0

প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য

Posted in


প্রাচীন কথা


পরাহত ভাগ্যনায়ক - তৃতীয় পর্ব
মিথিল ভট্টাচার্য


পরপর ছটি পুত্র সন্তান কংসের হাতে বধ হওয়ার পর, সপ্তম সন্তান দেবকীর গর্ভেই মারা যায়। এই একই সময় বসুদবের প্রথমা পত্নী রোহিনী গর্ভবতী হওয়ায় যাদব গোষ্ঠী তাদের চির বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে দিয়ে রটনার চেষ্টা করে যে রাজকুমারী দেবকীর সন্তানই, ঈশ্বরের আশীর্বাদে, দেবী রোহিনীর গর্ভে স্থান নিয়েছে। কিন্তু এই রটনা খণ্ডন করা কংসের মতো ধুরন্ধর রাজনীতিকের পক্ষে কঠিন ছিলনা। বসুদেবের যেকোনও সন্তান হোকনা কেন, যতক্ষণ না সে দেবকীর গর্ভজাত ততক্ষণ মথুরার সিংহাসনের উপর তার কোনও ন্যায্য অধিকার থাকতে পারে না। রোহিনীর পুত্র কোনও দিক থেকে তাঁর জন্য বিপদের কারণ নয়, তাই তাকে আক্রমণ করা তো দুরস্থান বরং ভগ্নীপতির প্রথমা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানকে তিনি সহাস্যেই আশীর্বাদ করেন। সামান্য ব্রাহ্মণরটনাকে প্রতিহত করতে বিশেষ কষ্টও তাঁকে করতে হয়নি।

এই প্রচেষ্টার ব্যর্থতার পর শুধু মাত্র একটি উপায়ই পড়ে থাকে যাদবদের কাছে। যেকোনও উপায়ে, অন্তত দেবকীর একজন গর্ভজাত পুত্রকে মথুরা থেকে সরিয়ে কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে গোপনে বড় করে তোলার। আশ্রয়ের কথা মাথায় আসলেই সর্বাগ্রে যে ব্যক্তির কথা তাদের মনে আসে তিনি হলেন বসুদেবের প্রিয় বন্ধু, গোকুলের ঘোষ সম্প্রদায়ের প্রবল পরাক্রান্ত নেতা, নন্দ। তাঁর কাছেই সসম্মানে রয়েছেন রোহিনী ও তাঁর সদ্যজাত পুত্র বলরাম। ভাগ্যক্রমে, এই সময় রাজকুমারী দেবকী ও নন্দপত্নী দেবী যশোদা একই সঙ্গে গর্ভবতী হন। এই অবস্থার সুযোগ নিয়েই যাদবপ্রধানরা অতি গোপনে নন্দ ও বসুদেবকে নিয়ে এক চরম দুঃসাহসিক পরিকল্পনার জন্ম দিলেন। যাদবকুলের স্বার্থে, মথুরার ভবিষ্যতের জন্য, নিজের সন্তানের বলি দিতে অবশেষে নিজেকে রাজি করালেন নন্দ।

দেবকীর সাত সাতটি সন্তানের বিনা বাধায় মৃত্যুর পর নিজের অজান্তেই বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে উঠেছিলেন কংস। তাঁর এই নিশ্চিন্ততার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই মথুরার কড়া পাহারাও খানিক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যাদবেরা পরিকল্পনা নিল সঠিক সময়ে যেন-তেন-প্রকারেণ দেবকীর গর্ভের এই অষ্টম সন্তানকে গোকুলে নন্দের গৃহে পাঠিয়ে দিয়ে, তার বদলে নন্দের ভাবী সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেওয়ার। মথুরার রাজবংশের অন্তত একজন উত্তরাধিকারী যেন জীবিত রয়ে যায় যে কংসের অধিকারকে প্রশ্ন করতে পারে। সেই কারণেই তাদের বলি দিতে হবে নন্দের ভবিষ্যত সন্তানকে, এক বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী নন্দ সময়মতো তাঁর আসন্নপ্রসবা স্ত্রীকে নিয়ে যমুনা নদীর ধারে এক নির্জন কুটিরে চলে যান। একমাত্র ধাত্রী যিনি উপস্থিত থাকেন তিনিও এই পরিকল্পনা সর্ম্পকে অবগত এক যাদব বংশীয়া রমণী। যশোদা যাতে প্রসবের পরেও জানতে না পারেন তাঁর কী সন্তান হয়েছে তার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করে যথেষ্ট মাত্রায় আফিমও সংগ্রহ করা হয়, প্রয়োজনে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য।

অবশেষে আসে সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন। কারাগারে দেবকী জন্ম দেন তাঁর অষ্টম সন্তানের। সেই সন্তান, যার নিরাপত্তার জন্য জন্মের বহু আগেই সচেষ্ট হয়েছিল একাধিক গোষ্ঠী, সেই সন্তান যে মথুরার গণ্ডী ছাড়িয়ে একদিন গোটা আর্যাবর্তকে নিয়ন্ত্রণ করবে, হয়ে উঠবে আর্যাবর্তের ভবিষ্যত ভাগ্যনায়ক। তার জন্মের দুই এক দিন পূর্বেই যশোদা এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। এই খবর গোপনে পৌঁছে গিয়েছিল মথুরার কারাগারে। দেবকীর অষ্টম পুত্রের জন্মের পরেই যাদবদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হলো। কিছু প্রহরী আগে থেকেই যাদবদের অর্থে বশীভূত হয়েছিল, আর বাকিদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল বসুদেবের বলরাম এবং রোহিনীকে দেখতে যাওয়াকে অনুমোদন করা কংসের নকল অনুমতিপত্র। দেবকীর অষ্টম পুত্রের জন্মের পরেই অতি সন্তর্পণে, বেতের ঝুড়িতে সদ্যজাত পুত্রকে লুকিয়ে নিয়ে, বসুদেব যাত্রা শুরু করলেন গোকুলের উদ্দেশ্যে। যাদবদের সহায়তায় যমুনা নদীর ধারে শেষনাগ জাতির আদিবাসীদের একজন একটি ছোট্ট নৌকা নিয়ে তাঁর অপেক্ষা করছিল। সেই নৌকায় তরঙ্গসঙ্কুলা যমুনা নদী পার হয়ে বসুদেব পৌঁছে ছিলেন নন্দের সেই কুটিরে। বসুদেবের হাত থেকে সদ্যজাত পুত্রকে অচেতন যশোদার কোলে দিয়ে, সদ্যজাত কন্যাকে শেষবারের মতো নিজের বুকে টেনে নিয়ে, ভেজা চোখে বসুদেবের হাতে সেই দিন তুলে দিয়েছিলেন নন্দ। প্রথম ও শেষ উপহারের মতো গোকুলের তাঁতশিল্পীদের নির্মিত দেবী দুর্গার নবরূপ অঙ্কিত একটি লাল কাপড়ে সযত্নে ঢেকে দিয়েছিলেন এই শিশুকে। দেবী দুর্গার রূপ নিয়ে ছিন্ন করুক সে কংসের ষড়যন্ত্রের জাল, রক্ষা করুক মথুরার শেষ উত্তরাধিকারীকে। একবার, শেষ বারের মতো, পুত্রকে নিজের আশিস দিয়ে নন্দের শিশু কন্যাকে বুকে আগলে, ছোট্ট নৌকাটি করে, গোপনে আবার মথুরার কারাগারে ফিরে আসেন বসুদেব। হতভাগিনী যশোদা জানতেও পারেননা তাঁর কন্যাকে কীভাবে তাঁর অজান্তে বলি দেওয়া হলো রাজনৈতিক ক্রীড়ার ক্রীড়নক বানিয়ে। 

কংসকে সঠিক সময়েই খবর দেওয়া হলো দেবকীর গর্ভের অষ্টম সন্তানের জন্মের। পুত্র নয়, এবার কন্যা হয়েছে দেবকীর। কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু পার্থক্য নেই কংসের কাছে। কন্যাও যদি হয় তবে সেই কন্যার ভবিষ্যৎ স্বামী এবং পুত্ররা কংসের সবথেকে বড় বিপদ হতে পারে। সেই সুদূর ভবিষ্যতের কথা যদি বাদ দেওয়াও হয়, তাহলেও এই কন্যার রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়ে বসুদেব নিজে সহজেই মথুরার সিংহাসন দাবি করতে পারেন। সুতরাং এই বিষবৃক্ষকে কোনওভাবেই বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না। তাই, কংসের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হলো সেই শিশুকে। কিন্তু এই শিশুই কংসের মনে সবথেকে বড় আতঙ্কের জন্ম দিয়ে গেল। নিজের মৃত্যু দিয়ে এই কুটিল রাজনীতিকের জীবনের শান্তি হরণ করে নিয়ে গেল সে। যে কাপড়ে ওই শিশু আবৃত ছিল সেই কাপড় কংসের মনে একটি অজানা আতঙ্কের জন্ম দিয়েছিল। যত বড় অত্যাচারীই হন না কেন, দেবী দুর্গার চিত্রাঙ্কিত ওই কাপড় তাঁর মতো নিষ্ঠুর ব্যক্তির মনেও জাগ্রত করেছিল এক অজানা ভয়। এর পরেই ক্রোধে, বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কোথা থেকে এলো এই কাপড় মথুরার কারাগারে? এই জাতীয় কাপড় বোনা তো গোকুলের তন্তবায়দের বৈশিষ্ট্য। দেবী দুর্গার নবরূপের চিত্র দিয়ে গড়া এই কাপড় গোকুলেই একমাত্র বানানো হয়। তবে? এর অর্থ কি? তার মানে কি এই সন্তান গোকুলের কোনও পরিবারের? তা যদি হয় তবে দেবকীর অষ্টম সন্তান কোথায় গেল? চরেদের মাধ্যমে অনুসন্ধানে প্রকৃত সত্য সামনে আসতে বেশি দেরী হলো না। যে কন্যাকে তিনি হত্যা করেছেন সে কন্যা গোকুলের ঘোষনেতা নন্দের কন্যা। তাঁর সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ, তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বেড়ে উঠছে গোকুলে; যাদবদের চক্রান্তে তাকে বিনাশ করার জন্য। কিন্তু, এবার তিনি নিরুপায়। যে কৌশলে তিনি এতদিন যাদবদের স্তব্ধ করে রেখেছিলেন, সেই একই কৌশলে তাঁর গতিও আজ রুদ্ধ। কোনও প্রমাণ নেই যে সেই সন্তান দেবকীর, আর তার উপর নন্দ কোনও দিক থেকে দুর্বল নন। সমস্ত ঘোষ সম্প্রদায় তাঁর অধীনে। এর উপর আছে যাদবদের সক্রিয় সহায়তা, প্রয়োজনে বসুদেবের জেষ্ঠা পৃথার পালকপিতা মহারাজা কুন্তীভোজও তাদের সহায়তা করতে প্রস্তুত। এই অবস্থায় গোকুল আক্রমণের অর্থ, যে সামরিক অভ্যুথানকে এত দিন তিনি অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে এসেছেন তাকেই নিজে থেকে বরণ করে নেওয়া; যাদবদের সুযোগ এনে দেওয়া তাঁর সঙ্গে সামরিক শক্তির দ্বন্দ্বে নামার। এই মুহূর্তে, ফাঁদে পড়া পশুর মতো তীব্র খেদোক্তি করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিলনা মথুরাধিপতির। তবে, এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে তিনিও শেখেননি। তাঁর শ্বশুর ও নিয়ন্ত্রক জরাসন্ধের পরামর্শে এবার তিনি আরম্ভ করলেন চোরাগোপ্তা আক্রমণ। যেখানে সামরিক শক্তির সরাসরি আক্রমণের পথ রুদ্ধ সেখানে কার্যসিদ্ধি করতে তিনি ব্যবহার শুরু করলেন গুপ্তঘাতকদের। 


(ক্রমশ)

0 comments: