0

সম্পাদকীয়

Posted in



সম্পাদকীয়



গ্রীষ্মস্ তে ভূমে বর্ষাণি
শরদ্ হেমন্তঃ শিশিরো বসন্তঃ।
ঋতবস্ তে বিহিতা হায়নীর্
অহোরাত্রে পৃথিবি নো দুহাতাম্ (অথর্ববেদ। কাণ্ড ১২। সুক্ত ১। শ্লোক ৩৬।) 

গ্রীষ্ম তোমার, ওগো ভূমি, বর্ষা শরৎ হেমন্ত
শিশির এবং বসন্ত
বাঁধাধরা এই ঋতুরা, বছরগুলি, দিন ও রাত
মোদের 'পরে, ও পৃথিবী, দুধের ধারা ঝরঝরাক (অনু. গৌরী ধর্মপাল) 

গ্রীষ্ম তার উপস্থিতি প্রবলভাবেই জানান দিচ্ছে। এই গ্রীষ্মে ঋতবাক চায় যে তার সকল ঋতব্রতী আপনজন বঙ্গবাণীর মাতৃদুগ্ধের ধারাস্নানে সিক্ত হোন। আজ থেকে ছিয়ানব্বই বছর আগে এই গ্রীষ্মেই জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায় (০২.০৫.১৯২১ ---২৩.০৪.১৯৯২)। ঋতবাক এই সংখ্যায় তাঁকে স্মরণ করছে। আমাদের তৃতীয় বর্ষ, দশম সংখ্যার নাম সত্যজিৎ সংখ্যা। 

এই সংখ্যা থেকে শুরু হলো ঋতবাকের নতুন বিভাগ 'আলাপ বিস্তার'। জীবনের এক অন্যতর অভিজ্ঞতা - সরাসরি। 

একটা অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করছে। গত ৫ই মে, দুপুর ১.৩০ আমরা গিয়েছিলাম আশানিকেতনে। এফ-এম-আর (Fellowship with Mentally Retarded)ইন্ডিয়ার অধীনে ১৯৭২ সালে ব্যাঙ্গালোরে শুরু হওয়া আশানিকেতনের এখন ভারতে মোট ৫টি শাখা। ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, কেরালা, কলকাতা, আসানসোল। ১৯৭৩এ কলকাতার আশানিকেতন শুরু হয় একা কাশীদাকে নিয়ে। এখনও আছেন কাশীদা। বয়স হয়েছে। আর্থারাইটিসের ব্যাথাটা মাঝে মাঝেই বড় কাবু করে ফেলে। 



'সরকারী সাহায্য পাওয়া যায়না কিছুই। আসলে ওদের প্রোডাক্টিভিটি তো তেমন বেশি নয়! সরকার প্রোডাকশন চায়।' ওয়ার্কশপ আর শোরুম দেখাতে দেখাতে বলে চললেন সুব্রতাদি। 'অনেক খরচ, জানেন। সবচেয়ে বেশি খরচ ওষুধের। সকলেরই প্রায় মৃগীর সমস্যা। ডে-কেয়ার আর রেসিডেন্স্যিয়াল মিলিয়ে ১১৫ জন ওরা। সকলকেই চেষ্টা করি ওষুধটুকু অন্তত দিতে। পুরোটা না পারলেও, খানিকটা। পুজোর সময় নতুন জামা দেওয়ারও চেষ্টা করি। প্রতি বছর সবাইকে পারিনা। গতবছর পেরেছিলাম, জানেন! টাকা জোগাড় করতে পেরেছিলাম।'

'কতজন থাকেন এখানে?' -জানতে চাই
'১৬ জন। ওদের সব খরচ আমাদের। আগে আগে একটা ফেসবুক গ্রুপ এই ১৬ জনের ব্রেকফাস্টের খরচটা দিতো। তারপর গ্রুপটাই ভেঙ্গে গেল।'
'কত খরচ হয় মাসে?''
'ব্রেকফাস্টের জন্য? মাসে দু'হাজার টাকা'

এলাম কম্যিউনিটি হলে। সেখানে তখন অপেক্ষাকৃত বড়রা প্রার্থনা করছেন। পুরো হলটার সবকটা দেওয়াল জুড়ে সব ধর্মের প্রতীক চিহ্ন। সর্ব ধর্ম সমন্বয় এখানে চর্চা করানো হয়। ওদের বিশাল বিশাল হৃদয়ের উত্তাপে ওরা হিংসা-গ্লানি-অসম্মান-পরাজয়-কুটিলতার বিষ-পাঁক নীলকন্ঠের মতো শুষে নিতে জানে। নিজেদের বড় শুদ্ধ মনে হচ্ছিল। নিজেদের কাছেই নিজেরা কথা দিয়েছি, ওদের জন্য কিছু একটা করব। কি করব, জানিনা। কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে। আপনারাও আছেন  সঙ্গে, বুঝেছি। এরই মধ্যে পেয়েছি সাহয্যের প্রতিশ্রুতি এবং বেশ কিছু চেক  FMR INDIA-র নামে। আরও যাঁরা সাহায্য করতে চান,  FMR-INDIA-র নামে একটা অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক পাঠাতে পারেন,  SWAPAN DEB, 16B RAJA NABA KRISHNA STREET, KOLKATA-700005 -এই ঠিকানায়। চেকের সঙ্গে একটা আলাদা কাগজে আপনার নাম, মোবাইল নং এবং মেল আইডি লিখে দেবেন। পাঠানোর আগে মোবাইলে চেকের একটা ছবি তুলে রাখবেন। চেকে তারিখ বসাবেন না। যাঁর চেক তাঁকে জানিয়েই চেক ব্যাঙ্কে ফেলা হবে।

সঙ্গে থাকার কথা বলতে মনে এল আগামী ১৮ই জুনের কথা। ঐ দিন ৩ আষাঢ়, ১৪২৪ ঋতবাক বর্ষাবন্দনা করবে শোভাবাজার রাজবাড়ীর গোপীনাথ জিউয়ের নাটমন্দিরে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে আর প্রকাশ পাবে ঋতবাকের পাঁচটি বই। আপনারা আসছেন নিশ্চয়ই? 

সকলে ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন। 

শুভকামনা নিরন্তর।

0 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


সত্যজিৎ রায় : জীবন ও সৃষ্টি
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের পিতৃপুরুষ আর পিতা সুকুমার ছিলেন ‘শিশুসাহিত্যের প্রবাদ-পুরুষ’ এই পরিচয়ের বাইরে এদেশে আধুনিক মুদ্রণ প্রযুক্তি প্রয়োগের পথিকৃত ও লন্ডনের ‘ফেলো অফ রয়াল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি’। উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত সন্দেশ পত্রিকার সমস্ত ছবি সুকুমারই আঁকতেন। পূর্বজ দুই পুরুষের সমস্ত প্রতিভার অত্যাশ্চর্য সম্মিলন ঘটেছিল সত্যজিতের মধ্যে। পিতার মৃত্যুর সময় সত্যজিৎ ছিলেন দু বছর চার মাসের শিশু আর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয় তাঁর জন্মেরও ছ বছর আগে। 

সুকুমার রায়ের অকাল মৃত্যুর পর ওদের পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত পারিবারিক ব্যবসা ‘ইউ রায় এন্ড সন্স’ দেউলিয়া ঘোষিত হয় এবং নামমাত্র মূল্যে নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। পারিবারিক ভাঙনের ফলে শিশুপুত্র সত্যজিৎকে নিয়ে মা সুপ্রভা আশ্রয় নেন ভবাণীপুরের বকুল বাগানে ভাই প্রশান্ত কুমার দাসের গৃহে। সুপ্রভা ‘বিদ্যাসাগর বাণীভবন বিধবাশ্রম’এ সেলাইএর কাজ করে সংসার নির্বাহের চেষ্টা করেন। চাকুরী নেন একটি স্কুলে এবং সেলাইএর কাজ করেন। সত্যজিৎ মাতুলালয়েই বেড়ে ওঠেন। বালিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন ১৯৪০এ । কলেজ ছাত্র থাকাকালীন চলচ্চিত্র ও সংগীত বিষয়ে আগ্রহ জন্মায় তাঁর। মার্চ ১৯৪৯এ বিবাহ করেন সম্পর্কে মামাতো বোন বিজয়া দাসকে।

মায়ের ইচ্ছা, পুত্র তাঁর গুরুদেবের বিশ্বভারতীতে শিক্ষা লাভ করুক, সত্যজিতের তেমন আগ্রহ ছিল না কলকাতার টানে। মায়ের ইচ্ছাতে সত্যজিৎ সম্মত হয়েছিলেন বিশ্বভারতীর কলাভবনে ভর্তি হতে। ১৯৪০এর ১৩ জুলাই ভর্তি হলেন ‘কলাভবন’এ। সেখানে আচার্য নন্দলাল বসু ও বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছে ফাইন আর্টএর শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর আগ্রহ ছিল কমার্শিয়াল আর্টস’এ দক্ষতা অর্জন করা। বিশ্বভারতীতে পাঁচ বছরের কোর্সে ভর্তি হয়েও বিশ্বভারতীতে কমার্শিয়াল আর্টস শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় সত্যজিৎ, আচার্য নন্দলালের অনুমতি নিয়ে বিশ্বভারতীতে তার শিক্ষা শেষ করেন তিনবছর পরেই। ১৯৪৩এর এপ্রিলে কলকাতায় প্রখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারএর অফিসে ‘জুনিয়ার ভিসুয়ালাইজার পদে চাকরী পেয়ে যান, মাস মাইনা ৮০টাকা। পরে ওখানে পদোন্নতি হয়ে আর্ট ডিরেক্টর হয়েছিলেন।

গত শতকের চল্লিশের দশকটা ছিল বাংলার সারস্বতভূমির মহা সৃজনকাল। সাহিত্যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় – তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক, জীবনানন্দ দাস, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নৃত্যকলায় উদয়শঙ্কর, সঙ্গীতে শচীনদেব বর্মন প্রমুখ উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের পাশে শম্ভু মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীর মতো নবীনদের দীপ্তিতে আলোকিত বাংলার সারস্বতভূমি, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের সৃজনভূমিতে নতুন চেতনা ও বোধের স্পর্শ। সত্যজিৎ প্রতিভার বিকাশ এই আবহে। যদিও বাংলা চলচ্চিত্রে এই নবচেতনা ও বোধের ছোঁয়া তখনও লাগেনি। সত্যজিৎ রায়ের মনে যখন চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাবনা বাসা বাঁধছে তখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের বয়স সবে ত্রিশ পেরিয়েছে (প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনী চিত্র দাদাসাহেব ফালকের ‘হরিশচন্দ্র’/ ১৯১৩) আর বাংলা চলচ্চিত্র সবাক হয়েছে মাত্র ১৫ বছর আগে (১৯৩১)। হয়তো সেই কারণেই চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রটিই হয়ে উঠেছিল তাঁর অন্বিষ্ট। তখনকার বিশ্ব চলচ্চিত্রের সঙ্গে ভারতীয় সিনেমার মানের কোনও তুলনাই হয় না। চলচ্চিত্র যে এক শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম, এর যে জীবনের সাথে যোগ থাকতে পারে, জীবনের মূল সত্যকে যে চলচ্চিত্র স্পর্শ করতে পারে এই সত্যটা সেই সময়ের চলচ্চিত্রকারদের ছিল না। সত্যজিৎ রায়ই ‘পথের পাঁচালী’র মধ্য দিয়ে আমাদের তা বোঝালেন। এই অবদান সত্যজিৎ রায়কে আধুনিক ভারতীয় চলচ্চিত্রে অনন্য স্রষ্টার আসনে বসিয়েছে। ভালো সিনেমা নির্মাণের ভাবনা তাঁর মনে বাসা বাঁধে চল্লিশ দশকের মধ্যভাগে। ১৯৪৮এ কলকাতার ইংরাজি দৈনিক ‘দি স্টেটসম্যান’এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন “দি র মেটেরিয়াল অফ সিনেমা ইজ লাইফ ইটসেলফ। ইট ইজ ইনক্রেডিবল দ্যাট আ কাউন্ট্রি দ্যাট হ্যাস ইনস্পায়ার্ড সো মাচ পেইন্টিং এন্ড মিউজিক এন্ড পোয়েট্রি শুড ফেইল ট মুভ সিনেমা মেকার। হি হ্যাজ ওনলি ট কিপ হিজ আইস ওপেন” (উদ্ধৃতি সূত্র :’সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রে ও নেপথ্যে’/অসীম সোম)। ১৯৪৭এর অগস্টে সমমনা চলচ্চিত্রপ্রেমি বন্ধু চিদানন্দ দাশগুপ্ত (অভিনেত্রী অপর্ণা সেনের পিতা), হরিসাধন দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত (সত্যজিতের প্রায় সমস্ত ছবির শিল্প নির্দেশক) প্রমুখদের নিয়ে গঠন করেন ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’। সেখানে বিশ্বখ্যাত সিনেমাগুলি সংগ্রহ করে দেখতেন সিনেমা শিল্পের নানান দিক সম্পর্কে নিজেদের সমৃদ্ধ করতেন। সত্যজিৎ এই প্রসঙ্গে লিখেছেন ‘সাধারণত আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায় বসে আমরা ১৬ মিলিমিটারের ফিল্ম দেখতাম এবং যেসব ফিল্ম দেখতাম তার নানান দিক নিয়ে আলোচনা করতাম নিজেদের মধ্যে। আমরা প্রথম দেখেছিলাম আইজেনস্টাইনের ক্ল্যাসিক ছবি ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’। শোনা যায় বিশ্ববন্দিত এই ছায়াছবি ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ পঁচিশ তিরিশবার দেখেন। ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সূত্রে এইসময় তাঁর পরিচিতি ঘটে প্রখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাক রেনোয়াঁর সঙ্গে। রেনোয়া তখন তাঁর ছবি তাঁর ‘দ্য রিভার’ এর কিছু অংশের সুটিং’এর জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। সত্যজিৎ রেনোয়ার সুটিং দেখেছিলেন এবং কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। 

সত্যজিৎ যখন জেডি কিমারের বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে কাজ করছেন তখন সেখানে ভালো পদে কাজ করতেন ডি কে গুপ্ত, যিনি ‘সিগনেট প্রেস’ নামে প্রকাশনা সংস্থা খুললেন আর সিগনেট প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণের দায়িত্ব দিলেন সত্যজিৎকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে। সিগনেট হয়ে উঠলো বাংলা পুস্তকের অভিজাত প্রকাশনা সংস্থা। জীবনানন্দ দাস, সুধীন্দ্রনাথ দত্তর কবিতার বই, জওহরলাল নেহেরুর ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’, জিম করবেটের ‘কুমায়ূনের মানুষখেকো বাঘ’এর বইয়ের প্রচ্ছদ সিগনেট প্রেসকে প্রভূত খ্যাতি এনে দিল। চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁর আগ্রহের প্রথমে ভেবেছিলেন চিত্রনাট্যকার হবেন। ১৯৪৬এ ‘ঘরে বাইরে’ সহ কয়েকটি চিত্রনাট্য চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন। ‘ঘরে বাইরে’র চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন পরিচালক হরিসাধন দাশগুপ্তর জন্য। সে ছবি অবশ্য হয়নি, হয়েছিল তাঁর পরিচালনায় অনেক পরে, ১৯৮৪তে। 

