0

ছোটগল্প - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in

ছোটগল্প


ছুটির নিমন্ত্রণে 
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস 



১. 

বাসটা বড়ো রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বিশাল ব্যানারে বুবলুদার কোচিং সেন্টারের নাম লেখা- ‘সাফল্য’। মোহনা দ্রুত পায়ে বাসটার দিকে এগিয়ে যায়। হালকা হালকা কুয়াশা আছে। শিরশিরে বাতাস। দশ-বারোজনের জটলা বাসটার চারপাশে। বুবলুদা তদারকি করছে রান্নার বাসন-কোসন বাসে তোলার, “এই পঞ্চা, কড়াইটা সাবধানে নে। হেব্বি ভারী কিন্তু। পঞ্চা মাথা চুলকোয়, “তোমার দু'চারটে ছাত্তর দ্যাও না…একা একা হয় নাকি এসব!” গুলতানিরত ছাত্রগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে বুবলুদা নিজেই সাহায্য করতে এগিয়ে যায়, “বুঝলি পঞ্চা, আজকে আর ছেলেমেয়েগুলোকে খাটাবো না। সারা সপ্তাহটা তো পড়ার চাপে থাকেই। আজ একটু আনন্দ করুক। পিকনিক বলে কথা!” পঞ্চা “হুঃ” বলে চুপ করে যায়। মোহনা এগিয়ে গেল, “দাদা, আমি সাহায্য করবো?” বুবলুদা হাসে, “ না। তুই যা। তোর বন্ধুগোষ্ঠী বাসে সীট রেখে দিয়েছে দ্যাখ গে যা!” মোহনা হাসতে হাসতে বাসের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। জানলা দিয়ে মাধুকরী মুখ বাড়িয়েছে, “অ্যাই মোহনা, এত দেরী করলি! উঠে আয়, উঠে আয়। “পেছন থেকে হইহই করে ওঠে সুগত-মৌলি-অগস্ত্যরা। দরজার হাতল ধরে উঠতে গিয়েই থমকে যায় মোহনা। কৃশানু!! কালো জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকাতে ঢোকাতে কৃশানু মনখোলা হাসি দেয়, “কি রে দেরী করলি যে!” মোহনা কি বলবে ভেবে পায় না। তার পেটের মধ্যে কোটি কোটি প্রজাপতি ওড়ে…সাদা, হলুদ, কালো… 

সুচরিতা জানলার ধারে বসেছে। ওর নাকি বাসে বমি করার প্রবণতা আছে। মোহনা ওর পাশে বসেছে। কিছুক্ষণ পরপরই খোঁজ নিচ্ছে, “ঠিক আছিস তো?” একই সাথে একই প্রশ্ন নিজেকেও করছে। বাসের গলিতে উদ্দাম হুল্লোড় করছে তার সহপাঠীরা। তাদের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে চোখ চলে যাচ্ছে কৃশানুর সিটের দিকে। কেন যে এরকম হয়! এতদিন একসাথে পড়ছে, তবু কিসের এত মুগ্ধতা তার কৃশানুর প্রতি!! যখনই দেখা হয় কৃশানুর সাথে, হয় সে কথা বলতেই ভুলে যায় কিংবা বেশী বকবক করে! শতভিষা কলকল করে ওঠে, ‘‘অ্যাই মোহনা, উঠে আয় না! নাচবি না?” মোহনা কোনওরকমে নিরস্ত করে জানলার দিকে ফেরে। আজ রোববার। রাস্তাভরা পিকনিক পার্টি। খোলা ম্যাটাডোরে বীভৎস আওয়াজে মাইক বাজছে। লোকজনের কি উদ্দাম নৃত্য! বড়ো চটের ব্যাগ থেকে ব্রেকফাস্টের প্যাকেটগুলো বের করছে বুবলুদা। অনেকেই সাহায্য করছে। মোহনার প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলো কৃশানু, ‘‘নে।’’ মোহনার ভীষণ ইচ্ছা করছে প্যাকেটটা সরিয়ে দিয়ে ঐ লম্বা লম্বা আঙুলগুলো ছুঁতে…। 



২. 

এই বাগানবাড়িটা বুবলুদার বন্ধু মানস ভৌমিকের। পনেরো ষোলো বিঘা জমি। একতলা ছড়ানো বাড়ি, পুকুর ঘেরা তাল-সুপুরী-নারকেল গাছের সারি, খেলার মাঠ, দুই খানা আমবাগান, কলাবাগান, সর্ষে ক্ষেত নিয়ে একেবারে এলাহি কাণ্ড। রান্না চেপে গেছে। সাদা ভাত, সবজি দিয়ে মুগের ডাল, কাতলার কালিয়া, মুরগীর মাংস আর চাটনী---এই হলো পিকনিকের মেনু। মাছে নুন হলুদ মাখানো শুরু হয়েছে। পঞ্চা গিয়েছে রাঁধুনীকে সাহায্য করতে। বিক্রম আর অজিত বসেছে মটরশুঁটি ছাড়াতে। যত না ছাড়াচ্ছে, তার চেয়ে মুখেই চালান করছে বেশী! দল বেঁধে ঘুরতে বেরিয়েছে কয়েকজন। সুচরিতার বমিভাব কেটেছে। সে জলখাবারের প্যাকেটটা খুলে প্যাটিসে কামড় বসায়। মোহনা ওর পাশে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে। 

‘‘জায়গাটা কি সুন্দর, না রে সুচি?” 

‘‘হুম। খুব ভালো।’’ 

‘‘কত জায়গা!এদের গরমকালে বোধহয় কষ্ট হয় না। কি সুন্দর ছায়া ছায়া...’’ 

‘‘ওসব ছায় টায়া বাদ দে। কত বড়লোক বলতো এরা!” 

মোহনা চুপ করে যায়। সুচরিতার এই এক দোষ। সবসময় টাকাপয়সা-লাভলোকসান নিয়ে হিসেব কষে। সুচরিতা বলতে থাকে, ‘‘এরকম টাকাপয়সাওয়ালা একটা ছেলেকে পটাতে পারলেই আমি খুশী। সারা জীবন তুলোয় মুড়ে রাখবে।’’ মোহনা উঠে দাঁড়ায়, ‘‘আমি একটু হেঁটে আসি। মৌলিরা সব ঐ দিকে গেল। তুই যাবি?” আঙুল চাটতে চাটতে সুচরিতা জবাব দেয়, ‘‘নাহ্। তুই যা।’’ মোহনা এগিয়ে যায়। ইঁটবিছানো পথ ধরে পুকুরের ঘাটে এসে দাঁড়ায়। টলটলে জল। শানবাঁধানো ঘাট। মাছ ঠোকরাচ্ছে রোদেলা জল। সজনে গাছের ডালে মাছরাঙা পাখি। উত্তুরে হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে পাতাদের। কৃশানু কখন ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, কে জানে! 

“কি করছিস একা একা দাঁড়িয়ে?” কৃশানুর গলা হঠাৎ শুনে মোহনা চমকে ওঠে। কৃশানু হেসে ফেলে, ‘‘তুই আমায় দেখে এত চমকাস কেন রে?” মোহনা নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলে, ‘‘তুই অকুস্থলে পাকুদাদু হয়ে আসিস কেন সবসময়!? হঠাৎ করে এসে চমকে দিস! উফ্, কি ভয়ই না পেয়েছি।” 

‘‘কি ভাবলি? ব্রহ্মদত্যি?” 

‘‘না, মামদো ভূত।’’ 

হো হো করে হেসে ওঠে কৃশানু। 

‘‘চল্, হাঁটি।’’ 

মোহনা মনে মনে বলে, ‘‘সারা জীবন।’’ সে মাথা নীচু করে কৃশানুর পাশে পাশে হাঁটে। কৃশানু জিগ্যেস করে, ‘‘সর্ষে ক্ষেতের দিকে যাবি?” মোহনা ঘাড় হেলায়। 

‘‘সুচরিতার বমি পাওয়া কমেছে?” 

‘‘হুঁ।’’ 

‘‘তুই কি চমকে দিলাম বলে রাগ করলি আমার উপর?” 

মোহনা মাথা তোলে। নরম চোখে তাকিয়ে আছে কৃশানু। থুতনিতে একটা তিল। হালকা গোঁফের তলায় কৌতুকের আভাস। তিরতির করে কাঁপছে কন্ঠিটা। 

‘‘নাহ্।’’অন্যদিকে তাকায় মোহনা। পাশাপাশি হাঁটে দু'জনে…নিঃশব্দে। মোহনার কথা বলতে ভয় করে…যেন কথা বললেই এই মুহূর্তটা মিথ্যে হয়ে যাবে…। 



৩. 

পিকনিক স্পট দেখে সবাই ফিরে এসেছে। ঝিনচ্যাক আওয়াজে দালের মেহেন্দির গান বাজছে। মাধুকরী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো সুগতর গায়ে। মৌলী বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। উদ্দাম নাচছে দশ-বারোজন। রান্না শেষের পথে। বিক্রম কোত্থেকে খেজুর রসের ভাঁড় এনেছে। একদল ছেলেমেয়ের ভিড় তাকে ঘিরে। বুবলুদা সিগারেট টানছে এক কোণে। মোহনা অনেকক্ষণ ধরেই চোখ পেতে খুঁজছে কৃশানুকে…পাচ্ছে না। সর্ষেক্ষেত দেখে অনেক আগে ফিরে এসেছে সবাই মিলে। তারপর গেল কোথায় কৃশানু? মোহনা সতরঞ্চি ছেড়ে উঠে পড়লো। 

‘‘কোথায় যাচ্ছিস?” 

‘‘কোত্থাও না…” 

পায়ে পায়ে হাঁটছে একা একা। আমবাগানের পথ ধরে। গাছগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোতে থাকে। মাঝদুপুরের রোদ ঝিলমিলে নকশা এঁকেছে এবড়ো খেবড়ো জমিতে। পিকনিক পার্টির গান ক্রমশ ফিকে এই পথে। কি একটা পাখি একা একা ডেকে চলেছে। এটাকেই কি কুবো পাখি বলে? বিশাল আমবাগানের মাঝে একা একা দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ সেই ডাক শোনে মোহনা। বহুদিন আগের এক দুপুরবেলার কথা মনে পড়ে যায় তার। সেদিনও এমন শিরশিরে রোদ ছিল…অন্য পাড়ার মণ্ডপ থেকে গান ভেসে আসছিল...“অ্যায় কাশ কে হাম হোশ মে অব আনে না পায়ে” …তেইশ নম্বর উপপাদ্য প্র্যাকটিস করছিল সে…কেন কিভাবে তা মনে নেই…শুধু মনে আছে, সেই দুপুরেই সে আবিষ্কার করে কৃশানুর প্রতি তার অসম্ভব দুর্বলতার কথা…। মোহনা চোখ বোজে…তিরতির করে কাঁপা একটা কন্ঠি দুই পাতা জুড়ে…। নাহ্, নিজেকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। মোহনা এগিয়ে যায় বনপথে। 

খস্ খস্ খস্ খস্…। দাঁড়িয়ে পড়ে সে। কিসের শব্দ? শেয়াল-টেয়াল আছে নাকি?ভয় দানা বাঁধে মোহনার বুকে। বিশাল বিশাল আমগাছ তার চারপাশে। তাদের পিকনিকের জায়গা ছেড়ে সে এতটা ভেতরে চলে এসেছে, বুঝতে পারেনি এতক্ষণ। খস্ খস্…ডানদিক থেকে আসছে শব্দটা। মোহনা এক পা দুই পা এগিয়ে যায় সেই দিকে। ডাইনের আমগাছটার ওপাশে ভয়ে ভয়ে উঁকি দেয় নিজেকে আড়াল করে…। কিছুটা দূরে ওরা হেঁটে যাচ্ছে…হাতে হাত…আলো-ছায়া মাখছে হাতদুটো…দাঁড়ালো…রহস্যময় হাসি ওদের ঠোঁটে…কাছে টানলো একে অপরকে…এতটা কাছে কেউ কারো কাছে আসতে পারে? মোহনা চোখ বুজে ফেললো। বাঁ চোখ দিয়ে কেন কে জানে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার গালে। ঠিক তখনই সে শুনলো কৃশানু সুচরিতাকে বলছে, ‘‘তোকে ভীষণ ভালবাসি…।’’ সুচরিতা কি বললো শুনতে পেল না মোহনা… 



৪. 

জিনিসপত্র বাসে তোলা হচ্ছে। পঞ্চা গজগজ করছে, ‘‘একটু হাতও তো লাগাতে পারো কেউ!” মোহনা এগিয়ে গেল, ‘‘পঞ্চাদা, আমায় কিছু দাও। আমি ধরছি।’’ পঞ্চা বিরক্ত গলায় বললো, ‘‘তুমি যাও তো মোহনাদিদি, আমি পারবো। এতগুলো ছেলের কেউ হাত লাগালো না…আর তোমাকে দিয়ে আমি কাজ করাবো! না, যাও।’’ মোহনা কিছু না বলেই বাসে উঠলো। সবচেয়ে শেষের সারির একটা জানলা সে বেছেছে। কেউ এখনও বাসে ওঠেনি। এদিক সেদিক আড্ডা হচ্ছে। দিনশেষের ছায়া বাসের ওপাশে…ঘর ফিরতি পাখিদের কিচিরমিচির…ফেলানো ছড়ানো এঁটোকাঁটা খাচ্ছে নেড়ির দল…পুকুরের জলটা লালচে…আকাশটাও…। মোহনাকে কিছুই স্পর্শ করছে না…কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে তার অনুভূতিগুলো। সে চোখ বুজে এক মনে প্রার্থনা করে, ‘‘হে ঈশ্বর, আমায় আগের মতো করে দাও…আমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।’’ 

‘‘ঘুমোচ্ছিস নাকি?” কৃশানুর কন্ঠস্বরে চোখ মেলে সে। এত বড়ো ফাঁকা বাসে কি তার পাশটুকু ছাড়া জায়গা নেই বসার? 

‘‘না।’’ বাইরে চোখ ফেরায় মোহনা। বুবলুদা চেঁচাচ্ছে, ‘‘উঠে আয় সব…শিগগিরি...।’’ বাসে হলদে আলো জ্বলে উঠেছে। হইচই হচ্ছে এন্তার। 

‘‘মোহনা…” উফ্, কেন যে ছেলেটা কথা বলছে তার সঙ্গে! চোখ জ্বালা করে মোহনার। কেঁপে যায় তার স্বর, ‘‘হুঁ…?” 

‘‘তোর কি শরীর খারাপ?” মোহনা চোখে চোখ রাখে কৃশানুর। এত নরম চোখে কি ও সুচরিতার দিকেও তাকায়? কৃশানুর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে সুচরিতাকে খোঁজে সে, ‘‘নাহ্, আমি ঠিক আছি।’’ বাস ছেড়ে দেয় সশব্দে। সবাই চেঁচিয়ে ওঠে একটা সুন্দর দিন কাটানোর আনন্দে, ‘‘হিপ হিপ হুররে…।’’ শুধু মোহনা জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে…আর কৃশানু মোহনার দিকে। একটা দুটো আলোর ফুটকি জ্বলে উঠছে দূরে। মোহনা ভুলে যেতে চায় পাশে বসা কৃশানুর অস্তিত্বকে…ভুলে যেতে চায় আজকের দুপুরটা…। সে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে, “ছায়া ঘনাইছে বনে বনে…’’ 

‘‘কিছু বললি?” 

চোখ খোলে মোহনা। জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে তাকায় কৃশানুর দিকে, ‘‘এরকমভাবে পাশাপাশি আমরা কতদিন বসবো?” 

কৃশানু অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মোহনার দিকে। তারপর স্পষ্টস্বরে উত্তর দেয়, ‘‘যতদিন আমরা বন্ধু হয়ে থাকবো…।’’ বাসের হর্ণে ঢাকা পড়ে যায় সান্ধ্য-শাঁখের আওয়াজ। শুধু একটা কুবোপাখি একা একা ডেকে যায় মোহনার অস্তিত্ব জুড়ে…।

0 comments: