ধারাবাহিক - রাজর্ষি পি দাস
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
ফেরা - ৯
রাজর্ষি পি দাস
দশমী
১০।১০। ২০১৯
পাড়ায় এখন বিসর্জনে গান্ধির ঢাকের ক্যাসেট বাজানো হয়। গান্ধির ছেলে পাঠিয়েছে। গান্ধী বেঁচে থাকলেও কানে শোনে না! সে আজকাল নগাঁওতে ছেলের এগরোলের দোকানে বসে। নন্তু ফোনে বল্ল!
প্রতিদিন একজন মানুষকে খেয়ে ফেলছি আমি। খাওয়ার আগে হত্যা করেছি, না জ্যান্ত চিবিয়ে খাচ্ছি, জানি না। আমার স্মৃতি থেকে ডেইলি একজন ক'রে হাফিশ করে দিচ্ছি। গত সাতদিনে আমি সাতজনকে খেয়ে বসে পুরো ঘেঁটে গেছি। আমার বিস্মৃতির অকস্মাৎ ওবেসিটিতে আমি ভারি বা ভরাক্রান্ত নই, উপরন্তু এতটাই হালকা লাগছে যে মনে হচ্ছে যে কোনও মুহূর্তে উড়ে যেতে পারি। আমার ভীষণ ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করছে।
ডাক্তার বলছে- সাবধান, it is a symptom of virtual cannibalism, a new trend in human brain by default । আমার মনে পড়ল ট্রেনিং সেন্টার প্যারেডের সা-------ব-----ধান! আশ্চর্য! ‘symptom of virtual cannibalism’ শব্দগুচ্ছ আমাকে বিচলিত করল না কেন? -by the way, what is virtual cannibalism? আমি প্রায় অনেকটা ঘাড় লম্বা করে ডাক্তারের ডান গালের উপর প্রায়! ডাক্তারনি গাল সরিয়ে মিষ্টি হেসে- just a minute! উনি হঠাৎ নিজের ল্যাপটপে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ।
সাতদিনের মাথায়, হ্যাঁ সাতদিনই হবে, সকাল সকাল এক সুন্দরী – মোটা – লম্বা – চওড়া মহিলা এসে বললেন – অনেক হয়েছে, চল আমার সাথে। আমি চিনতে পারলাম না, কিন্তু ঐ ‘চল আমার সাথে’ বলার ভঙ্গি দেখে ও শুনে যে কেউ বলে দেবে এই উক্তির পিছনে একটা প্রবল অতীত আছে। ও ভীষণ কনফিডেন্টলি আমার এলোমেলো জামাকাপড় আর ছড়ানো ছিটানো বইগুলোকে প্রথম গোছানো শুরু করল।
-তোমার তো আবার বই না হলে চলবে না। বইকে বউ বানিয়ে অনেক হলো –আপাতত যা পরে আছো চল, পরে সাবিত্রি পৌঁছে দেবে। জাঙ্গিয়া পরছ কি আজকাল? তোমার কবিতার বইগুলো কোথায়--?
এ কী, এ তো অনেকটাই জানে! কিন্তু উনি কে?
নাম বললেন – সোনা।
সোনা! আমার মাথা ঘুরে গেল। সব অন্ধকার। ধপ!
যখন জ্ঞান ফিরল, আমি আমার কাজের মহিলাকে চিনতে পারছি না, আমার ফ্রীজ চিনতে পারছি না, টিভিটা কার? আমার ডাক্তার, লোকে বলে পাগলের ডাক্তার, মহিলা, শ্যামলা সরস্বতীর মতো দেখতে, বিখ্যাত সাইক্রিয়াক্টিস্ট, অর্পিতা গাঙ্গুলি একটা যোগসূত্র আবিস্কার করছেন। আমার ফ্রিজ, টিভি, কাজের মহিলা সাবিত্রি, কিছু পুরোন জামাকাপড় চিনতে পারছি না, কারণ সোনা! বস্তুগুলো সোনার কিনে দেওয়া আর কাজের মহিলাকেও সোনা নিয়োগ করেছিল। পাঁচবছর আগে।
অর্পিতা আমার কেস স্টাডি থেকে মাথা তুলে – সোনা কে?
আমি নির্বিকার। সোনা মানে, মানে, সোনা মানে গয়নাগাটি-ম্যাকেনারস গোল্ড, ন্যাশনাল ট্রেজার... কিন্তু একজন মহিলার নাম সোনা ...আমাকে একটু ভাবতে হবে। হঠাৎ চারদিক থেকে সোনা নামের এই জেরা ...ডাক্তার তো বলেছেন, ভাবলে ব্রেণের ক্ষমতা বাড়ে, মাসল তো, শক্তি বাড়ে। ভাবা নিয়ে আরেকজন একটা কথা বলেছিলেন–কি একটা কর! তবে ডাক্তারের কথা অনুযায়ী আমি ভাবা প্র্যাকটিস করি আজকাল ।
আমি একটু গুছিয়ে সোনাকে নিয়ে গভীর ভাবে ভাবার জন্য বসার কায়দা বদলালাম! আমার শরীরিভাষা দেখে ডাক্তার তড়িঘড়ি উল্টো কথা বলে উঠলেন – দেখুন আপনি আর ভাববেন না, মানে ব্রেনে প্রেশার দেবেন না। রিল্যাক্স! I afraid, you are in a big trouble! প্লীজ ভাবা বন্ধ করুন!
এই কি? সাতদিন আগেই তো বললেন ভাবা প্র্যাকটিস করতে! বলেছিল কি? যাইহোক, বন্ধ করে দিলাম ভাবা, কে ওরকম একটা বোরিং জিনিস ভাবতে যাবে! আমার তো আবার বেশিক্ষণ ভাবলেই শরীর চুলকতো। চুলকে চুলকে রক্ত বেরিয়ে আসত একএক সময়। তবে বড্ড আরাম ছিল ঐ চুলকানিতে।
তো ভাবা বন্ধের সাথে সাথে সব বন্ধ। বাইরে বেরনো বন্ধ। ছাদে যাওয়া বন্ধ। মানে একা বেরনো বন্ধ। যদি বেরতে হয় কাজের মহিলার স্বামীকে নিয়ে বেরোতে হবে যাকে আমি চিনিই না, সে নাকি রোজ আমার জন্য নিপ নিয়ে আসত। এই তো ৫০০ মিটার হাঁটলেই মদের দোকান। হ্যাট! হ্যাট বলেই জানতে পারলাম আমার মদ খাওয়া বন্ধ। হায় হায়! কথা না শুনলে নাকি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার- গালভরা শব্দ – আরে বেসিক্যালি তো পাগলাগারদ। না না পাগলাগারদে তো পাগলরা যায়। আমি তো এখনও পুরো পাগল নই। ওষুধ ওষুধ খাও শিশির, নতুন ওষুধ দিয়েছেন ডাক্তারনি !
পরেরদিন আবার সেই পাগলের ডাক্তার। সাথে যে এল, সে সারাটা রাস্তা প্রায় একজন শিশুকে নিয়ে বাবা-মা যেভাবে রাস্তায় তদারকি করে, হার মেনে যাবে ওর উদ্বেগের কাছে, বাঁদিক দিয়ে হাঁটুন, এবার একটু ডানদিক, আরে এবার সোজা হাঁটুন, আবার আপনি দাঁড়িয়ে পড়লেন, আরে ড্রাইভারের পিছনে বসছেন কেন...এক চড় মারতে ইচ্ছে করল যখন ও আমার অচেনা প্যান্টটা টেনে তোলার চেষ্টা করল। রোগা হয়ে গেছি আমি জানি, আমার প্যান্ট একটু হাঁটলেই নীচের দিকে নামতে থাকে, আমি জানি, কিন্তু এই চোদনা জানে না আমি ব্যাপারটা উপভোগ করি। একটা অচেনা লোক আমার নেমে যাওয়া প্যান্ট তুলে ধরবে, তাও কিনা ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের ফুটপাতে। গাঁজাখোরদের মতো পাকানো চেহারা, টানা ৫০ বছর না গাঁজা না খেলে ঐ চেহারা হয় না।
নাম জিজ্ঞেস করতে উনি আকাশ থেকে পড়ে বললেন, আপনি আমার নাম ভুলে গেছেন!
তারপর বিরক্তিসহ উত্তর – ঘুনো খামড়াই। খামড়াই!
আরে এটা একটা নাম হলো, আচ্ছা ঠিক আছে পচা যদি নাম হতে পারে তাহলে ঘুনো তো বেশ ভালই, কিন্তু এটা একটা পদবী হলো, কামড়ে দেবে নাতো ? উনি দু'পা হাঁটার পর সবিনয়ে জানালেন উনি আমার কাজের মহিলা সাবিত্রির হাজবেন্ড! কি সাংঘাতিক, সাবিত্রির স্বামীর নাম কি ঘুনো, ছিল, ঘুণাক্ষরে?! এইরে আমাকে আবার শিব্রাম চক্কত্তিতে পেয়েছে। অর্পিতা এজন্যই ভাবতে বারণ করেছেন। আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম।
অর্পিতা আমার সামনে বা অর্পিতার সামনে আমি। ওনার হাতে একটা খাতায় খোলা দুটো পৃষ্ঠা অক্ষরের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। সামনে খোলা ল্যাপ্টপের আলোয় অর্পিতাকে ডাক্তার নয় নায়িকা মনে হচ্ছে। ডাক্তার একটু দেখতে শুনতে ভাল হলে শরীরের আগে মন ভাল হয়ে যায়, কিন্তু উনি একটু বাড়াবাড়ি টাইপ, প্রেমে পিছলে হাত পা ভাঙতে ইচ্ছে করে। না আর তাকানো যাচ্ছে না, কতদিন হলো আমি নারীসঙ্গ করি না- এক দুই তিন চার ... নাকি দুই, চার ছয় ...না ভাবা মানা। আমি ডাক্তার থেকে মুখ সরাই এঁটো আপেলে। স্টিব জোবস আপেলটাকে সাদা করে দিলেন কেন? ঐ আপেল তো লাল থাকার কথা, এঁটো আপেল থেকেই তো যাবতীয় উৎপাতের শুরু। ভারত থেকে কি সন্ন্যাস নিয়ে গেছিলেন, চুপিচুপি। আমেরিকায় ফিরে সারাদিন সিলিকন! উনি কি তারপর আর সেক্স করেননি?
- আপনি শিলং কবে গেছিলেন?
দৈব বাণীর মতো, অকস্মাৎ অর্পিতার প্রশ্ন! আমি চমকে উঠে, ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভাবার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বাঁ পা নামিয়ে ডান পা বাঁ পায়ের ওপর ওঠাতেই ওঁর মানবী উৎকণ্ঠা– ভাববেন না, একদম ভাববেন না, সাথে সাথে জবাব দিন। এটা রেপিড ফায়ার সেশন ।
-না। আমার ফায়ার ফেরত দিলাম!
এবার উনি ভাবছেন আর পেন্সিলটা ঠুকে যাচ্ছেন সাদা পৃষ্ঠায়। ওনার চোখ এখনো দুই উন্মুখ সাদা পাতার ওপর টানটান, যেন আমার জীবন লিখে রেখেছেন সাদা কালিতে, একবার ঝালিয়ে নিচ্ছেন মাত্র ।
আমার একটা 'না' বলে থেমে যাওয়াটা কেমন যেন অভদ্রতা মনে হলো, তাই – না, আমি শিলং কক্ষনো যাইনি। এটা আমার জীবনের আফসোস বলতে পারেন, যেভাবে আমি এখনও দার্জিলিং যাইনি আর কি! অথচ দেখুন সিকিম গেছি, কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, নরনারায়ণ পর্বত, মহাপ্রস্থানের রাস্তা, বসুধারা জলপ্রপাত, শুম্ভ–নিশুম্ভ, মানে যেখানে নকুল সহদেবের পতন...
বাড়ি ফিরে দেখি ভাই বসে আছে। ক্লান্ত, মাথায় চুল নেই বলে কতটা ক্লান্ত বোঝা যাচ্ছে না। ভাই বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছে। আমার এক উত্তর – a divorcee bachelor is very dangerously contagious to a happy family! ভাই টাকে হাত বুলিয়ে, তোর ডাক্তার আমার সাথে কাল রাতে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। যাই! মদ খাস না! তোর account এ পঞ্চাস হাজার টাকা ট্র্যান্সফার করেছি। মদ খাস না!
আমার ভাইয়ের নাম রাণা , কিন্তু আমি ডাকি থিও।
থিও দরজায় দাঁড়িয়ে বলল – সোনাকে এবাড়িতে আসতে মানা করে দিয়েছি ।
- আবার সোনা ?!?!
কে এই সোনা, একটু তদন্ত করতে হচ্ছে তো। সোনাকে এমনভাবে খেয়ে ফেলেছি যে একটু আঁশ বা কাঁটাও পড়ে নেই। ব্রেনে চাপ দেওয়া শুরু করলাম। বিদ্যুৎ চমকানো শুরু। মাথার ভিতর বর্ষার মেঘ। মেঘ যত কালো হচ্ছে বিদ্যুৎ তত ঝকঝকে। তারপর অন্ধকার স্থির হলো। আমি অস্থির, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। বসে পড়তেই সাবিত্রি, হাতে ওষুধ। অভ্যস্ত গলায় – নিন, ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
অর্পিতা আমাকে একটা প্রিন্ট আউট দিয়েছেন। সেটাতে পরপর অনেকগুলো নাম দেওয়া আছে। প্রতিদিন সকালে উঠে খবরের কাগজ পড়ার মতো হালকা মননিবেশে নামগুলো পড়তে হবে। কোনও নাম অচেনা ঠেকলে তার নীচে লাল কালির দাগ দিয়ে সাজাতে হবে নামটিকে! বাঃ খাসা কাজ! উনি আবার একটা ল্যাকপ্যাকে সস্তা কলম দিয়েছেন। বুড়ো আঙুলে বল ছুঁয়ে দেখলাম, ইয়েস লাল।
0 comments: