প্রবন্ধ
নবজাতক ও প্রসূতির স্বাস্থ্য--- কিছু জরুরী কথা
ডঃ সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে আরম্ভ করে গত শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত, বাংলা ভাষায় লেখা বিভিন্ন গল্প উপন্যাসে, হয় নবজাত শিশুর মৃত্যু কিংবা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু--- এই দুটি ঘটনা খুব 'কমন' ছিল।
সাহিত্য যদি সমাজের দর্পণ হয়ে থাকে, তবে স্বীকার করতেই হবে, উল্লিখিত সময়ে এই দুই ধরনের মৃত্যুর প্রাবল্য বেশ বেশি ছিল।
জটিল রোগ নয়, মারী নয়, নিতান্ত স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়ার এমন সাংঘাতিক পরিণতি কেন?
একটু বিশদে যাওয়া যাক।
প্রসূতি মৃত্যুর সংজ্ঞা কি? শিশুর জন্ম দেওয়ার ৪২ দিনের মধ্যে প্রসবজনিত কারণে কোনো মহিলার মৃত্যু হলে, তাকে প্রসূতিমৃত্যু আখ্যা দেওয়া হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যে মহিলা কতদিনের অন্তঃসত্ত্বা, বা তাঁর গর্ভাধান স্বাভাবিক জায়গায়, অর্থাৎ জরায়ুতে হয়েছে, না অন্যত্র--- সেই বিচার ব্যতিরেকেই এমন সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
বলা হয়, যে প্রতি বছর, একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে(অর্থাৎ একটি ব্লক, একটি জেলা কিংবা একটি রাজ্যের মধ্যে),প্রতি এক লক্ষ live birth, অর্থাৎ জীবিত শিশুপ্রসবের ক্ষেত্রে, যতজন প্রসূতি প্রসবের সময় অথবা তার ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রসবজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেটাই প্রসূতি মৃত্যুহার, বা Maternal mortality rate.
অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় ভারতবর্ষ, এই প্রসূতি মৃত্যুহারে বেশ খানিকটি পিছিয়ে রয়েছে।
1959 সালের প্রতি লক্ষ জীবিত প্রসবে 1000 মাতৃমৃত্যু থেকে 1980 সালে 450 হয়ে, 2012-13 তে 200-র কিছু নীচে নেমে এসেছে ভারতের প্রসূতিমৃত্যুহার। (যেখানে উন্নত দেশে প্রসূতি মৃত্যুহার প্রতি এক লক্ষ জীবিত প্রসবে ১২ থেকে ৫২-র মধ্যে বেঁধে ফেলা গেছে)।
এবারে দেখা যাক, কি কি কারণে, এই মৃত্যু হতে পারে।
কারণগুলোকে আমরা স্ত্রীরোগজনিত, অন্যান্য রোগজনিত, এবং সামাজিক--- এই তিনভাগে ভাগ করে নিতে পারি।
গর্ভস্থ শিশুর জটিল অবস্থান, প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, রক্তাল্পতা, সংক্রমণঘটিত রোগ, গর্ভপাতের চেষ্টা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, লিভার বা কিডনির কোনো অসুখ(যা গর্ভাধানের আগেই হয়েছিল), ক্যানসার------ রোগজনিত কারণে প্রসূতি মৃত্যুর ফর্দ লম্বা। চিকিৎসা পরিভাষার কচকচি দিয়ে তাকে দীর্ঘতর করে লাভ নেই।
আমরা নজর দেব, সামাজিক কারণগুলোর দিকে।
অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া অপরিণত নাবালিকার গর্ভাধান, কোনো রকম জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহার না করে ঘনঘন গর্ভাধান, পুত্রসন্তানের আশায় বারবার অন্তঃসত্ত্বা হওয়া বা প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে, অসাধু, অবিবেকী চিকিৎসকের সহায়তায় ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করে বারবার গর্ভপাত, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কারের বলি হয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব থেকে মুখ ফিরিয়ে, নোংরা অপরিসর আঁতুড়ঘরে অপ্রশিক্ষিত দাইদের হাতে আনাড়ি প্রসব, প্রত্যন্ত অঞ্চলে যানবাহনের অপ্রতুলতা---- এই সবই প্রসূতিমৃত্যুর গুরুতর সামাজিক কারণ।
এবার আসা যাক, এই মৃত্যুহার রোধে আমাদের কি কি করণীয় আছে, তার প্রতি একটু আলোকপাত করি।
একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের এই বিষয়ে অনেক কিছু করার আছে ঠিকই, তবে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে না হলেও, অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায়িত্বশীল বাবা-মা হিসাবে, সমস্ত দায় সরকারের উপর চাপিয়ে দেওয়া যে বাঞ্ছনীয় নয়, সেটা উপলব্ধি করার সময় সম্ভবত এসেছে আজ।
রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দী, আফসানা খাতুনরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে, ঠিকই, কিন্তু, তারা শেষ পর্যন্ত ব্যতিক্রমী ঘটনা হয়েই রয়ে গেছে। সমাজের সর্বস্তরে প্রকৃত বদল এসেছে কি?
আজও অজস্র ঘরে আঠারোর বহু আগেই স্কুলের পাট চুকিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের-- স্রেফ ভাল(?) পাত্র পাওয়া গেছে বলে।
আজও একটি পুত্রসন্তানের লোভে একটি অল্পবয়সী মেয়েকে কুড়ি একুশ বছর বয়সের মধ্যেই তিন চার বার মা হয়ে যেতে হয়। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে প্রযুক্তির উন্নতির নামে ঘৃণ্য বর্বরতা। Prenatal diagnostic technique(সংক্ষেপে PNDT), যবে থেকে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে আরম্ভ করেছে পুত্রপিপাসু সমাজ, বৈধ অবৈধ গর্ভপাতের সংখ্যা বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। অল্প বয়স, অপুষ্ট, অপরিণত শরীর, আর উপর্যুপরি গর্ভপাত--- এই ত্র্যহস্পর্শের জেরে মাতৃমৃত্যুর হার কিছুতেই উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হয়নি।
চিকিৎসকরাও এর দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। যেমনই পারে না সমাজ।
এবার একটু দৃষ্টি ফেরানো যাক, রাষ্ট্রের ভূমিকার দিকে।
জোসেফ ভোরের নেতৃত্বে 1946 সালে স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রথম কমিটি তৈরির পরে বহু বছর কেটে গেছে। তবু প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ওই কমিটির প্রস্তাবগুলোর উপযোগিতা আজও অনস্বীকার্য।
প্রতি পাঁচহাজার জনসংখ্যা পিছু একটি করে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এই জনস্বাস্থ্য নামক বিশাল ইমারতটির ভিত্তিপ্রস্তর বলে ধরা হয়।
এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক, প্রসূতি ও শিশুমৃত্যু রোধে এই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভূমিকার দিকে।
যে কোনো প্রসূতির, গর্ভাবস্থার ন'মাস দশদিনের মধ্যে অন্তত তিনবার check up প্রয়োজন। এই সময়ে মাপা হয় রক্তচাপ, ওজন(নিয়মিত বাড়ছে কিনা), রক্তাল্পতা আছে কিনা, অন্যান্য আপৎকালীন উপসর্গ-- যেমন পা ফোলা, অতিরিক্ত বমি, বাচ্চার নড়াচড়া অনুভব না করা-- ইত্যাদি উপসর্গ আছে কিনা। প্রতিটি প্রসূতিকে গর্ভাবস্থায় দেওয়া হয় iron আর folic acid এর বড়ি (যাতে রক্তাল্পতার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়), আর টিটেনাসের প্রতিষেধক।
আর প্রত্যেক ভাবী মা এবং তার পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করা হয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব করানোর জন্য।
এই উদ্বুদ্ধ করানোটা কেবল মুখের কথায় নয়। এর জন্য রয়েছে ভারত সরকারের স্বাস্থ্যনীতির অধীন একটি সুবৃহৎ যোজনা-- জননী সুরক্ষা যোজনা। প্রথম দু'টি জীবিত প্রসবের ক্ষেত্রে, তিনটি antenatal check up সম্পূর্ণ করা এবং হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব করা গর্ভধারিণীর জন্য একটি ভাতা রয়েছে, আর রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে সহায়তা করার জন্য একটি নিশ্চয়যান বা ambulance এর সুবিধা। খেয়াল করবেন, এই সুবিধা কেবলমাত্র প্রথম দুটি জীবিত প্রসবের জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ, পরোক্ষে, পরিবার পরিকল্পনাকে উৎসাহিত করছে এই প্রকল্পটি।
যদি দুর্গমতা বা অন্য কোনো কারণে নিতান্তই হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তানের জন্ম দেওয়া সম্ভব না হয়, তবে নিরাপদ প্রসবের ন্যূনতম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে বিভিন্ন রাজ্যের সরকার।
পশ্চিমবঙ্গে, তা দাই ট্রেনিং নামে খ্যাতিলাভ করেছিল, এক দশক আগে।
পরিচ্ছন্ন হাত, প্রসবের জন্য আলোহাওয়া যুক্ত পরিচ্ছন্ন স্থান, নাড়ি বাঁধার পরিচ্ছন্ন সুতো, নাড়ি কাটার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ব্লেড এবং শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে তাকে মুছিয়ে, জড়িয়ে রাখার পরিচ্ছন্ন কাপড়--- বাড়িতে স্বাভাবিক প্রসবের সময়, এইগুলো দেখে নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
এছাড়া, সব প্রসবই তো স্বাভাবিকভাবে হয় না। সেক্ষেত্রে গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা বুঝে তাকে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে প্রসব করানোর কথা বলার প্রশিক্ষণও দাইদের দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য, বর্তমানে সরকার ১০০% প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব করানোর কথাই বলছে।
তবে, সরকার বাহাদুর চাইলেন, আর ব্যাপারটা সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল--- এত সরল নয় বিষয়টা। সরকার আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ভাবনা আদানপ্রদানের সেতুটি বেশ কিছু কর্মীর দ্বারা প্রস্তুত। তার মধ্যে যেমন সরাসরি স্বাস্থ্যদফতরের অধীনে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন(Health assistant), বা রয়েছেন প্রসব করানোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবিকারা(auxiliary nurse midwife বা ANM), তেমনই রয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। এঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছেন কিছু স্বেচ্ছাসেবী, যাঁদের বলা হয়, Accredited social health activists, বা আশা কর্মী।
প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদের পদার্পণও অনিয়মিত, চিকিৎসক তো দূর অস্ত্, সেখানে শিক্ষার আলো না পৌঁছানো দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনার খবর পৌঁছে দেওয়া, প্রসূতির নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা জানানো, নিয়মিত টিকাকরণ ও গর্ভাবস্থায় অন্তত তিনটি চেক আপের কথা বলা, জননী সুরক্ষা যোজনার অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের গুরুত্ব আর উপযোগিতা মানুষকে বোঝানোর গুরুদায়িত্ব পালন করেন এই আশাদিদিরা।
ভারতবর্ষের মত বিশাল দেশে, এই সমাজসেবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া, এত বিপুল সরকারী কর্মকান্ডের সার্থক রূপায়ণ একপ্রকার অসম্ভব ছিল।
এবারে, এক বছর বয়সের নীচে শিশুমৃত্যুর ঘটনাগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
প্রতি বছর, প্রতি হাজার জীবিত প্রসবের ক্ষেত্রে, শূন্য থেকে এক বছর বয়স পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হারকে আমরা Infant mortality rate বলে অভিহিত করে থাকি।
এর মধ্যে শূন্য থেকে আঠাশ দিন বয়স পর্যন্ত শিশুমৃত্যুকে আমরা নবজাতক মৃত্যু বলে আখ্যা দিই।
স্বাধীনতা অর্জনের পরেই আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ১৩৪। তার পরের পনের বছরে, সেই হার আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৪৬ (প্রতি হাজার জীবিত প্রসবে)। তারপর ধীরে ধীরে কমতে থাকে শিশুমৃত্যুহার। ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় চল্লিশে। পশ্চিমবঙ্গের গড় জাতীয় গড়ের কিছুটা কম--- প্রতি হাজারে একত্রিশ।
এই শিশুমৃত্যুর পঞ্চাশ শতাংশ আবার জন্মের প্রথম এক মাসের মধ্যেই ঘটে থাকে। তার মধ্যেও জন্মের প্রথম আটচল্লিশ ঘন্টাকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সময় বলা হয়।
নবজাতকের মৃত্যুর মূল কারণগুলি হলো, অপরিণত শিশুর জন্ম, জন্মের সময় কোনো আঘাত বা সংকটজনক প্রসব(normal delivery করা সম্ভব হয় নি যেখানে), জরায়ুফুলের অস্বাভাবিকতা, শিশুর মারাত্মক কোনো জন্মগত ত্রুটি(congenital anomaly), অথবা অপরিণত শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসের সংক্রমণ। এগুলি থেকে নবজাত শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
আর একমাস থেকে একবছর বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে কারণগুলি হলো-- সংক্রামক পেটের রোগ থেকে পাতলা পায়খানা থেকে জলশূন্যতা, শ্বাসপ্রশ্বাসের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, হুপিংকাশি, মেনিনজাইটিস জাতীয় রোগ, অপুষ্টি অথবা জন্মগত ত্রুটি।
যে অত্যন্ত অল্পবয়সী প্রসূতি, খুব কম সময়ের ব্যবধানে অনেকগুলো শিশুর জন্ম দিয়েছেন, তাঁর ক্ষেত্রেও কম ওজনের, অপুষ্ট শিশু জন্মানোর সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায়, এবং সমানুপাতিক হারে শিশুমৃত্যুর সম্ভাবনাও বাড়ে।
এছাড়া কিছু সামাজিক কুপ্রথা ও কুসংস্কারের জন্যও শিশুদের জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
যেমন, জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই মাথার চুল কামানো--- গ্রামেগঞ্জে অধিকাংশ সময়েই অপরিশোধিত ক্ষুর বা বহুব্যবহৃত ব্লেডের সাহায্যে হয়ে থাকে। যদি কোনোভাবে সামান্য রক্তপাতও হয়, তবে তা সংক্রমণকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনার সামিল হয়।
জন্মের পরে শিশুকে প্রাকৃতিক প্রতিষেধক সমৃদ্ধ মায়ের গাঢ় হলুদ দুধ(colostrum) খেতে না দেওয়া, মুখে মধু দেওয়া, নাভিতে গোবর দেওয়া, নির্জলা মাতৃদুগ্ধের পরিবর্তে ভুল মাপে কৃত্রিম কৌটোর দুধ খাওয়ানো--- ইত্যাদি নানা কুপ্রথার ফলে শিশুমৃত্যুর হার এখনো আমাদের দেশে, অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। (আমেরিকা ৬.১, ইংল্যান্ড ৪.২, অস্ট্রেলিয়া ৪.১, দক্ষিণ কোরিয়া ৩.২, সুইডেন ২.৫)।
এর উপরে আছে নানা সামাজিক বৈষম্যের অত্যাচার, যেখানে শিশুকন্যার মৃত্যুহার শিশুপুত্রের মৃত্যুহারের চেয়ে লজ্জাজনক ভাবেই বেশি।(২০১৩তে প্রতি হাজার জীবিত প্রসবে, শিশুকন্যার মৃত্যুহার ছিল বিয়াল্লিশ, যেখানে শিশুপুত্রের ক্ষেত্রে তা ছিল উনচল্লিশ), তবে আশার কথা এই, যে তারতম্য দ্রুত কমে আসছে।
প্রসূতিমৃত্যু কমানোর জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন, শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রেও তা অনেকাংশে প্রযোজ্য।
যেমন, শিশুর জন্মের পর থেকে প্রথম এক বছরের মধ্যে, যতগুলি আবশ্যক টিকা রয়েছে, অর্থাৎ, বিসিজি, ডিপিটির তিনটি টিকা, ওরাল পোলিওর টিকা(পালস পোলিও সহ), হামের টিকা, হেপাটাইটিস বি-এর টিকা, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শমাফিক সেগুলো সময়মত নিয়ে নেওয়া উচিৎ।
প্রতিটি শিশুকে নিকটবর্তী অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে নিয়মিত নিয়ে গিয়ে তার পুষ্টির পরিমাপ দেখা প্রতিটি বাবা-মায়ের কর্তব্য। যদি অঙ্গনওয়াড়ি দিদি বলেন, যে, শিশুর পুষ্টির মান স্বাভাবিকের নীচে, তাহলে তৎক্ষণাৎ নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করা বাঞ্ছনীয়।
তাছাড়া, জ্বর, খিঁচুনি, পাতলা দাস্তের কারণে শিশুর শরীরে জলশূন্যতার চিহ্ন, শ্বাসকষ্ট, মায়ের দুধ খেতে না পারা, স্বাভাবিক ওজনবৃদ্ধি না হওয়া-- ইত্যাদি বিপজ্জনক উপসর্গ সম্পর্কে বাবা- মাকে স্বাস্থ্যকর্মী বা আশাদিদিদের সঙ্গে কথা বলে ওয়াকিবহাল হতে হবে। যাতে প্রাথমিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে তাঁদের দেরী না হয়। এই সাধারণ ব্যাপারগুলো খেয়াল রাখলেই কিন্তু, রোগব্যাধিজনিত শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
কিন্তু সামাজিক কুপ্রথাগুলো দূর করা সর্বাগ্রে জরুরি-- যেটা করা অতটা সহজ নয়।
সরকার তথা রাষ্ট্রের অনেক হাত--- তা চতুর্দিকে ছড়ানো।
সাধারণ গৃহস্থের মনের ভিতরে শিকড় গেড়ে বসে থাকা কুসংস্কারের মহীরূহ সমূলে উৎপাটন করা, রাষ্ট্রের কোনো একটি হাত, যেমন, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী বা চিকিৎসকের একার দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়। ফরমান জারি করে নয়, প্রকৃত শিক্ষাই পারে এই কুসংস্কারের চোরাবালি থেকে জাতিকে বের করে আনতে।
কিন্তু, আমরা, তথাকথিত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত, আধুনিক মানুষেরা, ''ওদের'' বলে যাদের আত্মঘাতী সংস্কারগুলোর কথা শুনে চোখ কপালে তুলি--- তারা ভুলে যাই, যে বিশ্বের দরবারে যখন এই দেশের indicators of life নিয়ে আলোচনা চলবে, তখন কিন্তু সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতার তথ্যমালার পাশাপাশি পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামের তথ্যও ব্যবহৃত হবে গড় পরিমাপ করার জন্য।
যত সহজে বিদ্যুৎ, রাস্তা, পরিশুদ্ধ পানীয় জল, ব্যাঙ্ক বা আন্তর্জাল পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া গেছে অজ গ্রামাঞ্চলের অন্দরে, প্রকৃত শিক্ষার আলো কি পৌঁছে দেওয়া গেছে তার কিছুটা হলেও?
অবশ্যই অনেক কাজ হয়েছে।
প্রত্যেক বাড়িতে শৌচাগার নির্মাণ, প্রতিটি শিশুর সম্পূর্ণ টিকাকরণ, প্রতিটি প্রসূতির প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব, প্রতিটি দম্পতিকে জন্মনিয়ন্ত্রণের সুফল বুঝিয়ে দেওয়া যাতে তারা তাদের সুবিধামাফিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে---- এগুলো করার জন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের, যারা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে আছি, তাদেরও হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
নয়ত, শুধু ডিজিট্যাল ইন্ডিয়ার স্লোগান তুলে আর নতুন নতুন উপগ্রহ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করলেই বিশ্ব মানচিত্রে প্রগতি এবং উন্নয়নের ধ্বজা ওড়ানো যাবে না।
সুতরাং, পথ এখনো অনেক বাকি!
0 comments: