ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
॥৯॥
বিবর্ণ বাদামি তামাকের ছেঁড়া পাতার ভিতর দিয়ে পূর্ণিমার আলো স্নিগ্ধ মদির
গোরাচাঁদ
বিভ্রান্ত। হতবাক গোরাচাঁদ। ভেবেছিলেন খনিজ নিষ্কাষণের ব্যাপারে সরকারি অনুমতিতে রাশিয়ান কম্পানীর দল ও তার রক্ষকেরা ভারতীয় সুরক্ষা বাহিনীর সাথে এখানে তাঁবু গেড়েছে। হয়তো তাই জনজাতির কাছে নিজেদের উদার ও বন্ধু মনোভাব ব্যক্ত করার জন্য ওরা জেরকার সেবা শুশ্রষার কাজে তড়িঘড়ি হাত লাগিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ান রক্ষাবাহিনীর এই মানুষটি যে সামরিক বাহিনীর একটি উচ্চপদস্থ কমাণ্ডিং অফিসার এবং ভারতের রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে ভারতীয় বাহিনীর সাথে যৌথ অভ্যাস মহড়ার নামে এন্টিটেররিস্ট অপারেশন ও ড্রিল চালানো হবে সে কথা কোনও ভণিতা না করে সোজাসুজি বলে দিলেন গোরাচাঁদকে। যেহেতু গোরাচাঁদ রাশিয়ান ভাষা বোঝেন ও বলতে পারেন তাই কথাবার্তা শুধু দুজনের মধ্যেই। তাও আবার ক্লোজড ডোর। এতে গোরাচাঁদের বিভ্রান্তি বাড়লো বই কম হলো না। ওঁর নাম সারগেই ইভানোভিচ এবং ইন্ডিয়ান পার্ট থেকে মেজর জেনারেল তাঁরই সুপুত্র সৌমজিত দাস উগ্রবাদী দমনে এই যুগ্ম অভিযানে হত্যা করার খোলা অনুমতি পেয়েছেন সে কথাও তিনি বলে দিলেন। রাত পার হয়ে তরতর করে সূর্য প্রায় মাথার ওপরে। তাঁবুর তৈরি অফিসঘরে গোরাচাঁদ ও সারগেই। ঘরটিতে একটি পুরু পারদর্শী প্লাস্টিকের জানালা। সেখান থেকে দূরে খুব ছোট ছোট অনেকগুলি সামরিক তাঁবুর জটলা। একদুটোর উপর ভারতের পতাকা দেখে গোরাচাঁদের শরীর হিম হয়ে গেল। গোরাচাঁদ যে সৌমজিতের বাবা সেকথা তো অফিসার বলেই দিল। তাই হয়তো প্রাণে না মেরে বসিয়ে রেখেছে। জেরকার বিষয়ে তবে এরা নিশ্চয় জানেনা। জানলে ওরা ওকে প্রাণে বাঁচাতো না। ওখানেই খতম করে দিত। মনে হয় আর একটু পরে সমুর হাতে আমাদের তিনজনকে তুলে দেবে। তাহলে এরা দেরি করছে কেন?এইকথা ভাবতে ভাবতে গোরাচাঁদ দেখলেন সারগেই তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এমন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যে গোরাচাঁদ শিউরে উঠলেন। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এমন এক্স রে নজর কখনও দেখেননি তিনি। ভীষণ অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। ওই অবস্থাতেই শুনলেন সারগেই বলছে জেরকার ব্যাপারে সে সমস্ত তথ্য জোগাড় করেছে। শুধু জেরকা কেন, গোরাচাঁদ, পেরো এবং অন্য সব এক্টিভিস্টদের ব্যাপারে যতটা ও জানে ঠিক ততটা মেজর জেনারেল সৌমজিতও জানেনা। এমনকি এই প্রান্তরের ভৌগলিক খনিজ বনজ সবকিছুই তার জানা হয়ে গেছে।
গোরাচাঁদের বিস্ময়ের আর সীমা রইলনা। একি! এই লোকটা কি থট রিডিংও জানে নাকি? ও যেন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে গোরাচাঁদের মনের কথা পড়ে নিয়েছে! কিকরে সম্ভব? উনি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন সারগেই মিটিমিটি হাসছে। গোরাচাঁদ এবার সরাসরি চোখে চোখ রাখলেন। দেখলেন ওর দৃষ্টি তিক্ষ্ণ আর সম্মোহক। ব্যাপারটা বুঝে গিয়ে হেসে ফেললেন তিনি। ওর ভাষাতেই বললেন, এসব কথা আমাকে বলে কি লাভ? যেমন করার আছে করুন। আমরা তো সমর্পিত। সারগেই তেমনি ভাবেই তাকিয়ে থেকে বেল বাজাল। একজন সশস্ত্র রক্ষী ভেতরে আসতেই চোখ একটুও না সরিয়ে বলল, কফি। গোরাচাঁদও ওর চোখ থেকে দৃষ্টি সরালেন না। রক্ষী চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পর আবার এসে যখন দুকাপ কফি রেখে গেল, সারগেই গোরাচাঁদের উপর থেকে এবার দৃষ্টি সরিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে উঠল, ভেরি টাফ এন্ড ইন্টেলিজেণ্ট। ইংরেজি ভাষাতেই তড়বড় করে ওঁর মানসিক শক্তির অনেক প্রশংসা করতে লাগলো সারগেই। গোরাচাঁদ সহজ হয়ে গেলেন। কফি তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন। লোকটার গেসচার পজেটিভ। বললেন,-আপনার ইংরেজিতে ফ্লুয়েন্সি সত্যিই প্রশংসনীয়।
সারগেই আবার বলে উঠল ইংরেজি ভাষাতেই, -শ্যাল আই কনটিনিউ ইন ইংলিশ, মিঃ দাস? গোরাচাঁদ রাশিয়ান ভাষাতেই উত্তর দিলেন, না না আমি আপনার ভাষাতেই খুব সহজ বোধ করব, মিঃ সারগেই। আপনি আপনার ভাষাতে কথা বলতে পারেন। সারগেই উত্তর দিল, -আমার মাতৃভাষা যদিও চেক কিন্তু আপনাকে ধন্যবাদ যে রাশিয়ান ভাষা আপনার ভালো লাগে।
-ধন্যবাদ। আমি চেক রিপাবলিক ভাষাও একটু একটু বুঝতে পারি। এটি রাশিয়ান পোলিশ আর ক্রোয়েশিয়ানদের সাথে মিল আছে। আমাদের ফ্রাঞ্চ কাফকার ভাষা তো চেক ছিল।
কাফকার নাম করতে সারগেই গদগদ হয়ে উঠল। চেয়ার থেকে উঠে এসে গোরাচাঁদের হাত দুহাতে ধরে বলল,-আপনি মহান, মিঃ দাস। কাফকাকে আপনি 'আমাদের' বললেন! আপনি আর আপনার ছেলে সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি ইংরেজি ভাষা সহজ ভাবে বলতে পারি। তা সত্ত্বেও আপনার ছেলের সাথে দোভাষী নিয়ে গেছি। কেবলমাত্র পাওয়ার ক্ল্যাশ। আপনার মতন বিপ্লবী মানুষ থাকতেও আপনাদের দেশে যে কেন সাম্যবাদ বলিষ্ঠ নয়। শোষণ আর শোষিত সমাজ এখানে সর্বত্র।
গোরাচাঁদের মনে হলো এবারে আসল কথাটা জানা যেতে পারে। বললেন,-ধন্যবাদ মিঃ সারগেই। আমি সব বুঝতে পেরেছি আমাদের ব্যপারে আপনি সব কিছুই জানেন। এবার আপনি দয়া করে যদি বলেন আমাদের নিয়ে আপনি কী করবেন? অবশ্য যদি আপনার অফিসিয়ালি বলতে বাধা না থাকে।
সারগেই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল,-মিঃ দাস, আপনাদের এখানে রাশিয়া ও ইন্ডিয়ার যে যুগ্ম অভ্যাসের মেনু ঠিক করা হয়েছে সেটা এখানে না হয়ে কাশ্মীর কিংবা দেশের অন্য কোনও বর্ডারে হতে পারত। যেখানে উগ্রবাদীর আসল মানে আমরা সবাই জানি, দেশদ্রোহিতা। এই মহড়ার নাম রাখা হয়েছে অসুর নিধন। কথা হচ্ছে অসুর এখানে কে? আপনার ছেলে এবং অন্য কোনও সুবিধাবাদী মাইন্সওনার, পোচার, টিম্বার মার্চেন্ট কিংবা ফার্মাসিউটিক্যাল্স রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এই ব্যবস্থা করেছে। এ সব দেশেই হয়। কিন্তু আপনাদের দেশে একটু বেশিই টুইস্টিং। আপনার ছেলে নিজে ইনিসিয়েটিভ নিয়ে এখানে উগ্রবাদী মারার চিরুনি তল্লাশির ব্যবস্থা করেছেন। এখানের উগ্রবাদী মানে আমি যতটা জানি, কিছু ভীতু আদিম মানুষ। যারা নানারকম রোগ অভাব দারিদ্রতা ও অপুষ্টিজনিত কষ্টে জর্জরিত। তারা এমনিই মরে আছে। তাদের মারার ব্যবস্থা? হ্যাঁ, একান্তই ব্যক্তিগত আক্রোশ আপনার ছেলের থাকতে পারে কয়েকজনের বিরুদ্ধে। সেটা আপনিই ভাল জানেন। সেটা বলবেন কি?
গোরাচাঁদ তার উত্তর দিলেন না। বললেন,-আমি জানিনা আপনি ব্যক্তিগতভাবে এর কারণ জানতে চাইছেন, না অফিসিয়াল? এখানে আসার আপনাদের দেশের কি স্বার্থ?
সারগেই সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল,- না না এই জানতে চাওয়াটা একান্তই ব্যক্তিগত। তবে শুনুন এই এলাকায় চিরুনি তল্লাশিতে সম্মত হওয়ার পিছনে আমার দেশের কি স্বার্থ। আমাদের প্রতিবেশী মঙ্গোলিয়ার বর্ডারের কাছাকাছি এলাকায় আর সাইবেরিয়াতে প্রচুর লেপ্রসি। প্রতিবছর আমাদের দেশে নিয়ম করে লেপ্রসির সংখ্যা গণনা করা হয়। এখন যদিওবা সংখ্যায় কম কিন্তু ওদের মধ্যে প্রচুর ড্রাগ রেজিস্টাণ্ট। কোনও ওষুধই কাজ করছেনা। তাছাড়া ইউক্রেন, কাজাখস্থান, তুর্কি, -এইসব প্রতিবেশী দেশগুলির সীমান্তের কাছে এতবেশি ক্যানাবিস, মারিজুয়ানা, হাসিস, এইসবের উপজ প্রচুর হয়যে তার ফলে এখন রাশিয়াতে আড়াই মিলিয়নের বেশি ড্রাগ এডিক্টেড। হেরোইন নেশায় সারা পৃথিবীতে প্রথম স্থান। এই অবস্থায় রাশিয়া এই দুই রোগ থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে গেছে।
-এতে আমাদের দেশ কি করতে পারে?
-আমাদের কাছে যখন ইন্ডিয়ার টপ সিক্রেট দফ্তর থেকে আমন্ত্রণ এলো, বিশেষ করে আপনাদের এই এলাকায় জয়েন্ট মিলিটারি এক্সারসাইজ হবে, তখন আমরা এখানটা স্যাটেলাইট ছবিতে খুব ক্লোজ ওয়াচ করেছি। এখানের মাটি, জল, মেডিসিন্যাল প্ল্যাণ্ট - সবকিছু স্টাডি করেছি। এমনকি এখানের জিওগ্রাফিক্যাল ও পলিটিক্যাল অবস্থা সবকিছুই জেনে নিয়েছি। বহু আগে আপনাদের দেশে ইংরেজদের আমলের একজন ইংরেজ পর্যটক এই জায়গাতে এমন একধরনের প্ল্যাণ্ট আবিষ্কার করেছিলেন যেটা বিড়ি, হেরোইন, গাঁজা, চরসের নেশা ছাড়ানোতে অব্যর্থ ভেষজ। খুব কম সময়ের মধ্যে। আবার সেটা লেপ্রসি সারিয়ে তো দেয়ই, এমনকি ক্ষয়ে যাওয়া অঙ্গের নাকি রিজেনারেশন হয়ে যায়। এই আশ্চর্য ভেষজটির প্রমাণ ইন্ডিয়ার ভূতত্ত্ববিদেরাই দিয়েছেন।
সারগেই একনাগাড়ে এত কথা বলে থামল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,-দেখুন, মিঃ দাস। হিপনোটিজমে আমার স্পেশ্যাল ট্রেনিং নেওয়া আছে। আমি মানুষের চরিত্র ভালই বুঝি। আপনি যে উদার প্রকৃতির মানুষ আমি বুঝেছি বলেই এত গোপনীয় কথা বললাম। আজ সকালে আমাদের ডাক্তার বলেছে জেরকা ম্যাডামের বেশ কয়েকটা স্ট্যাব করা গভীর ক্ষত দুদিনের পুরোনো। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে তাজা। তাই অপারেশন করা ও স্টিচ করা সম্ভব হয়েছে। মেডিক্যাল সায়েন্স এটা বিশ্বাস করবে না। এত পুরোনো ঘা পচতে বাধ্য। সেলাই সম্ভব নয়। কিন্তু এটা ঘটনা। যেভাবে নোংরা নালায় পড়েছিল এখন তো সেপ্টিক হয়ে পচে যাওয়ার কথা। কিন্তু নিশ্চয় কোনও হার্বাল ট্রিটমেন্ট করেছেন আপনারা। আপনাদের উপরে আমার কোনও আক্রোশ নেই বরং আপনাদের রক্ষা করার ভার আমাদের বাহিনীর। কিন্তু গোপনে। আইনত নয়। বিনিময়ে ওইসব ভেষজ আমাদের চাই। এবং তারপর পেটেণ্টের ব্যবস্থা আমাদের সরকার করবে।
0 comments: