প্রবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
পদ্য গদ্য মদ্য
দীপারুণ ভট্টাচার্য
বোতল পুরাণ রচেন যিনি, তিনি নাকি দা-ঠাকুর,
ঠাকুর দাদা এরস পেলে উঁচু গ্রামে চড়ান সুর।
মাতাল পেঁচো এই রসেতে ডুব দিয়ে রয় রাত্রিদিন,
প্রানের মতো বন্ধু পেলে গল্প জমে অন্তহীন।
মদ্য ও তার পান সম্পর্কে কোন প্রগাঢ় জ্ঞান আছে বলেই লিখছি, এমন ভাবলে ভুল হবে। আমি আবগারি দপ্তরের কর্মী নই যে অমূল্য সুরা পেতে পারি বিনামূল্যে অথবা আমি নেশামুক্তি অভিযানের আহ্বায়কও নই। তাই আপনি পছন্দ করলে যেমন আমি ঠেকাবো না,অপছন্দ করলে উৎসাহও দেবো না। আমি শুধু কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করতে চাই। কথায় বলে ভাগ করলে আনন্দ বাড়ে। রসিক বন্ধুদের কাছে একথার ব্যাখা নিষ্প্রয়োজন।
কলেজে পড়ার সময় এক রসিক বন্ধু এ বিষয়ে কটা লাইন লিখেছিলো। আসরে টেবিল চাপড়ে সুরটা অবশ্য আমিই করেছিলাম। তারপর থেকে প্রায় প্রতি আসরেই উল্লাস পর্ব শুরুর আগে এই গানটি গাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এখানে শুধু গানের কথাই রইলো। আশা করি রসিক বন্ধুরা নিজ সুরে আসর মাতাবেন। ছাত্রজীবনের এ লেখার সাহিত্যগুণ বিচার কিন্তু অনর্থক।
হুইস্কিতে আছে শশুর, শাশুড়ী রামের-মতি
বৌ আমার লজ্জাবতি, ওয়াইনে কি বা ক্ষতি!
বন্ধুরা বাংলা মালে, সাজিয়েছে বাসি ছোলা,
বান্ধবী জিনের ভিতর, দুয়েক ফোঁটা কোকাকোলা।
মদ্যপানের ইতিহাস কিন্তু নতুন নয়। বেদ যে পানীয়ের সন্ধান দিয়েছে তা হলো সোমরস। বস্তুটি ঠিক কি ছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে। ইন্দ্রের প্রিয় এই পানীয় নাকি ছিলো সুস্বাদু। কেউ বলেন সোম লতা থেকে তৈরি হয় তাই সোম রস। সোম লতাকে অনেকে আখ মনে করেন। কেউবা বলেন সোমরস তৈরি হতো এফেড্রা (ephedra) জাতীয় গাছের রস থেকে।
যাই হোক বস্তুটি যে শক্তি ও মাদকতা দিতো সে বিষয়ে সবাই একমত। হয়তো সে জন্য সোমরসকে আধুনিক কালের ওয়াইন-এর সাথেও তুলনা করা যায়। দ্রাক্ষারস শব্দটিও আমরা শুনেছি। ওয়াইন আসলে তাই। আঙ্গুর কে ফার্মেন্টেশন করে এই পানীয় তৈরি হয়। সাধারণত এতে চিনি, জল বা অন্য কোন বস্তুকে বাইরে থেকে মেশানো হয়না। তবে কিছু কিছু ওয়াইনে চিনি মিশিয়ে Sweet Wine বানানো হয়। ওয়াইন মূলত দুই প্রকার, সাদা ও লাল। লাল রঙ হয় আঙ্গুরের খোসাfermented হয়ে। তাই খোসা সহ fermentation করলে ওয়াইন লাল হয় আর খোসা ছাড়া করলে হয় সাদা।
এই পানীয়তে অ্যালকোহলের পরিমান ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়, এবং তা আঙ্গুরের উৎস ও তৈরির পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। একটা ধারণা আছে, ওয়াইন পুরোন হলে মূল্যবান হয়। এখনও পর্যন্ত জর্জিয়াতে পাওয়া গেছে সবচেয়ে পুরোনো ওয়াইন। যা প্রায় আট হাজার বছর আগেকার বলে অনুমান। তেমনই ইরাকে পাওয়া গেছে সাত হাজার ও আমেরিকাতে ছয় হাজার বছর আগেকার ওয়াইন।
শেরী (Sherry), এই পানীয়ের নাম আমি প্রথম শুনি 'ওগো বধূ সুন্দরী' ছবির একটি গানে। এটিও কিন্তু এক প্রকারের ওয়াইন। স্পেনের এই বিশেষ ওয়াইন তৈরির সময় আঙ্গুরের সাথে কিছুটা জলপাই ও মেশানো হয়। এতে অ্যালকোহলের পরিমান হয় ১৫.৫ শতাংশের থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে। ইতিহাস ১১০০ বি.সি.তে এই পানীয়ের উল্লেখ করে। মনে হয় তখনই এই পানীয়ের সৃষ্টি হয়েছিল।
শ্যাম্পেনের নাম শোনেননি এমন সুরা-রসিকের সংখ্যা নিতান্তই কম। যে ওয়াইনকে পানের চেয়ে ধবল ফেনিল অবস্থায় উড়িয়ে দেওয়ার প্রতি মানুষের বেশি আগ্রহ, সেটাই শ্যাম্পেন। ফরাসী এই পানীয়কে তাই sparkling wine বলা হয়। ফ্রান্সের এক বিশেষ অঞ্চলের আঙ্গুর দিয়েই শুধুমাত্র এই পানীয় তৈরি করা সম্ভব। কাঁচামালের মতোই এই পানীয়ের বোতল, ছিপি এবং তৈরির পদ্ধতি, সব কিছুই বিশেষ ভাবে নিয়ন্ত্রিত। তাই কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া কেউ এই পানীয় তৈরির সুযোগ পায়না।
আমাদের এক সহকর্মী প্রায়ই অফিস ছুটির সময় বলতেন, তাড়া আছে; আজ আবার বিহার ঘুরে বাড়ি ফিরবো। অফিসের সবাই জানতেন তার বিয়ার (Beer) তৃষ্ণার কথা। তৃষ্ণাই বটে। শুনলে অবাক হতে হয়, জল ও চায়ের পরেই, বিয়ার পৃথিবীর তৃতীয় পছন্দের পানীয়। বার্লি, গম, ভুট্টা ও চাল থেকে তৈরি এই পানীয়তে সাধারণত ৪%-৬% অ্যালকোহল থাকে। তবে সেটা ১৪% পর্যন্তও যেতে পারে। বহু পুরনো এই পানীয়ের ইতিহাস। প্রায় ৯৫০০ বি.সি.তে এই পানীয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পাঁচ হাজার বছর আগেও বিয়ার পাওয়া যেতো ইরাক ও ইজিপ্ট অঞ্চলে। যে সব শ্রমিকরা সে যুগে পিরামিড তৈরির কাজ করতো, তাদের প্রতিদিন ৪-৫ লিটার বিয়ার দেওয়া হতো। পানীয়টি তাদের পুষ্টি ও মনোরঞ্জনের প্রয়োজন মেটাতো। এবাদে চীন দেশে প্রায় সাত হাজার বছর আগে, বর্তমান সিরিয়াতে চার হাজার এবং ইউরোপে প্রায় ৩০০০ বি.সি.তে বিয়ার এর অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়।
মদ্যপানের ব্যাপারে ছুঁৎমার্গ কিন্তু বিলক্ষণ বজায় আছে কিছু মানুষের মধ্যে। দিল্লীতে থাকার সুবাদে দেখেছি উত্তর ভারতে এই বিষয়ে নাক উঁচু ভাব কম। কিন্তু বাংলায় এখনও কিছু মধ্যবিত্ত পরিবার মদের নাম শুনলেই রে রে করে তেড়ে আসে। এসব আলোচনায় এক প্রবীণ মানুষ একবার বলেছিলেন, 'যাদের কালচার মানে এগ্রিকালচার (হরিয়ানা ও উল্টোপ্রদেশ প্রসঙ্গ) ; আমাদের কি তাদের থেকে শিখতে হবে, কাকে কোন চোখে দেখবো!' কথাটা হয়তো ঠিক। তবে বাংলায়, যাঁদের আমরা সংস্কৃতির মাথা মনে করি, তারা কিন্তু প্রায় সকলেই এই রসের রসিক।স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এ বিষয়ে উদার মনোভাবাপন্ন ছিলেন বলে কয়েকটি লেখায় উল্লেখ আছে।
তবে রসাস্বাদন সীমা ছাড়ালে তা বিরক্তির কারন হয়। যেমন, আমার বর্তমান অফিসের ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে এক বিরাট বিক্রয়কেন্দ্র। কাছেই মারুতির গাড়ি কারখানা। কাজেই অনেক শ্রমিকেরা বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বোতলটি সংগ্রহ করে আসপাশের সিগারেটের গুমটির পাশে দাঁড়িয়েই তৃষ্ণা মেটান। একদিন সকাল আটটাতে সিগারেট কিনতে গিয়ে আমার এক সহকর্মীর রোষানলে পড়লো এক তৃষ্ণার্ত শ্রমিক। বেশ বিরক্ত হয়েই সে বলল, 'সকাল সকাল কি করছো ভাই! এসব তো সন্ধ্যেবেলা ভালোলাগে।' খানিকটা জড়ানো গলায় যুবকটি বললো, 'সন্ধ্যে? আমিতো নাইট ডিউটি করে ফিরছি দাদা!' বাক্ যুদ্ধে পরাজিত আমার সহকর্মী সেদিন, রাম রাম বলে পালিয়েছিল।
এবার আসি রামের কথায়। প্রাচীন ভারত ও চীনে, চিনির সিরা বা আখের রস থেকে যে রঙ্গীন পানীয়টি বহুবছর আগে তৈরি হয়েছিল, কেন জানিনা তার নাম দেওয়া হয় রাম (RUM)। তবে আধুনিক রামের উৎপত্তি স্থল দক্ষিণ আমেরিকা। ওক কাঠের পিপেতে রেখে পুরনো করা হয় এই লাল বা বাদামি রঙের পানীয়। প্রায় ৪০% অ্যালকোহল যুক্ত এই পানীয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের লোকেদের কাছে একটা সংস্কারের মতো। যেকোনো শুভ অনুষ্ঠানে সেখানে রাম ব্যাবহার বাধ্যতামূলক।
চিরকুমার সভায় রবিঠাকুর লিখেছেন, 'অভয় দাও তো বলি আমার wish কী....../ একটি ছটাক সোডার জলে পাকি তিন পোয়া হুইস্কি।'
ভুট্টা, যব, বার্লি ও গম থেকে প্রথমে ফার্মেন্টেশন ও পরে পাতন পদ্ধতিতে তৈরি এই পানীয়র নাম কেন হুইস্কি হয়েছে বলা মুশকিল তবে পরিচিত এক রসিক এর নাম দিয়েছেন ইচ্ছের চাবি (উইশ কি)। ইতিহাস বলে মেসোপটেমিয়ার সময়, ব্যাবিলনের লোকেরা প্রথম এই পানীয় তৈরি করেছিলেন। তারা পাতন পদ্ধতি জানতেন। পানীয়টিকে ওক কাঠের পিপেতে রেখে পুরোন করার পদ্ধতিটি অবশ্য তত পুরনো নয়। প্রথমে এই পানীয় তৈরি হয় ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। মনে হয় পরে এর গুণমুগ্ধরা একে শুধু মাত্র ওষুধে সীমাবদ্ধ থাকতে দেননি। পৃথিবীতে সব চেয়ে বেশি ব্র্যান্ড আছে শুধু মাত্র এই পানীয়ের। গ্রীক মহাবীর আলেকজান্ডার এই পানীয় খুব পছন্দ করতেন। তাই তিনি মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রসার করেছিলেন। স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে হুইস্কির সর্বাধিক প্রচার ও প্রসারের উল্লেখযোগ্য কারন পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলের মানুষ আধুনিক পাতন পদ্ধতি জানতেন। স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে প্রস্তুত হুইস্কিকে আমরা মূলত স্কচ নামে চিনি। এডওয়ার্ড ডায়ার (Edward Dyer) ১৮২০ সালে ভারতের সোলান জেলার কাসাওলিতে প্রথম হুইস্কি তৈরির কারখানা খোলেন।
কলেজ জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের কলেজের লেডিস হোস্টেলের উল্টোদিকে একটা খুপচিতে দুষ্টু ছেলেদের দুষ্টু পানের আস্তানা ছিলো। এতে রথ দেখা ও কলা বেচা দুইই হতো। বলা বাহুল্য, সেখানে আমাদের দামাল সহপাঠীদের সংখ্যাই ছিলো সর্বাধিক। দুষ্টু দমনে হোস্টেল সুপার এক নেতার সাহায্য নেন। এলাকায় পোস্ট হয় দুজন পার্টি পুলিশ। তারা পান করতে দেখলেই পিটিয়ে জান বার করে দিতো। কিন্তু নেশা বড় দায়। একদিন তথাগত নামক ছেলেটি তথাগত ভঙ্গীতে পান করতে গিয়ে ধরা পড়ে। নিজেকে বাঁচতে সে বলে, আমি হোস্টেলের ছেলে নই, আমি ক্যান্টিনে কাজ করি। এই মিথ্যার পুরস্কার স্বরূপ তাকে পাশের হোটেলে সারাদিন বাসন মাজতে হয়েছিলো।
এর থেকেও আশ্চর্য ঘটনা একবার ওভারল্যান্ড কাগজে (এখন আর এ কাগজ নেই) পড়েছিলাম। তখন সোভিয়েত রাশিয়া সবে ভেঙেছে। টাকার অভাবে এক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের মাইনের বদলে দিচ্ছিলেন সপ্তাহে ১৪ বোতল ভদকা (Vodka)। হ্যাঁ ভদকা নামক পানীয়টি রাশিয়ার দেশীয় বলেই পরিচিত। পাতন পদ্ধতিতে ইথানল থেকে তৈরি হয় এই পানীয়। মূল উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয় আলু ও অন্য খাদ্যশষ্যকে। প্রায় ৪০% অ্যালকোহল যুক্ত এই পানীয় অত্যন্ত ঠাণ্ডা অবস্থায় জল ও বরফ ছাড়া নীট খাওয়ার নিয়ম রাশিয়াতে। ইতিহাস মতে ১৪০৫ সালের পর থেকে বস্তুটি কারণ হিসেবে ব্যবহার হলেও আগে এটি ছিলো ওষুধ।
একই রকম স্বচ্ছ আরও একটি পানীয় হল্যান্ড-এ প্রথম জুনিপার বেরি (juniper berry) থেকে তৈরি করা হয়েছিল ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। পরে অবশ্য সেটিও পরিণত হয়েছে কারণে। পানীয়ের নাম জিন (Gin)। ১৬৮৯ সালে হল্যান্ডের রাজা উইলিয়ামব্রিটেনের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন থেকে এই পানীয়টি লন্ডনে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সুগন্ধের জিন বাজারে পাওয়া যায়, যেমন পাতি লেবু, কমলা লেবুর সুগন্ধ ইত্যাদি।
দুই বা তার বেশি পানীয় মিশিয়ে যখন একটি পানীয় তৈরি হয়, যার মধ্যে অন্তত একটি পানীয় অ্যালকোহল যুক্ত তখন তাকে ককটেল বলে। ককটেল (Cocktail) তৈরির কাজে অবশ্য ভদকা ও জিনের জুড়ি মেলা ভার। তবে মদ বস্তুটিকে শুধুমাত্র সোডা বা ফলের রস মিশিয়ে পান করার একটা চল আছে। ১৮৯০ সালে এমন অ্যালকোহল পানীয়ের নাম দেওয়া হয় High Ball. কেউ কেউ অবশ্য Cocktail কে ও High Ball বলে থাকেন। তবে Cocktail এর ইতিহাস খুব বেশি পুরাতন নয়। প্রফেসর জেরি টমাস, ১৮৬২ সালে লেখেন Cocktail recipes, How to Mix Drinks। আর ১৯১৭ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম ককটেল পার্টির উল্লেখ পাওয়া যায়।
একটা পুরোনো কথা মনে পড়ছে। তখন স্কুল পড়ি। এক মুদিদোকান থেকে দুটো সোডার বোতল কিনে বেরোচ্ছি, আমরা দুই বন্ধু। উদেশ্য বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ লাইম সোডা খাবো। ঘটনাচক্রে মুদিদোকানের পাশেই ছিলো মদের দোকান। সোডার বোতল হাতে দুই নাবালকের দিকে সেদিন এক জ্যাঠামশাই টাইপ বৃদ্ধ এমন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন যেন, সর্বস্ব রসাতলে গেছে। সেদিন না জানলেও আজ জানি, জল, সোডা, লেবুর রস বা অন্য অ্যালকোহল হীন পানীয়ের মিশ্রণকে মকটেল বলে। তবে যেমন তেমন ভাবে পানীয় মিশিয়ে কিন্তু ককটেল বা মকটেল তৈরি করা যায় না। তার জন্য রয়েছে নিদৃষ্ট উপাদান, পরিমাপ ও পদ্ধতি। সাথে রয়েছে তার আকর্ষণী নামও। এখানে কয়েকটি পরিচিত ককটেলের নাম উল্ল্যেখ করছি, Vodka martini, Cosmopolitan, Vodka Tonic, Screwdriver, Greyhound, Moscow Mule, Bloody Mary ইত্যাদি।
ট্যাকিলা (Tequila) মদ্য জগতে একটি পরিচিত নাম। নামটির উদ্ভব মেক্সিকোর ট্যাকিলা শহরের নাম থেকে। এই মদ্যটি তার সেবন পদ্ধতির জন্য বিখ্যাত হয়েছে। পানীয়টি নীট অবস্থায় পানের পর নুন ও লেবু চেটে নিজেকে পরবর্তী পান বা শট এর জন্য প্রস্তুত করাটাই দস্তুর। এই পানীয়টি তৈরি হয় নীল আগেভি (Blue Agave) গাছের রস থেকে। গাছটিকে অনেকটা অ্যালোভেরা গাছের মত দেখতে।
মদ জগতের আরও দু-একটি কথা এখানে বলা জরুরি। যেহেতু প্রায় সব রকম মদের উৎপত্তি কোনও না কোনও কার্বোহাইড্রেট থেকে, তাই চিনি মদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মদের থেকে চিনি বার করাকে বলে Dry করা। মদ যত dry হবে তত দাম বাড়বে। কোনও কোনও রসিক জনকে নেশা বাড়াতে সেবনের পর মিষ্টি খেতে দেখেছি। মিষ্টি নেশার উৎকর্ষ বাড়ায় কিনা জানিনা, তবে মনে হয় মিষ্টি প্রেমী বাঙালিকে এক তূরীয় তৃপ্তি দেয়।
ব্লেন্ডেড মদ জগতে খুব পরিচিত শব্দ। ব্লেন্ডিং শব্দের অর্থ এক কথায় বোঝানো কঠিন। যেমন কঠিন বছরের পর বছর ধরে একই মদের একই স্বাদ ও গন্ধ ধরে রাখা। আসলে কাঁচামাল ও জলবায়ুর পরিবর্তন এ কাজের মূল চ্যালেঞ্জ। উৎপাদকেরা বিভিন্ন বছরের মদ খানিকটা খানিকটা করে মিশিয়ে ধরে রাখেন তাদের স্বাদের পরম্পরা। অনেক সময় এই মিশ্রণকে বেশ কয়েক বছর ধরে পুরনো করে তবে বাজারে ছাড়া হয়। বোতলের উপর লেখা থাকে সেটি কত বছরের পুরনো। এই সম্পূর্ণ পদ্ধতিটির নাম ব্লেন্ডিং।
যে সব মদ্য এতক্ষণের আলোচনাতে উঠে এসেছে সেগুলো সবই বিদেশী। এই বিদেশী মদের মধ্যে যে গুলো ভারতে তৈরি হয় তাদের বলে India made foreign liquor বা IMFL. বিদেশী মদ্যপানের বিভিন্ন পদ্ধতি বা প্রত্যেকটি মদের জন্য ব্যবহৃত আলাদা ধরনের স্ফটিক পাত্র পানের উৎসাহ বাড়িয়ে তোলে। মদ্যপানের ক্ষেত্রে 'পেগ' শব্দটি অতি পরিচিত। শব্দটি সম্পূর্ণ ভারতীয়। মূলত ভারতে ও নেপালে এর ব্যাবহার বেশি। 'পেগ' মদের পরিমাপক। ছোটো পেগ মানে ৩০ মিলি লিটার আর বড় পেগ মানে ৬০ মিলি লিটার। কেউ কেউ বলেন পাতিয়ালা পেগ। এটা পাঞ্জাব উদ্ভূত ১২০ মিলি লিটারের বিশাল এক পেগ।
বিদেশী মদ বা ভারতে তৈরি বিদেশী মদ ছাড়াও ভারতে তৈরি দেশী মদ বা India made country liquor (IMCL) অর্থাৎ দেশী দারুর বাজার কিন্তু বিরাট। ভারতে বিক্রি হওয়া সমগ্র মদের প্রায় ৩০% ই এই দেশী দারু। বছরে এর পরিমাণ প্রায় ২৫ কোটি লিটার (২০১৫ এর পরিসংখ্যান)। ভারতের দেশী দারুর বাজার বৃদ্ধির পরিমান প্রায় ৭%, যা আমাদের জিডিপি বৃদ্ধির প্রায় সমতুল্য। তবে এই দেশী দারুর হিসাবের মধ্যে কিন্তু আদৌ ধরা নেই মহুয়া, তাড়ি বা চুল্লুর মতো মদ গুলি। এই ক্রমবর্ধমান মদ বিক্রিতে পশ্চিমবঙ্গও পিছিয়ে নেই। বর্তমানে লাইসেন্স-রাজ নরম হয়েছে। On Shop লাগোয়া Off Shop খোলা বাধ্যতামূলক হয়েছে। গুটিকতক জাতীয় ছুটির দিন বাদ দিলে প্রায় সারা বছরই দোকান খোলা থাকে। তবু কোন এক অজানা কারনে বাঙালিরা প্রকাশ্যে মদ্যপানকে এখনও ঘৃণা করেন। এ যেন অনেকটা খরগোসের শুধু মুখটুকু লুকিয়ে রাখার মতো।
একটা পরিচিত গল্প দিয়ে লেখা শেষ করবো। এক মদ্যপ ছেলে রোজ গভীর রাতে বাড়ি ফিরে দরজা খোলার জন্য, বাবাকে 'জামাইবাবু' বলে ডাকতো। একদিন বিরক্ত হয়ে বাবা কারণ জানতে চাইলে ছেলে বলে, 'জামাইবাবু ডাক শুনে পাড়ার লোকেরা ভাববে তোমার শালা মাতাল। বাবা বলে ডাকলে, তুমিতো পাড়ায় মুখ দেখাতে পারবে না।'
আমার বিশ্বাস, এই সব ঘটনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সেই মহান প্রবাদ, 'জাতে মাতাল, তালে ঠিক'।
This comment has been removed by the author.
ReplyDelete