১৯৫০এ সত্যজিৎ যে বিজ্ঞাপন কম্পানীতে চাকুরী করতেন তারা তাঁকে লন্ডনে কাজ করতে পাঠান। লন্ডনে তিনি ছিলেন ৬ মাস। এই ৬ মাসের ইউরোপ প্রবাস তাঁর মধ্যে সিনেমা নির্মাণের ভাবনাটি আরও উস্কে দেয়। সত্যজিৎ তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন ‘কলকাতায় যে সব ছবি দেখতে পাইনি এমন পঁচানব্বইটি ছবি দেখলাম পাঁচ মাসে। যেদিন লন্ডনে পৌছালাম সেদিনই দুটো ছবি দেখলাম কার্জন সিনেমায় ‘এ নাইট এট দি অপেরা’ ও দি বাইসাইকেল থিফ’। ঐ ছবি দেখেই আমি টের পেলাম স্টুডিওর বাইরে শুধু অপেশাদার অভিনেতা নিয়ে পরিচালক কী ঘটাতে পারেন। ভাবলাম যা ইতালিতে হতে পারে, তা কলকাতাতেও হতে পারে ...। লন্ডনে ‘দি বাইসাইকেল থিফ’ দেখে আমি স্থির করলাম নিওরিয়ালেস্টিক মেথডে আমি ‘পথের পাঁচালী’ করবো। এদিকে, পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেপু’ প্রকাশ করবে সিগনেট, তার ছবি আঁকার কথা সত্যজিতের। লন্ডন থেকে ফেরার পথে জাহাজে বসে ছবিগুলি আঁকলেন। আর এই ছবিগুলিই হলো তাঁর চলচ্চালীর ’পথের পাঁচালী’র এক একটি দৃশ্যের ফ্রেম - পথের পাঁচালীর প্রকৃত চিত্রনাট্য। ‘আম আঁটির ভেপু’র ছবি আঁকার সূত্রেই তাঁর প্রথম ‘পথের পাচালী’ পড়া। পড়ে অভিভূত হলেন এবং নিশ্চিত হলেন এই কাহিনী নিয়ে একটা ভালো ছায়াছবি করা যায়।

চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরি করে, প্রায় পাঁচশ স্কেচ এঁকে অনেক প্রযোজক, পরিবেশককে দেখালেন। কিন্তু কেউই এগিয়ে এলেন না, গুরুত্বই দিলেন না। এমন কি ‘নিউ থিয়েটার্স’ বাংলা ছায়াছবির ক্ষেত্রে যাঁরা পথিকৃত, যাঁদের ভারতজোড়া খ্যাতি, তাঁরাও না। তবুও সত্যজিতের অনন্য জেদ আর প্রত্যয় হার মানলো না। লিখছেন “ ১৯৫২ সালে স্থির করলাম যেমন করে হোক এ ছবি আমি করবোই”। তারপর সে এক ইতিহাস। মা ও স্ত্রীর অলঙ্কার, নিজের বইপত্র বিক্রি করে, বন্ধুদের থেকে ধার নিয়ে ছবির কাজ কিছুটা এগোলো। এক তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হওয়ার পর দেখলেন আর টাকার জোগান নেই। হতোদ্যম হয়ে পড়লেন। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সহানুভূতিশীল হয়ে এগিয়ে না এলে পথের পাঁচালী সম্পূর্ণ হতো না, বিশ্ব চলচ্চিত্রে ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পকলার অবদানও স্বর্ণাক্ষরে লেখা হতো না কোনও দিন। শেষ চেষ্টা হিসাবে সত্যজিৎ মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি একটা আবেদন জমা দিতে বললেন। প্রখ্যাত নাট্যকার মন্মথ রায় তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি উপদেষ্টা। তিনি অসমাপ্ত ছবিটি দেখলেন এবং উছ্বসিত প্রসংশায় আবেদনের অনুকূলে মত দিলেন। কিন্তু সরকারী আমলাতান্ত্রিক নিয়মে যা হয়, আবেদনটি মুখ্যমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য যাবার আগে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত আমলা পি এস মাথুরের কাছে গেলো। মাথুর লিখলেন এখন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রচার চলছে, সেই প্রচার অভিযানের মধ্যে এমন দুঃখ-দারিদ্রের ছবি দেখালে সরকারী প্রচার অভিযান ব্যর্থ হবে। মাথুরের বিরোধিতার ফলে বিধানচন্দ্র নিজে অসমাপ্ত’ ‘পথের পাঁচালী’ দেখলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্যাবিনেট অনুমোদন নিলেন যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ছবিটির প্রযোজনার দায়িত্ব নিল এবং পরিবেশকের দায়িত্ব দেওয়া হলো ‘অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন’কে। ছবি শেষ হলো, পরিবেশক ও ঠিক হয়েছে কিন্তু কলকাতায় কোনও চিত্রগৃহ পাওয়া গেলো না প্রদর্শনের জন্য। তামাম বিশ্ব বরণ করে নিয়েছিল যে চলচ্চিত্রকে ‘শ্রেষ্ঠ মানব দলিল’ রূপে, সেটি তার নিজের শহরে মুক্তি পেলো না, প্রথম মুক্তি পেল নিউ ইয়র্কের ‘মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট’এ – ১৯৫৫র এপ্রিলে। কলকাতায় মুক্তি পেল ১৯৫৫’র ২৬শে অগস্ট। তারপর বিশ্বচলচ্চিত্র ভুবনে আলোড়ন ফেলে দেওয়া সব বৃত্তান্ত বলে শেষ করা যাবে না। মজার কথা, ‘পথের পাঁচালী’র রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠাণে স্রষ্টা সত্যজিৎ আমন্ত্রিত ছিলেন না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে পুরষ্কার নিয়েছিলেন সেই আমলা মাথুর।

পথের পাঁচালী মুক্তি পাবার পর মুম্বাই চলচ্চিত্রের খ্যাতনাম্নি অভিনেত্রী নার্গিস এবং আরও কেউ কেউ বলেছিলেন সত্যজিৎ পথের পাঁচালীর মধ্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে ভারতের দারিদ্রকেই তুলে ধরেছেন। এই সব অর্বাচীন অপলাপ নিশ্চিতভাবেই তাঁদের অগৌরবের মাত্রাই বাড়িয়েছে, সত্যজিতের বিরাটত্বকে তিলমাত্রও খাটো করতে পারেনি। বাস্তবের দারিদ্র্যকে শিল্পের সত্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সত্যজিৎ। ‘পথের পাচালী’র হরিহর বুঝতে পারেননি যে যুদ্ধোত্তর গ্রামীণ সমাজেও বেঁচে থাকার পদ্ধতিরও বদল ঘটেছে। হরিহর চেয়েছিল পুজো-পাঠ করেই সংসার চালাতে, চেয়েছিল অপুও তাই করবে এটাই হরিহরের ট্রাজেডি। অপু ট্রিলজিতে হরিহরের ট্রাজেডি এবং সেই পরিমণ্ডল থেকে অপুর মুক্তির প্রয়াস আমাদের উত্তরণেরই চিত্র-ভাষ্য। ‘অপু ট্রিলজি’ থেকে ‘দেবী’, ‘জলসাঘর’ ‘জনঅরণ্য’ পেরিয়ে ‘সদগতি’, ‘শাখা-প্রশাখা’, ‘গণশত্রু’ থেকে শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ পর্যন্ত মানুষের উত্তরণের কথাই সত্যজিৎ বলে গিয়েছেন।

সত্যজিৎ রায়ের ২৮টি কাহিনী চিত্রের মধ্যে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘নায়ক’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ ও ‘হীরক রাজার দেশে’ এই পাঁচটি ভিন্ন সবক’টি ছবির কাহিনীর উৎস কথাসাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, পরশুরাম, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, শঙ্কর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প ও উপন্যাস তাঁর কাহিনীচিত্রগুলির উৎস। তিনি ক্যামেরায় গল্প বলেছেন নিজের মতো করে। আপন জীবনবোধ, ইতিহাস জিজ্ঞাসা ও আপন শিল্পদৃষ্টিতে সেইসব কাহিনীগুলিকে দর্শকের অনুভূতিতে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ অভিনেতা মুরারী ভাদুড়ীকে এক পত্রে লিখেছিলেন “চলচ্চিত্র এখনো সাহিত্যের চাটুবৃত্তি করে চলেছে – তার কারণ কোন রূপকার আপন প্রতিভার বলে তাকে এই দাসত্ব থেকে উদ্ধার করতে পারেনি”(সূত্র ‘সত্যজিৎ কথা : চলচ্চিত্রে ও নেপথ্যে’ / অসীম সোম )। সত্যজিৎ সেটা করলেন, আর তাই তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলি হয়ে উঠেছে ‘সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা। চিত্রনাট্য থেকে টাইটেল ও প্রচারের বিজ্ঞাপন রচনা সবই তাঁর নিজের হাতের, নিজের শিল্পবোধ ও ভাবনায়। সঙ্গীতের প্রয়োগ তাঁর ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছে। চলচ্চিত্র পরিচালনায় নামার আগেই নিজেকে তৈরি করে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ চিত্রকলা ও সঙ্গী বিষয়ে। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ছিল আবাল্য আকর্ষণ। সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ও অন্বেষণ শান্তিনিকেতন পর্ব থেকেই। কলাভবনে শিক্ষাকালীন তাঁর সঙ্গীত চর্চার পরিধিরও বিস্তার ঘটেছিল। ‘পথের পাঁচালী’ সহ প্রথম ৬টি ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন রবিশঙ্কর, বিলায়েৎ খান ও আলি আকবর। কিন্তু ছবিগুলির আবহ সঙ্গীতের প্রয়োগ নানান দৃশ্যের ‘মুড’ নির্মাণে পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের উপস্থিতি দর্শকরা বুঝতে পারেন। পথের পাঁচালীতে অশীতিপর চূণীবালার (ইন্দীর ঠাকুরন) কন্ঠে ‘হরি দিন তো গেলো সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে’ গানটির প্রয়োগ আমাদের চমকিত করেছিল। ক্রমে সত্যজিৎ উপলব্ধি করেন তাঁর ছবির সঙ্গীত পরিচালকরা পেশাগতভাবে খ্যাতকীর্তি হলেও চলচ্চিত্র দৃশ্যের মুড, পরমিতি বোধ ও পরিচালকের ভাবনা বোঝা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। বিশ্বের সব মহৎ চিত্র পরিচালকই মুখোমুখী হয়েছেন এই দ্বন্দ্বের। চার্লি চ্যাপলিন, আইজেনস্টাইন নিজেই সঙ্গীত পরিচালনা করতেন নিজের ছবির। তাই ১৯৬০এর পর বাইশটি ছবির সঙ্গীত রচনার দায়িত্ব তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। এই পর্বেই আমরা পেয়েছি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ এর মতো মিউজিকাল ফ্যান্টাসি। ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০) শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালনার জাতীয় পুরষ্কার পায়। অনেক আগে ‘জলসাঘর’ (১৯৫৮) মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের পুরষ্কার পায় (সঙ্গীত পরিচালনা – বিলায়েৎ খান)

যুবা বয়স থেকে প্রৌঢ়ত্ব সত্যজিতের এই পাঁচ দশকের জীবনকাল স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, দেশ বিভাগ, বাম আন্দোলন, জরুরী অবস্থার কৃষ্ণপ্রহর, নকশাল আন্দোলন ইত্যাদি অনেক উত্তাল সময়ের সাক্ষী। কিন্তু সংস্কৃতি ভাবনায় বাম বা দক্ষিণ কোনও দিকেই তাঁর ‘কমিটমেন্ট’ ছিল না। তাঁর কমিটমেন্ট ছিল শিল্পের প্রতি। জীবনমনস্ক সত্যজিতের কাছে শিল্পচর্চাই ছিল জীবনচর্যা।

আমার স্মৃতিতে আছে, ১৯৬২র চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময় উগ্র জাতীয়তাবাদ ও কমিউনিষ্ট বিরোধীতার ঢেউ উঠেছিল। শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটা অংশ সেই উগ্র জাতীয়তাবাদের ঢেঊয়ে গা ভাসিয়েছিলেন। এই আবহে কলকাতার একটি দৈনিকে, সম্ভবত আনন্দবাজা্রে সম্পাদকীয় নিবন্ধে লেখা হয়েছিল ‘সত্যজিৎ রায় নীরব কেন’। উদ্দেশ্য পরিস্কার। তাঁর মতো বিশ্ববন্দিত শিল্পীর পেছনেও কিছু দেগে দেওয়া। এইসব ব্যাপার তখন বিশ্ববন্দিত সত্যজিৎকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি। জওহরলাল নেহেরুর অনুরোধে সীমান্ত যুদ্ধ নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের প্রস্তাবে আগ্রহ দেখাননি, ইন্দিরা গান্ধী – সিদ্ধার্থ রায় জমানায় তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য পদের প্রস্তাবও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নিজ বিশ্বাস, প্রত্যয় আর নিজস্ব ধ্যানধারণা থেকে কোনও প্ররোচনাই তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি ।

১৯৫৫ থেকে ২৩এ এপ্রিল ১৯৯২এ মৃত্যু পর্যন্ত ৩৭ বছরে তিনি নির্মাণ করে গেছেন ২৮টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র, ৫টি তথ্যচিত্র, ৩টি টেলি ফিল্ম। ১৯৫৬তে কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি থেকে ১৯৯২এ মৃত্যুশয্যায় অস্কার সম্মাননা পর্যন্ত দেশে বিদেশে কত রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, কত প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মাননা জানিয়ে গৌরবান্বিত হয়েছে তার সব বৃত্তান্ত একটি স্বল্প পরিসরের নিবন্ধে দেওয়া সম্ভব নয়, মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করলাম - ভারত সরকারের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘ভারত রত্ন’ (১৯৯২), চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘দাদাসাহেব ফালকে’(১৯৮৫) পুরষ্কার, ম্যাগসেসাই’ পুরস্কার(১৯৬৭), ফ্রান্সের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘লিজিয়ন অফ অনার’(১৯৮৭), বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’(১৯৭৮) ।

১৯৮৩তে ‘ঘরে বাইরে’ ছবির চলচ্চিত্রায়ন চলার সময়ে বড় রকমের হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পুত্র সন্দীপ রায় তাঁর পরামর্শ নিয়ে ছবিটি শেষ করেন। বিদেশে তাঁর হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার হয় এরপর প্রায় চিকিৎসকের পরাপর্শে তিন বছর তিনি কোনও চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেননি। ১৯৮৭তে পিতা সুকুমার রায়কে নিয়ে একটি তত্যচিত্র শেষ করার পর অসুস্থ শরীরে পরের তিন বছরে তিনটি ছবি করেন ‘গণশত্রু’(১৯৮৯), ‘শাখাপ্রশাখা’(১৯৯০) এবং শেষ ছবি ‘আগন্তুক’(১৯৯১)। অসুস্থ্যতার কারণে এই তিনটি ছবিই পুরোপুরি ইন্ডোর সুটিং করেই সম্পন্ন করেন। চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মতে এই তিনটি ছবিতে সত্যজিৎকে পাওয়া যায়নি আগের মতো। ১৯৯২এ আবার তাঁর হৃদযন্ত্রে জটিলতা ধরা পড়ে। হাসপাতালে ভর্তি হন, কিন্তু আর সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসতে পারেননি। ১৯৯২এর ২৩শে এপ্রিল চিরতরে চলে যান এই বিশ্ববরেণ্য বাঙালি সত্যজিৎ রায়।

একটা পরিচ্ছন্ন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালিয়ানা, স্বচ্ছ চিন্তাধারা ও সবল মানসিকতা ছিল সত্যজিৎ রায়ের। তিনি ছিলেন একান্তভাবেই কলকাতা প্রেমী বাঙালি। একটি ছাড়া বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি, বাংলা ও বাঙ্গালিজীবনই তাঁর তাবৎ চলচ্চিত্রকর্মের সূত্র। তাদের নিয়েই ক্যামেরায় ছবি এঁকেছেন সত্যজিৎ রায়। পথের পাঁচালী থেকে আগন্তুক, বিজ্ঞাপন এজেন্সির গ্রাফিক ডিজাইনার, সিগনেট প্রেসের প্রতিষ্ঠিত প্রচ্ছদ শিল্পী থেকে ফেলুদা, শঙ্কু, সঙ্গীত থেকে কল্পবিজ্ঞান এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তাঁর জীবন-অন্বেষা ও সৃজন বৈভব আমাদের চিরকালীন সম্পদ। চলচ্চিত্র নিয়ে সত্যজিতের বিশ্বজয় যেন বাঙ্গালিরই বিশ্ববিজয়। বাঙ্গালির অনেক কিছু নেইয়ের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথ, আছেন সত্যজিৎ রায়। রবীন্দ্রনাথের পর সত্যজিৎ রায়ই তো বাঙালির সেরা আইকন।

2 comments:

13

প্রবন্ধ - কণিষ্ক ভট্টাচার্য

Posted in




প্রবন্ধ


তার চে বরং 
কণিষ্ক ভট্টাচার্য

।। এক ।।
বেন অ্যান্ড জেরির একটা আইসক্রিম ব্র্যান্ড আছে যার নাম ‘চেরি গেভারা’। তাদের আইসক্রিমের লেবেলে বলা হয়, “চেরির বৈপ্লবিক সংগ্রাম থেঁতলে গেছে কারণ তারা আটকা পড়েছে চকোলেটের দুটো স্তরের মাঝে। তাদের স্মৃতি আপনাদের মুখে বেঁচে থাকুক।” আইসক্রিম শেষ করার পরে আপনার হাতে আপনার হাতে থাকবে একটি কাঠি, যেমন থেকে থাকে আর কি। কিন্তু ঠিক তেমন নয়, বরং তাতে লেখা থাকবে, “আমরা শেষ অবধি কামড় দেব, ছাড়ব না।”
এক ফরাসি ব্যবসায়ীর একটি পারফিউম ছিল। চে পারফিউম বলে সেটা বিখ্যাত। নাম ‘চেভাগন’। পণ্যটির বক্তব্য, “পারফিউমটি তাঁদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত যারা বিপ্লবীর অনুভূতি ও গন্ধ পেতে চান।”
২০০৮ সালে রেনল্টের অনুসারী শিল্প, গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা ডাসিয়া একটা বিজ্ঞাপন তৈরি করে তাদের নতুন লোগান এম সি ভি স্টেশন ওয়াগনের জন্য, যার নাম ছিল ‘রেভলিউশন’। সেই বিজ্ঞাপনে ফিদেল কাস্ত্রোর ভূমিকায় এক অভিনেতা একটা দুর্গম গ্রামে গিয়ে পৌঁছন। সেখানে তাঁকে অভিবাদন জানান আধুনিক যুগের অন্য বিপ্লবীরা। বিজ্ঞাপন যেখানে শেষ হয় সেখানে আমরা দেখি, একটা প্যাশিও গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে আর্নেস্তো চে গেভারা কার্ল মার্ক্সকে বলেন, “এটা একটা নতুন বিপ্লবের সময়।” মার্ক্স উত্তর দেন, “চে এটা তা-ই, যা মানুষ চায়।”
আমেরিকান ফুড চেইন ‘টাকো বেল’ একটা চিহুয়াহুয়া কুকুরকে চে-র সাজে সাজিয়ে তাঁকে দিয়ে বিজ্ঞাপনে বলায়, “আমি টাকো ভালবাসি।” কেন চে-কে এইভাবে ব্যবহার করা হল? এই প্রশ্ন করায় টাকো বেলের বিজ্ঞাপন অধিকর্তা চাক বেনেট জানান, “আমরা এক হিরোয়িক লিডারকে চাইছিলাম একটা টাকো বিপ্লবের জন্য।”
১৯৭০ সালে ইতালীয় কোম্পানি ‘অলিভেত্তি’ তাদের বিক্রি বাড়ানোর জন্য বিজ্ঞাপনে চে-র ছবি ব্যবহার করে লেখে, “যদি আমরা ওকে ভাড়া করতাম!”
পেরুতে গেলে আপনি কিনতে পারেন ‘এল চে সিগারেট’। আবার ‘এল চে কোলা’ তাদের নিট মুনাফার পঞ্চাশ শতাংশ দেয় এনজিও-কে। তাদের স্লোগান, “পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে গেলে তোমাদের অভ্যাস পরিবর্তন করো।” – এই অভ্যাস অবশ্য একটা নির্দিষ্ট কোলা খাওয়ার অভ্যাস।
‘স্মার্নফ ভদকা’ চে-র ছবি তাদের বিজ্ঞাপন আর বোতলে ব্যবহারের চেষ্টা করে ২০০০ সালে, কিন্তু আলবের্তো কোর্দা অনেক আইন আইন আদালত করে তা বন্ধ করতে সক্ষম হন।


।। দুই ।।
কে এই আলবার্তো কোর্দা? ১৯৬০ সালে সহযোদ্ধার মৃত্যুর খবর পেয়ে যখন তাঁকে শেষবার দেখতে আসেন আর্নেস্তো চে গেভারা, তখন চে-র একটা ছবি তোলেন আলবের্তো কোর্দা, তাঁর ‘লেসিয়া’ ক্যামেরায়। সেই ফ্রেমে অপর এক সহযোদ্ধার প্রোফাইল ছিল চে-র ডান দিকে। আর বাঁ দিকে ছিল পাম গাছের কিছু পাতা। সহযোদ্ধার মৃত্যুতে শোকার্ত, স্তম্ভিত অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চে-র ঘাড় ছিল কিছুটা ডান দিকে হেলানো। কানের পাশ দিয়ে নেমে আসা চুল, অবিন্যস্ত গোঁফদাড়ি আর মাথায় সেই কালো ব্যারেট। এই ছবিকে কিছুটা ক্রপ করা হয়। বাদ যায় অপর সহযোদ্ধার প্রোফাইল আর পাম গাছ। ছবিটা টিল্ট করা হয় কিছুটা যাতে বাঁকা ঘাড় সোজা হয়, সাবজেক্ট দাঁড়ায় হাফ বাস্ট। এই ছবিটাই পরবর্তীকালে, মানে ৯ অক্টোবর ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ায় চে গেভারার নির্মম হত্যার পরে ‘Guerrilleor Heroico’ নামে এক স্টাইলাইজড ইমেজ হিসেবে বিশ্বজুড়ে এক প্রতীকে পরিণত হয়েছে। অথচ মাঝে মাঝেই দেখা যায় এই প্রতীকায়নের কারণগুলি বিপরীতধর্মী। এই প্রতিমা আসলে বিজয়প্রার্থীর এক বর্গীয়-প্রতিমায় রূপান্তরিত হয়েছে। আবার রূপান্তরিত হয়েছে আদর্শবাদের প্রতীকেও, এমন একজন মানুষ যিনি কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে প্রাণ পর্যন্ত করতে পারেন এবং অনায়াসে। এই ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে এক চিহ্নক। ‘চে-স আফটার লাইফ : দ্যা লেগাসি অব অ্যান ইমেজ’-এ এই ছবির প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে যেমন বলেন মিশেল ক্যাসি, “এটা এমন একটা ছবি যা যে-কোনও কারও যে-কোনও কিছু, বা সবার কাছে সবকিছুকেই চিহ্নিত করে।”


।। তিন ।।
তাই অর্বুদ অর্বুদ পোস্টার, ক্যাপ, চাবির রিং, মাউস প্যাড, ওয়েস্ট বিন, পতাকা, বেরেট, ন্যাপস্যাক, ব্যান্ডানা, টিশার্ট, রুমাল, বেল্ট, ওয়ালেট, ঘড়ি, জিপো লাইটার, পকেট ফ্লাস্ক থেকে চটিজুতো, ট্যাটু থেকে বিকিনি পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই সবকিছুতেই চে-র প্রতিমা-প্রতীক ব্যবহৃত হয়। এমনকি নরওয়ের বার্জেনের রাস্তার গ্রাফিত্তিতে স্বয়ং চে-কেই আপনি দেখতে পাবেন চে-টিশার্ট পরিহিত অবস্থায়। বস্তুত চে-র বৈপ্লবিক প্রতিমা কেবল এক ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজে পরিণত হয়েছে।
কী না পাবেন আপনি চে-কে নিয়ে, ভিডিওগেমস অবধি। আজকে নয়, ভিডিও গেমসের প্রায় আদিযুগে ১৯৮৭ সালেই জাপানে ‘গেভারা’ গেমসে আপনি স্বয়ং চে-কে পাবেন ‘ফ্যামিকন’ এডিশনে। ২০০১ সালে ‘ট্রপিকো’র ‘এল প্রেসিডেন্ট’ গেমে চে হলেন প্রেসিডেন্ট, আর বলিভিয়ায় চে-র নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত CIA এজেন্ট ফেলিক্স রড্‌রিগেজকে নায়ক করে আপনি নিজে হাতে বারবার চে-কে হত্যা করতে পারেন, রড্‌রিগেজকে চালনা করে ‘প্লে স্টেশন- টু’তে ‘জাস্ট কজ’ নামের গেমে। আবার ‘গ্লোবাল ফান মোবাইল’ এনেছে ‘এল চে’ নামে ফোন। ‘এল চে’ ফোনের মডেলগুলি হল অ্যাসল্ট রাইফেল, গ্রেনেড, রকেট লঞ্চারের মিনিয়েচার।


।। চার ।।
চে-প্রতীক ব্যবহারের প্রধানত তিনটি ধরণ দেখা যায়। 
প্রথমত, চে মানুষটি কে, তিনি কী করেছিলেন, সমাজ বদলের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান কী – এগুলি জেনে তাঁর পক্ষে বাঁ বিপক্ষে একটি অবস্থান নেওয়া এবং তদনুসারে সেই প্রতীক ব্যবহার। 
দ্বিতীয়ত, চে এবং তাঁর জীবন ও কাজ সম্পর্কে অবগত হয়ে সচেতনভাবে তাকে তরলীকৃত করে কেবল এক স্টাইলাইজড ইমেজ হিসেবে ব্যবহার, যাতে সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্মরণীয় না হয়ে কেবল পরিপ্রেক্ষিতহীন এক জনপ্রিয় মুখ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যেহেতু আবিশ্ব যুব সমাজের একটা বিরাট অংশের মধ্যে তাঁর যে সচেতন বা অসচেতন জনপ্রিয়তা তাকে নিজের ব্যবসার কাজে লাগানো যায়। স্মরণীয়, যারা ভারতসহ সাত কি আটটি দেশে প্রচলিত ক্রিকেট নামক খেলাটি দেখেন না তারাও শচীন রমেশ তেন্ডুলকরকে চেনেন, কর্পোরেটের বিজ্ঞাপনে তিনি ব্যবহৃত হন সেই মানুষদের কথা ভেবেও। তাঁর জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে কর্পোরেট। সেই চাপে তাঁকে ভারতরত্নও দিতে হয়।
তৃতীয়ত, সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে চে সম্পর্কে একটা ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ।
এই তিনটি অংশে স্পষ্টতই দুইটি পক্ষ। এই দুটি পক্ষ আদর্শগত ভাবে ভিন্ন অবস্থানে আছে সচেতন ভাবেই। একটি সমাজতান্ত্রিক পক্ষ অপরটি পুজিবাদী পক্ষ। মার্ক্সবাদী মতাদর্শ প্রচলিত প্রচলিত ব্যবস্থার মূলে আঘাত করা র‍্যাডিক্যাল দর্শন বলেই জন্ম থেকে নানা আক্রমণে আক্রান্ত। বিগত শতকের শেষ দশকে এই আক্রমণ তীব্রতর হওয়ার কারণ পূর্ব ইউরোপে এর প্রায়গিক ব্যর্থতার প্রকাশ। আবার যেখানেই সমাজতন্ত্র আত্মরক্ষার জন্য আপোষ করেছে পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির ব্যবস্থার সঙ্গে, সেই প্রতিটি আপোষ তাঁর আদর্শগত অবস্থানকে দুর্বল করেছে এবং জনমানসে আকর্ষণ হারিয়েছে। অথচ পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় পুঁজিবাদ ব্যক্তিমুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েও ন্যূনতম মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছে মানুষকে।
যে আদর্শগত আক্রমণের মাধ্যমে মার্ক্সীয় মতাদর্শের পতন ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে তা উত্তর আধুনিকতাবাদ, যা র‍্যাডিক্যাল ভঙ্গির আড়ালে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের স্বার্থসিদ্ধ করে। মার্ক্সবাদী মতাদর্শ মূলত ইউরোপীয় যুক্তিবাদ ভিত্তিক বস্তুবাদী মতাদর্শ, যা এনলাইটমেন্টের তাত্ত্বিক যে বিজ্ঞান-প্রগতির আন্তঃসম্পর্কনির্ভর প্রগতিতত্ত্ব তাঁর ধারাবাহিকতায় আগত। এই ধারাবাহিকতাটাই অস্বীকার করে উত্তর আধুনিকতা। যা লেখক বা বাচকের ‘টেক্সট’কে স্বীকার করে যা এই মতানুসারে একটি ‘নির্মাণ’ এবং টেক্সটের অবনির্মাণ বা বিনির্মাণের মাধ্যমে পাওয়া যায় এর অপর কোনও বিপরীত বাচন, যা একটি পাল্টা টেক্সট। কিন্তু এই নির্মাণ-বিনির্মাণের আবর্তে সত্য বা বাস্তবের কোনও স্থির অবস্থান নেই। সেখানে বাস্তব হল সম্ভাব্য সব ব্যাখ্যার এক অবিরাম স্রোত। কোনও একটি টেক্সট যদি কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে শেষ কথা বলতে চায় তবে সেটা হবে আধিপত্যবাদী টেক্সট।
ফলে উত্তর আধুনিক চিন্তায় সত্য বা বাস্তবের কোনও চরম বাচন নেই। এমনকি সত্যকে কোনও নির্দিষ্ট টেক্সটের মাধ্যমে খোঁজার প্রয়োজনও নেই। বাচন-প্রতিবাচনের মধ্যে দিয়ে কোনও মাস্টার ডিসকোর্স পাওয়া যাবে না। এই ভাবে ধারাবাহিকতাটিকে অস্বীকার করে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহাবাচনের বিরোধিতার মাধ্যমে এই মতাদর্শ শেষ বিচারে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের পক্ষে দাঁড়ায়। 
কী ভাবে? এই মতানুসারে সত্যের কোনও বাচন নিরপেক্ষ অস্তিত্ব নেই। ভূগোল সংক্রান্ত টেক্সট যদি হয়, ‘পৃথিবী গোলাকার’। তাঁর পাল্টা টেক্সট হবে, ‘পৃথিবী থালার মতো চ্যাপ্টা’ – কিন্তু বাস্তব সত্য কী তা কখনওই বলা যাবে না। -- কারণ এই সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক সত্যও উত্তর আধুনিকের কাছে একটি টেক্সট, যার একটি পাল্টা টেক্সট আছে এবং এর কোনও শেষ নেই। সত্যের বাচন নিরপেক্ষ অবস্থান না থাকায় তা আসলে ভাববাদ। যা এনলাইটমেন্ট-যুক্তিবাদ-বস্তুবাদ-প্রগতিতত্ত্বের ধারাবাহিক জ্ঞানচর্চাকে পিছনের দিকে অর্থাৎ ভাববাদে টেনে নিয়ে গিয়েও নিজেকে ‘উত্তর আধুনিক’ দাবি করে।


।। পাঁচ ।।
আমেরিকান টিভি সিরিজ ‘আমেরিকান ড্যাড’-এ ছেলে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়ে যাচ্ছে জেনে বাবা একদিন প্রবল উত্তেজিত হয়ে ছেলের অনুপস্থিতিতে ছেলের ঘরে ঢুকে কমিউনিজম সংক্রান্ত সমস্ত জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত ঘরের দেয়ালে চে-র পোস্টার দেখে হঠাৎ থেমে যায়। ছেঁড়ে না, বলে – “ This we can agree on, ‘Planet of the Ape’ was a fine picture” – মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। 
চল্লিশ বছর ধরে চে-কে নিয়ে অজস্র সিনেমা, তথ্যচিত্র, নাটক, গান, টেলি-শো, বই, পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে বহু দেশ ও ভাষার পাশাপাশি এ দেশেও ২০০৯ সালে তৈরি হয়েছে বলিউড থ্রিলার ‘সিদ্ধার্থ দ্যা প্রিজনার’। পরিচালক প্রয়াস গুপ্তা, মুখ্য ভূমিকায় রজত কাপুর। ট্রিশা জিফ দুটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে। প্রথমটি ‘Personal Che’ দ্বিতীয়টি ‘Chevolution’। সুপার মডেল জিসেলে ব্যান্ডবেন চে-র ছবিসহ বিকিনি পরে হাঁটেন সাও পাওলো ফ্যাসান উইকে জুলাই ২০০২ সালে। কয়েক বছর আগে কলকাতার সদ্যজাত শপিং মলে চে-র ছবিসহ বাথরুম স্লিপার বিক্রি হয়েছে। রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনের কভার পেজে জনি ডেপকে দেখা গেছে গলায় চে পেন্ডেন্ট পরে। দিয়াগো মারাদোনা, মাইক টাইসন, ব্রিটিশ ফুটবলার জ্যাবেন ক্যুরি, আর্জেন্টাইন ফুটবলার সেবাস্তিয়ান ভেরনো, ইতালীয় ফুটবলার ফ্যাব্রিজিও মিকোলি, সুইডিশ বক্সার জোয়ানেমা টার্কসন, সাউথ আফ্রিকান ফুটবলার মার্ক ফিস – প্রত্যেকের শরীরে ট্যাটুতে অঙ্কিত আছেন চে। মুন্তাদার আল জাইদির সাংবাদিক জিন জর্জ ডাব্লিউ বুশকে জুতো ছুঁড়েছিলেন, সাংবাদিকরা তাঁর ঘরের দেয়ালেও দেখা পেয়েছিলেন ‘গেরেলিয়েরো হিরোয়িকো’র। আবার পারভেজ মুশারফ, পাকিস্তানের সেনা শাসকের জার্মান শেফার্ড কুকুরের নাম চে।


।। ছয় ।।
২০০৯ সালের এপ্রিলে পোল্যান্ডের মন্ত্রী এলজিবিটা রজাডজিসসেওয়াস্কা ফ্যাসিস্ট ও টোটালেটেরিয়ান প্রচার আটকাতে সে দেশের পুলিশ আইনে সংশোধন আনেন। নতুন আইন অনুসারে সে দেশে চে গেভারার ছবি সম্বলিত টিশার্ট বা সোভিয়েত জ্যাকেট আর পরা যাবে না। পড়লে দু বছরের জেল।
আজারবাইজানের রুউফ মামাদোভ দাবার এক গ্র্যান্ড মাস্টার, যিনি চে টিশার্ট পরেই আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন। তাঁর মতে, “আমি চাই না আমার পিতার মুখচ্ছবি যে কেউ না ভেবেচিন্তে ব্যবহার করুক। তাঁকে আমি অযুত সংখ্যক জিন্সের পিছনের পকেটে স্টিকার হিসেবে দেখতে চাই না। যারা চে টিশার্ট পরে তারা যেন স্থিতাবস্থার পক্ষে না দাঁড়ায়, যেন সমাজের থেকে আরও বেশি দাবি করতে পারে, তারা যেন ভালো মানুষ হয়।”
আবার অস্ট্রেলিয়ান পাঙ্ক ব্যান্ডের ‘দ্যা ক্ল্যাপ’ অ্যালবামের “The Che Guevara T shirt wearer” গানের কোরাস লাইন হল, “You are a Che Guevara T shirt wearer, and you have no idea who he is.”
ব্রিটিশ রাজনীতিক জর্জ গলওয়ের বক্তব্য, “যদি মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ যারা চে-র টিশার্ট পরেন তারা জানেন তিনি কে, কীসের পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, সেটাও কিন্তু বহু কোটি। একই সঙ্গে তার পুরোটাই যৌবন – যারা পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে চায়। কিন্তু ১০ শতাংশের বহু বেশি তার পরিচয় জানেন। জানবেন, যদি কোথাও চে-র ছবি থাকে তার কারণ তাঁর লড়াই – প্রাণত্যাগ – যা পৃথিবীর ফ্যাসানেবলতম।”


।। সাত ।।
রেগিস ডেবরে বলিভিয়ার জেলে চে-র সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তিনি পরবর্তী কালে লেখেন, “চে হলেন আধুনিক খ্রিস্ট, কিন্তু আমার মনে হয় তিনি আরও তীব্রভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন। ২০০০ বছর আগের তার ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়ে প্রাণত্যাগ। কিন্তু চে জানতেন যে তার কোনও ঈশ্বর নেই এবং তাঁর মৃত্যুর পরে আর কিছুই থাকবে না।”
সুজানা ওসিয়ানা একজন নার্স ছিলেন, যিনি চে-কে হত্যার পরে তাঁর মৃতদেহ পরিষ্কার করেছিলেন। সুজানা বলেছিলেন, “উনি ঠিক জিশু খ্রিস্টের মতো, তাঁর তীব্র চোখ, দাড়িগোঁফ, লম্বা চুল...” কিন্তু তিনি চে-র সেই হাতের পাতার কথা উল্লেখ করেননি, যা কেটে নেওয়া হয়েছিল চে-র মৃতদেহ থেকে।
জর্জ সি কাস্তেন্দা বলেন, “... যেন মৃত গেভারা তাকিয়ে আছেন তাঁর হত্যাকারীদের দিকে এবং তাঁদের ক্ষমা করে দিচ্ছেন আদর্শের জন্য প্রাণ দেওয়া মানুষের যন্ত্রণার থেকে। জার্মান নাট্যকার পিটার ওয়েইসের মনে হয়, “Christ taken down from the cross”। চে-কে নিয়ে ‘লাস্ট সাপার’ আঁকা হয়েছে। বলিভিয়ায় চে ও তাঁর বিপ্লবী সহযোগীদের যাত্রাপথকে কেন্দ্র করে ‘হোলি গ্রেইল অব চে গেভারা’ নামে ট্যুরিজম আছে। এমনকি আছে ‘সেন্ট আরনেস্তো চার্চ’। তাই হানা চার্লটন লেখেন, “সম্ভবত মোনালিসার ছবির থেকে বেশি, জিশুখ্রিস্টের ছবির থেকেও, বিটলস বা মনরোর থেকে ঢের বেশি চে-র ছবি প্রজন্মের পর প্রজন্মের কল্পনাকে ধারণ করে আছে।”


।। আট ।।
কিন্তু কেন এমন হল, কেন এমন হয় – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে ফ্র্যাঙ্কফুট স্কুলে থিওডোর অ্যাডোরনো (১৯০৩-১৯৬৯) এবং ম্যাক্স হরখেইমারের (১৮৯৫-১৯৭৩) কাছে, ১৯৪৪ সালে ‘কালচার ইন্ডাস্ট্রি’ শব্দবন্ধ যারা প্রথম ব্যবহার করেন ‘Dialectic of Enlightenment’ বইতে। এই বইয়ের ‘The Culture Industry: Enlightenment as Mass Deception’ অধ্যায়ে বলা হয়, “Pop culture is a factory product of film, radio, magazine – that are used to manipulate mass society into passivity, consumption of easy pleasure of pop culture made available by the mass com media make people control to cultivation of false psychological need that can only be made and satisfied by the product of capitalism. No matter how difficult their economic circumstances.” তাঁরা দেখান, চে-র মৃত্যুর বহু আগে, ‘গেরিলিয়েরো হিরোয়িকো’র অনেক আগেই যে, মাস প্রোডিউসড কালচার প্রযুক্তিগত ভাবে ও বৌদ্ধিক ভাবে কত বেশি ক্ষতিকর তথাকথিত হাই আর্টের থেকে। ফলে চে-র মুখ রশোমন এফেক্টের মতো কাজ করে গেছে যারা তা দেখেছেন তাঁদের প্রত্যেকের মনে আলাদা রকম ভাবে। আর আত্র উপভোক্তা ও দর্শকেরা প্রকৃত বিপ্লবাত্মক বোধকে তরল করে নিয়েছেন চে-র মুখের ছবি দিয়ে। কারণ পপ আর্টের নৈর্ব্যক্তিকীকরণ, সাধারণীকরণ, তরলীকরণ চে-র মুখকে সকলের জন্য নালিয়ে এনেছে, পপ আর্টের তত্ত্ব চে-কে প্রশ্ন-পরিপ্রশ্নহীন, প্রতিফলনহীন, নির্বিষ, নিরীহ বস্তুতে পরিণত করেছে তাঁর পুনঃ-পুনঃ-পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে। এক ঐকান্তিক বিপ্লবী পুঁজিবাদের পণ্যতে পরিণত হয়েছেন, কারণ capitalism devours everything – even its worst enemies.
--- --- --- 
(‘কালি কলম ইজেল’ পত্রিকায় জানুয়ারি ২০১৪ সালে প্রকাশিত সমনামী প্রবন্ধের পরিমার্জিত রূপ এই প্রবন্ধ।) 

13 comments:

1

প্রবন্ধ - পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in


প্রবন্ধ


কয়েকটা ঝরাপাতার গল্প
পিনাকী চক্রবর্তী



মুখবন্ধ :-

লেখাটা পড়ার আগে একবার মনে করিয়ে দিই যে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে মোটামুটি ভাবে দশ লক্ষ বছর আগে। আর আমাদের চেনাশোনা মানুষেরা এসেছেন হয়তো তিন থেকে সাত হাজার (?) বছর আগে (ঋগ্বেদের সময় কি তিন হাজার বছর ? আমি ঠিক বলতে পারবো না, তবে আমি ওইদিকে যাচ্ছি না)। শেষ হিমযুগ শেষ হয়েছে এগারো হাজার বছর আগে – গুহামানবের গুহা ছেড়ে বাইরে বেরনোর সময়। আমার কাহিনী কিন্তু এর অনেক আগেকার সময় নিয়ে লেখা...


প্রায় তিরিশ কোটি বছর আগেকার কথা। কারবোনিফেরাস যুগ শেষ হতে চললো, পারমিয়ান যুগ আসছে। গন্ডোয়ানাল্যান্ডের হিমবাহগুলোর বরফ ছাড়ানোর জন্যে ভগবান পৃথিবীকে তখন ডিফ্রস্ট মোডে রেখে হালকা হালকা সেঁকা শুরু করেছেন। সমস্ত গন্ডোয়ানাল্যান্ডের আবহাওয়া তখন একেবারে কুলু বা কাংড়া উপত্যাকার মতো। গরমকালে হাল্কা চাদর গায়ে দিলেই চলে, শীতকালে কাঁপিয়ে দেয়। কিন্তু মোটের ওপর বেশ মনোরম। এখানে ওখানে ছিটিয়ে ছড়িয়ে অজস্র গ্লেসিয়ার তখনও আছে, কিন্তু তাদের যুগ যাব যাব করছে। গ্লোবাল ওয়ারমিং শুরু হয়ে গেছে, এবার গ্লেসিয়ার গলবে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়বে। গরমে সেই জলের থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেরিয়ে আসবে। তার গ্রীন হাউস এফেক্টে আরও গরম বাড়বে, মাটীতে গাছপালা বাড়বে, ঝড়বৃষ্টি বাড়বে, বাড়বে তুফানী উচ্ছাস... কিন্তু এ সব হবে ধীরে ধীরে, একদিনে নয় ...

সেই বিশালকায় ভূখণ্ডের দক্ষিণ দিকে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে গলে সমুদ্রের জলস্তর বাড়িয়ে চলেছে। উত্তরদিকে ভারতের তালচের থেকে বরাকর পর্যন্ত বিস্তৃত হিমবাহ গলা জল প্রধানত শোণ নদের পথ ধরে উত্তরে টেথিস সমুদ্রে গিয়ে মিশছে। অল্পস্বল্প বাঁচাবুচা (হিন্দী বলতে বলতে বাংলাটা এক্কেরে গিয়েছে) জলটা হয় পূবের দিকে মহানদী ধরে বয়ে চলেছে হয় অ্যান্টার্কটিকা নাহয় অস্ট্রেলিয়ার দিকে। সেদিকে কোন হ্রদ বা লেগুন বা জলাভূমিতে মিশবে। আর নাহলে পশ্চিমে শিশু নর্মদা ধরে আফ্রিকার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু এরও গতি হবে ওইরকম কোন জলাভূমিতেই।

ভারতের পূব দিকে খানিকটা সরে আছে অস্ট্রেলিয়া। তার দক্ষিণ ভাগে কিন্তু কিছু না কিছু অশান্তি লেগেই আছে। তাসমানিয়া আর অ্যান্টার্কটিকার সাথে গুঁতোগুঁতিতে সেখানে মাঝে মাঝেই পাহাড়ের সারি মাথা তুলছে আর তার সাথে সাথে এসে যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। কি উৎপাত ! এই পাহাড় গজালো, এই ভূমিকম্প হলো, এই অগ্ন্যুৎপাত হলো, এই আবার ভূমিকম্প হলো...

ওদিকে এই ঠেলায় দক্ষিণ আর পূব দিকের গ্লেসিয়ারগুলো আরও তাড়াতাড়ি গলছে, কিন্তু সেই জল এসে থেমে যাচ্ছে মাঝের বিরাট বিরাট জলাভূমিতে। সেই জলাভূমিতে গজিয়ে উঠছে আমাদের সুন্দরী কাঠের মতো কিছু গাছ, যারা বেশ লম্বা চওড়া হলেও আসল কায়দা লুকিয়ে আছে তাদের শিকড়ে। সেই শিকড় জলাভূমির জলের ওপর মাথা উঁচু করে হাওয়া টানতে পারে। অন্য গাছের শিকড়ের মতো পচে যায় না। আবার শীতকালে প্রবল গ্রাউন্ডফ্রস্ট হলেও এরা বেঁচে থাকে। শুধু পাতাগুলোকে ঝরিয়ে দেয়। কারণ এমনিতেই রোদ বেশি পাওয়া যায় না তখন। তার ওপর সেই রোদ সবার মধ্যে ভাগ করে নিতে গেলে কারও ভাগেই বেশি কিছু আসে না। তখন কম্পিটিশনে নামতে হয়। যে মাথা বেশী উঁচু করবে, সে একটু বেশী রোদ পাবে, কিন্তু তাতে রান্নাবান্না যথেষ্ট হবে কিনা কে আগের থেকে বলতে পারে ? ফালতুতে নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে গিয়ে কারুরই উপকার হবে না ... ধুসসস ... অত পরিশ্রম পোষায় না ! তার থেকে এনার্জি বাঁচাই, পাতা টাতা ঝরিয়ে দিয়ে শুকনো কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর অপেক্ষা করি কবে বসন্তকাল আসবে। তখন নাহয় আবার পাতা গজিয়ে নিলেই হবে...

এর মধ্যে আবার ভূমিকম্পে আস্ত আস্ত জঙ্গল মাটীর নিচে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। তার ওপর মাটী জমে আবার জঙ্গল হচ্ছে, আর আবার তলিয়ে যাচ্ছে। এই এক ব্যাপার দু তিন কোটি বছর ধরে হয়ে চলেছে, আর পারা যাচ্ছে না, উফফফফ...। সেই গাছপালাগুলো নাকি আবার কুড়ি তিরিশ কোটি বছর পরে কয়লা হয়ে মানুষ না ফানুষ কারা সব সেই সময় পৃথিবীতে রাজত্ব করবে, তাদের কাজে লাগবে।

এই তো সেদিন, একটা আস্ত গ্লসপটেরিস জঙ্গল তার পাতা টাতা ঝরিয়ে শীতের জন্যে তৈরী হচ্ছিলো। জঙ্গলের পথ ধরে নিঃশব্দে হাঁটা চলা করা যায় না শুকনো পাতার খড়র মড়রে। এমনি সময়েই মাটী কাঁপতে লাগলো, আর তার সাথে এলো সেই উৎপাত! অগ্ন্যুৎপাত!! নিমেষে আকাশ ঢেকে গেল আগ্নেয়গিরির ছাইয়ে। যারে কয় ভলকানিক অ্যাশ। সেই ছাই ঝরে পরতে না পরতেই নামলো বৃষ্টি। আর তার পরে পরেই ধ্বসে গেলো মাটী। চাপা পড়ে গেল সব গাছপালা আর তাদের শুকনো পাতা। 
তিরিশ কোটি বছর পরে সেই মানুষ নামক প্রাণী তাদের প্রয়োজনীয় কয়লা তুলতে এসে হাজির হলো অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে। মাটী কেটে কয়লা তোলার সাথে সাথে কাটা পড়লো কিছু ভলকানিক অ্যাশের স্তরও। সেই সময়ে তারা দেখতে পেল পাথরের মধ্যে ফসিল হয়ে যাওয়া সেই শুকনো পাতাগুলোকে। ওই অবস্থাতেই ছাইচাপা পড়ে গিয়েছিলো তারা, তাই তাদের রঙও বদলায়নি। তা, মানুষের কি বুদ্ধি গো! ওপরে তুলে এনে সেই পুরোনো পাতার ছাপওয়ালা পাথর বেচতে লাগলো তারা। দরকার নেই বলে তাদের গাছেরা ঝরিয়ে দিয়েছিলো সে পাতাগুলোকে, আজ সেই পাতার ছাপ আছে বলে এক একটা পাথরের টুকরোর দাম উঠলো ৮০ থেকে ১০০ ডলার। তা আমার তো পকেটে অত রেস্ত নেই যে পয়সা দিয়ে সেই আদ্দিকালের পুরোনো আর শুকনো ক’টা পাতা কিনি !!! তাই তাদের ছবিটুকুই তুলে এনেছিলাম সে দেশ থেকে। সেই ছবিই আজ ছাপিয়ে দিলাম নীচে।



এরা হলো অস্ট্রেলিয়ার পারমিয়ান যুগের গ্লসপটেরিসের পাতা, বয়েস কমবেশী ২৮ কোটি বছর ... সাইজের একটা আন্দাজ দিয়ে দিই ... এই পুরো ছবিটা আড়াআড়িভাবে একটা মাথাটেপা বল পয়েন্ট পেনের সমান। ওদেরই মধ্যে একজনের ছবি আবার একটু বড় করে দিলাম। আপনারা দেখুন আঠাশ কোটি বছরের পুরোনো একটা পাতাকে, যে নিজে জমে পাথর হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার শিরা উপশিরাগুলো এখনো বাইরে থেকেই চিনতে পারা যাচ্ছে।

ওপরে যে গন্ডওয়ানা ল্যান্ডের কথা বলা আছে, তার চেহারা সম্পর্কে একটা আন্দাজ দেবার জন্যে একটা ম্যাপ সাথে লাগিয়ে দিলাম। 


ছবিটাতে যা দেখা যাচ্ছে,, একটু নজর করলে বোঝা যাবে, বাঁদিক (ম্যাপের বাঁদিক মানে পশ্চিম) থেকে শুরু করলে প্রথমেই আসবে একটু তেরচা ভাবে দক্ষিণ অ্যামেরিকা, তার ডানদিকে সেঁটে আছে আফ্রিকা। এরা সবচেয়ে বেশি করে লেগে আছে বর্তমান নাইজার নদীর মোহানার কাছাকাছি। 

এবার আফ্রিকার ডানদিকে নজর ফেললে বোঝা যাবে, সেখানে অনেকেই গুঁতোগুঁতি করে লাইন দিয়ে লেগে আছে। ওপর থেকে (মানে উত্তর দিক থেকে) শুরু করলে দেখা যাবে বর্তমান আরব ভূখন্ডকে। লোহিত সাগরটা নেই - মিশর আর আরব দেশের মাঝখানে, কিন্তু একটা সূক্ষ্ম ফাটল দেখা যাচ্ছে। কালে কালে ওটাই রেড সী-তে পরিণত হবে, যখন আরব দেশ সরে যাবে আফ্রিকার থেকে। যেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো পারস্য উপসাগর, আরব দেশের ডানদিক ধরে। সাথে একটু ইরান-ইরাক আর আরো ওপরে তুরস্কের অংশও দেখা যাচ্ছে, কিন্তু অতটা পরিষ্কার ভাবে নয়। আন্দাজ করে নিতে হচ্ছে।

আফ্রিকার ডানদিকে ইথিওপিয়া, ইরিট্রিয়া ধরে লেগে আছে ভারতের রাজস্থান এবং তার সামান্য পশ্চিমের অংশ। ধরে নিন বর্তমানে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ। 
দেখে নিয়েছেন ? এবার ভারত ভূখণ্ড ধরে আর একটু নেমে আসুন। ভারতের দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম দিক আর আফ্রিকার পূবদিকের মাঝখানে দেখুন লেগে আছে মাদাগাস্কার। আবার দাক্ষিণাত্যের পূবদিকে (মানে ডানদিকে), অর্থাৎ পূর্বঘাট পর্বতমালা ঘেঁষে লেগে আছে অ্যান্টার্কটিকা। বেশ সবুজ আর হলদে রঙ করে বোঝানো আছে এ জায়গা আগে কিছু কিছু জঙ্গলেও ঢাকা থাকতো, আবার একটু ঝোপঝাড় মরুভুমি টাইপের আবহাওয়াও হয়তো ছিলো এখানে, শুধুই আজকের মতো বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে থাকতো না সে সবসময়।

ভারতের উত্তর দিকে (এখানে দেখে উত্তরপূর্ব মনে হচ্ছে, কারণ ভারতও আজকের হিসাবে একটু তেরচা হয়েই ছিলো সে সময় ) যে হাল্কা বাদামী অঞ্চলটা আছে, এটা তখনকার টেথিস সমুদ্রের নিচে ছিলো। সেখানের জমা পলিমাটি দিয়ে হিমালয়ের অনেকটা অংশ তৈরি হয়েছে। সেটা অবশ্য অনেক পরের কথা। সে হলো, "যেদিন সুনীল জলধি হইতে ..." ইত্যাদির পরে। আজ থেকে প্রায় ছ'কোটি বছর আগে এই অঞ্চলটাই এসে মূল এশিয়া ভূখণ্ডে ধাক্কা মারে।

মজার ব্যাপারটা কি জানেন ? মূল এশিয়া ভূখণ্ড বলে হয়তো বিশাল কিছু মহাদেশ তেমন একটা ছিলো না সে সময়। ছাড়া ছাড়া আলগা আলগা কয়েকটা লম্বা লম্বা মাটির টুকরো ছিল। সেগুলো এই প্রবল ধাক্কায় সব জুড়ে টুড়ে গিয়ে এক হয়ে গিয়েছিলো। আর কিছু না হলেও, অন্তত এইজন্যেই ভারতবর্ষকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর। যাই হোক ... 

হ্যাঁ, যা বলছিলাম ... সেই হবু হিমালয়ের ডানপাশে দেখা যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, আর কি আশ্চর্য ! সেই পুরাকালের অস্ট্রেলিয়ার মাথার ওপর প্রায় অবিকৃত অবস্থায় পাপুয়া নিউ গিনিকেও দেখা যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জর বাকি অংশের কিন্তু টিকিটিরও দেখা নেই। অদ্ভূত, না ? 

না, তেমন অদ্ভূত কিছু নয়, কিন্তু সেটা আবার অন্য গল্প। সব গল্প কি একদিনেই শুনে নিলে চলবে ? একটু বাকি রেখে দেওয়া ভালো। ওতে ক্ষিদে বাড়ে ! 

1 comments:

0

প্রবন্ধ - ডঃ সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


নবজাতক ও প্রসূতির স্বাস্থ্য--- কিছু জরুরী কথা
ডঃ সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়


ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে আরম্ভ করে গত শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত, বাংলা ভাষায় লেখা বিভিন্ন গল্প উপন্যাসে, হয় নবজাত শিশুর মৃত্যু কিংবা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু--- এই দুটি ঘটনা খুব 'কমন' ছিল। 
সাহিত্য যদি সমাজের দর্পণ হয়ে থাকে, তবে স্বীকার করতেই হবে, উল্লিখিত সময়ে এই দুই ধরনের মৃত্যুর প্রাবল্য বেশ বেশি ছিল।

জটিল রোগ নয়, মারী নয়, নিতান্ত স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়ার এমন সাংঘাতিক পরিণতি কেন?
 
একটু বিশদে যাওয়া যাক।

প্রসূতি মৃত্যুর সংজ্ঞা কি? শিশুর জন্ম দেওয়ার ৪২ দিনের মধ্যে প্রসবজনিত কারণে কোনো মহিলার মৃত্যু হলে, তাকে প্রসূতিমৃত্যু আখ্যা দেওয়া হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যে মহিলা কতদিনের অন্তঃসত্ত্বা, বা তাঁর গর্ভাধান স্বাভাবিক জায়গায়, অর্থাৎ জরায়ুতে হয়েছে, না অন্যত্র--- সেই বিচার ব্যতিরেকেই এমন সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। 
বলা হয়, যে প্রতি বছর, একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে(অর্থাৎ একটি ব্লক, একটি জেলা কিংবা একটি রাজ্যের মধ্যে),প্রতি এক লক্ষ live birth, অর্থাৎ জীবিত শিশুপ্রসবের ক্ষেত্রে, যতজন প্রসূতি প্রসবের সময় অথবা তার ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রসবজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেটাই প্রসূতি মৃত্যুহার, বা Maternal mortality rate.

অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় ভারতবর্ষ, এই প্রসূতি মৃত্যুহারে বেশ খানিকটি পিছিয়ে রয়েছে। 
1959 সালের প্রতি লক্ষ জীবিত প্রসবে 1000 মাতৃমৃত্যু থেকে 1980 সালে 450 হয়ে, 2012-13 তে 200-র কিছু নীচে নেমে এসেছে ভারতের প্রসূতিমৃত্যুহার। (যেখানে উন্নত দেশে প্রসূতি মৃত্যুহার প্রতি এক লক্ষ জীবিত প্রসবে ১২ থেকে ৫২-র মধ্যে বেঁধে ফেলা গেছে)।

এবারে দেখা যাক, কি কি কারণে, এই মৃত্যু হতে পারে।
কারণগুলোকে আমরা স্ত্রীরোগজনিত, অন্যান্য রোগজনিত, এবং সামাজিক--- এই তিনভাগে ভাগ করে নিতে পারি।
গর্ভস্থ শিশুর জটিল অবস্থান, প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, রক্তাল্পতা, সংক্রমণঘটিত রোগ, গর্ভপাতের চেষ্টা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, লিভার বা কিডনির কোনো অসুখ(যা গর্ভাধানের আগেই হয়েছিল), ক্যানসার------ রোগজনিত কারণে প্রসূতি মৃত্যুর ফর্দ লম্বা। চিকিৎসা পরিভাষার কচকচি দিয়ে তাকে দীর্ঘতর করে লাভ নেই।
আমরা নজর দেব, সামাজিক কারণগুলোর দিকে।
অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া অপরিণত নাবালিকার গর্ভাধান, কোনো রকম জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহার না করে ঘনঘন গর্ভাধান, পুত্রসন্তানের আশায় বারবার অন্তঃসত্ত্বা হওয়া বা প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে, অসাধু, অবিবেকী চিকিৎসকের সহায়তায় ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করে বারবার গর্ভপাত, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কারের বলি হয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব থেকে মুখ ফিরিয়ে, নোংরা অপরিসর আঁতুড়ঘরে অপ্রশিক্ষিত দাইদের হাতে আনাড়ি প্রসব, প্রত্যন্ত অঞ্চলে যানবাহনের অপ্রতুলতা---- এই সবই প্রসূতিমৃত্যুর গুরুতর সামাজিক কারণ।

এবার আসা যাক, এই মৃত্যুহার রোধে আমাদের কি কি করণীয় আছে, তার প্রতি একটু আলোকপাত করি।

একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের এই বিষয়ে অনেক কিছু করার আছে ঠিকই, তবে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে না হলেও, অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায়িত্বশীল বাবা-মা হিসাবে, সমস্ত দায় সরকারের উপর চাপিয়ে দেওয়া যে বাঞ্ছনীয় নয়, সেটা উপলব্ধি করার সময় সম্ভবত এসেছে আজ।

রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দী, আফসানা খাতুনরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে, ঠিকই, কিন্তু, তারা শেষ পর্যন্ত ব্যতিক্রমী ঘটনা হয়েই রয়ে গেছে। সমাজের সর্বস্তরে প্রকৃত বদল এসেছে কি?
আজও অজস্র ঘরে আঠারোর বহু আগেই স্কুলের পাট চুকিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের-- স্রেফ ভাল(?) পাত্র পাওয়া গেছে বলে।
আজও একটি পুত্রসন্তানের লোভে একটি অল্পবয়সী মেয়েকে কুড়ি একুশ বছর বয়সের মধ্যেই তিন চার বার মা হয়ে যেতে হয়। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে প্রযুক্তির উন্নতির নামে ঘৃণ্য বর্বরতা। Prenatal diagnostic technique(সংক্ষেপে PNDT), যবে থেকে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে আরম্ভ করেছে পুত্রপিপাসু সমাজ, বৈধ অবৈধ গর্ভপাতের সংখ্যা বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। অল্প বয়স, অপুষ্ট, অপরিণত শরীর, আর উপর্যুপরি গর্ভপাত--- এই ত্র্যহস্পর্শের জেরে মাতৃমৃত্যুর হার কিছুতেই উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হয়নি। 
চিকিৎসকরাও এর দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। যেমনই পারে না সমাজ।

এবার একটু দৃষ্টি ফেরানো যাক, রাষ্ট্রের ভূমিকার দিকে।

জোসেফ ভোরের নেতৃত্বে 1946 সালে স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রথম কমিটি তৈরির পরে বহু বছর কেটে গেছে। তবু প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ওই কমিটির প্রস্তাবগুলোর উপযোগিতা আজও অনস্বীকার্য।

প্রতি পাঁচহাজার জনসংখ্যা পিছু একটি করে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এই জনস্বাস্থ্য নামক বিশাল ইমারতটির ভিত্তিপ্রস্তর বলে ধরা হয়।
এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক, প্রসূতি ও শিশুমৃত্যু রোধে এই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভূমিকার দিকে।

যে কোনো প্রসূতির, গর্ভাবস্থার ন'মাস দশদিনের মধ্যে অন্তত তিনবার check up প্রয়োজন। এই সময়ে মাপা হয় রক্তচাপ, ওজন(নিয়মিত বাড়ছে কিনা), রক্তাল্পতা আছে কিনা, অন্যান্য আপৎকালীন উপসর্গ-- যেমন পা ফোলা, অতিরিক্ত বমি, বাচ্চার নড়াচড়া অনুভব না করা-- ইত্যাদি উপসর্গ আছে কিনা। প্রতিটি প্রসূতিকে গর্ভাবস্থায় দেওয়া হয় iron আর folic acid এর বড়ি (যাতে রক্তাল্পতার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়), আর টিটেনাসের প্রতিষেধক।
আর প্রত্যেক ভাবী মা এবং তার পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করা হয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব করানোর জন্য।

এই উদ্বুদ্ধ করানোটা কেবল মুখের কথায় নয়। এর জন্য রয়েছে ভারত সরকারের স্বাস্থ্যনীতির অধীন একটি সুবৃহৎ যোজনা-- জননী সুরক্ষা যোজনা। প্রথম দু'টি জীবিত প্রসবের ক্ষেত্রে, তিনটি antenatal check up সম্পূর্ণ করা এবং হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব করা গর্ভধারিণীর জন্য একটি ভাতা রয়েছে, আর রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে সহায়তা করার জন্য একটি নিশ্চয়যান বা ambulance এর সুবিধা। খেয়াল করবেন, এই সুবিধা কেবলমাত্র প্রথম দুটি জীবিত প্রসবের জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ, পরোক্ষে, পরিবার পরিকল্পনাকে উৎসাহিত করছে এই প্রকল্পটি।

যদি দুর্গমতা বা অন্য কোনো কারণে নিতান্তই হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তানের জন্ম দেওয়া সম্ভব না হয়, তবে নিরাপদ প্রসবের ন্যূনতম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে বিভিন্ন রাজ্যের সরকার। 
পশ্চিমবঙ্গে, তা দাই ট্রেনিং নামে খ্যাতিলাভ করেছিল, এক দশক আগে।

পরিচ্ছন্ন হাত, প্রসবের জন্য আলোহাওয়া যুক্ত পরিচ্ছন্ন স্থান, নাড়ি বাঁধার পরিচ্ছন্ন সুতো, নাড়ি কাটার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ব্লেড এবং শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে তাকে মুছিয়ে, জড়িয়ে রাখার পরিচ্ছন্ন কাপড়--- বাড়িতে স্বাভাবিক প্রসবের সময়, এইগুলো দেখে নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। 
এছাড়া, সব প্রসবই তো স্বাভাবিকভাবে হয় না। সেক্ষেত্রে গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা বুঝে তাকে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে প্রসব করানোর কথা বলার প্রশিক্ষণও দাইদের দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য, বর্তমানে সরকার ১০০% প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব করানোর কথাই বলছে।

তবে, সরকার বাহাদুর চাইলেন, আর ব্যাপারটা সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল--- এত সরল নয় বিষয়টা। সরকার আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ভাবনা আদানপ্রদানের সেতুটি বেশ কিছু কর্মীর দ্বারা প্রস্তুত। তার মধ্যে যেমন সরাসরি স্বাস্থ্যদফতরের অধীনে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন(Health assistant), বা রয়েছেন প্রসব করানোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবিকারা(auxiliary nurse midwife বা ANM), তেমনই রয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। এঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছেন কিছু স্বেচ্ছাসেবী, যাঁদের বলা হয়, Accredited social health activists, বা আশা কর্মী।

প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদের পদার্পণও অনিয়মিত, চিকিৎসক তো দূর অস্ত্, সেখানে শিক্ষার আলো না পৌঁছানো দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনার খবর পৌঁছে দেওয়া, প্রসূতির নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা জানানো, নিয়মিত টিকাকরণ ও গর্ভাবস্থায় অন্তত তিনটি চেক আপের কথা বলা, জননী সুরক্ষা যোজনার অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের গুরুত্ব আর উপযোগিতা মানুষকে বোঝানোর গুরুদায়িত্ব পালন করেন এই আশাদিদিরা।

ভারতবর্ষের মত বিশাল দেশে, এই সমাজসেবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া, এত বিপুল সরকারী কর্মকান্ডের সার্থক রূপায়ণ একপ্রকার অসম্ভব ছিল।

এবারে, এক বছর বয়সের নীচে শিশুমৃত্যুর ঘটনাগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।

প্রতি বছর, প্রতি হাজার জীবিত প্রসবের ক্ষেত্রে, শূন্য থেকে এক বছর বয়স পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হারকে আমরা Infant mortality rate বলে অভিহিত করে থাকি। 
এর মধ্যে শূন্য থেকে আঠাশ দিন বয়স পর্যন্ত শিশুমৃত্যুকে আমরা নবজাতক মৃত্যু বলে আখ্যা দিই।

স্বাধীনতা অর্জনের পরেই আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ১৩৪। তার পরের পনের বছরে, সেই হার আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৪৬ (প্রতি হাজার জীবিত প্রসবে)। তারপর ধীরে ধীরে কমতে থাকে শিশুমৃত্যুহার। ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় চল্লিশে। পশ্চিমবঙ্গের গড় জাতীয় গড়ের কিছুটা কম--- প্রতি হাজারে একত্রিশ।

এই শিশুমৃত্যুর পঞ্চাশ শতাংশ আবার জন্মের প্রথম এক মাসের মধ্যেই ঘটে থাকে। তার মধ্যেও জন্মের প্রথম আটচল্লিশ ঘন্টাকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সময় বলা হয়।

নবজাতকের মৃত্যুর মূল কারণগুলি হলো, অপরিণত শিশুর জন্ম, জন্মের সময় কোনো আঘাত বা সংকটজনক প্রসব(normal delivery করা সম্ভব হয় নি যেখানে), জরায়ুফুলের অস্বাভাবিকতা, শিশুর মারাত্মক কোনো জন্মগত ত্রুটি(congenital anomaly), অথবা অপরিণত শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসের সংক্রমণ। এগুলি থেকে নবজাত শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়তে পারে।

আর একমাস থেকে একবছর বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে কারণগুলি হলো-- সংক্রামক পেটের রোগ থেকে পাতলা পায়খানা থেকে জলশূন্যতা, শ্বাসপ্রশ্বাসের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, হুপিংকাশি, মেনিনজাইটিস জাতীয় রোগ, অপুষ্টি অথবা জন্মগত ত্রুটি।

যে অত্যন্ত অল্পবয়সী প্রসূতি, খুব কম সময়ের ব্যবধানে অনেকগুলো শিশুর জন্ম দিয়েছেন, তাঁর ক্ষেত্রেও কম ওজনের, অপুষ্ট শিশু জন্মানোর সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায়, এবং সমানুপাতিক হারে শিশুমৃত্যুর সম্ভাবনাও বাড়ে।

এছাড়া কিছু সামাজিক কুপ্রথা ও কুসংস্কারের জন্যও শিশুদের জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। 
যেমন, জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই মাথার চুল কামানো--- গ্রামেগঞ্জে অধিকাংশ সময়েই অপরিশোধিত ক্ষুর বা বহুব্যবহৃত ব্লেডের সাহায্যে হয়ে থাকে। যদি কোনোভাবে সামান্য রক্তপাতও হয়, তবে তা সংক্রমণকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনার সামিল হয়।
জন্মের পরে শিশুকে প্রাকৃতিক প্রতিষেধক সমৃদ্ধ মায়ের গাঢ় হলুদ দুধ(colostrum) খেতে না দেওয়া, মুখে মধু দেওয়া, নাভিতে গোবর দেওয়া, নির্জলা মাতৃদুগ্ধের পরিবর্তে ভুল মাপে কৃত্রিম কৌটোর দুধ খাওয়ানো--- ইত্যাদি নানা কুপ্রথার ফলে শিশুমৃত্যুর হার এখনো আমাদের দেশে, অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। (আমেরিকা ৬.১, ইংল্যান্ড ৪.২, অস্ট্রেলিয়া ৪.১, দক্ষিণ কোরিয়া ৩.২, সুইডেন ২.৫)।

এর উপরে আছে নানা সামাজিক বৈষম্যের অত্যাচার, যেখানে শিশুকন্যার মৃত্যুহার শিশুপুত্রের মৃত্যুহারের চেয়ে লজ্জাজনক ভাবেই বেশি।(২০১৩তে প্রতি হাজার জীবিত প্রসবে, শিশুকন্যার মৃত্যুহার ছিল বিয়াল্লিশ, যেখানে শিশুপুত্রের ক্ষেত্রে তা ছিল উনচল্লিশ), তবে আশার কথা এই, যে তারতম্য দ্রুত কমে আসছে।

প্রসূতিমৃত্যু কমানোর জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন, শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রেও তা অনেকাংশে প্রযোজ্য। 
যেমন, শিশুর জন্মের পর থেকে প্রথম এক বছরের মধ্যে, যতগুলি আবশ্যক টিকা রয়েছে, অর্থাৎ, বিসিজি, ডিপিটির তিনটি টিকা, ওরাল পোলিওর টিকা(পালস পোলিও সহ), হামের টিকা, হেপাটাইটিস বি-এর টিকা, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শমাফিক সেগুলো সময়মত নিয়ে নেওয়া উচিৎ।
প্রতিটি শিশুকে নিকটবর্তী অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে নিয়মিত নিয়ে গিয়ে তার পুষ্টির পরিমাপ দেখা প্রতিটি বাবা-মায়ের কর্তব্য। যদি অঙ্গনওয়াড়ি দিদি বলেন, যে, শিশুর পুষ্টির মান স্বাভাবিকের নীচে, তাহলে তৎক্ষণাৎ নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করা বাঞ্ছনীয়। 
তাছাড়া, জ্বর, খিঁচুনি, পাতলা দাস্তের কারণে শিশুর শরীরে জলশূন্যতার চিহ্ন, শ্বাসকষ্ট, মায়ের দুধ খেতে না পারা, স্বাভাবিক ওজনবৃদ্ধি না হওয়া-- ইত্যাদি বিপজ্জনক উপসর্গ সম্পর্কে বাবা- মাকে স্বাস্থ্যকর্মী বা আশাদিদিদের সঙ্গে কথা বলে ওয়াকিবহাল হতে হবে। যাতে প্রাথমিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে তাঁদের দেরী না হয়। এই সাধারণ ব্যাপারগুলো খেয়াল রাখলেই কিন্তু, রোগব্যাধিজনিত শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।

কিন্তু সামাজিক কুপ্রথাগুলো দূর করা সর্বাগ্রে জরুরি-- যেটা করা অতটা সহজ নয়।
সরকার তথা রাষ্ট্রের অনেক হাত--- তা চতুর্দিকে ছড়ানো।
সাধারণ গৃহস্থের মনের ভিতরে শিকড় গেড়ে বসে থাকা কুসংস্কারের মহীরূহ সমূলে উৎপাটন করা, রাষ্ট্রের কোনো একটি হাত, যেমন, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী বা চিকিৎসকের একার দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়। ফরমান জারি করে নয়, প্রকৃত শিক্ষাই পারে এই কুসংস্কারের চোরাবালি থেকে জাতিকে বের করে আনতে।

কিন্তু, আমরা, তথাকথিত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত, আধুনিক মানুষেরা, ''ওদের'' বলে যাদের আত্মঘাতী সংস্কারগুলোর কথা শুনে চোখ কপালে তুলি--- তারা ভুলে যাই, যে বিশ্বের দরবারে যখন এই দেশের indicators of life নিয়ে আলোচনা চলবে, তখন কিন্তু সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতার তথ্যমালার পাশাপাশি পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামের তথ্যও ব্যবহৃত হবে গড় পরিমাপ করার জন্য।

যত সহজে বিদ্যুৎ, রাস্তা, পরিশুদ্ধ পানীয় জল, ব্যাঙ্ক বা আন্তর্জাল পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া গেছে অজ গ্রামাঞ্চলের অন্দরে, প্রকৃত শিক্ষার আলো কি পৌঁছে দেওয়া গেছে তার কিছুটা হলেও?

অবশ্যই অনেক কাজ হয়েছে।

প্রত্যেক বাড়িতে শৌচাগার নির্মাণ, প্রতিটি শিশুর সম্পূর্ণ টিকাকরণ, প্রতিটি প্রসূতির প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব, প্রতিটি দম্পতিকে জন্মনিয়ন্ত্রণের সুফল বুঝিয়ে দেওয়া যাতে তারা তাদের সুবিধামাফিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে---- এগুলো করার জন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের, যারা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে আছি, তাদেরও হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

নয়ত, শুধু ডিজিট্যাল ইন্ডিয়ার স্লোগান তুলে আর নতুন নতুন উপগ্রহ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করলেই বিশ্ব মানচিত্রে প্রগতি এবং উন্নয়নের ধ্বজা ওড়ানো যাবে না।

সুতরাং, পথ এখনো অনেক বাকি!

0 comments:

0

প্রবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in

প্রবন্ধ


ইতি নাসিকা সংবাদ 
দীপারুণ ভট্টাচার্য 



"তেজ পাতে তেজ কেন? ঝাল কেন লঙ্কায়? 
নাক কেন ডাকে আর পিলে কেন চমকায়?" 

সুকুমার বাবু এই সব্বনেশে প্রশ্নটি তুলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত নোটবুকে। কিন্তু ধরুন সত্যি সত্যিই কারুর বুক যদি কেঁপে ওঠে! প্রিয় মানুষের সঙ্গে শুয়ে ঘুমের মধ্যে, যদি চমকে ওঠে পিলে! তবে নিশ্চিন্তে মেনে নিন নাসিকা গর্জনই এর একমাত্র কারণ। 

ছোটবেলায় বাপ-ঠাকুরদা'র কাছে শুনেছি স্বাধীনতা সংগ্রামে মহান বিপ্লবীরা তরুণদের 'ডাক' দিয়েছিলেন, স্নেহময়ী মা তার আলাভোলা খোকন সোনাকে ঘুম পাড়াতে চাঁদ-কে ডাকেন "আয় আয় চাঁদমামা টি দিয়ে যা", এ সবই কিন্তু প্রাণের ডাক। আর ধ্বনিগম্ভীর ও বহুবিধ সুরের বাহারে,স্ফীত উদরের থরথর কম্পনে, গুম্ফের শাস্ত্রীয় নৃত্য সহযোগে রাত্রিকালীন যে ডাক শয্যায় পরিবেশিত হয় সে ডাকের ভার যে কতখানি তা এই বড়বেলায় বুঝলাম। আর এও জানলাম যে এইসব ডাকের সব বিচিত্র ভাষার শব্দ বা ধাতুরূপের সন্ধান অন্তত ভারতীয় শব্দ ভাণ্ডার দিতে পারবে না। অভিজ্ঞতা থেকে দু একটি উদাহরণ পেশ করতে পারি - ফোঁ রররররর্ ফোঁৎ, ঘ্রররর ঘ্রিসসস, ভ্রুসসসস ইত্যাদি। 

এমন কোন শব্দ ও তার অর্থ এই মায়াময় সংসারে যদি কারুর জানা থাকে তাহলে এই অধমকে অবগত করিয়ে কৃতার্থ করবেন। 

এখন প্রশ্ন হলো নাক কেন ডাকে? এ বিষয়ে ডাক্তার বাবুরা অনেক গম্ভীর আলোচনা করতে পারেন ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু আমিতো আর ডাক্তার নই তাই দুই লাইনেই পেশ করছি - 

"এই ডাকেতে সাহস ভরে যদিবা দাও সাড়া, 
কাটবে প্রহর বিরক্তিতে এবং নিদ্রা হারা।" 

ভুক্তভোগীরা বিলক্ষণ জানেন যে বিষয়টি হাসি মজার মতো হালকা নয় আদৌ। বহু দাম্পত্য কলহের ঊষা লগ্নের পাঞ্চজন্য বাজিয়েছে ওই নাসিকা গর্জন। এই উপমহাদেশে নেহাত এখনও নারীদের ভিতর ততটা বিদ্রোহী সত্তার জন্ম নেয়নি। তাই এখনও বহু দাম্পত্য টিকে আছে। নাহলে এখানেও পশ্চিমি দুনিয়ার মত সংসার ভাঙার শব্দ নাকের গর্জনকে ছাড়িয়ে যেত। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও বিষয়টা সত্যি। স্বামী ও স্ত্রীর মাঝখানে যখন নাক তার ডাক (পড়ুন গর্জন) পেশের মাধ্যমে, নাক গলিয়ে ফেলে তখন ওঠে পরিত্রাহি রব। শুনেছি সয়ং চার্লি চ্যাপলিন সাহেবেরও একটা বিয়ে শুধু মাত্র নাসিকা গর্জনের কারনেই ভেঙেছিলো। ওদের না হয় অনেক অনেক আছে। একটা আধটা ভেঙেগেলে কি বা আসে যায়! ঠিকই বলছি চার্লি সাহেব হাতের পাঁচ আঙুলের মতোই পাঁচটি বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু আমাদের তো সবে ধন নীলমণি! সেটাও যদি ভেঙে যায়….হায় হায়….! 

হ্যাঁ, আমাদের দেশের অনেক নারীদের কিন্তু শোক করা ছাড়া বিশেষ কিছু করার থাকেনা। রাম কুমার চট্টোপাধ্যায় এর একখানা গান মনে পড়ছে, সেখানে একজন নারী তার বান্ধবীদের বলছেন তার স্বামীর সম্পর্কে; 

"স্বামী নয় ধুমের খণি, নাক ডাকে ঘুমের ঘোরে। 
বাপ-মা যখন পাত্র দেখে, দেখেনি ঘুম পাড়িয়ে তাকে।।" 

কিন্তু আজ সময় বদলেছে। বদলেছে এযুগের নারীর মন। তারা কেন মুখ বুজে সইবেন রাতভর স্বামীর নাসিকা বাণ! একথা অবশ্য একেবারেই ভুল যে নাক ডাকা পুরুষদের জন্মগত অধিকার। অনেক মহিলাও এ গুনের অধিকারিণী। তবে সে সংখ্যাকে নগন্যই বলা যায়। তাই পুরুষের নাক ডাকাকে ঘিরেই সাধারণত খিটিমিটির ঢেউ লাগে সংসার সংগ্রামে। 

যেমন ধরুন না কেন, আমার প্রিয় বন্ধু, জনপ্রিয় নাগের কথাটা। প্রায় আট বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর বান্ধবী নাকচাবি দে'কেই সে বিয়ে করে। সে অবশ্য বেশ কিছুদিন আগের কথা। সম্প্রতি এক ডাক্তার বাবুর প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে জনপ্রিয় এসেছিলো আমার কাছে। তখনই এবিষয়ে আমি বিশদে জানতে পেরেছি। ধর্মত বলছি কারোর আপন জীবনে নাক গলানো বা কান পেতে শোনা আমার রক্তে নেই। আমি নিতান্তই নিরীহ টাইপ। 

বেড়ালটা আসলে বেরিয়েছিল ফুলশয্যার পরের রাতেই। জনপ্রিয় ঘুমাচ্ছে অথচ নাকচাবি নিদ্রাহীন। তাই যা হওয়ার তাই হলো, রাম ধাক্কা…. 

- কি হলো, এত বিচ্ছিরি ভাবে নাক ডাকছো কেন? 

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর হয়না। তাই জনপ্রিয় জড়ান গলায় বলল, বেশি হয়ে গেছে বুঝি? 

প্রশ্নের উত্তরে মহিলারা যদি প্রশ্নই ফিরে পান তবে তাদের ভিতরের বাঘিনী জেগে ওঠে। এ আমি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারি। হলোও তাই। নাকচাবি গলা চড়িয়ে বলল, বেশি মানে, আমি তিন ঘন্টা ধরে জেগে আছি। এখন রাত দুটো বাজে। 

- তোমার কষ্ট হচ্ছে? আমি কি করবো বলতো! 

- এত দিনতো বলোনি যে তুমি এমন বিচ্ছিরি ভাবে নাক ডাকো? 

- আমিওতো আজই জানলাম! 

- সব তোমার বদমাইশি! তুমি জানতে না? ন্যাকামি হচ্ছে! 

- আমি জানতাম একটু আধটু….. 

- বাজে বোকোনা। এমন জানলে কোন দুঃখে… 

- তোমার বাবাও তো নাক ডাকে না কি? 

- তোমার মতো নয়। আর তাছাড়া আমি ছোট বেলা থেকেই আলাদা ঘরে শুই। 

- ইশ বিয়ের আগে যদি একটু অভ্যাস করে আসতে! 

- যাও সোফায় গিয়ে শোও…. 

সে রাতের পর, জনপ্রিয়ের তাই হলো যা অন্যদেরও হয়ে থাকে। "আমি না ঘুমানো পর্যন্ত তুমি ঘুমাতে পারবে না"। অগত্যা শ্রী হরি। 

এই ঘটনার মাস দুই পরে এক পারিবারিক ভ্রমণে জনপ্রিয়-নাকচাবি গেল জিম করবেট জঙ্গলে। জঙ্গলের মধ্যেই রাত্রি বাস। পাশাপাশি ঘর। এক ঘরে জনপ্রিয়-নাকচাবি অন্য ঘরে তার দাদা, বৌদি আর ছয় বছরের ভাইপো, পিংলু। সে বেচারি সারা দিন বাঘের গল্প শুনে শুনে ক্লান্ত। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে জেগে উঠলো স্বভয়ে। প্রাণপণে মাকে জড়িয়ে ধরলো, মা, বাঘ এসে পড়েছে, আমাকে বাঁচাও। ছেলের মাথায় নরম হাত বুলিয়ে মা বললেন, ঘুমিয়ে পড়ো সোনা, বাঘ নয়, ওটা তোমার কাকামনি। এর পরই দরজায় টোকা দিলো দাদা, 'জনো, পাশ ফের….।' 

নাকচাবি তখনও কিছু বলেনি। ব্যাপারটা সীমা ছাড়াল ফেরার ট্রেনে। রাতের অন্ধকারে স্বশব্দে ছুটে চলেছে ট্রেন। সবাই নিদ্রা মগ্ন। হঠাৎ একটা চিৎকারে নাকচাবি'র ঘুম ভাঙলো। শুনলো একজন সহ যাত্রী বলছেন, "ঘাড় ধরে নামা ব্যাটাকে! নাক কেটে হাতে ধরিয়ে দে। অসভ্য ইতর ছোটলো…" মেয়েরা সব পারে কিন্তু স্বামীর অপমান সইতে পারেনা। বাড়ি ফিরেই হুকুম হলো, যে করেই হোক নাসিকা গর্জনের ইতি চাই, চাই, চাই। 

অগত্যা জনপ্রিয় ছুটলো নাক-কান-গলার এক ডাক্তার বাবুর কাছে। সব শুনে তিনি স্বযত্নে বোঝালেন নাক ডাকার কারণ ও ফলাফল। বললেন,….. 

নাক ডাকার মূল কারণ হলো ঘুমোনর সময় নিঃশ্বাসের সমস্যা। ঘুমের মধ্যে প্রশ্বাস এবং নিঃশ্বাস বারবার ব্যহত হলেই মানুষ নাক ডাকে। আসলে শব্দটির উৎস নাক ও গলার সংযোগ স্থল। ঐ অংশে আমাদের কিছু 'সফ্ট টিস্যু' ও পেশি থাকে। ঘুমের সময় গলার ওই পেশির সংকোচন প্রসারণ হয়। তার ফলে যদি গলার ভিতরের শ্বাসনালির পথ বারবার বন্ধ হয় এবং খোলে তখনই নাক থেকে শব্দ বের হয়। নাক ডাকার ফলে শরীরের উপরে চাপ সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে হৃদরোগের কারণ হতে পারে। তাই নাক ডাকাকে দীর্ঘদিন অবহেলা করা উচিত নয়। 

দীর্ঘ দিন অবহেলা করলে, এর থেকে হতে পারে sleep apnea, যা খুবই মারাত্মক। যারা নাক ডাকে তাদের সবারই যে এই রোগ হবেই এমন নয়। তবে এই রোগে আক্রান্ত মানুষদের ঘুমের মধ্যে মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় ৪৬% বেড়ে যায়। এমন মানুষও আছেন যারা ৬ ঘন্টার ঘুমের মধ্যে প্রায় ২৫০০-৩০০০ বার নাক ডাকেন। পলিসমনোগ্রাফি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করতে হয় সত্যি sleep apnea হয়েছে কিনা। যদি তা হয় তবে একটি যন্ত্র এখন বেরিয়েছে যেটি নাকে লাগিয়ে শুলে, সমস্যা অনেক অংশেই কমে যায়। 

এসব বলার পর ডাক্তার বাবু বললেন, এখুনি অত চিন্তা করার কিছু নেই। আগে লাইফ স্টাইলে কিছু পরিবর্তন করুন। আমি লিখে দিচ্ছি। তাতে যদি কিছু না হয় তাহলে মাস ছয় বাদে আসুন। তখন দেখবো কি করা যায়। 

ডাক্তার বাবুর প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে সেদিন সে বাড়ি ফেরে। কিন্তু ডাক্তারদের হাতের লেখা বোঝা কি এতোই সহজ। কাজেই বন্ধুটিকে আসতেই হলো একজন ডাক্তারি হস্ত লেখা বিশারদ, মানে আমার কাছে। অনেক পড়ে ও ভেবে চিন্তে ডাক্তার বাবুর প্রেস্ক্রিপশনের একটা বাংলা তর্জমা করেছিলাম সেদিন। আমার বন্ধু সেটা কতটা পালন করেছে ঠিক জানিনা। তবে জনপ্রিয়-নাকচাবি এখন আগের চেয়ে যে বেশ আমোদেই আছে; এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। সত্যি, দেখলেও ভালো লাগে। 

শুয়ে পড়ে কাত হয়ে যাও 
কমিয়ে ফেলো ওজন, 
অনেক খানি জল পান আর 
রাতে হালকা ভোজন। 

ভোজন শেষে বিছানা বালিশ 
নয় গো তাড়াতাড়ি, 
শান্ত মাথায় এদিক ওদিক 
হোকনা পায়চারি। 

বদ নেশাটা হোকনা বিদায় 
বিড়ি সিগারেট খরচা, 
নিয়ম করে হোকনা শুরু 
হালকা শরীর চর্চা। 

বালিশ খানা উঁচুই ভালো 
হোক সে নরম তুলো, 
নিয়ম করে সাফাই করো 
নাসারন্ধ্র গুলো। 

হিসাব করে ঠিক করে নাও 
ঘুমের সময় খানা, 
নাক ডাকাটা কমবে তবেই 
ওমনি ওষুধ বিনা। 

এদিকে আমার হয়েছে অন্য জ্বালা। অফিসের কাজে মাঝে মধ্যে বাইরে যেতে হয় আমায়। বৌ বলে আমি না থাকলে তার নাকি ঘুমই হয় না। কেন? আমার নাক ডাকার তালে তালেই সে তার ঘুম গভীর করতে শিখেছে। 

বোঝো কাণ্ড। 

এখন ভাবছি বৌকে একটা কানের ডাক্তার দেখাবো কিনা!

0 comments:

2

বইঘর - চয়ন

Posted in

বইঘর


বইঘরে অবলোকন 
চয়ন


নমস্কার। বইঘর থেকে কথা বলছি অবলোকন পাত্র। আজ আমার ডাকে সাড়া দিয়ে যে দুজন এখানে এসেছেন তাঁদের পায়ের ধুলোয় বইঘর ধন্য। আসুন পরিচয় করিয়ে দিই। আমার ডানপাশে যিনি আছেন গত দুশো বছরের মধ্যে পৃথিবীতে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি যার সঙ্গে তাঁর কোনও না কোনও যোগ নেই। এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে তিনি যাননি। দীর্ঘ শীর্ণ দেহ ,চাড়া দেওয়া গোঁফ; স্থান কালের অধীনতা অস্বীকারকারী একামেবাদ্বিতীয়ম্ ঘনশ্যাম দাস। আমার বাঁ পাশে বসে থাকা এই প্রবীণ মানুষটিকেও আপনারা সবাই চেনেন। মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে, দাড়ি গোঁফ আছে , চোখে একজোড়া সোনার চশমা। প্রশস্ত ললাটের অধিকারী, শান্ত, সংযত, ঋষিপ্রতিম, ঊনসত্তরটি ভাষায় সাবলীল জ্ঞানের যে কোনও মার্গে অবাধ বিচরণশীল, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, কালজয়ী, অমর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। আজ প্রফেসর শঙ্কুর সঙ্গে কথা বলবেন শ্রীদাস। আমার কাজ দোহারের। 

অবলোকন : ঘনাদা, আপনার মুখে আপনার পেটেন্ট বাঁকা হাসি। কারণ, আমি অবশ্যই জানি। কিন্তু,বলব না। আপনি কথা আরম্ভ করুন।

দাস : প্রফেসর শঙ্কু, প্রণাম। 

শঙ্কু : কীর্তিমান হও ঘনশ্যাম। বল কী জানতে চাও। 

দাস : আচ্ছা, প্রোটোভিট্রোমর্ফিজেনেরাস সলিউশন, ট্যানট্রাম বোরোপ্যাক্সিনেট, একুইয়স্ ভেলোসিলিকা এগুলো কী জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ প্রফেসর? একটু যদি ফর্মূলাটা বলে দেন। 

শঙ্কু : তোমাদের কেতাবী বিজ্ঞানে এর হদিশ পাবে না। এ শুধু পৃথিবীর একটি মানুষই বানাতে পারে। আর সেরকম মানুষ পৃথিবীতে একটিই আছে। তার নাম...

দাস : ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। জানি তো। ব্যাঙের ছাতা, কচ্ছপের ডিমের খোল, আর সাপের খোলস মেশানো কম্পাউণ্ড, গলদা চিংড়ির গোঁফ দিয়ে তৈরী মিরাকিউরল... সত্যিই একজনই বানাতে পারে! পরে অবশ্য বলেছেন স্বর্ণপর্ণী দিয়ে বানিয়েছিলেন এই ওষুধ। তার মানে হয় হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের আদল আর নয়তো স্রেফ ভাগ্য! বিজ্ঞানের সব শাখায় আপনার অবাধ বিচরণ কিন্তু আপনি ঘোষণা করেন যে, 'কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকেই আমি সম্পূর্ণ মানুষের সৃষ্টি বলে মনে করতে পারি না।' বিরাট ফাঁক রয়ে গেল যে একটা! 

শঙ্কু : কী ফাঁক ঘনশ্যাম? 

দাস : সেই ফাঁক যার মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের সঙ্গে মিশে যায় ভূত, প্রেত, টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভয়েন্স। বটুকেশ্বরের তন্ত্রসামগ্রী আর নিওস্পেকট্রোস্কোপ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ হয়ে যোগসাধনা আর বিজ্ঞানকে এক করে তোলে। আপনার পোলার রিপলেয়ন থিওরি আর ভূতপ্রেতের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণামূলক বইয়ের মধ্যে কোনও ফারাক থাকে না। সামূহিক কল্প বিশ্বাসের শক্তি আর বিজ্ঞানের শক্তি মিলে মিশে একাকার হয়ে এক ডুলুং ডো গড়ে তোলে যেখানে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র আর ক্রাগের মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার, অমঙ্গলকারী গ্রহরাজ শনি আর আর গ্রোপিয়াস, অ্যালকেমি আর বিজ্ঞানসাধনা সবই একই অঙ্গে লীন!

অবলোকন : আপনি উত্তর দেওয়ার আগে একটা কথা বলে নিই প্রফেসর। ঘনাদার তথ্যনিষ্ঠা কিংবদন্তিপ্রতিম। সম্পূর্ণ কাল্পনিক বা অস্তিত্বহীন কোনওকিছুকেই তিনি তাঁর বিশ্বে প্রবেশাধিকার দেন না।

শঙ্কু : জানি অবলোকন। আমি তোমায় শ্রদ্ধা করি ঘনশ্যাম। কিন্তু, তুমি আর আমি একেবারে দুরকম চোখে বিশ্ব দেখি। বিজ্ঞানকে আমি পুরোপুরি মানুষের সৃষ্টি বলি না কেন সে তুমি জান অবলোকন। অনন্ত সম্ভাবনা, অনন্ত মহাবিশ্ব। কখন, কোন সম্ভাবনা বাস্তবরূপ নেবে সেটা একা মানুষ নিয়ন্ত্রণ করবে কী ভাবে? মানুষের চেয়ে অনেক বড় একটা শক্তির অস্তিত্ব আমি মানি ঘনশ্যাম। সে শক্তি বিশ্ব প্রকৃতির অণু পরমাণুতে। আমার উত্তরাধিকারই আমায় ত্রিলোকেশ্বর নাম দিয়েছে। আমি বিষ্ণু, শিব বা সূর্য কোনওটাই না। তবু, আমি তিমিরাতীত জ্যোতিকে দেখি। দেখি অসংখ্য কিশোর কিশোরীর হাসি ভরা মুখের মধ্যে। হ্যাঁ, তুমিও তাই দেখ আমি জানি। তবে আমাদের মৌলিক পার্থক্য হলো আমি মানবকেন্দ্রিক বিজ্ঞানের গা জোয়ারিটা মানতে পারি না। কোটি কোটি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস বা বিস্ময়বোধ, অজানা রহস্যের প্রতি টান, প্রাচ্য পাশ্চাত্য ছাড়ানো সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের আনন্দ আমি ওদের মধ্যে চারিয়ে দিতে চেয়েছি। ধন্য অ্যালকেমি যার থেকে কেমিস্ট্রি শব্দটা এসেছে। ধন্য হারুণ অল্ রশিদের বাগদাদ। ধন্য সুমেরীয় সভ্যতা। ধন্য তাজমহল,ধন্য পার্থেনন। ধন্য ধন্য মানি আমি এই সবকে। আলতামিরার বাইসন যে আঁকে সে অমর ঘনশ্যাম। সেই মানবের আত্মা। তাই সে অমর গুহামানব। যুগ যুগ ধরে জ্ঞান সঞ্চয় করে চলে। এ সেই জ্ঞান যা বোঝে আজও বিজ্ঞান জানে না অন্ন বস্ত্র বাসস্থান জনিত সমস্যা দূরের উপায়, স্মৃতির রহস্য, মৃত্যুর পরের অবস্থা। যন্ত্র যে সভ্যতার প্রভু হতে চলেছে সেই জড়বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত বিশ্বকে প্রশ্ন করে মহাকাশের দূত, কম্পু। আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রাণিত করতে চাই যারা আমার কথা শোনে তাদের।

অবলোকন : ঘনাদা, প্রফেসর মনে হচ্ছে বিজ্ঞান আর ক্ষমতার সমীকরণের কথা বলছেন। সেই পুঁজির উদ্ভবের সময় থেকে আমি দেখে আসছি কেমন করে তা বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করে। উপনিবেশ যখন গড়ে উঠছে সেই তখন থেকে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষমতা কায়েম রাখার জন্য। ব্যারাকপুরে ইংরেজ সৈন্যরা অজানা জ্বরে মরছে যখন তখনই রোলাণ্ড রস্ কলকাতায় মশা নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করছেন এ আমার নিজের চোখে দেখা। ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরীই হয়েছে উপনিবেশের রক্ষীদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য। বিজ্ঞানের পশ্চিমমুখীনতা, তাকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার যে প্রবণতা তার একটা বিরোধিতা তৈরী হওয়ার দরকার নেই কি?

দাস : একশবার আছে অবলোকন। তুমি দেখেছ কীভাবে এই বিরোধিতা বারবার আমি নিজে করেছি। তাই আমি অবাক হয়ে প্রফেসরের কথা শুনছিলাম! বিজ্ঞান আর ক্ষমতার যৌগপত্যের কথা কে বলছেন না যিনি স্নাফ্ গানের প্রয়োগ প্রথম করেন চাকর প্রহ্লাদের ওপর! মেনে নিচ্ছি উনি আর আমি একই রকম নারী বর্জিত বিশ্বে বাস করি। সাধারণ মানুষ আর চাকর বাকর বেষ্টিত সে দুনিয়া। কিন্তু, অবলোকন, শিবু, গৌর, শিশির, সুধীর, রামভুজ, বানোয়ারী আর আমার মধ্যে আদতে কোনও তফাৎ আছে কি? আমার নামের সঙ্গে জোড়া দাদা বা বড়াবাবু শব্দদুটো স্রেফ আদরের ডাক। আর ওদিকে? সাধারণ মানুষের প্রতি কী নিঃসীম অবজ্ঞা। অবিনাশবাবুকে উনি নগন্য মানুষ বলেন, খোকার পোস্ট অফিসের কেরানি বাবা ওঁকে 'বাবু' বলেন, প্রহ্লাদ আর ওঁরা এঁর কাছে প্রায় এক। পশ্চিমি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দহরম মহরমে বারবার যে ক্ষমতার গরিমা প্রকাশ পায় সেটা দেখে আমার ওঁকে বলতে ইচ্ছে করে, আমার দেশের নাম মানুষের দুনিয়া। হটেনটট, হাউসা মোড়ল, পেত্রা, তানাকা সবাই এক সেখানে। আপনার জগৎ তার মধ্যে নেই বোয়ানা। সেই 'জল'এর অভিযানের সময় যেমন বলেছিলাম ফিংককে। 

শঙ্কু : একটু বেশি কঠোর হচ্ছ না ঘনশ্যাম? তুমি ভুলে যাচ্ছ আফ্রিকা আর স্বপ্নদ্বীপে অবিনাশবাবু কী ভাবে আমার প্রাণ বাঁচান? নকুড়বাবুর কথা ভুলে যাচ্ছ? এঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা মনে নেই তোমার? একবার ভাব তো লাল খাতায় অবিনাশবাবু নিজের ভাষায় কথা বলে কেমন ভাবে আমার বয়ানের ওপর ওঁর স্বাক্ষর রেখেছেন স্বপ্নদ্বীপে? গরিলার হাত থেকে আমায় উদ্ধার করার ঘটনাটার সবটাই ওঁর গলায় শোনা যায়। প্রহ্লাদের প্রতি আমার মনোভাব একটা বিশেষ শ্রেণী চরিত্র প্রসূত ঠিকই। তার জন্য আমি গর্বিতও নই। কিন্তু, ঘনশ্যাম, ও আর নিউটন ছাড়া আসলে যে আমার কেউ নেই সেটাও তো ঠিক? খুব প্রভুত্বকামী মনে হচ্ছে কি আমাকে? খুব অমানবিক? 

দাস : ক্ষমা করবেন। আমি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। তবুও, আমার মূল আপত্তিটা থেকেই যাচ্ছে। কঙ্গো অভিযানে আপনি কিন্তু নিজে বলছেন যে স্ট্যানলি, ম্যাঙ্গোপার্ক, লিভিংস্টোনের পথে চলেছেন আপনি। কিগানি ক্যানিবলদের দেখছেন জিম ম্যাহনির চোখে মানে সাদারা যা বারবার বলে এসেছে আঁধার মহাদেশ সম্পর্কে সেই চোখে। বলছেন যে দুহাজার মাইল বিস্তৃত ট্রপিকাল রেইন ফরেস্টের অনেক অংশেই 'সভ্য' মানুষের পা পড়েনি এখনও। কিং সলোমনস্ মাইনস্, ব্যালান্টাইন, বয়েজ্ ঔন্ পেপারের গন্ধটা যে বড় প্রকট প্রফেসর শঙ্কু! মানবপ্রেমী ত্রিলোকেশ্বরের বিশ্ববীক্ষণ আর ঊনবিংশ শতকের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গী এক? কাহিন্দিরা ভাঙা ইংরিজি না শিখলে সভ্য হবে না? শুধু ম্যাকফারসনরা গীতাঞ্জলি পড়লেই প্রাচ্য প্রতীচ্য মিলন সম্পূর্ণ? 

অবলোকন : প্রফেসর মুখ নামিয়েছেন। লজ্জা পাবেন না প্রফেসর শঙ্কু। আসলে আপনারা দুই অমর একে অপরের পরিপূরক। আপনার কথা শুনে জন্মানো বিস্ময় বোধ নিয়ে ঘনাদার বিশ্বে যে পা রাখবে সে অক্লেশে বুঝবে জীবন পরস্পর বিরোধিতাতেই গড়া। ঘনাদা, আপনার আর প্রফেসরের সম্মিলিত স্বর শুনেই সে বুঝতে শিখবে যে আপনারা যে ভুবন গড়েন তার প্রেরণা 'শুধু অবসর বিনোদন নয়, মানসিক বিলাস নয়।' এর চালিকাশক্তি হলো 'সামনে ও পেছনের এই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে দুর্জ্ঞেয় পণ্যময় জীবনের কথা জীবনের ভাষায় বলার বিরাট, বিপুল এক দায়।' ১৯৪৪এ এই কথা আমায় বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। আপনাদের দুজনকে অসংখ্য ধন্যবাদ বইঘরে আসার জন্য।

2 comments: