প্রচ্ছদ নিবন্ধ - শিবাংশু দে
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
হোলি ও হরমোন:নিলাজ-রাঙা পাগল রঙে
শিবাংশু দে
ললিতলবঙ্গলতা পরিশীলন কোমলমলয় সমীরে।
মধুকরনিকর করম্বিতকোকিল কূজিতকুঞ্জকুটীরে ।।
বিহরতি হরিরিহ সরসবসন্তে।
নৃত্যতি যুবজনেন সমং সখি বিরহিজনস্য দুরন্তে ।।
(বসন্তরাগ যতিতালাভ্যাং গীয়তে) (গীতগোবিন্দমঃ জয়দেব)
জয়দেব গোস্বামী বলেছিলেন, শ্লোকটি গাইতে হবে রাগ বসন্ত, তাল যতি, যাকে সংক্ষেপে যৎও বলা হয়, সেই ভাবে। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, তরুণ বয়সে বনারসে বড়ি মোতিবাইয়ের কাছে শেখা তাঁর এই গান। এক হোলির পূর্বসন্ধ্যায়। সুরের এবং সংরচনার জাদু এমন, এই গানটি শ্রোতাকে, এমনকি গায়ককেও যেকোনও ঋতুতে বসন্তের কাছে নিয়ে যেতে পারে। বসন্ত মানেই তো হোলি। তিনি তো যৎ তালে গাইতেন না। প্রথম চরণদুটি মুক্তবিস্তারে আর তার পর রাধাকান্ত নন্দীর (আহা, রাধাকান্ত, দু'টি রোমাঞ্চকর হাত ও সিম্পলি ডুবিয়ে দেওয়া দশটি আঙুল ছিলো তাঁর) সঙ্গতে তিনতালে। হোলির উন্মাদনা কি তিনতাল ছাড়া ধরা যায়?
'বিহরতি হরিরিহ সরসবসন্তে।
নৃত্যতি যুবজনেন সমং সখি বিরহিজনস্য দুরন্তে।।'
ঢিমে থেকে লয় বাড়তে থাকে, রাধাকান্ত চলে যান তাঁর প্রবাদপ্রতিম উল্টো ঠেকায় আর রামকুমার নক্শা কাটতে থাকেন সুরে। চিলের ডানার মতো স্থির নৈঃশব্দ্যে বসন্ত নেমে আসে বুকের ভিতরে। চেতনার আধো আলোর ভুবনে ঝির ঝির স্পষ্ট হতে থাকে আবির গুঁড়োর শীৎকার।
'প্রদ্যোতস্য সুতা বসন্তসময়স্তংচেতি নাম্রা ধৃতি
কামঃ কামমুপৈত্বয়ং মম পুনর্মনৈ মহানুৎসবঃ।।'
(শ্রীহর্ষের রত্নাবলী নাটকে কামউৎসবে রাজার উক্তিঃ সপ্তম শতক)
'প্রদ্যোতের কন্যা (রতি দেবী), বসন্তসময় এবং তুমি বিদ্যমান। অতএব নাম দ্বারাই কাম পর্যাপ্ত সন্তোষ লাভ করুন। এই মহান উৎসবকে (বসন্তকালীন কামমহোৎসবকে) নিজস্ব উৎসব মনে করছি।'
জীমূতবাহন লিখেছিলেন দায়ভাগ গ্রন্থ দ্বাদশ শতকে। তা'তে রয়েছে হোলাক বা হোলক উৎসবের কথা। সারা উত্তর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেও এই উৎসবটির সম্যক প্রচলন ছিলো। সময়ের সঙ্গে এই পার্বণটির ক্রমবিবর্তন বেশ আকর্ষণীয় বিষয়। আদিযুগে এই উৎসবটি ছিলো কৃষিসমাজের পূজা অনুষ্ঠান। শস্যপূর্ণা বসুন্ধরার কামনায় নরবলি ও যৌনলীলাসম্পৃক্ত নৃত্যগীত উদযাপন ছিলো এর মুখ্য অঙ্গ। এই অনার্য ঐতিহ্যের সঙ্গে পরবর্তীকালের বৈদিক উপচার হোমযজ্ঞ মিলে যায়, নরবলির বদলে পশুবলি প্রচলিত হয়। সুশস্যকামনায় পূজা অর্চনার ক্ষেত্রে যেমন বলি ও যজ্ঞ গৃহীত হয়, একইভাবে হোলির শৃঙ্গাররসমুখর দিকটি কেন্দ্র করে বসন্ত, মদন ও কাম উৎসবের এবং রাধাকৃষ্ণের লীলাখেলার উৎপত্তি হলো। এর সঙ্গে কোনও এক মূর্খ রাজাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার জন-ইচ্ছাটিও প্রথা হিসেবে সামগ্রিকভাবে হোলি উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলো।
যেরকম নথিভুক্ত ইতিহাসে দেখা যায়, তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, অর্থাৎ গুপ্তযুগের প্রাথমিক সময়কাল থেকেই ষোড়শ শতক পর্যন্ত সম্পূর্ণ পুরাণযুগে বসন্ত বা মদন বা কামমহোৎসব নামে একটি উৎসব উত্তরভারতের সর্বত্র অতিসমারোহে পালিত হতো। এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায় তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বাৎসায়নের কামসূত্রে, সপ্তম শতকে শ্রীহর্ষের রত্নাবলীতে, অষ্টম শতকের মালতী-মাধব নাটকে, একাদশ শতকে অল-বিরুনির লেখায়, দ্বাদশ শতকে জীমূতবাহনের কালবিবেক গ্রন্থে এবং ষোড়শ শতকে রঘুনন্দনের বিবরণে। এই উৎসবে প্রচুর নৃত্যগীতবাদ্য, শৃঙ্গারসূচক সংলাপ ও যৌনতাব্যঞ্জক অঙ্গভঙ্গি মুখ্য স্থান নিয়ে থাকতো। পূজা অনুষ্ঠানের অভীষ্ট দেবতা ছিলেন মদন ও রতি দেবী এবং পুষ্পময় চৈত্রের অশোকবৃক্ষের ছায়ায় তার আয়োজন করা হতো। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীহর্ষের রত্নাবলী নাটকে মদন মহোৎসবে ভিজ্যুয়ালটি এইভাবের বর্ণনা করা হচ্ছে...
'অহো, পৌরগণের আহ্লাদ অত্যন্ত উৎকর্ষ প্রাপ্ত হইতেছে, যেহেতু দিবস প্রারম্ভতুল্যকারী কুম্কুমমচূর্ণবদ গৌর, বিক্ষিপ্ত পীত চূর্ণরাশি ও স্বর্ণালংকরণ দীপ্তি এবং কিণ্কিরাত পুষ্পশোভিত ভার অবনত পীত পরিচ্ছদশোভিত কৌশাম্বী নগর যেন স্বর্ণদ্রব মণ্ডিত লোকযুক্ত হইয়া শোভা পাইতেছে'।(অর্থ, পীত বস্ত্রশোভিত পুরবাসীরা পীতচূর্ণরাশি (আবির) প্রক্ষেপ করে অশোকবৃক্ষের ছায়ায় স্বর্ণমন্ডিত হয়ে কামউৎসব উদযাপন করছে।)
যেরকম অনুমান করা হয়, ষোড়শ শতকের পরবর্তীকালে চৈত্রীয় কামমহোৎসব, ফাল্গুনী দোলপূর্ণিমায় প্রচলিত হোলি উৎসবের সঙ্গে মিলে যায় এবং মদন উৎসব উদযাপনের দিন শেষ হয়ে যায়। আসলে মুসলিম রাজাদের আমলে হোলি উৎসব রাজ অনুগ্রহে প্রচুর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং মদন উৎসবকে গ্রাস করে নেয়। তবে এর ধর্মীয় দিকটি বেঁচে থাকে যখন একাদশ শতক নাগাদ রাধাকৃষ্ণের ঝুলন উৎসব এই চৈত্রীয় পার্বনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। অল-বিরুনির বিবরণ ছাড়াও গরুড় ও পদ্মপুরাণে এমত পড়া যায়। তারও পরবর্তীকালে এই অনুষ্ঠান চৈত্র পূর্ণিমা থেকে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় এগিয়ে আসে। এই উৎসবের প্রধান পালনীয় কৃত্য ছিলো ঝুলন আরোহী রাধা ও কৃষ্ণের প্রতি সখিসহচরীরা আবীর, কুমকুম ও পুষ্পবৃষ্টি করবে। বাংলায় এই জন্যই উৎসবটিকে 'দোলযাত্রা' বলা হয়, ঝুলনে দোলায়িত পুরুষ-প্রকৃতির যুগ্মসম্মিলনের দৈবী মাহাত্ম্য মুখর এর গরিমা। প্রাক বৈদিক আদিম কৃষিজীবী সমাজের ব্যাকানালিয়ার উদযাপন ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে হোলির বর্তমান রূপে বিবর্তিত হয়েছে। এখনও এই উৎসব মূলত 'শূদ্রে'র উৎসব। হোলিকাদহন বা বাংলায় যার নাম চাঁচর, তার আগুন অস্পৃশ্য শূদ্রদের থেকে গ্রহণ করার বিধি রয়েছে।
উত্তর ভারতে প্রচলিত হোলি উৎসবের যে সাধিত অমার্জিত উদযাপন রয়েছে, তার থেকে ঊনবিংশ শতকের বাবুকালচারভিত্তিক নাগরিক বাঙালির 'দোলযাত্রা'র চোরাস্রোত আর অবক্ষয়ের ডাইনামিক্সের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিলোনা। এই পর্যায় থেকে দোলউৎসব উদযাপনে ব্রাহ্ম রুচিবোধ ও য়ুরোপীয় সফিস্টিকেশন নিয়ে আসার কৃত্যটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেকালের বাঙালির থেকে একালের বাঙালির রুচি ও মননবোধে আরো অসংখ্য পরিমার্জন সাধনের পথে কবির এই প্রয়াসটিও অল্পবিস্তর সফল হয়েছিলো। মঙ্গলকাব্য থেকে নিধুবাবু, বাংলায় বসন্তঋতু ও উৎসব নিয়ে অনেক কিছুই লেখাটেখা হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে এসে সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতটি পাল্টে যায়। আমাদের সমৃদ্ধতম ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দি ও উর্দুর সাহিত্য ও মননসৃজনের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় থাকার সুবাদে বলতে পারি বসন্ত বা বর্ষা নিয়ে বাঙালির মননবিশ্বে যে গহন আততি রয়েছে, তার জুড়ি এই ভাষাগুলিতে দেখিনি। এর শ্রেয়ফল রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্য।
বাঙালির পক্ষে বসন্ত নিয়ে কোনও কথা বলতে গেলে বা বসন্তের হৃদমাঝারে যাত্রা করার কোনও ইচ্ছে থাকলে পাসপোর্ট নিতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। কারণ, কোত্থাও ছিলোনা, বসন্তের এমন একটা চিত্রচলন তাঁর ধারণা থেকে আমাদের মধ্যে এসেছে। এত প্রগাঢ় তার আবেষ্টন আর অন্তঃসলিল অভিঘাত, যে আমাদের চেতনায় বসন্ত শুধু একটা ঋতু হয়ে নেই, একটা অন্তর্জলী সমর্পণ হয়ে গেছে। শান্তিনিকেতনী দোলের পৌত্তলিকতার থেকে ভিন্ন, কালিদাসের কুমারসম্ভব থেকে পৃথক বা বিহার অওধের শারীরমাংসে তপ্ত রং বর্ষে জুনুন থেকে আলাদা এক নিগূঢ় রণিত সন্ধান।
--------------------
গাঙ্গেয় অববাহিকায় হোলি উদযাপন করার মূল অঙ্গ হচ্ছে 'ধমাল'।(এটার ইতিহাস অতি প্রাচীন।'ধমার' নামের যে সফিস্টিকেটেড সঙ্গীত শৈলী আছে তা বস্তুত হোলির 'ধমাল'এর সময় গাওয়া হতো এবং তার নাম থেকেও এটি প্রকাশ পায়)। এই ধমালের অবক্ষয়িত রূপসামন্ততান্ত্রিক গ্রামীণ পরিবেশে বহু সময়ই নিতান্ত রুচিহীন নোংরামি দিয়ে পালন করা হয়। যেহেতু হোলি বসন্ত উৎসব এবং এই উৎসবের সঙ্গে ফার্টিলিটি কাল্ট ও ব্যাকানালিয়ান মাত্রা ওতপ্রোত জড়িত, তাই বেশ প্রকট আদিরসাত্মক প্ররোচনা সবসময় দেখা যায়।কিছু রাজনীতিক, যেমন ধরা যাক, বিহারের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ, লাটসাহেবকে (পাটনায় রাজ্যপালকে তাই বলে)হোলির দিন আবির লাগাতে যাওয়ার সময় প্রায় নির্বস্ত্র ভাঙ্গমত্ত অবস্থায় গলায় একটি ঢোল ঝুলিয়ে, বিহারের মাপকাঠিতেও নিতান্ত অশালীনফাগুয়া বা চইতা গাইতে গাইতে, বিবিসির নিউজটিমকে ডেকে ছবি তোলাতেন। তাঁর মতে হয়তোএই কাজটি তাঁর 'গরীব কা মসীহা' ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বলতরকরে। কারণ এদেশে হোলি হাজার বছরেরও অধিক কাল ধরে এভাবেই উদযাপিত হয়।কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্রতমমানুষদের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়াএত অসম্ভ্রমের সঙ্গে হোলি পালন করতে দেখা যায়না। অথচ বিহারের ছোটোবড়ো শহরাঞ্চলে এই সব রাজনীতিকদের অনুকরণে জনতাকে ধমাল করতে দেখা যাবে। সব থেকে মৃদু উদাহরণ, পচা গোবরের চৌবাচ্চায় মানুষকে ফেলে দিয়ে ডোবানোর চেষ্টা। অন্য ক্রিয়া কলাপগুলি না হয় নাই বললাম। এটা হয়তো একটা আরোপিত উদ্যম। সম্পন্ন, ক্ষমতাশালী মানুষদের (ভদ্রলোক?) সম্ভ্রমবোধের অভাব প্রকাশ করছে ঐতিহ্যের নামে। এর সম্পূর্ণ বিপরীতে নীতীশ কুমারের মতো আদ্যন্ত গ্রামীণ, রুচিশীল, 'ভদ্রলোকের' হোলি উদযাপনও দেখা যাবে। তিনিও রাজনীতিক এবং দীর্ঘকাল ধরে নানারকম মন্ত্রিত্ব সামলাচ্ছেন। তিনিও ভাঙ্গ সেবন করেন, আবির লাগান এবং 'হোলি' উদযাপনের কোনও অঙ্গকেই অবহেলা করেননা। অথচ সম্ভ্রমবোধের সহজ লক্ষণরেখাটি অতিক্রম করেন না কখনও। মনে রাখতে হবে, বিহারের হোলি সেন্টিমেন্ট কখনও শান্তিনিকেতনী ধরনে 'খোল দ্বার খোল' বা মাথায় পলাশের মালা পরে পেলব নৃত্যে প্রকাশ করা যায়না। শান্তিনিকেতনী দোলযাত্রা আর বিহারী কি উত্তরদেশীয় হোলি হয়তো বহিরঙ্গে পৃথক, কিন্তু যাঁদের 'সম্ভ্রমবোধ' আছে তাঁরা সেটা কদাপি বিসর্জন দেননা। সহজ উদাহরণ,বেশ কিছুদিন ধরে খোদ শান্তিনিকেতনেও বসন্ত-উৎসবও বহিরাগত এক শ্রেণীর অতিথিদের অত্যাচারে প্রায় পুলিস হেফাজতে পালন করা হয়।
মল্লিকা চোপরা দীর্ঘদিন মার্কিন প্রবাসী। তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন ঐ দেশে তাঁরা যতটা নিষ্ঠার সঙ্গে দিওয়ালি পালন করেন, সেভাবে হোলি উদযাপন করতে পারেন না। কারণটা সিম্পল। এদেশে যে আবেগ বা উদ্যম নিয়ে হোলি পালন করা হয়, সে আবহ বা উৎসাহ বিদেশে সৃষ্টি করা যায়না। তিনি তাঁর সন্তানদের নিয়ে হোলির সময় এদেশে আসেন। যদি তারা সেন্টিমেন্টটি কিছুটা ধরতে পারে। বস্তুত সাহেবরা এই উৎসবটির অন্তর্লীন সেন্টিমেন্টটি কখনই ধরতে পারেননি। যদিও রোমান লুপারক্যালিয়া, ব্যাকান্যালিয়া বা স্যাটারন্যালিয়ার সঙ্গে হোলির সাদৃশ্য তাঁরা সতত খুঁজে পেতে চান। অথবা লাতিন বিশ্বের প্রাক-লেন্ট মত্ততা ও ইংলিশ মে-ডে'র গ্রামীণ উদযাপনও বাদ যায়না। কিন্তু এদেশে হোলির দিন সকালে দল-মত-শ্রেণী নির্বিশেষে যাবতীয় সামাজিক স্তর বিভেদকে অস্বীকার করে পরস্পরকে রাঙিয়ে দেওয়ার প্রথাটির শিকড়টি ঠিক খুঁজে পাননা। সাহেবরা প্রথম যখন এদেশে আসেন তখন এ দেশীয়দের হোলি উৎসবটি নিয়ে বিশেষভাবে বিরক্ত থাকতেন।জনৈক পাদ্রি ফাদার ওয়েন্ডেল এই উৎসবটিকে Crudest foolishness বলেছিলেন। তৎকালীন বাদশা মুহম্মদ শাহ রঙ্গিলে যেভাবে জাঁকজমকের সঙ্গে হোলি খেলতেন, তা তাঁর চোখে 'হিন্দু'দের থেকেও অধিক মূর্খতা মনে হয়েছিলো। উইলিয়ম ক্রুক লিখেছেন "Among the Ramoshis of (Balaghat district in Central provinces) on the day after (Holi) pyre is lighted, they throw filth at each other, pour mud out of a pot on any respectable man they chance to meet, and challenge him to a wrestling match; the next day cowdung isflung on all well dressed people." ক্যাপ্টেন ব্রাউটনও সমানভাবে বিতৃষ্ণ। তিনি লেখেন ''In Central India, the Mahrattas cast the ashes of Holi pyre upon one another, and throw them in air, repeating their favourite extemporary stanzas, full of grossest indecency, in which they freely introduce the names of their superiors, coupled with most abominable allusions." ক্রুক সাহেব আরো লিখেছিলেন, "The rites are purely animistic; at any rate, they have no connection with orthodox Hinduism. The otiose legends which profess the rites are figments of a later age invented to bring it in line with Brahminism." তাঁর সহকারী, রামগরিব চৌবে, একজন শিক্ষিত ব্রাহ্মণ,ক্রুকসাহেবকে জানিয়েছিলেন হোলির সময় বর্ণব্যবস্থার অচলায়তনকে আক্রমণ করা আমাদের ওর্যাল ট্র্যাডিশনের অংশ। হোলির সময় তিনি একটি গান শুনেছিলেন যেখানে একজন দুসাধ জাতির ব্যক্তি(অতি নিম্নবর্ণ) একজন ব্রাহ্মণকে কুস্তিতে পরাজিত করে তার ভগ্নীকে বিবাহ করেছিলো। অন্য বিপদও ছিলো সেসময়। প্রায় আজকের মতন। বিখ্যাত স্লীম্যানসাহেব (ঠগী দমনকারী) হোলির দিন তটস্থ থাকতেন কোনও মুসলিম প্রতীক বা ব্যক্তির প্রতি যেন আবির ছোঁড়া না হয়। সেক্ষেত্রে হাঙ্গামা থামানো পুলিসের পক্ষে বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতো। মনে হয় সে ট্র্যাডিশন আজও চলেছে।
ঐতিহাসিক লিভি জানিয়েছেন, ১৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সেনেটররা ব্যাকাসদেবতার অনুগামীদের ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া প্রভাব রোধ করতে আইনি ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশেষ সফল হওয়া যায়নি। সিজার অগস্টাস এই প্রথাগুলিকে 'বহিরাগত', 'অবাঞ্ছিত' ইত্যাদি ফতোয়া দিলেও ব্যাকান্যালিয়ার নেশা দূর করতে পারেননি। আমাদের দেশেও সেই সময় থেকেই হোলিকে কেন্দ্র করে সাময়িকভাবে মানুষের নৈতিক বাঁধাবাঁধির লক্ষণরেখাকে প্রত্যাখ্যান করার ঐতিহ্য বেড়ে উঠতে থাকে। মনস্তত্ত্ববিদরা বিষয়টি নিয়ে নানাকথা বললেও সর্বজনসম্মত ব্যাখ্যা বা চূড়ান্ত অবস্থান নিয়ে সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া যায়নি। বঙ্গসংস্কৃতির স্বভাবজ মৃদুতর মাত্রায় উৎসবটি কখনও দোলযাত্রা, কখনও বসন্ত উৎসব। ব্যক্তি আমার অবচেতনার মানচিত্রে উত্তরভারতের হোলি তার মহিমা নিয়ে নিঃসন্দেহে সতত জেগে থাকে। কিন্তু আমার কবি যেভাবে তার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে দিয়েছেন, মাশাল্লাহ! রক্তে আমার তাহার পায়ের রঙ লেগেছে। সেই রং, কবীর যাকে বলেছেন, অ্যায়সে রঙ্গা দেঁ, কি রঙ্গ নাহি ছুটে....
"..... সেইখানে মোর পরানখানিযখন পারি বহে আনি,
নিলাজ-রাঙা পাগল রঙে রঙিয়ে নিতে থরে থরে ॥
বাহির হলেম ব্যাকুল হাওয়ার উতল পথের চিহ্ন ধরে—
ওগো তুমি রঙের পাগল, ধরব তোমায় কেমন করে ।
কোন্ আড়ালে লুকিয়ে রবে,তোমায় যদি না পাই তবে
রক্তে আমার তোমার পায়ের রঙ লেগেছে কিসের তরে ॥"
0 comments: