান। ফলে মন্ডপে পৌঁছতে দেরি হওয়ায় সর্বদলীয় কোঅর্ডিনেশন কমিটির সদস্যেরা বাড়ি ফিরে যান। মণ্ডপে পুলিশ এসে উগ্রপন্থী সন্দেহে কার্তিককে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের পক্ষে ‘অকাট্য প্রমাণ’ হল - “ধৃত ব্যক্তি কবুল করিয়াছে যে, তাহার বয়স একুশ এবং তীর ধনুকও তাহার, তাহাও সে স্বীকার করিয়াছে। অতএব উহাকে বিভিন্ন স্থানে জোতদার হত্যার আসামী হিসাবে অনায়াসে চালান দেওয়া যাইবে।“ [‘হিং টিং ছট’] 

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের পূর্বোক্ত ‘হরপার্বতী সংবাদ ১৩৯১’ রচনাটিতে দুর্গাপূজা ও বঙ্গজীবন নিয়ে শিবের নানারকম ভুয়োদর্শন পাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে বাঙালির দৈনন্দিন অভাব আর অনটনের প্রসঙ্গঃ- “ ...সার্বজনীন অনেকটা টিউমারের মতো, আবের মতো। বেড়েই চলে। ... বাঙালীর জীবনে আর কী আছে বল। চাকরি নেই, বাকরি নেই, জল নেই, আলো নেই, খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই, সুখ নেই, নিরাপত্তা নেই, শিল্প নেই, সংস্কৃতি নেই। থাকার মধ্যে এই পুজোটুকু আছে। “ আবার পূজোর সময় গতবছর মশার কামড় খেতে হয়েছে, দুর্গার এই অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁকে শিবের উপদেশঃ- “ এবার প্যান্ডেলে সিংহের পিঠে উঠে পোজ দেবার আগে বড়বাজার থেকে বেশ বড় সাইজের একটা নাইলনের মশারি কিনে নিও। ম্যালেরিয়া, ফ্লু আর ডেঙ্গু একসঙ্গে ধরলে ধন্বন্তরীর বাবার ক্ষমতা নেই সারায়।“ এই বিবরণ যেন মনে করিয়ে দেয় এর একশো বছে আগে লেখা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিঘ্নময় এ বাঙ্গালা’ শব্দবন্ধটি।

পশ্চিম বাঙলা বা বাঙালি যতই আর্থিক অস্বাস্থ্যে ভুগুক, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যে সাময়িক ভাবে হলেও বাঙালির অর্থনীতিতে, বাণিজ্যে চাঙ্গাভাব আসে, সেই সত্যটিও শিবই জানান দুর্গাকেঃ- “......তুমি তো ক্যাপিটাল গো, মূলধন। তোমাকে পেছনে রেখে পুজো, পুজোকমিটি। বাইশের পল্লী, তেইশের পল্লী। বিল বই, চাঁদা। প্রিপূজা সেল, পূজা সেল, একজিবিশান, ফাংশান। পটুয়াপাড়ায় তুমি হাফ-ফিনিশ হয়ে এসেছ। দোমেটের কাজ শেষ হয়ে এসেছে। তোমার ছাঁচে ঢালা মুন্ডু সার সার তাকে তোলা আছে। ঠ্যাঙে বায়নার টিকিট ঝুলছে। গেরস্থেরা মার্কেটিং-এ নেমে পড়েছে। শ্যামবাজার থেকে গড়িয়া গুঁতোগুঁতি শুরু হয়ে গেছে।“ [আনন্দবাজার পূজা ক্রোড়পত্রিকা, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪] আজ থেকে তিন দশক আগের এই বর্ণনাটি পড়লে মনে হয় আমরা যেন হুতোমের নকশায় বা ‘বসন্তক’ পত্রিকার কোনও রম্য রচনায় বঙ্গজীবনে দুর্গোৎসবের ছবি দেখছি। বোঝা যায় যে, গত তিনশো বছরে রাজনীতি, অর্থনীতি আর সমাজনীতি অনেক বদলে গেলেও নিজেদের জীবনে সবরকম দায়দুর্গতিকে মেনে নিয়েই বাঙালির ‘শুভঙ্করী’ দুর্গাকে আবাহন করে নেবার সেই কৌতুকস্নিগ্ধ মেজাজটি আজও হারিয়ে যায়নি।

                     




2 comments:

0

প্রবন্ধ - নিলয় কুমার সরকার

Posted in


প্রবন্ধ


আউল বাউলের গানে ভাসে বেদান্তের অন্তর্নাদ?
নিলয় কুমার সরকার 


মানুষের তিনটে প্রধান মৌলিক বৃত্তি আছেl এরা হলো বুদ্ধিবৃত্তি, কর্মবৃত্তি, আর হৃদয়বৃত্তিl তাদের মিলিত প্রভাবে মানুষের ঈশ্বর সম্পর্কিত চিন্তা আর ধর্মীয় আচরণ গড়ে ওঠেl সকল ধর্ম সাধনার মূলেই রয়েছে মানুষের সেই শাশ্বত সত্ত্বার আপন মূল্যবোধl এই ধর্মবোধ মানুষের মনের মধ্যে একটা মৌলিকবোধ.হিসেবেই গাঁথা হয়ে আছেl শিল্পবোধের মতই তা হলো মানুষের মনের এক স্বতস্ফুর্ত উপাদানl এই বোধই পৃথিবীর নানা দেশে নানান প্রচলিত লোকধর্মের উতপত্তির মূলেl এই ধর্ম বোধই হয় সাধকের নিজের সাধনপথে চলবার একান্ত প্রেরণা সুতরাং লোকবৃত্তের অন্তরালে ধর্ম সম্পর্কিত ভাবনার প্রবাহকে খুঁজে পেতে মন কে প্রস্তুত করতে হবেl এই ধর্মবোধ কিভাবে গড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে ঈশ্বর চেতনয় পরিণত হয় --তা বুঝে নিতে, সেইসব ব্রাত্যজন, আউল বাউলের গানে কোথায় যেন খুঁজে পাই বেদান্তের চির-শাশ্বত আভাসl যদিও এ আমার ব্যক্তিগত ধারণা, তবুও যেন ভেসে চলি সেই ব্রাত্য-র দিগন্তে ফকির লালন-শা'র গানে গানেl 
" ...... ...... ......
আইন কল্লেন জগত-জোড়া 
সেজদা হারাম খোদা ছাড়া 
মুরশিদ বরজোক সামনে খাড়া 
সেজদার কালে থুই কোথা "

সত্যিই তো মুরশিদ , বরজোক যদি সামনে অপেক্ষমান হন, আর সেই সময় যদি পৃথিবী জোড়া আইন বলে ভগবান ছাড়া অন্য কারো কে 'সেজদা' বা প্রণাম করা পাপ, তবে প্রণতির সময় তাঁদের রাখি কোথায় ? এবার মীর কালা শাহ-র গানে দেখি 

" কাম সাগরে জ্বলছে এক সোনার-পুরী 
সেই পুরীতে যাবে যারা 
জীয়ন্তে মড়া হবে তারা 
মড়ামুখে কিসের বাহাদুরী 
ও মন ব্যাপারী 
কল্পতরু খড়ির গড়ে 
মুরশিদে বরজোক ধরে 
কাম সাগরে যাওরে ডঙ্কা মারি "

স্বভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে বরজোক কি ! কেনই বা মুরশিদ-কেও বরজোক-এর স্মরণ নিতে হয় ? চলুন গানের চলনে ভাসতে ভাসতে এবার শুনে নিই 'পাগল কানাই'--এর গান 

" আরও বরজোক ধরে সেজদা করো ভাই 
---নইলে নামাজ হবে না 
ও ইশকে-সাদেকে বান্ধ হে ইমান 
বরজোকে রাখ তোর নয়ান "

"ইশকে-সাদেকে" অর্থাত ভালবাসায় ও পবিত্র প্রেমে 'ইমান' বা বিশ্বাস কে বাঁধোl আর বরজোকে তোমার দৃষ্টি স্থির রাখোl প্রশ্নজাগে "বরজোক" এই শব্দের বন্ধনে তবে কোন নিবিড় কথা বলা হয়েছে? হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এই বাংলার সুফি বা মরমিয়া কবিগণ এই শব্দটি বারবার তাঁদের লোকায়ত গানে কেন ব্যবহার করেছেন ? যতদূর মনেহয় গুরু অথবা পীর বা মুরশিদ গুরুর প্রতীকি অর্থে ব্যবহার হলেও "বরজোক" শব্দটির বস্তুতঃ কোনো এক বিশেষ তাত্পর্য আছে, অথবা অন্য কোনও যেন তৃতীয় সংকেতবাহীl অন্বেষণে দেখি আভিধানিক অর্থে "বরজোক" একটি আরবী শব্দl আরবীতে এই শব্দটি বাঁধ, ব্যবধান, মধ্যবর্তী বা অন্তর্বর্তী অবস্থা , এই সব অর্থেই ব্যবহার হয়ে থাকেl শুনেছি কোরানে ও এই শব্দটির ব্যবহার হয়েছে তিনবারl সেখানে বলাহয় স্বর্গ আর মর্ত্য-র মাঝখানে এক টুকরো জায়গায় মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা যেখানে শেষ বিচারের জন্য অপেক্ষা করে l কিন্তু এই সব সাধারণ অর্থের মধ্যেই আবার এর গূঢ় তাত্পর্যপূর্ণ আধ্যাত্মিক অর্থ ও যেন নিহিত রয়েছে l আর সেই মত অনুসারে মানুষের জীবনের তিনটি ভাগ -

১> যা পার্থিব জীবন 
২> শেষ বিচারের জন্য 'বরজোক'-এ অবস্থানকালীন এক অন্তর্বর্তী জীবন 
৩> বিচারের পর মুক্ত বা দণ্ডিত অবস্থা 

সুফি সাধকগণ মনে করেন এই 'বরজোক' শব্দে মনের তিনটে ক্রমের উর্দ্ধ ধাবমান অবস্থার কথাই এখানে বলা হয়েছেl সুফিদের বিশ্বাসে বস্তুতঃ পরমপুরুষ ছাড়া কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেইl যা দৃষ্ট হয় তা কেবল তাঁরই সংকেত এবং প্রতীক l সূর্য্য ও তার ছায়া, দিন এবং রাত, জল এবং বায়ু, এছাড়াও প্রকৃতি নিবদ্ধ সমস্ত বিষয় তারই সংকেত মাত্রl প্রতিমুহূর্তে তিনি কেবল সেই পরম দিব্যভাবে ও মানব মনের পাপপূণ্যের অন্তর্নিহিত সত্ত্বারই নির্দেশ দিচ্ছেন কিন্তু আশ্চর্য এই যে জীব আত্মা সেই পরম সত্ত্বাকে সঠিক ভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে নাl প্রকৃত ভগবত প্রেমীই পারেন জ্যোতিঃস্বরূপে, সেই পরম স্বত্ত্বার দর্শন করতেl তাঁর সৃষ্ট সব কিছুই যুগল রূপে প্রকাশিত হয় এই বিশ্ব-চরাচরেl তারা আপত বিরোধী আবার সুসামঞ্জস্য ভাবে বিরাজিতl একজন আর একজনকে ছাড়া কখনো নিজেকে সম্পূর্ণ করতে পারে নাl এই পারস্পরিক ভোগের পূর্ণতা ক্ষণিক মোহেরl এই ভোগ পূর্ণ হয় তিনটি সত্ত্বার আবর্তনে ও নির্যাসেl যা হলো মূলতঃ তিন প্রকার -
১> প্রাকৃত বা শারীরিক 
২> মন সম্পর্কিত বা মানসিক 
৩> আত্মা সম্পর্কিত বা আত্মিক 

সুফিরা মনে করেন এই তিন প্রকার ভোগের শেষ না হলে তাঁকে বা নিজের পরম সত্ত্বা কে কখনই সম্পূর্ণ ভাবে উপলব্ধি করা যায় নাl বস্তুতঃ এই বিশ্বের যিনি ভালো মন্দের সঠিক বিচার করতে পারেন, তিনিই কেবল আত্ম গুরুর সন্ধানে ধাবিত হনl এই ভাবধারা কে কেন্দ্র করেই আউল-বাউলের গানে গুরু কে মুর্শিদ; এবং মরমিয়া সুফি ভাবনায় এক অন্তর্বর্তী স্থানকে "বরজোক" বলা হয়েছে বারবারl গুরু সান্নিধ্যে এসে আউল বাউল যখন পার্থিব সব চিন্তা থেকে মুক্তি লাভ করেন এবং মুরশিদ বা গুরুর সান্নিধ্যে এসে তাঁর প্রকৃত সত্ত্বাটি যখন সে সঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন ---তখন সেই স্বরূপটি তার নিজের কাছেই বর্ণনার অতীতl তিনটে মনের অবস্থা বা দরজা পেড়িয়ে আসতে পারলেই যা লাভ হয় তা হল 'তুড়ীয়'- সুখl কিন্তু বলা যতো সহজ তা বাস্তবে সহজ নয় মোটেইl কারণ মনের তিনটে দরজার প্রত্যেকটি অন্তর্দেশেই কার্যতঃ একটি করে "বরজোক" বা খিল আটকে আছে l অর্থাত 'সুসুপ্তি' কার্যতঃ যাকে সরিয়ে বা অতিক্রম করে পরবর্তী অবস্থায় পৌঁছতে হবেl 

" আপনে সে মুরশিদ হইয়া 
জীবকে শিক্ষা দিতেছে 
আপনা ভজন করে বিতরণ 
জীব তারাইবার ফাঁদ পাইতাছে l 
মানুষ গুরু কল্পতরু মনে যারো খিল পইড়াছে 
ফকির লালন বলে কিসের অভাব তার 
দোজখ তার তরে হারাম হইয়াছে ll "

তাহলে জিজ্ঞাস্য হলো দোজখ কার কাছে হারাম হয় l মৃত্যু কার কাছে মৃত্যুহীন হয় ? যে মৃত্যুঞ্জয় তার কাছে আবার কিসের অভাব ? লালন ফকিরের গান লোকায়ত জীবন কে সেই শিক্ষাই দিয়েছে l আত্মোপলব্ধির পথের এই প্রধান কাঁটা থেকে যে অব্যহতি লাভ করতে পারে সেই তো 'অজড়' আর অমর l সেই অমরত্ব লাভের জন্যই তো সঙ্কটমোচন কে আনতে হয়েছিল 'বিশল্যকরণী' l বিশল্যকরণী সম্ভবত বাস্তবে কোনও ভেষজ ওষুধ নয় , এ হলো আত্মভেদের ভাবনা হতে অব্যহতি লাভের উপায় l 

আউল বাউলের গানে ত্রিবেণী বা ত্রিপানি শব্দটি বারবার এসেছে l আরবী শব্দ 'বরজোক' আর লোকবৃত্তের 'ত্রিবেণী-সঙ্গম' বস্তুতঃ একই ভাবনার হয়তো ভিন্নরূপ l মনের তিনটে ভাবধারার সেখানে একত্রে সন্মেলন হয়েছে l চলুন আবার তবে ডুব দেয়া যাক অন্য এক গানের অতলে l 

" শ্রীরূপ নদীটি অতি চমৎকার l 
তোরে বলি সার , হৃদে কর বিচার ,
দেখে ভব-গর্ত হলি মত্ত 
আস্বাদনে কি বুঝলি তার ll 
বিষম সে ত্রিপানি নদী --
ত্রিকোন যন্ত্র পাতালভেদী 
মধ্যে আছে মহা ঔষধি l 
..... ....... ......
ওঠে খুরনো জল ,যদি না থাকে গুরুবল 
তবেই খুলবে মণিকোঠা , বাধবে ল্যাঠা 
সেখানে খুব খবরদার Il 
শ্রীরূপ নদীটি অতি চমৎকার ....
নদীর ভিতর তলায় গরল-সুধা 
এক পাত্রেতে রহে সদা ,
সুধা খেলে যায় ভব-ক্ষুধা 
গরল পান করে প্রাণেতে মরে ,
ছুটে সেই উল্টো কল নেমেছে ঢল 
শিখতে হবে আপ্তসার Il 
শ্রীরূপ নদীটি অতি চমৎকার ....
ত্রিপানি-তে তিনটে ধারা 
নি-ধারা'তে আছে ধরা, ঠিক রেখো নয়নের তারা l
পলকে প্রলয় , হয়ে যাবি ক্ষয় ,
স্থূলে মূলে সকল ভুলে , করতে হবে হাহাকার ll 
শ্রীরূপ নদীটি অতি চমৎকার 
বাঁকা নদীর পিছল ঘাটে 
যেতে হবে নিষ্কপটে , সাধু বাক্য ধরে এঁটে 
তিন দিন বারূণী , তাইতে নাইতে শুনি 
নাইলে সে মহাযোগে সম অনুরাগে 
কাম-কুম্ভীর কি করবে তার ll 
শ্রীরূপ নদীটি অতি চমৎকার ....
রসিক ডুবুরী হলে , ডুব দিয়ে সেই গভীর জলে 
সুফি মতে সে অনায়াসে রত্ন-ধন তোলে 
গোঁসাই গোবিন কয় , কুবীর চাঁদের জয় 
ভেবে গোপাল মূর্খ , পায়রে দুঃখ , 
দিনে দেখে আঁধার Il 

মনের তিনটে অবস্থাকে বেদান্তে বলা হয়েছে ' ভূ -ভূর্ব-স্ব ' l সুফী মতে এদের রূপান্তর হলো 'আলমেনাছুৎ'--'আলমে-মালকুৎ'--ও 'আলমে-লাহুৎ' এই ত্রিলোক বা ত্রিধারায় প্রাণের বর্ণনা পাওয়া যায় আরও একটি বাউল গানে লোককবি রশীদ-শা'র গানে চলুন এবার তবে সাঁতার দিয়ে নিই 

" স্বরূপ সাগরে ডুবারু যে হয় ,
করিয়াছে সে রূপের নির্ণয় ; 
আধ্যাত্মিক জগতে রূপের উত্পত্তি 
স্বরূপ সাগর সে দেশ --'লাহুতি'
আধ্যাত্মিক জগত 'আলমে--মালকুৎ'
এ জড় জগত 'আল--মেনাছুৎ' ll "

অন্য দিকে নরহরি গোঁসাই এর গান শুনবেন ? তিনি গাইছেন এইভাবে 

" রূপ-সায়রে তিন ধারা ,
বুঝতে পারে রসিক যারা 
সদাই রূপে দেয় পাহারা ,
নিরিখ দিয়ে সেই লহর l 
প্রথমে গুণেরই মানুষ 
ভক্তি করে রাখ ধরে হুঁশ ; 
দ্বিতীয়াতে হোস না বেহুঁশ ,
নির্বিকারে তাঁরে স্মর l 
পূর্ণ-ঈশ্বর উদয় তিনে 
নিষ্কাম যাজন সেই দিনে ,
নিরিখ-দিয়ে সেইখানে 
জোয়ার এলে সন্ধান করো ll "

ভাগবত মতে মনের এই তিনটে ধারাকে , আধ্যাত্মপ্রেমের তিনটে শ্রেণীতে বিভাগ করা হয়েছে --সেগুলি হলো 'সাধারণী,'-'সামঞ্জসা'--ও 'সমর্থা'...অর্থাত লোকায়ত দর্শনে যা পশুসুলভ ও স্বার্থপর কামনা বাসনার জগত তাই হলো 'সাধারণী' l অন্যদিকে মানবতাধর্মী পারস্পরিক আকর্ষণ ও ভালবাসা হলো --'সামঞ্জসা' l এবং দেব-দুর্লভ নিঃস্বার্থ প্রেম হলো --'সমর্থা'র লৌকিক স্বরূপ l বাউল কবি রামলাল গোস্বামী এই ত্রিধারা প্রেমের বিশ্লেষণে গেয়েছেন ,আরও এক তত্ত্বগান l আসুন শুনে নিই l 

" বিরজার প্রেম নদীতে , যে জলে ডুবেছে 
ও সে অটল মানুষ রতন পেয়েছে I 
'সাধারণী' আর 'সামঞ্জসা' আর 'সমর্থা' প্রেম কুটিল বড় 
নাই তার ভরসা ,
ইহার তিন মানুষের করিলে আশা 
হবে তার নিরাশা l 
জেনে লও এক মানুষ বসে আছে ll "

তারই অন্য গানে আবার ভাসে যেন বেদান্তের অনুনাদ----

" তিন মানুষের খেলা রে মন 
কারে বা করো অন্বেষণ 
তিন মানুষের তিন রূপ--করণ 
সদগুরু মন আগে ধরো l 
জন্ম-দ্বার আর মৃত্যু-দ্বারে 
আর এক দ্বার আর কইবো কারে ; 
মৃত্যুর-দ্বারে যে জন্মাইতে পারে 
তার সাধন হবে অমর ll "

মৃত্যুর দ্বারে যে জন্মায় তার আবার মরণ হয় নাকি ? সেই তো মৃত্যুঞ্জয় যা হলো বেদান্তের মর্মবাণীl মরমিয়া ভাবনায় এই ভব-সাগরে গুরুরুপী মীন আপন আনন্দে খেলা করে যায়l সেই গুরুকে কান্ডারী করে 'ভবসাগর' কে পারি দিতে হবে 'অচিন-রতন' পাবার আশায়l এখানেও যেন সেই বেদান্তের প্রতিচ্ছায়াl ভবসাগর / ভবসিন্ধু / রূপসাগর ...এই সব শব্দের অন্তরালে সুফী কবিদের ভাবনায় যে শব্দটি উঠে আসে তাকে বলে 'আবে--হায়াৎ'---অর্থাত জীবন নদী , লালন গাইছেন এইভাবে :..

" আব--হায়াৎ নাম গঙ্গা সে যে 
সংক্ষেপে কেউ দেখো বুঝে ,
জগতজোড়া মীন সেই গাঙ্গে 
খেলছে খেলা পরম রঙ্গে 
লালন বলে জল শুকালে 
মীন মীশিবে হাওয়ায় ---"

এবার হীরুচাঁদের গানে শুনুন গুরুরুপী মীনের আপন কথাl এবারেও স্মরণে রাখুন 'বরজোক' হলো অন্তর্বর্তী স্থান ---'কালামোল্লা' অর্থাত ভগবানের কথা l 'ত্রিপিন' অর্থাত্ তিনের সঙ্গম বা ত্রিবেনী l 'পাঞ্জ' --অর্থাত পঞ্চ-রিপুর সমাবেশ l 

" মূল--সাধন করো মালেক চিনে l 
মীনরুপী সাঁই গভীরজলে 
যোগ-সাধন করো বরজোক ধ্যানে l 
মীন আল্লা নিজ নাম ধরে ,
কালামোল্লায় দেখো জেনে ,
আছে নির্মল মহল মনিপুরে 
খেলেছে খেলা ঘাট ত্রিপিণে I 
সে দরিয়ার মাঝে তরী ,
হাওয়া বারি আতশ পুরী ,
কৃপানন্দ আদরিনী ,
বসে তথা মধুপানে l 
মীনের খবর জীব কি জানে ,
মীন ধরে অনেক সন্ধানে ,
হীরুচাঁদ কয় ভাব না জেনে ,
পাঞ্জ মলি শেউলি টেনে ll "

যেমন ভবসাগর পারি দেবার জন্য আবশ্যিক হয় কান্ডারীর সহায়তা ,তেমনি ভবনদী পার হওয়ার জন্য চাই মনকে কঠোর সংযমে আবদ্ধ করা l এই সাধনকথার নির্দেশ রয়েছে গোস্বামী রামলালের গানে l এবারে সেই কথা শুনুন ...

" ভবসিন্ধু সেতুবন্ধ করে হওরে পার 
গুরু--উপাসনা ছাড়া পার হওয়া 
সত্যিই হবে ভার Il 
'রেচক', 'পুরক', 'স্তম্ভন', দিয়ে নদী করো বন্ধন 
প্রেমভক্তি খুঁটি তার কর হে স্থাপন ,
সে নদী অত্যন্ত গভীর , আছে কামরুপী কুম্ভীর 
বাঁধলে সাঁকো সে হবে ভেক , গুপ্ত হবে নীর ,...
সেথায় আছে লোভ-রুপী রায় , ক্রোধ-রূপ কাঁটা আর l 
গুরু উপাসনা ছাড়া পার হওয়া হবে ভার ...."

জীবনপথে অথবা সাধন অনুশীলনে আসে নানান প্রসঙ্গl এই প্রসঙ্গ অনুষঙ্গের মাধ্যমেই হয় পরমের সঙ্গলাভl অসীমের সন্ধানে সাধক তার সীমার মাধ্যমেই সেই অচিন-এর পরিচয় লাভ করতে করতে এগিয়ে চলেl এই ভাবেই যুগল সঙ্গের ধরাবাহিকতা এগিয়ে চলে নানা অনুষঙ্গ চর্চার মাধ্যমে সেই অসীম নিঃসঙ্গ অথবা একক সঙ্গের আশায়l 
" ভব পারে যদি রে অবুঝ মন 
আমার মন-রে রসনা 
দিন থাকিতে মুরশিদ ধরে 
সাধন ভজন কেন করলে না ...
দেহের বাদী রিপু ছয়জন 
আগে মন বস করো তারে ,
ঐ নাম ভুললে পরে পড়বি ফেরে 
প্রাণ যাবে কাম হীরার ধার-এ 
ও দারমালি চোর ; ওরে গাঁজা খোর 
আর কত বুঝাবো তোরে 
তাই পাগল কানাই কয় ---ওরে আমার অবুঝ মন 
---ও রে রসনা "

0 comments:

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ৬
শিবাংশু দে

বাংলায় একটা শব্দ আছে, 'ট্র্যাডিশনাল', অর্থাৎ শিল্পের আদিরূপের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রবণতা। আমার কিন্তু মনে হয় 'ঐতিহ্য' ব্যাপারটি নদীর মতো বহমান। তার প্রতিটি ঘাটের নিজস্ব ট্র্যাডিশন রয়েছে এবং সেটা সময় নিরপেক্ষ। তার প্রাসঙ্গিকতা শুধু মানুষের কাছে পৌঁছোতে পারার প্রয়াস থেকেই বিচার্য হওয়া উচিত। গঙ্গোত্রীর ঐতিহ্য বা গঙ্গাসাগরের ঐতিহ্য, দুয়েরই নিজস্ব গরিমা রয়েছে। তাদের সার্থকতা মানুষের তৃষ্ণাকে নিবারণ করতে পারার ক্ষমতা থেকেই নির্ধারিত হয়। এই কথাগুলি এই জন্য মনে এলো যে এই পাঁচজন শিল্পী নিঃসন্দেহে এই অর্থে ট্র্যাডিশনাল এবং তাঁদের রসসৃজনের ক্ষমতা ও মানুষের শিল্পতৃষ্ণাকে তৃপ্ত করতে পারার জাদু, বহু যুগ পেরিয়ে এসে, আজও সমঝদার শ্রোতার কাছে সমান প্রাসঙ্গিক। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে এই সব শিল্পীদের বৃহত্তর শ্রোতাদের সামনে গান শোনাবার সুযোগ হয়নি। মুষ্টিমেয় কিছু রসগ্রাহী শ্রোতা এবং ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত আগ্রহী রসিকবর্গ ব্যতিরেকে এঁদের গান শোনার অবসর ইতর সাধারণের ঘটেনি। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে উপাসনামন্দির বা অভিজাতবর্গের বৈঠকখানা থেকে সর্বশ্রেণীর শ্রোতাদের নাগালে নিয়ে আসার কাজটি করেছিলেন অন্য কেউ। 

'... কোন রাতের পাখি গায় একাকী, সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে'

পৃথিবীর যেকোন বনেদি ভাষায় শব্দ উচ্চারণ থেকে বক্তা'র শ্রেণী নির্ধারণ করা হয়। সংস্কৃতে 'অশুদ্ধ' অর্থাৎ যথেষ্ট আর্ষ নয়, এমন উচ্চারণকে শূদ্রের স্তর দেওয়া হতো। এমনটিই ছিলো লাতিনে বা ফার্সিতে। পরবর্তী ঔপনিবেশিক কালে এই প্রবণতাটি ইংরিজি ও ফরাসি ভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যেও দেখতে পাই। লোকে বলে, শেক্সপিয়রের সময় ইংরিজি উচ্চারণ নিয়ে তত মাথাব্যথা ছিলোনা, যেমন দেখা যায় মহারানী ভিক্টোরিয়ার সময়কালে। ফরাসি বিপ্লবের সময়ও মৌখিক শব্দের উচ্চারণ দিয়ে 'শোষক' ও 'শোষিতে'র ফারাক করার প্রয়াস হতো। অর্থাৎ চিরকালীন অভিজাত আর ইতরজাত'র বিভেদ। এই ধরণের স্বীকৃতির কাঠিণ্য ভাষাগুলির বানানপদ্ধতির ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। এই কাঠিণ্য বস্তুতঃ শাসকের (পড়ুন অভিজাতর) জেদ। যে জাতি যতো বেশি প্রাকৃত সম্পদ লুটতে পারে, তার তত অধিক বলের অভিমান। ঔপনিবেশিক অভিজাতর বানান, উচ্চারণ, উপস্থাপনার প্রতি ইতরজাত সদা সন্দিগ্ধ ও বিপ্রতীপ। কাব্যের মর্মবাণী যেহেতু শব্দ আশ্রিত এবং শব্দের আত্মা যেহেতু উচ্চারণে, তাই কোনও শ্রাব্য কাব্যসৃষ্টিই মূলশব্দের স্বীকৃত উচ্চারণ ভঙ্গিকে অস্বীকার করে ধরা দেবেনা। অন্যপক্ষে দৃশ্যশব্দের কাব্যপাঠে স্বীকৃত বানানশৈলীর গুরুত্ব অপরিসীম। উভয় নিরিখেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের 'শুদ্ধতা' স্বীকৃত উচ্চারণ ও বানান শৈলির প্রতি দায়বদ্ধ। যেকোনও ভাষার মতো বাংলাতেও উচ্চারণ ও বানান পরস্পর নির্ভরশীল। 


এখন প্রশ্নটি হচ্ছে কোনও শব্দের বানান উচ্চারণভিত্তিক হবে না তার আনুগত্য উৎস শিকড়ের প্রতি অধিক থাকবে। এই অনুপাতের কার্যকারণ সম্পর্কের উপরেই শব্দের ও উচ্চারণের শরীর নির্ভর করে। জোড়াসাঁকো দ্বীপের বাইরের কোলকাতায় যে বাংলা ব্যবহৃত হতো, জোড়াসাঁকোর লোকজন তা সযত্নে পরিহার করে চলতেন। যার পরিচয় কালী সিংহি থেকে নরেন দত্ত, সবার লেখাতেই পাওয়া যায়। কারণ 'জোড়াসাঁকো', 'রাঁড়ি-বাড়ি-জুড়িগাড়ি'র কোলকাতায় এক টুকরো য়ুরোপীয় উপনিবেশ। সেখানে উপনিষদও চর্চা হতো য়ুরোপীয় পণ্ডিতদের 'বৈজ্ঞানিক' নিষ্ঠায়। তাই আজ যে ভাষাকে 'বাংলা' বলা হয় তার সৃজক দুজন বঙ্গভাষী য়ুরোপীয়। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ। আমি সচেতনভাবে এ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের নাম নিচ্ছিনা, কারন তিনি ছিলেন গঙ্গোত্রীর উৎস, নদী হতে পারেননি। ঠাকুরবাড়ির 'বাংলা' উচ্চারন তাই শিমলা-গরানহাটা- ঠনঠনের উচ্চারন থেকে ভিন্ন। এর পিছনে ব্রাহ্মসমাজি শ্রেণীসচেতনতাও কাজ করেছে। বরিশালের ব্রাহ্মরাও 'জোড়াসাঁকো'র বাংলায় কথা বলতে প্রয়াস পেতেন। বাংলাভাষাকে একটি আধুনিক অগ্রসর মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপীয়, মূলত ইংরিজি, structured ব্যবস্থাটির শরণ নেন। এটি মূল সংস্কৃত বানান ও ব্যাকরণ পদ্ধতির থেকে পৃথক। এই কারণে হিন্দি বানান ও উচ্চারণ অনেক বেশি সমগোত্র, কিন্তু বাংলা বানান ও উচ্চারণ ইংরিজির মতো বহুরূপী। রবীন্দ্রসংগীতের উচ্চারণ প্রকরণে এই সব নানা কার্যকারণ কাজ করেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথমযুগের স্বরলিপি যাঁরা করেছেন, জ্যোতিরিন্দ্র, ইন্দিরা বা দিনু ঠাকুর, তাঁরা তো ঐ পারিবারিক ব্যবস্থারই অঙ্গ। 


পরবর্তীকালে শৈলজারঞ্জনের শিক্ষাও তো ইন্দিরাদেবীরই পথানুসারী। তাই স্বরবিতানে অ-কার ও ও-কারের যে দিশানির্দেশ আছে তার উৎসও এই নিয়মেরই অন্তর্গত। সম্প্রতি একজন প্রতিষ্ঠিত সুগায়িকা বন্ধুর (যাঁর শিক্ষা কোলকাতায় অনেক গুণীজনের কাছে) সঙ্গে 'বিজনঘরে' প্রসঙ্গে অনেক আলোচনা হলো। সেখানে সব সম্ভাব্যতা, যেমন বিজন (হসন্ত), বিজন(অ) বা বিজনো, নিয়েই কথা হলো। তাতে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হলো যে উচ্চারনটা বিজন(অ) হওয়াটাই সমীচীন, তবে ঘাতটা তীব্র হবেনা, মৃদু হওয়াই কাম্য। কিন্তু কিছু সেরা শিল্পীরা ব্যতিক্রমও তো আছেন।



আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত মানে নিজের সঙ্গে কথা বলা। তাই সততা ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোনও অঙ্গকেই ঠিক আত্মস্থ করা যায়না। এই বিষয়টি কথা, উচ্চারণ, সুর বা গায়ন, সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতোগুলি সূক্ষ্ম লক্ষণকে সঠিক মাত্রায় আয়ত্ব করে রস উপভোগ করার জন্য যে প্রস্তুতি লাগে, তা বৃহত্তর শ্রোতামণ্ডলীর নাগালের বাইরে। আমজনতার কাছে শোনার জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। 'কানে' শুনে 'ভালো' না লাগলে তাঁদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে বিজড়িত থাকার কোনও গরজ নেই। শব্দঝংকারের ক্ষেত্রে , দৈনন্দিন পথেঘাটে শোনা উচ্চারণধ্বনির সঙ্গে কোনও ব্যতিক্রম হয়ে গেলেই, তাঁরা বিযুক্ত হয়ে যা'ন। এ ভাবেই কয়েকজন প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের ক্ষেত্রেও অভিযোগ আসে, তাঁরা 'চিবিয়ে' শব্দ উচ্চারণ করেন। এটা যতোটা ব্যক্তিস্তরের অরুচি, তা'র থেকে অনেক বেশি ইতরজাত'র আপত্তি। একালে কণিকা বা নীলিমার বা অন্য কোনও সিদ্ধ শিল্পীর প্রতিও এই অভিযোগ শোনা যায়। আবার জর্জদা'র গানে আকাশ 'ভওরা' উচ্চারণ বিতর্কটি মনে পড়ছে সুভাষ চৌধুরী মশাইয়ের বক্তব্য ছিলো, যেটা এক্ষণের ( পরে আজকাল কাগজেও) জন্য রায়মশাইয়ের সাক্ষাৎকার নেবার সময় তিনি উল্লেখ করেছিলেন। 


সুচিত্রার উচ্চারণের প্রতি বৃহত্তর শ্রোতৃকূল অতি প্রসন্ন, আবার অনেক 'সমঝদার' তাঁর উচ্চারণে অকারণ অতিরিক্ত শ্বাসাঘাত প্রয়োগে কখনো অস্বস্তি বোধ করেন। তবে শ্রোতা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঠিক কোন ধরনের উচ্চারণে আশ্বস্ত বোধ করবেন? এর কোনও প্রশ্নাতীত সমাধান নেই। তবে স্পষ্ট ও প্রযুক্ত শব্দগুলির গভীরতর ইঙ্গিতের প্রতি যথোচিত সম্মান জানিয়ে যে উচ্চারণ, তার আবেদন সচরাচর ব্যর্থ হয়না। কিন্তু কণিকা তো সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন, তবু এক শ্রেণীর শ্রোতার কেন এই অনুযোগ? একজন বলেছিলেন, কণিকার গায়নভঙ্গি মাত্রাতিরিক্ত 'কোমল', একটু আদুরে, ললিত সমর্পণে অতি নিবেদিত। রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একটু বেমানান। আমি ঠিক নিশ্চিত ন'ই এটাই যথার্থ কারণ কি না। 


সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ''..... সকলের উচ্চারণ শুনে নিশ্চয়ই আমার ভাল মনে হয়না। স্পষ্ট উচ্চারণই অনেকে করেনা। কয়েকজন - সুচিত্রা-টুচিত্রা আছে, যারা ভাল গাইয়ে - তাদের মধ্যে উচ্চারণটা বোধ হয়..... সুচিত্রার উচ্চারণ খুব পরিষ্কার। '' তখন প্রশ্ন ওঠে সুচিত্রা 'সন্ধ্যা' শব্দটি 'স(অ)ন্ধ্যা' উচ্চারণ করেন, কিন্তু ব্যাকরণের নির্দেশ অনুযায়ী তা 'সোন্ধ্যা' হওয়া উচিৎ ছিলো। তখন সত্যজিৎ বলেন 'স(অ)ন্ধ্যা' উচ্চারণটি 'খুবই খারাপ'। আরও বলেন,''.....In general, বাচনভঙ্গিটা খারাপ হয়ে গেছে।.... বাংলা উচ্চারণের সেই awarenessটা অনেকটা চলে গেছে।....উচ্চারণটি সেখানে অঙ্গ ছিলো শিক্ষার। এখন সে পরিমাণে মোটেই নেই। যে জন্য সেটা গানেও reflected হচ্ছে।''


'চিবিয়ে' অর্থাৎ শব্দগুলিকে ঈষৎ চেপে বঙ্কিমভঙ্গিমায় উচ্চারণ করার প্রবণতা, যা তৎকালীন অন্যান্য বাংলাগানের গায়কির অঙ্গ ছিলো, আমরা রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে প্রথমদিকের কিছু প্রধান শিল্পীদের গানের মধ্যে পাই। পথিকৃৎ হিসেবে এঁরা নমস্য, কিন্তু এখন আমরা এ ব্যাপারটি হয়তো পছন্দ করিনা। রুচি তো বদলাতে থাকে। এঁদের মধ্যে কনক দাসও ছিলেন, কিন্তু কণিকার গায়নশৈলি ও শব্দোচ্চারণ ছিলো একান্ত নিজস্ব, নিবেদিত ও তল্লীন। 

0 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


বম্বে স্টোরিজ
সাদাত হাসান মান্টো 
সাদাত হাসান মান্টো উর্দু সাহিত্যের একটি এমন নাম যা উপমহাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব ও উত্তর, এবং দেশভাগের যন্ত্রণায় দীর্ণ হতে থাকা অসংখ্য সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি স্বরূপ। তাঁর দেখার চোখ আর সমাজের তথাকথিত নীতিবাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাওয়া মানবিক বোধ, মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান উপেক্ষা করে তাদের যাপনের যন্ত্রণাগুলোকে সামনে এনেছে। সাহিত্য বলে শুধু নরম পেলব স্বপ্নময়তা দিয়ে আঁকা রোম্যান্টিক কিছু কথন নয়। সাহিত্য তীব্রভাবে জীবনের সেই সব দিককেও তুলে আনে যা আমাদের চোখে পড়লেও আমরা এড়িয়ে যাই। এসব সাহিত্যের বিষয় হতে পারেনা, এমনটাই ভাবি। লেখক আমাদের বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করিয়ে দেখিয়েছেন, জীবন মানে এটাও হয়। শিউরে উঠেছি। কষ্ট পেয়েছি । 
এই বইটিতে মোট চোদ্দটি গল্প আছে । নামেই যাদের পরিচয় লেখা। আমার দুর্ভাগ্য যে মূল উর্দুতে আমি লেখককে পড়তে পারিনি। উর্দু পড়তে পারিনা বলেই। উর্দুতে অডিও বুকের মাধ্যমে শুনলে আমার মনে হয় গল্পগুলোর আরো কাছে যাওয়া সম্ভব। যে কোনও রচনা তার স্থান কাল পাত্র পরিবেশের একটি দুর্লঙ্ঘ্য গন্ধ বয়ে আনে। ইংরিজিতে যাকে বলে ফ্লেভার। অনূদিত গল্পের ক্ষেত্রে, যত ভালো অনুবাদ হোক না কেন, মূল গল্পের সেই ফ্লেভার কিছুটা হলেও অনুপস্থিত থাকে। এ ক্ষেত্রে ম্যাট রীক অবশ্য অত্যন্ত সুষ্ঠ ভাবে যত্নের সঙ্গে অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। উপমহাদেশের লেখক হওয়া সত্ত্বেও মান্টোকে যে প্রতীচ্য পোস্টমডার্ণ সাহিত্যিক হিসেবে এই জায়গা দিয়েছে সেটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। একথাটির কারণ এই, যে মান্টো অবিভক্ত ভারতের মানুষ বলেই নিজেকে ভাবতেন। দেশ ভাগ তাঁকে চরম দুর্ভাগ্যের দিকে টেনে নিয়েছিল। যার ফলস্বরূপ অকালমৃত্যুর শিকার হন তিনি। 
এই বইয়ের চোদ্দটি গল্প মান্টোর বম্বের স্মৃতি। বেশির ভাগই লাহোরে চলে যাবার পর লেখা। তবে কিছু গল্প বম্বে থাকাকালেও লেখা। যেমন ‘বু’ গল্পটি। এই গল্পটি এবং ইসমত চুঘতাইয়ের লিহাফ গল্পটি একই সঙ্গে অশ্লীলতার দায়ে আদালতে পৌঁছেছিল । দুই লেখক ও দুই বন্ধু একই সঙ্গে কোর্টে যান। কি ছিল গল্পটিতে? রীক নামকরণ করেছেন, স্মেল । যেহেতু মান্টোর চিন্তার মধ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা একটি চেনা বৈশিস্ট্য, এক্ষেত্রে তা উঠে এসেছে এক যুবকের যৌনতুষ্টির সঙ্গিনী এক নিম্নবর্গীয় তরুণীকে ঘিরে। বিবাহিত যুবকটির সুন্দরী স্ত্রী নিদ্রিত। সে নিজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বহু আগের সেই মেয়েটির কথা মনে করছে । যার ক্লেদাক্ত শরীরের প্রতিটি রোম থেকে উঠে আসছিল এক অদ্ভুত গন্ধ, যা কখনোই সুগন্ধ নয়, অথচ যা তাকে দিয়েছিল এক অদ্ভুত তুষ্টি । তার মনে হয়েছিল এ গন্ধ তার খুব চেনা । শৈশবে দুধ খাওয়ার কালে কি সে এই গন্ধ পেয়েছিল? আজ সুন্দরী স্ত্রী তাকে সেই তুষ্টি দিতে পারছেনা যা সেই মেয়েটি তাকে দিয়েছিল। কিংবা ধরা যাক ‘দশ টাকা’ গল্পটি। চৌলে থাকা কিশোরী মেয়েটি যে ধান্দায় যায় তা সকলেই জানে। কিন্তু প্রচন্ড জীবনসংগ্রামের মধ্যে এ নিয়ে কেউই মাথা ঘামায়না। তার মায়ের মিথ্যেকথা নিয়েও কেউ প্রতিবাদ করেনা। কিশোরীটি যাই করুক না কেন , তার মধ্যে বালিকাবেলার একটি নিষ্পাপ মন রয়ে গিয়েছে। তাই সে ধান্দায় যেতে ভালোবাসে। কেননা তাহলে সে গাড়ি চড়তে পারে। এটি তার অত্যন্ত প্রিয়। এমনই একদিন সে গাড়িতে চেপে বম্বে ছাড়িয়ে এক নির্জন সমুদ্রের ধারে গেল। সঙ্গী ছিল তিন অল্পবয়সী তরুণ। কিশোরীটির নিষ্পাপ উচ্ছ্বলতা তাদেরকেও প্রভাবিত করেছিল। ফলে তারা কেউই দৈহিকভাবে একে অন্যের সঙ্গে লিপ্ত হলোনা। বরং চার বন্ধু যেন একটি অমলিন বিকেলবেলা সাগরের পাড়ে কাটিয়ে ফিরল। প্রথমে একটি ছেলে কিশোরীটির বুকে একটি দশ টাকা গুঁজে দিয়েছিল। ফিরে এসে গাড়ি থেকে নামার সময় কিশোরী সেই টাকাটা ফিরিয়ে দেয়। সিটের ওপরে টাকাটা রেখে সে যখন চলে যায় তখন পাঠকেরও বুক চিনচিন করে। কি অসম্ভব অসহায়তা ! জীবন কি ছেলেখেলা করে! এমন করে লিখতে বসলে গোটা চোদ্দটি গল্প বলা হয়ে যাবে। সেটা ঠিক হবেনা। শুধু পাঠক হিসেবে নিজের কথাটি বলি। মান্টোকে যেভাবেই চিহ্নিত করা হোক না কেন, আমার কাছে তিনি এক অভিমানী মানুষ বলেই প্রতিভাত হলেন । তাঁর চেতনার গভীরে তিনি যেন নিখাদ ভালোবাসাই খুঁজেছেন সারাটা জীবন। আদিম মানবের মতো তাঁর খোঁজ শরীর ছাপিয়ে চেতনায়, মস্তিষ্কের শিরায় উপশিরায় ছড়িয়ে গিয়েছে । তাঁর সময় ও পরিবেশ যে তাঁর ওপরে এক চূড়ান্ত বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। রাশদি বলেছেন মান্টো নিম্নবর্গীয় জীবনের ব্যাখ্যাতা। অবশ্যই তাই। বঞ্চিত অসহায় দুঃখী মানুষের জীবনজোড়া সুখ ও ভালোবাসার খোঁজ তাঁর এই চোদ্দটি গল্পের পরতে পরতে মিশে আছে।

0 comments:

0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in

স্মৃতির সরণী


কথামালা
বিপুল দাস


১৯৭১-এ ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রপতি শাসনের সুযোগ নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নকশাল দমনের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। সঙ্গে রাজ্য-পুলিশ এবং প্যারা-কমান্ডোদের এই মিলিত আক্রমণের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন স্টিপল্‌চেজ’। সিপিএম-এর ক্যাডাররা নকশালদের মারছে, কংগ্রেসি গুণ্ডারা মারছে, পুলিশ মারছে, মিলিটারি মারছে। পার্টির নেতৃত্বও তখন আর প্রশ্নহীন, অবিসংবাদিত নয়। দল ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন অনেক তাত্ত্বিক নেতা। বহু তরুণের তাজা প্রাণের রক্তে ভিজে আছে পশ্চিমবাংলার মাটি। ক্ষতবিক্ষত, ছিন্নভিন্ন দল থেকে বেরিয়ে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য উপদল। যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল কাকদ্বীপ থেকে তেলেঙ্গানা, শ্রীকাকুলাম থেকে গোপীবল্লভপুর, অন্ধ্রে, উড়িষ্যায়, মধ্যপ্রদেশে, বিহারে, উত্তরপ্রদেশে – তার উৎসভূমির প্রদীপ নিভে আসছিল। কিন্তু অগ্নিশিখাটুকু নেভানো যায়নি। এখনো তারা তাদের আদর্শের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে জেহানাবাদে, জঙ্গলমহলে, সীতামাঢ়ীতে, অন্ধ্রে। কিন্তু চারু মজুমদারের লাইন থেকে অনেক দূরে তাদের রণনীতি। ভূমিহীন কিষাণের অধিকারের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের ডাক দিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের সেই আন্দোলনের রূপরেখা ও তার প্রয়োগের ত্রুটিবিচ্যুতি অনেক আলোচনা, অনেক লেখালেখি হয়েছে। শৈলেন দেবনাথের মতে –

একঃ চারু মজুমদারের গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার রণনীতি ভুল ছিল। এই লাইন সার্থক ভাবে প্রয়োগ করতে হলে গ্রামীন শ্রমিককৃষক বাহিনীকে যে রাজনীতির শিক্ষা দেওয়া দরকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি। গেরিলাযুদ্ধের রণকৌশল শেখানো হয়নি। অস্ত্র বলতে সামান্য কিছু ছিনতাই করা পুলিশের রাইফেল আর জোতদারের গাদা বন্দুক। চারু মজুমদার ভেবেছিলেন এ ভাবেই সরকারকে বাধ্য করবেন সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির দিকে।

দুইঃ কানু সান্ন্যালের আপত্তি সত্ত্বেও জনভিত্তির ওপর জোর না দিয়ে গোপন সংগঠনের ওপর জোর দেওয়া। গোপনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে এই গোপন সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্রুত যোগাযোগের অব্যবস্থা।

তিনঃ শহুরে মধ্যবিত্ত মানসিকতার যুবকদের প্রকৃত রাজনৈতিক শিক্ষা ছাড়াই, তাদের সম্পর্কে ঠিকঠাক খোঁজখবর না নিয়েই পার্টির কাজের দায়িত্ব দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে এক সময় কোনও একটি অঞ্চলের প্রায় সমস্ত কিশোর এবং যুবকরাই নকশালপন্থী হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক ক্লাস নিয়ে ভারতবর্ষ এবং পৃথিবীর ইতিহাস, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লড়াই-এর কৌশল, দেশি পুঁজি-বিদেশি পুঁজির শোষণের পদ্ধতি – ইত্যাদি বিষয়ে তাদের খুব কমই বোঝানো হয়েছে। এক ধরণের নায়কোচিত বীরত্বের আবেগে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখত এরা। স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল।

চারঃ রাজনৈতিক সভাসমাবেশ, সঠিক প্রচার ইত্যাদির দ্বারা জনভিত্তি সুদৃঢ় করার বদলে ব্যক্তিহত্যার লাইন, ফলে জনসমর্থনও যেটুকু ছিল, শেষের দিকে সেটাও আর ছিল না। প্রকৃত পক্ষে কে প্রকৃত শ্রেণিশত্রু, সেটা নিয়ে দলের কর্মীরাই সংশয়ে ভুগেছে। এমনও দেখা গেছে, যে মানুষটি পার্টির সহায় বা সমর্থক হতে পারত, শুধুমাত্র ধনী হওয়ার অপরাধে খতম হয়ে গেছে।

পাঁচঃ ঠিকঠাক স্ক্রুটিনি না করে যেমন খুশি ক্যাডার নিয়োগ করে সংখ্যার বিচারে আত্মপ্রসাদ লাভ হ’ত, কিন্তু তার ফলে দলে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের স্পাই, এবং অবশ্যই পুলিশের গুপ্তচর বাহিনী দলে ঢুকে পড়েছিল। গোপন সভাসমাবেশের কথা দ্রুত পুলিশের কাছে পৌঁছে যেত।

একদম সঠিক বিশ্লেষণ করেছেন শৈলেন দেবনাথ। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা হবে, অথচ যোদ্ধা হচ্ছে নবিশ আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা শহুরে কলেজের ছাত্র এবং আনাড়ি কৃষক। রণকৌশল তৈরি না করেই, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার ডাক দেওয়া হ’ল। কানু সান্ন্যালের আপত্তি সত্ত্বেও গোপন সংগঠনের ওপর জোর দেওয়া। রাজনৈতিক ভাবে সংগ্রামকে এগিয়ে না নিয়ে ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি। আদপেই শ্রেণিশত্রু নয়, এমন নিরীহ মানুষকে খতম করার চুল হিসেব। দলে কে পঞ্চমবাহিনীর লোক, সে সব মনিটরিং করার কেউ ছিল না। গোপন খব্র অতি সহজেই ফাঁস হয়ে যেত। গুরুত্বপূর্ণ নেতারা অভাবিত ভাবে ধরা পড়ে যেতেন।

১৯৬৭ তে আমি কলেজে, সেকেন্ড ইয়ার। আজ আমার এই ৬৭ বছর বয়সে পেছন ফিরে তাকিয়ে কত অস্পষ্ট ছবি ভেসে ওঠে। টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সিপিআই এম এল। আমি কোনও দিন অ্যাকশন স্কোয়াডে ছিলাম না। এমন কী ওয়াল-পোস্টারিংও করিনি। পড়াশোনা করতাম। নতুন ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে দেখতাম ওরা কেউ সোনাম ওয়াংদির নামও শোনেনি, এম এন রায় তো দূর অস্ত্‌। বুঝতাম ওরা অ্যাকশনে যেতে বেশি আগ্রহী। ওরা রেডবুকের নাম শুনেছে, চারু মজুমদারের ঐতিহাসিক আটটি দলিল পড়েনি। গল্পের ছলেই আমি প্যারি কমিউনের গল্প, রাশিয়ার বিপ্লব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বিশ্বপুঁজির বাঁটোয়ারা নিয়ে পশ্চিমি শক্তির লড়াই, জাতপাতের ঊর্ধে উঠে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের ঐক্যের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ও শ্রেণিহীন সমাজ গড়ার কথা বলতাম। খুব একটা সুবিধে হ’ত না। তা ছাড়া আমার নিজেরই তখনও অনেক সংশয় দূর হয়নি।

চারুদার পরিবারের সঙ্গে এখনও ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। অসম্ভব ভালোমানুষ ছিলেন লীলাদি। বড় মেয়ে অনীতা মজুমদার ডাক্তার, ছোট মেয়ে মধুমিতা ভালো গল্পকবিতা লেখে, ছোট ছেলে অভিজিৎ মজুমদার শিলিগুড়ি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। নানারকম সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে অভিজিৎ জড়িত। এ ছাড়াও সিপিআই—এম এল( লিবারেশন) গ্রুপের সক্রিয় কর্মী।

মাঝে মাঝে নদীর পারে গিয়ে একটা পুরনো গাছ খুঁজি। গাছটা আর খুঁজেই পাই না। সেই নদী নেই। অনেক দূরের একটা কালো জলের আবিল নর্দমা হয়ে গেছে আমার প্রিয় মহানন্দা। যা ছিল টলটলে সবুজ জল, এখন পঙ্কিল, দুর্গন্ধময়। সেই গাছটার নীচে একদিন আমার মাথায় শোষণমুক্ত পৃথিবীর কথা বলেছিল দীপকদা। এই গাছের নীচে পুলিশের দালাল ননী মজুমদার শরীরে চৌত্রিশটা টাঙ্গির কোপের চিহ্ন নিয়ে পড়েছিল। এই গাছের নীচে রানাকে গুলি করে বর্ষার মহানন্দায় ভাসিয়ে দিয়েছিল সিদ্ধার্থ রায়ের পুলিশ। গাছটা নেই। পরে শুনেছিলাম কে নাকি ঐ গাছে ফাঁসি দিয়ে মরেছিল। আশপাশের লোকজন ভয় পেত। কেটে ফেলেছে ওরাই। নেই সেই মহাযুদ্ধের সাক্ষী। কেউ সেদিন বলেনি – বাছা তুমি রণে যাইও না। চৌদিকে কাফিরের দেশ, জহর মিলে তো পানি মেলে না। তিতাসের সেই বিখ্যাত জারিগান।

শাশ্বত একদিন একটা অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিল। ওর বাবা অনিল সরকার ছিলেন আমাদের পাড়ার স্কুলের হেডমাস্টার। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান থেকে এসে আরও অনেক উদ্বাস্তুর মত কলোনিতে জমি পেয়ে ঘরবাড়ি তুলেছিলেন। ওপারেও তিনি শিক্ষক ছিলেন। কলোনিতে স্কুলের জন্য জমি দিয়েছিলেন স্থানীয় একজন পুরনো রাজবংশী জোতদার শ্রেণীর লোক। ওপারে সব ছেড়ে-আসা মানুষজন মাথার ওপরে আচ্ছাদন আর দু’বেলা কায়ক্লেশে নুনভাতের ব্যবস্থা করার পর হাত দিয়েছিলেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে লেখাপড়া শেখানোর ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে। প্রাথমিক ভাবে ওই ভূস্বামীর দলিজ ঘরে ক্লাসের ব্যবস্থা হয়েছিল। পরে সরকারি সাহায্য আর স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে একটু একটু করে স্কুলটা গড়ে উঠেছিল।

ফালতু ধরা পড়েছিল শাশ্বত। সে সময়ে অবশ্য অনেকেই এ রকম ফালতু, শুধু সন্দেহের বশেই ধরা পড়ত। কোনও কালে কোনও পলিটিক্সের ভেতরেই সে ছিল না। নদীর পারে ছাতিমতলায় ননী মজুমদার খতম হয়েছে শুনে সে একেবারে কাঁচা গাণ্ডুর মত একটু বেশি রাতে স্পট দেখতে গিয়েছিল। সেখানে মোতায়েন ছিল জাসুসি পুলিশ। বর্ষায় ধানখেতে যেমন ধানগাছের নড়াচড়া দেখে কপাত্‌ করে পলো ফেলে শোলমাছ ধরে মানুষ, তেমনই কপাত্‌ করে তাকে ধরেছিল পুলিশ। ওরা নিশ্চিত ছিল শাশ্বত একজন ক্রিমিনাল। কারণ, আর্থার কোনান ডয়াল বলেই গেছেন অপরাধী তার অপরাধের স্পটে একবার ঘুরে আসবেই।

ভ্যানে তোলার আগে একজন পুলিশ তার পেছনে বন্দুকের নল ঠেসে ধরে বলেছিল – মাদারচোদ, রাজনৈতিক ক্ষমতার উস্‌সো বন্দুকের নল, অ্যাঁ ? দ্যাখ কেমন লাগে। শালা, মাও-সে-তুং তোর গাঁড়ে ভরে দেব এবার। ইন্ডিয়ার খাবি আর চায়নার ঢেকুর তুলবি। আর একজন সিপাই বলেছিল – এই দত্ত, বাই চান্স ফায়ার হয়ে যাবে। হা হা করে হেসে উঠেছিল দত্ত। বলেছিল – আরে সেও তো একরকম মারা-ই হবে। মাইরি, এদের পোঁদে নল ঠেকালেই আমার বডিতে কেমন হিট এসে যায়। শাশ্বত টের পাচ্ছিল তার রেক্‌টামে চাপ দিচ্ছে রাষ্ট্রের ধাতব-শীতল তীক্ষ্ণতা।

পেছনে বন্দুক ঠেকিয়ে ওকে একটু দূরে অন্ধকারে দাঁড়-করানো কালোগাড়িতে তোলা হয়েছিল। তখন আর একটা জিপ থেকে নেমে এসেছিল একজন কাঁধে স্টারলাগানো অফিসার। হাতে মোটা কালো কাঠের রুলার। শাশ্বত টের পাচ্ছিল এখনই মলমূত্রে তার পোশাক নষ্ট হয়ে যাবে। তার মুখের দিকে টর্চ মেরে কিছুক্ষণ দেখল সেই অফিসার। মদের গন্ধ পাচ্ছিল শাশ্বত।

আরে, এটাকে কে ধরে আনল ?

আমরা স্যার, আমি আর দত্ত। জানতাম, মাল ঠিক দেখতে আসবে।

মাল না বাল। এটাকে তো বাংলার ঠেকে রেগুলার বসে থাকতে দেখি। শালা, এখনই হেগেমুতে দেবে। এ করবে মার্ডার ? ধুস্‌, দেখছিস না লিভার পচে গেছে। একদিন জোরে কোথ্‌ পেড়ে হাগলেই লিভারমিভার সব বেরিয়ে যাবে। দু’দিন পরে এটা এমনই ভোগে যাবে।

শাশ্বত বুঝতে পারছিল না সে যে বাংলাপোষ্য নয়, বাপের কড়া শাসনে নিয়মিত কে সি নাগপোষ্য কিশোর, সে কথা বলে কোনও লাভ হবে কিনা।

নাম কী তোর ?

শা শা ...

দেব স্যার ? দেখুন আবার আপনাকে খিস্তি দেবার চেষ্টা করছে। বাহানচোদ...

চুপ করো দত্ত। আমাকে হ্যান্ডেল করতে দাও।

মারুন স্যার, আপনিই হ্যান্ডেল মারুন। দেখুন কিছু বেরোয় কিনা।

হ্যাঁ বল, কী নাম তোর ?

শাশ্বত সরকার। বাবার নাম ...

জানি, তোর বলতে হবে না। অনিল সরকার। এই এরিয়ার প্রত্যেকের ঠিকুজিকুষ্ঠি আমাদের জানা আছে। এত রাতে এখানে কী করতে এসেছিলি ? তুই জানিস না আজ এখানে একজনকে কুপিয়ে মারা হয়েছে।

তৎ... তখন আসতে সাহস হয়নি, এখন ভাবলাম একবার দেখে আসি জায়গাটা।

দেখাচ্ছি তোকে। দত্ত, একে জিপের পেছনে বসাও। ওই বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় চলো।

দত্ত বুঝে গেল বাঁশঝাড়ের সামনে নামিয়ে একেও একই চিত্রনাট্য অনুযায়ী বলা হবে – যা পালা, ছেড়ে দিলাম তোকে। তারপর প্রাণভয়ে যেই ছুটতে শুরু করবে, পেছন থেকে সরকারি বুলেট পিঠ ফুটো করে দেবে। স্যারের হাত বড় চমৎকার। কালই কাগজে বেরোবে মিথ্যে এনকাউন্টারের গল্প।

বাঁশঝাড়ের পাশে অন্ধকারে জিপ দাড় করাল ড্রাইভার গুরুং। চোখের সামনে কত মার্ডার দেখল সে। শাশ্বতকে নিয়ে দত্ত নেমে এসেছিল। জিপের সামনে হেডলাইটের আলোর বৃত্তে তাকে দাঁড়াতে বলল এস আই চৌধুরী। বলল – যা ভাগ, বাড়িতে গিয়ে পড়তে বোস। যা যা, পালা জলদি।

এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে প্রাণের ভয়ে দৌড়তে শুরু করেছিল শাশ্বত। গাড়ির আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল প্রাণের ভয়ে মানুষ কেমন করে পালাতে চায়। দত্ত অপেক্ষা করছিল স্যারের নিখুঁত অ্যাক্‌শনের জন্য। স্যার এসে গাড়িতে বসে রইলেন। পালিয়ে বাঁচতে-চাওয়া ওই শরীরটার প্রতি তার কোনও আগ্রহ দেখা গেল না।

ছেড়ে দিলেন স্যার ? হতাশ গলায় দত্ত বলেছিল।

ধুস্‌ ওটা আর ম্যাক্সিমাম একমাস বাঁচবে। ফালতু একটা সরকারি বুলেট খরচ করে কী লাভ ? বুঝতে পারছ না, এটার নকশাল হওয়ার মত মুরোদ নেই। নকশাল হতে গেলে হেবি দম লাগে। শালা, প্রথম দিকে ফোর্সের মনোবলই ভেঙে দিয়েছিল। বউ দিনরাত কাঁদত। চাকরি ছেড়ে দিতে বলত। শ্বশুর কালীঘাটে পুজো দিয়ে এসেছিল।

শাশ্বত পালিয়ে যাওয়ার পর হয়তো এ রকমই কথাবার্তা হয়েছিল ওদের ভেতর। অনেক পরে শাশ্বত জেনেছিল সেই এস আই ছিল তার বাবার ছাত্র। এই শক্তিনগর কলোনি গড়ে ওঠার সময় বিনয় চৌধুরীও অনিল সরকারের সঙ্গে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছে। সেই বিনয় চৌধুরীর ছেলে এখন এস আই আয়ুষ্মান চৌধুরী।

0 comments:

0

প্রাচীন কথা - দোলা সেন

Posted in


প্রাচীন কথা


পঞ্চকন্যা - তারা
দোলা সেন 


অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাপম বিনাশনম॥

এই পঞ্চকন্যা নিয়ে আমার বিস্ময় আর ফুরায় না। এক তো সেই পুরুষশাসিত যুগে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ দেখে তাবড় তাবড় বীর ও জ্ঞানী পুরুষেরা চুপ করে বসে থাকেন। স্ত্রীকে হাতি ঘোড়া রথের মতোই বাজি রাখেন একপঞ্চমাংশের স্বামী। আবার নিজ শৌর্যের পরিচয় দিতে স্ত্রীকে উদ্ধার করার পরেও তাকে এমনই কটু অপমানজনক কথায় বিদ্ধ করেন তথাকথিত ঐশ্বরিক পুরোষোত্তম যে, রমণী ধিক্কারে, ঘৃণায় আগুনে ঝাঁপ দেন। আবার সেই যুগেই এই শ্লোক? দুই মহাকাব্যে এত অজস্র ঋষি মুনি রাজা মহারাজা থাকতে সর্বপাপ বিনাশ করতে পাঁচজন নারীকে বেছে নিতে হল শাস্ত্রকারদের? কিন্তু কেন? এই প্রশ্ন আমায় তাড়া করে বেড়ায়। আবার এই নির্বাচনে এমন পাঁচজনকে খুঁজে বের করা হয়েছে যাঁরা স্বীয় চরিত্রবলে ভাস্বর। সবচেয়ে বড় চমক বোধহয় এই শেষ দুই নির্বাচনে। সেখানে শ্লোককার আর্য অনার্যের সীমানা ছাড়িয়ে মানবতার অঙ্গনে উপস্থিত হয়েছেন। তীব্র বর্ণবৈষম্যকে পার করে তিনি খুঁজে নিয়েছেন, কাব্যে উপেক্ষিতা দুই অনার্য নারীকে। তারা এবং মন্দোদরী।

রামায়ণ যেহেতু মহাভারতের চেয়েও ভারতবাসীর অনেক প্রাণের কাছের জিনিস, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের জনজীবন তাদের আপন আপন সংস্কৃতি, আচার, মনন অনুযায়ী কাহিনীকে তাদের আপন রসে জারিত করে নিয়েছে অনেক বেশি পরিমাণে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় তার চেহারা এতোটাই বদলে গিয়েছে যে একের সঙ্গে আরেকজনের মিল পাওয়া দুস্কর। তাই মোটামুটিভাবে আমি বাল্মীকি রামায়ণের চলিত রূপটাকেই আশ্রয় করেছি। তবে বিভিন্ন অঞ্চলের রূপবদল যে আমার লেখা বা ভাবনাকে প্রভাবিত করে নি একথা বললে নেহাতই মিছে কথা বলা হবে।

তার এবং মন্দোদরী। আজকের যুগেও যখন এই দুই মানবীর কথা পড়ি, তখন আধুনিকতার সংজ্ঞাটা আরেকবার বুঝে নিই। পুরুষের অন্তরালে বাস নয়, পাশে বসে কর্মক্ষেত্রের ভার নিয়েছেন, এই দুই নারী। বিশেষ করে তারার কথা ভাবতে গেলে আমার বারবার চিত্রাঙ্গদার কথা মনে পড়ে। যুগের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকা এই নারীকে বুঝতে গেলে সেই সামাজিক প্রেক্ষপটটির একটি রূপরেখা আমাদের জানা প্রয়োজন।

তারার জন্ম বানরবংশে। এখানে বানর বলতে অবশ্যই গাছের বানর নয়। সে সময় অনেক অনার্য সম্প্রদায় নিজেদের প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন পশুপাখীর টোটেম ব্যবহার করত। যেমন বানর, সর্প, পক্ষী ইত্যাদি। প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি থাকা এই মানুষগুলির রুচি, শিক্ষা, সামাজিক রীতি আর্যদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা ছিল। শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর যোগদানের কোন বাধা ছিল না বলেই মনে হয়। অন্তত তারার ব্যক্তিত্ব এবং তার সর্বজনগ্রাহ্যতা দেখে আমার এমনটাই মনে হয়েছে। গোষ্ঠিপতি পুরুষই হতো। কোন নারীর স্বামী মারা গেলে তার উপর স্বামীর ভাইয়ের অধিকার স্বীকৃত ছিল। তবে ভাই জীবিত থাকলে তার পত্নীকে অধিকার করা নিন্দনীয় এবং পাপ বলে পরিগণিত হতো। পারিবারিক আনুগত্য, ভাইয়ে ভাইয়ে সদ্ভাব কাম্য ছিল। গোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণভাবে গোষ্ঠিপতি বা রাজার বশ্যতা স্বীকার করে চলত।

অহল্যা বা দ্রৌপদীর মতো দৈবী কৃপায় জন্মাননি তারা। এমন কি কুন্তীর মতো রাজার ঘরেও নয়। তিনি বানরবৈদ্য সুষেণের কন্যা। অপুর্ব রূপশালিনী এই কন্যাটি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী এবং সর্বশাস্ত্রে পারঙ্গমা। বিভিন্ন সময়ে তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় আমাদের বিস্মিত করে। কিস্কিন্ধ্যার অধিপতি বানররাজ বালী তার স্বামী। প্রবল পরাক্রমী এই পুরুষটি তাঁর স্ত্রীর বিচক্ষণতা ও বিচারবোধে মুগ্ধ। তারার পরামর্শে বানররাজ্য ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সবই ঠিকঠাক চলছিল। কাল হলো বালীর শক্তির গর্ব আর ভয়ঙ্কর রাগ। সেখানে আঘাত লাগলে স্ত্রীর কথায় বিন্দুমাত্রও কর্ণপাত করেন না বানররাজ।

একদিন রাতে তিনি ঘুমোচ্ছেন – রাজবাড়ির দরজায় দানব দুন্দুভির বেজায় হাঁকডাকে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। কী ব্যাপার! না, অসীম বলশালী এই দানব শুনেছে, এই পৃথিবীতে তার সমক্ষ একজনই আছে। তার নাম বানররাজ বালী। বালীকে হারাতে পারলেই সে এই জগতের শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী বলে বিবেচিত হবে। তার এক্ষুণি লড়াই চাই।

রাতদুপুরে ঘুম ভেঙে এসব শুনতে কারই বা ভালো লাগে। বালীরও লাগলো না। তারা যতই নিষেধ করুক, এখনই এই অভদ্র দানবটাকে উচিত শিক্ষা দিতে তিনি কৃতসংকল্প।

অতএব লড়াই হলো। বালী জিতলেন এবং দুন্দুভিকে মাথার ওপর তুলে বাঁই বাঁই করে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বহুদূরে। রাগ আর রাত দুয়ে মিলে দিক বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তিনিও পারলেন না। কপাল খারাপ হলে যা হয়। দুন্দুভির দেহ গিয়ে পড়ল ঋষ্যমূক পর্বতে। সেখানে তখন মার্তণ্ড মুনি তাঁর শিষ্যদর নিয়ে যজ্ঞ করছিলেন। তাঁর পুজো পণ্ড হলো। তিনি বেজায় রেগে শাপ দিলেন – এই ঋষ্যমূক পর্বতের ধারেকাছে আসলেই বালীর মৃত্যু অবধারিত।

কি আর করা যাবে! সারা পৃথিবীতে ঐ একটিমাত্র জায়গা বালীর অনধিগম্য হয়ে রইলো।

কিন্তু লড়াই করতে যে ভালোবাসে, সে নতুন প্রতিপক্ষ খুঁজে নেবেই।। এবারে বালীর লড়াই মায়াবীর সঙ্গে। মায়াবী দুন্দুভির ভাই। ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নিতে সে এসেছে বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। কিন্তু যুদ্ধে হার নিশ্চিত দেখে মায়াবী পালাতে গেল। ততক্ষণে বালীর রোখ চেপে গেছে। তিনি ভাই সুগ্রীবকে নিয়ে মায়াবীর পিছু ধাওয়া করলেন। ছুটতে ছুটতে মায়াবী এক গুহার মধ্যে আশ্রয় নিল। তখন সুগ্রীবকে গুহামুখে পাহারায় রেখে বালী ভিতরে ঢুকলেন। ভাইকে বলে গেলেন, গুহামুখ থেকে যদি সাদা রক্ত বের হয় তাহলে জানবে মায়াবী মেরেছে। তখন তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আর যদি দেখ লাল রক্ত বের হচ্ছে তাহলে বুঝবে আমি নিহত হয়েছি। সেক্ষেত্রে তুমি এই গুহামুখ বন্ধ করে রাজ্যে ফিরে যাবে এবং রাজা হয়ে সবার খেয়াল রাখবে।

দিন যায়। গুহার ভিতর কি হচ্ছে কেউ জানে না। বাইরে বসে বসে অধৈর্য হয়ে পড়েন সুগ্রীব। ক্ষমতার লোভও কি কাজ করে ভিতর ভিতর? যাই হোক, সুদীর্ঘ আঠাশ দিন (মতান্তরে একবছর) পরে গুহামুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে এল লাল রক্ত! সুগ্রীব তড়িঘড়ি গুহার মুখে বিশাল এক পাথর চাপা দিয়ে রাজ্যে ফিরে এলেন। তাঁর মুখে সব শোনার পর বানরকুল তাঁকেই রাজা বলে মেনে নিল। সমাজের নিয়মমতে তারা এখন তাঁর মহিষী!

এদিকে হয়েছে কি, প্রথমটায় গুরুতর আহত হলেও বালী আসলে মরেননি! আরও অনেকদিন তিনি মায়াবীর সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করলেন। লড়াই করতে করতে তাঁর একদমই সময়ের খেয়াল নেই। তিনি জানেনই না এর মধ্যে কতোদিন পেরিয়ে গেছে। এইবার তাঁর ফেরার পালা। কিন্তু বেরোতে গিয়ে তিনি ভীষণ অবাক! গুহামুখ বন্ধ কেন? ভাই সুগ্রীবের তো এখানেই অপেক্ষা করার কথা! অতিকষ্টে তিনি পাথর সরিয়ে বাইরে এলেন। তারপর একটু সুস্থ হলে রওনা দিলেন কিস্কিন্ধ্যার উদ্দেশ্যে।

রাজসভায় ঢুকে তো তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! সুগ্রীব রাজসিংহাসনে! পাশে আবার তারা! বালী রাগে অন্ধ হয়ে গেলেন। সুগ্রীব কতো বোঝালেন, মাপ চাইলেন, রাজ্য ফিরিয়ে দিতে চাইলেন – কিন্তু বালীর কানে তার কিছুই ঢুকলো না। অন্যরাও চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন ফল হলো না। তখন উপায়ান্তর না দেখে প্রাণ বাঁচাতে সুগ্রীব রাজ্য ছেড়ে ঋষ্যমূক পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। পৃথিবীর এই একটিমাত্র স্থান বালীর হাত থেকে সুরক্ষিত।

বালী আবার রাজা হলেন। সুগ্রীবকে শাস্তি দিতে তিনি সুগ্রীবের বৌ রুমাকে অধিকার করলেন। তারা বারবার মানা করলেন, বোঝাতে চেষ্টা করলেন – এ অন্যায়, এ পাপ। জীবিত ভাইয়ের স্ত্রীতে উপগত হওয়া সামাজিকভাবেও অতি নিন্দনীয়। সুগ্রীব তারাকে মহিষী বানিয়েছিল বটে, কিন্তু সে তো বালীর মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে।

তা রাগ, না চণ্ডাল! রেগে গেলে কবেই বা তারার কথা শুনেছেন বালী? বারবার বিপদে পড়েও তাঁর চৈতন্য হয়নি। অতএব তিনি তাই করলেন যা তাঁর মন চায়। আর এই অন্যায় আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বানরসমাজের প্রমুখ – মহাবীর হনুমান, রাজবৈদ্য সুষেণ, নীলের মতো বিশিষ্ট শক্তিশালী কয়েকজন - তাদের অনুচরদের নিয়ে ঋষ্যমূক পর্বতে সুগ্রীবের কাছে চলে গেলেন।আত্মগর্বী বালী দৃকপাতও করলেন না।

দিন যায়। এর মধ্যে অযোধ্যা থেকে নির্বাসিত হয়েছেন পরমপুরুষ রাম। তাঁর চোদ্দ বছর বনবাসের সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তাঁর পত্নী সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেছেন রাক্ষসরাজ রাবণ। কিন্তু কোথায় যে তিনি সীতাকে লুকিয়ে রেখেছেন কেউ জানে না। সেই খোঁজে ছোটভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে তিনি এসে পৌঁছেছেন ঋষ্যমূক পর্বতে। সুগ্রীব দেখলেন এই সুযোগ। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, রাজ্য ফিরে পেলে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে সীতাকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করবেন। রামেরও তখন লোকবলের একান্ত প্রয়োজন। কাজেই চুক্তি হতে দেরি হলো না।

রামের ভরসায় সুগ্রীব ঋষ্যমূক পর্বতের আশ্রয় ছেড়ে বাইরে এসে বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। তারা রামের ঋষ্যমূক পর্বতে আসর খবর রাখতেন। দুয়ে দুয়ে চার করতে তাঁর মতো বুদ্ধিমতীর ভুল হল না। বারবার তিনি বালীকে বারণ করলেন। বললেন, সুগ্রীবের মতো ভীতু মানুষ যখন এই দুঃসাহস করছে তখন তার পিছনে নিশ্চয় রামের মদত আছে। রাম নিশ্চয় কোন না কোনভাবে এই যুদ্ধে বালীকে মারার চেষ্টা করবেন। অতএব বালীর উচিত এই আহ্বানে সাড়া না দেওয়া।

বালী শেষবারের মতো তারার অবাধ্য হলেন। তিনি সুগ্রীবের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ে যোগ দিলেন। চুক্তি অনুযায়ী রামচন্দ্র আড়াল থেকে তীর মেরে বালীকে ধরাশায়ী করলেন। অমিত শক্তিধর বালী কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ বেঁচে ছিলেন এর পরেও। তিনি প্রথমে রামকে একহাত নিলেন কাপুরুষের মতো পিছন থেকে আঘাত করায়। তারপর বললেন – সীতার খোঁজ নেবার জন্য এই চাতুরির কোন দরকার ছিল না। আমাকে বললে আমিই রাবণকে মেরে তোমার সীতা উদ্ধার করে দিতাম। বালী কাউকে ফেরায় না।

ইতিমধ্যে রাজবাড়িতে খবর পৌঁছেচে। শোকে আকুল হয়ে তারা ছুটে আসছেন রণক্ষত্রে। পথের মাঝে তাকে আটকাল বালীর অনুগত বানরের দল। তারা তারাকে নিয়ে রাজধানী সুরক্ষিত করতে আগ্রহী। দাদার হত্যাকারীর হাত থেকে সিংহাসন বাঁচানোর এই একমাত্র উপায়। তারা দৃঢ়স্বরে জানালেন, বালীই যদি না থাকেন, তাহলে তারার কাছে রাজ্যের কোন মূল্য নেই। তিনি বালীর কাছেই যেতে চান। শত অঙ্গদও( তারা ও বালীর পুত্র) বালীর কাছে তুচ্ছ।

এরপর তিনি পৌঁছালেন বালীর কাছে। তাঁর দুঃখের কান্নায় পাথরের চোখেও জল আসে। সুগ্রীব তো সামান্য বানর। তার অনুতাপের অবধি রইলো না। তারা রামকে বললেন – আর দেরি কেন হে পুরুষোত্তম। যে তীরে আমার স্বামীকে হত্যা করেছেন, সেই তীরে আমাকেও বিদ্ধ করুন। আমি ছাড়া বালী স্বর্গেও ভালো থাকতে পারবে না। আমি শুধু তার সঙ্গেই থাকতে চাই।

তারার কান্নায় রামচন্দ্রও বিচলিত হয়ে পড়লেন। হনুমান তারাকে অনেক প্রবোধ দিলেন। অঙ্গ আর রাজ্যের কথা ভাবতে বললেন বারবার। এমন সময় বালী কথা বললেন –

- ভাই সুগ্রীব, যদি আমরা ভাই ভাইয়ে লড়াই না করে মিলেমিশে থাকতাম, তাহলে আমরা অজেয় থাকতাম। সময়ে তা করা হল না। এখন তুমি রাজ্য ও তারাকে ভোগ করো। তারা অত্যন্ত দূরদর্শী। সবসময় তার কথা শুনে রাজ্য চালনা করো। রাজ্যের এবং তোমার মঙ্গল হবে। অঙ্গদ আমার খুব আদরের। তার যত্ন নিও।

আর অঙ্গদ, তুমি কাকার কথা মান্য করে চলো। তার অনুগত থেকো। তার প্রিয়সাধন করো।

এইসব বলে বালি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আর তারা? মৃত্যুকালে বালী রাম, অঙ্গদ এমনকি সুগ্রীবের সঙ্গেও কথা বললেন, কিন্তু তারার জন্য তাঁর মুখ থেকে একটি বাক্যও বের হলো না! অথচ তারাকে কিভাবে ব্যবহার করলে সুগ্রীব উপকৃত হবেন, তার টিপস দিতে ভুললেন না। তারা কি ভেবেছিলেন, তাঁর মনে কিসের আলোড়ন উঠেছিল, সে বিষয়ে মহাকবি একান্তই নীরব।

গুণীজন, অপরাধ নেবেন না, যদি এইখানে একটি মেয়ের মন দিয়ে আমি তারাকে বুঝতে চাই। তারা দেখলেন তিনি একা। যে স্বামীর জন্য তাঁর কাছে নিজের এমনকি একমাত্র ছেলের জীবনও তুচ্ছ মনে হয়েছিল, তিনি রাজ্যের সঙ্গে স্ত্রীকেও সঁপে দিলেন ভাইয়ের হাতে। নাকি বালীর অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল? কিছু কি বার্তা তিনি দিলেন তারাকে? চিরকালের প্রেমিক স্বামী হঠাৎ করে মৃত্যুমুখে এভাবে মুখ ফেরান যদি, তাহলে তার অবশ্যই কোন গূঢ় কারণ আছে। হঠাৎ করে পুরো দৃশ্যের আর একটি অর্থ তাঁর সামনে প্রতিভাত হল।

বালীর সাহায্যে সীতা উদ্ধার করলে রামের কোন কৃতিত্ব থাকে না। কারণ বালী একাই পুরোটা সামলে নেবেন। সে জায়গায় এই মেরুদণ্ডহীন সুগ্রীবকে রাজা করলে তিনি বাস্তবে সম্পূর্ণ বানর বংশকে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছেন। এখানে উদ্ধারের সব কৃতিত্ব রামচন্দ্রের। অঙ্গদ ও বানররাজ্যের গভীর সংকট এখন। তাই নিজেকেই নিজে শান্ত করলেন তারা। রামচন্দ্রের বন্দনা করে নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করলেন। রামও নিজের কৃত অন্যায় শোধনের একটা রাস্তা পেয়ে গেলেন। তিনি সুগ্রীবের রাজ্যভিষেকের সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গদের যৌবরাজ্যে অভিষেকও করালেন। তারা বুঝলেন বানরজাতি ও ছেলেকে বাঁচাতে হলে এ ছাড়া আর পথ নেই। তাই তিনি সুগ্রীবের মহিষীর পরিচিতিটা মেনে নিলেন।

এখানে তারার যে স্থিতপ্রজ্ঞার পরিচয় আমরা পাই, তা সত্যিই অবাক করার মতো। এরপর আমরা দেখবো তাঁর ক্ষুরধার কূটনৈতিক চালে কিভাবে বশীভূত হন লক্ষ্মণ।

সুগ্রীব রাজা হয়ে যথারীতি আমোদে গা ভাসালেন। রুমা, তারার মতো সুন্দরী যাঁর গৃহে, সে তো শ্রেষ্ঠ রম্য নিকেতন। বনবাসী রামের কথা, সীতা উদ্ধারের কথা তাঁর মনেই রইলো না। তারা অবশ্য বারে বারে মনে করিয়ে দেন পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা, না মানলে কী কী বিপদ হতে পারে সে কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল দুই ভাইয়ের অবাধ্য হবার ব্যাপারে অন্তত বেশ মিল রয়েছে।

কিছুদিন বাদে সীতা উদ্ধারের কোন তোড়জোড় না দেখে রেগে গিয়ে রাম লক্ষ্মণকে পাঠালেন বিষয়টা সরোজমিনে তদন্ত করে দেখে আসতে। লক্ষ্মণ এসে দেখেন সুগ্রীব সুরায় ও নারীতে আকণ্ঠ ডুবে রয়েছেন। এমনকি নেশার ঘোরে লক্ষ্মণের সঙ্গেও যে ব্যবহার করলেন, সেটা ভোটে জেতার পরে নেতারা জনতার সঙ্গে যেমনটি করে থাকেন। লক্ষ্মণ স্বভাবতই খুব রেগে গেলেন। তারা দেখলেন সমূহ বিপদ। রাম আর্যবংশের মহান প্রতিভূ। তাঁকে চটালে বানররাজ্যের সর্বনাশ কেউ ঠেকাতে পারবে না। অতএব তিনি পরিস্থিতির হাল ধরলেন।তিনি লক্ষ্মণকে যথাবিহিত আপ্যায়ন করে বললেন –

- আপনি পরম জ্ঞানী। এই তুচ্ছ বানরের উপর রাগ করা আপনার শোভা পায় না। সুগ্রীব সামান্য বানর। তার উপর রাজার ভাই হয়েও দীর্ঘদিন বনে জঙ্গলে বহু দুঃখ কষ্টে দিন কাটিয়েছে। সে তো আপনি জানেন। তাই হঠাৎ এই বিলাস ব্যাসন পেয়ে একটু বিস্মরণ ঘটেছে মাত্র।

- আমি সামান্যা নারী হয়ে আপনাকে কী বোঝাবো। নারীর মোহে যুগে যুগে কতো বড় বড় মুনিঋষির তপোভঙ্গ হয়েছে সে আমার চেয়ে আপনি অনেক বেশি জানেন। আর এ তো বনের বানর। তার সেই শিক্ষাই বা কোথায়?

এইসব বলে টলে তারা যখন দেখলেন লক্ষ্মণ একটু নরম হয়েছেন, তখন তিনি তাঁর ব্রহ্মাস্ত্রটি বের করলেন। মধুরভাষে জানালেন, একা হাতে সীতা উদ্ধার করা সম্ভব হলে, রামের মতন বীর কখনো সুগ্রীবের মতো সামান্য বানরের সঙ্গে মৈত্রীতে আবদ্ধ হতেন না। সুগ্রীবের যেমন রামকে প্রয়োজন, রামেরও সুগ্রীব ও তার সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজন।

লক্ষ্মণ শান্ত হলেন। ইত্যবসরে সুগ্রীব এসেও ক্ষমা টমা চেয়ে পরিস্থিতি সামলে নিলেন। তারার কূটনৈতিক বুদ্ধি সুগ্রীব তথা বানর জাতিকে রক্ষা করল। এরপরে রামায়ণে আর তারার কোন উল্লেখ পাই না। তাঁর আরব্ধ কাজ করে তিনি আবার কাব্যের অন্তরালে চলে গেলেন।

সত্যিই কি গেলেন? তাহলে পঞ্চকন্যার নাম করতে গিয়ে এই ধীময়ী দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ রমণীর কথা শ্লোককারের মনে পড়ত না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে জানেন – সীতা যখন রামের কটু অপমান সহ্য করতে না পেরে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছিলেন, তখন এই অসামান্য নারীটির ভাবনা কেমন ছিল? মহাকবি সে বিষয়ে কোন ইঙ্গিত দেননি।

0 comments: